post editorial লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
post editorial লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করে জল মাপছে বিজেপি! সাবা নকভি



উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিল এই রাজ্যের বিধানসভায় ৬ ফেব্রুয়ারি পেশ করা হয়েছিল। গোটা ভারতে এই বিল আরোপ করার সূচনা হল উত্তরাখণ্ডে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে কারণ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম মতাদর্শগত অঙ্গীকার ইউসিসি লাগু করা।

লোকসভা নির্বাচনের মুখে আমরা যেহেতু দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাই এই প্রস্তাবিত আইন গভীর ভাবে রাজনৈতিক ও মারাত্মক রকম মতাদর্শিক। এই আইনের লক্ষ্য হল, মুসলিম পার্সোনাল ল’কে সংস্কার করার মাধ্যমে মুসলিম ধর্মগুরুদের কোণঠাসা করা। দাবি করা হচ্ছে, মুসলিম পার্সোনাল আইন নারীদের জন্য সুবিধাজনক নয়। একই ভাবে, এই আইনের আওতা থেকে আদিবাসী ও জনজাতিদের বাদ রাখা হচ্ছে কারণ সরকার আদিবাসীদের নিজস্ব যে আইন রয়েছে তা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায় না।

বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে যায় ছেলেদের হাতে। এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, সমাজের একাংশের নারীদের কি সম-অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত? রাষ্ট্রে ফের এমন একটা ইস্যু কেন তুলে আনবে যাতে মুসলিম সংখ্যালঘুরা আবার চাপে পড়ে যাবে?

এই বিলে অদ্ভুত কিছু অনুচ্ছেদ রয়েছে। আদিবাসী ও জনজাতি ছাড়া সকল নারীকে সমান ভাবে সম্পত্তি ও ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও এটি নাগরিকদের স্বাধীনতা ও লিবার্টিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এতে দাবি করা হয়েছে, অসম-লিঙ্গের ব্যক্তিরা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকলে তা স্থানীয় থানায় নথিভুক্ত করতে হবে। নারীদের যাতে পরিত্যাগ করা না হয় তা রুখতে এমনটা করা হচ্ছে বলে ধারণা। উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিতে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় (সঙ্গী বাছাই থেকে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত), কিন্তু ‘থানায় নিবন্ধনে’র এই অনুচ্ছেদ গভীর ভাবে অস্বস্তিকর।

সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের রক্ষণশীল প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে কেউ সন্দেহ করতেই পারে যে, এটি আন্তঃধর্মীয় বা আন্তঃবর্ণীয় সম্পর্ক বা দাম্পত্যকে আটকানোর অভিপ্রায়েই করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবার, বংশ ও খাপ-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে তরুণ-তরুণীদের বেরিয়ে আসাকে আরও কঠিন করে তুলছে এই আইন। তাছাড়া কোন প্রাপ্তবয়স্করা একসঙ্গে জীবন যাপন করছে সেদিকে সহ-নাগরিক ও প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে এটি।

সুতরাং ঠিক এই সময়ে এমন বিল আনার পিছনে প্রকৃত অভিপ্রায় কী তা নিয়ে ভাবতে বসে কেউ মনে করতেই পারেন যে, এটা শুধুমাত্র মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। লিঙ্গ পরিচয়কে বিচারের আওতায় আনতে চাওয়ার মাধ্যমে এক সংগঠিত রক্ষণশীল সমাজ গড়ার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। জাতীয় স্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা হলে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার একটা পরীক্ষাও হচ্ছে উত্তরাখণ্ডে।

এই প্রসঙ্গে এটা বলা জরুরি, বিশ্বের সমস্ত কাস্টমারি আইন পুরুষদের দ্বারা লিখিত যারা ঐতিহাসিক ভাবে নারীদের সমান মনে করেনি। তাই, এই লেখকসহ বহু নারী ও পুরুষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ধারণাকে সমর্থন করতে পারেন নীতিগত ভাবে কারণ সভ্য সমাজে বিবাহ, উত্তরাধিকার, ডিভোর্স, দেখভাল ও শিশুর তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার থাকা উচিত।

তারপরও এই সময়ের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে অনেকেই উত্তরাখণ্ডের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ নিয়ে সংশয়ী হতে পারেন। ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর রাখুন: বিধানসভায় এই বিল পেশ হওয়ার পরে পরেই উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ্দ মৌর্য বলেন, উত্তরাখণ্ডের পর “উপযুক্ত সময়ে” তাঁর রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করা হবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, উত্তরাখণ্ডের পরিস্থিতির দিকে তিনি নজর রাখবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিজের রাজ্যে লাগু করবেন, কিন্তু এরই মধ্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে তিনি আইন নিয়ে আসবেন।

বিজেপি ও তার মতাদর্শগত পরিবার এই বছর মরিয়া হয়ে কাজে লেগে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে: জানুয়ারিতে রাম মন্দির, ফেব্রুয়ারিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও মার্চ থেকে মে মাসে লোকসভা নির্বাচন। এই শাসক নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একদলীয় সিদ্ধান্ত ও নীতি-নির্ধারণের পথে হাঁটছে কারণ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তিনটি ইস্যুর একটি যাকে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। জোট সরকারের সময়, এমনকি প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর যুগেও। ৩৭০ ধারা রদ করতে এই সরকার সফল হয়েছে, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণেও সফল, এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সামনে রাখা হচ্ছে।

রাজনৈতিক ভাষ্যের নিরিখে তৃতীয় দফার জন্য নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ‘এক নেতা, এক জাতি, এক নির্বাচনে’র ধারণাকে প্রচার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যায় একটি সাধারণ আইন দিয়ে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি একই সঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় এই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তাই ইউসিসিকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখা দরকার। কেন্দ্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার এ এক সুচারু কৌশল এবং সেই সঙ্গে এই সাধারণতন্ত্রে নানা দিকে অভিন্নতা নিয়ে আসার সূক্ষ্ম ভাবনা কাজ করছে এখানে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুসলিম ধর্মগুরুদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাঁদের কথায়, এই আইন তাদের পার্সোনাল ল’তে হস্তক্ষেপ করছে। ১৯৮৬ সালে মুসলিম নারী (ডিভোর্সের অধিকার রক্ষা) আইন নামে এক পশ্চাদগামী নিয়মের মাধ্যমে দেওয়া রায়কে বদলে দিতে মুসলিম ধর্মগুরুরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির উপর চাপ দিয়েছিলেন। বিজেপি হঠাৎ একটা ইস্যু পেয়ে গিয়েছিল—মুসলিম পুরুষদের ‘তোষণ’ করছে কংগ্রেস। এখন প্রায় ৪০ বছর পর সেই ইস্যু আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

ইতোমধ্যে কী কী বদল হয়েছে? যারা নারীর অধিকার বৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তারা বিজেপির উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নিয়ে সন্দিহান। তাই, প্রগতিশীল নারী গোষ্ঠীগুলি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সংস্কারের পক্ষে এবং এই বৃহৎ দেশে আচার ও আইনের বৈচিত্র্য বজায় রাখার উপর জোর দিচ্ছে তারা। লিঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে যারা এক সময় অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন করেছিল, তারা এখন দেখতে পাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে বিজেপির “আমরা-ওরা”র ভাষ্যে মুসলিম পুরুষদের দমনপীড়ন করার এ আরেক ইস্যু ভিন্ন আর কিছু নয়।

 

তরজমা: জিয়াউল হক

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু মর্যাদা সংক্রান্ত মামলা ও তারপর। বিশেষ প্রতিবেদন

 

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এএমইউ) সংখ্যালঘু মর্যাদা সংক্রান্ত মামলার রায় স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ। তালিকা ১-এর এন্ট্রি ৬৩ অনুযায়ী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম যাকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি এমন মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠান হল বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এএমইউ আইনের অধীন এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২০ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার ইতিহাসকে তিনটি পর্বে দেখা যেতে পারে—১) ১৮৭০-১৮৭৭ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা অনেকের মাথায় আসে এবং মুহাম্মদিন অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল (এমএও) কলেজ স্থাপন করা হয়েছিল। ২) ১৮৭৭-১৯১০ সালে মুহাম্মদিন ওরিয়েন্টাল কলেজ বা এমএও-কে রূপান্তরিত করার জন্য মিছিল করে মুসলিম সম্প্রদায় এবং চাপের মুখে সরকার এই এই কলেজকে পরিবর্তিত রূপ দিতে রাজি হয়। ৩) ১৯১০-১৯২০ সালে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা সক্রিয় ভাবে এই কাজে মনোনিবেশ করেন এবং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিতে সফল হন এবং সেদিনে মুহাম্মদিন ওরিয়েন্টাল কলেজ বর্তনামের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়।

