জিয়া হক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
জিয়া হক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

আমাকে নিয়ে চলো। গদ্য। জিয়া হক

 


আমাকে নিয়ে চলো।

তুমি তাহলে যেতে চাও?

হ্যাঁ।

এই বাড়ি, শহর, রাতের সুন্দর খাবার, সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো আর ভালো লাগছে না?

আমি একবারও বলিনি আমার এসব ভালো লাগছে না।

তাহলে?

ভালো লাগা থেকে কোথাও চলে যেতে পারে না কেউ?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারে। কোনও কারণ ছাড়াই চলে যেতে চাও?

আমি ঘুরতে ভালোবাসি না, জায়গায় জায়গায় ঘুরে ঘুরে নানারকম খাবার খাওয়ার লোভও আমার নেই, বরং পুনরাবৃত্তিই আমার প্রিয়, একটা বই একই জায়গায় আমি সব সময় পড়ে থাকতে দেখতে চাই, তারপরও আমি এবার যেতে চাই।

কিন্তু যেখানে যাবে সেখান থেকেও তো একদিন পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করবে।

তখন পালাবো।

তাহলে গিয়ে কাজ কী?

তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গরম করে নিয়ে আসি। এইখানে বসে থেকো। কোথাও উঠে যেও না। যেভাবে বসে আছো সেইভাবে বসে থাকবে। চুল যেমন আছে তেমন থাকবে, হাত বুলিয়ে অন্যরকম করে দেবে না। তুমি আমার কেউ নও, অথচ তোমার কাছে আমার কত দাবি, তাই না?


আমি ঠাণ্ডা চা-ই খাবো। তুমি বসো। বলো, আমার কাছে এত দাবি কেন তোমার?

গান শুনবে? একটা নতুন গান শিখেছি।

আগে উত্তর শুনবো। তারপর গান শুনবো।

জানালাটা খুলে দিই? মনে হয় মেঘ করেছে। মেঘলা আকাশ দেখতে তুমি পছন্দ করো। করো না?

তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো আমার প্রশ্ন যেটা আসলে তুমিই তুলেছিলে।

আমি তুলেছিলাম, আমিই চাপা দিয়ে দিচ্ছি। আর একে খুঁড়ে বের করে এনো না। খুঁড়লে সব সময় গুপ্তধন পাওয়া যায় না, কঙ্কালও উঠে আসে।

আমার গুপ্তধন চাই না, কঙ্কালও চাই না। আমি শুধু প্রশ্নের উত্তর চাই।

তোমাকে একটা গল্পের বই দেবো, সেখানে তোমার প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। আমি বলতে গেলে তেমন করে বলতে পারব না।

আমি তো বইয়ের কথা শুনতে চাই না। তোমার কথা শুনতে চাই।

তোমাকে একটা সিনেমা দেখাবো, সেখানে তোমার প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।

নিজের কথা বলে তোমার কিছু নেই? সব ধার করা?

কে কার কাছ থেকে ধার করেছে? আমি তাদের থেকে না তারা আমার থেকে? সব ছবি, গল্প, গানেই তো আমি আছি, তুমিও আছো। নেই?

জানি না। আমার জানার কথাও নয়। কথা কি?

তেমনই তো কথা ছিল বলে জানতাম। কবে সংশোধন হল জানতে পারলাম না কেন?

তুমি আমাকে সরল ভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছো না।

সারল্য বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?

যা জটিল নয়।

জটিলতা কী?

তুমি জটিল। এখন নিজেকে বিচার করে দেখো জটিলতা কেমন।

মানে তুমি সরল। তাহলে নিজেকে বিচার করে বলো সরলতা কেমন।

আমার প্রশ্নটা শুধু হারিয়ে গেল। সেটা কি ঠিক হল?


জিয়া হক 

 


উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে চিন! : রুশান আব্বাসের সাক্ষাৎকার


 

রুশান আব্বাস উইঘুর সমাজকর্মী। চিনে উইঘুর মুসলিমদের নৃশংস অত্যাচার নিয়ে তিনি সরব। আব্বাস জানিয়েছেন, গণহত্যা চালানো হচ্ছে এবং চিনা কনসেন্ট্রেশন শিবিরে বন্দি করে রাখা হচ্ছে উইঘুরদের। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস অঞ্চলে জন্ম আব্বাসের। ক্যাম্পেন ফর উইঘুর নামে একটি সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী অধিকর্তা। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস রিজিয়ন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন কীভাবে মূর্তিমান বিপদ হয়ে উঠছে তা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তাঁর বড় দিদি গুলশান আব্বাসকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিনারা পণবন্দি করেছিল। প্রথমে চিনা সরকার সেই কথা স্বীকার করেনি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রী স্বীকার করেন যে, গুলশানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ চাপানো হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। রুশান ও তাঁর পরিবার এখনও জানেন না, গুলশান জীবিত রয়েছেন কি না। আইএএনএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উইঘুরদের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন রুশান।

