বিজ্ঞান রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বিজ্ঞান রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

প্রিন্সিপিয়ার ইতিহাস এবং । দ্বিতীয় পর্ব । অর্পণ পাল



১/ লেখা শুরুর পর থেকে প্রকাশ অব্দি।।
প্রিন্সিপিয়ার বিষয়বস্তু আইজ্যাক নিউটনের মাথায় ঘুরছিল এডমন্ড হ্যালির সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার অন্তত বছর ছয়েক আগে থেকেই। সে সময়েই তাঁর আবিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে যে সূর্যের চারদিকে যে পৃথিবী ঘোরে (বা পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ)— এই ঘোরবার জন্য প্রয়োজনীয় আকর্ষণ বল বিপরীত বর্গের সূত্রই মেনে চলে (অর্থাৎ দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, আকর্ষণ বল সেই দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে কমতে থাকে)। তবে এরপরেই তাঁর জীবনে চলে আসে একের পর এক মৃত্যুর স্রোত। ১৬৭৭ সালে প্রয়াত হন তাঁর কাছের দু’জন— কেমব্রিজের প্রাক্তন লুকাসিয়ান অধ্যাপক আইজ্যাক ব্যারো আর রয়্যাল সোসাইটির প্রথম সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গ, আইজ্যাককে আরও একটু নিঃসঙ্গ করে দিয়ে। এমনিতে তিনি উইকিনস ছাড়া তাঁর বাড়িতে সঙ্গ দিতেন না কাউকেই, উপরন্তু ১৬৭৯ সালের মে মাসে ন’দিনের জন্য লন্ডন থেকে ঘুরে এসে তিনি খবর পান তাঁর মায়ের শরীর খুব খারাপ।
খবরটা পেয়েই তিনি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গ্রামে মায়ের পাশে থেকে দিন কয়েক সেবা করবার পরেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় (মায়ের পাশে সারারাত জেগে থাকতেন তিনি, মায়ের ফোঁড়া নিজে হাতে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিতেন)। হানাকে তাঁর প্রথম স্বামীর পাশেই কবরস্থ করা হয়। আইজ্যাক, আশা করা যায় এই ব্যাপারে অন্তত সন্তুষ্টই হয়েছিলেন।
সম্পত্তির দেখাশোনা এবং মায়ের কিছু পাওনা আদায় করতে গ্রামের বাড়িতে এরপর আইজ্যাক থেকে যান মাস কয়েক। কেমব্রিজে যখন ফিরে আসেন, তখন দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছে; তাঁর শূন্য বাড়িতে শুধু জমে আছে এক গুচ্ছ চিঠি। যার মধ্যে একটি এসেছে রয়্যাল সোসাইটি থেকে, প্রেরকের নাম রবার্ট হুক।
চিঠির উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না, তবু চিঠিটা পড়ে দেখলেন, সেখানে উল্লেখ করা আছে একটা বহুদিনের পুরনো সমস্যার। হুক উৎফুল্লভাবে জানিয়েছেন, তিনি গ্রহের গতি সংক্রান্ত কিছু নতুন ধারণা আবিষ্কার করেছেন এবং এ ব্যাপারে আইজ্যাকের মতামত চান। এ ব্যাপারে যদি আইজ্যাকের কিছু দ্বিমতও থাকে, সেটা জানালেও হুক আনন্দিত হবেন। আর এ সব তিনি গোপন রাখবেন।
আইজ্যাক হুককে জানান তাঁর মানসিক অবস্থার কথা, আর সেই সঙ্গে এ-ও জানান, এই ব্যাপারে (গ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত ব্যাপারে) তাঁর জ্ঞান যথেষ্টই কম। তিনি শুধুমাত্র পৃথিবীর আহ্নিক গতি সম্বন্ধে কিছু ধারণার কথা বলে চিঠি শেষ করেন।
প্রসঙ্গটা এই, অনেকেই এর আগে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য খুব উঁচু একটা টাওয়ার থেকে যদি কেউ কিছু নিচের দিকে ফেলে, তবে সেটা কি একেবারে নিচে না পড়ে কিছুটা এগিয়ে, বা পিছিয়ে গিয়ে পড়বে? কারণ ওই পতনকালের মধ্যেই তো পৃথিবী সামনের দিকে বা পিছনের দিকে অল্প হলেও সরে যাবে।