সংবিধানের ৩০ ধারা মোতাবেক আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সংখ্যালঘু মর্যাদা’ দেওয়ার বিষয়টি বেশ জটিল। সংখ্যালঘু মর্যাদা কী? ভারতীয় সংবিধানের ৩০ ধারা ভারতের ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার দান করে। এই ধারা নির্দিষ্ট ভাবে সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনা ও পরিচালনার অধিকার দিয়েছে। মৌলিক অধিকার অনুযায়ী, এই ধরনের সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য ভর্তি সংক্রান্ত নীতিমালায় সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে পারে।

প্রতিষ্ঠানের সংখ্যালঘু চরিত্র রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেয় এই ধারা। এই আইনের লক্ষ্য হল, সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত স্বায়ত্বশাসন, পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের যুক্তিগ্রাহ্য বিধিনিয়মকে মান্যতা দেওয়া। আজিজ বাশা বনাম ভারত সরকারের মামলায় (১৯৬৭ সালে জেনেসিস অফ দ্য কনানড্রাম) ৭ বিচারপতির একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলে, ১৯৫১ ও ১৯৬৫ সালে সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রকৃত এএমইউ আইন বদল করা হয়েছিল কেন? সেই সঙ্গে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে অ-সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হল কেন?

তৎকালীন সিজিআই কে এন ওয়ানচু, বিচারপতি আর এস বাচাওয়াত, বিচারপতি ভি রামাস্বামী, বিচারপতি জি কে মিত্র ও বিচারপতি কে এস হেগড়ের বেঞ্চ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে নজর দেয় এবং জানানো হয়, এএমইউ-এর প্রতিষ্ঠাতারা মুসলিম ছিলেন বলে এটা বলা যেতে পারে না যে, এএমইউ ৩০ ধারা অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের দ্বারা স্থাপিত ও পরিচালিত হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে আসার কারণ ছিল, বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছিল যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে প্রাক-সাংবিধানিক পন্থায়। এই পন্থায় এটি স্থাপিত হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বারা নয়। ১৯২০ সালের এএমইউ আইন চতুর্থবারের মতো ১৯৮১ সালে সংশোধিত হয়। তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছিল—প্রথমত, ১৯৮১ সালের আইনের ২(১) ধারা “বিশ্ববিদ্যালয়” শব্দটিকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলে এটি “ভারতের মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত”। দ্বিতীয়ত, সংশোধনী আইনের ৫ ধারাকে সংস্কার করে ভারতের মুসলিমদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয়ত, ১৯২০ সালের আইনের প্রস্তাবনা থেকে “প্রতিষ্ঠিত” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এই বদলগুলি করা হয়েছিল বেগ কমিটি ও ভারতের সংখ্যালঘু কমিশনের সুপারিশ মেনে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে সংখ্যালঘু মর্যাদা দেওয়ার পিছনে এই বদলগুলির প্রভাব ছিল।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বনাম মলয় শুক্লা মামলায় ২০০৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট মুসলিম প্রার্থীদের সংরক্ষণ নীতি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের দিকে জোর দেয়। এএমইউয়ের নীতিতে বলা হয়েছিল, স্নাতকোত্তর কোর্সের ৫০ শতাংশ আসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত হবে যা আসলে পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তারদের জন্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তি দিয়েছিল, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধনী আইন ১৯৮১) বাশা মামলার রায়ের ফলে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তবে, একক বেঞ্চ শেষ পর্যন্ত জানিয়েছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচ্য নয়। একক বেঞ্চের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ স্থির করে যে, সংখ্যালঘু ব্যক্তির দ্বারা স্থাপিত হলেও সেই ভাবে একে সংখ্যালঘু দ্বারা পরিচালনা বা পরিচালনার দাবি ওঠেনি, তাই এটি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না। হাইকোর্ট রায় দেয়—ক) বাশা মামলার রেশিওর দিকে তাকিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় একটি অ-সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বহাল থাকবে এবং ৩০ ধারা মোতাবেক একে দাবি করা যাবে না। খ) ১৯৮১ সালের আইনের এস ২(১) ও ৫(২)(সি)-কে বাতিল বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। গ) ১৯২০ সালের আইনের প্রস্তাবনা থেকে ১৯৮১ সালের আইন দ্বারা “প্রতিষ্ঠিত এবং” শব্দগুলি সরানো অবৈধ এবং এই শব্দগুলি প্রস্তাবনায় থাকবে। ঘ) পিজিসির জন্য ৫০ শতাংশ মুসলিম কোটার দাবি অসাংবিধানিক এবং ভবিষ্যতে এই নীতি মানা যাবে না। ঙ) ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্র আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত সংখ্যালঘু মর্যাদাকে পরীক্ষা করে দেখতে বলে এবং মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের বিষয়টিকে খারিজ করা হয়। ২০১৯ সালে দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন ৩ বিচারপতির বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ের অনুষঙ্গে ৭ জন বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২০০৬ সালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানির সময় সেই প্রসঙ্গ ফিরে এসেছিল।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কেন বিক্ষোভ কৃষকদের? হরবীর সিং

