সিসিটিভি: একটি ছোট্টগল্প


লোকটা চুপ করেই ছিল। সাদা লিনেন প্যান্ট, নীল টি শার্ট, স্লিপার্স জুতো, হাতে সোনাটা ঘড়ি। চোখে চশমা নেই। চুল খুব পরিপাটি নয়, তবে আগোছালোও নয়। চুলে হালকা পাক ধরেছে। জুলফির ধারটা প্রায় সাদা।
তিনি বেশ মৃদু ভাবে বললেন, তোমাদের এমনটা মনে হচ্ছে কেন?
কফিশপটা ছোট। সবাই সবাইকে দেখতে পায়। সোফা দিয়ে ছোট ছোট ঘেরাটোপ করা। সোফার সামনে একটা করে কাচের টি টেবল। তাতে সুন্দর ফুলদানি। অজানা ফুল ঘাড় ঘুরিয়ে রয়েছে।
একজন বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, মানে?
বিস্মিত হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রতিবেশি টেবিল থেকে কেউ হঠাৎ আগ বাড়িয়ে আলোচনায় ঢুকে পড়লে অবাক হওয়া যায় বৈকি।
লোকটা বললেন, আমি আপনাদের আলোচনা মন দিয়ে শুনছি অনেকক্ষণ ধরে।
পাশের ঘেরাটোপে তিন জন বসেছিলেন। শুভঙ্কর—একজন সাংবাদিক। প্রমোদ—একজন স্কুল শিক্ষক। জয়—একজন কলেজের অধ্যাপক। প্রথম কথাটি বলেছিলেন শুভঙ্করই।
আমাদের ভাবনায় সমস্যাটা কোথায়? জানতে চাইলেন প্রমোদ।
লোকটা বললেন, কফিশপে এসব নিয়ে আলোচনা আমি করতে চাই না। একদিন আমার বাড়িতে আসুন আপনারা।
ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর কি কিছু লাগবে আপনার?
না, বিল দিয়ে দিন, বলে উঠে পড়ার আগে তিনটে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে গেলেন শুভঙ্করের হাতে।
শপের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলে কার্ডের দিকে নজর দিল তিন জন। তাতে লেখা—অনির্বাণ মুখার্জি, ১২ বি ফুলতলা রোড, কলকাতা ৩২। লোকটা কী করেন, কী পড়াশুনো করেছেন, যোগাযোগের ফোন নম্বর—কিছুই লেখা নেই। অদ্ভুত একটা ভিজিটিং কার্ড।
তিন জন পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
কোনও মানে হয় না। প্রমোদ বললেন।
জয় জানতে চাইলো, মানে?
মানে, ওর বাড়ি যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।
তিন জনই সায় দিল—নাহ, এভাবে কোথাও, কখনও যাওয়া অনুচিত।

খ।
পরের দিন শনিবার। আকাশ পরিষ্কার। শরৎকালের আকাশ। গাভীর মতো মেঘ চরছে আকাশে তবে সেই মেঘ দুগ্ধবতী নয়।
অনির্বাণবাবু তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, কে আসতে পারে আজ? সেদিনের কফিশপের চশমাপরা ছেলেটিই আসবে।
কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেল।
দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলেন, গেটের খাঁজে খবরের কাগজ গোঁজা আর ঠিক গেটের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে চশমাপরা ছেলেটা।
গুড মর্নিং, শুভঙ্কর বললেন।
সুপ্রভাত। দাঁড়ান, গেট খুলছি, বলে ভেতরের গেটটা প্রথমে খুললেন অনির্বাণবাবু।
সকালে এখানে গরম সিঙাড়া ভাজে দেখলাম, তাই আপনার জন্য কয়েক পিস নিয়ে এলাম, সিঙাড়া খেতে আপত্তি নেই তো? শুভঙ্কর জানতে চাইলেন।
মৃদু হেসে অনির্বাণবাবু বললেন, একেবারে অপরিচিত লোকের আনা জিনিস তো আমি খাই না শ্রী...
আমি শুভঙ্কর। শুভঙ্কর মজুমদার।
আসুন শুভঙ্করবাবু। আমার এই কুটিরে আপনাকে স্বাগত।
খবরের কাগজটা টেবিলের ওপরে রাখলেন ভদ্রলোক। ঠিক দুই গ্লাস জল খেলেন। তারপর নিজের বিছানায় পা মুড়ে বসে গায়ে একটা ফিনফিনে সাদা চাদর জড়িয়ে বললেন, আমি জানতাম আপনি আজ আসবেন।
সিঙাড়াটা তখনও হাতে ধরে রয়েছেন শুভঙ্করবাবু। মুখে খানিকটা বিস্ময়,  আপনি জানতেন আমি আসব?
হ্যাঁ, আপনাকেই আগে আসতে হতো।
এবার শুভঙ্করবাবু তাঁর সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে ফিরে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আরো দু জন ছিল। তারা নয় কেন?
অনির্বাণবাবু বললেন, সিঙাড়াগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখুন। চা খাবেন?
অপরিচিত কারো কাছে আমি চা খাই না, শুভঙ্করবাবু বললেন।
আপনি আমাকে নকল করছেন শুভঙ্করবাবু। বি ইয়োরসেলফ। মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।
আপনি এখনও আমার কথার জবাব দিলেন না।
দাঁড়ান, তার আগে চা-টা বসিয়ে দিই। আমার কোনও কাজের লোক নেই।
বিয়ে করেননি?
বৌকে কি কাজের লোক মনে করেন?
এমন আসতে পারে শুভঙ্করবাবু বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন।
রান্না, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার যাওয়া—সব আমাকেই করতে হয় বলে আমার ঘরে সব জিনিস দেখুন অল্প। আমরা তখনই সব অতিরিক্ত করি যখন আমাদের অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার সামর্থ্য থাকে।
শুভঙ্করবাবু এবার নিজের ফর্মে ফিরে এলেন। বললেন, সব ঠিক আছে কিন্তু আপনার সব একটু আমার অদ্ভুত ঠেকছে মশাই।
নির্বিকার মুখে মন্থরভাবে অনির্বাণবাবু বললেন, এর জন্য দায়ী সেট থিয়োরি।
সেট থিয়োরি? আলগা কৌতূহল জেগে উঠল শুভঙ্করবাবুর মুখে।
এটা এমন কিছু নয়, খুবই সিম্পল। আসলে জগৎ সম্বন্ধে আমাদের ধারনাগুলো ধীরে ধীরে এমন বাঁধাধরা হয়ে যায় যে তার বাইরে কোনও কিছু দেখলে তাকে অদ্ভুত মনে হয়। আমারও এমন মনে হত।
এখন আর হয় না বলছেন?
না।
একটা অবিশ্বাস ফুটে উঠল শুভঙ্করবাবুর চোখে।
অবিশ্বাস্য ঠেকছে তো? অস্বাভাবিক নয়। এটা একটা প্র্যাকটিস। এর জন্য একটু উদাসীনতা দরকার। আর কী দরকার জানেন?
কী? বেশ গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন শুভঙ্করবাবু।
সব কিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বন্ধ করা। অনির্বাণবাবু তার ইলেকট্রিক কেতলি থেকে কাচের কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন শুভঙ্করবাবুর দিকে।
পারফেক্ট টি বললে কম বলা হয়। যথাযথ চিনি, যথাযথ লিকার। দুধ নেই। দুধে বায়ুরোগ হয়।
আপনি কি সাইকোলজিস্ট? আপনার কার্ডে তো কিছুই লেখা ছিল না... আমতা আমতা করে শুভঙ্করবাবু জানতে চাইলেন।
না, আমি সাইকোলজিস্ট নই, আমি সাইকায়াট্রিস্ট। হেড স্রিঙ্কারও বলতে পারেন, এই বলে মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।
হেড স্রিঙ্কার কেন হতে যাবেন?
না, ইউরোপ, আমেরিকায় সাইকায়াট্রিস্টদের এই নামে ডাকার চল রয়েছে। যাইহোক, আপনি তো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াতে চেয়েছিলেন?
এই কথা শুনে শুভঙ্করবাবু নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ অনির্বাণবাবুর মুখের দিকে। সত্যিই তো তিনি কখনও সাংবাদিক হতে চাননি। হতে চেয়েছিলেন প্রফেসর। নামের আগে ডক্টর ডিগ্রি। শুধু প্রফেসর নয়, জনপ্রিয় প্রফেসর হতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হল কই। কয়েকবার নেট-সেট দিয়েও পেলেন না। তেমন যোগাযোগও ছিল না। কিন্তু এ সব কথা ইনি জানলেন কী করে। নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, আমি যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই না তা কি করে জানলেন?
না, তা হতে পারে না, আপনাকে যতটুকু স্টাডি করেছি তাতে এটুকু আমি নিশ্চিত, তবে সরি, আজ আমাকে এখন উঠতে হবে। পরে কখনও কথা হবে।
চেম্বারে যাবেন নাকি?
না, আমার কোনও চেম্বার নেই, তবে চেম্বারের বাইরেও প্রচুর পেশেন্ট থাকতে পারে। থাকতে পারে কেন বলছি, আছে।
তবে আমি কী করি তা তো আপনি বললেন না।
সেটা বলা আমার কাজ নয়, আমি মিসির আলি নই। তবে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনও কাজই করেন।
শুভঙ্করবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি সাংবাদিক। আরম্ভ কাগজে আমি ক্রাইম বিট-টা দেখি।
আরম্ভ এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বহুল প্রচারিত প্রথম সারির দৈনিক কাগজ। শুভঙ্করবাবুর বেতন কম করে ৪৫ হাজার টাকা।
আপনি যে এসেছিলেন, সে কথা আপনার বন্ধুদের বলবেন না। বেশ গাঢ় স্বরে বললেন ভদ্রলোক।
একটু অবাক হয়ে শুভঙ্করবাবু বললেন, কেন?
বললাম তো, বলবেন না। ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে তারা আপনার ভালো চায় না। এতটুকুই। এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু বলি, তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।
কী বলেছে তারা আমার নামে? আপনি কি সত্যিই এখন বেরবেন?
না, এখনই বেরব না, প্রথমে পেপার পড়ব। তারপর আরও কিছু কাজ আছে, সেগুলো সারবো, তারপর বেরবো। তবে এবার আপনাকে উঠতেই হবে। আর হ্যাঁ, সিঙাড়াগুলো রেখে যান। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। এখন খেতে পারি।