প্রশ্নঃ বর্তমানে উইঘুর সমস্যা নিয়ে আমাদের বলুন।

উঃ কয়েক বছর ধরে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার শিকার। 'পুনর্পাঠে'র নামে লক্ষ লক্ষ উইঘুরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। কয়েক লক্ষকে আবার দাসে পরিণত করা হয়েছে। উইঘুর মেয়েদের শরীর এই গণহত্যার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাদের জোর করে বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে, গর্ভপাত করানো হচ্ছে এবং বলপূর্বক বিয়ে করানো হচ্ছে। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি তাদের অফিসিয়াল ট্যুইটারে প্রকাশ্যে এই ধরনের কাজকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারা দাবি করছে, তাদের এই দুর্ব্যবহারের কারণে উইঘুর মহিলারা কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে। এক লক্ষ উইঘুর শিশুকে সরকার পরিচালিত অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেজিং-এর চরম জাতীয়তাবাদী নীতি, বর্ণ-বৈষম্য ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের জন্মভূমির উপর নিগ্রহ চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি থেকেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যায়।

প্রশ্নঃ আপনার দিদি গুলশান আব্বাসকে জোর করে চিনা সরকার ধরে নিয়ে গেছে এবং আপনার পরিবারের কাছে তাঁর সম্পর্কে কোনও খবর নেই। তাঁর সঙ্গে কী ঘটেছে বলে আপনার ধারণা? এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনগুলি থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

উঃ আজ আমি আমার প্রিয় বোনের স্বাধীনতার বিনিময়ে আন্দোলনের কাজ করে চলেছি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমার দিদি গুলশান আব্বাসকে তাঁর উরুমচির বাড়ি থেকে চিন সরকার পণবন্দি করে। এর ছয় দিন আগে, ওয়াশিংটন ডিসিতে এক চিন্তাবিদের সঙ্গে আমি চিনের গণহত্যাকারী নীতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার হারিয়ে যাওয়া দিদির ঘটনা নিয়ে আমি যখন প্রশ্ন তুললাম তখন চিনের সরকারি মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে অন্যের ছবি চুরি ও আমার নিরুদ্দিষ্ট দিদির সম্পর্কে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ করে। তারপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রক দিদির নামোল্লেখ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগের ভিত্তিতে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কোনও বিচার নেই, কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনও খবর মেলেনি। পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার ও কথা বলার অধিকার কারাবন্দিদের থাকে। কিন্তু এ কেমন ধরনের কারাব্যবস্থা যেখানে এগুলিকে অনুমতি দেওয়া হয় না? আমার দিদি অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার এবং শান্তিপ্রিয় ও অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই তাঁর আটক ও কারাদণ্ডের মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে অন্যান্য উইঘুরদের চুপ থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। নীরব না থাকলে প্রিয়জনদের এমনই অবস্থা হবে।

প্রশ্নঃ চিনা সরকারের হাতে উইঘুররা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। ঠিক কী হচ্ছে সেখানে, আমাদের জানান।

উঃ ১৯৪৯ সালে আমাদের জন্মভূমি দখল করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর থেকে চিনের চাপানো কঠোর নীতির ভিতর দিয়ে দিনযাপন করছে উইঘুররা। সেই নীতি আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের বিরোধী। স্কুল ও কলেজে আমাদের ভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পাঠ্যে কাঁচি চালানো হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পালন ও অনুশীলন করার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে এবং কোনও রকম বাক-স্বাধীনতা নেই। এই ভাবে চিনা সরকার আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার সম্মুখীন। জেনোসাইড কনভেনশনের ২ ধারায় যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে এই গণহত্যার। বর্তমান কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ হল নিম্নে বর্ণিত কোনও কাজ যদি কোনও জাতি, এথনিক, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে ঘটানো হয় তা গণহত্যা, যেমন--

ক) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে হত্যা করা : আমরা প্রত্যক্ষ রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানি যে, নির্যাতন, অপুষ্টি ও মৃত্যদণ্ডের কারণে কারাগার ও শিবিরে মানুষ মারা যাচ্ছে।

খ) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা : এখানে মানুষ শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। কারাবন্দিদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। খাদ্য দেওয়া হচ্ছে না। এমন পদার্থ তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা জোম্বিদের মতো অবস্থায় চলে যাচ্ছে।

গ) এই তথ্য সবাই জানে যে, উইঘুরদের, বিশেষত মহিলাদের, জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে হান চাইনিজদের সঙ্গে এবং বিয়ে করতে অস্বীকার করাকে উগ্রবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ফলে শিবির বা কারাগারে আটক করা হচ্ছে। উইঘুর জনসংখ্যাকে লঘু করে দেওয়া বা সংকর প্রজাতি সৃষ্টি করাই চিনের লক্ষ্য।

ঘ) গোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংকরায়ন ঘটানোর কাজ চলছে। শিবিরে আটকে রাখা বন্দিদের বলপূর্বক বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে। গর্ভপাত করানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হচ্ছে। উইঘুর শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে। হান চাইনিজ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা ও কমিউনিজকে নতুন ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্নঃ চিন ও চিনপন্থীদের দাবি, আপনার আন্দোলনের পিছনে নির্দিষ্ট কিছু বিদেশি শক্তির মদত রয়েছে। এই সমালোচনার জবাব দেবেন কীভাবে?

উঃ এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমি একজন উইঘুর-আমেরিকান। ১৯৯৫ সালে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছি। আমেরিকান নাগরিক হিসেবে আমার সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তারই ভিত্তিতে আমি আন্দোলন করছি। আমার দিদির স্বাধীনতা ও যারা গণহত্যার শিকার তাদের জন্য আমার এই লড়াই।

প্রশ্নঃ দেশের মানুষদের অধিকার হরণ করে কি চিন বিশ্বশক্তি হয়ে উঠছে?

উঃ জোর করে শ্রমিক বানানো এমন এক অন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন যেটা চিন করে চলেছে। শিবিরে আটকে রাখা উইঘুরদের বলপূর্বক বৈদ্যুতিন, বস্ত্র ও অটোমোটিভ কারখানায় কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে কাজের পরিবেশ কদর্য। উইঘুরদের তা সহ্য করতে হয়। কাউকে সামান্য মজুরি দেওয়া হয়, কাউকে কিছুই দেওয়া হয় না। তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে যে পণ্য উৎপাদিত হয়ে আসে তা ব্যবহার করে অ্যাপল, অ্যামাজন, বিএমডব্লিউ, নাইকি ও অ্যাডিডাসের মতো বড় বড় ব্র্যান্ড। চিনকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করে তুলেছে যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই, সেখানেও এই শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় কাজ করতে এবং তারা নানা অধিকার ভঙ্গের সমস্যায় ভোগে।

প্রশ্নঃ তিয়ান-আনমেন স্কোয়ারের ম্যাসাকার চিনের জন্য একটা বড় কলঙ্ক। তারপরও কোনও নৈতিক দ্বিধা ছাড়াই এই দেশ এগিয়ে চলেছে। চিন সরকারের ভয়ে কি চিনের ছাত্র আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মীরা নীরব রয়েছেন?

উঃ আমার যখন ১৮ বছর বয়স, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন সরকারি নীতির (১৯৮৫ সালের ১২ ডিসেম্বরে)বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্র আন্দোলনের আমি ছিলাম সহ-সংগঠক। ঐতিহাসিক ভাবে বলছি, ছাত্র আন্দোলন শেষ করে দেওয়া হয় ছাত্রদের বরখাস্ত করে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়ন করে, বন্দি করার মাধ্যমে বা হত্যার মধ্য দিয়ে। চিনে আপনারা যে সব প্রতিবাদ দেখেন, এর অর্থ হল, গুরুতর কিছু ঘটছে যার জন্য মানুষ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।

প্রশ্নঃ চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে মানুষ কীভাবে দিন গুজরান করেন?