 


কৃষকরা শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির নিশ্চয়তার দাবিতে পুনরায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আমাদের এখন দেখা প্রয়োজন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি সীমান্তে চলা কৃষকদের আগের বিক্ষোভ থেকে এবারের বিক্ষোভ কোথায় ও কতখানি আলাদা। আগের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল, কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা ছিল ঐচ্ছিক দাবি।

পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা মনে করেছিলেন, উক্ত আইনের নিয়মাবলি যেমন সরকার কর্তৃক শস্য সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বাজার কমিটি (এপিএমসি) আইনের অধীন মান্ডি ব্যবস্থা ও চুক্তিভিত্তিক চাষ তাঁদের প্রভাবিত করবে। তাই, সেই সময়, ওইসব রাজ্যের কৃষকরা মূল ইস্যু নিয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন কারণ মান্ডি ও শস্যসংগ্রহ ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছিলেন তাঁরা।

বিহার যেখানে এপিএমসি মান্ডি নেই এবং মধ্য ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশ যেখানে এপিএমসি মান্ডির তেমন সুবিধা পাওয়া যায় না, সেখানকার কৃষকরা কৃষি আইনের সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত বা সম্পৃক্ত হননি। তবে সকল কৃষকই তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য চান এবং এ জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি জরুরি। এই বিশ্বাসই এমএসপির আবেদনকে সর্বজনীন করে তুলেছে। এই কারণে ২০২৪ সালের কৃষক আন্দোলনের গোটা দেশে সাড়া ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছর পাঁচ রাজ্যের প্রায় ৬০০ জন কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি এমনই একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। শস্যের স্বল্প মূল্য ও গ্রামীণ পরিবারগুলির ক্রমবর্ধমান সমস্যাই ছিল তাদের সাধারণ উদ্বেগ ও যন্ত্রণার বিষয়। রাজস্থানের যোধপুর, উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর, ওড়িশার ভুবনেশ্বর, মেঘালয়ের শিলং ও তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের কৃষক ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম। ছয় মাস ধরে আমরা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলাম। দিল্লি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর পর।

একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ভাল মূল্য প্রাপ্তিকেই সমস্যার সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেন। দেশের সমস্ত প্রান্তের কৃষকরা কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যই শুধু চান না, সেই সঙ্গে এমএসপির নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টিও চান। প্রায় তিন মাস পরে দিল্লির উদ্দেশে মিছিল শুরু হয়েছিল পুনরায়। পঞ্জাবের দুটি স্বল্প পরিচিত কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাঁদের দাবি দেশের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন কৃষক সংগঠনগুলি দিল্লি সীমান্ত থেকে ফিরে গিয়েছিল, সম্যুক্ত কিষাণ মোর্চাকে (এসকেএম) লেখা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব সঞ্জয় আগারওয়াল বলেছিলেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত ইস্যুর সমাধান বের করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আগারওয়ালের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে, এমএসপির পাশাপাশি তাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে কৃষির ব্যয় ও পণ্যের মূল্য বিষয়ে কমিশনের কর্মকাণ্ড, প্রাকৃতিক ও জৈব কৃষি ইত্যাদি। এসকেএম-এর তিন প্রতিনিধিকে এই কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এসকেএম তা গ্রহণ করেনি এবং ওই কমিটিতে যোগ দেয়নি। সেই কমিটির রিপোর্ট এখনও আসেনি। এর ফলে যে কৃষকরা বলেছিলেন এই কমিটি গঠন আসলে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার তাঁদের কথাই সত্যি হয়েছে। সরকার সম্ভবত উপলব্ধি করেনি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ইস্যুটি এত সহজে যাওয়ার নয়।

