রুশান আব্বাস উইঘুর সমাজকর্মী। চিনে উইঘুর মুসলিমদের নৃশংস অত্যাচার নিয়ে তিনি সরব। আব্বাস জানিয়েছেন, গণহত্যা চালানো হচ্ছে এবং চিনা কনসেন্ট্রেশন শিবিরে বন্দি করে রাখা হচ্ছে উইঘুরদের। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস অঞ্চলে জন্ম আব্বাসের। ক্যাম্পেন ফর উইঘুর নামে একটি সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী অধিকর্তা। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস রিজিয়ন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন কীভাবে মূর্তিমান বিপদ হয়ে উঠছে তা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তাঁর বড় দিদি গুলশান আব্বাসকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিনারা পণবন্দি করেছিল। প্রথমে চিনা সরকার সেই কথা স্বীকার করেনি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রী স্বীকার করেন যে, গুলশানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ চাপানো হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। রুশান ও তাঁর পরিবার এখনও জানেন না, গুলশান জীবিত রয়েছেন কি না। আইএএনএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উইঘুরদের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন রুশান।
প্রশ্নঃ বর্তমানে উইঘুর সমস্যা নিয়ে আমাদের বলুন।
উঃ কয়েক বছর ধরে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার শিকার। 'পুনর্পাঠে'র নামে লক্ষ
লক্ষ উইঘুরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। কয়েক লক্ষকে আবার দাসে পরিণত
করা হয়েছে। উইঘুর মেয়েদের শরীর এই গণহত্যার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাদের জোর করে
বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে, গর্ভপাত করানো হচ্ছে এবং বলপূর্বক বিয়ে করানো হচ্ছে। চাইনিজ
কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি তাদের অফিসিয়াল ট্যুইটারে প্রকাশ্যে এই ধরনের কাজকে স্বাগত
ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারা দাবি করছে, তাদের এই দুর্ব্যবহারের কারণে উইঘুর মহিলারা
কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে। এক লক্ষ উইঘুর শিশুকে সরকার
পরিচালিত অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেজিং-এর চরম জাতীয়তাবাদী নীতি, বর্ণ-বৈষম্য
ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের জন্মভূমির উপর নিগ্রহ চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে
ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি থেকেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যায়।
প্রশ্নঃ আপনার দিদি গুলশান আব্বাসকে জোর করে চিনা সরকার ধরে নিয়ে গেছে এবং
আপনার পরিবারের কাছে তাঁর সম্পর্কে কোনও খবর নেই। তাঁর সঙ্গে কী ঘটেছে বলে আপনার ধারণা?
এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনগুলি থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
উঃ আজ আমি আমার প্রিয় বোনের স্বাধীনতার বিনিময়ে আন্দোলনের কাজ করে চলেছি।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমার দিদি গুলশান আব্বাসকে তাঁর উরুমচির বাড়ি থেকে চিন সরকার
পণবন্দি করে। এর ছয় দিন আগে, ওয়াশিংটন ডিসিতে এক চিন্তাবিদের সঙ্গে আমি চিনের গণহত্যাকারী
নীতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার হারিয়ে যাওয়া দিদির ঘটনা নিয়ে আমি যখন প্রশ্ন তুললাম
তখন চিনের সরকারি মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে অন্যের ছবি চুরি ও আমার নিরুদ্দিষ্ট দিদির সম্পর্কে
মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ করে। তারপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রক দিদির নামোল্লেখ
করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগের ভিত্তিতে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কোনও
বিচার নেই, কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত
কোনও খবর মেলেনি। পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার ও কথা বলার অধিকার কারাবন্দিদের থাকে। কিন্তু
