উত্তরাখণ্ডে
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিল এই রাজ্যের বিধানসভায় ৬ ফেব্রুয়ারি পেশ করা হয়েছিল।
গোটা ভারতে এই বিল আরোপ করার সূচনা হল উত্তরাখণ্ডে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে কারণ ভারতীয়
জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম মতাদর্শগত অঙ্গীকার ইউসিসি লাগু করা।
লোকসভা নির্বাচনের
মুখে আমরা যেহেতু দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাই এই প্রস্তাবিত আইন গভীর ভাবে রাজনৈতিক ও মারাত্মক
রকম মতাদর্শিক। এই আইনের লক্ষ্য হল, মুসলিম পার্সোনাল ল’কে সংস্কার করার মাধ্যমে মুসলিম
ধর্মগুরুদের কোণঠাসা করা। দাবি করা হচ্ছে, মুসলিম পার্সোনাল আইন নারীদের জন্য সুবিধাজনক
নয়। একই ভাবে, এই আইনের আওতা থেকে আদিবাসী ও জনজাতিদের বাদ রাখা হচ্ছে কারণ সরকার আদিবাসীদের
নিজস্ব যে আইন রয়েছে তা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায় না।
বহু আদিবাসী
জনগোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে যায় ছেলেদের হাতে। এখন প্রশ্ন
তোলা যেতে পারে, সমাজের একাংশের নারীদের কি সম-অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত? রাষ্ট্রে
ফের এমন একটা ইস্যু কেন তুলে আনবে যাতে মুসলিম সংখ্যালঘুরা আবার চাপে পড়ে যাবে?
এই বিলে অদ্ভুত
কিছু অনুচ্ছেদ রয়েছে। আদিবাসী ও জনজাতি ছাড়া সকল নারীকে সমান ভাবে সম্পত্তি ও ডিভোর্সের
অধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও এটি নাগরিকদের স্বাধীনতা ও লিবার্টিকে ছিনিয়ে
নিচ্ছে। এতে দাবি করা হয়েছে, অসম-লিঙ্গের ব্যক্তিরা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকলে তা স্থানীয়
থানায় নথিভুক্ত করতে হবে। নারীদের যাতে পরিত্যাগ করা না হয় তা রুখতে এমনটা করা হচ্ছে
বলে ধারণা। উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিতে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় (সঙ্গী
বাছাই থেকে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত), কিন্তু ‘থানায় নিবন্ধনে’র এই অনুচ্ছেদ গভীর ভাবে
অস্বস্তিকর।
সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের
রক্ষণশীল প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে কেউ সন্দেহ করতেই পারে যে, এটি আন্তঃধর্মীয় বা আন্তঃবর্ণীয়
সম্পর্ক বা দাম্পত্যকে আটকানোর অভিপ্রায়েই করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবার, বংশ ও খাপ-এর
নিয়ন্ত্রণ থেকে তরুণ-তরুণীদের বেরিয়ে আসাকে আরও কঠিন করে তুলছে এই আইন। তাছাড়া কোন
প্রাপ্তবয়স্করা একসঙ্গে জীবন যাপন করছে সেদিকে সহ-নাগরিক ও প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি
দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে এটি।
সুতরাং ঠিক
এই সময়ে এমন বিল আনার পিছনে প্রকৃত অভিপ্রায় কী তা নিয়ে ভাবতে বসে কেউ মনে করতেই পারেন
যে, এটা শুধুমাত্র মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। লিঙ্গ পরিচয়কে বিচারের আওতায় আনতে
চাওয়ার মাধ্যমে এক সংগঠিত রক্ষণশীল সমাজ গড়ার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর
কিছু নয়। জাতীয় স্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা হলে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার
একটা পরীক্ষাও হচ্ছে উত্তরাখণ্ডে।
এই প্রসঙ্গে
এটা বলা জরুরি, বিশ্বের সমস্ত কাস্টমারি আইন পুরুষদের দ্বারা লিখিত যারা ঐতিহাসিক ভাবে
নারীদের সমান মনে করেনি। তাই, এই লেখকসহ বহু নারী ও পুরুষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ধারণাকে
সমর্থন করতে পারেন নীতিগত ভাবে কারণ সভ্য সমাজে বিবাহ, উত্তরাধিকার, ডিভোর্স, দেখভাল
ও শিশুর তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার থাকা উচিত।
তারপরও এই