গোটা দেশে কৃষকদের আয় হয় খুব কম, নয়ত হ্রাসের দিকে। যে সব রাজ্যে ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, সেখানকার উৎপাদনশীলতা পড়তির দিকে এবং কৃষির ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। আমরা বলতে পারি, কৃষকরা যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে তার সামান্যই তাঁরা ফিরে পান। গত চার দশকে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হওয়ায় কৃষকদের উপার্জন হ্রাস পেয়েছে এবং এর ফলে তাঁদের জীবন যাপনের মানের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবধান ব্যাপক হয়েছে। এদিকে, তথ্যের বিস্ফোরণের ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার যা কিছুই দাবি করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ অনেক গুণ বেড়েছে, অথচ এই সব ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবে কৃষিক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষক পরিবারের সন্তানদের কাজের সুযোগ কমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের একটা সর্বজনীন আবেদন রয়েছে কারণ এটি কৃষকদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কৃষকরা ফসলের উৎপাদন ও মূল্য নিয়ে বর্ধিত অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে চান। গম, ধান, আখ, আলু, পেঁয়াজ বা নারকেল—যা-ই চাষ  করুন না কেন, কৃষকরা তাঁদের শস্যপণ্যের ভাল ও স্থায়ী মূল্য চান। আমাদের দৃষ্টিকোণ বদলানো উচিত এবং চিন্তা করা উচিত যে, ভারত ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। এই দেশ নিউজিল্যান্ড বা চিলির মতো নয় যেখানে কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উপায় হিসেবে ভাবা হয়।

বিপুল সংখ্যক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হয় আমাদের এবং আমরা কেবলমাত্র আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভর করতে পারি না। কৃষি উৎপাদনকে আমাদের কৌশলী ক্ষেত্র হিসেবে দেখা উচিত এবং একে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। দেশে প্রায় ১৪ কোটি জমি-মালিকানা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের কল্যাণই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কাছ থেকে আমাদের বুঝে নিতে হবে, তারা দেশের ২০ লক্ষ কৃষকের উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কারণ তারা শুধুমাত্র খাদ্য আমদানির উপর নির্ভর করে বসে থাকতে চায় না। আমাদের উপভোক্তাদের মানসিকতাও বদলানো জরুরি। তাদের ভাবতে হবে, কৃষকরা তাদের পেট ভরান এবং সে জন্য তাঁদের ভাল মূল্য পাওয়া উচিত। উপভোক্তাদের সঙ্গে কৃষকদের দ্বন্দ্ব তৈরি করার পরিবর্তে যখন আমরা ১২ টাকায় এক কিলোগ্রাম আলু ও ১৫ টাকায় এক কিলোগ্রাম পেঁয়াজ কিনি তখনই এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন: দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কি যায়নবাদকে আড়ালের চেষ্টা! । রামজি বারৌদ

 


ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অনস্তিত্ব সমস্যা নয়, যায়নাবাদ স্বয়ং এক মূর্তিমান সমস্যা ও বিপদ। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করে কী হবে যদি বর্ণবাদী মতাদর্শ হিসেবে যায়নাবাদ ইসরাইলের প্রথম পরিচয় হয় এবং এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসরাইলের এই চরিত্র যদি ফিলিস্তিনের উপর ক্রমাগত চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্ব কোথায়?