গ।
আজকের আরেকজন আসবেন। কে আসতে পারে? রবিবার সকালবেলা বিছানায় একই ভাবে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন অনির্বাণবাবু। তাদের ভাবনার সমস্যা কোথায় জানতে চেয়েছিল যে ছেলেটি সে আসবে। তাঁর যা বয়স তাতে করে এই তিন জনকে লোক না বলে ছেলেই বলতে পারেন। বেশি বয়সের কিছু সুবিধা রয়েছে।
কিছুক্ষুণ পরে প্রমোদ এসে ঢুকলো অনির্বাণবাবুর শোবার ঘরে। আগের দিন যেভাবে বসেছিলেন সাদা চাদর জড়িয়ে ঠিক সেইভাবে বিছানায় বসে রয়েছেন ভদ্রলোক। সামনের বেতের চেয়ারে শুভঙ্করের বদলে প্রমোদ। শুরুতেই প্রমোদ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্কুলে পড়ান।
কেউ কোনও তথ্য দিলে অনির্বাণবাবু নির্বিকারভাবে শোনেন। কোনও প্রত্যুত্তর করেন না। যেন তিনি সবই জানেন। নতুন করে কেন বলা।
প্রমোদবাবু শুরুতেই বললেন, আমাদের সেদিনের আলোচনায় আপনি দূর থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আমি এটা করে থাকি।
অন্যের কথা শোনাকে আড়িপাতা বলে আর আড়িপাতা অন্যায় তা কি জানেন না? প্রমোদ বেশ গড়গড় করে বলে যান।
না, ওটা আড়িপাতা ছিল না।
কেন?
কারণ আপনারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। আড়িপাতার সংজ্ঞা একটু আলাদা।
প্রমোদবাবু একটু দমে যান। তিনি এরপরে কী বলবেন মনে মনে সাজাতে থাকেন।
অনির্বাণবাবু এই ফাঁকে বললেন, আমি এরকমটা করে থাকি। তবে আড়ি  পাতি না। তা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এই বলে ইলেকট্রিক কেতলি থেকে চা ঢেলে প্রমোদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এই নিন বৈদ্যুতিন টি।
অনির্বাণবাবু চায়ে সামান্য চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি তো স্কুল শিক্ষক কিন্তু হতে তো চেয়েছিলেন কোনও মিডিয়া হাউসের বড় কর্তা।
এই কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন প্রমোদবাবু। এ তো এক্কেবারে ঠিক কথা। স্কুলে চাকরিতে ঢোকার আগে কম করে হলেও চোদ্দটা মিডিয়া হাউসে তিনি পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তার মধ্যে আরম্ভ পত্রিকায় তিন বার। প্রতিবারই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন কিন্তু ইন্টারভিউতে গিয়ে কেটে গেছে।
ইতস্তত করে প্রমোদবাবু বললেন, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
এ সব জানা খুব বড় কোনও ব্যাপার না। এই বলে আবার চায়ে চুমুক দিলেন অনির্বাণবাবু।
আপনি কি জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা করেন? প্রমোদবাবু এবার একটু রাগিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন ভদ্রলোককে।
আপনি আমাকে রাগিয়ে দিতে পারবেন না প্রমোদবাবু। এই মানবিক গুণগুলো আমি বহুকাল আগে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।
আপনি কি মহাপুরুষ নাকি? একই রকম উত্তেজিত প্রমোদবাবু।
না, সাধারণ মানুষ। আমার বাবা আমাকে মহাপুরুষ হওয়ার শিক্ষাও দেননি কখনও।
পেশা কী আপনার?
পেশা-টেশা কিছু নেই। লোককে স্টাডি করা আমার কাজ। আমি একজন হেড স্রিঙ্কার মানে সাইকায়াট্রিস্ট।
নিজেকে হেড স্রিঙ্কার বলতে সংকোচ হচ্ছে না আপনার?
বললাম যে, এই সব মানবিক গুণগুলো ছেড়ে বহুকাল আমি বেরিয়ে এসেছি।
খুব বড় মতলববাজরা আপনার মতো করে কথা বলে, তা কি জানেন? প্রমোদ ইচ্ছা করেই এই কড়া কড়া কথাগুলো বলছেন যাতে ভদ্রলোক সত্যিই রাগ, ক্রোধ, লোভ, মোহ, কাম, লজ্জা, এইসব বিষয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কিনা তা জানতে।
ঈষৎ শব্দ করে হাসলেন অনির্বাণবাবু। তাঁর হাতের চায়ের পেয়ালাটা কেঁপে উঠল তাতে করে। বিছানার এক পাশে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে গায়ের চাদরটা আরো একটু আঁটোসাটো করে জড়িয়ে বললেন, মতলব শব্দটির আভিধানিক অর্থ জানেন? জানলে বুঝতেন, সকলেই মতলববাজ। আপনি আমাকে ফেরেব্বাজ বলতে পারতেন। সকলে ফেরেব্বাজ হয় না।
ধীর, শান্ত গলা ভদ্রলোকের। তাতে রাগের লেশমাত্র নেই। কীভাবে সম্ভব এমনটা?
প্রমোদবাবু এবার কথা ঘুরিয়ে বললেন, কিন্তু সেদিন কফিশপে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছিলাম সেখানে ভুলটা কী ছিল?
আজকের মতো আপনার সময় শেষ প্রমোদবাবু। আমাকে একটু বেরতে হবে। পরে কখনও এলে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাবে।
প্রমোদবাবু একটু যেন অপমানিত বোধ করলেন। হাতের চা-টা নামিয়ে রেখে বললেন, বেশ, তাহলে আজ উঠি। কখনও এলে আবার কথা হবে কিন্তু আপনি এইভাবে উত্তর না দিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন না।
আমি কী করতে পারি আর কী পারি না সেটা আমাকেই ডিসাইড করতে দিলে ভালো হয়। ধন্যবাদ আসার জন্য। তবে আপনি যে এসেছিলেন সেটা আপনার বন্ধুদের না বলাই উত্তম।
এক চুমুকও চা না খেয়ে কাপ নামিয়ে রেখে বেগে বেরিয়ে গেলেন প্রমোদবাবু। তাঁকে যদি বলা হতো, আপনার আসার কথা বন্ধুদের বলবেন না, তাহলে তিনি হয়ত বলে দিতেন কিন্তু অনির্বাণবাবু যেভাবে নির্দেশটা দিয়েছেন তাতে তিনি আর বলবেন বলে মনে হয় না। কারণ এই নির্দেশের সঙ্গে আরো একটা কথা জুড়ে দিয়েছেন অনির্বাণবাবু। সেটা হল, আপনার বন্ধুরা কিন্তু আপনার মোটেও ভালো চান না। কারণ তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।
বিছানার উপর পেপারটা ছড়িয়ে বসে মন দিয়ে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে লাগলেন ভদ্রলোক।

ঘ।
বৃহষ্পতিবার মহালয়ার ছুটি। তৃতীয় বন্ধুটির দেখা নেই। তবে অনির্বাণবাবু জানেন, তিনি আসবেন। আর আজ, এই মহালয়ার দিনেই আসবেন।
একই ভাবে দু জন বসে রয়েছেন—বিছানায় সাদা চাদর গায়ে অনির্বাণবাবু আর তাঁর সামনের বেতের চেয়ারে অধ্যাপক জয়। জয় সরকার। সুন্দর পাঞ্জাবি আর জিন্স। চোখে বেশ বিনয়। হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে কোলের উপর রাখা। জয়বাবুর কপালটা একটু বড়।
অনির্বাণবাবুই কথা শুরু করলেন, কত দিন কিছু লেখেননি?
হ্যাঁ, অনেক দিন কোনও লেখা আসছে না। কিন্তু রোজ রাত বারোটার পর খাতাপেন নিয়ে বসি। জয়বাবু বেশ লাজুকভাবে বলে গেলেন।
আপনার স্ত্রী চান না আপনি লেখালিখি করুন। নারী আর স্ত্রীয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
ঠিক বলেছেন।
আপনার প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। এই যুগে হলে কলকাতাতেই তাঁর ভালো চিকিৎসা হতে পারত।
এবার একটু বিস্মিত হলেন জয়বাবু। তিনি যে নজরুলের কবিতা ভীষণ পছন্দ করেন আর কলেজে নজরুল পড়ান তা তো এই ভদ্রলোকের জানার কথা নয়। তাছাড়া, সবার কাছে তিনি জীবনানন্দের নামই বলেন। খুব ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া তাঁর যে প্রিয়তম কবি নজরুল তা কেউ জানে না।
অনির্বাণবাবু বলে চললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কী বলতে পারেন? তারপরও তাঁকে সেই দেশের জাতীয় কবি করার কোনও মানে ছিল? শামসুর রাহমান, আল মাহমুদরা ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় কবি বলে কিছু হয়? সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতটাই তো অন্য কবির লেখা।
ইচ্ছা করেই এই সব প্রসঙ্গ তুলে আনছেন অনির্বাণবাবু। আসলে তিনি এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনাই করতে চান না। এটা তাঁর একটা কায়দা। অন্তত অধ্যাপকদের জন্য বিশেষ কায়দা তো বটেই। তাঁরা কিছু ভারি ভারি বিষয় নিয়ে না কথা বলতে পারলে, ভাবতে পারলে মনে করেন সময়টা বেকার যাচ্ছে।
গম্ভীর হয়ে ভাবছেন জয়বাবু। হাতে বৈদ্যুতিন চায়ের পেয়ালা। কাচের পাত্রে মদের মতো রঙ।
আপনি কি চাননি কবি হতে, জয়বাবু? খুব বড় কবি। সব পত্র-পত্রিকাতে আপনার লেখা বেরবে। সম্বর্ধনা পাবেন। কবিতা পাঠের আসরে সভাপতির আসন উজ্জ্বল করে বসে থাকবেন।
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কখন মাথা নেড়ে ফেলেছেন খেয়াল করেননি জয়বাবু। চা-টা পাশে একধারে রেখে তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, ঠিকই বলেছেন অনির্বাণবাবু, আমি কবিই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিবারিক কারণে কবিতা লেখা ছাড়তে হয়েছিল এক সময়। নেট পাশ করার জন্য দু বছর লাগাতার পরিশ্রম করেছি। তখন শুধু কোন উপন্যাসে কোন কথাটি কে বলেছে, কোন কবিতার বই কত সালে কততম মুদ্রণ হয়েছে, কোন নাটকে কত নম্বর দৃশ্যে কী ঘটেছে—এই শুধু মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কবিতা তখন হারিয়ে যায়। আজও আমি তাকে খুঁজছি।
আপনি শ্রী গুপ্তর কাছে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন, তাও হল না।
এবার বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে জয়বাবু বললেন, আমার সম্পর্কে এতসব জানলেন কীভাবে বলুন তো?
আপনার গবেষণার বিষয় ছিল বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে নগর।
কী করব, কবিতা নিয়ে সুখময়বাবু কাজ করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই যেটা পাওয়া গেল তাই নিয়েই শুরু করলাম কাজ। কিন্তু আপনি কীভাবে...!
আপনাকে আজ উঠতে হবে জয়বাবু। অন্য কখনও এলে আবার কথা হবে। আমাকে একটু বেরতে হবে। তবে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।
আরেকটু সময় কথা বলা যায় না অনির্বাণবাবু? গলায় ভীষণ কাতরতা জয়বাবুর।
না, আজ আর নয়। আপনি আসুন। তবে আপনি যে এসেছিলেন তা যেন বাকি বন্ধুরা না জানে। কেননা তাঁরাও এসেছিলেন আর আপনার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ভীষণ কুৎসিত। যাইহোক, ভালো থাকবেন।
আমি আবার আসব।
জয়বাবু অনিচ্ছুকভাবে বেরিয়ে যেতেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। আজকের মহালয়া। পরের দিন কাগজ বন্ধ থাকবে। একটা কাগজে দু দিন চালাতে হবে।

ঙ।
সেই কফিশপে তিন বন্ধু বসে এস্প্রেসোর অর্ডার দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। অন্য দিন শুভঙ্করই প্রথম নানা বিষয় উত্থাপন করে। আজ তার মুখ বন্ধ। আবহাওয়া নিয়েই কথা শুরু করা ছাড়া উপায় নেই যেন।
কালো কফি এস্প্রেসো এলো।
তিন বন্ধু মুখ বুজে কফি পান করে চলেছে। তাদের চোখ পাশের ঘেরাটোপগুলোর দিকে ঘোরাফেরা করছে। কাউকে যেন খুঁজে চলেছে তিন জোড়া চোখ। কিন্তু আজ কফিশপ বেশ ফাঁকা। এক জোড়া তরুণ-তরুণী একে অপরের নাকের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তাদের গায়ের পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে এসির বাতাসে।
প্রমোদই বললেন, কোনও মানে হয় না।
শুভঙ্কর বললেন, সত্যিই কোনও মানে হয় না এর।
জয় বললেন, কী ব্যাপার বলো তো?
ওই অনির্বাণ মুখার্জি না কে, তার বাড়িতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। এরকম অচেনা ফেরেব্বাজ লোকের অভাব আমাদের শহরে কম নেই। যে লোক আড়ি পাতে অন্যের আলোচনায় সে আর যাই হোক সুবিধের লোক নয়। তাও এমন একটা ভিজিটিং কার্ড যেখানে না আছে তার ডিগ্রি, না আছে তার প্রফেশন। আজব। এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন প্রমোদ।
জয় বললেন, ঠিক কথা। এই রকম আনকেনি লোকের খপ্পরে না পড়াই ভালো।
শুভঙ্কর হঠাৎ বললেন, আমরা এক সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম, মনে আছে তোমাদের?
জয় বললেন, সে আর মনে থাকবে না? এই তো বছর খানেক আগের কথা।
ঠিক, বছর খানেকই হবে। সেখানেই আমাদের আলাপ। তার আগে কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতামও না। সূর্যতোরণ হোটেলের লবিতে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আলাপ।
প্রমোদ বললেন, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তখনও কেউ কাউকে ভালো ভাবে চিনিও না।
সবাই চুপ হয়ে গেলেন।
শুভঙ্কর নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে বললেন, আজও কি আমরা পরষ্পরকে ভালো ভাবে চিনি?
এই কথায় আড্ডা আরও শান্ত হয়ে গেল। সত্যিই কি তারা সবাই সবাইকে প্রকৃত চেনা বলতে যা বোঝায়, সেভাবে চেনে? তারা কি এত দিন শুধু বোকার মতো সময় কাটিয়ে এসেছে এক সঙ্গে? শুভঙ্কর যেদিন আরম্ভ পত্রিকায় প্রমোশন পেয়ে ক্রাইম বিটের হেড হল সেদিনের পার্টিতে বাকি দুই বন্ধুর মুখ কি একটু ফ্যাকাশে হয়ে ছিল? যেদিন জয় কলেজের বিভাগীয় প্রধান হল, সেদিন শুভঙ্কর, প্রমোদের মনের অবস্থা কেমন ছিল? সাহিত্য পত্রিকায় যখন প্রমোদের গুচ্ছ কবিতা বেরিয়েছিল, তখন? সবাই মনে করার চেষ্টা করে, কোথাও কি কোনও সমস্যা রয়ে গিয়েছে?
সেদিনের আড্ডা জমল না। কফির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিন বন্ধু। শুভঙ্কর যাবেন এক মন্ত্রীর আমলার বাড়িতে, কিন্তু বললেন, শরীর ভালো নেই, বাড়ি চলে যাবেন রেস্ট নিতে। প্রমোদের যাওয়ার কথা সুকান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের বাড়ি, অথচ অক্লেশে বললেন, তাঁর একটু কেনাকাটা আছে, বাজারে যাবেন। প্রমোদ যাচ্ছেন ‘স্বদেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু বললেন যে মায়ের শরীর খারাপ, তাই তাকেও বাড়ি যেতে হবে।
প্রত্যেকে যে প্রত্যেককে সন্দেহ করছে তা তাদের চোখমুখ দেখে বোঝা যায়।
আরও দু জন তরুণ-তরুণী কফিশপে এসে ঢুকল। তারা বেরিয়ে পড়লেন।
অন্য দিন, পরের দেখা হওয়ার দিন ফিক্সড করে তারপর তারা বেরোন। আজ তারা ভুলে গেল সে কথা।
চুপচাপ তিন জন তিন জনের দিকে হাত তুলল শুধু।

চ।
পাঁচ দিন পর রেজিস্ট্রি ডাকে একটা চিঠি এসে পৌঁছলো শ্রী মুখার্জির বাড়ি। বালিগঞ্জের কোনও একটি এলাকার ঠিকানা উপরে লেখা। দুপুর বেলা। খুব নিস্তব্ধ চারধার।
চিঠি খুলে শ্রী মুখার্জি প্রথমে প্রেরকের নাম দেখলেন। পাঠিয়েছেন শ্রীমতী জয়া সরকার। চিঠির বয়ান খুবই সংক্ষিপ্ত। চিঠিটি এইরকম—
শ্রী অনির্বাণ মুখার্জি শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
আমি অধ্যাপক জয় সরকারের স্ত্রী। আপনার কথা আমার স্বামীর কাছে অনেক শুনেছি। আপনি একজন সাইকায়াট্রিস্ট। ভারি বিড়ম্ববনায় পড়ে আপনাকে চিঠি লিখছি। সমস্যাটা আমার স্বামীকে নিয়ে। চিঠিতে কিছু লিখতে চাই না। আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। অনুগ্রহ করে যদি একটু সময় দেন তাহলে বাধিত হব।
ইতি
জয়া সরকার
চিঠিটা পড়ে শ্রী মুখার্জি মৃদু মৃদু হাসলেন। কিন্তু তিনি তো মহিলাদের সঙ্গে পারতপক্ষে সাক্ষাৎ করেন না। মহিলাদের খুব সন্দেহের চোখে দেখেন। তারা অনেকেই ইকুয়ালিটির কথা বলেন, কিন্তু ইকুয়ালিটিতে তাদের বিশ্বাস নেই। এটা স্রেফ একটা ভড়ং। অধিকাংশ মহিলাই যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না। তাদের কোনও প্ল্যান ‘এ’ নেই। কিন্তু প্ল্যান এ-র ভান আছে। অনেক পুরুষ সম্বন্ধেও কথাগুলি খাটে।
দুপুরে আজ রান্নার জন্য জাপানি পুঁটি এনেছেন। জাপানি পুঁটি ভাজা আর ভাত। সঙ্গে একটু ঘি নেবেন।
ইলেকট্রিক কেতলিতে চায়ের জল বসিয়ে তিনি ভাবলেন, জয়া সরকারের সঙ্গে দেখা করা উচিত হবে কিনা। কেননা তিনি জানেন যে জয়বাবুর কী সমস্যা হতে পারে। জয়বাবু কলেজ যাওয়া বন্ধ রেখে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন না। কফিশপে যাওয়াও বন্ধ। মেজাজ খিটখিটে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাও অসম্ভব নয়।
চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে স্নানে গেলেন। আজ বেশ গরম। এই চিঠির কোনও উত্তর তিনি দেবেন না।

ছ।
গত পনেরো দিনের মধ্যে তিন বন্ধু আলাদা আলাদা ভাবে শ্রী মুখার্জির বাড়ি এসেছেন। একে অপরের প্রতি এত অভিযোগ জমা হয়েছিল তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। সুখের কথা, জয় সরকার বললেন, তিনি আবার কবিতা ফিরে পাচ্ছেন। দুঃখের কথা, তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে চান। আর কম্প্রোমাইজ ভালো লাগছে না তাঁর। প্রমোদবাবু বললেন, তিনি স্কুল ছেড়ে আবার মিডিয়া হাউসে ঢোকার চেষ্টা শুরু করেছেন। কোনও এক নিউজ পোর্টালে হয়ত একটা চাকরি হয়েও যাবে। শুভঙ্কর মজুমদার বলে গেলেন, যে তিনি আবার পড়াশুনো শুরু করেছেন। তাছাড়া তাঁর এখন অনেক যোগাযোগ। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি হয়ে যাবে। তারপর অপরাধজগৎকে বিদায় জানিয়ে কলেজে ঢুকে পড়বেন। একটা ভারি ফ্রেমের চশমার অর্ডারও দিয়েছেন।
জয়বাবুকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন শ্রী মুখার্জি, আপনারা তিন বন্ধু কি কখনও পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
খানিকটা অবাক হয়ে তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। মাউন্ট আবু।
আপনার কি মনে হয়নি, কেউ আপনাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে?
আসলে এমন কিছুই হয়নি। তিন জনই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কে আর কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে?
কিন্তু সম্মোহিতের মতো জয়বাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার একবার মনে হয়েছিল, কেউ যেন আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে চাইছে।
আপনি আর কখনও কফিশপে যাবেন না, শ্রী মুখার্জি বেশ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন জয়বাবুকে।
শুধু জয়বাবুকেই নয়, কফিশপে যেতে নিষেধ করেছেন বাকি দুই বন্ধুকেও।
এটা তাঁর একটা খেলা। এবং তিনি জানেন, এরা কেউই আর ওই কফিশপে কখনও যাবেন না।

জ।
একদিন সন্ধ্যাবেলা সেই কফিশপে ঢুকলেন শ্রী মুখার্জি। আজ বেশ ভিড়। গমগম করছে। ঘেরাটোপগুলো যেন উপচে পড়ছে। কফিশপের মালিক সম্বিত মিত্র তাঁর পরিচিত। তিনি কাউন্টারে বসেন না। ভেতরে এক ঘুপচি ঘরে তিনি বসে সিসিটিভিতে সব লক্ষ্য রাখেন।
আজ আর সোফায় না গিয়ে সরাসরি মিস্টার মিত্রের চেম্বারে প্রবেশ করলেন শ্রী মুখার্জি।
আসুন, আসুন—সম্ভাষণ জানালেন মিস্টার মিত্র।
কেমন আছেন?
ফাইন, অ্যাজ অলওয়েজ। আপনার খবর কী বলুন?
সব ঠিক আছে। আচ্ছা, যে তিন বন্ধু আপনার এখানে রোজ এসে আড্ডা দিত তাদের তো বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি না। কী ব্যাপার?
হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি, তারা আর আসছেন না।
আমার সঙ্গে একটা বেট করবেন?
আপনার সঙ্গে আগের বেট-এ হেরেছি। আর নয়। আমার ২৫ হাজার টাকা গচ্চা গেছে। না, আর আপনার সঙ্গে বেট নয়। বেলতলায় বারবার নয়।
এবারে কিন্তু আমি হেরেও যেতে পারি।
বলছেন?
হ্যাঁ, বলছি।
তা, কী বিষয়ে বেট বলুন তো?
ওই তিনটে ছেলে আর কখনও আসবে না আপনার কফিশপে।
ধুর, তা হয় নাকি? ওরা আমার পার্মানেন্ট ভিজিটর। তাছাড়া, আমার এই সস্তার কফিশপ ছাড়া এই শহরে আর আড্ডা দেবেটাই বা কোথায়?
তাহলে ধরুন বেট।
বেশ, রইলো বেট। এবার কত টাকার?
৪৫ হাজার।
আপনি কিন্তু এবার হারছেন। তা হারলে ভালই আমার আগের ২৫টা ফেরত পাবো।
হোক, আপনারই জয় হোক, বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে পড়লেন শ্রী মুখার্জি।

ঝ।
হাফ মাস পরে সম্বিত মিত্রের সঙ্গে দেখা করলেন শ্রী মুখার্জি। এই পনেরো দিনে রোজ কফিশপটায় গিয়েছেন ভদ্রলোক। একদিনও তিন বন্ধু আসেননি।
মিস্টার মিত্রের মুড খারাপ। আবার ৪৫ হাজার টাকা হারার দুঃখে বেশ মুহ্যমান।
শ্রী মুখার্জি সরাসরি কফিশপের ভেতরের ঘুপচি ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে বললেন, কী মিস্টার মিত্র, কোথায় আপনার পার্মানেন্ট ভিজিটর্স?
গালে হাত দিয়ে চুপ করে রয়েছেন কফিশপের মালিক। এবারের টাকাটা প্রায় হাফ লাখ। গায়ে লাগছে। তার চেয়ে গায়ে লাগছে বারবার হেরে যাওয়াটা।
খুব আলগা ভাবে বললেন, বসুন। কফি খেয়েছেন?
নাহ, আজ কফি খেতে আসিনি। আজ টাকাটা নিতে এসেছি। দিন আমার পাওনাগন্ডা।
সে আপনি পাবেন তো বটেই। সম্বিত মিত্রের কথার নড়চড় হয় না, সে আপনি ভালো মতোই জানেন।
মিস্টার মিত্রের সামনের ডেস্কের এপারের চেয়ারে বসে পড়লেন শ্রী মুখার্জি। তাঁর মুখে ঈষৎ হাসি খেলা করছে। তবে হাসিটা চাপার চেষ্টা করছেন। মুহ্যমান লোকের সামনে হাসতে নেই, তাতে তার যন্ত্রণা আরও বাড়ে। আত্মহত্যা করে ফেলাও অসম্ভব নয় এমন অবস্থায়।
বেল বাজিয়ে ওয়েটারকে ডাকলেন মিস্টার মিত্র। দু কাপ কফি দিতে বললেন। তারপর স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কীভাবে সম্ভব বলুন তো? পর পর দুবার আপনার প্রেডিকশন মিলে গেল। টাকা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার টাকা আপনি পেয়ে যাবেন। ক্যাশে নেবেন না চেকে নেবেন, বলুন। কিন্তু আজ আপনাকে বলতেই হবে এটা কীভাবে আপনি করেন।
মুচকি হেসে এবার শ্রী মুখার্জি বললেন, তার মানে এটাই আমার সঙ্গে আপনার শেষ বেট, তাই তো?
তা কেন হবে? আবার আমরা বেট করব পরে।
কিন্তু আমার ট্রেড সিক্রেট বলে দিলে তো ওই বাজির আর কোনও মানে থাকবে না।
আপনি তো একজন সাইকায়াট্রিস্ট। সেটাই তো আপনার ট্রেড। এসব আবার আপনার ট্রেড হল কবে থেকে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন মিস্টার মিত্র।
দেখুন মিত্রবাবু, আমার কাছে সবাই রোগী। না, একেবারে রোগী না হলেও আমার পর্যবেক্ষণের বিষয় মানে এলিমেন্ট। আপনিও কিন্তু তার বাইরে নন।
এই কথায় নড়েচড়ে বসলেন মিস্টার মিত্র, আমিও?
হ্যাঁ, আপনিও।
আপনি তো বেশ বিপজ্জনক লোক মশাই। যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক গুণ বেশি বিপজ্জনক,--এখন মিত্রবাবুর মুড অনেকটা হালকা হয়েছে। হাস্য সহকারে কথাগুলো বলে কফিতে চুমুক দিলেন।
আমার স্বীকার করতে কোনও অস্বস্তি নেই যে আমি লোকটা বেশ বিপজ্জনকই। তবে আজ থেকে আর আমি আপনার কাছে বিপজ্জনক থাকব না। বারবার একই লোককে হারাতে ভালো লাগে না।
এবার বেশ গুছিয়ে এসিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মিস্টার মিত্র বললেন, তাহলে বলুন, কীভাবে আপনি বলে দিলেন যে ওই তিন বন্ধু আর আমার কফিশপে আসবেন না?
ডেটা।
ডেটা? সে আবার কী?
সিম্পল স্টাডি আর ডেটা অ্যানালিসিস। আমি কেন যে কেউই পারবে। তবে ধৈর্য্য দরকার এর জন্য।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। একটু বিশদে ব্যাপারটা বলুন না,--উৎকণ্ঠা গলায় মিস্টার মিত্রের। তিনি জানতে উদগ্রীব।
শুনুন তাহলে। ওই তিন বন্ধু যে টেবিলে এসে রোজ বসত আমি ঠিক তার পাশের টেবিলে দিনের পর দিন এসে বসতাম। আপনি খেয়াল করেননি হয়ত। এটা খেয়াল করা সম্ভবও নয়। যাইহোক, তারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলত। সেই কথাগুলো আমি নোট নিতাম। সেখান থেকেই পেয়ে যাই তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় ডেটা। কে কী করেন, কী ভালোবাসেন, কার স্ত্রী কেমন, কার ছেলে পড়াশোনায় ভালো, কে কোথায় বাজার করেন, এমনকি তাদের কোমরের মাপও। এই রকম অজস্র তথ্য। আপনার এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে, তা দিয়ে আপনি সবার উপর নজর রাখেন। আমারও একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। আমি তা দিয়ে যার উপর চাই তার উপর নজর রাখতে পারি। যাইহোক, এরপর আমি একটা ভিজিটিং কার্ড বানাই। যে কার্ডটা আর পাঁচটা ভিজিটিং কার্ডের মতো নয়। এটা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল কৌতূহল জাগানো। গড়পড়তা জিনিস মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আর দৃষ্টি আকর্ষণ না করলে মনও আকর্ষণ করে না। আমি তারপর তাদেরকে আমার কার্ডটা দিই। আমি জানতাম সেটা তারা উপেক্ষা করতে পারবেন না। আমার বাড়িতে আসবেনই। এবং এটাও জানতাম তারা এক সঙ্গে আসবেন না কেননা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চরিত্র, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, সব ডেটা আমার হাতে। তারা এলেনও। একা একা। আলাদা আলাদা ভাবে। সেটাই ছিল আমার জন্য সুযোগ। আমি একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি তারপর। তারা যে আপনার কফিশপে আর আসছেন না সেটা আমিই তাদের মানা করেছিলাম।
আর তারা আপনার নিষেধ শুনলেন?
সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।
এটা কীভাবে সম্ভব হল?
কারণ ততদিনে তারা আমার হাতের মুঠোয়। আমি তাদের সম্পর্কে যা বলি সব মিলে যায়। এতে করে তারা আমাকে এক অলৌকিক মানুষ ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমার বলা কথাগুলো তো মিলবেই কেননা তাদের সব তথ্য তো আমার হাতের মুঠোয়।
কী কান্ড মশাই। এ তো দিন দুপুরে চুরি। মানে তথ্য চুরি,--মিস্টার মিত্র উত্তেজিত হয়ে চেকে সই করছেন।
চেকটা হাতে নিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, সিম্পলি এটা ডেটা চুরির গল্প। আর কিছু নয়।

