আমি কি লেখার কৌশলকানুন ভুলে যাচ্ছি? যদি তা না হবে তাহলে একটা অনুচ্ছেদও লিখতে পারছি না কেন? আমি কি সময় দিচ্ছি না, যতটা সময় দাবি করে লেখাজোখা? আমার কী হল? এ কি রোগ? এ রোগ কি না জানি না, তবে এ যন্ত্রণা। কিছু রোগের ওষুধ রয়েছে। কিছু কেন, এখন তো অধিকাংশ রোগ প্রতিহতযোগ্য। কিন্তু এমন যন্ত্রণার কি দাওয়া রয়েছে যা ঠিক রোগের নয়, যার প্রতিকারযোগ্যতা অ-প্রমাণিত। চিকিৎসার জন্য রোগ-নির্ণয় প্রয়োজন। কিন্তু এমন স্টেথোস্কোপ কোথায়, এমন প্যাথলজিকাল গবেষণাগার কোথায় যে লিখিত বা মৌখিক বিবৃতি দেবে রোগের বিষয়ে। আমি হতাশ হয়ে পড়ব? কিন্তু এও তো সত্যি, হতাশা মানেই তো সেখানে আশা নিহত হয়েছে। একটি নিহত ব্যাপারকে জাগানো কি সম্ভব? আমরা তো এখন ঈশ্বরের নয়, বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী। সে যা বলে তা-ই ধ্রুব। তা-ই সত্য। সে যা অস্বীকার করে তা বে-ঠিক। বিজ্ঞানকে পরীক্ষা করার বিজ্ঞান এখনও তো নেই। যদিও বিজ্ঞান এমন এক ক্লিনিকাল ল্যাব যা প্রমান-নিরপেক্ষ ভাবে বলে দেয় তিনি নেই। তিনিও নেমে আসেন না, নেমে এসে বলেন না—এই দেখো, ও হদ্দ বোকারা, আমি আছি আর তুমুল ভাবে আছি। আমাকে মেনে নাও নতুবা ওই দেখো লাভা স্রোত, আগুনের কুণ্ড। দেখো, তোমাদের পূর্বপ্রজন্মের মরণোত্তর দিনকাল। ওই সুদৃশ্য নহরের সুরামিশ্রিত মধু পান করছেন যিনি তিনি কি তোমার প্রপিতামহের প্রপিতামহ নন? দেখো, দুজন হুর আর রম্ভা কাকে সেবা করছে। তিনি নির্বিকার। তাঁর স্ব-প্রমানের গরজ নেই। তিনি সেই উদাসীন পেন্টার যিনি নিভৃতে বসে এঁকে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ট শিল্পকলা এবং উদ্ভাবনের ও প্রকাশের কোনো তাড়া নেই বলে সংরক্ষণ না করেই সেই শিল্প শিশুর খেলনার মতো আমাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছেন আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি কেননা তাঁর সৃজনীসত্তা সৃষ্টির বিনিময়ে পন্টিয়াক গাড়ি চড়তে চায় না। শিশুরাই খেলনা বিগড়ে দেয়, যেভাবে আমরা খুলে ফেলছি পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে আর তাকে নাম দিয়েছি ‘আবিষ্কার’ আর আরও বিগড়ে দিতে দিতে চলেছি এই যাবতীয় মেকানিজমকে। তবে কি শিশুর কৌতূহলকে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে এখানে? প্রশ্নকারীকে ডিমোরালাইজ করা হচ্ছে এখানে? আমার এক ছাত্রী ছিলেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন তখন। তাঁর প্রশ্নগুলি ছিল খুব জরুরি। উত্তরগুলিও আমার কিঞ্চিৎ জানা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, সেই উত্তরগুলো বোঝার জন্য তিনি বড় ছোট। তাঁকে তা বোঝানো যেত না। হয়ত তিনি বুঝেছিলেন একদিন। ‘আ’-এর উচ্চারণ ‘আ’-এর মতো কেন? ‘ক্রিয়া’কে আমরা ক্রিয়া বলি কেন? অসম্ভব সুন্দর সব প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর আমি যতবার দেওয়ার চেষ্টা করতে গেছি তিনি