এই মতাদর্শ অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের জীবনের মূল্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের বিশুদ্ধ বর্ণবাদী রাষ্ট্র কায়েম করাই লক্ষ্য। তাদের এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে বা আহত করেছে।

যায়নাবাদকে যদি সার্বিক ভাবে পরাস্ত করা না যায় তাহলে দ্বি-রাষ্ট্র বা একক-রাষ্ট্রের সমাধান দিয়ে কিছু করা যাবে না। যায়নবাদকে সংস্কার বা ‘সারিয়ে’ তোলা নয়, একেবারে একে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। গাজা ভূখণ্ডে নজিরবিহীন ভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে যখন সেই সময় পশ্চিমা রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। কিন্তু এখন কেন? ইসরাইল যখন সব রকমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে তখন এই রাজনীতিকরাই ও তাঁদের সরকার নীরব থেকেছে বা ইসরাইলের বর্বর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়েছে।

তাঁদের নৈতিক মূল্যবোধ বা বিবেক জাগ্রত হয়নি। ইসরাইল যখন নিয়ম করে ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করছে তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁরা স্বদেশের মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ-র সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস গানস বলেছিলেন, “মানব ইতিহাসে এটাই প্রথম গণহত্যা যেটা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে।” এই গণহত্যা বর্তমানে আরও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে কারণ ফিলিস্তিনিরা অনাহারে মারা যেতে বসেছে। আবার সেখানকার বহু মানুষ রোগ, দূষিত জলের কারণে মারা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলের বোমা ও গুলিবর্ষণ তো রয়েছেই।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতো অনেকেই বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া “দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি”। কিন্তু এটা হল এই বিষয়ে ন্যূনতম কথা। কেননা প্রতিদিন যারা বাঁচার জন্য লড়াই করে চলেছে তাদের কাছে পশিমা রাজনীতিকদের এটা আরও একটা ফাঁপা বুলি ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়। এ নিয়ে তারা ভাবিতও নয়। গাজা ভূখণ্ডে যে গণহত্যা চলছে তা আমাদের বলে দেয়, এই ইস্যু কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, সেই সঙ্গে এটা মতাদর্শেরও। পশ্চিমা নেতারা যখন “দীর্ঘমেয়াদি শান্তি”র কথা বলেন, তখন ইসরাইল তাদের সহিংসতা ও জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় ও বাড়িয়ে তোলে।

চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গির বলেছিলেন, “এমন পরিস্থিতি কখনও আসতে পারে না যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নারী ও শিশুরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। সবাইকে (…) বুলেটবিদ্ধ করা হবে।”

গাজা ভূখণ্ডে সহিংসতা ব্যাপকাংশে অসুস্থকর। ইউরো-মেড মনিটর নামে এক অধিকার সংগঠন ১২ ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, “ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটককৃতদের অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দেখার জন্য দশ-কুড়ি জন করে ইসরাইলি সাধারণ মানুষকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা হাসতে হাসতে সেই দৃশ্য রেকর্ড করে।” ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর মারাত্মক নিগ্রহ ও নির্যাতন করে ইসরাইলি সৈন্যরা।

এই সব কর্মকাণ্ডের কোনও যৌক্তিক রাজনৈতিক ন্যায্যতা থাকতে পারে না। এগুলির (গণহত্যার ভাষা, গণহত্যা স্বয়ং ও বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত করার হুমকি) শিকড় যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক তত্ত্বে নেই, রয়েছে যায়নাবাদে। সমস্যা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে কারণ আমরা সমস্যাটিকে সমাধান করতে চাইছি না। প্রকৃত প্রস্তাবে, অনেকে ঠিক এর উল্টোটা করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সরকারগুলি যায়নাবাদের সমালোচনা ও সেমিটিজম-বিরোধীতাকে সমগোত্রীয় প্রমাণ করতে আইন পাশ করেছে বা করছে। এমনকি, ফেসবুকও ‘যায়নবাদী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ করতে চায় যদি তা ইসরাইলকে সমালোচনা করতে ব্যবহার করা হয়।

ইসরাইলের হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু ৫ নভেম্বরে গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন যখন,  সেই সময় অনেকে তাঁর নিন্দা করেছিলেন অনুপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করার জন্য। অথচ পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা নিয়ে কেউ সমালোচনা করেননি। ইসরাইলের কয়েকজন কর্মকর্তাও এলিয়াহুর সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তা মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের ভাবমূর্তি ক্ষতি করার জন্য।

যাইহোক, ইসরাইলের ওই মন্ত্রী কেবলমাত্র রাগে উন্মত্ত হয়ে ওই মন্তব্য করেননি। তিনি জেনেবুঝেই বলেছিলেন কারণ তারপর থেকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা করার এই ইচ্ছা সত্যিই তাদের মধ্যে রয়েছে।

