ফিলিস্তিনি
রাষ্ট্রের অনস্তিত্ব সমস্যা নয়, যায়নাবাদ স্বয়ং এক মূর্তিমান সমস্যা ও বিপদ। ফিলিস্তিন
রাষ্ট্র গঠন করে কী হবে যদি বর্ণবাদী মতাদর্শ হিসেবে যায়নাবাদ ইসরাইলের প্রথম পরিচয়
হয় এবং এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসরাইলের এই চরিত্র যদি ফিলিস্তিনের উপর ক্রমাগত
চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্ব কোথায়?
এই মতাদর্শ
অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের জীবনের মূল্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের বিশুদ্ধ
বর্ণবাদী রাষ্ট্র কায়েম করাই লক্ষ্য। তাদের এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা লক্ষ লক্ষ
ফিলিস্তিনিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে বা আহত করেছে।
যায়নাবাদকে
যদি সার্বিক ভাবে পরাস্ত করা না যায় তাহলে দ্বি-রাষ্ট্র বা একক-রাষ্ট্রের সমাধান দিয়ে
কিছু করা যাবে না। যায়নবাদকে সংস্কার বা ‘সারিয়ে’ তোলা নয়, একেবারে একে নিশ্চিহ্ন করতে
হবে। গাজা ভূখণ্ডে নজিরবিহীন ভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে যখন সেই সময় পশ্চিমা
রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। কিন্তু এখন কেন? ইসরাইল
যখন সব রকমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে তখন এই রাজনীতিকরাই
ও তাঁদের সরকার নীরব থেকেছে বা ইসরাইলের বর্বর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়েছে।
তাঁদের নৈতিক
মূল্যবোধ বা বিবেক জাগ্রত হয়নি। ইসরাইল যখন নিয়ম করে ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করছে
তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁরা স্বদেশের মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ
নিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ-র সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস গানস বলেছিলেন, “মানব ইতিহাসে এটাই প্রথম
গণহত্যা যেটা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে।” এই গণহত্যা বর্তমানে আরও বিপজ্জনক
অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে কারণ ফিলিস্তিনিরা অনাহারে মারা যেতে বসেছে। আবার সেখানকার
বহু মানুষ রোগ, দূষিত জলের কারণে মারা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলের বোমা ও গুলিবর্ষণ
তো রয়েছেই।
যুক্তরাজ্যের
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতো অনেকেই বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি
দেওয়া “দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি”। কিন্তু এটা হল এই বিষয়ে ন্যূনতম কথা।
কেননা প্রতিদিন যারা বাঁচার জন্য লড়াই করে চলেছে তাদের কাছে পশিমা রাজনীতিকদের এটা
আরও একটা ফাঁপা বুলি ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়। এ নিয়ে তারা ভাবিতও নয়। গাজা ভূখণ্ডে
যে গণহত্যা চলছে তা আমাদের বলে দেয়, এই ইস্যু কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, সেই সঙ্গে এটা
মতাদর্শেরও। পশ্চিমা নেতারা যখন “দীর্ঘমেয়াদি শান্তি”র কথা বলেন, তখন ইসরাইল তাদের
সহিংসতা ও জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় ও বাড়িয়ে তোলে।
চলতি বছরের
১২ ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গির বলেছিলেন, “এমন পরিস্থিতি
কখনও আসতে পারে না যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নারী ও শিশুরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে।
সবাইকে (…) বুলেটবিদ্ধ করা হবে।”
গাজা ভূখণ্ডে
সহিংসতা ব্যাপকাংশে অসুস্থকর। ইউরো-মেড মনিটর নামে এক অধিকার সংগঠন ১২ ফেব্রুয়ারিতে
জানিয়েছিল, “ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটককৃতদের অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দেখার জন্য দশ-কুড়ি
জন করে ইসরাইলি সাধারণ মানুষকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা হাসতে হাসতে সেই দৃশ্য রেকর্ড
করে।” ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর মারাত্মক নিগ্রহ ও নির্যাতন করে ইসরাইলি সৈন্যরা।
এই সব কর্মকাণ্ডের
কোনও যৌক্তিক রাজনৈতিক ন্যায্যতা থাকতে পারে না। এগুলির (গণহত্যার ভাষা, গণহত্যা স্বয়ং
ও বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত করার হুমকি) শিকড় যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক তত্ত্বে নেই, রয়েছে
যায়নাবাদে। সমস্যা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে কারণ আমরা সমস্যাটিকে সমাধান করতে চাইছি
না। প্রকৃত প্রস্তাবে, অনেকে ঠিক এর উল্টোটা করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সরকারগুলি
যায়নাবাদের সমালোচনা ও সেমিটিজম-বিরোধীতাকে সমগোত্রীয় প্রমাণ করতে আইন পাশ করেছে বা
করছে। এমনকি, ফেসবুকও ‘যায়নবাদী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ করতে চায় যদি তা ইসরাইলকে সমালোচনা
করতে ব্যবহার করা হয়।
ইসরাইলের
হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু ৫ নভেম্বরে গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন
যখন, সেই সময় অনেকে তাঁর নিন্দা করেছিলেন অনুপযুক্ত
ভাষা ব্যবহার করার জন্য। অথচ পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা নিয়ে কেউ সমালোচনা করেননি। ইসরাইলের
কয়েকজন কর্মকর্তাও এলিয়াহুর সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তা মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
ইসরাইলের ভাবমূর্তি ক্ষতি করার জন্য।
যাইহোক, ইসরাইলের
ওই মন্ত্রী কেবলমাত্র রাগে উন্মত্ত হয়ে ওই মন্তব্য করেননি। তিনি জেনেবুঝেই বলেছিলেন
কারণ তারপর থেকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, ফিলিস্তিনিদের গণহারে
হত্যা করার এই ইচ্ছা সত্যিই তাদের মধ্যে রয়েছে।
টিকে থাকার
জন্য যায়নবাদীরা যা কিছু করতে পারে এবং তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে আছে কাল্পনিক শত্রুকে
ধ্বংস করে দেওয়ার উপর। বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক বা এমনকি সাংস্কৃতিক ভাবে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া
নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা।
১৯৪৮ সালে
ফিলিস্তিনে যে জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান চালানো হয়েছিল তা নাকবা নামে পরিচিত।
ইসরাইলের সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতেই এই মারাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ‘শত্রু’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র টিকে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধ অব্যাহত রাখায় ও তাদের
সমষ্টিগত অধিকার দাবি করায় ইসরাইলের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বর্তমানে জায়গা করে
নিয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা।
যদি গাজার
পতন হয় তাহলে বাকি ফিলিস্তিনের সকল ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে ইসরাইলি সহিংসতা,
জাতিগোষ্ঠী সাফাই ও প্রয়োজন হলে গণহত্যার। নতুন রাজনৈতিক সমাধান সূত্র সন্ধান করার
নামে ইস্যুটিকে লঘু ও খাটো করার অর্থ হল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে মিথ্যা আশা বিক্রি
করা এবং মূল ইস্যু অর্থাৎ ইসরাইলের যায়নবাদী মতাদর্শকে আড়াল করার চেষ্টা। সমস্ত বর্ণবাদী
ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মতো যায়নাবাদও উপনিবেশিত ভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের
ক্ষেত্রে শূন্য-দায়বদ্ধতার নীতি নিয়ে চলে। তাদের মূল কথা হল, জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ
ও গণহত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার।
“দীর্ঘস্থায়ী
শান্তি”র জন্য যায়নবাদ নির্মূল হওয়া প্রয়োজন।
তরজমাঃ জিয়াউল
হক