শিশুতোষ গপ্পো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শিশুতোষ গপ্পো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
তারপর যা হওয়া উচিত । জিয়া হক
ব্যাঘ্রশাবক অরণ্য পরিদর্শনে বাহির হইয়া দেখিল এক রুগ্ন, শীর্ণ ও প্রৌঢ় কাঠুরে ঘামিতে ঘামিতে একটি বাবলা গাছের মোটা শিকড় কাটিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার লাল গামছা মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ব্যঘ্রশাবকের বড় করুণা হইল। কাঠুরেটির কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। একটি জলজ্যান্ত ব্যাঘ্র দেখিয়া ভয় পাইয়া দুই পা পিছাইয়া গেল কাঠুরে। পালাইবার পথ খুঁজিতে সে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল।
কিন্তু সে তো জানিত না, সকল ব্যাঘ্র অনুরূপ হয় না। ব্যাঘ্রশাবক বিনীত ভাবে করজোড়ে বলিল, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষ খাওয়া শিখিনি। নররক্তের স্বাদ কী তা আমার অজানা।
কাঠুরে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, আমি কি তোমার প্রথম খাদ্য হব?
দুঃখমিশ্রিত হাসিতে সেই শিশু ব্যাঘ্রের মুখখানি মলিন হইয়া গেল। সে বলিল, আপনি কাঁপা বন্ধ করুন। একটা জরুরি কথা আপনাকে এখন বলতে চাই, মন দিয়ে শুনুন। আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আপনার কাঠ আমিই কেটে দেব। আপনি শুধু সেগুলো বেঁধে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবেন।
এমন আশ্বাস ও অভয়বাণী শুনিয়া কাঠুরে শান্ত হইল। তাহার চোখে জল আসিল। মাটি হইতে গামছা তুলিয়া চোখ মুছিয়া সে বলিল, তুমি নিশ্চয়ই বনেদি বংশের। তোমার শরীরে এক বিন্দু হলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই তোমাকে মানুষ করে দেন। আজ আমি চলি।
এই বলিয়া কাঠুরে তাহার ছোট কাঠের বোঝাটি মাথায় চাপাইয়া চলিয়া গেল বাজারের দিকে।
শিশু ব্যাঘ্রটি আবার চলিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে দেখিল, প্রখর রৌদ্রে এক কৃষক কাদা-জলে দাঁড়িয়ে ধানের চারা পুঁতিয়া দিতেছে। তাহার শরীর অনাহারে অর্ধাহারে পাকাটির মতো হইয়া গিয়াছে। দর দর করিয়া ঘামিতেছে অথচ কাজে বিরাম নাই। এই দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটির বড় মায়া জন্মিল। গুটি গুটি পায়ে সে কৃষকটির পিছনে গিয়া দাঁড়াইল।
কত দূর ধানের চারা পোঁতা হইল তা দেখিবার জন্য পিছনে ফিরিয়া কৃষকের চক্ষু চড়ক গাছে উঠিল। সে উল্টাইয়া কাদাজলে পড়িয়া গেল। সেই দৃশ্য দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটি মুচকি হাসিল। তারপর বলিল, আমাকে অনুগ্রহ করে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষের মাংস খাই না। নররক্তের স্বাদ কেমন তা আজও আমার জানা হয়নি।
কৃষকটি বলিল, তাহলে আমাকে দিয়েই কি শুরু করবে, বাবা?
শিশু ব্যাঘ্রটি বলিল, আমাকে বাবা বলেছেন মানে আমি আপনার সন্তান হলাম। বাবার প্রতি সন্তানের একটা দায়িত্ব থাকে না?
কৃষক জানাইল, আমার তো তিন ছেলে। কেউই তাদের দায়িত্ব পালন করল না। আমাকে খেয়ে তুমিই সেই দায়িত্বটা পালন করে দাও, বাবা।
আপনি অযথা ভয় করছেন। আমি এখন একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন আমিই আপনার ধানের চারা পুঁতে দেব। ধান বড় হলে কেটে, বেঁধে, ঝেড়ে, বস্তা বোঝাই করে ধান আপনার গোলায় তুলে দিয়ে আসব। আপনি শুধু বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসবেন।
কৃষক বলিল, তুমি কোন বাড়ির ছেলে বাছা? তোমার মনে এত মায়া কোথা থেকে এলো বাছা? তুমি নিশ্চয়ই বাঘবেশী কোনও দেবতা। যদি দেবতা না-ও হও, তাহলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত এক ফোঁটা হলেও তোমার শরীরে বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই যেন তোমাকে মানুষ করে দেন।
এই বলিয়া কৃষক বাড়ির পথ ধরিল। ব্যাঘ্রশাবকটিও চলিয়া গেল।
গুহায় ফিরিয়া বাবা-মা'কে যা যা দেখিয়াছিল সব কথা বিস্তারিত বলিতে লাগিল ব্যাঘ্রশাবকটি। শুনিয়া তাহার অভিভাবকরা চমকাইয়া উঠিল। সন্তানের এমত মতিগতি তাহাদের ভাল ঠেকিল না। তাহারা বুঝিল বিপদ আসন্ন। মনুষ্যপ্রজাতির হাতেই তাহাদের সন্তানের অনিষ্ট হইবে। পুত্র যাহাতে বুঝিতে না পারে সেইভাবে তাহারা ভিন্ন ভাষায় আলাপ করিতে লাগিল।
ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইয়ে জাগা ইসকে লিয়ে ঠিক নেহি।
ব্যাঘ্রমাতা বলিল, কিসি দুসরে জাগা পর ইসকো লে জানা চাহিয়ে।
-তুমহারি শ্বশুরাল জিস জঙ্গল মে হ্যায়, ওঁহা পর জানা সব সে সেফ হ্যায়।
-ঠিক কাহা আপনে। চলো, কাল হি নিকাল পড়তে হ্যায়।
ব্যাঘ্রশিশুটি পিতামাতার কোনও কথা বুজিতে না পারিয়া আকাশ দেখিতে লাগিল। অরণ্যানির মর্মরধ্বনি, দূরের ঝর্নার কলকল শব্দ, পাখির বিচিত্র গুঞ্জন, শুষ্ক পত্র ঝরিবার খসখস আওয়াজ শুনিতে লাগিল। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা কী বলছ গো?
ব্যাঘ্রমাতা বলিল, অনেক দিন এই বনে আছি। কাল আমরা তোর মামার বাড়ি যাব। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসব। তোর মামা খবর পাঠিয়েছে।
পরের দিন তাহারা বাহির হইয়া পড়িল। সকাল হইয়াছে। চারিদিকে কেবলই আলো। রাস্তা নির্জন বলিয়া ঘাসেদের তখন ঘুম ভাঙে নাই। ব্যাঘ্র-পরিবার সন্তর্পণে লোকালয়ের পাশ দিয়া চলিতে লাগিল। ব্যাঘ্রশিশুটি পুনঃ পুনঃ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া তাহাদের পুরাতন অরণ্যখানি দেখিতে লাগিল। তাহার মুখে খানিক দুঃখ লাগিয়া রহিয়াছে।
অকস্মাৎ এক কাণ্ড ঘটিল।
তাহারা দেখিল, পথের পাশে এক কাঠুরে তাহার পরিবারসহ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার হাতে গুড়-মুড়ি-বাতাসা-চিঁড়ে। তাহার চোখে জল।
ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইনি কে?
ব্যাঘ্রশিশুটি বলিল, প্রকৃত মানুষ।
তাহারা আবার চলিতে লাগিল। আরও একটি লোকালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখিল কেউ যেন কিছু হাতে লইয়া কারও জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কাছে যাইতে তাহারা দেখিল--এক কৃষক। তাহার হাতে রুটি-তরকারি। তাহার চোখে জল।
ব্যাঘ্রমাতা বলিল, ইনি কে খোকা?
ব্যাঘ্রখোকা বলিল, প্রকৃত মানুষ।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)