টিকে থাকার জন্য যায়নবাদীরা যা কিছু করতে পারে এবং তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে আছে কাল্পনিক শত্রুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উপর। বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক বা এমনকি সাংস্কৃতিক ভাবে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে যে জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান চালানো হয়েছিল তা নাকবা নামে পরিচিত। ইসরাইলের সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতেই এই মারাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘শত্রু’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র টিকে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধ অব্যাহত রাখায় ও তাদের সমষ্টিগত অধিকার দাবি করায় ইসরাইলের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা।

যদি গাজার পতন হয় তাহলে বাকি ফিলিস্তিনের সকল ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে ইসরাইলি সহিংসতা, জাতিগোষ্ঠী সাফাই ও প্রয়োজন হলে গণহত্যার। নতুন রাজনৈতিক সমাধান সূত্র সন্ধান করার নামে ইস্যুটিকে লঘু ও খাটো করার অর্থ হল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে মিথ্যা আশা বিক্রি করা এবং মূল ইস্যু অর্থাৎ ইসরাইলের যায়নবাদী মতাদর্শকে আড়াল করার চেষ্টা। সমস্ত বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মতো যায়নাবাদও উপনিবেশিত ভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শূন্য-দায়বদ্ধতার নীতি নিয়ে চলে। তাদের মূল কথা হল, জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ ও গণহত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার।

“দীর্ঘস্থায়ী শান্তি”র জন্য যায়নবাদ নির্মূল হওয়া প্রয়োজন।

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক

হলদোয়ানি সহিংসতা আসলে ইতিহাস মুছে ফেলার ছক: হর্ষ মন্দার

 



বিশেষ প্রতিবেদন

 

হর্ষ মন্দার। মানবাধিকার কর্মী। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নির্যাতিতদের প্রতি সংহতি জানাতে তিনি ‘কারওয়াঁ-এ-মহব্বত’ প্রচার শুরু করেছিলেন। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারিতে ঘটা হলদোয়ানি সহিংসতাকে তিনি “শরীরি নিগ্রহ ব্যতিরেকে মুসলিম আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন” করার প্রয়াস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে মন্দার সতর্ক করেছেন, ‘অখণ্ড ভারত’ নির্মাণের নামে গোটা ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ফিরে ফিরে আসতে পারে। মিডিয়ার একাংশসহ দক্ষিণপন্থীরা অখণ্ড ভারতের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ও এই ভাষ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে।

মন্দার বলেছেন, “এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, এটাই কি তার বহিঃপ্রকাশ? প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও হলদোয়ানি মেরুকরণের শিকার হয় রাজ্য সরকারের মদতে এবং এর ফলে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি পায়। তাই আমাদের বোঝা জরুরি, হলদোয়ানিতে ঠিক কী ঘটেছিল।”

উত্তরাখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা নৈনিতালে অবস্থিত হলদোয়ানি। এখানকার শাসক বিজেপির পুষ্কর সিং ধামি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ এলাকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গ্রাসে চলে গেছে। মন্দার উল্লেখ করেছেন, গেরুয়া দলের বর্তমান লক্ষ্য হল, গোরস্থানের মতো ধর্মীয় জায়গা, স্মৃতিস্তম্ভ বা ধ্বংসাবশেষকে মুছে ফেলা।

 

হলদোয়ানি সহিংসতা: ২০২৪

জবরদখলের অভিযোগে বনভুলপুরা জেলা প্রশাসন একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ঘটে। বিপুল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ১০০-র বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে মোতায়েন করা হয়েছিল। পাশাপাশি, বাড়িঘরগুলি যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন স্থানীয় হিন্দুরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। এর ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।

সরকারি নথি বলছে, পুলিশের সঙ্গে এই সংঘর্ষে ছয়জন মারা গেছে। এদের অধিকাংশই মুসলিম। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরও এই সহিংসতার বলি হয়েছে। এই অশান্তির পর জেলা প্রশাসন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় এবং সমস্ত স্কুল ও কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দুই দিন পর, পুলিশ ১৯ জন নামধারী ও ৫ হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী, কথিত মূলচক্রী আব্দুল মালিক-সহ ৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