এ কেমন ধরনের কারাব্যবস্থা যেখানে এগুলিকে অনুমতি দেওয়া হয় না? আমার দিদি অবসরপ্রাপ্ত
ডাক্তার এবং শান্তিপ্রিয় ও অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই তাঁর
আটক ও কারাদণ্ডের মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে অন্যান্য উইঘুরদের চুপ থাকার বার্তা দেওয়া
হয়েছে। নীরব না থাকলে প্রিয়জনদের এমনই অবস্থা হবে।
প্রশ্নঃ চিনা সরকারের হাতে উইঘুররা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার।
ঠিক কী হচ্ছে সেখানে, আমাদের জানান।
উঃ ১৯৪৯ সালে আমাদের জন্মভূমি দখল করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর থেকে
চিনের চাপানো কঠোর নীতির ভিতর দিয়ে দিনযাপন করছে উইঘুররা। সেই নীতি আমাদের সংস্কৃতি
ও ধর্মের বিরোধী। স্কুল ও কলেজে আমাদের ভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়
পাঠ্যে কাঁচি চালানো হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পালন ও অনুশীলন করার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো
হয়েছে এবং কোনও রকম বাক-স্বাধীনতা নেই। এই ভাবে চিনা সরকার আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
২০১৬ সাল থেকে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার সম্মুখীন। জেনোসাইড কনভেনশনের ২ ধারায় যা বলা
হয়েছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে এই গণহত্যার। বর্তমান কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ হল
নিম্নে বর্ণিত কোনও কাজ যদি কোনও জাতি, এথনিক, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ
ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে ঘটানো হয় তা গণহত্যা, যেমন--
ক) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে হত্যা করা : আমরা প্রত্যক্ষ রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী
ও ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানি যে, নির্যাতন, অপুষ্টি ও মৃত্যদণ্ডের কারণে কারাগার ও শিবিরে
মানুষ মারা যাচ্ছে।
খ) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা : এখানে মানুষ
শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। কারাবন্দিদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। খাদ্য
দেওয়া হচ্ছে না। এমন পদার্থ তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা জোম্বিদের মতো
অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
গ) এই তথ্য সবাই জানে যে, উইঘুরদের, বিশেষত মহিলাদের, জোর করে বিয়ে দেওয়া
হচ্ছে হান চাইনিজদের সঙ্গে এবং বিয়ে করতে অস্বীকার করাকে উগ্রবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর ফলে শিবির বা কারাগারে আটক করা হচ্ছে। উইঘুর জনসংখ্যাকে লঘু করে দেওয়া বা সংকর প্রজাতি
সৃষ্টি করাই চিনের লক্ষ্য।
ঘ) গোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অন্য গোষ্ঠীর
সঙ্গে সংকরায়ন ঘটানোর কাজ চলছে। শিবিরে আটকে রাখা বন্দিদের বলপূর্বক বন্ধ্যা করে দেওয়া
হচ্ছে। গর্ভপাত করানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হচ্ছে। উইঘুর শিশুদের
বোর্ডিং স্কুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে। হান চাইনিজ
সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা ও কমিউনিজকে নতুন ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে চাপ দেওয়া
হচ্ছে।
প্রশ্নঃ চিন ও চিনপন্থীদের দাবি, আপনার আন্দোলনের পিছনে নির্দিষ্ট কিছু
বিদেশি শক্তির মদত রয়েছে। এই সমালোচনার জবাব দেবেন কীভাবে?
উঃ এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমি একজন উইঘুর-আমেরিকান। ১৯৯৫ সালে আমি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছি। আমেরিকান নাগরিক হিসেবে আমার সংবিধানে যে অধিকার
দেওয়া হয়েছে তারই ভিত্তিতে আমি আন্দোলন করছি। আমার দিদির স্বাধীনতা ও যারা গণহত্যার
শিকার তাদের জন্য আমার এই লড়াই।
প্রশ্নঃ দেশের মানুষদের অধিকার হরণ করে কি চিন বিশ্বশক্তি হয়ে উঠছে?