জিয়া হক

রমাজানের একটি বিকল্প দুয়া


আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ও আমার আল্লাহ। তুমি প্রিয়।
তুমিই আমাকে প্রাণ দিয়েছো। মৃত্যু তুমিই আমাকে দেবে।
এই যে সজীব আমি ব্যবহার করে চলেছি বিবিধ
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ —সবই তোমার দেওয়া। যা খাই, যা পরি, যেখানে যাই —সবই তোমার। তুমি আমাকে নিয়ত প্রত্যক্ষ করো। আমার সব কথাই তুমি শোনো। যা ভাবি তা জানো।
তুমি ক্ষমা করো আমাকে।
প্রদত্ত দানের আমি অপচয়কারী। নিজেকে সেখানেও নিয়ে গিয়ে তুলেছি যে জায়গায় সীমালঙ্ঘনকারীরাই যায়। যা নিষিদ্ধ তাতে আমি অংশ নিয়েছি। অনুপুঙ্খ তুমি জানো।
পাপ গোপন নেই। সবই তোমার সম্মুখে।
এখন তোমার দয়া ছাড়া আমার আর কোনো আলো
অবশিষ্ট নেই। আমি নিজেই যেন একখণ্ড অন্ধকার।
ক্ষমা করো।
যে পথ সহজ, যে পথ সরল, যে পথ তোমার দিকেই শুধু
গেছে সেই পথ আমাকেও দাও।
আলো থেকে দূরে চলে যাওয়া যে কী যন্ত্রণা তা আমি
টের পাচ্ছি আল্লাহ।
মায়ের চেয়ে কত কত গুণ ভালোবাসো তুমি।
মা আমাকে ক্ষমা করে — তুমিও ক্ষমা করে দাও।
জান্নাতের বাসিন্দা কোরো।
আমার যা কিছু অশালীন, তুমি ধুয়ে দাও।
আমার সকল অভিপ্রায়কে ঠিক করে দিও।
তুমি যে আশ্রয় আমার, তুমি যে ঠিকানা।
ক্ষমা।

জিয়া হক 

আমরা যারা ছাদে উঠতে ভালোবাসি


আমি ছাদে উঠতে ভালোবাসি।
 ছাদে উঠলে নিজেকে দূর্গ রক্ষক মনে হয়।
কিন্তু ছাদ বানিয়ে দেয় আব্বা।
আমার তৈরি করা কোনো ছাদ নেই বলে বৃষ্টিতে
যেখানেই দাঁড়াই মনে হয় ভিজে যাচ্ছি।
আব্বা যখন ছোট ছিল তখন তালপাতার ঘরে
দুই ভাই এক বোন বর্ষাকালে ভিজত। সারারাত।
শুধু তারা নয়, সারা পাড়া জেগে বসে থাকত উবু হয়ে।
একে তারা কোনোমতে একটা ফিল্মি খেলা মনে
করতে পারত না। পাখি বলতে পেঁচা। তারই ডাক
শোনা যেত। বাদাম গাছে সে বসে থাকত।
বাদাম গাছ দেখলে তাই ভয় করত। তবে ভোরে
খালের জলে বাদাম ভাসত। যেন অপুষ্ট ভ্রূণ।
কঞ্চির ডগা দিয়ে পাড়ে তুলে আনা হত। বাদামের
ভেতরে ছোট বাদামের সাদা আত্মা। সুস্বাদু।
এখানে অগ্রজদের কবর। কবরের উপর বাঁশের বাগান।
এই বাগানে জুতো পরে যাওয়া নিষেধ। এটুকুই শ্রদ্ধা।
কেউ কখনও ভাবেনি আমার আব্বা সারাজীবনে
ছয়তলা বাড়ি বানাবে। ঘর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবে।
পরামর্শদাতা হবে। জলের প্রতিপক্ষ হবে।
আমি মাইলোভুট্টার উপকথা শুনেছি, কখনও দেখিনি।
ভাত কোথায় সবদিন। দুধ কোথায়। ছিল বার্লি আর
মাইলোভুট্টার ছাতু। এগুলো গল্প হয়ে গেছে কাটাপোনা
আর ব্রকোলির পাশে।
এ আমারই গল্প, অথচ এ আমার একার গল্প নয়।
আমাকে কেউ নক্ষত্র দেখাতে বসেনি। কুমার শানু শুনেছি।
মনে হয়েছে, কুমার শানুর চেয়ে বড় নক্ষত্র আর কে আছে?
আব্বা বলত, পড়াশোনাই তোমাদের ব্যবসা।
পুঁজি বলতে বর্ণপরিচয়, আদর্শলিপি, বিদ্যাসাগর।
কেউ জানে না দুপুরে কোথায় চলে যেতাম।
খুব হাওয়া হত দক্ষিণ দিক থেকে, পতঙ্গ উড়ত।
জেট বিমান বছরে একবার অন্তত যেত আমাদের
মাথার উপর দিয়ে, তার সাদা ধোঁয়ায় পথ পড়ত আকাশে।
আমি টের পেতাম, আমার মতো হুবহু কেউ কোনো
রাজার বাড়ি বড়ো হচ্ছে, হয়ত দ্বিতীয় আমি রাজার বাড়ির
আস্তাবলে শুয়ে ঘাসের বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ঘোড়াদের
বিনোদন করে আর তাকে ঘিরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে
নগরগর্দভ থেকে শিশুপ্রজা —সবাই।
বোম্বে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সে রোজ ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি পার্শ্বচরিত্রই হতে চেয়েছি তাই আমার কাহিনিতে
নায়কের মুখ ঢাকা থাকত কালো কাপড়ে।
সবাই বলে, নেতৃত্ব দাও, সব গুণ তোমার রয়েছে,
হিংসা ও ক্ষমা, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় —তুমি সবই পারো
তারা তো জানে না, আমি ঘুমোতে ভালবাসি আর
পক্ষ নিয়ে ফেলি, শত্রুভাবাপন্ন নই, জিতে গেলে
আমি দুঃখিত হই, হতাশা আসে, কান্না কান্না পায়
অযথা প্রস্তাবও তাই আমি বিবেচনা করে দেখি।
আমার মুখ মায়ের মতো, আমি ঠাকুরদার নকল,
নিজস্বতা আমার কিছু নেই, এইভাবে
বেঁচে থাকা সহজ কাজ নয়, কে বুঝবে?
রিহার্সাল ছাড়াই আমি মঞ্চে এসে পড়েছি ;
দর্শক মহোদয়গণ এই নটকে ক্ষমা করুন যেভাবে
কাকের আওয়াজ মেনেই নিয়েছেন, সেই ভাবে।
ছাদে যেতে এখন আমার নিজেকেই করুণা।
ওই নক্ষত্রভরা ছাদ আমি পেরিয়ে চলে যেতে চাই,
চাই সেখানে যেন দিঘার সমুদ্রের মতো কিছু থাকে
চাহিদা যার নেই সে গাছে ওঠে না, কুড়িয়ে নিয়ে আসে

জিয়া হক 

কৌরবদের কেউ ভালোবাসে না,


কৌরবদের কেউ ভালোবাসে না, যেমন আমাকে
বিকেলের দিকে যাদের নিঃসঙ্গ বোধ হয়
আমি তাদেরই একজন, কৃষ্ণ সবার থাকে না
জুলাইয়ের পর পর ইংরেজি মাসগুলো আসে
বৃষ্টির পর পর এসে যায় অন্য ঋতুগুলি
ঋতুমতী হয় গাছপালা, সহোদরা, গ্রাম্য বাজার
জবা আরও লাল আর কখনও হয় না, যেমন
কেউ বোঝে না কৌরবদের, আমাকে, দিল্লির ভাষা
ওষুধও এর নেই, সুতির ন্যাপকিন, দুই ভাঁজ, বেশি রক্ষণশীল
আক্রমণ করো, কাছে টানো, অপভাষা দাও —বুঝি
শরীরই খারাপ হয়ে থাকে, দোষারোপ করি না সেহেতু
ক্ষমাপত্র লিখে রাখি, বিতরণ হবে অবর্তমানে
দেখি লক্ষ্যভ্রষ্ট ছুরি কথা বলে ভদ্রলোক ও অর্জুনের সাথে
আমার সাইকেল খেয়ে নেয় মাটি,
সময় এগিয়ে আসে হত্যা করবে বলে, বলে রাখি
ধৃতরাষ্ট্র আমার কেউ নয়, প্রতিবন্ধী বলে তাকে মনেও হয়নি

জিয়া হক 

Gulzar on Kolkata, কেমন তাঁর কলকাতা?


