এখন এই ‘রয়্যাল’ দলটি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে যে গ্রহেরা মেনে চলবে মহাকর্ষ
বলের বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র। কিন্তু একটাই সমস্যা, তাঁদের কেউ এটা প্রমাণ করতে
পারছেন না গাণিতিকভাবে। মহাকর্ষ বল বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র মেনে চললে যে গ্রহের
চলার পথ উপবৃত্তাকার হবেই, এটা প্রমাণ করা খুব দরকার। নইলে কোন দিন দেখা গেল নতুন একটা
গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেল যে মহাকর্ষ বলের ওই সূত্র মেনে চলেও হয়তো অন্য কোনওরকম পথে ঘোরে।
ক্রিস্টোফার আর এডমণ্ড তো স্বীকার করে নিলেন, তাঁদের দ্বারা এই প্রমাণ করা সম্ভব না।
রবার্ট হুক চিরাচরিত পথেই হার না মানা ভঙ্গিতে বললেন, তিনি যদি একটানা এই সমস্যাটা
নিয়ে লেগে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই সমাধান করে ফেলতে পারবেন।
ক্রিস্টোফার এই শুনে বললেন, যদি এডমণ্ড বা হুক, এঁদের কেউ দু’মাসের মধ্যে
এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন, তবে তিনি এই মুহূর্তে বাজি ধরলেন, তাঁকে দুই পাউন্ড
দামের একটি বই উপহার দেবেন।
এরপরে আড্ডা শেষে যে যার বাসায় ফিরে গেলেন। হ্যালিকে পারিবারিক ব্যবসায়
এখন সময় দিতে হয় আগের চেয়ে বেশি, কারণ তাঁর বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন সদ্য। তো
ব্যবসার কাজে সময় দিতে হলেও তাঁর মাথার মধ্যে কিন্তু ঘুরছিল ওই গ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত
সমস্যাটা।
একদিন হ্যালি ভাবলেন একবার কেমব্রিজ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। আগস্ট মাসে একদিন কেমব্রিজের ট্রেনে চেপে বসলেন এডমণ্ড
হ্যালি, উদ্দেশ্য ট্রিনিটি কলেজে গিয়ে দেখা করা সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি এই সমস্যার
সমাধান করতে সবচেয়ে উপযুক্ত লোক।
নিউটন তখন নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন। কলেজে তাঁকে ক্লাসও নিতে হয়না
আর, ছাত্ররা, তিনি দেখেছেন প্রাকৃতিক দর্শনের ক্লাস করতে মোটেই আগ্রহী নয়। এমন অনেকবাওই
হয়েছে, তিনি শূন্য ক্লাসরুমে একাই লেকচার দিয়ে গিয়েছেন। এখন আর সেটাও করেননা।
ব্যক্তিগত জীবনেও শোকের সময় চলছে তখন তাঁর। বছর পাঁচেক আগে তাঁর মা হানা
ম্যালিগন্যান্ট জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিংকনশায়ারে তাঁর কাছে গিয়ে
নিউটন শেষ কয়েক দিন সেবা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু মাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি।
তবে মায়ের মৃত্যুতে নিউটন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছেন, এটাও বলে নেওয়া
দরকার। তিনি ছিলেন বড় সন্তান, সুতরাং মায়ের বেশিরভাগ সম্পত্তি তিনিই পেলেন।
আরও একটা আঘাত পেলেন নিউটন, যখন তাঁর কুড়ি বছরের গৃহসঙ্গী তাঁর সঙ্গ ছেড়ে
চলে গেলেন অন্যত্র। এই সঙ্গীর নাম জন উইকিনস, বা উচ্চারণের তফাতে অনেকে উইকেনস বলেন
(নিউটনের সঙ্গে তাঁর সমকামী সম্পর্ক থাকলে থাকতে পারে বলে অনুমান করেছেন অনেকে, তবে
এর কোনও সলিড প্রুফ নেই)। স্টক এডিথ-এর পেরিশ চার্চের মিনিস্টারের দায়িত্ব নিয়ে চলে
যান তিনি; বিয়েও করেন, পরে নিকোলাস নামে তাঁর একটি ছেলেও জন্মায়, সুখেই ঘরকন্না করতে
থাকেন উইকিনস। বেচারা নিউটন হয়ে পড়লেন সঙ্গীবিহীন। পরবর্তীকালে তাঁদের আর কখনও দেখাসাক্ষাতই
হয়নি, সামান্য দু’চারটে চিঠির আদানপ্রদানেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তাঁদের যোগাযোগ।
সব মিলিয়ে নিউটন এখন বিষণ্ণ, উদাসীন এক জীবন কাটান। ভালো করে খান না, তাঁর
সর্বক্ষণের সঙ্গী হামফ্রে নিউটনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এইসময় তিনি টেবিলে খেতেও
বসতেন না। মাঝেমাঝে দু’এক চামচ খাবার ইচ্ছে হলে মুখে দিতেন, আর তাঁকে দেখেই বোঝা যেত—
সারাক্ষণই কিছু একটা নিয়ে যেন ভেবেই চলেছেন। আপনমনে পায়চারি করেন, রাতে ঘুমোতে যান
দেরি করে, সকালে উঠে পড়েন পাঁচটা ছ’টার মধ্যে। শুতে যাওয়ার সময় পোশাকও বদলান না; চুল
অবিন্যস্ত থাকে, চিরুনির স্পর্শ পড়ে না। এই ধরনের আচরণ সাহেবদের কাছে একবারেই অপ্রত্যাশিত।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি এইসময় তারিখ বা দিনরাত সম্বন্ধেও উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন।
তাঁর এইসময়কার চিঠিতে বা লেখাপত্রে প্রায়ই দেখা যায় ভুল তারিখ বা বার লিখে ফেলেছেন।
হ্যালি এসব কিছুই জানতেন না। তাঁর সঙ্গে নিউটনের এর আগে একবারই সাক্ষাৎ
এবং আলাপ-পরিচয় হয়েছিল লন্ডনে, এবারে তিনি যে এখানে আসছেন, সেটা চিঠি লিখেও জানাননি।
তবে এসে দেখলেন, তাঁর আগমনে নিউটন বিরক্ত হন নি মোটেই। বরং বেশ স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের
কথাবার্তা আরম্ভ হল।
অন্য নানা প্রসঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পর আসল প্রসঙ্গ এল; নিউটনকে
হ্যালি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, যদি একটা গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক
হারে মহাকর্ষ বল অনুভব করে, তবে আপনি কী মনে করেন, ওই গ্রহের গতিপথ কীরকম হওয়া উচিত?’