উঃ জোর করে শ্রমিক বানানো এমন এক অন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন যেটা চিন করে
চলেছে। শিবিরে আটকে রাখা উইঘুরদের বলপূর্বক বৈদ্যুতিন, বস্ত্র ও অটোমোটিভ কারখানায়
কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে কাজের পরিবেশ কদর্য। উইঘুরদের তা সহ্য করতে হয়। কাউকে সামান্য
মজুরি দেওয়া হয়, কাউকে কিছুই দেওয়া হয় না। তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চল
থেকে যে পণ্য উৎপাদিত হয়ে আসে তা ব্যবহার করে অ্যাপল, অ্যামাজন, বিএমডব্লিউ, নাইকি
ও অ্যাডিডাসের মতো বড় বড় ব্র্যান্ড। চিনকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করে তুলেছে
যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই, সেখানেও এই শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় কাজ
করতে এবং তারা নানা অধিকার ভঙ্গের সমস্যায় ভোগে।
প্রশ্নঃ তিয়ান-আনমেন স্কোয়ারের ম্যাসাকার চিনের জন্য একটা বড় কলঙ্ক। তারপরও
কোনও নৈতিক দ্বিধা ছাড়াই এই দেশ এগিয়ে চলেছে। চিন সরকারের ভয়ে কি চিনের ছাত্র আন্দোলন
ও মানবাধিকার কর্মীরা নীরব রয়েছেন?
উঃ আমার যখন ১৮ বছর বয়স, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন সরকারি নীতির (১৯৮৫
সালের ১২ ডিসেম্বরে)বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্র আন্দোলনের আমি ছিলাম সহ-সংগঠক। ঐতিহাসিক ভাবে
বলছি, ছাত্র আন্দোলন শেষ করে দেওয়া হয় ছাত্রদের বরখাস্ত করে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়ন
করে, বন্দি করার মাধ্যমে বা হত্যার মধ্য দিয়ে। চিনে আপনারা যে সব প্রতিবাদ দেখেন, এর
অর্থ হল, গুরুতর কিছু ঘটছে যার জন্য মানুষ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।
প্রশ্নঃ চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে মানুষ কীভাবে দিন গুজরান করেন?
উঃ ১৯৪৯ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করার পর থেকে চিন সরকার অবিরাম চেষ্টা
করেছে উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে ধ্বংস করে দিতে। পঞ্চাশের দশকে 'জাতীয়তাবাদী'
তকমা দিয়ে উইঘুরদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। ষাটের দশকে তাদের বলা হল 'প্রতি-বিপ্লবী'
এবং নয়ের দশকে তাদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হল 'বিচ্ছিন্নতাবাদী'র তকমা। ৯/১১ ট্রাজেডির
পর, কমিউনিস্ট রেজিম তাদের অত্যাচার-লীলাকে 'সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে'র ছদ্মবেশে
নতুন ভাবে সামনে এনেছে। বর্তমানে পূর্ব তুর্কিস্তানের মানুষ শি জিনপিং-এর আপন প্রকল্প
'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড'-এর শিকারে পরিণত হয়েছে। গোটা এলাকাকে ঘিরে রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক
ও ব্যাষ্টিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনা অপরাধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আটকে রাখা
হয়েছে। সব রকম রাজনৈতিক প্রতিরোধকে চিন 'ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' হিসাবে তুলে ধরছে। এই
পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছে এক নজরবন্দি রাষ্ট্রের। সংগ্রহ করা হচ্ছে ডিএনএ, চারিদিকে
লুকনো ক্যামেরা, মুখ-চিহ্নতকারী সফটওয়্যার ও গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিং লাগানো হয়েছে।
শিবিরের এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, তথাকথিত 'কারিগরি প্রশিক্ষণে'র অর্থ হল সশস্ত্র
বাহিনী, কাঁটাতার, উপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা ঘর, অপুষ্টি, পানীয় জলের অভাব, বেহাল শৌচব্যবস্থা।
এর আরও অর্থ হল, ঘর ও পরিবার থেকে ছিন্নমূল করে দেওয়া, সংস্কৃতি ও ধর্মকে পিষে দেওয়া,
জোর করে ধর্মান্তরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আমার জন্মভূমিতে চিনের সামরিকীকরণ
অব্যাহত এবং এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সিসিপির কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গণ-পরিযায়ন