অবহেলিত পদগুচ্ছ
গুলজার
.............................................................................................
কলকাতা

দেখেছো কখনও বহুতলে, কোনও সিড়ির নিচে যেখানে
বিদ্যুতের হিসাবরক্ষক মিটার বসানো—প্রাচীন জং ধরা-করা
পান খাওয়া ময়লা দাঁতের মতো এক খোলা কৌটোর নিচে
রাখা আছে কিছু ধাতব ফিউজ প্লেট, পুরনো বল্টুনাট, খুচরো পেরেক
এক কোণে আছে—কখনও খোলা হয়েছিল
অসংখ্য রঙের তারে জোড়া সিড়ির নিচে পোঁতা লোহার শলাকা
সুতো আর সুতোয় বাঁধা হোল্ডার থেকে ঝুলে আছে বাল্ব যে
হাসে হায়াহীন বদদুষ্ট বালকের মতো

প্রায়শই কেটে পড়ে তার, ফিউজও নিভে যেতে থাকে, অথচ
এ আলো চিরকেলে, অনন্ত উজ্জ্বল
কলকাতা এই, এই হল সংজ্ঞা কলকাতার
যেখানেই যাই হোক না কেন, জীবিত এ


জিয়া হক

জেনারেল ডায়েরি


রাত্রির ভাগ পরিমাণে বেশি হয়ে গেলে
এই পথে আর নয়, এই রেলপথে পদব্রজে
সাট্টাখোর, গুটখাপ্রেমিক, তরমুজ ব্যবসায়ী
বলে, —চোপ্, পকেট বানাও অকারণে?
ভিড় যে থাকে না তা নয়, তারা
দায় নিয়ে ঠেলাঠেলি করে
এই হল মানবসম্পদ, ভিখিরির গান শোনে,
উষ্মা জানায়, গরম করে তোলে গলার বাতাস —
অপভাষা দেয়
নিজেকে খুঁজেও পায় না এরা রাত্রি বেশি হলে
বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের যে ভাঙা পথ অটোতে উঠেছে
নিরাপদ, টুনি বাল্ব জ্বলে, পান সাজা হয়
খেয়াল করো না, এই ভিড় নিরস্ত্র নয় আর
তোমাকেও পেতে চায় একা

জিয়া হক

হেনস্থার পর, পরিচয় পর্ব


বাগানরক্ষক সেই খোকা
          বাগানেই মানা তার ঢোকা
ফুল তাকে টানে এরপরও
মালিক বলেছে, 'তুমি মরো'
যেইদিন চাঁদ যায়
     রাত্রি কালা ঘোর
বাগানের রক্ষাকারী খোকা
সম্ভবত বনে যায় চোর

বালক ভাবেনি কোনওভাবে
ফুলের মালিকই চাপকাবে
  কর্তৃপক্ষ ঘুমিয়েও জাগে
বালক জানেনি এর আগে

খোকাদের জ্ঞানের তালিকা
এত ছোট — হেসে ফেলে
    পর্দাবতী ছাত্রী, বালিকা

ফুলচোর আর অন্ধকার
  সবাই ঘুমিয়ে পড়ে,
            নেই কেউ মুখে বসিবার


জিয়া হক 

যাই তবে, এই মরে যাই, রাষ্ট্র বলে


মরে যাও, তুমি বলো, ট্রেন চলে যায় প্রবাসে, যাদবপুরে
কী ঘন ঘন ঘটা করে হতাশা চমকায়, পূব আকাশ পূর্বের মতো —কালো, খুনে, ঝমঝমপ্রবণ
সন্ধ্যাতারা কোনদিকে ওঠে, ভুলে গেছি, তাকিয়ে আছি
চিত্র-তারকারাজির দিকে, হতাশ ও হতভম্ব হয়ে
মরে যাও —শুনেছি তো, তবু ফের ফের বলো?
যারা সুখাদ্যের গল্প শোনে শুধু, রেডিও বাজায়, নিজে থেকে বাজে,
যারা এই আসছি বলে আসে না কখনও, মাছ ধরে ছেড়ে দেয় বাৎসল্যরসে, কেঁচোদের চলাফেরা শিল্পীর মতো করে দেখে,
 তারা কি প্রজনন জানে?
টিপে টিপে দেখে নাও বিবাহযোগ্য কারা, কারা মৃত, সাদা চোখ, গজদাঁত আছে
যদি আমি সোফা হয়ে যাই, শয্যা হিসেবে, খুশি হবে?
হবে, কেননা আমাকে কাটলে বড় ঘর্ঘর ঘর্ঘর হয়,
পোড়ানো সুন্দর, ছাই দিয়ে দাঁত মাজা যাবে, এককালে যেত

জিয়া হক

এই সব উল্টোপাল্টা শাহরুখ কিং খান


যার বিশেষায়িত জ্ঞাপন নেই, তার বাজারি অস্তিত্ব নেই। এই সরলমতি বাক্যবন্ধকেই নিয়তি ধরে বহুজাতিক সংস্থাগুলি বানাচ্ছে বিজ্ঞাপন-প্রকল্প। এটা কি ভিন্ন অর্থে 'পুশ সেলিং' নয়? কিন্তু বিপণন আধিকারিক এইভাবে বেচা-বাটার মধ্যে কোনও অনৈতিকতা দেখেন না। তাঁরও থাকে এক কর্তাপক্ষ। তিনিও কার্যত বিক্রিত। বিকৃত?  বিকারের প্রসঙ্গ এসে যায় কেন না এই জ্ঞাপন-প্রক্রিয়ায় 'অ-সত্য' বা তথ্য গোপনের মতো বিষয়গুলি থাকেই। ব্যাঙ্কের ঋণ সংক্রান্ত বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বা বীমার বিজ্ঞাপনক্ষেত্রগুলিতে সবচেয়ে জরুরি তথ্য সবচেয়ে দ্রুত পাঠ করা হয় কিংবা ছোটতম লিপিতে লেখা হয়ে থাকে। সংস্থাগুলি 'পোলিটিকালি ঠিক', তারা অবধ্য —অন্তত আইনি কুরুক্ষেত্রে। ভোক্তারাই ভোগে। আমাদের অনক্ষরতা, আমাদের অশিক্ষা এদের মূলধনের কিয়দংশ।
ছেলে ভুলানো ছড়ার মতো জনমন গলানো বিজ্ঞাপন যে আসলে একটি বড়তর চক্রের উপরিতল মাত্র —তা কারও অজ্ঞাত নয়। উষ্মা সেখানেই যখন একজন সাংস্কৃতিক তারকা তাঁর ভক্তকুলকে প্রতারিত করতে বিসর্গমাত্র ভাবেন না। ধরা যাক চিত্রতারকা শ্রী খান একটি ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে সুটোল হাসিতে জানাচ্ছেন, তাঁর 'বিশ্রী' থেকে 'শ্রীযুক্ত' এবং তাঁর সফলতায় ওই শ্রী-এর ইস্তেমাল কীভাবে তাঁকে আজ 'মহান' করে তুলেছে। এই কথাগুলো বলছেন কাদের? যারা তাঁকে ভালবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে, গ্রহণ করেছে, মান্যতা দিয়েছে। শ্রী খান কি জানেন না কী বিষয়ে কী কথা তিনি বলছেন বিপণন কর্মী চরিত্রে? চলচ্চিত্রে আমরা তাঁর খলনায়কোচিত রূপকে স্বীকার করে তাঁকে হিরোত্বে বরণ করে নিয়েছি। কিন্তু বিজ্ঞাপনে তো তিনি ব্যক্তিগতকে, সতত সততাকে বেচছেন । শ্রী খান, শ্রী কপুর, শ্রী সিং, শ্রী চট্টোপাধ্যায় —সবাই কি একই ক্ষমতার ভাষায় কথা বলছেন না? তাঁরা কি কার্যত দেশজোড়া অশিক্ষাকেই উপহাস করছেন না? লগ্নি / 'এনক্যাশ' করছেন না?  কাল্পনিকতা দিয়ে নিজেকে বৈধতা দিতে পারবেন কি বিজ্ঞাপনচিত্রে? প্রসঙ্গত কয়েকটি প্রশ্ন উপস্থিত হয়। শ্রম, অধ্যবসায়, মেধা নয় —সফলতা বহিরাঙ্গিক রূপ-নির্ভর। একটি শ্রীবর্ধক ক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, রূপ-বৃদ্ধি পুরুষটিকে হারেমের মালিক করে তুলেছে। নারীরা তার গুণমুগ্ধ কেন না তার ত্বক পূর্ববৎ 'নেটিভতা' হারিয়ে এখন উজ্জ্বল। জাতীয়তাবাদকে বিক্রি করছে কোনও সংস্থা। রাষ্ট্রপ্রীতিও পণ্য। এই পণ্যায়ন বিশেষ রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো-সম্মত। বেড়ালই এখানে ঘন্টা উৎপাদনের বিনিয়োগকারী। কে বাঁধে কী? কাকে?
চিন্তা অন্যত্র। এই কর্পোরেট বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলিতে যারা কর্মরত, যারা ভেবে চলেছে গণমন ভোলানোর করণ-কৌশল, ফিকির-ফন্দি —তারা কারা? মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবীরা। এই মেধা তো আত্মহন্তারক। অবক্ষয়ী। এই মেধা যে এক্সপ্লয়টেড মেধা তা এই মেধাবীরাও জানে। তাহলে? কী তাদের বিবেককে সংহত, সংযত রাখে? এর সঙ্গে কী বিধি-বদ্ধ আছে কোনও প্রতারণাময় অতীত যা তার প্রতারক সত্তাকে সেফ-গার্ড করে? নাকি কেবলই জীবনযুদ্ধ, মুদ্রারাক্ষস আর অস্তিত্বের সংকটের কাহানি? সমস্যা কি নিহিত আছে আমাদের শিক্ষাতন্ত্রে? শিক্ষাক্রম - শিক্ষক - শিক্ষণ : এই ত্রিবিধের যে বিজ্ঞাপন শিক্ষার্থী আশৈশব পেয়ে থাকে, 'ভূত' কি সেখানে? আমাদের শ্রেয়বোধ যত হ্রাস পাচ্ছে এই ভূতও কিন্তু তত মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে।
কবি শঙ্খ ঘোষ খেদোক্তি করেছিলেন, বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাচ্ছে মুখটাই। একুশ শতকের প্রথম দশকে মানুষ নিজেই হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপনের বর্ধিত অংশ। সে বিজ্ঞাপনের ভাষায় কথা বলে, বিজ্ঞাপিত স্বপ্নই এখন তার স্বপ্ন। বিজ্ঞাপনের অ-সত্য বা আধা-সত্যকে সে অনুমোদন দিয়েছে যেহেতু তার জীবনেও কম 'মিথ্যা' নেই।

জিয়া হক

একটি ফেক ভ্রমণ কাহিনি ও ইসলামোফোবিয়া


রাত্রি গভীর। হ্যাঁ, প্রায় সাড়ে ৭ ঘটিকা। ঘুরঘুটিল অন্ধকার। একটি মিষ্টি চাঁদ উঠেছে মেঘের দেউড়িতে। পুকুরের জলে ছায়া পড়েছে বটগাছের। ঠিক, এমন পুকুর দেখা যায় না বললেই চলে কেননা এই পুকুরপাড় ন্যাড়া। বাতাস আছে। দোপাটির পাতাগুলি দুলছে। আশ্চর্য এই পাড়া —কোথাও দোপাটি নেই! শুধু ইনকা গাঁদা আর বাজ ভেরেন্ডা। আমি চলেছি। একটি মৃত পশুখামারে যেতে চাই। দেখতে চাই কোথায় যায় সব মৃতেরা। চিড়িয়াখানায়? চিড়িয়াখানা ঘুরে কোথায় যায়? পচাই পান করা জাতি, শুঁটকি খাদ্য যাদের, তারা এখন যাহা পচনশীল তাহা নিয়েই সন্দিগ্ধ। টর্চে হ্যাজাকের আলো। সমস্যা হল, বহুদিন ব্যাটারি দিতে পারিনি টর্চটায়। পথে ধুলো নেই। মেটে রাস্তা। এমন চাঁদ, এমন চাঁদু, সঙ্গিনী থাকা বাঞ্ছনীয়। মেলে কই? বেসুরকার যে আপনি, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার গান্ধর্বী কই? এ পথ কার্যত শূন্য, যেমন ও যেভাবে এ পথিক। শূন্যতার কয়েকটি সুবিধা হল এই —
১. আপনি আপাতত আকাশ। সমার্থক। ফলত আপনি তারকাখচিত। উপভোগ করুন।
২. কেন এই শূন্যতা? ভাবতে বসলেন। এবার আপনি হলেন ভাবুক, চিন্তক, মায় দার্শনিক। এ কম কথা?
৩. আমি শূন্য, হ্যাঁ, আমিই শূন্য। এই বোধ আপনাকে পরিপূর্ণ রাখবে। 'আত্ম'-এর প্রতি প্রেম নিবেদন করতে অনুরোধ করবে। এটাই কি আংশিকভাবে সীমার মাঝে অসীমকে খুঁজে পাওয়া?
৪. যেহেতু আপনি শূন্য, সেহেতু ধরে নিতে হবে আপনি দুর্বল। দৌর্বল্য কি বিনীত করে? যদি করে —আপনাকে শুভেচ্ছা, ভাগ্য আপনার সহায়ক।


জিয়া হক

দেবতারা আশ্রয় তবে অনিশ্চিত ছাদ


এ গোরস্থান আমার প্রিয় নয়। এ দূরদেশী। অজ্ঞাত ঘাসের টিলা
দেবতারা এক অনিশ্চয় আশ্রয়। কেউ ভালোবাসে।
যেভাবে লোক যায় বাজারে, বিদ্যালয়ে, ঘোড়ার দৌড়ে
জানো কি বলে তারা তোমার সম্পর্কে — থাক, কিছু অপূর্ণতা
ছেড়ে দাও —হাল, সপত্নী, পরস্ত্রী, অনামা বালিকা
প্রস্রাব চেপে রাখা এখানেও সমীচীন নয়, জানো।
বলে ফেলো কে তোমাকে দীর্ঘতম বাঁশে স্থাপন করেছে
যা কিছু চমকপ্রদ বলে ভেবে বসে আছো, যা তোমাকে
নিয়ে যাবে পুরস্কারে, মগডালে, পানীয় টেবিলে, ভাবো
নির্বাচন করো, কোথায়, কোনখানে, পোঁতা হবে এই দেহ

জিয়া হক 

সর্বনামগুলো কুৎসিত আর প্রেমে অনিচ্ছুক


'আমি' — এই বিষয়ে বলবার কিছু নেই।
'তুমি'— এই বিষয়ে শোনবার কিছু আছে?
'তারা'— যতদূর জানি যুদ্ধে গিয়েছে —গৃহযুদ্ধে ঠিকই
'আমরা'— বুঝতে পারি না ভালোবাসব কাকে!
'তিনি'— সংগঠক, ঘন ঘন ঘর বদলান
'সে'— 'তিনি'কেই নমস্কার করে
                      জল তোলে, ঘর মুছে দেয়

জিয়া হক 

যিনি উন্মাদ তিনি অজ?