১৭ ফেব্রুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও উঠে আসে। তাতে দেখা যায়, এফআইআরে উল্লেখিত মালিক-সহ ৯ ব্যক্তির বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করছে পুলিশ। এক জেলা দেওয়ানি আদালত অভিযুক্তদের সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দেয়। পুলিশ কর্মকর্তারা এক অভিযুক্তের বাড়ির দরজা চুরমার করে দিচ্ছে, এমন ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকে।

 

পরিকল্পিত সহিংসতা

কারওয়াঁ-এ-মহব্বত ও অন্যান্য অধিকার গোষ্ঠীর সহায়তায় অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস একটি সত্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের শিরোনাম ‘বুলডোজিং পিস: স্টেট ভায়োলেন্স অ্যান্ড অ্যাপাথি ইন মুসলিম সেটলমেন্টস অফ হলদোয়ানি’। এতে অভিযোগ তোলা হয়েছে, হলদোয়ানির সহিংসতা মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুদের উপর পরিকল্পিত ও নিশানাকৃত সহিংসতা। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার ও র‍্যাডিকল দক্ষিণপন্থী নাগরিক গোষ্ঠীগুলি মিলিতি ভাবে মারাত্মক মেরুকৃত ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এর মধ্যে বহু ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর বিষয় রয়েছে।

 

২০২২: অনুরূপ প্রচেষ্টা

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে হাইকোর্টের নির্দেশে রেলের জমি থেকে মানুষজনকে উৎখাত করার খবর পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত জমি বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের। এটাও ছিল হলদোয়ানির একই বনভুলপুরা এলাকায়। এই এলাকায় বসবাস করা হাজার হাজার বাসিন্দা রেলে জমি থেকে তাদের বাড়িঘর উপড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। পরিকল্পিত উচ্ছেদ অভিযানে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত এবং বলেছিল, একটা কার্যকরী সমাধান বের করতে হবে।

 

অন্যান্য নিশানাস্থল

চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে জবরদখল-বিরোধী অভিযানের নামে দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) আগাম নোটিশ ছাড়াই ৬০০ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নয়াদিল্লির মেহরাউলির আখন্দজি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ১২০০ সালের আগে। যাইহোক, ডিডিএ-র বক্তব্য অনুযায়ী, এই মসজিদ দাঁড়িয়েছিল জবরদখল করা জমিতে।

এই মসজিদের ইমাম জাকির হুসেনের মতে, ফজরের আজানের আগে গোটা ধ্বংসপ্রক্রিয়াটি ঘটেছিল। তাঁর অভিযোগ, মানুষের চোখের সামনে থেকে ধ্বংসযজ্ঞকে আড়াল করতে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, “ডিডিএ কর্মকর্তারা আমাকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেননি। কর্মকর্তারা জোর করে আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন যাতে ধ্বংস চলাকালে আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি।” পাশাপাশি তিনি যোগ করেন, মসজিদের মধ্যে রাখা পবিত্র কুরআন বের করে আনারও অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডিডিএ পাঁচটি ইসলামি সৌধ ভেঙে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দরগা সুনেহরি বাবা ও দরগা হজরত কুতুব শাহি চিস্তি। এগুলি নয়াদিল্লির অশোক রোডে ভারতের নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরের বাইরে অবস্থিত।

 

হিন্দু-রাষ্ট্র নির্মাণ চলছে?

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ‘দিস উইক ইন এশিয়া’তে বলেন, ভারতকে কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ বানানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইসরাইলি সেনা বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনি জনগণের চলমান হত্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা যখন গণহত্যার কথা বলি, তখন এই গণহত্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সাংস্কৃতিক উচ্ছেদ বা বহিষ্কার। গাজাতে দেখুন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-স্মৃতি মুছে ফেলতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব-সম্বলিত পুরাতাত্ত্বিক সৌধ ও ভবনগুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ইসরাইল। একই ভাবে, ভারতে আরএসএসের এটাই লক্ষ্য।” অপূর্বানন্দ আরও বলেন, “অবৈধতা ও আক্রমণকারীদের প্রতীক বলে আপনারা মাজার ও মসজিদগুলিকে ভেঙে দিচ্ছেন এবং আদালতগুলিও মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে যেহেতু কোনও প্রাণহানি হয়নি। ফলত, আপনি দুটি বিষয় অর্জন করলেন—আপনি এক জনগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিলেন এবং হত্যা না করেই তাদেরকে ক্ষমতাহীন করে ফেললেন।”

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক