শহরটার ল্যান্ডস্কেপ আমি হারিয়ে ফেলছিলাম । বাজার, স্কুল, আদি গঙ্গা, বন্ধুর বাড়ি, প্রেমিকা যেখানে মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়েছিল, চপের দোকান, সাইকেলের লিক সারানোর সেন্টার, ভোটগ্রহণ কেন্দ্র, ছাপাখানা, রাধেশ্যাম বস্ত্রালয়, আসমা হোটেল, অন্নপূর্না মিষ্টান্ন ভান্ডার, পদ্মপুকুর বাস স্ট্যান্ড, পাথর-ওঠা নতুন বাইপাস, আমার নিজের বাড়ি —একে একে আমি সব গুলিয়ে ফেলছিলাম । গুলিয়ে পড়া লোকেরা গুলিয়ে ফেলে । গুলিয়ে হঠাৎ করে যায় না, তার একটা পূর্বাশ্রম থাকে । অতীত আপাতত থাক । কেননা 'অন্ধকার যুগ' থেকে শিক্ষা নিয়ে 'নতুন' যে যুগ আমরা গড়েছি তা মোটেও আলো-ভর্তি নয় । আসলে নিজের অন্ধকার ঢাকার জন্য অন্যকে অন্ধকার প্রমাণ করা জরুরি । কিন্তু আমার চিন্তা তা নয়, আমি ভাবছি যে কীভাবে আমার ঘনিষ্ঠতম শহরটার ল্যান্ডস্কেপ ফিরে পেতে পারি ।
তাপসীকে জানালাম ।
নাফিসাকে জানালাম ।
অপরূপকে জানালাম ।
আর জানালাম সুনয়নাকে ।
এখন সব এমসিকিউ । চারজনকে জানালে একজনের সাড়া মিলতে পারে । না মিললে আবার চারজন । আমি অক্লান্ত কারণ গুলিয়ে পড়া কোনও কাজের কথা নয় আর এখান থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতেই হবে । আসতেই হবে কারণ আমার রোজগার দিয়ে আব্বা মা কে এখনও দু'জোড়া জুতো কিনে দিতে পারি নি ।
সুনয়নার গলা শুনে মনে হল আমার বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবার মতো অবসর তার রয়েছে ।
সে বলল, আমার সঙ্গে বকখালি চল । এসব একঘেয়েমি থেকে হয় ।
সেই মুহূর্তে ওকে বিলেত-ফেরত ডাক্তারই মনে হল । যদিও সে মেটালার্জি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শিবপুরে । ওর বাবা রাজ্য সরকারের কোনও একটা দপ্তরের সচিব ।
আমি বললাম, আমার এমন একজনকে দরকার যে বিকালে আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরবে, বকখালি না গেলেও অসুবিধে নেই ।
সুনয়না বলল, তুই আমাদের কসবার ফ্ল্যাটটায় মাসখানেক অজ্ঞাতবাস নে । চেনা, জানা, পরিচিত দুনিয়াটাকে একটু দূর থেকে দেখ না । আমার মনে হয় না খারাপ লাগবে ।
আমি বলি, এভাবে কি নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়?
সে বেশ মজার একটা কথা বলল । এমন কথা তার মুখে কখনও শুনি নি ।
সে বলল, দুভাবে স্বর্গে যাওয়া যায় । যদি স্বর্গে আদৌ তোর বিশ্বাস থাকে । প্রথম হল, পুণ্য করে আর দু নম্বর হল, পাপ না করে ।
সব কিছুর উত্তর সব সময় দিতে নেই । আমি সুনয়নাদের কসবার ফ্ল্যাটে আত্মগোপন করে থাকবো স্থির করে ফেলেছি ।
শুধু বললাম, সন্ধ্যাগুলো আমার সঙ্গে কাটিয়ে যাস কিন্তু ।
সে মাথা নাড়ল ।
প্রগলভ নয় এমন মেয়েদের আমি পছন্দ করি কিন্তু আমার পছন্দ কাউকে জানাই না কারণ সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেলেই ওই রাষ্ট্রে আমার যে অ-বান্ধব শ্রেণি আছে তাদের প্রাথমিক কাজই হবে আমার পছন্দ - অপছন্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে আক্রমণ করা । আক্রান্ত হতে তারা ভালোবাসে যারা আক্রান্তের রাজনীতি জিনিসটা বোঝে ভালো । আমি শুধু বুঝি না তা নয়, বুঝতে চাইও না ।
গোল বাধল অন্যত্র ।
ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছি, শনিবার বিকেল, সন্ধ্যার আগেই কসবায় পৌঁছতে চাই । ৩টে ২০ তে ট্রেন । পারতপক্ষে আমি বাসে চড়ি না । বাস ব্যবসায়ীরা আমার বিরুদ্ধে যান-বৈষম্যের অভিযোগ আনতেই পারে । একমাত্র মহামান্য আদালত যদি বছর দশেকের মধ্যে এই তুমুল জটিল বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে আমাকে স্বস্তি দিতে পারে ।
বেরনোর ঠিক আগে তাপসীর ফোন ।
'তুই সেদিন কীসব বলছিলি বল তো, একটু ডিস্টার্বড ছিলাম তাই মন দিতে পারি নি । '
ওকে কসবার ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিলাম ।
সেক্টর ফাইভ থেকে ফেরবার পথে ও একবার ঘুরে যাবে ।
তাপসী কয়েক মাস হল বিয়ে করেছে । ওর বর ইস্টার্ন রেলের টিকিট পরীক্ষক । ওদের বিয়েতে আমি যাই নি । আসলে আমি মেনে নিতে পারি নি । আমি চেয়েছিলাম যে তাপসীও আমার মতো একা থাকুক । একা থাকতে গেলে এক নীল আগুন নিজের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখতে হয়, নিভতে দেওয়া যায় না । তাপসী পারত । মনে হত, যে-আগুনে চাল সিদ্ধ হতে পারত, সেই আগুনে বিড়ি জ্বালানো হতে থাকবে । এ অপচয় ।
অপরূপের ফোনও এল ।
এখন আর কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না । কিছুই আর সমাপতন নয় । নাফিসার ফোনও এসে যেতেই পারে । সে যতই আমাকে ঘৃণা করুক । প্রসঙ্গত বলবার, নাফিসা বানু অত্যন্ত মিতবাক আর সেই সঙ্গে মেধাবী । কলেজের কোনও কোনও শিক্ষক ও অ-শিক্ষক কর্মচারীও তার পাণিপ্রার্থী ছিলেন । আর নাফিসার স্বপ্নে ছিল অভিনব বিন্দ্রার মতো কেউ । ও একদিন স্বপ্ন বলে ফেলেছিল । কিন্তু মিস্টার বিন্দ্রাকে ভালবাসতে হলে আমাকে যে কেন ঘৃণা করতে হবে তার কোনও সদুত্তর পাই নি ।
অপরূপকেও কসবার ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়েছি । ও স্কুল থেকে ফেরার পথে আসবে ।
নিজেরই আধা-পরিচিত বাড়ি ছেড়ে বেরনোর সময় দেখি মা ঘুমোচ্ছে । তার পায়ে হাত রাখতেই তার ঘুম ভেঙে গেল । মা বেশ অবাক, কেননা প্রণাম আমি আগে কখনও করিনি । শ্রদ্ধা জানাতে কারো পায়ে হাত দিতে হয় —এই তত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই । আমার শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল, মায়ের জন্য একটা এসি যন্ত্র কিনে আনব । এই গরমে তার ভীষণ কষ্ট হয়, ঘুমোতে পারে না ।
একজন মানুষ ঘুম থেকে তৃপ্তি নিয়ে জেগে ওঠে অথচ মা'র চোখে জল ।
আমি ও মা দুজনেই দুজনকে বললাম, কী হয়েছে?
মা বলল, একটা খারাপ স্বপ্ন কদিন আমাকে খুব জ্বালাতন করছে রে ।
আমি বললাম, সেই স্বপ্নটা আবার ফিরে এসেছে মা?
-কোন স্বপ্নটা?
আমি ধরিয়ে দিতে চাইলাম, যে-স্বপ্নে আমি মরে যাচ্ছি, সেই স্বপ্নটা ।
মা বলল, তুই কী করে বুঝলি?
আমি সত্যিই মরে যাচ্ছি মা । তুমি টের পাবে না তা কি হয়?
মা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, এসব কী বলছিস আসাদ ?
