love for zihaad or zihaad for love লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
love for zihaad or zihaad for love লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

First Death Experience : in memoriam of Afrazul


প্রথম মৃত্যু ও এক স্তন্যপায়ী শিশু
...........................
প্রথম মৃত্যু আর প্রথম মৃত্যুর স্মৃতি —পাঠ্যপুস্তক এতদিন যা শেখাতে চেয়েও পারেনি, অথবা শেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি —সেই জ্ঞান দিয়ে যায়। শিশুর সর্বপ্রাণবাদীতায় প্রথম জড়ের সংক্রমণ। আর এই জড় আদি থেকে জড় নয়, হঠাৎ-জড়।
শিশু তখনও স্মৃতিচারণ করতেও শেখে না। যা মনে আসে সেটা ভেসে আসা কুটো, ভাসিয়ে আনা নয়। স্মৃতিচারণ শিক্ষণীয়।
শিশু একটি নব্য প্রাণের টিলা আর সে যখন ঠিক তার বিপরীত অ-প্রাণ, নিষ্প্রাণতা দেখে তখন এক মনোজাগতিক সংঘাত হয়। এই 'সন্ত্রাস' - এর স্মৃতির স্থায়িত্ব পারত্রিকতার আগে অবধি।
খুব শিশুর কাছে মৃত্যু একটা ভিড়। মৃত্যু একটা সমাগম। একটা মেলার কম কিছু নয়। মৃত্যু - পরবর্তী আলোচনাসভা থেকে সে শেখে গৃহকর্তাদের ক্ষমতার, পদাধিকার, আধিপত্যের স্তর। কে বাদশাহ আর কে পারিষদ —সে আঁচ করে।
শিশু তখনও পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতির পূর্ণাঙ্গ অংশ। মৃত্যু তার কাছে প্রকৃতি প্রদত্ত এক রহস্য, আর সেই মিস্ট্রিকে, সেই মিস্টিককে হয়ত বুঝতে নয়, এমনিতেই প্রকৃতির চলনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। হয়ত সেদিন ঝিরি-বৃষ্টি হল, হয়ত সেদিন সূর্য ছায়াময় ছিল, হয়ত সেদিন সামান্য গতির বাতাসে কোনও বৃদ্ধ কলাগাছ ভেঙে পড়ে গিয়েছে —এই সব কিছু শিশু তার স্কিমা বা তথ্যাধারে জমা করে। হয়ত অচেতনেই। হয়ত অজ্ঞাতসারেই। মানুষের মৃত্যুকালীন এই প্রাকৃতিক চিহ্নগুলোকে সে অব্যবহিত পরে 'অ-মঙ্গল' - এর ধারনার আওতায় নিয়ে আসে।
শিশুরা তো পতঙ্গের মৃত্যু দেখে, সে হয়ত একটা ফড়িং বা ঝিঁঝিঁ পোকার ডানা কেটে দেয়, দলে দেয়। এরা দলিত। শিশুর কাছে গতিশীলকে স্থির করে দেওয়া একটা খেলা মাত্র তখন।  ফলত মৃত্যু একটি স্পোর্টস। নিজের যম বা আজরাইল হয়ে ওঠাই তখন তার প্রাইজ। এই মনুষ্যেতরদের মৃত্যু কার্যত প্রকৃতির বিপক্ষপাতিত্ব ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এর অনেক পরে এই আত্মক্ষয়ী বিপ্লবের প্রায়শ্চিত্তের ভান করতে তাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি করতে হবে। সে পরের কথা।
মৃত্যু কিশোরকে যাবতীয় 'রতি' র দিকে সরিয়ে আনতে পারে অথবা যাবতীয় থেকে তাকে 'রত' করতে পারে। মৃত ব্যক্তির জন্য মৃত্যু যেমন একটা স্থিতি-ফোর্স, তেমনই জীবিতকে সে গতি দিয়ে যায়। এই গতি তাকে শিয়ালদহ নিয়ে যাবে না, তবে উপাসনালয়ে নিয়ে যেতে পারে কিছুকে, কাউকে।