ছবি- ১। রবার্ট হুক। রিটা গ্রিয়ার-এর আঁকা।

রবার্ট হুকের সঙ্গে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আইজ্যাকের বিরোধ বেধে যায় এরপরে কয়েক মাসের মধ্যে, এবং সেই বিরোধের রেশ চলেছিল ১৭০৩ সালে রবার্ট হুকের মৃত্যু অব্দি। দুজনের সম্পর্ক কখনওই আর স্বাভাবিক হয়নি। রবার্ট হুক আর আইজ্যাক নিউটনের বিরোধ সতেরো শতকের বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় ঘটনা। আমরা অন্য অধ্যায়ে এই প্রসঙ্গ আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

২/
গোটা ১৬৮৫ সাল আইজ্যাক নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন এই বইটি লেখবার কাজে। এপ্রিল আর জুন মাসে মাত্র দু’বার তিনি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন, সপ্তাহদুয়েক করে থেকে কিছু কাজ সেরে আসবার জন্য। তাঁর অন্য যে কাজে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল, সেই অ্যালকেমিবিদ্যার চর্চাও এইসময় প্রায় বছর দেড়েক বন্ধ রেখেছিলেন এই বইটি লেখার জন্য। তখন তিনি নতুন সহকারী পেয়েছেন এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় হামফ্রে নিউটনকে। হামফ্রে এসেছিল গ্র্যান্টহ্যাম থেকে, আইজ্যাক নিউটনের কাছে থেকে পড়াশুনো করবার জন্য। মূলত আইজ্যাক নিউটনের লেখাপত্র বা যন্ত্রপাতি গুছিয়ে দেওয়া— এইসবই করত সে। প্রিন্সিপিয়া বইটি সে কপিও করে দিয়েছিল, শোনা যায়। মজা করে অনেকে বলেন, হামফ্রে যা টুকতেন তার সবই প্রায় না বুঝেই টুকতেন।
প্রিন্সিপিয়া লেখাকালীন সময় দিন কয়েক শুধু এই লেখার জন্যই আইজ্যাক যোগাযোগ রেখেছিলেন তখনকার ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল জন ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বহু তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নিউটনকে। তবে নিউটন তাঁকে ঘুণাক্ষরেও বলেন নি যে তিনি একটি বিরাট বই লিখছেন, আর এই তথ্যগুলো চাওয়া হচ্ছে সেই বইয়ের প্রয়োজনেই। পরে তাঁর বইয়ে অবশ্য আইজ্যাক ফ্ল্যামস্টিডের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি।
হামফ্রে নিউটনের স্মৃতির কিছুটা উল্লেখ করা যেতে পারে—
I never saw him take any recreation or pastime, either in riding out to take the air, walking, bowling, or any other exercise whatever. Thinking all hours lost that were not spent in his studies, to which he kept so close that he seldom left his chamber… so intent, so serious [was he] … that he ate very sparingly, nay, sometimes he forgot to eat at all, so that going into his chamber, I have found his mess untouched. When I have reminded him, he would reply: Have it! Then making to the table, would eat a bit or two standing, for I cannot say, I ever saw him sit at table by himself.’ (নিউটনের জীবনীকার জন কন্ডুইটের কাছে স্মৃতিচারণ)
শুধু একটা ঘটনাতেই মাঝখানে একবার আইজ্যাক বিচলিত হয়েছিলেন, যখন খবর পেয়েছিলেন যে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। সেটা ১৬৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। রাজার ভাই দ্বিতীয় জেমস দায়িত্ব নিয়ে দেশটাকে ক্যাথলিক হিসেবে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারেন এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আইজ্যাক দ্বিতীয় চার্লসকে অনেক ব্যাপারে অপছন্দ করলেও দ্বিতীয় জেমসকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। সুতরাং তাঁর মনে কিছুটা দুশ্চিন্তা জাগল এইসময়। আর এই দুশ্চিন্তার কারণেই হয়তো, তিনি লেখবার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন।
বইটা মোটামুটি সম্পর্কযুক্ত তিনটি খণ্ডের হতে চলেছে, একটি ভূমিকা সহ— তিনি ঠিক করে ফেলেছেন ততদিনে। প্রথম খণ্ডে থাকবে তাঁর সেই গতিসূত্র তিনটি আর সেগুলো নিয়ে আলোচনা; দ্বিতীয় খণ্ডে বিভিন্নরকমের বল আর সেই বলের প্রভাবে বস্তুর গতি, উদস্থৈতিকবিদ্যা (Hydrostatics), উদগতিবিদ্যা (Hydrodynamics), শব্দ, তরঙ্গ আর স্রোত নিয়ে আলোচনা; আর তৃতীয় খণ্ডে থাকবে বিভিন্ন বলের প্রভাবে বস্তুর গতির বাস্তব কিছু উদাহরণ যেমন গ্রহ বা উপগ্রহের গতি, ধূমকেতুর গতি ইত্যাদি— এইভাবে মোটামুটি বইটাকে সম্ভাব্য সজ্জায় সাজানো হল। তবে প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন বইয়ের সম্ভাব্য খণ্ড হবে দুটি— প্রথমটি হবে ‘De motu Corporum, Liber primus, আর De motu corporum, secundus’। পরে তিনি মত পাল্টে একটি খণ্ড বাড়িয়ে দেন। তাঁর তৈরি ওই প্রাথমিক বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটি, যেটা লেখা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায়, তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় আলাদাভাবে, তবে সে প্রসঙ্গ পরে।
আইজ্যাক এটাও ভেবে রেখেছিলেন, তাঁর বই হবে একেবারেই বোদ্ধা পাঠকদের জন্য। সাধারণের বোধগম্য যাতে না হয়, সেদিকে নজর ছিল তাঁর। সে জন্য তিনি লিখলেন ল্যাটিন ভাষায়, আর পরবর্তীকালেও এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে যথেষ্ট দেরি করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র বছরখানেক আগে প্রিন্সিপিয়া ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
ইচ্ছে করেই আইজ্যাক তাঁর বইটাকে লিখেছিলেন এমনভাবে, যাতে সাধারণ পাঠকের পড়তে অসুবিধা হয়। এক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর বইটি পড়ে বুঝতে গেলে আগে সেই মানুষকে ইউক্লিডের চোদ্দ খণ্ডের ‘এলিমেন্টস’, জ্যামিতি আর বীজগণিতের একাধিক পুরনো বই, জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে কোপারনিকাসের বই— এরকম বেশ কিছু বই পড়ে তবে মাঠে নামতে হবে।

৩/
প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ডের প্রাথমিক খসড়া শেষ হল ১৬৮৬-এর এপ্রিল মাসে। সেটা নিউটন পাঠালেন লন্ডনে, রয়্যাল সোসাইটিতে। হ্যালি ততদিনে সোসাইটিতে বইটি প্রকাশের ব্যাপারে প্রাথমিক জমি তৈরি করে রেখেছেন। এদিকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে নতুন অতিথি— ১৬৮৫ এর এপ্রিলে তাঁদের একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু তাঁর নিজের তখন সোসাইটিতে অবনমন হয়েছে। এতদিন ছিলেন ফেলো এবং কাউন্সিলের সদস্য, ১৬৮৬ এর ২৭ জানুয়ারি থেকে তিনি হয়েছেন ক্লার্ক। তাঁর বছরে পঞ্চাশ পাউন্ড মাইনে নির্ধারিত হয়েছে। [অনেকে মনে করেন বাবার মৃত্যুর পর এডমন্ড হ্যালির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই চাকরিটি তিনি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু এই সময়ে তাঁর অন্য উপার্জনও ছিল, তিনি বাবার এস্টেট থেকে বছরে প্রায় দুশো পাউন্ড পেতেন]


ছবি-২। এডমন্ড হ্যালি। থমাস মারে-র আঁকা।

তবু হ্যালি এক মাসের মধ্যে সোসাইটির মিটিং থেকে বইটি প্রকাশের জন্য অনুমতি আদায় করে নিলেন। তবে সোসাইটির পরের মিটিং হতে একটু দেরি হল, মে মাসের উনিশ তারিখের মিটিং-এ ঠিক হল বইটি সোসাইটির খরচের ছাপা হবে। আবার এর পরের মিটিং-এ, জুনের ২ তারিখে সিদ্ধান্ত হল বইটির ছাপাবার যা কিছু খরচ, সব দেবেন এডমন্ড হ্যালি নিজেই, তাঁর ট্যাঁক থেকে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজেই, বইটির প্রকাশ যাতে আটকে না যায় সেজন্য। কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? আসলে সোসাইটির বইটি ছাপাবার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তখন। প্রয়োজনীয় পাউন্ড না থাকার কারণটাও ভারী অদ্ভুত। রয়্যাল সোসাইটি তখন অর্থকষ্টে জেরবার অন্য একটি বই ছেপে বিপুল লস খাওয়ার ফলে। আজ এসব ইতিহাস শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে, আইজ্যাক নিউটনের অত বিপুল বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া’ প্রকাশিত হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল যে বইটির কারণে, সেটার নাম ‘Historia Piscium’, বা ‘History of Fishes’, যার লেখক John Ray আর Francis Willughbyসচিত্র এই মৎস্যবিষয়ক বইটি নিয়ে সোসাইটির আশা বা উচ্চাশা ছিল বিরাট, অনেকটা বড় বাণিজ্যিক ব্লকবাস্টার ছবি ফ্লপ হওয়ায় প্রযোজকদের মাথায় যেমন হাত পড়ে, সেরকমই; পরবর্তী সিনেমায় ইনভেস্ট করবার মতো ট্যাঁকের জোর নেই আর তাঁদের।