হাই তুলেছেন। আমার মনে হয়, প্রত্যেকের একটা মানসিক পরিণতির জায়গা থাকে। সব যেমন ব্যাখ্যেয় নয়, সব তেমনই বোধগম্য নাও হতে পারে। একটি মনুষ্যেতর প্রাণী, যেমন রুই মাছ, কি বুঝতে পারে মানুষের শ্রেণিগত বৈষম্য। এখন বলা যাবে যে, সে যে বোঝে না তার কি কোনও প্রমাণ মানুষের আছে? এ কথা কি বলা যাবে যে সে যদি বোঝে তার প্রমাণ তার আচরণে তা কখনও ধরা পড়েনি কেন? হয়ত বলা হবে, সেই প্রমাণের দায় তার নেই। এই দায় কি বিজ্ঞানের দায়? পৃথিবীর যেখানে যা আচম্বিতে পড়ে আছে তাকে উদ্ধার করে করে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা? আচম্বিতে কি কিছু পড়ে থাকে? ইগো এমন এক বস্তু সে অগম্যে পৌঁছতে চায়। অসম্ভবকে স্বীকার করতে তার ভারি লজ্জা। তার আহত হওয়ার ভয় ও সতর্কতা সব চাইতে বেশি। ইগোয়িস্টকে বলতেই পারবেন না যে, ‘আপনি এই বিষয়টি জানেন না।’ নিজের সামান্য অর্থক্ষয় সে মেনে নেবে কিন্তু জনসমক্ষে তার ‘অজ্ঞানী’ ইমেজটাকে সে কখনও মানতে পারবে না। অন্তত উপসংহারে সে বলবে, ‘বিষয়টা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবছি। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে জানাবো।’ হয়ত কেউ ভাবে, হয়ত কেউ ওই কথাকে সাময়িক পলায়নের ঢাল বানিয়ে তোলে। আমরা সব কিছুর উত্তরে যেতে চাই। শুধুমাত্র নিজের বোধ ও বুদ্ধির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাই। মানুষ রেগে যায় কেন? ইগো আক্রান্ত হলেই তার রাগ হয়। অহং বড় বিষম আর ছ্যাঁচড়া বস্তু। আবার এই অহং-ই মানুষকে আলাদা করেছে মনুষ্যেতরদের থেকে। যুক্তিবাদী হওয়ার চাইতে বড় লোভ খুব কমই আছে। অথচ যুক্তিবাদে পৌঁছনোর জন্য যে মানসিক কসরত তা করতে অনীহাও বড় কম নয়। তার ফলে আমরা এমন এক যৌক্তিক স্তরে হাজির হই যা দেখতে লাগে যুক্তির মতো, কিন্তু তা কার্যত অহং-সেবা। একে কি শিবসেবা বলা যাবে? জানি না। বিজ্ঞান তো শিবকে অস্বীকার করে। যেমন সে অস্বীকার করে নন্দী-ভৃঙ্গিকে। কৈলাস, রৌরবকে। আলমে বরজখ, আলমে আরওয়া, জাকুম বৃক্ষকে। মেটাফিজিক্স তাই খানিক একঘরে, ব্রাত্য। যেভাবে গড়ে উঠেছে দুই স্বতন্ত্র দল—ঈশ্বরবাদী বিজ্ঞানী ও নিরিশ্বরবাদী বিজ্ঞানী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখানেও জনতা নিজের বোধ-অনুভূতি নয়, একজন বিজ্ঞানীর নিদানের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্টিফেন হকিং যখন বলে দেন যে, নাহ, আফটার লাইফ বলে কিছু নেই। তখন এক শ্রেণি সান্ত্বনা পায়। যদিও হকিংবাবু তাঁর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতো এই নিরীশ্বরবাদী তত্ত্বকে গানিতিকভাবে প্রমাণ করেননি। কিন্তু ওই--তিনি মহান বিজ্ঞানী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞানী। কেউ ভেবেও দেখল না, শেষাবধি একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁরা জ্যোতিষী বানিয়ে তুললেন।
স্নায়ুপতনের শব্দ