সময়ের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে অনেকেই উত্তরাখণ্ডের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ নিয়ে সংশয়ী
হতে পারেন। ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর রাখুন: বিধানসভায় এই বিল পেশ হওয়ার পরে পরেই উত্তরপ্রদেশের
উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ্দ মৌর্য বলেন, উত্তরাখণ্ডের পর “উপযুক্ত সময়ে” তাঁর রাজ্যে
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করা হবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, উত্তরাখণ্ডের
পরিস্থিতির দিকে তিনি নজর রাখবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিজের রাজ্যে
লাগু করবেন, কিন্তু এরই মধ্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে তিনি আইন নিয়ে আসবেন।
বিজেপি ও
তার মতাদর্শগত পরিবার এই বছর মরিয়া হয়ে কাজে লেগে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে: জানুয়ারিতে
রাম মন্দির, ফেব্রুয়ারিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও মার্চ থেকে মে মাসে লোকসভা নির্বাচন।
এই শাসক নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একদলীয় সিদ্ধান্ত ও নীতি-নির্ধারণের পথে হাঁটছে কারণ
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তিনটি ইস্যুর একটি যাকে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির আওতার বাইরে
রাখা হয়েছিল। জোট সরকারের সময়, এমনকি প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর
যুগেও। ৩৭০ ধারা রদ করতে এই সরকার সফল হয়েছে, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণেও সফল, এখন
অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সামনে রাখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক
ভাষ্যের নিরিখে তৃতীয় দফার জন্য নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ‘এক নেতা, এক জাতি, এক নির্বাচনে’র
ধারণাকে প্রচার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যায় একটি সাধারণ
আইন দিয়ে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দের
নেতৃত্বাধীন কমিটি একই সঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় এই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।
তাই ইউসিসিকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখা দরকার। কেন্দ্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ
কায়েম করার এ এক সুচারু কৌশল এবং সেই সঙ্গে এই সাধারণতন্ত্রে নানা দিকে অভিন্নতা নিয়ে
আসার সূক্ষ্ম ভাবনা কাজ করছে এখানে।
অভিন্ন দেওয়ানি
বিধি মুসলিম ধর্মগুরুদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাঁদের কথায়, এই আইন তাদের পার্সোনাল
ল’তে হস্তক্ষেপ করছে। ১৯৮৬ সালে মুসলিম নারী (ডিভোর্সের অধিকার রক্ষা) আইন নামে এক
পশ্চাদগামী নিয়মের মাধ্যমে দেওয়া রায়কে বদলে দিতে মুসলিম ধর্মগুরুরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
রাজীব গান্ধির উপর চাপ দিয়েছিলেন। বিজেপি হঠাৎ একটা ইস্যু পেয়ে গিয়েছিল—মুসলিম পুরুষদের
‘তোষণ’ করছে কংগ্রেস। এখন প্রায় ৪০ বছর পর সেই ইস্যু আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
ইতোমধ্যে
কী কী বদল হয়েছে? যারা নারীর অধিকার বৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তারা বিজেপির উদ্দেশ্য
ও অভিপ্রায় নিয়ে সন্দিহান। তাই, প্রগতিশীল নারী গোষ্ঠীগুলি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সংস্কারের
পক্ষে এবং এই বৃহৎ দেশে আচার ও আইনের বৈচিত্র্য বজায় রাখার উপর জোর দিচ্ছে তারা। লিঙ্গের
দৃষ্টিকোণ থেকে যারা এক সময় অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন করেছিল, তারা এখন দেখতে পাচ্ছে,
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে বিজেপির “আমরা-ওরা”র ভাষ্যে মুসলিম পুরুষদের
দমনপীড়ন করার এ আরেক ইস্যু ভিন্ন আর কিছু নয়।
তরজমা: জিয়াউল
হক