-শুধু দোয়া কোরো যেন ন্যাচারাল ডেথ হয় ।
মা তাকিয়ে আছে তার ছেলের মুখের দিকে । বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে । কেউই তার সৃষ্টি করা জিনিসের মৃত্যু দেখতে চায় না । খুব বিকৃত হলেও সে চায় জিনিসটা থাক ।
মা শুধু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস বাবা?
আমি বললাম, জানলে তুমি যেতে দেবে না মা । কিন্তু যেতে আমাকে হবেই ।
মা'র চোখেমুখে সন্তান হারিয়ে ফেলবার বিন্দু বিন্দু ভয় জমে উঠেছে ।
আমি রাস্তায় নামলাম ।
পরিচিত রাস্তায় নামলে যেমন অনুভূতি হওয়া দরকার তা হচ্ছে না । এ রাস্তা আমাকে বারুইপুর রেলস্টেশন নিয়ে যাবে —এই জ্ঞানটুকু আমার সান্ত্বনা । সান্ত্বনা খুব জরুরি । অনেকে শুধু সান্ত্বনা পেতে চিকিৎসকের কাছে যায় । চিকিৎসক একটি মূর্তিমান সান্ত্বনা ।
কসবার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি গত পঁয়তাল্লিশ মিনিট । চাবি নিতে ভুলে গেছি । সুনয়নাও আমাকে চাবিখানা দিতে ভুলে গেছে । তাপসী, অপরূপ কেউ এখনও এসে পৌঁছয় নি । দশ মিনিটের মধ্যে কেউ না এলে সন্তোষপুরে এক জ্যোতিষীর দরবারে যাবো, মনস্থির করে ফেলেছি । জ্যোতিষীদের আত্মবিশ্বাস খুব কন্টাজিয়াস । আমার এখন সেটুকুও দরকার ।
আরও মিনিট পাঁচেক পর সিড়িতে অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল । ওরা হয়ত এসে গেছে । আমার উদভ্রান্ত মুখ দেখে তারা কী ভাববে আমি তাই-ই ভাবছি । ভালোবাসা যে পাত্র থেকেই আসুক সেটা যদি তোমাকে শীতল না করে তবে সরেজমিনে আবার দেখে নিতে হবে আগাছা কোথায় জন্মে গেল । যে কোনও সম্পর্কে নিড়ানি ব্যবহার জরুরি ।
এ আমি কাদের দেখছি এখানে? তাপসী, সুনয়না, অপরূপ তো এরা নয় । খাকি-পরা তিনজন পুলিশ ।
সবচেয়ে লম্বা পুলিশটা বলল, তোকে থানায় যেতে হবে ।
আমি বললাম, 'তোকে' বলছেন কেন, আপনি বলুন ।
সবচেয়ে মোটা পুলিশটা বলল, যতক্ষণ তুই নির্দোষ প্রমাণ না হবি ততক্ষণ আমরা তোকে আপনি বলতে পারব না ।
-কিন্তু আমার দোষ কী?
সবচেয়ে রোগা পুলিশটা বলল, থানায় না গেলে আমরা তোকে কিছু বলতে পারব না ।
অগত্যা থানা ।
লকাপে বসে আছি । জেল যদি হয় সংশোধনাগার, তাহলে লকাপকে কী বলা যাবে? ভাবছি সংশোধনাগারে যদি আমাকে পাঠানোই হয় তাহলে আমার কী কী সংশোধন হতে পারে । প্রথমেই মনে হল, মানুষকে সহজে বিশ্বাস-ভরসা করবার পাপটাই সবার আগে শোধন হবে ।
সবচেয়ে মোটা পুলিশটা লকাপের গেট খুলে দিয়ে বলল, আয়, বড়বাবু কথা বলবেন ।
গিয়ে দেখলাম সবচেয়ে রোগা পুলিশটাই বড়বাবু ।
একটা চটি - পাতলা পুস্তিকা এগিয়ে দিয়ে বড়বাবু বললেন, এটা পড় ।
একটা আরবি বর্ণপরিচয় ধরনের বই । আলিফ, বা, তা, সা, জিম, হা, খ, দাল, জাল —প্রতিটা অক্ষর প্রায় তিরিশ ফন্ট সাইজে নিউজ প্রিন্টে ছাপা ।
আমি বললাম, এসব পড়তে হবে কেন? আর আমিই বা পড়তে যাব কেন?
বড়বাবু বললেন, তুইই পড়বি কারণ এটা যা-তা বই নয় । এটা একটা সন্ত্রাসী সংগঠনের ইশতেহার । আর তুই সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ।
-কীভাবে?