.......................
লবণের ঘোলা জলে
সারাটাদিন অহিংসারা চলে
সরিষা ক্ষেতের ভূত
যেন পলাতক বেঁটে রোগা দেবদূত
আমাদের কল্যাণে
সামাজিক সব তত্ত্ব বইয়ের সহায়িকা আর মানে
রেখেছেন লিখে ধীরে
এই সব কথা আলোচিত হয় দোকানের দুই তীরে
কেউ কি খেয়াল রাখে
বাবা ছাড়া আর কতজন তার ভালোবাসে প্রিয় মাকে
দরকার নেই, থাক
জলজিরা দিয়ে বরফ পুদিনা হবে আজ পরিপাক
খাবে?
বিদ্রোহ না করে রয়ে যাও তবে আমাদের সদ্ভাবে

জিয়া হক 

ফিরায়ো না রমণী বড়ো বা লাভ জিহাদ


.................................
এসেছো খোলাচুলে, এসেছো খোলাহাতে
এসেছো খাপ খোলা সালওয়ারে
আসেনি বিদ্যুৎ, আসেনি মাছডাল
আসেনি জ্ঞানট্যান মওলারে

নামাজি সন্ধ্যা, সূর্য সিজদায়
তোমাকে গ্রহণের নাপাক কাল
আমি কি মূর্খ, অল্প মুরতাদ
বিপ্রবর্ণীয় গো চণ্ডাল?

ঘরে তো উঠবে, তবুও মসজিদ
প্রশ্ন করবেই ফারিশতা
আমি কি জান্নাতি, পরহেজ বান্দা
ফলত তকলিফ এ রিস্তার

গুনাহে সম্মতি দিয়েছি কখনও কি
কেন এ মশিবত, এই বালা
নিরীহ তাবলিগ কর্মী কেন পায়
প্রেমের মসনদে কারবালা

তবুও লড়কি এসেছো ভিনদেশে
পেয়ালা উপচানো আমাকে নাও
আমরা পালাবো, পালাবো ওই জলে
যেখানে ভাসছে নূহের নাও

জিয়া হক

শূকর শূকরীকে চেনে কি এখনও?


বসিয়ে রাখো, আমাকে বসায়ে রাখো ও অনুকম্পায়ী বিল
আমাদের বধ্যভূমি, লাল রঙা ঝিল
সামনে দেখা যায়

দেহের শক্তি শুধু নিভে গেল কোষেদের অকাল পতনে
শূকর আমাকে চেনে যেহেতু রতনে
প্রেম করে, ভালোবাসে প্রায়

নিজেকে চিনিনি বলে দুধ খেতে গেছি বাঘিনীরও
'পান করো, পুষ্ট হও, পরিশিষ্টে হাড়খানি দিও '
বলে প্রাণী

এভাবেই ছোট হয়, মাল হয় এক হাজারি জীবনসম্পদ
নদীদের জুটে যায় পেশিযুক্ত এক লাখি নদ
সেরকম জানি

জিয়া হক

স্বজনের ভাষা বা কানাভাঙা পদ


আমি দূর সংযোগ করি যেভাবে প্রাকৃতিক বায়ু আসে
মনকে বলি, ভাষা শিক্ষা করো, পড়তে যেও না কারো মন
কথ্য বর্ণনাই সে বোঝে
শব্দভান্ডার তার মুখাপেক্ষী নয় অভিধানের
কারখানা এ, এ কল
আঙুল হেলানোই তার যথেষ্ট প্রাঞ্জল

রাত হয় রাত্রিকানার এই দেশে, আর
বলা যায় সন্ধ্যা শুভ হোক? কেননা
বক্তা কি আদৌ চেয়েছে এই জ্ঞান, যা
সৌজন্যে রয়েছে শুধু মুখে?

রহো একবার, থাকো, তিষ্ঠ এ বুকের বিপ্লব
অপদার্থ গন্ধগুলি তবু এ যে ঢপ
আমি জানি
পানীয় পেট্রোল বুঝি গতিশীল প্রাণী
আমাকে একবার
এনে দাও স্বজনের গালির সম্ভার
আমি দেখি
পরিবেশ কবিদের কতখানি করেছে একাকী



জিয়া হক 

বিপ্লবীর


তার কাজ নেই, স্বমেহন করবে কি?
ছাদের ওপর থেকে পৃথিবী দেখে সে বুঝেছে,
মাথার ওপরে নয়, পায়ের তলায় চায় অনেকেই ছাদ
অংশত বাদ —
এই রাম জন্মভূমি
সে, তারা, ওই, এই, আমি আর তুমি
ভালোবাসি রাম
যেভাবে শহরবাসী কফিশপে গ্রাম —
ভালোবাসে
সুপবন বয় আজ বাতাসে বাতাসে
ছাদ থেকে আমি দেখি রোজ
নবম শ্রেণির মেয়ে হয়েছে নিখোঁজ
নামতে পারি না, নেই সিঁড়ি
ঝাঁপ দেব —এমন বিচ্ছিরি
নাই শক্তি ভায়া
আমি কি বাঙালি নই? নই আমি আগাছা বেহায়া?
মেলা দেখি আমি আর বই পড়ে ছাদ
পরিশিষ্টে থাকে যারা সম্মেলনে বাদ —
এমনই হয়েছে

ছাই হতে তিন মিনিট, —আসুক দমকল
স্বমেহন আপাতত তোমার সম্বল

জিয়া হক 

স্নায়ুপতনের শব্দ


আমি কি লেখার কৌশলকানুন ভুলে যাচ্ছি? যদি তা না হবে তাহলে একটা অনুচ্ছেদও লিখতে পারছি না কেন? আমি কি সময় দিচ্ছি না, যতটা সময় দাবি করে লেখাজোখা? আমার কী হল? এ কি রোগ? এ রোগ কি না জানি না, তবে এ যন্ত্রণা। কিছু রোগের ওষুধ রয়েছে। কিছু কেন, এখন তো অধিকাংশ রোগ প্রতিহতযোগ্য। কিন্তু এমন যন্ত্রণার কি দাওয়া রয়েছে যা ঠিক রোগের নয়, যার প্রতিকারযোগ্যতা অ-প্রমাণিত। চিকিৎসার জন্য রোগ-নির্ণয় প্রয়োজন। কিন্তু এমন স্টেথোস্কোপ কোথায়, এমন প্যাথলজিকাল গবেষণাগার কোথায় যে লিখিত বা মৌখিক বিবৃতি দেবে রোগের বিষয়ে। আমি হতাশ হয়ে পড়ব? কিন্তু এও তো সত্যি, হতাশা মানেই তো সেখানে আশা নিহত হয়েছে। একটি নিহত ব্যাপারকে জাগানো কি সম্ভব? আমরা তো এখন ঈশ্বরের নয়, বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী। সে যা বলে তা-ই ধ্রুব। তা-ই সত্য। সে যা অস্বীকার করে তা বে-ঠিক। বিজ্ঞানকে পরীক্ষা করার বিজ্ঞান এখনও তো নেই। যদিও বিজ্ঞান এমন এক ক্লিনিকাল ল্যাব যা প্রমান-নিরপেক্ষ ভাবে বলে দেয় তিনি নেই। তিনিও নেমে আসেন না, নেমে এসে বলেন না—এই দেখো, ও হদ্দ বোকারা, আমি আছি আর তুমুল ভাবে আছি। আমাকে মেনে নাও নতুবা ওই দেখো লাভা স্রোত, আগুনের কুণ্ড। দেখো, তোমাদের পূর্বপ্রজন্মের মরণোত্তর দিনকাল। ওই সুদৃশ্য নহরের সুরামিশ্রিত মধু পান করছেন যিনি তিনি কি তোমার প্রপিতামহের প্রপিতামহ নন? দেখো, দুজন হুর আর রম্ভা কাকে সেবা করছে। তিনি নির্বিকার। তাঁর স্ব-প্রমানের গরজ নেই। তিনি সেই উদাসীন পেন্টার যিনি নিভৃতে বসে এঁকে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ট শিল্পকলা এবং উদ্ভাবনের ও প্রকাশের কোনো তাড়া নেই বলে সংরক্ষণ না করেই সেই শিল্প শিশুর খেলনার মতো আমাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছেন আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি কেননা তাঁর সৃজনীসত্তা সৃষ্টির বিনিময়ে পন্টিয়াক গাড়ি চড়তে চায় না। শিশুরাই খেলনা বিগড়ে দেয়, যেভাবে আমরা খুলে ফেলছি পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে আর তাকে নাম দিয়েছি ‘আবিষ্কার’ আর আরও বিগড়ে দিতে দিতে চলেছি এই যাবতীয় মেকানিজমকে। তবে কি শিশুর কৌতূহলকে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে এখানে? প্রশ্নকারীকে ডিমোরালাইজ করা হচ্ছে এখানে? আমার এক ছাত্রী ছিলেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন তখন। তাঁর প্রশ্নগুলি ছিল খুব জরুরি। উত্তরগুলিও আমার কিঞ্চিৎ জানা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, সেই উত্তরগুলো বোঝার জন্য তিনি বড় ছোট। তাঁকে তা বোঝানো যেত না। হয়ত তিনি বুঝেছিলেন একদিন। ‘আ’-এর উচ্চারণ ‘আ’-এর মতো কেন? ‘ক্রিয়া’কে আমরা ক্রিয়া বলি কেন? অসম্ভব সুন্দর সব প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর আমি যতবার দেওয়ার চেষ্টা করতে গেছি তিনি হাই তুলেছেন। আমার মনে হয়, প্রত্যেকের একটা মানসিক পরিণতির জায়গা থাকে। সব যেমন ব্যাখ্যেয় নয়, সব তেমনই বোধগম্য নাও হতে পারে। একটি মনুষ্যেতর প্রাণী, যেমন রুই মাছ, কি বুঝতে পারে মানুষের শ্রেণিগত বৈষম্য। এখন বলা যাবে যে, সে যে বোঝে না তার কি কোনও প্রমাণ মানুষের আছে? এ কথা কি বলা যাবে যে সে যদি বোঝে তার প্রমাণ তার আচরণে তা কখনও ধরা পড়েনি কেন? হয়ত বলা হবে, সেই প্রমাণের দায় তার নেই। এই দায় কি বিজ্ঞানের দায়? পৃথিবীর যেখানে যা আচম্বিতে পড়ে আছে তাকে উদ্ধার করে করে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা? আচম্বিতে কি কিছু পড়ে থাকে? ইগো এমন এক বস্তু সে অগম্যে পৌঁছতে চায়। অসম্ভবকে স্বীকার করতে তার ভারি লজ্জা। তার আহত হওয়ার ভয় ও সতর্কতা সব চাইতে বেশি। ইগোয়িস্টকে বলতেই পারবেন না যে, ‘আপনি এই বিষয়টি জানেন না।’ নিজের সামান্য অর্থক্ষয় সে মেনে নেবে কিন্তু জনসমক্ষে তার ‘অজ্ঞানী’ ইমেজটাকে সে কখনও মানতে পারবে না। অন্তত উপসংহারে সে বলবে, ‘বিষয়টা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবছি। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে জানাবো।’ হয়ত কেউ ভাবে, হয়ত কেউ ওই কথাকে সাময়িক পলায়নের ঢাল বানিয়ে তোলে। আমরা সব কিছুর উত্তরে যেতে চাই। শুধুমাত্র নিজের বোধ ও বুদ্ধির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাই। মানুষ রেগে যায় কেন? ইগো আক্রান্ত হলেই তার রাগ হয়। অহং বড় বিষম আর ছ্যাঁচড়া বস্তু। আবার এই অহং-ই মানুষকে আলাদা করেছে মনুষ্যেতরদের থেকে। যুক্তিবাদী হওয়ার চাইতে বড় লোভ খুব কমই আছে। অথচ যুক্তিবাদে পৌঁছনোর জন্য যে মানসিক কসরত তা করতে অনীহাও বড় কম নয়। তার ফলে আমরা এমন এক যৌক্তিক স্তরে হাজির হই যা দেখতে লাগে যুক্তির মতো, কিন্তু তা কার্যত অহং-সেবা। একে কি শিবসেবা বলা যাবে? জানি না। বিজ্ঞান তো শিবকে অস্বীকার করে। যেমন সে অস্বীকার করে নন্দী-ভৃঙ্গিকে। কৈলাস, রৌরবকে। আলমে বরজখ, আলমে আরওয়া, জাকুম বৃক্ষকে। মেটাফিজিক্স তাই খানিক একঘরে, ব্রাত্য। যেভাবে গড়ে উঠেছে দুই স্বতন্ত্র দল—ঈশ্বরবাদী বিজ্ঞানী ও নিরিশ্বরবাদী বিজ্ঞানী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখানেও জনতা নিজের বোধ-অনুভূতি নয়, একজন বিজ্ঞানীর নিদানের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্টিফেন হকিং যখন বলে দেন যে, নাহ, আফটার লাইফ বলে কিছু নেই। তখন এক শ্রেণি সান্ত্বনা পায়। যদিও হকিংবাবু তাঁর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতো এই নিরীশ্বরবাদী তত্ত্বকে গানিতিকভাবে প্রমাণ করেননি। কিন্তু ওই--তিনি মহান বিজ্ঞানী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞানী। কেউ ভেবেও দেখল না, শেষাবধি একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁরা জ্যোতিষী বানিয়ে তুললেন।

