কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার: প্রশ্নে কবি প্রসূন মজুমদার


১) প্রথমেই তোমার নিজস্ব কবিতা-অভিপ্রায় সম্বন্ধে জানতে চাই।মানে কবিতার কাছ থেকে তুমি কী পেতে চাও?আর কী দিতে চাও কবিতায়?

আমার কাছে, কবিতার কাছ থেকে কিছু পেতে চাওয়া এবং কবিতাকে কিছু দিতে চাওয়ার বিষয়টি এক। একটু কনফিউজিং শোনাতে পারে। ব্যাখ্যা করছি। আমি মনে করি শিল্পী, বিজ্ঞানী, ভাবুক  হলেন আধার মাত্র। লেখনীও বলা চলে। প্রকৃতি কিছু কথা বলছে। আমি সেই সব কথার লেখনী কতদূর হয়ে উঠতে পারছি, তার উপর নির্ভর করে আমি কতদূর সেই কথাকে অনুবাদ করতে পারছি। আমি কিছু লিখছি না আসলে। লিখছে বা বলছে প্রকৃতিই। আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখছি প্রকৃতির কাছ থেকে আসা সেই বার্তাটুকুর জন্য। এই নিজেকে সর্বসময়ের আধার বা লেখনী হিসেবে প্রস্তুত করে রাখার নাম হল সাধনা। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি কবি আদৌ কিছু করছেন না? লিখছেন না তিনি? কথা বলছেন না? নিজে কিছু আবিষ্কার করছেন না? ধরুন বিজ্ঞান থেকে সুরকার থেকে কবি-- কে নতুন কিছু আবিষ্কার করছে বলুন তো? প্রকৃতিতে যা আসছে, তাকেই খুঁজে বের করছে। ডিসকভারি বলা যেতে পারে, প্রায় গোয়েন্দা বা ভ্রমণকারীর মতো বা এক বিজ্ঞানীর মতোই। যিনি মহাকাশে অনুভূতি পেতে আছেন, মহাকাশের রহস্যকে সামান্য হলেও জানার জন্য, তিনিও একপ্রকার কবিতাই লিখছেন। কিন্তু তাঁর খুঁজে যাওয়াটি হচ্ছে ভিন্ন পথে। আমরা সকলেই আসলে মহাবিশ্বজীবনের স্রোতের মধ্যে অবগাহন করে চেতনাকে বা চৈতন্যকে খোঁজার চেষ্টা করছি। আর প্রকৃতিই তার বার্তা আমার কাছে / আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত পাঠাচ্ছে। এই প্রতিনিয়ত পাঠানোর মধ্যে মধ্যে প্রকৃতি বিশেষ কোনও বার্তা বিশেষ ভাবে কখনও কখনও পাঠাচ্ছে। তাকে নির্বিশেষও বলা যেতে পারে। তখন শিল্পীর কাজ হল সেই নির্বিশেষকে বিশেষে অনুবাদ করা। তার লেখনীটিকে এই প্রকৃতির নির্বিশেষ থেকে বিশেষে অনুবাদ করার সময় প্রাসঙ্গিক, বোধসম্পন্ন, সময়ের ভাষায় শাণিত করে রাখাটাই শিল্পীর কাজ। এই সময়ের মধ্যে আবার মিশে থাকে সাম্প্রতিক ছাড়িয়ে সময়চেতনার সময়। কারণ একটি লেখার মধ্যে যেমন বর্তমান থাকে, তেমন থাকে অতীত এমনকী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এই সময়কে বলা যায় আবহমান সময়। আবহমান সময়কে সমসময়ে অনুভব করার কাজটি এবং সমসময়ের মধ্যে আবহমান সময়কে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতাই একজন লেখকের। আর এই কাজটি যিনি করতে পারেন, লেখার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পান। সারাজীবনের কবিতায় এই ব্যক্তিত্বকে খুঁজে চলা এবং আত্মবিশ্বস্ত থাকাটিই এক কবির উদ্দেশ্য। ফলে, আমার চাওয়া না চাওয়ার উপর কিছু নির্ভর করে না। আসল বিষয়টি হল, নিজেকে এক যোগ্য আধার হিসেবে প্রস্তুত রাখা। নিজেকে প্রকৃতির লেখনী করে তোলা। কবি কেবল উপলক্ষ্য মাত্র। আর কিছু না। 




২) এই মুহূর্তে দেশে চলছে একধরণের সংকীর্ণ হিন্দু-মৌলবাদের রাজত্ব। এই বিষয়ে তোমার ভাবনা আর ভিসনটা যদি স্পষ্ট করো...

ভিশন আর কী হবে! দেখতে পাচ্ছি গোটা দেশটাই চলেছে ফ্যাসিবাদের পথে। এক চরম মেরুকরণ চলছে। ইতিহাস বিকৃতি চলছে। এই সংকীর্ণ হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের এক সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নামা উচিত। প্রত্যক্ষ বিরোধিতা না করলে পরে এই ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। 



৩) মৃত্যুকে তুমি তো টেবিল - দূরের সন্ধ্যার মতো দেখে এলে,তাই জানতে চাইছি মৃত্যু সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?

উপনিষদ  তো অনেক আগেই ভাবা হয়েছে অনেক কিছু। বার্গম্যান ভেবে গেছেন। দাবা খেলার মতো। অনেক ধরনের ভাবনা আছে। আলাদা ভাবে কোনও ভাবনাকে আমি সত্য বলে মনে করি না। কারণ গোটাটাই তো কল্পনা।

৪) গদ্য আর কবিতা দুই ভাষাতেই লিখেছো তুমি।দুটো মাধ্যমের আঙ্গিকগত পার্থক্য নিয়ে কী ভাবো?

এ আবার কী প্রশ্ন! গদ্য আর কবিতা আলাদা কোনও ভাষা কি? আলাদা দুটি আঙ্গিক। একটা গদ্য আর একটা কবিতা। এখানেই তো পার্থক্য। আবার কী পার্থক্য হবে!

৫) প্রাতিষ্ঠানিকতা কী কবির বা লেখকের ক্ষতি করে বলে মনে হয়?

প্রশ্নের প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে যদি বোঝায় কোনও বিশেষ বা বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে লেখার বিষয়, তাহলে বলি এসব কোনও কবি বা লেখকের ক্ষতি আদৌ করে না। কোনও লেখক যদি তাঁর ব্যক্তিত্ব, ভাবনাকে অক্ষুন্ন রেখে প্রতিষ্ঠানে লিখতে পারেন, তবে তিনি সজাগ এবং জীবিত লেখক। আর একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক যদি নিজের লেখার প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে হেরে যান, বা বিশেষ কোনও মতবাদ বা গোষ্ঠীবাদ বা বিশেষ কিছু কিছু মানুষের ভাবনা দ্বারা চালিত হন, তাহলে তিনি ঘোষিত সরব অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও মৃত লেখক। অপ্রাতিষ্ঠানিকতার অর্থ নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া। নিজেকে বারবার ভাঙা। এ যুদ্ধ প্রতিষ্ঠানে লিখেও হয়। ক্ষতিটা আসলে তখন হয়, যদি সেই লেখক নিজের আপাত সফল ইমেজের কাছে হেরে গিয়ে তাকেই বারবার রিপিট করতে থাকেন, নিজেকে আক্রমণ করেন না। আর এই সময়ে তো এই প্রাতিষ্ঠানিকতা বা অপ্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনার মানে নেই। কারণ বিষয়গুলি আর সেভাবে নেই। বরং লেখকদের ভাবা উচিত  কীভাবে নিজের কথাগুলি বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর এটি এক প্রকৃত সাবভারসিভ রাজনীতির কাজ। তথাকথিত রাজনীতির না, রাজনীতিকেও যা চালায়, তার কাজ। 



৬)রুচির শুদ্ধতায় বিশ্বাস করো?

রুচিবোধে বিশ্বাস করি, তবে শুদ্ধতা বলতে কী বোঝায়? সব ভীষণ আপেক্ষিক। তথাকথিত পুণ্যবান হওয়ার চেয়ে বরং পাপ করা ভাল। রুচি বলতে ভাবনার সততা বললে অবশ্যই তার শুদ্ধতায় বিশ্বাস করি। নির্মিত সত্যই হল রুচির অশুদ্ধতা। এই ম্যানুফ্যাকচার্ড বা ম্যানিপুলেটেড সত্যই হল বিকৃত রুচি।

৭) শহরের জীবনে বাংলা ভাষার যে বিপর্যয় সেটা নিয়ে কী ভাবছো?

দ্য চেয়ার ইজ সো ছোট দ্যাট আই হ্যাভ টু সিট হাঁটুমুড়ে। এই তো আজকের ভাষা। এই বিপর্যয় বাংলা ভাষার শহুরে বিপর্যয় ডেকে আনছে সন্দেহ নেই। তবে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের বেটন তো কলকাতা বা নগর গুলো ধরে নেই। ধরে আছে মফস্বল, গ্রাম, জেলা, বাংলাদেশ, প্রবাসী বাঙালি এবং ইন্টারনেট। ফলে একটা কাউন্টার স্ট্রাগলও চলছে। কলকাতার কিছু হবে না। এখানে বাঙালিরাও নিজেদের শ্রদ্ধা করে না আর। আশা করি অন্যত্র তা থাকবে না।

৮) ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছো?

ভাবছি, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইজরায়েলের কোনও কবি কী ভাবছে।

৯) পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভাবনা কী?

হয় বিজেপি আসবে নয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রবল হিন্দু করে ছাড়বে। এই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। তাতে তারা সফল। এখানে তাদের বিরোধীরাও রামনবমী আর হনুমানজয়ন্তী পালন করে। তারা আর হিন্দুত্বের বিরোধিতা কী করে করবে! এখানে কয়েকদিনের মধ্যে না রিয়ালিটি শো হয়-- প্রমাণ কর, কারা প্রকৃত হিন্দু! 
এক কথায় অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তবু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই চলছে আর চলবেও। কিন্তু অর্গানাইজড ফ্যাসিস্ট পলিটিক্সের বিরুদ্ধে লড়ার মতো মতাদর্শগত লড়াইটাই বা কই?

১০) সম্প্রতি একটি পত্রিকা আর তার ব্লগ ভার্সান-এর সম্পাদক তুমি।সম্পাদক হিসাবে তোমার ভাবনা যদি জানাও.

আবহমান একটি ছ মাস অন্তর মুদ্রণ পত্রিকা এবং এক মাস অন্তর ওয়েব ভার্সন পত্রিকা। আমরা চেষ্টা করছি বাংলা সাহিত্যের আবহমান যে ধারা তাকেই তুলে ধরতে। বাংলা মেন্সট্রিম সাহিত্যে গদ্যসাহিত্য- গল্প , উপন্যাস এগুলির তো খুব খারাপ অবস্থা। বলা যেতে পারে বাংলা মেনস্ট্রিমের গল্প উপন্যাস পড়লে ( আর যদি কেউ বিশ্ব সাহিত্য পড়ে থাকেন, বা বাংলার আবহমান গদ্য সাহিত্য) মনে হয় বিশ্ব সাহিত্য যদি মেসি হয়, তাহলে বাংলা সাহিত্য ষষ্ঠী দুলে। অবশ্য সমস্যা হল রোনাল্ডো, নেইমাররা নির্জনেই লিখে যাচ্ছেন। তাঁদের লেখাপত্র নিয়মিত প্রকাশ করাটিও আমাদের একটি উদ্দেশ্য। আর ঠিকঠাক সমালোচনা সাহিত্যের একটি ধারা তৈরি করাও আমাদের একটি লক্ষ্য। নতুনদের প্রাধান্যই দিচ্ছি এবং তার সাথে প্রকৃত মেজর কবি সাহিত্যিকদের লেখা তুলে ধরছি। অনেক তরুণ কবিই অনেক কিছু পড়েননি। তাঁদের দোষ না। সঠিক বইগুলি যদি এখন পাওয়া না যায় কী করা যাবে। সাহিত্য নিয়ে সিরিয়াস কাজ করাটাই লক্ষ্য। অনেকটা স্প্যানিশ গ্রানাডার মতো। দেখি, পারি কিনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Share. Comment. Subscribe