সুতরাং এডমন্ড হ্যালির আগ্রহে এবং আর্থিক সাহায্যের ফলেই ১৬৮৭-এর জুলাই মাসে প্রকাশিত হল প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ড। বইটি প্রকাশের আগে আরও কিছু নাটকীয় ব্যাপার ঘটেছিল, যার জন্য এর প্রকাশ হওয়াটাই প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তখন রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি রবার্ট হুক, যাঁর সঙ্গে বিরোধের জন্যেই মূলত প্রিন্সিপিয়ার আকাশে কালো মেঘ দেখা দেয় গোটা ১৬৮৬ সাল জুড়ে। তবে সে প্রসঙ্গ পরের পর্বে।

প্রিন্সিপিয়ার ইতিহাস এবং : অর্পণ পাল



এই কাহিনির শুরু ১৬৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে। সেবারে লন্ডনে ঠাণ্ডাটাও পড়েছিল একেবারে হাড়কাঁপানো। টেমস নদীর জল জমে গিয়েছিল পুরো। সেই রকম এক ঠাণ্ডা দিনে রয়্যাল সোসাইটির একটি অধিবেশনের শেষে সেখানকার তিন সদস্য-বন্ধু কাছাকাছি একটি কফি হাউসে কফি খেতে আর গল্প করতে একত্রিত হলেন। তিনজন আমাদের পূর্বপরিচিত— এডমণ্ড হ্যালি, রবার্ট হুক আর ক্রিস্টোফার রেন। তাঁদের মধ্যে শুরু হল গ্রহের গতিপথ নিয়ে আলোচনা। কিন্তু সে পথ কেমনতর, তা তো অনেক আগে থেকেই জানা। জোহানেস কেপলার তো পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে তথ্যপ্রমাণ-সহযোগে বলে গিয়েছিলেন, গ্রহের গতিপথ হবে উপবৃত্তাকার। সে না হয় হল, কিন্তু গ্রহেরা কোন সূত্র মেনে ঘুরে চলে সূর্যের চারপাশে?
এখন এই ‘রয়্যাল’ দলটি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে যে গ্রহেরা মেনে চলবে মহাকর্ষ বলের বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র। কিন্তু একটাই সমস্যা, তাঁদের কেউ এটা প্রমাণ করতে পারছেন না গাণিতিকভাবে। মহাকর্ষ বল বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র মেনে চললে যে গ্রহের চলার পথ উপবৃত্তাকার হবেই, এটা প্রমাণ করা খুব দরকার। নইলে কোন দিন দেখা গেল নতুন একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেল যে মহাকর্ষ বলের ওই সূত্র মেনে চলেও হয়তো অন্য কোনওরকম পথে ঘোরে। ক্রিস্টোফার আর এডমণ্ড তো স্বীকার করে নিলেন, তাঁদের দ্বারা এই প্রমাণ করা সম্ভব না। রবার্ট হুক চিরাচরিত পথেই হার না মানা ভঙ্গিতে বললেন, তিনি যদি একটানা এই সমস্যাটা নিয়ে লেগে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই সমাধান করে ফেলতে পারবেন।
ক্রিস্টোফার এই শুনে বললেন, যদি এডমণ্ড বা হুক, এঁদের কেউ দু’মাসের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন, তবে তিনি এই মুহূর্তে বাজি ধরলেন, তাঁকে দুই পাউন্ড দামের একটি বই উপহার দেবেন।
এরপরে আড্ডা শেষে যে যার বাসায় ফিরে গেলেন। হ্যালিকে পারিবারিক ব্যবসায় এখন সময় দিতে হয় আগের চেয়ে বেশি, কারণ তাঁর বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন সদ্য। তো ব্যবসার কাজে সময় দিতে হলেও তাঁর মাথার মধ্যে কিন্তু ঘুরছিল ওই গ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত সমস্যাটা।