নর-নারীবাদ


ওড়নার নিচে তুমি বড় হয়ে গেলে, পর্দাপ্রথার নিচে নিচে
এসব অশ্লীল আর ইমেজের অনুকূল নয়
মূর্তিপুজো নামাজিও করে, যেহেতু এ ভাবমূর্তি
তাই স্বর্গ দূর নেই —এমত ধারণা
ধারণাই বনজ সম্পদ যা আনে সাপ ও ময়ূর
নিয়ে আসে হস্তশেক, মাঝের অঙ্গুলি
সম্পদ বললেই কেন মাথা নীচু করো? বক্ষসৌন্দর্য্য ছাড়া
কিছুই ভাবার আর ইহলোকে নেই?
বিক্রেতাই ঢেকে রাখে, প্রদর্শন করে—
বানিজ্যিক তুমিও কি কম, ‌ও লজ্জা, লাজুকশাস্ত্রী
                         পুং-মাংস নারী?

জিয়া হক 

ব্যবহার করো আমাকে


ওয়েদার বড় নিঝ্ঝুম আর বাতাসার মতো ঠান্ডা
আজকে সবাই ব্যস্ত তাই বীর্য পতন হয়নি
ভালোবাসা আর প্রস্তাব তবে
পাশাপাশি ছিল হোটেলেই

সবেবরাতের রাত্রি —সব বাতি বসিয়েছে কবরে
আর সন্তান যার পীড়িত তারা
হাত পেতে আছে মাদুরে

ঘন ঘন এই সন্ধ্যায় ডাকে কবুতর আর নেতৃ
ভালবাসা ওঠে বেলচায় তবে
বেলচা রুপোর তৈরি

যতবার তাকে প্রয়োজন তুমি প্রেম দাও তাকে ততবার
তবে পাঠকেরা সব ফ্রয়েডের
এক একজন দূর শিষ্য

বুরখা ওঠাও আজকে দেব প্রস্তাব তিন সন্ধির
লজ্জাবনত অস্থি যদিও
গানের জন্য প্রস্তুত?

কীভাবে তুমি যে উঠবে ওই পতিদেওতার বৃক্ষে
ধাতু ঝরে যায় চিন্তায় আর
চিন্তা বিছিয়ে ঘুম দিই

সেবাহীন যত বৃক্ষের ফল টক হয়ে যেতে বাধ্য
আর ট্রেন চেপে যারা বাড়ি যায়
টোকো আঙ্গুর কেনে না

জিমখানা জুড়ে উড়ছে আজ পরাজিত কিছু কাব্য
শিক্ষক খালি দেখে নেয় তার
ঘড়ি চলছে কি ঠিকঠাক?

ভালবাসা লাল সিম্বল, যত ছাত্রীরা পায় প্রায়শই
ব্যাখ্যাকারীর হজমিগুলি
শেষ হয়ে যায় সন্ধ্যায়

আমাকে একটি গানের মতো করতেই পারো ব্যবহার
পোকা ধরে গেলে মনটায়
অন করে দিয়ে রাখলে

জিয়া হক

মশহুর গুলাটির নেপথ্যে


মশহুর গুলাটি জিনিয়াস । শাহরুখ খান, করণ জোহররা যতই কপিল শর্মাকে বলুক, ইউ আর দ্য বেস্ট।
অথচ মশহুর গুলাটি যখন সুনীল গ্রোভার তখন তিনি ফ্লপ। তার নিজের মুখ যে কেন সবাই অপছন্দ করে, কে বলবে?
কাল্ট হয়ে ওঠা মশহুর গুলাটি শুধু একজন কমেডিয়ান নয়, তিনি একজন ভালো অভিনেতা, তা কে অস্বীকার করতে পারে?
দ্য কপিল শর্মা শো যে কার্যত দ্য গুলাটি শো হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে পেরেছিল স্বয়ং কপিল শর্মা। তাই কি অস্ট্রেলিয়াতে গন্ডগোল বাঁধে নিজেদের মধ্যে? একটা ঈর্ষার বাতাবরণ টের পাওয়া যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। সোনি কর্তৃপক্ষও গুলাটি নির্ভর হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। কপিল কি বোঝেনি তা? নিশ্চয়ই বুঝেছে। স্ক্রিন স্পেশ ও স্ক্রিন টাইম নিয়ে তাদের বৈরিতা যে কোনো সচেতন, সজাগ দর্শক মাত্রই খেয়াল করেছে নিশ্চয়ই।
কপিল শুধু মাত্র একজন আলাপক হয়ে, মানে ইন্টারভিউয়ার হয়ে আটকে গেল, অথচ তার উত্থান স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে। শর্মা তার প্রিয় কাজটাই মিস করতে শুরু করেছিল বলে বোধ হয়। তাছাড়া সমস্ত করতালি যখন গুলাটি কুড়িয়ে নিয়ে যায় তখন দুর্বল জোক মারা কপিল কি প্রমাদ গোনেন না?
কপিল ম্যাজিক হারিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে যে বেশি দায়ী সে হল কপিল নিজে। কমেডি নাইট উইথ কপিল হিট হওয়ার পর তার মধ্যে একধরনের মালিক ও স্বৈরাচারী সত্তা জেগে ওঠে যে মনে করে সে যা বলবে তাতেই লোক হল্লা করে উঠবে হেসে। অথচ কমেডি নাইটের কন্টেন্টই ছিল কিং, কপিলরা যোগ্য সঙ্গত করেছিল মাত্র। দ্য কপিল শর্মা শো তে কন্টেন্ট বড় স্থূল ও নড়বড়ে। শুধু মাত্র প্রতিভা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও অভিনয় গুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মশহুর।
সুনীল গ্রোভার অনেক অনেক পর এই স্টারডম পেয়েছেন। তার স্ট্রাগল পিরিয়ডটা দীর্ঘ দিনের। সেটা অনেকটা নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির মতোই। তা কি কেউ খেয়াল করেছে? 

নিয়তি, যুক্তিবাদ, সফোক্লিস, কী দরকার?


নিয়তিবাদীরা চুপ। খানিক কোণঠাসা। যুক্তিবাদ ও পরা-যুক্তিবাদীদের সুরমরমার পর্ব এ। যুক্তিবাদের মৌলধর্ম হল ব্যক্তিগত বোধগম্যতা ও তার সূক্ষ্মতা —জোর। যার 'বোধ' নেই —নির্বোধ —বা অবোধ —তার কোনো 'যুক্তি' নেই। ফলত নেই আত্মকে প্রতিষ্ঠার পীড়া। নিজেকে বা নিজের চিন্তাকে 'জাস্টিফাই' করা লজিকের অনেকের বিশেষত্বের একটি।
নিয়তি অব্যাখ্যেয়, এমনই ধারণা। নিয়তি একটি 'ব্লক'। যুক্তিবাদ তাই নিয়তিকে অ-নিরাপদ দূরত্বে রেখে সংশয়-সন্দেহের তর্কে দেখে নিয়মিত। গ্রিক নাটককার সোফোক্লিসও যুক্তিবাদ দিয়ে ঈদিপাসের নিয়তিকে বিখন্ডিত করতে পারেননি। বলা ভালো, করেননি। যদিও তিনিই ছিলেন গ্রিক নাটকে যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিত্ববাদের পুরোধা। ইসকাইলাসকে মনে রেখেও তা বলা যায়।
নিয়তিবাদের সর্বোচ্চ পাহারাদার স্বয়ং মৃত্যুই। যুক্তিবাদীতা মৃত্যুর কাছে এসে নত-তর্ক হয়। এখন প্রশ্ন হল, প্রকৃতিই কি নিয়তিবাদের সংগঠক? পৃষ্ঠপোষক? তাহলে বলতে হবে, প্রকৃতি নিজেই নিয়তির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিতে যেতে পারেনি। সেও নিয়তি-নির্দিষ্ট, বলিপ্রদত্ত।
পৃথিবীর সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই প্রায় এই অসহ নিয়তিকে মানুষ প্রজাতির সখ্যে উঠিয়ে আনতে সদাচেষ্ট। ধর্ম যেহেতু নিয়তির উপরে ঈশ্বরকে স্থাপনা দিয়েছে, নিয়তিরও নিয়তি হল ঈশ্বর, তাই নিয়তি কার্যত ধর্মের একটি নিয়ন্ত্রক 'টুল' বৈ আর কিছু নয়। ধর্ম কি নিজেকে নিয়তির নীতি-নির্ধারক হিসেবে প্রচার করেনি? তবে একটা শুভবোধ আছে। রয়েছে সহৃদয়তা — সমতাবিধানের অভিপ্রায়। 'কর্মফল' - এর প্রসঙ্গ আনা হয়। বলা হয়, এক্ষেত্রে মানুষই হতে পারে 'নিয়তি' নামক খেয়ালি ঘোড়ার নিয়ামক ; চালক। কেননা ধর্মগ্রন্থ যখনই বলে সৎ কর্মশীলদের মৃত্যুর যন্ত্রণা লাঘব হবে বা প্রায় শূন্য এবং সততা ও কর্মশীলতা যেহেতু মানুষের ইচ্ছাধীন সেহেতু প্রকারান্তরে নিয়তির উঠে যাবার সম্ভাব্য পথনির্দেশনা ও ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় মানুষকেই।
ধর্ম নাকি ভয় দেখায় ; ধর্মের ভিত্তিপাথর নাকি সন্ত্রাস! আসলে কথাগুলি খাটবে ধর্মট্রেডারদের সম্বন্ধে যেহেতু তারা ধর্মের ডিলারশিপ নিয়ে বসে আছে ও টেন্ডার ডেকে ধর্মকে বিক্রি করতে চায়। মৌল ধর্মে তাহলে কেন নরকের উল্লেখ? সেটা কি ভয়ের উপমা নয়? স্বাভাবিক প্রশ্ন। তবে, এক্ষেত্রে স্বীকার্য, নরক-যাত্রার যাবতীয় শর্তাবলীর সঙ্গে সম্বন্ধ ইহজাগতিক জীবন ও যাপনের ভালো-মন্দের। অর্থাৎ এই জাহান্নম কার্যত ইহজাগতিক সব অশুভ-এর প্রসারিত অংশ এবং ঐহিক ভারসমতার রক্ষাকবচ।
তাই কি? জানি না। তবে, রাষ্ট্রীয় আইন ও পেনাল কোড কি ভয় দেখায় না? তাহলে আমরাই তাকে নিজেদের ওপর অর্পণ করেছি কেন? 