আমি কি লেখার কৌশলকানুন ভুলে যাচ্ছি? যদি তা না হবে তাহলে একটা অনুচ্ছেদও লিখতে পারছি না কেন? আমি কি সময় দিচ্ছি না, যতটা সময় দাবি করে লেখাজোখা? আমার কী হল? এ কি রোগ? এ রোগ কি না জানি না, তবে এ যন্ত্রণা। কিছু রোগের ওষুধ রয়েছে। কিছু কেন, এখন তো অধিকাংশ রোগ প্রতিহতযোগ্য। কিন্তু এমন যন্ত্রণার কি দাওয়া রয়েছে যা ঠিক রোগের নয়, যার প্রতিকারযোগ্যতা অ-প্রমাণিত। চিকিৎসার জন্য রোগ-নির্ণয় প্রয়োজন। কিন্তু এমন স্টেথোস্কোপ কোথায়, এমন প্যাথলজিকাল গবেষণাগার কোথায় যে লিখিত বা মৌখিক বিবৃতি দেবে রোগের বিষয়ে। আমি হতাশ হয়ে পড়ব? কিন্তু এও তো সত্যি, হতাশা মানেই তো সেখানে আশা নিহত হয়েছে। একটি নিহত ব্যাপারকে জাগানো কি সম্ভব? আমরা তো এখন ঈশ্বরের নয়, বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী। সে যা বলে তা-ই ধ্রুব। তা-ই সত্য। সে যা অস্বীকার করে তা বে-ঠিক। বিজ্ঞানকে পরীক্ষা করার বিজ্ঞান এখনও তো নেই। যদিও বিজ্ঞান এমন এক ক্লিনিকাল ল্যাব যা প্রমান-নিরপেক্ষ ভাবে বলে দেয় তিনি নেই। তিনিও নেমে আসেন না, নেমে এসে বলেন না—এই দেখো, ও হদ্দ বোকারা, আমি আছি আর তুমুল ভাবে আছি। আমাকে মেনে নাও নতুবা ওই দেখো লাভা স্রোত, আগুনের কুণ্ড। দেখো, তোমাদের পূর্বপ্রজন্মের মরণোত্তর দিনকাল। ওই সুদৃশ্য নহরের সুরামিশ্রিত মধু পান করছেন যিনি তিনি কি তোমার প্রপিতামহের প্রপিতামহ নন? দেখো, দুজন হুর আর রম্ভা কাকে সেবা করছে। তিনি নির্বিকার। তাঁর স্ব-প্রমানের গরজ নেই। তিনি সেই উদাসীন পেন্টার যিনি নিভৃতে বসে এঁকে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ট শিল্পকলা এবং উদ্ভাবনের ও প্রকাশের কোনো তাড়া নেই বলে সংরক্ষণ না করেই সেই শিল্প শিশুর খেলনার মতো আমাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছেন আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি কেননা তাঁর সৃজনীসত্তা সৃষ্টির বিনিময়ে পন্টিয়াক গাড়ি চড়তে চায় না। শিশুরাই খেলনা বিগড়ে দেয়, যেভাবে আমরা খুলে ফেলছি পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে আর তাকে নাম দিয়েছি ‘আবিষ্কার’ আর আরও বিগড়ে দিতে দিতে চলেছি এই যাবতীয় মেকানিজমকে। তবে কি শিশুর কৌতূহলকে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে এখানে? প্রশ্নকারীকে ডিমোরালাইজ করা হচ্ছে এখানে? আমার এক ছাত্রী ছিলেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন তখন। তাঁর প্রশ্নগুলি ছিল খুব জরুরি। উত্তরগুলিও আমার কিঞ্চিৎ জানা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, সেই উত্তরগুলো বোঝার জন্য তিনি বড় ছোট। তাঁকে তা বোঝানো যেত না। হয়ত তিনি বুঝেছিলেন একদিন। ‘আ’-এর উচ্চারণ ‘আ’-এর মতো কেন? ‘ক্রিয়া’কে আমরা ক্রিয়া বলি কেন? অসম্ভব সুন্দর সব প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর আমি যতবার দেওয়ার চেষ্টা করতে গেছি তিনি হাই তুলেছেন। আমার