মৃত্যু শিশুকে মুগ্ধ করে, খানিক বিস্মিত করে, চঞ্চল করে ; কেননা মৃত্যু-সংক্রান্ত পরিবেশ, সে পারিবারিক আবার সামাজিক বা বিশেষ ব্যক্তিক যেটা শিশুর কাছে বৃহত্তর প্রকৃতির অংশ —তাকে অভিভূত করে।
এতদিন সে কেঁদেছে, বাবা মা শান্ত করিয়েছে ;
এখন, আজ বাবা মা কাঁদছে —এ দৃশ্য তাদের কাছে বিরল। সমস্যা হল, তারা জানে না কীভাবে এই বয়ঃপ্রাপ্ত কাঁদুনেদের শান্ত করতে হয়।
সে বড় জোর মৃত্যুর বিপ্রতীপ হিসেবে তাদের কোলে গিয়ে বসতে পারে।
রোহিঙ্গা শিশু, সিরীয় শিশু, ইরাকি শিশু কার কোলে গিয়ে সান্ত্বনা রাখবে?  তাদের অভিভাবকরাই কী জীবিত?  একটি শিশু কতবার শান্তি, সান্ত্বনা আর নিরাময়ের ঔষধ হয়ে উঠতে পারে? মৃত্যু কি সেখানে নৈমিত্তিক নয়? খেলনা হারিয়ে যাওয়ার মতোই কি আত্মীয় হারিয়ে যায় না তাদের? মৃত্যু কি তাদের কাছে আর আদৌ প্রাকৃতিক - দৈব - ঐশ্বরিক কোনও অ-ঘটন?  'দুর্ঘটনা'র ধারণা-শূন্য শৈশব তাদের কৈশোরের রাগ ও জঙ্গ-স্পৃহার ভিত্তি নির্মাণ করে দেয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শিশুর পৃথিবীর প্রতি প্রীতি-ভালবাসা আসবে কোন আকাশপথে? আকাশপথ তো সেখানে বিমানময়। আর সেই বৈমানিকেরা লজেন্স বৃষ্টি করে না। যে-শব্দ তার স্কিমা গঠনের সহায়ক হতে পারত, সেই শব্দ তার ভয়ের আয়োজন করে। উচ্চনাদ মানে মৃত্যু।
দুর্গার মৃত্যু-স্মৃতি অপু জীবনান্তেও ভোলেনি। স্মৃতিভ্রংশতা ভিন্ন এর উপশম নেই। আছে?
উল্লেখে রোহিঙ্গা বা পশ্চিম এশীয় একটি বিশেষ ধর্মীয় শিশুরা রয়েছে —এর অর্থ এই নয় যে, অন্যত্র সীমাহীন স্বস্তি। হিংসা তো মানুষের মজ্জাগত আর পরিকল্পিত সন্ত্রাস তো তারই নিরাবরণ প্রকাশ। প্রথম বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব বলে আলাদা কোনও উচ্চবচতা নেই —সকলেই প্রায় আক্রান্ত। প্রায় সবাই আক্রান্ত-সীমার ধারেকাছে ঘোরাফেরা করছে। ফলত কেউই নিরাপদ নয়। দুঃখজনক সত্য হল নিরাপত্তা বিষয়ে সাধারণ বিশ্ব যাদের মুখাপেক্ষী সেই রাষ্ট্রগুলিই 'আত্ম'রক্ষায় মগ্ন। 'আমার শিশু'র প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ, 'তোমার শিশু' শ্রেণিশত্রু। ফিলিস্তিনে তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বারুদ পাঠানো যায়, হাসপাতাল, প্রসূতিসদনে যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োগ করা যায়। পাঠক্রম শেখায় শিশুরা পবিত্র —ঈশ্বরের অংশ। আমরা ঈশ্বরের মুখে আগ্নেয় 'মানবতা' নিক্ষেপ করি। মোজেস, যীশু, মহম্মদ —যাঁরা অখন্ড মানুষের 'ধর্ম'পরিচয় দিয়েছেন, যে-ধর্মপরিচিতি এখন নীতিবর্জিত ও রাজনীতি-নিয়ন্ত্রিত —সেই মৌল ধর্ম আর তার ধর্ম প্রচারকেরা শিশুর সমার্থক এবং শিশুকে কেবল একটি বিশেষ্য নয়, বিশেষণ হিসেবে দেখেছেন, যা একাষেঁড়ে দৈত্যের বাগানে শৈত্যপ্রবাহ রুখে বসন্ত উপহার দিয়েছিল কোনও এক কালে ।