নিউটন, শুনেই নাকি বলে ওঠেন, ‘কেন, উপবৃত্তাকার!’
হ্যালি তো আনন্দ আর উত্তেজনায় হতবাক, আমতা আমতা করে বললেন, ‘কী করে জানলেন?’
নিউটন স্বভাবসিদ্ধ শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমি কষে দেখেছি।’
‘তা আমাকে সেই হিসেবটা একটু দেখাতে পারেন?’
নিউটন এই কথা শুনে কিছুক্ষণ তাঁর কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখলেন, তারপর বললেন,
‘নাহ, খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, আর একবার কষে পরে তোমায় পাঠাব’খন।’ [*/ নিউটন-হ্যালি
এই কথোপকথনের কথা জানা যায় অনেক বছর পরে এক ফরাসী আব্রাহাম দি ময়ার-এর লেখা থেকে, ইনি
সেইসময় নিউটনের সঙ্গেই থাকতেন, তবে তাঁর কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য না যদিও; কিন্তু
কী আর করা যাবে, এ ছাড়া আর কোনও স্মৃতিকথা নেই যে কারও!]
নিউটনের জীবনীলেখক অনুমান করেন, তাঁর এই হিসেবটা কষে ফেলবার পর সেটা আবার
হারিয়ে ফেলার কথাটা একেবারে মিথ্যে। আসলে তিনি চেয়েছিলেন তিনি যে এটা পেরেছেন এই কথাটা
ছড়িয়ে পড়ুক; আর পরে তিনি যখন এটা সত্যিই কষে সবাইকে দেখাবেন, তখন এর সময়কাল কিছুটা
আগের বলে চালানো যাবে।
তবে এটাও ঠিক, নিউটন কোনও একটা মনোমত সমস্যা পেলে সেটার সমাধান শেষ না করা
অব্দি থামতেন না। সুতরাং এই হিসেবও দিন রাত খেটে তিনি অবশেষে করে ফেললেন।
সেই বছরেই নভেম্বর মাসে হ্যালি একটা ন’পাতার চিঠি পেলেন। তাতে সুন্দর করে
গুছিয়ে গ্রহের গতিপথ আর বর্গের ব্যস্তানুপাতিক সূত্রের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা
আছে। আর এই লেখাতেই একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, ব্যাপারটা পরে বই হয়ে উঠতে পারে!
লেখাটির ল্যাটিন নাম ‘De Motu Corporum in gyrum; ইংরেজিতে দাঁড়ায় –
’‘On the Motion of Bodies in an Orbit’। বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি বিখ্যাত পেপার। জানুয়ারিতে
যে সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন তিন মূর্তি, সেটার সমাধান অবশেষে এল নভেম্বরে। আনন্দিত
আর বিস্মিত হ্যালি আরও একবার কেমব্রিজে ছুটলেন নিউটনকে জিজ্ঞেস করে আসতে, তাঁর পেপারটি
রয়্যাল সোসাইটিতে পেশ করা যাবে কি না।
নিউটনের সম্মতিতে ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে রয়্যাল সোসাইটির মিটিং-এ হ্যালি
পেশ করলেন সেই পেপার। তখন সোসাইটির নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন স্যামুয়েল পেপিস। সকলের
সম্মতিতে ফেব্রুয়ারি মাসে এই পেপারটি প্রকাশিত হল সোসাইটির ট্র্যাঞ্জ্যাকশনে।
তবে নিউটন পেপার লিখেই ক্ষান্ত হলেন না, তখন তাঁর মনের মধ্যে ভাবনার স্রোত
বইতে শুরু হয়ে গিয়েছে— এই পেপারটাকে ফুলিয়ে বইয়ের আকার দেওয়ার। সুতরাং আগামী কয়েক মাসের
জন্য তিনি তাঁর অ্যালকেমিচর্চা সাময়িকভাবে থামিয়ে দিলেন, টানা পনেরো মাসের পরিশ্রমে
শেষ হল এই বইয়ের প্রথম অংশের খসড়া।
ক্রমশর
দ্বিতীয় পর্ব
[*/ Gale E. Christianson-এর নিউটন জীবনী থেকে এই অংশের অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে।]
ক্রমশর
দ্বিতীয় পর্ব
[*/ Gale E. Christianson-এর নিউটন জীবনী থেকে এই অংশের অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে।]