একদিন হ্যালি ভাবলেন একবার কেমব্রিজ থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। আগস্ট মাসে একদিন কেমব্রিজের ট্রেনে চেপে বসলেন এডমণ্ড হ্যালি, উদ্দেশ্য ট্রিনিটি কলেজে গিয়ে দেখা করা সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি এই সমস্যার সমাধান করতে সবচেয়ে উপযুক্ত লোক।
নিউটন তখন নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন। কলেজে তাঁকে ক্লাসও নিতে হয়না আর, ছাত্ররা, তিনি দেখেছেন প্রাকৃতিক দর্শনের ক্লাস করতে মোটেই আগ্রহী নয়। এমন অনেকবাওই হয়েছে, তিনি শূন্য ক্লাসরুমে একাই লেকচার দিয়ে গিয়েছেন। এখন আর সেটাও করেননা।
ব্যক্তিগত জীবনেও শোকের সময় চলছে তখন তাঁর। বছর পাঁচেক আগে তাঁর মা হানা ম্যালিগন্যান্ট জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিংকনশায়ারে তাঁর কাছে গিয়ে নিউটন শেষ কয়েক দিন সেবা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু মাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি।
তবে মায়ের মৃত্যুতে নিউটন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছেন, এটাও বলে নেওয়া দরকার। তিনি ছিলেন বড় সন্তান, সুতরাং মায়ের বেশিরভাগ সম্পত্তি তিনিই পেলেন।
আরও একটা আঘাত পেলেন নিউটন, যখন তাঁর কুড়ি বছরের গৃহসঙ্গী তাঁর সঙ্গ ছেড়ে চলে গেলেন অন্যত্র। এই সঙ্গীর নাম জন উইকিনস, বা উচ্চারণের তফাতে অনেকে উইকেনস বলেন (নিউটনের সঙ্গে তাঁর সমকামী সম্পর্ক থাকলে থাকতে পারে বলে অনুমান করেছেন অনেকে, তবে এর কোনও সলিড প্রুফ নেই)। স্টক এডিথ-এর পেরিশ চার্চের মিনিস্টারের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান তিনি; বিয়েও করেন, পরে নিকোলাস নামে তাঁর একটি ছেলেও জন্মায়, সুখেই ঘরকন্না করতে থাকেন উইকিনস। বেচারা নিউটন হয়ে পড়লেন সঙ্গীবিহীন। পরবর্তীকালে তাঁদের আর কখনও দেখাসাক্ষাতই হয়নি, সামান্য দু’চারটে চিঠির আদানপ্রদানেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তাঁদের যোগাযোগ।
সব মিলিয়ে নিউটন এখন বিষণ্ণ, উদাসীন এক জীবন কাটান। ভালো করে খান না, তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হামফ্রে নিউটনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় এইসময় তিনি টেবিলে খেতেও বসতেন না। মাঝেমাঝে দু’এক চামচ খাবার ইচ্ছে হলে মুখে দিতেন, আর তাঁকে দেখেই বোঝা যেত— সারাক্ষণই কিছু একটা নিয়ে যেন ভেবেই চলেছেন। আপনমনে পায়চারি করেন, রাতে ঘুমোতে যান দেরি করে, সকালে উঠে পড়েন পাঁচটা ছ’টার মধ্যে। শুতে যাওয়ার সময় পোশাকও বদলান না; চুল অবিন্যস্ত থাকে, চিরুনির স্পর্শ পড়ে না। এই ধরনের আচরণ সাহেবদের কাছে একবারেই অপ্রত্যাশিত। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি এইসময় তারিখ বা দিনরাত সম্বন্ধেও উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এইসময়কার চিঠিতে বা লেখাপত্রে প্রায়ই দেখা যায় ভুল তারিখ বা বার লিখে ফেলেছেন।
হ্যালি এসব কিছুই জানতেন না। তাঁর সঙ্গে নিউটনের এর আগে একবারই সাক্ষাৎ এবং আলাপ-পরিচয় হয়েছিল লন্ডনে, এবারে তিনি যে এখানে আসছেন, সেটা চিঠি লিখেও জানাননি। তবে এসে দেখলেন, তাঁর আগমনে নিউটন বিরক্ত হন নি মোটেই। বরং বেশ স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের কথাবার্তা আরম্ভ হল।
অন্য নানা প্রসঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পর আসল প্রসঙ্গ এল; নিউটনকে হ্যালি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, যদি একটা গ্রহ সূর্য থেকে দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে মহাকর্ষ বল অনুভব করে, তবে আপনি কী মনে করেন, ওই গ্রহের গতিপথ কীরকম হওয়া উচিত?’
নিউটন, শুনেই নাকি বলে ওঠেন, ‘কেন, উপবৃত্তাকার!’
হ্যালি তো আনন্দ আর উত্তেজনায় হতবাক, আমতা আমতা করে বললেন, ‘কী করে জানলেন?’
নিউটন স্বভাবসিদ্ধ শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমি কষে দেখেছি।’
‘তা আমাকে সেই হিসেবটা একটু দেখাতে পারেন?’
নিউটন এই কথা শুনে কিছুক্ষণ তাঁর কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখলেন, তারপর বললেন, ‘নাহ, খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, আর একবার কষে পরে তোমায় পাঠাব’খন।’ [*/ নিউটন-হ্যালি এই কথোপকথনের কথা জানা যায় অনেক বছর পরে এক ফরাসী আব্রাহাম দি ময়ার-এর লেখা থেকে, ইনি সেইসময় নিউটনের সঙ্গেই থাকতেন, তবে তাঁর কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য না যদিও; কিন্তু কী আর করা যাবে, এ ছাড়া আর কোনও স্মৃতিকথা নেই যে কারও!]
নিউটনের জীবনীলেখক অনুমান করেন, তাঁর এই হিসেবটা কষে ফেলবার পর সেটা আবার হারিয়ে ফেলার কথাটা একেবারে মিথ্যে। আসলে তিনি চেয়েছিলেন তিনি যে এটা পেরেছেন এই কথাটা ছড়িয়ে পড়ুক; আর পরে তিনি যখন এটা সত্যিই কষে সবাইকে দেখাবেন, তখন এর সময়কাল কিছুটা আগের বলে চালানো যাবে।
তবে এটাও ঠিক, নিউটন কোনও একটা মনোমত সমস্যা পেলে সেটার সমাধান শেষ না করা অব্দি থামতেন না। সুতরাং এই হিসেবও দিন রাত খেটে তিনি অবশেষে করে ফেললেন।
সেই বছরেই নভেম্বর মাসে হ্যালি একটা ন’পাতার চিঠি পেলেন। তাতে সুন্দর করে গুছিয়ে গ্রহের গতিপথ আর বর্গের ব্যস্তানুপাতিক সূত্রের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা আছে। আর এই লেখাতেই একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, ব্যাপারটা পরে বই হয়ে উঠতে পারে!


