harsh mander লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
harsh mander লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

হলদোয়ানি সহিংসতা আসলে ইতিহাস মুছে ফেলার ছক: হর্ষ মন্দার

 



বিশেষ প্রতিবেদন

 

হর্ষ মন্দার। মানবাধিকার কর্মী। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নির্যাতিতদের প্রতি সংহতি জানাতে তিনি ‘কারওয়াঁ-এ-মহব্বত’ প্রচার শুরু করেছিলেন। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারিতে ঘটা হলদোয়ানি সহিংসতাকে তিনি “শরীরি নিগ্রহ ব্যতিরেকে মুসলিম আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন” করার প্রয়াস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে মন্দার সতর্ক করেছেন, ‘অখণ্ড ভারত’ নির্মাণের নামে গোটা ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ফিরে ফিরে আসতে পারে। মিডিয়ার একাংশসহ দক্ষিণপন্থীরা অখণ্ড ভারতের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ও এই ভাষ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে।

মন্দার বলেছেন, “এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, এটাই কি তার বহিঃপ্রকাশ? প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও হলদোয়ানি মেরুকরণের শিকার হয় রাজ্য সরকারের মদতে এবং এর ফলে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি পায়। তাই আমাদের বোঝা জরুরি, হলদোয়ানিতে ঠিক কী ঘটেছিল।”

উত্তরাখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা নৈনিতালে অবস্থিত হলদোয়ানি। এখানকার শাসক বিজেপির পুষ্কর সিং ধামি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ এলাকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গ্রাসে চলে গেছে। মন্দার উল্লেখ করেছেন, গেরুয়া দলের বর্তমান লক্ষ্য হল, গোরস্থানের মতো ধর্মীয় জায়গা, স্মৃতিস্তম্ভ বা ধ্বংসাবশেষকে মুছে ফেলা।

 

হলদোয়ানি সহিংসতা: ২০২৪

জবরদখলের অভিযোগে বনভুলপুরা জেলা প্রশাসন একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ঘটে। বিপুল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ১০০-র বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে মোতায়েন করা হয়েছিল। পাশাপাশি, বাড়িঘরগুলি যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন স্থানীয় হিন্দুরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। এর ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।

সরকারি নথি বলছে, পুলিশের সঙ্গে এই সংঘর্ষে ছয়জন মারা গেছে। এদের অধিকাংশই মুসলিম। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরও এই সহিংসতার বলি হয়েছে। এই অশান্তির পর জেলা প্রশাসন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় এবং সমস্ত স্কুল ও কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দুই দিন পর, পুলিশ ১৯ জন নামধারী ও ৫ হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী, কথিত মূলচক্রী আব্দুল মালিক-সহ ৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

১৭ ফেব্রুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও উঠে আসে। তাতে দেখা যায়, এফআইআরে উল্লেখিত মালিক-সহ ৯ ব্যক্তির বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করছে পুলিশ। এক জেলা দেওয়ানি আদালত অভিযুক্তদের সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দেয়। পুলিশ কর্মকর্তারা এক অভিযুক্তের বাড়ির দরজা চুরমার করে দিচ্ছে, এমন ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকে।

 

পরিকল্পিত সহিংসতা

কারওয়াঁ-এ-মহব্বত ও অন্যান্য অধিকার গোষ্ঠীর সহায়তায় অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস একটি সত্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের শিরোনাম ‘বুলডোজিং পিস: স্টেট ভায়োলেন্স অ্যান্ড অ্যাপাথি ইন মুসলিম সেটলমেন্টস অফ হলদোয়ানি’। এতে অভিযোগ তোলা হয়েছে, হলদোয়ানির সহিংসতা মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুদের উপর পরিকল্পিত ও নিশানাকৃত সহিংসতা। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার ও র‍্যাডিকল দক্ষিণপন্থী নাগরিক গোষ্ঠীগুলি মিলিতি ভাবে মারাত্মক মেরুকৃত ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এর মধ্যে বহু ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর বিষয় রয়েছে।

 

২০২২: অনুরূপ প্রচেষ্টা

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে হাইকোর্টের নির্দেশে রেলের জমি থেকে মানুষজনকে উৎখাত করার খবর পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত জমি বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের। এটাও ছিল হলদোয়ানির একই বনভুলপুরা এলাকায়। এই এলাকায় বসবাস করা হাজার হাজার বাসিন্দা রেলে জমি থেকে তাদের বাড়িঘর উপড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। পরিকল্পিত উচ্ছেদ অভিযানে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত এবং বলেছিল, একটা কার্যকরী সমাধান বের করতে হবে।

 

অন্যান্য নিশানাস্থল

চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে জবরদখল-বিরোধী অভিযানের নামে দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) আগাম নোটিশ ছাড়াই ৬০০ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নয়াদিল্লির মেহরাউলির আখন্দজি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ১২০০ সালের আগে। যাইহোক, ডিডিএ-র বক্তব্য অনুযায়ী, এই মসজিদ দাঁড়িয়েছিল জবরদখল করা জমিতে।

এই মসজিদের ইমাম জাকির হুসেনের মতে, ফজরের আজানের আগে গোটা ধ্বংসপ্রক্রিয়াটি ঘটেছিল। তাঁর অভিযোগ, মানুষের চোখের সামনে থেকে ধ্বংসযজ্ঞকে আড়াল করতে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, “ডিডিএ কর্মকর্তারা আমাকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেননি। কর্মকর্তারা জোর করে আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন যাতে ধ্বংস চলাকালে আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি।” পাশাপাশি তিনি যোগ করেন, মসজিদের মধ্যে রাখা পবিত্র কুরআন বের করে আনারও অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডিডিএ পাঁচটি ইসলামি সৌধ ভেঙে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দরগা সুনেহরি বাবা ও দরগা হজরত কুতুব শাহি চিস্তি। এগুলি নয়াদিল্লির অশোক রোডে ভারতের নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরের বাইরে অবস্থিত।

 

হিন্দু-রাষ্ট্র নির্মাণ চলছে?

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ‘দিস উইক ইন এশিয়া’তে বলেন, ভারতকে কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ বানানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইসরাইলি সেনা বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনি জনগণের চলমান হত্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা যখন গণহত্যার কথা বলি, তখন এই গণহত্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সাংস্কৃতিক উচ্ছেদ বা বহিষ্কার। গাজাতে দেখুন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-স্মৃতি মুছে ফেলতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব-সম্বলিত পুরাতাত্ত্বিক সৌধ ও ভবনগুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ইসরাইল। একই ভাবে, ভারতে আরএসএসের এটাই লক্ষ্য।” অপূর্বানন্দ আরও বলেন, “অবৈধতা ও আক্রমণকারীদের প্রতীক বলে আপনারা মাজার ও মসজিদগুলিকে ভেঙে দিচ্ছেন এবং আদালতগুলিও মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে যেহেতু কোনও প্রাণহানি হয়নি। ফলত, আপনি দুটি বিষয় অর্জন করলেন—আপনি এক জনগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিলেন এবং হত্যা না করেই তাদেরকে ক্ষমতাহীন করে ফেললেন।”

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক