রণজিৎ দাশ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রণজিৎ দাশ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা—পাঠ-প্রতিক্রিয়া : দেবায়ন চৌধুরী


‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি রণজিৎ দাশ লিখেছিলেন- “ যদিও লিখছি দীর্ঘকাল ধরে, কিন্তু বেশি পরিমাণ কবিতা লিখতে পারিনি কখনও। ফলে, এতাবৎ প্রকাশিত আমার পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ঠাঁই পেয়ে গেল এই সংকলনে। এতে সুবিধের হল এই যে, কার্যত শ্রেষ্ঠ কবিতার বিপজ্জনক দাবি রইল না এই সংকলনটির, শুধু ঐতিহ্যবাহী নামকরণের গৌরবটুকু রয়ে গেল। আর, অদৃশ্য বিচারকের মতো, রয়ে গেলেন পাঠক। কবিতার পাঠক—এক শুদ্ধ, নির্জন, অলৌকিক মানুষ। তাঁকে নমস্কার।”— ২০০১ সালের জুলাই মাসে এই কথাগুলি বলার পর পেরিয়েছে অনেকটা সময়। দ্বিতীয় সংস্করণে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু নতুন কবিতা, আর ভূমিকায় উঠে এসেছে মানব চৈতন্যের অভিমুখ ও তাঁর কবিতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের আন্তরিক পরিচয়। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ শুরু হয়েছে যে কবিতাটি দিয়ে, কবির নন্দনতত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে তা বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠতে পারে-
 “ আমাদের লাজুক কবিতা, তুমি ফুটপাতে শুয়ে থাকো কিছুকাল
  তোমার লাজুক পেটে লাথি মেরে হেঁটে যাক বাজারের থলে- হাতে
                                                  বিষণ্ণ মানুষ
  শুদ্ধ প্রণয়ভুক তোমার শরীরে কেউ ছ্যাঁকা দিক বিড়ি জ্বেলে—
                                                   নিতান্ত ঠাট্টায়
  তুমি স্থির শুয়ে থাকো, কষ্ট সয়ে, মানুষের দীর্ঘতম ফুটপাত জুড়ে
  শুধু লক্ষ্য রেখো, অন্ধে না হোঁচট খায়, কোনো ভিক্ষাপাত্র ভুল করে
       তোমার কাছে না চলে আসে
  ধীরে ধীরে রোদ- ঝড়-শীতের কামড়ে তোমার সোনার অঙ্গ কালি হবে
  ওই পোড়ামুখে তবে ফুটবে তামাটে আভা পৃথিবীর, তাই দেখে
  ফুটপাতশিশুরা ভারি ঝলমলে হাততালি দেবে
   তাদেরকে দিও ছন্দজ্ঞান, লজেন্স দিও না। ’’ বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না কবিতা ও কাব্যগ্রন্থের নাম – ‘আমাদের লাজুক কবিতা’। ১৯৬৮- ১৯৭৭ সময়সীমায় লেখা এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। রণজিৎ দাশকে সত্তরের কবি হিসেবেই জানি আমরা। উত্তাল সত্তর দশক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বড়ো বাঁক নিয়ে এসেছে। সত্তরের কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা ছিল, ছিল আপাত নির্লিপ্তি উদাসীনতা, কিন্তু সময়ের ছোঁয়াচ এড়িয়ে যেতে পারেননি কেউ। সময়ের ভেতরের আগুনের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন প্রত্যেকেই, নিজস্ব প্রবণতা অনুযায়ী ‘অ্যাসিড বিক্রিয়া’ ঘটেছিল কবিদের মনে ও মননে। সত্তরের কবিদের মধ্যে স্বভাবত স্বতন্ত্র রণজিৎ দাশের সপ্রতিভ সময়নিরীক্ষণে, মৌলিকতায়, মেধাবী শব্দব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন বিশিষ্ট সমালোচকেরা। কবিকে বুঝতে চেয়ে এবারে তাঁর জীবনের দিকে চোখ রাখা যেতে পারে। ঢাকা বিক্রমপুরে পৈতৃক নিবাস, কবির জন্ম শিলচরে, ১৯৪৯ সালে। কবিতা লেখার প্রথম জীবনে ‘অতন্দ্র’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলকাতা চলে আসেন ৭১ সালে। ৭৬-এ চাকরি জীবন শুরু। ৭৭- এ প্রথম কবিতার বই। কবির একটি সাক্ষাৎকারে সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি-  তিনি গর্ভস্থ হয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে আর ভূমিষ্ঠ হয়েছেন ভারতে। বাংলা সাহিত্যের তিনটি ভুবন জুড়েই তাঁর অস্তিত্ব। সারা জীবন জুড়ে ব্যাপক স্থানান্তর, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির স্পর্শে জারিত হয়ে তিনি কি নিজের মত গড়ে তুলতে চেয়েছেন ‘এক কবির অহং এর উপনিবেশ’? যে রাজ্যে তিনি একক অধীশ্বর। ফিরে আসি আবার ‘লাজুক কবিতা’র প্রসঙ্গেই। রণজিৎ দাশের মত অনুযায়ী কবি ও কবিতা- দুয়েরই লাজুক হওয়া উচিত। তবে ‘লাজুক’ শব্দটি এখানে ‘আইরনিকাল’ কেননা নাম কবিতাতেই স্পষ্ট তিনি কবিতাকে লাজুকতা ছেড়ে সমাজসচেতন হয়ে উঠতে বলেছেন। আর তাই কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে- “ ফুটপাত শিশুরা ভারি ঝলমলে হাততালি দেবে/ তাদেরকে দিও তুমি ছন্দজ্ঞান, লজেন্স দিও না।” এর পরের কবিতাই ‘প্রকৃতির দিকে’, যে কবিতার শেষে কবি বলছেন- “ শুধু মনে হয়, এই অভ্যস্ত ফেস্টুন কাঁধে দিগ্বিদিকে ছোটাছুটি/ ঠিক নয়, ঠিক নয়/ যেন মনে হয়, বোধিপরবাস থেকে একদিন প্রত্যেকেই/ ফিরে যাবে প্রকৃতির দিকে”। ঠিক নয় ঠিক নয় কথাগুলি যেন নিজেকেই বলা হচ্ছে। আত্মগত মনে হওয়া কীভাবে আমাদের সকলের ‘বোধিপরবাস’ নিয়ে ভাবায়। মায়াভবনের পথে দেখা হয়ে যায়...

(২)
বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কবি রণজিৎ দাশ তাঁর কবিতাভাবনাকে খুব সুন্দর ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন- “আমি খুব সচেতনভাবেই বলছি, যে কবিরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, শুধু আমি নই, প্রত্যেকে, সেই আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, প্রত্যেকের কবিতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবার্থসম্পন্ন। সেই ভাবার্থটাই বিষয়। যে কল্পনাটি আসছে সেটি বিষয়, যে চিত্রকল্পটি আসছে সেটি বিষয়।” কবিতায় দুর্বোধ্যতা কিংবা বিষয়হীনতা তাঁর অভিপ্রেত নয়। নিজেকে আধুনিক কবি বলে অভিহিত করতে তিনি নারাজ কেননা তাঁর মতে আধুনিকতা নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। সুধীন্দ্রনাথের বিরূপ বিশ্বে মানুষের একাকী থাকার চেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ – বেশি প্রিয় উচ্চারণ হয়ে ওঠে তাঁর। অসীম রহস্যময় জগতের আনন্দ-বেদনাপ্রবাহকে, মানুষের বেঁচে থাকাকে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে চান তিনি। বামপন্থায় বিশ্বাসী কবি শ্লোগাননির্ভর কবিতা পছন্দ করেন না। সমাজের কাছে কবির দায়বদ্ধতা ভালো কবিতা লেখা। আর ভালো কবিতায় সময়ের ক্ষতচিহ্ন মুদ্রিত হবেই। আলাদাভাবে সময়কে ধরে রাখার আরোপিত চেতনা কবির কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। কবির মতে, কবিতার মূল রহস্য যদি থাকে জীবন রহস্যের উদ্‌ঘাটনের মধ্যে, তবে ‘সময়ের ভাষ্যকার’ কথাটির আলাদা গুরুত্ব থাকে না। কবিতা কাকে বলা হবে এর উত্তরে কবি রণজিৎ দাশ বলেছিলেন কবিতার লাইনে ক্লাসিক গুণাবলীর কথা- “ ক্লাসিক গুণাবলী সংক্ষেপে বলা যায় কাব্যভাষার সৌন্দর্য কল্পনার চমৎকারিত্ব, গভীর হৃদয়বত্তা এবং কবির জীবনদৃষ্টির মৌলিকতা।’’ কথারা অনিবার্যভাবেই প্রস্তাব করছে কবিতা- পড়ার। কবিতার নাম- ‘ইতিহাস’--
ছাতে বসে দেখছি রাত্রির আকাশ। একটানা দুঃসহ বৈশাখ। শুকিয়ে- যাওয়া টবের
ফুলগাছটি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার কোণে, শেয়ালদা স্টেশনের পকেটমার ছেলেটির
মতো। বৃষ্টির প্রতীক্ষা করছে সমস্ত শহর। রাত্রির ঘননীল আকাশপথে অবিশ্রান্ত
গতিতে উড়ে যাচ্ছে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ। যেন অতিকায় ম্যাজিক লন্ঠনের ছবি।
বিরামহীন, গত দু’রাত ধরেই চলেছে এই মেঘের দল। যেন ৪৭ সালের
সীমান্ত- পেরিয়ে- আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুর্দা, ঐ
দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে- পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা।

অনেক রাতে ভেসে গেল সুঠাম, অভিজাত দুটি মেঘ পাশাপাশি- মনে হল নেহরু
আর এডুইনা মাউন্টব্যাটেন।

কবিতাটি আমাদের স্তব্ধ করে দেয় কবি কথিত ক্ল্যাসিক গুণাবলীতে। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কবি তার মধ্যে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করছেন। শুকিয়ে যাওয়া টবের ফুলগাছ আর শেয়ালদা স্টেশনের পকেটমার—দুজনের জন্যই অন্ধকার কোণ। উদ্বাস্তুদের মিছিলের ছবি অব্যর্থ। কবি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই লেখেন কিন্তু সে একটি মাত্র ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়। অমিয়ভূষণ মজুমদার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “ আমার তো মনে হয়, প্রতিভা অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে সেই ক্ষমতাও, যা বহুর অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করে একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে অভিজ্ঞ করে তুলতে পারে।’’ এবং  “ ... যেহেতু কবির অভিজ্ঞতা বর্তমানের এবং অতীতের অন্য অনেকের অভিজ্ঞতার এবং তার নিজের অভিজ্ঞতার যোগফল, তেমনি কবির শব্দচয়নে তার সৃষ্ট ভ্যালুজের মধ্যে অন্য অনেকের অভিজ্ঞতার, ভ্যালুজের পুনর্জন্ম দেখতে পাই। ’’—এই পুনর্জন্ম শব্দটির মধ্য দিয়েই ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে নেহরু আর এডুইনা-র পাশাপাশি অবস্থান হয়ত কারণ হয়ে দাঁড়ায় উদ্বাস্তু মিছিলের। কাব্য মূলত ইতিহাস- কবি এক অর্থে ঐতিহাসিক। ছাতের দূরত্ব থেকে তিনি রাতের আকাশ যেভাবে দেখেন, ১৯৮৭- ১৯৯২ সময়পর্বে লেখা ‘বন্দরে কথ্যভাষা’ কবিতা-বইয়ের ‘ইতিহাস’ কবিতাটি সেভাবেই হয়তো সময়ের দূরত্বে লেখা হয়। যে দূরত্ব হয়ে ওঠে অমোঘ,গভীর। আমরা জানি কবি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মেঘের সূত্রে ইতিহাস- দর্শন আমাদের নিয়ে যেতে পারে কবির ‘ইশ্বরের চোখ’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার শেষ অংশে- “ সবকিছুর মীমাংসা রণরক্তে, আমি ভাবি। ভাবি সেই কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের কথা, যাঁরা মনে করতেন, ‘ গভীরতর বাস্তবতা’ বলে কিছু নেই...’’ পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে এক নতুন জলের কল্পনা করেছিলেন জীবনানন্দ, সমস্ত দীপ ছেড়ে এক নতুন প্রদীপ, নতুন এক ব্যবহারের কল্পনাও ; জীবনের সঙ্গে যার ‘গোপনীয় সুড়ঙ্গলালিত’ সম্বন্ধ। সুড়ঙ্গের কথা ভাবলেই অন্তর্ঘাত শব্দটি হানা দেয় মনে। সময় ও পৃথিবীর অভিজ্ঞতায় কবি যে বাস্তবকে নির্মাণ করেন, তার অনুষঙ্গে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে দেবর্ষি সারগীর ‘ভ্রমণসঙ্গী ঈশ্বর’ উপন্যাসের দুটি বাক্য- “ শব্দ শুধু বাস্তবতা বহন করে না, বহন করে প্রজ্ঞাও, যা নিছক বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে আমরা নাও লাভ করতে পারি। বাস্তবতা যা আমাদের শেখাতে ব্যর্থ হয়, শব্দ তা শেখায়।” এবারে পড়ে নেব আরেকটি কবিতা।

বংশী সামন্ত
সেদিন আর নেই যখন নকশালদের ভয়ে ডাক্তারেরা নামমাত্র ফিজ দিয়ে রোগী
দেখত। রিক্সাচালক বংশী সামন্ত সেই ভাগ্যবান রোগীদের একজন। কঠিন অসুখ
হয়েছিল তার, হৃদপিন্ডের, স্রেফ অচিকিৎসায় মারা যেত, যদি না নকশাল
ছেলে তাকে এক বিলেতফেরত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। মাত্র পাঁচ টাকা
এবং অদৃশ্য পাইপগানের বিনিময়ে। পরে পুলিশের গুলিতে সেই ছেলেটি মারা
গেছে। কিন্তু সুস্থদেহে বেঁচে আছে বংশী। বেঁচে আছেন সেই ডাক্তারটি-ও, তাঁর
ফিজ এখন দুশো টাকা, বংশী শুনেছে। ক্বচিৎ- কখনো গাড়িতে ওঠার মুখে বংশীর
সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তিনি এখনো হেসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভালো আছো তো?’
বংশী কৃতার্থ হয়ে যায়। তার মনে হয় যেন সেই ছেলেটির স্মৃতি এখনো ডাক্তারকে
সম্পূর্ণ ছেড়ে যায়নি, না হলে ওর মতো নগণ্য লোককে তিনি এতদিন মনে
রাখবেন কেন। রাজনীতি বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বংশী, এখনো, প্রায়ই সেই ছেলেটির
কথা চিন্তা করে।

সত্তরের দশক মুক্তির দশক। বংশী সামন্ত নামটি বেশ ভাবায়। নকশাল ছেলেটি আজ নেই কিন্তু রোগী আর ডাক্তার তাকে মনে রেখেছে। কবিতাটিকে নকশাল আন্দোলনের মূল্যায়ন হিসেবে পড়া যেতে পারে কি? গল্পের গঠনের মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে। রাজনীতি বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বংশীর সেই ছেলেটির কথা চিন্তা করাকে কীভাবে দেখতে পারি আমরা? স্মৃতি এখানে সত্তার কথা বলে। চিন্তা অস্তিত্ববাচক। বিশেষ থেকে নির্বিশেষে পৌঁছুনোর প্রবণতা বারবার ধরা পড়ে কবির কবিতায়। তিনি ভালো- মন্দের মধ্যে দোলাচলতা দেখাতে চান। তাঁর কবিতার দর্শনে থাকে উত্তরণের কথা। সে উত্তরণ অবশ্যই মানবিক। ভাষার সংযোগের সঙ্গে নীরবতা মিশে নতুন এক ভাষা তৈরি করে। যার মধ্য দিয়ে হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে কবিতার বোঝাপড়া।


(৩) 


     বাবাকে
   
     ভাতকাপড়ের দুশ্চিন্তা করেই
     সমস্ত জীবন কাটলো আপনার।

     কোনো শিল্প, কোনো সম্ভোগ, কোনো উদাসীনতা
     আপনাকে স্পর্শ করলো না।

     আপনার কথা লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।
     আপনি আমার লেখার জগৎ থেকে একটু দূরে রয়েছেন,
     যেমন শহর থেকে একটু দূরে থাকে পাওয়ার স্টেশন।

‘মাত্রাচেতনা’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন- “ শ্রেষ্ঠ কবিতা- অন্য যে কোনো শ্রেষ্ঠ শিল্পের মতো কবিমানসের আপন অভিজ্ঞতাকে যতদূর সম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে-নিঃস্বার্থ জিনিস।” - কথাটি এই কবিতা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সম্ভ্রমজনিত দূরত্বের আঁচ আমরা পেয়েছি ছেলের বাবাকে আপনি সম্বোধনের মধ্যেই। ভাতকাপড়ের দুশ্চিন্তার জীবনে যে শিল্প, সম্ভোগ, উদাসীনতা স্পর্শ করতে পারল না, এর দায় বাবার একার নয়। ছেলের লেখার জগৎ থেকে বাবা দূরে থাকেন অনুপ্রেরণা হয়ে। পাওয়ার স্টেশন আলোর কথা বলে। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে বাবা যে আলো তুলে দিয়েছেন ছেলেকে। এই কবিতাটি পড়লে অদ্ভুত কষ্ট হয়। মনে হয় এ কথা আমার, আমাদের। মনে হয় বাবাদের কথা সেভাবে লেখা হল না বাংলা কবিতায়।  গরম ভাতের গন্ধে কত কিছু যে মিশে থাকে, সে কথা ভাবতে ভাবতে চোখ চলে যায় পরের পাতায়। পড়ে ফেলি ‘কলকাতা’ কবিতাটি—

এ শহরে মাটি বিক্রি হয়।

বেতের ঝুড়িতে করে চাপ চাপ অন্ধকার মাটি
ক্লান্ত মাথায় নিয়ে ফেরি করে উদোম বালক

চোখে পড়ামাত্র, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।

‘ইতিহাসচেতনা’ আর ‘কালজ্ঞান’কে সম্যকভাবে আত্মস্থ করেছেন বলেই এমন দৃশ্যকে কবি তুলে আনতে পারেন শব্দে। রণজিৎ দাশের কবিতার মিতায়তন তাঁর মনের বিশেষ প্রবণতাকে চিনিয়ে দিতে পারে। ‘পাঠকই কবিতা’ শীর্ষক লেখায় জয় গোস্বামী এই কবিতা সম্বন্ধে বলেছিলেন- “ সত্যি সত্যি এটি একটি শ্বাসরোধী কবিতা। অত্যন্ত স্বল্প কয়েকটি শব্দ এবং স্পেস ব্যবহারের নীরবতা এক দমচাপা ভাব ধরে রেখেছে। এবং মাটির আগে ব্যবহৃত হয়েছে চাপ চাপ অন্ধকার শব্দ দুটি। যদিও প্রথম লাইনটিতে, আপাতনিরীহ প্রথম লাইনটিতে মাটির আগে কোনো বিশেষণ নেই। একটা সামান্য স্টেটমেন্ট যেন। প্রায় কবিতার লাইনই নয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে পঙ্‌ক্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে কবির স্তব্ধ হতভম্ভ ভাব, তাঁর মর্মাহত বিস্ময় ধরা পড়ে। অর্থাৎ-- এমনকি, এই শহরে মাটি পর্যন্ত বিক্রি হয়।” এই কবিতাটি পড়তে পড়তে সত্তর দশকের অন্যতম কবি নির্মল হালদারের ‘অনাথপিন্ডদ’ কবিতার কথা মনে পড়ে- “মাটি বিক্রি করতে গেলে মনে হয়/ মাকে বিক্রি করছি/ মায়ের চোখ নেই মুখ নেই হাত পা নেই/ মা কেবল বুক পেতে দিয়েছে/ এক ঝুড়ি মাটির দাম আট আনা।” মাটির কথা এল, এল মায়ের কথাও। ‘শ্মশানছবি’ কবিতার শেষ পঙক্তিদুটি মনে হলেই সমস্ত দেহমনে শিহরণ ওঠে- “ ... সৌরশ্মশানের বুকে শীলমোহরের মতো জেগে থাকে সেই দৃশ্য:
                             মায়ের মুখাগ্নি করে সন্তানের অকৃতজ্ঞ হাত!”
শব্দের পবিত্র শিখা ছুঁয়ে থাকে আমাদের। পুড়ে যায় নিঃস্বতার আত্মঅহংকার।


(৪)

আমাদের শহরে
প্রত্যেক ধর্মের মানুষদের জন্য
ভিন্ন ভিন্ন দেবালয়;
কিন্তু সকল ধর্মের মানুষদের জন্য
একটিই বেশ্যালয়—

কোনো সমস্যা নেই। (আমাদের শহরে)  
কবি আমাদের চেনা পৃথিবীকেই হাজির করেন এমন গভীর তাৎপর্যে, চমক লাগে যেন। প্রত্যেক মানুষের ধর্মাচরণের জন্য আলাদা স্থান, কিন্তু যৌনতার পীঠস্থান একটি— ‘কোনো সমস্যা নেই’ শব্দবন্ধ ধর্ম নিয়ে মানুষের পারস্পরিক হানাহানির দিকেই দৃষ্টি আরোপ করে। আবার ‘খাটাল’ কবিতায় আমরা দেখি, একটি খড়ে ঠাসা মৃত বাছুরের মাথা মোষের সামনে এগিয়ে দিয়ে কীভাবে ‘অনর্গল ফেনা-ভর্তি দুধে ভরে ওঠে শহরের বালতি’। মা জানে না সন্তান মৃত, অপ্রাকৃত স্নেহের নিঃসরণ হয়েই চলে। শহরের খন্ড খন্ড অংশগুলো যেভাবে সিনেমাপোস্টারে সেঁটে থাকে, তাকে জড়ো করে গুছিয়ে রাখতে থাকেন স্রষ্টা। ‘সোডিয়াম আলোয় বি.টি রোড ঘোড়ার লিঙ্গের মতো লাল’, ‘তামাম চৌরঙ্গী তখন নিয়ন আলোর বাবলগাম’—অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে ওঠে লেখায়। ওনিডা টিভির শয়তানের কথা যখন বলেন ‘ টেলি- খুশি’ কবিতায়, ‘ সুপার মার্কেটের কবিতা’–য় লেখেন—“নতুন মানুষ এক বেরিয়েছে নতুন মার্কেটে/ ড্রেস্‌ড্‌ চিকেন- এর মতো/ নিজেকে বিক্রয় করে—স্বপ্ন ও কবিতার ডানাদুটি ছেঁটে” তখন বিশ্বায়িত সময়ের নিখুঁত আয়না হিসেবে কবিতাগুলিকে পড়তে অসুবিধা হয় না। আধুনিকতার নীরব সন্ত্রাসকেও প্রত্যক্ষ করতে পারি তাঁর কবিতায়। যৌনতার নতুন ভাষ্য তৈরি হতে থাকে মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। ‘মানুষের জীবন হচ্ছে ঈশ্বরের অসুখ’ লিখেছিলেন কবি ‘মিশেল ফুকো’ কবিতায়। ‘ঈশ্বরের চোখ’ কাব্যগ্রন্থে ‘সুড়ঙ্গ’ কবিতায় জানিয়েছিলেন- “প্রকৃত নিজের কাছে যাওয়া এক অকল্পনীয় অন্তর্ঘাত”। এক সন্ধ্যার পাগল বসে থাকে ফুটপাতে, গির্জার মাঠের গোলপোস্টে ঢুকে যায় চাঁদ, ‘নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের কথা’ কবিতাটি মনে পড়ে। মাছ ও জলের সংসারে তিনি এত একা কেন, এর উত্তরে যা বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে--
“এখানে আমার কোনো নিকট- আত্মীয় নেই, শুধু
 এক দূরসম্পর্কের ঈশ্বর আছেন।”