লেখাটির ল্যাটিন নাম ‘De Motu Corporum in gyrum; ইংরেজিতে দাঁড়ায় – ’‘On the Motion of Bodies in an Orbit’। বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি বিখ্যাত পেপার। জানুয়ারিতে যে সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন তিন মূর্তি, সেটার সমাধান অবশেষে এল নভেম্বরে। আনন্দিত আর বিস্মিত হ্যালি আরও একবার কেমব্রিজে ছুটলেন নিউটনকে জিজ্ঞেস করে আসতে, তাঁর পেপারটি রয়্যাল সোসাইটিতে পেশ করা যাবে কি না।
নিউটনের সম্মতিতে ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে রয়্যাল সোসাইটির মিটিং-এ হ্যালি পেশ করলেন সেই পেপার। তখন সোসাইটির নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন স্যামুয়েল পেপিস। সকলের সম্মতিতে ফেব্রুয়ারি মাসে এই পেপারটি প্রকাশিত হল সোসাইটির ট্র্যাঞ্জ্যাকশনে।
তবে নিউটন পেপার লিখেই ক্ষান্ত হলেন না, তখন তাঁর মনের মধ্যে ভাবনার স্রোত বইতে শুরু হয়ে গিয়েছে— এই পেপারটাকে ফুলিয়ে বইয়ের আকার দেওয়ার। সুতরাং আগামী কয়েক মাসের জন্য তিনি তাঁর অ্যালকেমিচর্চা সাময়িকভাবে থামিয়ে দিলেন, টানা পনেরো মাসের পরিশ্রমে শেষ হল এই বইয়ের প্রথম অংশের খসড়া। 


ক্রমশর

দ্বিতীয় পর্ব

[*/ Gale E. Christianson-এর নিউটন জীবনী থেকে এই অংশের অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে।]