চলছেই, বদলে যাচ্ছে পূর্ব তুর্কিস্তানে জনবিন্যাস এবং এতে লাভবান হচ্ছে হান চিনারাই।
তাই, বহু দেশের স্বীকৃতি ও মিডিয়ার চোখের সামনে সব ঘটার পরও গোটা বিশ্ব যেন নিথর হয়ে
রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শিবিরে আটকে রাখা লক্ষ লক্ষ উইঘুরদের জোর করে শ্রমিক বানানো হচ্ছে।
তাদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। শিবিরের বাইরে বাস করা উইঘুরদের
সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখা হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন প্ল্যাটফর্মের (আইজেওপি)
মাধ্যমে। কোনও 'সন্দেহজনক' আচরণ শনাক্ত করতে এই ব্যবস্থা। এই লাগাতার নজরদারির ফলে
উইঘুরদের চলাফেরা, যোগাযোগ রক্ষা ও মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা নেই। সারাক্ষণ আটক হওয়ার
ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চিনের তথাকথিত 'জিরো কোভিড' নীতির আওতায় এই অঞ্চলকে তিন মাসেরও
বেশি সময় ধরে সার্বিক লকডাউন করে রাখা হয়েছিল। কোনও খাদ্য, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়নি।
আধিকারিকরা এসে দরজাগুলিতে তালা ও শেকল ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, রাস্তাগুলি বেড়া দিয়ে
আটকে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ২০২২ সালের নভেম্বরে যখন অগ্নিকাণ্ড 'ঘটে', তখন মানুষ অসহায়
ভাবে পুড়ে মারা গিয়েছে।
প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়, কিন্তু
আপনারা যে যন্ত্রণা সহ্য করছেন তা তেমন তুলে ধরা হয় না। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
উঃ আসলে, বিশ্বের অর্ধেক দেশই চিনের উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। এই কারণে,
অধিকাংশ দেশ, বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি চুপ করে আছে। মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের
কাছে মুনাফার গুরুত্ব অনেক বেশি। গোটা বিশ্ব রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনকে দেখছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে
যেন মায়ানমার সরকার এই পাশবিকতা চালাচ্ছে। অথচ, বেজিং রয়েছে এর পিছনে। চিনের বেল্ট
অ্যান্ড রোড প্রকল্প যে সব এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেখানেই মুসলিমদের রক্তের দাগ লেগে
রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করতে মায়ানমারকে চালিত করেছে চিনের বেল্ট অ্যান্ড
রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। মায়ানমারের নেতাদের চিন চাপ দিয়েছে যাতে যে সব এলাকা দিয়ে
এই প্রকল্পের কাজ হবে সেখান থেকে মুসলিমদের উৎখাত করা হয়।
প্রশ্নঃ উইঘুর সমস্যার যৌক্তিক সমাধান কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উঃ জটিল প্রশ্ন। যুক্তি দিয়ে বললে, কোনও দেশের মানুষ যেন গণহত্যার মুখে
না পড়ে। কিন্তু বর্তমান মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে যা দাঁড়িয়েছে তা হল, সকল দেশকে
মেনে চলতে হবে যে, কোনও সরকার (এ ক্ষেত্রে চিন) যদি গণহত্যা রুখতে ব্যর্থ হয় বা নির্দিষ্ট
পরিমিত বজায় রাখতে না পারে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাহলে, রাষ্ট্রসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের
কাছে সেই দেশ জবাবদিহি করতে বা দায় নিতে বাধ্য থাকবে। তাদের উপর চাপানো হবে নিষেধাজ্ঞা,
রেজল্যুশন বা অন্য পথও অবলম্বন করা যেতে পারে। কর্তৃত্ববাদী রেজিমগুলি মানবাধিকার লঙ্ঘন
করে চলেছে আজও, এর কারণ হল, এই ভয়াবহ কাজ রুখতে যথেষ্ট চাপ তাদের উপর নেই। হ্যাঁ, চিনারা
উইঘুর গণহত্যার জন্য দায়ী, কিন্তু বাকি বিশ্বও সমান ভাবেই দায়ী, যদি এই গণহত্যা বন্ধ
করতে তারা যদি কোনও পদক্ষেপ না নেয় এবং এই রেজিমকে দোষী সাব্যস্ত না করে। গণহত্যা,
দাসত্ব ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চিনের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এই ইস্যুর সমাধানের দায়িত্ব
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর এবং সেই সঙ্গে চিনা রেজিমের হাত থেকে উইঘুরদের রক্ষা করাও তাদের
কর্তব্য।
অনুবাদ : জিয়া হক