১
রাস্তাই এখন একমাত্র রাস্তা
ট্যাক্সির পেটের ভিতর থেকে দেখছি
জোনাকির মতো দপদপে পিছলে যাওয়া
আলোকিত জানলাদের, আর হাওয়ার ঝাপটা
আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিগত শতকে
এই হলুদ অ্যাম্বাস্যাডর ও তার বৃদ্ধ চালক
সারথির মতো, অথবা টাইম মেশিন –
শতবর্ষ আগের হুমায়ুন প্লেস অথবা লিন্ডসে থেকে
বালিগঞ্জের দিকে থ্রি-পিস স্যুট ও চুরুটে তরুণ
বিভ্রান্ত যাতায়াতে–একটা পৃথিবী শেষ হচ্ছে
আরেক নতুনের ঝাপসা অবয়বে সে বিমূঢ়
এলিয়ট ও নাগরিকতার চর্চার শেষে পড়ে আছে
ঔপনিবেশিক অন্ধকার।
এভাবে আমিও দেখছি কনফেটির মতো আলো
ছড়িয়ে পড়ছে সড়কের দু-পাশে। ফিরে যাচ্ছি।
অথচ বাসার কোটর আমার জন্য নয়,
বই-পাড়া, ঐতিহ্যের সদাগরি
মজ্জমান কলকাতা শহর ছেড়ে চলেছি
আশ্চর্য এই চার চাকার যানে।
২
শুধু একটা মূর্ছনার খোঁজে কবিতার কাছে আসা।
অর্কেস্ট্রা
অদৃশ্য কোনো কন্ডাকটরের হাতের ঈশারায়
বেজে চলেছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে
এক কোষী প্রাণের স্পন্দন থেকে জটিলতম বিবর্তনে
সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে পর্বতের ঢেউয়ের গঠনে
দাবানলে, ঘনঘোর মৌসুমি বর্ষায়
কিশোরের শিশ্নে প্রথম চলকে ওঠা উত্তেজনায়
কিশোরীর বুকের বোঁটার প্রথম শিহরণে
কবিদের কখনো না-লেখা সার্থক কবিতায়
সুর, মূর্ছনা, ছন্দ, স্পন্দন
বেজে চলেছে অনিবার।
শুধু এই মূর্ছনার খোঁজ দিতে পারলে
শয়তানের কাছে বন্ধক রাখা যেত আত্মাকে পাগানিনির মতো
অথবা সে সুরে পৌঁছলে, বসন্তের শেষ কৃত্যে
যেমন স্ট্রাভিনস্কি খেপিয়ে তোলেন সাধারণ্যের অভ্যস্ত কান
তাকে অবুঝ রাগে ধ্বংস করতে চায় সে জনতা
অসহনীয় তেমন সুন্দরের স্পর্শে শিউরে উঠি
মৃত্যুকেও সহজ মনে হয়।
৩
অথচ এর আভাসটুকু শুধু মধ্য চল্লিশে।
১৪৩১ সন–বাতাসে বিষ, ঘৃণার উত্তাপ;
পাহাড় জঙ্গল হিমবাহ–দালির ঘড়ির মতো,
ভয়ংকর বিকৃতিতে গলে পড়ছে,
সংবিধান ও সংহিতা চরম নাস্তিতে বিলীয়মান,
অটুট স্বাস্থ্যের বদলে প্রাত্যহিক ছন্দপতনে
শুকোচ্ছে আমের মুকুল। দরকচা দৈনন্দিনে
অপার্থিব ভিনাস শরীর সর্বস্বতায় সামান্য স্ট্রিপার
সাজে নীল পর্দার মেটাচ্ছে খোরাকি,
ধর্ষকাম লালা ঝরাচ্ছে হাজারো জিভ
সুফির ‘মস্তি’ আজ ভোগীর পুংদণ্ডে ঠেকেছে।
হায়, সুর ও সোমরস...
ইউনানি সাধনে শরীর ও মন,
মননের উজ্জ্বল স্ফুরণে নাগরিক হতে চেয়েছিল
আদর্শ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটা ইঁট গাঁথার শুরুতে
ভাব ও বস্তুর স্বরূপের খোঁজ;
সেখানেই সংগীত সেখানেই সংখ্যা,
আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়,
নীল ক্যাসিডির গাড়ি এসে থামে;
নাগরিক সংকীর্তন জ্যাজের আলাপে
বেজে ওঠে–হ্লাদিনী উন্মাদপারা
জাগরুক সে আজ মেটালের সুর বিস্তারে
পিনা বাউশ-এর পায়ের ছন্দে যেমন দেখেছি
আবির্ভূত হন নটরাজ,
যেমন বিচ্ছেদ ও প্রেমে দ্বান্দ্বিক যাতায়াত
প্রলয়ের মাঝে সুন্দরের প্রকাশ –
ত্রস্ত করে, প্রতি মুহূর্তে টানটান রাখে আমাদের৷
আমার জানলার নামানো কাচে
শহরের উচ্চতম বাড়ি পেরিয়ে, এখন
ঠিকরে উঠছে ‘নক্ষত্রের রাত’
হলুদ ট্যাক্সির চালক গুনগুন করে উঠল
বাবুল মোরা নৈহর ছুট যায়...
আমি তাকিয়ে দেখলাম আকাশের তারাগুলো
মরে যাচ্ছে একটা একটা করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe