শোভন ভট্টাচার্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শোভন ভট্টাচার্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সিরিজ কবিতা : কালের কদম্ব-কাঁটা : শোভন ভট্টাচার্য


 

 

কালের কদম্ব-কাঁটা

সন্তানই ধর্ষক হলে নাভীশ্বাস ওঠে প্রকৃতির;
বিষে বিষে ছটফটায় ক্ষিতি অপ তেজ মরুত ব্যোম।
সেদিকে দ্যাখে না ফিরে সভ্যতার উদ্ধত অহম;
মানুষই নিয়ন্তা যেন বিশ্বময় গতি ও স্থিতির।

 

ভুলে যায় তার জন্ম এই প্রকৃতিরই ছায়াতলে।
সেই শান্তি, সে-আশ্রয়, কী নিবিড় মাতৃস্নেহবৎ
ভুলে গিয়ে ভাবে মূর্খ মহাবিশ্বে মানুষই মহৎ;
লুন্ঠনের থাবা তার পড়ে জলেস্থলে ফুলেফলে।

 

স্বপ্ন বোমাবিশ্বরূপ, ধ্বংসরূপে ন্যস্ত পরমাণু;

মাটি-আকাশের কান্না আস্ফালনে চাপা পড়ে যায়;

সেই অশ্রু সুনামির ঢেউ হয়ে জগৎ ভাসায়;

কালের কদম্ব-কাঁটা হয়ে অশ্রু ছড়ায় জীবাণু।

 

ঘরমুখী দুনিয়া, মৃত্ প্রতিদিন হাজারে হাজার...
সভ্যতা উজাড় করে পথ খোঁজে প্রকৃতি বাঁচার।

 

 

যুদ্ধবাজ ‘প্রথম’ বিশ্বকে 

তোমার ধ্বংসের বার্তা তোমারই বিজয়-ব্যভিচারে;

মানুষকে মানুষ নয়, ভেবেছ গ্ল্যাডিয়েটর তুমি;

শিকল-গোঙানি যত শুনেছে তোমার মাতৃভূমি;

যত মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা, উদযাপিত অ্যাম্ফিথিয়েটারে…

 

মানুষের মুণ্ডু কেটে তোমরাই তো খেলেছ ফুটবল;

হিরোশিমা নাগাশাকিতে ছুড়েছ পরমাণু বোমা;

কোথাও খইয়ের মতো ছড়িয়েছ মিসাইল তোমার;

জ্বলন্ত ক্ষুধার মুখ বন্ধ করতে গুঁজেছ পিস্তল।

 

তোমার দুর্দশা দেখে, প্রকৃতিও যেন তাই হাসে! 

মাটিতে লুটোয় আকাশের হাসি— হাসে কালপুরুষ—

তিনিও হাসেন, ঘরে ঘরে যার টাঙিয়েছ ক্রুশ।

তুমি কিনা কাঁপছ পারমাণবিক সামান্য ভাইরাসে?

 

তোমরাই তো চেয়েছিলে অস্ত্র হোক ‘জীবাণু-সন্ত্রাস’;

এখন কে কাকে মারবে? কে কবর দেবে কার লাশ?

 

 

‘পরিযায়ী’ প্রশাসনকে

অসুখ উড়িয়ে আনলে, সব সুখের পায়রা এল দেশে;

যতদিন না জান-জাহান ছেয়ে গেল পর্যাপ্ত জীবাণু।

কে তুমি সরকার আর এ তোমার কী ‘কালাকানুন’

পরিযায়ী শ্রমিকেরা দেশেরই ভেতরে গেল ফেঁসে।

 

ভিনরাজ্যে, কর্মহীন, অনাহারে, অনিশ্চয়তায়;

লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি, লক্ষ-কোটি ক্ষুধাক্লিষ্ট প্রাণ

পড়ে থাকল, পচতে থাকল একা— অসহ্য পেটের টান

সামলাতে না পেরে কেউ, বাড়ির আলেয়া-পথ পা’য়

 

হাঁটা শুরু করল— পথে ঝরল কত মেহনতী লোক;

তারাই দেশের চাকা ঘোরাত লকডাউনের আগে;

তাদেরও বাড়ি-ফেরার জন্য যে কয়েকটা চাকা লাগে

কে চায় সে-কথা ভাবতে? তাদের মরণে কার শোক?

 

ত্রাণের প্লাস্টিকে ছাপা মন্ত্রীর প্রধান-মুখ্য মুখ

দেখায়— মহামারির চেয়ে কত গভীরে অসুখ।    

 


কালাজাদু

আফ্রিকা নামে যে একটা মহাদেশ ছিল পৃথিবীর

সেই ছায়াচরাচর মহামারিকালে আজও আছে?

খররোদ তুচ্ছ করা কালো মানুষের বোবা নাচে

এখনো কি জেগে আছে সীমাহীন দুর্ভিক্ষ শিবির?

 

যখন ছেয়েছে বিশ্ব শ্বাসরোধী মারণ ভাইরাস;

ঘোর মৃত্যুভয়ে কাঁপছে আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ;

প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর রোগের প্রকোপ;

হাঁপাচ্ছে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারেরা লড়ছে রুদ্ধশ্বাস।

 

সুসভ্য মিডিয়া সেই কাঁপনের তালে থরহরি;

এমনকী মাস্ক পরে বাকরুদ্ধ সংবাদপাঠিকা;

সংবাদ সমূহে তবু দুনিয়ার কোথায় আফ্রিকা !

পৃথিবীর গল্পে তার স্থান শুধু কালাজাদুকরি ? 

 

বাকি পৃথিবী কি জানে সে-ভূখণ্ড কোথায় বেখোঁজ ?