(৫)

প্রেমের কবিতার আলোচনা ছাড়া ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। ‘একটি প্রেমের কবিতা’র পর কীভাবে গ্রন্থিত হয় ‘প্রত্যাখ্যান’- এর পংক্তিমালা – “ সকল বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে/ জেনেছি যে, প্রত্যাখ্যান অনিবার্য।” প্রত্যাখ্যানের অতীত এক সম্পর্ক রচনাই কবির কাম্য হয়ে ওঠে। ‘দৃষ্টিবিনিময় একটি সম্পূর্ণ বিবাহ’ কথাটি ভাবতে থাকি। সমস্ত জীবন জুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুটে থাকার স্বপ্নে বিভোর মন, আপনজনকে দেওয়া ‘প্রথম লিরিক’--
“ আজ আবিষ্কার করি—
 পথের ধুলো ও ঘাস, ছায়া, প্রেম, কৃষ্ণচূড়া—এত বাস্তবিক।

দ্রুত হাতে লিখে রাখি কালো মেয়েটির জন্য প্রথম লিরিক।” স্মরণযোগ্যতা যদি কবিতার অন্যতম মাপকাঠি হয়, তবে এই লাইনগুলি আলাদা মাত্রা রাখতে পারে। ‘বন্দরে কথ্যভাষা’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির সূত্রে পড়া যেতে পারে ‘সমুদ্র সংলাপ’ বইয়ের ‘একটি জেন- কবিতা’কে। কবিতার বিষয় আর প্রকরণ মিলে প্রেমের দর্শনকে যেভাবে তুলে ধরেছে, তার তুলনা নেই—
  তুমি আমার বাড়িতে এলে।
  টেবিলে-রাখা আমার কবিতার বইটা
  ছুঁয়েও দেখলে না।
  
  গল্প করলে জঙ্গলের এবং জিপগাড়ির।
  আমি একটা সুদৃশ্য জাপানি পেয়ালায়
  তোমাকে চা দিলাম।

  তুমি বললে, ‘বাঃ পেয়ালাটা কী সুন্দর!’
  সেই পেয়ালায় চা খেয়ে তুমি
  উঠে চলে গেলে।

  আমার সব ক’টি কবিতা তুমি
  পড়ে চলে গেলে।

সৎ কবিতার স্পর্শে এসে আমাদের নিহিত অভিজ্ঞতার পুনরুত্থান ঘটে বলে জীবনানন্দের মনে হয়েছিল। সার্থক শিল্প আমাদের নিজের কাছে ফিরতে শেখায়। স্মৃতির বসত জুড়ে কত মুখের আদল ভেসে ওঠে। মানুষ যেভাবে বাঁচে, যেভাবে বাঁচতে চায় কিংবা বাঁচতে পারে—এই সবটুকু মিলে মানবিক অস্তিত্বকেই চিনতে শিখি আমরা। শ্রেষ্ঠ কবিতা সব অসঙ্গতির জট কাটিয়ে নিয়ে যায় অসীম আনন্দের দিকে।
বুঝি বৃষ্টি নেমে আসে। ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। টাটকা মেঘের জলে ভাসতে থাকে আমাদের মনকেমনের নৌকোরা… শুদ্ধ, নির্জন, অলৌকিক হয়ে উঠতে থাকে পাঠক কিংবা রণজিৎ দাশের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’।.

.......................................................………
রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা
দে’জ পাবলিশিং
কলকাতা
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০২
প্রচ্ছদশিল্পী- মিলন বন্দ্যোপাধ্যায়