প্রথম মুনাজাত



আমাকে ক্ষমা করো ও আল্লাহ আমার
অজ্ঞাতসারে আমি অবাধ্য এক
কুঁয়োয় পড়েছি, তুমি জানো।
জল ও অন্ধকার নিয়ে সে তো
প্রস্তুত ছিল,
         গ্রহণেরও অনেক অভিজ্ঞতা তার আছে
আমি যে বেমালুম পড়ে গেলুম ও আমার আল্লাহ

খালি আলোর দিনগুলো,
দিনের আলোদের কথা মনে পড়ে —
এটা শাস্তি, এটুকুই শান্তি এখানে
উপর ও নিচ এই মনে পড়াটুকুতেই আটকে রয়েছে
তুমি সবই জানো।
আফিয়াত দাও, ওই দরজাখানি খুলে রেখো
যেটা দিয়ে জান্নাত দেখা যায় আর তার বাতাস।
পৃথিবীর জানালাদের আমি এ-কারণেই
সমীহ করি, বর্ষাপর্বে ছাঁট ও ঝাপটা উপহার দেয়।
দূরের নক্ষত্রে দুপুরের স্কুল ছুটির ঘন্টা শুনব বলে
কান পেতে থাকি।
আমি কি ধরে নেব স্কুলখানি নেই? করণিক ভাতঘুমে
গেছে? ছুটিগুলি মৌখিক ঘোষণা?
মনোবিদ, নাক-কান-গলাবিদের কাছে যেতে হবে?
আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করো,
আমি পাতার লেফাফা ভেবে কুঁয়োয় পড়েছি,
তুমি জানো সবিশেষ তাই আফিয়াত দাও
সরু জল যেন কাদা করে না বসি
        ইত্যবসরে 

গগনেন্দ্র পাঠশালার ছাত্রী


গগনেন্দ্র পাঠশালা দূরে
দেখে যায় খোজা লোক, দেখে যায় শাকাশী কুকুরে
নেই তার ছাত্রই একখানি
ছিল এক রান্নাঘর আর এক অন্ধ কেরানি
বেতন আসত ছয় মাসে
পরিবার বার্লি খায়, শিশুরাই মুখ দিত ঘাসে
ঘাসে থাকে পোকা আর
ঘাসে ছিল পুস্তকের দানা
পুষ্টিতত্ত্বে নুন নেই
তবে কিন্তু মিটে যায়
রাত্রিকালীন ভোজখানা

গগনেন্দ্র পাঠশালা মায়ের মতোই ছিল একা
আমার যেটুকু বিদ্যা, তার সব ওখানেই শেখা
আমি চাই, আমাদের বড়ছোট মেয়ে
পুত্রদের পাশে বসে এমনই আপেল ধুয়ে খেয়ে
উঠে যাক আকাশে একদিন
যাকে আমি মা বলি, সম্পর্কে আমার বহিন
লতার মতোই তার গলা
বিজ্ঞান প্রেমিক তার, অথচ পড়েছে শিল্পকলা
কেউ কি দেখেছে তাকে ভিড়ে?
মহামানবেরা আট দিন ধরে
তাদেরই সাগরতীরে...
থাক এই কথা, সিনেমার কথা হোক
যারা ডুবে যায়, যারা গৃহে ভাসে
তারা কি যোগ্য লোক?
এমন প্রশ্ন তুলে আনে গবেষণা
সব উঠে আসে, সব তোলা হয়
কন্যাটিকে তুলেও আনে না


জিয়া হক


October : a story of every season : a film review ****


'যদি মরে যাই 
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই'

বিরাট পর্দার সামনে এই লাইনগুলো আমার কানে বাজছিল বার বার। রুটিনমাফিক সাজিয়ে দিতে পারি এইভাবে যে গল্পটা অমন ছিল, ক্যামেরা ছিল ব্যাপক, সাংঘাতিক এডিটিং আর অভিনয়টাও বেশ ভালো। সকলের দেখা উচিত। খেল খতম পয়সা হজম। ব্লা ব্লা ব্লা!
কিন্তু আবেশকে তো ওভাবে বলা যায় না। ভালোবাসা বিধৃত হয়না এত সরলে। বাবার মৃত্যু পিকুকে যেখানে ছেড়ে গিয়েছিল শিউলি হয়তো সেখান থেকে শুরু করে। ঘাসের ভেজা সবুজে আনমনা পড়ে থাকা বাংলার শিউলিগুচ্ছ আলতো হাতে তুলে নেয় শিউলি নামেরই আয়তচোখের এক মেয়ে; তার মুখে তখন নরম রোদ আর চারপাশে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ইনটার্নশিপ আর নিয়ম না-মানা,একটি শুভ ছেলে ড্যান। ছাদ থেকে হাত পিছলে পড়ে যাওয়ার আগে তার শেষ বাক্যটাও ছিল ওই ড্যানকে নিয়েই। 'হোয়ারিস ড্যান?' এরপর থেকে কাহিনি আর শিউলির থাকে না, পুরোটাই হয়ে ওঠে ড্যানের। শুধু কাহিনি নয়, শিউলির মা, শিউলির ভাই-বোন, শিউলির হসপিটালের বিছানা, নার্স, কেয়ার টেকার, একটা বর্ষাকাল, ডাক্তার, ওষুধ, তর্ক, আশাবাদ এমনকি শিউলির চোখ মেলাটাও ড্যানেরই হয়ে ওঠে। নিয়ম না-মানা, পথের উল্টো পানে হাঁটতে থাকা ড্যান যেন এতদিন এমনকিছুরই অপেক্ষায় ছিল। একটা খাঁটি উদ্দেশ্য যার জন্যে রাতের পর রাত জাগা যায়, কাজে পাহাড় প্রমান ফাঁকি দেওয়া যায়, মিথ্যে বলা যায়, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা যায় হিসেবহীন টাকা তবু আশা ছাড়া যায় না যে হসপিটাল বেডে এতগুলো মাস প্রায় ভেজিটেবল হয়ে থাকা শিউলি একদিন জাগবে না। প্রকৃত পুরুষ তো এরকমই। তার শুশ্রুষা লাগে না, ভালোবাসা লাগে না, একটা চুমুও লাগে না। তার লাগে একটা ছোট্ট উদ্দেশ্য যাতে সে প্রাণপাত করলেও করতে পারে। আমরা ওই পুরুষটার কথা ভুলে যাই যে শুধু হসপিটাল আর হোটেলে তার জীবন থামিয়ে রাখতে পারে। নিজের মায়ের কথাও তার মনে পড়ে না। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা (একটি সিঙ্গেল শটও বোধহয় রিপিট হয়নি এত অনাবিল সুন্দর, নির্ভার সেই ক্যামেরা) আর শান্তনু মৈত্রের সুর-করুণা সেই বিপ্রতীপে ড্যানের সাথে আমাদেরও কনস্ট্যান্ট দাঁড় করিয়ে রাখে। তবে অপেক্ষাতেই শেষ নয়, ড্যান কোনো এক শিউলি-সম্ভাবনার সাথে শেষাবধি নিশ্চয়ই থেকে যায়। সব ড্যানদের পক্ষেই তা সম্ভব শুধু আমরা বোধহয় তাদের সেই উদ্দেশ্যটা দিতে পারি না যা রাত্রি শেষে তাদের একেকজনকে এক অজানা সুগন্ধে রূপান্তরিত করতে পারে।
ছবি সমাপ্তিতে হলের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ছাড়ছিল না, পায়ে পায়ে জড়িয়ে নামছিল বাকি লাইনগুলো,

'যে ফুলের নেই কোনো ফল 
যে ফুলের গন্ধই সম্বল 
যে গন্ধের আয়ু একদিন 
উতরোল রাত্রে বিলীন 
যে রাত্রি তোমার দখলে 
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে 
আপন সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।'...

সুজিত সরকার এরকমই।💖

একা নায়ক, বোকা নায়ক


আজ
বৃষ্টি হল বেশ
ভেঙে গেল
ঘুমকাতুরে
ভিতর প্রদেশ
কাদা হল খুব
পায়ের সঙ্গীত হয়
চপ্পলেরা চুপ—
থাকে না কোথাও
বড় ভিজে
কুকুরের ভিক্ষাপাত্র
বেজে ওঠে ব্রিজে
প্রশাসক আজ
চোখ মারে, ফেলে রাখে
টেবিলের কাজ
সেহেতু মুশকিল
মরে যায় স্বাভাবিক
বৃহৎ টেবিল
বসে শোকসভা
জড়ো হয় চুরি করা
অহেতুক জবা
যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে ওঠে
গাঁদা গাছে গাঁদা নয়
জবা যেন ফোটে
এমনই নির্দেশ
আজ
তবে
বৃষ্টি
হল
বেশ

জিয়া হক 

যেভাবে পদ্য লেখা হয়


যখন আমি কবিতা —কবিতাই লিখতে চেয়েছি
তখন হারিয়ে গেল আমার শব্দবোধ
নিজেকে লিখতে গিয়েছি যখন
তখন পেলাম শব্দের পাহাড়
সেই পাহাড়ে গুহা আছে, বনদপ্তর নেই,
বনমানুষেরা চাকরি করতে যাবে তাই
ঝর্নায় চুল ধুতে গেছে

জিয়া হক 

আমার হরিণী-কন্যা, বনপথে একা


গৃহস্থের গ্রামজীবন আমি কাটাবো অনেক
কন্যা তুলতে যাবে ফুল আর জবার খুশবাই
সে যাকে অনুমতি দেবে সে-ই তার নদীতে প্রবেশ
পুলিশেরা বাড়িতে ঘুমোবে, থানা হবে খুকির সাজঘর
অথচ সে আর সাজাবে না তার ভুরু ও পল্লব
এমনি এমনিই সে হয়ে যাবে কারোর ঘরণী
সোনালি জেওর যত পড়ে থাকবে পাঠের টেবিলে
নাকফুল সে হয়ে ফুটবে উঠোনে, একদিন
জঙ্গলে সে যাবে একা, হবে সন্ধ্যা, বাঘও আসবে সেই পথে
কিছু কিছু মতবাদ তার জানা আছে, আর
শরণাপন্ন নয় সে সহিংস সংঘের, তাই
অরণ্য ঘোরাবে বাঘ প্রদর্শক হয়ে
আমার কন্যা তাকে বিবাহেও বেঁধে আনতে পারে
আমার কন্যা পারে দত্তক নিতে ওই ব্যাঘ্রশাবক
কাটাবো জীবন আমি গেরস্তের মতোই শহরে

জিয়া হক 

কেন ও কীভাবে বেলাল চৌধুরী? ও একটি পদ্য


বেলাল চৌধুরী কৃত্তিবাসী হয়েও স্বতন্ত্র। ভারতীয়  কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বাংলাদেশি প্রতিনিধি। তবে, সীমান্তরেখাকে অস্বীকার করাই কবির কাজ। তিনি তা করেছেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই সীমান্তহীন। যদিও তাঁর 'বিচিত্র' জীবনের চর্চা যতটা হয়, যেমনটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে, ততটা তাঁর কবিতা নিয়ে হয় কি? শক্তির কবিতা নিয়ে কিন্তু কম আলোচনা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গীয় একটি তথাকথিত সাহিত্য আন্দোলনের ভাষ্যে ব্যক্তি বেলাল চৌধুরী যে মর্যাদা পান, তাঁর কবিতা কি তা পায়? অন্তত ভারতে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে?

পুনশ্চ : তাঁর একটি 'বহুল পঠিত' কবিতা দেওয়া গেল।

জিয়া হক

কীটমানুষ এবং যা যা গাভীপনা


কীটমানুষ
..............
কীটনাশক এইখানে পড়িয়াছ‌ে কম
জঙ্গলের গাছে কেউ সার মারে নাকি
বাক্য দিয়ে আমি তাকে বুঝিতে সক্ষম
শস্যদের খাদ্য হওয়া
                     এখনও যে মাসাধিক বাকি

আমি তো পচনশীল, হাটে ও বাজারে
জঙ্গলের গাছে আহা সার কেউ মারে?

পরিচর্যাহীনভাবে আমি আছি দেখো
লক্ষ রাখি
               শস্য ধান্য কণা
গতরের ঠিক দাম আজও জানিনেকো
ফলত শ্রমের ক্রেতা
                    ধন্যবাদ-
সহ আট আনা
দেয়।  আজ সূর্য উঠল খুব
মুঘল যুগের যেন সেনা
পাখা থেকে হাওয়া পড়ে —টুপ
গ্রন্থপঞ্জি
            আমাকে জানবে না


জিয়া হক