—তোর ব্যাগে এই ধরনের কয়েকটা বই পেয়েছি আমরা ।
আমি জানি যে আমার ব্যাগে এখন নাপাম বোমা, ক্ষেপনাস্ত্র, এবং রাসায়নিক অস্ত্র পাওয়া যাবে একে একে । আর এঁদের সঙ্গে তর্ক করেও লাভ নেই ।
বিনীতভাবে বললাম, স্যার, এটা একটা আরবি বর্ণপরিচয় । এই দেখুন, এই আলিফ জবর আ, শিন জবর শা, মিম জবর মা, যেমন আমাদের বাংলায় তালব্য শ আকার শা, ম আকার মা, ঠিক তেমনি । দেখুন দুটোতেই মা আছে, কী মজার না?
সবচেয়ে লম্বা পুলিশটা বললেন, দেখলেন স্যার, বলেছিলাম, এ সব জানে, তথ্য গোপন করছে ।
পরের দিন সকালে একজন বিরাপ্পানী গোঁফের পুলিশ এসে লকাপ খুলে আমাকে বড়বাবুর সামনে নিয়ে গেলেন ।
বড়বাবু বললেন, বসুন ।
আমি বেশ অবাকই হলাম । জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার স্যার, আমাকে আপনি-আজ্ঞে করছেন?
তিনি বললেন, উই আর সরি ।
-সরি কেন স্যার?
-আপনার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই ।
আমার খুব দুঃখ হল । এটা অনৈতিক । এতে পুলিশি ব্যবস্থার মানহানি হয় ।
বললাম, স্যার, দুঃখ করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে ।
থানার বাইরে বেরিয়ে এসেছি । থানার বাইরে পৃথিবীটা সত্যিই অন্যরকম । কিন্তু এই অন্যরকম পৃথিবীটা আমি এখন চিনতে পারছি । সবাইকে চিনতে পারছি । আর অসুস্থ বোধ হচ্ছে না । আমাকে জ্যোতিষীর কাছে একবার যেতে হবেই।
জ্যোতিষী গোবর্ধন শাস্ত্রীর বাড়ির সামনে প্রচুর লোক । এত মানুষ জ্যোতিষে বিশ্বাসী! ঠিক, যখন জনপদ খুব হতাশায় ভোগে তখন এই ধরনের খোপগুলোতে ভিড় বাড়ে । জ্যোতিষীদের মতো ধৈর্য খুব অল্প প্রাণীরই থাকে । তারা ঠিক দেবতা নয়, ঠিক দৈত্যও নয় —মাঝখানে আটকে থাকা জীব —এই অবস্থানে থাকা যে কী উপভোগ্য তা সংখ্যালঘু মাত্রেই জানে ।
জানলাম যে জ্যোতিষার্ণব শ্রী গোবর্ধন শাস্ত্রী হিমালয় চলে যাচ্ছেন । ইহজগৎ থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্তি । তাঁর কাছে হিমালয় ইহজগতের অংশই নয় ।
ভিড় ঠেলে তাঁর সামনে যেতেই তিনি বললেন, ভিজিলান্তে! কিছু ভাষা এবার ভুলে যাও বৎস ।
আমি জানি তাঁর কানে সব খবর চলে এসেছে । কীভাবে তিনি এত খবর পেয়ে যান, রাখেন আমি বুঝি না ।
আমি বললাম, আপনাকে এখন আমাদের খুব দরকার শাস্ত্রী মশাই ।
তিনি মৃদু হাসলেন । তারপর মুখময় সেই হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, কেউই দরকারি নয় বৎস । প্রত্যেকে শাস্তি ভোগ করে চলে যাবে । এই যেমন আমি চলে যাচ্ছি ।
আমি অবাক হলাম । কী বলছেন ইনি!
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার অপরাধ কী শাস্ত্রীজি?
তিনি একই ভঙ্গিতে বললেন, অপরাধ আমার না, অপরাধ আমার পিতামাতার । আমাকে জন্ম দেওয়ার মহান যে অপরাধ তারা করেছিল তার শাস্তি আমাকেই ভোগ করে যেতে হবে ।
-আপনার সঙ্গে কথা বলে আজ মোটেও ভালো লাগছে না । এর একটা বিহিত করুন ।
শাস্ত্রীজি বললেন, আসাদ, আমরা সবাই মুক্তি চাই কিন্তু যে - সামান্যটুকুও আমাদের আয়ত্তাধীন তাকে মুক্তি দিতে আমরা পারি?
নাহ, এত রগরগে জীবনবোধ আমার ভালো লাগছে না । বললাম, যাই শাস্ত্রীজি । হিমালয়ে কখনও গেলে দেখা করে আসব ।
তিনি আবারও হাসলেন । এই হাসির ব্যাখ্যা সবাই জানে । এমন হাসি হাসতে সবাই পারে না ।
আমি উঠে ভিড় ঠেলে বারান্দায় এসেছি, তাঁর একজন ভক্ত ডাকলেন , গুরুজি তোমাকে ডাকছেন ।
ভক্তটি আমাকে পাশেই আরেকটা ঘরে নিয়ে গেলেন । এই ঘরে লোকজন নেই । দেওয়ালে একটা বড় ফটো টাঙানো । শাস্ত্রী মশাইয়ের যৌবনের ফটো । উলোঝুলো দাড়িগোঁফ নেই, একেবারে ক্লিন শেভেন । সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো লাগছে । চোখময় দ্রোহ ।
শাস্ত্রী মশাই ঘরে ঢুকে বললেন, আখলাক, এই টাকাটা রাখ, মায়ের জন্যে একটা এসি নিও ।
এ আবার কী? আমি তো নিজের উপার্জনে মা'কে যা কেনার কিনে দিতে চাই । এই টাকায় আমার শ্রম কোথায়? এ টাকা আমি নিতে পারব না, তা-সে যতই মহৎ কাজের জন্য দেওয়া হোক না কেন ।
বললাম, আমার কাজ আপনি কেন করে দিতে চাইছেন?
শাস্ত্রী মশাই বললেন, তুমি জিজ্ঞেস করলে না কী করে আমি জানলাম ।
-আপনার 'জানা' নিয়ে সংশয় অনেক দিন আগে থেকেই আর আমার মনে নেই । কিন্তু এ টাকা আমি নিতে পারব না ।
তিনি তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে , যদিও তাঁর দৃষ্টিতে আমি নেই তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তাঁর দৃষ্টি আর মোটেও ইহজাগতিক নয়, আমার এবার যাওয়া দরকার । ভিড় ঠেলেই আবার আমাকে যেতে হবে । ভক্তদের ভিড় ।
বিকালে নিঃশব্দে বাড়িতে এসে ঢুকলাম । একটা অচেনা বেড়াল আমাদের গেটের ধারে দুটো ছানা নিয়ে বসে আছে । ধবধবে তাদের লোম । মা ঘুমাচ্ছে ।
ছাদে আমার একটা গোপন কুঠুরি আছে । আদৌ সেটা গোপন নয়, তবে ভাবতে ভালো লাগে যে এই ঘরের হদিশ কেউ জানে না । এই কক্ষটার নাম দিয়েছিলাম উত্তমাশা অন্তরীপ । তখনও বার্থালোমিউ দিয়াজ একটা স্বপ্ন । সে দস্যু না এক্সপ্লোরার তা চিন্তাতেই ছিল না ।
ওই অন্তরীপে ঢুকে আমার প্রথম কাজ হল একে একে তাপসী, সুনয়না, অপরূপকে ফোন করা ।
পুরো বিষয়টা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয় । হঠাৎ সবাইকে নিজের জীবনে ডাকলাম, তারা এলোও, কিন্তু এটা কী হল তারপর?
প্রথমেই সুনয়নাকে ফোন করলাম ।
তার ফোনের সুইচ বন্ধ ।
অপরূপের ফোনের সুইচ বন্ধ ।
তাপসীর বেলাও তাই ।
কিন্তু এ থেকে কোনও সিদ্ধান্তেই আসা অনুচিত । একই সঙ্গে তিনজনই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারে । একই সঙ্গে তিনজনের ফোন বিগড়ে যেতেই পারে । তাদের প্রতি ক্ষোভ করে আমি নিজেকেও আর যন্ত্রণা দিতে চাই না । খুব স্বাভাবিক ।
বারুইপুর শহরটাকে এখন আমার স্নায়ুর মধ্যে অনুভব করতে পারছি কি না —সেটা দেখাই এখন আমার প্রাথমিক কাজ ।
জিয়া হক