'ওদের বাঁচামরায় কী ভেদ, ওরা তো মরে রোজ'...

 


শূন্য থেকে শুরু

প্রকৃতি, আত্মরক্ষার্থে, জন্ম দেয় যতেক ভাইরাস;

করোনা ইবোলা নিপা— নাম শুধু বদলে বদলে যায়;

আসে নবমৃত্যুদূত সভ্যতার স্বীয় কালবেলায়;

নাচে মৃত্যু নিঃশ্বাসের আসন্ন বাতাসে— তাই মাস্ক—

 

অন্যের প্রশ্বাস থেকে পালিয়ে বাঁচার বর্ম তাই;

পালিয়ে বাঁচার পথ পেতে যে চালিয়েছিল ‘এসি’

সেও আজ জেনে গেছে সে-পথে বিপদ আরো বেশি;

কখনো বৃক্ষের চেয়ে সুরক্ষিত হয় কি বনসাই?

 

তাই তারা সহজেই উপড়ে আসে, মূলে নেই মাটি;

শহরে শহরে তাই ঝড় এলে বড় গাছ পড়ে;

শহরে শহরে তাই করোনায় বড় লোক মরে;

যেখানে আকাশ নেই, আছে দালানের দাঁতকপাটি।

 

শূন্য খনি শূন্য বন শূন্য জমি শূন্য জলাধার;

শূন্য থেকে শুরু হোক মানুষের প্রস্তুতি আবার।   

 

 

হিরণ্যকশিপু

তোমার সংহারমূর্তি আমাকে সংযত হতে বলে;

দেখায় আমার মৃত্যু স্বরোপিত খেতের ফসল;

দেখায় আমারই বিষে নীলাভ আকাশমাটিজল;

আমারই গরল দুধে, ওষুধে, ঘাতক স্নেহতলে।

 

দেখায় আমার থাবা খাবলা করে দিচ্ছে বনস্থলী;

দেখায় আমার থাবা ফুটো করে দিচ্ছে বায়ুস্তর;

দেখায় আমার থাবা শ্বাপদের চেয়ে ভয়ঙ্কর;

আমারই সহস্তে লেখা সভ্যতার এই অন্তর্জলী।

 

করোনা কারণ মাত্র— এ আমার স্বীয় আত্মঘাত;

নৃসিংহের মতো জাগে আমার প্রতিটি স্তম্ভ, রিপু;

ক্ষুদ্রতার আস্ফালনে আমি মস্ত হিরণ্যকশিপু;

মরে যেন বাঁচি, যাতে বাঁচে কিছু প্রকৃত প্রহ্লাদ।

 

মানুষ বাঁচার মন্ত্র খুঁজে পাবে হয়তো বা তখন;

নম্র-সগৌরবে যদি বুনে তুলতে শেখে তপোবন।    

 






শোভন ভট্টাচার্যের দুইটি কবিতা


আণবিক পৃথিবীর অতিবাস্তবতা

পৃথিবীতে আছে যত মানুষ, মনুষ্যেতর, একেকটা পৃথিবী;
পৃথিবীতে আছে যত উদ্ভিদ, পতঙ্গ, পশু, একেকটা পৃথিবী;

সকলেই ঘোরে তার অদৃষ্টপ্রবণ মায়াময় কক্ষপথে;
কোনো পৃথিবীর সাথে কোনো কোনো পৃথিবীর নাক্ষত্রিক যোগ দেখা যায়।

অরণ্য-পৃথিবী টানে কোনো কোনো বিবাগীহৃদয় পৃথিবীকে;
বাজার-পৃথিবী তানে কৌশলী কর্মঠ কর্তাভজা কৃতীটিকে…

কোনো কোনো দুঃখে যার প্রাণ কাঁদে, সে আবার কোনো দুঃখ পাশকাটিয়ে যায়;
কোনো কোনো সুখে যার হর্ষ হয়, সে আবার কোনো সুখ দেখেও দ্যাখে না।

বস্তুর আদিতে পাক খায় যত লক্ষকোটি অণু-পরমাণু
সেরকমই পাশাপাশি, ঘেঁষাঘেঁষি পাক খায় বিন্দুবিন্দু অজস্র জীবন।

একেকটা পৃথিবী তার নিয়তি নক্ষত্রালোকে নিজস্ব গোকুল খুঁজে পায়;
একেকটা পৃথিবী ঘোরে বহু পৃথিবীর পাশে, বড়জোর হয় মুখচেনা।

একেকটা পৃথিবী মানে প্রাণ কিংবা পাষাণের একেকটি একক;
বাঁচে-মরে ব্যক্তিগত প্রারব্ধ বা কর্মফলে, ভোগ আর ভোগান্তিলেখায়। 


মায়া প্রপঞ্চ

যতই তুমি করো না-শোনার ভান
যতই তুমি ঘুরিয়ে নাও চোখ
আমি কিন্তু বুঝেছি সম্যক
মর্মভেদী বাজে একটা গান

গহীন গান, ধারালো এক ছোরা
নিঝুম গান, রাতের ঝুমঝুমি
যতই অন্যমনস্ক হও তুমি
ঢেউ দিয়ে যায় নিহিত তান-তোড়া

যতই অন্য কারুর গান গাও
যতই মুখে বলো অন্যের কথা
মনের কথার হয় না অন্যথা
শুনতে তুমি চাও বা না-ই চাও

একটা সুর ধনুক-টানা মিড়
একটা প্রেম এমনই পরপুরুষ
কুল-মান যায়, ফেরে না তাও হুঁশ
এমনই মায়া প্রপঞ্চ প্রকৃতির