আমি এক নিরীহ দৈত্যকে চিনি। শুঁয়োপোকার মত, অ্যামিবার মতো নিরীহ এক দৈত্য। সে সবার ভেতরে লেপ টেনে ঘুমিয়ে আছে।  তাকে অকালে জাগিয়ে তোলা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। প্রতিটি রাবণ তাই অপারগ না হলে চায় না ওই ভাইকে জাগাতে যার নিদ্রাভঙ্গই কার্যত জীবনভঙ্গ। এই দৈত্য থ্যানাটস। সে কর্কট। সে মরণসংক্রান্তি। তাকে জাগাতে নেই। আরও একটা ব্ল্যাঙ্কেট তার জন্য এই শৈত্যদিনে বরাদ্দ হলে যাবতীয় জাগতিক সাম্য, প্রাণজ ভারসমতা থাকবে। আকাশপথ বেলুনের, ঘুড়ির, নীলাকাশের, মেঘের, বৃষ্টির —এই পথে কর্কশ কর্কট, বিপুল বৃশ্চিক নামিয়ে দেওয়া পশ্চিম এশিয় ভূ-দেহে। কুম্ভকর্ণদের ঘুমই প্রার্থনীয় । সে এতটাই নিরাপদ আর নিষ্ক্রিয় যে তাকে জাগাতে হলে অর্কেস্ট্রা দরকার হয়। সে এতটাই বধ্য, মৃত্যুপ্রবণ যে তার আকস্মিক জাগা-ই চিরকেলে ঘুম নির্দিষ্ট করে রেখেছে। প্রাচ্যের তৈলাক্ত অংশটির ঘুম সেদিনই ভেঙে যায়, অন্তত বৈশ্বিক রাজনৈতিক আলোচনায়, যেদিন ওই ফ্লুইড মিলল যে তরল ম্যাজিকল। যেমন মৃত্যু। মৃত্যু একটি যাদুক্ষমতা। কিন্তু এই যাদুর সাধনা সম্ভব নয় কেননা এ কোনো আঙুরফল নয়, আর সাধকও কোনো শেয়ালদেবতা নন।
—ধরে নাও কাল তোমার মৃত্যু। আজ কী কী করবে?
—প্রথম কথা,  আমি কিছুই ধরে নেব না।বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি আজরাইল?
—আমি আজরাইল হতে যাব কেন? আমি তো ফেরেশতা নই।
— তাহলে এত মৃত্যু মৃত্যু করছেন কেন?
—ফেরেশতারা কি মৃত্যু মৃত্যু করে?
—ওই যে ছেলেটিকে দেখছেন, ওকে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা নিজেকে হারিয়েছে।
—এসব রাখুন।  দেখুন চাওয়ালা কুকুরকে বিস্কুট ভেঙে খাওয়াচ্ছে।
এক মৃতের গল্প দিয়ে এই অসার লেখাটি শেষ করতে চাই আপাতত।  সেই লোকের নাম আলম বারি। তো,  মৃত্যুর দেবতা এসেছেন আলম বারির প্রাণ কব্জা করতে। আলম বারি পায়খানায় লুকিয়ে বসে আছে কেননা সে শুনেছে দেবতারা পবিত্র —মনুষ্য পায়খানায় নিশ্চয়ই তারা ঢুকবে না। তার ধারণা অমূলক ছিল না একেবারে। মওতের দেবতা বলল, বাবা আলম, তোমাকে যদি মৃত্যুর পর আরেকবার জান দেওয়া হয় তাহলে কি তুমি বেরিয়ে আসতে পারবে?
আলম ভিজে লুঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন করল, সেই জীবনে কি আবার আমাকে মরতে হবে?
দেবতা বলল, তা তো বটেই বাবা আলম।
—চাই না ও জীবন।
আলমকে যেতে হল পরলোকে। মৃত্যুর দেবতা দেবতাদের আড্ডায় কিছু একটা মুখে দিতে দিতে বলল,
—অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,  দুনিয়ায় সবাই আলম বারি। 

ভালবাসা
জিয়া হক