মনে হয়, প্রত্যেকের একটা মানসিক পরিণতির জায়গা থাকে। সব যেমন ব্যাখ্যেয় নয়, সব তেমনই বোধগম্য নাও হতে পারে। একটি মনুষ্যেতর প্রাণী, যেমন রুই মাছ, কি বুঝতে পারে মানুষের শ্রেণিগত বৈষম্য। এখন বলা যাবে যে, সে যে বোঝে না তার কি কোনও প্রমাণ মানুষের আছে? এ কথা কি বলা যাবে যে সে যদি বোঝে তার প্রমাণ তার আচরণে তা কখনও ধরা পড়েনি কেন? হয়ত বলা হবে, সেই প্রমাণের দায় তার নেই। এই দায় কি বিজ্ঞানের দায়? পৃথিবীর যেখানে যা আচম্বিতে পড়ে আছে তাকে উদ্ধার করে করে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা? আচম্বিতে কি কিছু পড়ে থাকে? ইগো এমন এক বস্তু সে অগম্যে পৌঁছতে চায়। অসম্ভবকে স্বীকার করতে তার ভারি লজ্জা। তার আহত হওয়ার ভয় ও সতর্কতা সব চাইতে বেশি। ইগোয়িস্টকে বলতেই পারবেন না যে, ‘আপনি এই বিষয়টি জানেন না।’ নিজের সামান্য অর্থক্ষয় সে মেনে নেবে কিন্তু জনসমক্ষে তার ‘অজ্ঞানী’ ইমেজটাকে সে কখনও মানতে পারবে না। অন্তত উপসংহারে সে বলবে, ‘বিষয়টা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবছি। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে জানাবো।’ হয়ত কেউ ভাবে, হয়ত কেউ ওই কথাকে সাময়িক পলায়নের ঢাল বানিয়ে তোলে। আমরা সব কিছুর উত্তরে যেতে চাই। শুধুমাত্র নিজের বোধ ও বুদ্ধির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাই। মানুষ রেগে যায় কেন? ইগো আক্রান্ত হলেই তার রাগ হয়। অহং বড় বিষম আর ছ্যাঁচড়া বস্তু। আবার এই অহং-ই মানুষকে আলাদা করেছে মনুষ্যেতরদের থেকে। যুক্তিবাদী হওয়ার চাইতে বড় লোভ খুব কমই আছে। অথচ যুক্তিবাদে পৌঁছনোর জন্য যে মানসিক কসরত তা করতে অনীহাও বড় কম নয়। তার ফলে আমরা এমন এক যৌক্তিক স্তরে হাজির হই যা দেখতে লাগে যুক্তির মতো, কিন্তু তা কার্যত অহং-সেবা। একে কি শিবসেবা বলা যাবে? জানি না। বিজ্ঞান তো শিবকে অস্বীকার করে। যেমন সে অস্বীকার করে নন্দী-ভৃঙ্গিকে। কৈলাস, রৌরবকে। আলমে বরজখ, আলমে আরওয়া, জাকুম বৃক্ষকে। মেটাফিজিক্স তাই খানিক একঘরে, ব্রাত্য। যেভাবে গড়ে উঠেছে দুই স্বতন্ত্র দল—ঈশ্বরবাদী বিজ্ঞানী ও নিরিশ্বরবাদী বিজ্ঞানী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখানেও জনতা নিজের বোধ-অনুভূতি নয়, একজন বিজ্ঞানীর নিদানের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্টিফেন হকিং যখন বলে দেন যে, নাহ, আফটার লাইফ বলে কিছু নেই। তখন এক শ্রেণি সান্ত্বনা পায়। যদিও হকিংবাবু তাঁর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতো এই নিরীশ্বরবাদী তত্ত্বকে গানিতিকভাবে প্রমাণ করেননি। কিন্তু ওই--তিনি মহান বিজ্ঞানী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞানী। কেউ ভেবেও দেখল না, শেষাবধি একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁরা জ্যোতিষী বানিয়ে তুললেন।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe