বাজারিকরণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বাজারিকরণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

King Kong Khan


বাজার যাহা বলে, তাহা ফলে?
...........................................

যার বিশেষায়িত জ্ঞাপন নেই, তার বাজারি অস্তিত্ব নেই। এই সরলমতি বাক্যবন্ধকেই নিয়তি ধরে বহুজাতিক সংস্থাগুলি বানাচ্ছে বিজ্ঞাপন-প্রকল্প। এটা কি ভিন্ন অর্থে 'পুশ সেলিং' নয়? কিন্তু বিপণন আধিকারিক এইভাবে বেচা-বাটার মধ্যে কোনও অনৈতিকতা দেখেন না। তাঁরও থাকে এক কর্তাপক্ষ। তিনিও কার্যত বিক্রিত। বিকৃত?  বিকারের প্রসঙ্গ এসে যায় কেন না এই জ্ঞাপন-প্রক্রিয়ায় 'অ-সত্য' বা তথ্য গোপনের মতো বিষয়গুলি থাকেই। ব্যাঙ্কের ঋণ সংক্রান্ত বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বা বীমার বিজ্ঞাপনক্ষেত্রগুলিতে সবচেয়ে জরুরি তথ্য সবচেয়ে দ্রুত পাঠ করা হয় কিংবা ছোটতম লিপিতে লেখা হয়ে থাকে। সংস্থাগুলি 'পোলিটিকালি ঠিক', তারা অবধ্য —অন্তত আইনি কুরুক্ষেত্রে। ভোক্তারাই ভোগে। আমাদের অনক্ষরতা, আমাদের অশিক্ষা এদের মূলধনের কিয়দংশ।
ছেলে ভুলানো ছড়ার মতো জনমন গলানো বিজ্ঞাপন যে আসলে একটি বড়তর চক্রের উপরিতল মাত্র —তা কারও অজ্ঞাত নয়। উষ্মা সেখানেই যখন একজন সাংস্কৃতিক তারকা তাঁর ভক্তকুলকে প্রতারিত করতে বিসর্গমাত্র ভাবেন না। ধরা যাক চিত্রতারকা শ্রী খান একটি ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে সুটোল হাসিতে জানাচ্ছেন, তাঁর 'বিশ্রী' থেকে 'শ্রীযুক্ত' এবং তাঁর সফলতায় ওই শ্রী-এর ইস্তেমাল কীভাবে তাঁকে আজ 'মহান' করে তুলেছে। এই কথাগুলো বলছেন কাদের? যারা তাঁকে ভালবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে, গ্রহণ করেছে, মান্যতা দিয়েছে। শ্রী খান কি জানেন না কী বিষয়ে কী কথা তিনি বলছেন বিপণন কর্মী চরিত্রে? চলচ্চিত্রে আমরা তাঁর খলনায়কোচিত রূপকে স্বীকার করে তাঁকে হিরোত্বে বরণ করে নিয়েছি। কিন্তু বিজ্ঞাপনে তো তিনি ব্যক্তিগতকে, সতত সততাকে বেচছেন । শ্রী খান, শ্রী কপুর, শ্রী সিং, শ্রী চট্টোপাধ্যায় —সবাই কি একই ক্ষমতার ভাষায় কথা বলছেন না? তাঁরা কি কার্যত দেশজোড়া অশিক্ষাকেই উপহাস করছেন না? লগ্নি / 'এনক্যাশ' করছেন না?  কাল্পনিকতা দিয়ে নিজেকে বৈধতা দিতে পারবেন কি বিজ্ঞাপনচিত্রে? প্রসঙ্গত কয়েকটি প্রশ্ন উপস্থিত হয়। শ্রম, অধ্যবসায়, মেধা নয় —সফলতা বহিরাঙ্গিক রূপ-নির্ভর। একটি শ্রীবর্ধক ক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, রূপ-বৃদ্ধি পুরুষটিকে হারেমের মালিক করে তুলেছে। নারীরা তার গুণমুগ্ধ কেন না তার ত্বক পূর্ববৎ 'নেটিভতা' হারিয়ে এখন উজ্জ্বল। জাতীয়তাবাদকে বিক্রি করছে কোনও সংস্থা। রাষ্ট্রপ্রীতিও পণ্য। এই পণ্যায়ন বিশেষ রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো-সম্মত। বেড়ালই এখানে ঘন্টা উৎপাদনের বিনিয়োগকারী। কে বাঁধে কী? কাকে?
চিন্তা অন্যত্র। এই কর্পোরেট বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলিতে যারা কর্মরত, যারা ভেবে চলেছে গণমন ভোলানোর করণ-কৌশল, ফিকির-ফন্দি —তারা কারা? মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবীরা। এই মেধা তো আত্মহন্তারক। অবক্ষয়ী। এই মেধা যে এক্সপ্লয়টেড মেধা তা এই মেধাবীরাও জানে। তাহলে? কী তাদের বিবেককে সংহত, সংযত রাখে? এর সঙ্গে কী বিধি-বদ্ধ আছে কোনও প্রতারণাময় অতীত যা তার প্রতারক সত্তাকে সেফ-গার্ড করে? নাকি কেবলই জীবনযুদ্ধ, মুদ্রারাক্ষস আর অস্তিত্বের সংকটের কাহানি? সমস্যা কি নিহিত আছে আমাদের শিক্ষাতন্ত্রে? শিক্ষাক্রম - শিক্ষক - শিক্ষণ : এই ত্রিবিধের যে বিজ্ঞাপন শিক্ষার্থী আশৈশব পেয়ে থাকে, 'ভূত' কি সেখানে? আমাদের শ্রেয়বোধ যত হ্রাস পাচ্ছে এই ভূতও কিন্তু তত মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে।
কবি শঙ্খ ঘোষ খেদোক্তি করেছিলেন, বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাচ্ছে মুখটাই। একুশ শতকের প্রথম দশকে মানুষ নিজেই হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপনের বর্ধিত অংশ। সে বিজ্ঞাপনের ভাষায় কথা বলে, বিজ্ঞাপিত স্বপ্নই এখন তার স্বপ্ন। বিজ্ঞাপনের অ-সত্য বা আধা-সত্যকে সে অনুমোদন দিয়েছে যেহেতু তার জীবনেও কম 'মিথ্যা' নেই। অন্তর-মুখ নিয়ে চিন্তিত নয়, সে বাহির-মুখাপেক্ষী এবং এই 'ঢাকা'টা তার সচেতন নির্বাচন। বরং বিজ্ঞাপনহীনতাই তাকে পীড়িত করে। সোশাল মাধ্যমে রেস্তোরাঁ ভ্রমণের ছবি অপ্রকাশিত থাকলে তার হৃদমাঝারে চিনচিন করে। এর উৎস কোথায়? এই জ্ঞাপন ও নিভৃতিবাসে তার প্রাপ্তি কী? ফিল্টার্ড আলোকচিত্র কি কারও কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সন্ধান দিচ্ছে? ধরা যাক দেয়, কিন্তু দিচ্ছে কি স্বস্তিসুখের সন্ধান? আসলে 'বাড়ন্ত বাচ্চাদের জন্য' যে পানীয় দরকার, 'প্রকৃত পুরুষদের জন্য' যে সুগন্ধি দরকার, 'রান্নায় স্বাদ আনতে' যে গুঁড়ো মশলা দরকার —সেই সবই বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রয়োজনীয়তা - বিকল্পহীনতার মাঝখানে থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। যেভাবে আমরা আমৃত্যু বিক্রিত হয়ে যাই।
আমরা বিজ্ঞাপনদাতারা কার্যত গোয়েবলস।

জিয়া হক