উঃ ১৯৪৯ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করার পর থেকে চিন সরকার অবিরাম চেষ্টা করেছে উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে ধ্বংস করে দিতে। পঞ্চাশের দশকে 'জাতীয়তাবাদী' তকমা দিয়ে উইঘুরদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। ষাটের দশকে তাদের বলা হল 'প্রতি-বিপ্লবী' এবং নয়ের দশকে তাদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হল 'বিচ্ছিন্নতাবাদী'র তকমা। ৯/১১ ট্রাজেডির পর, কমিউনিস্ট রেজিম তাদের অত্যাচার-লীলাকে 'সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে'র ছদ্মবেশে নতুন ভাবে সামনে এনেছে। বর্তমানে পূর্ব তুর্কিস্তানের মানুষ শি জিনপিং-এর আপন প্রকল্প 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড'-এর শিকারে পরিণত হয়েছে। গোটা এলাকাকে ঘিরে রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ব্যাষ্টিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনা অপরাধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। সব রকম রাজনৈতিক প্রতিরোধকে চিন 'ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' হিসাবে তুলে ধরছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছে এক নজরবন্দি রাষ্ট্রের। সংগ্রহ করা হচ্ছে ডিএনএ, চারিদিকে লুকনো ক্যামেরা, মুখ-চিহ্নতকারী সফটওয়্যার ও গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিং লাগানো হয়েছে। শিবিরের এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, তথাকথিত 'কারিগরি প্রশিক্ষণে'র অর্থ হল সশস্ত্র বাহিনী, কাঁটাতার, উপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা ঘর, অপুষ্টি, পানীয় জলের অভাব, বেহাল শৌচব্যবস্থা। এর আরও অর্থ হল, ঘর ও পরিবার থেকে ছিন্নমূল করে দেওয়া, সংস্কৃতি ও ধর্মকে পিষে দেওয়া, জোর করে ধর্মান্তরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আমার জন্মভূমিতে চিনের সামরিকীকরণ অব্যাহত এবং এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সিসিপির কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গণ-পরিযায়ন চলছেই, বদলে যাচ্ছে পূর্ব তুর্কিস্তানে জনবিন্যাস এবং এতে লাভবান হচ্ছে হান চিনারাই। তাই, বহু দেশের স্বীকৃতি ও মিডিয়ার চোখের সামনে সব ঘটার পরও গোটা বিশ্ব যেন নিথর হয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শিবিরে আটকে রাখা লক্ষ লক্ষ উইঘুরদের জোর করে শ্রমিক বানানো হচ্ছে। তাদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। শিবিরের বাইরে বাস করা উইঘুরদের সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখা হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন প্ল্যাটফর্মের (আইজেওপি) মাধ্যমে। কোনও 'সন্দেহজনক' আচরণ শনাক্ত করতে এই ব্যবস্থা। এই লাগাতার নজরদারির ফলে উইঘুরদের চলাফেরা, যোগাযোগ রক্ষা ও মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা নেই। সারাক্ষণ আটক হওয়ার ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চিনের তথাকথিত 'জিরো কোভিড' নীতির আওতায় এই অঞ্চলকে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সার্বিক লকডাউন করে রাখা হয়েছিল। কোনও খাদ্য, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়নি। আধিকারিকরা এসে দরজাগুলিতে তালা ও শেকল ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, রাস্তাগুলি বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ২০২২ সালের নভেম্বরে যখন অগ্নিকাণ্ড 'ঘটে', তখন মানুষ অসহায় ভাবে পুড়ে মারা গিয়েছে।

প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়, কিন্তু আপনারা যে যন্ত্রণা সহ্য করছেন তা তেমন তুলে ধরা হয় না। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

উঃ আসলে, বিশ্বের অর্ধেক দেশই চিনের উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। এই কারণে, অধিকাংশ দেশ, বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি চুপ করে আছে। মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে মুনাফার গুরুত্ব অনেক বেশি। গোটা বিশ্ব রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনকে দেখছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যেন মায়ানমার সরকার এই পাশবিকতা চালাচ্ছে। অথচ, বেজিং রয়েছে এর পিছনে। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প যে সব এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেখানেই মুসলিমদের রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করতে মায়ানমারকে চালিত করেছে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। মায়ানমারের নেতাদের চিন চাপ দিয়েছে যাতে যে সব এলাকা দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ হবে সেখান থেকে মুসলিমদের উৎখাত করা হয়।

প্রশ্নঃ উইঘুর সমস্যার যৌক্তিক সমাধান কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উঃ জটিল প্রশ্ন। যুক্তি দিয়ে বললে, কোনও দেশের মানুষ যেন গণহত্যার মুখে না পড়ে। কিন্তু বর্তমান মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে যা দাঁড়িয়েছে তা হল, সকল দেশকে মেনে চলতে হবে যে, কোনও সরকার (এ ক্ষেত্রে চিন) যদি গণহত্যা রুখতে ব্যর্থ হয় বা নির্দিষ্ট পরিমিত বজায় রাখতে না পারে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাহলে, রাষ্ট্রসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছে সেই দেশ জবাবদিহি করতে বা দায় নিতে বাধ্য থাকবে। তাদের উপর চাপানো হবে নিষেধাজ্ঞা, রেজল্যুশন বা অন্য পথও অবলম্বন করা যেতে পারে। কর্তৃত্ববাদী রেজিমগুলি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে আজও, এর কারণ হল, এই ভয়াবহ কাজ রুখতে যথেষ্ট চাপ তাদের উপর নেই। হ্যাঁ, চিনারা উইঘুর গণহত্যার জন্য দায়ী, কিন্তু বাকি বিশ্বও সমান ভাবেই দায়ী, যদি এই গণহত্যা বন্ধ করতে তারা যদি কোনও পদক্ষেপ না নেয় এবং এই রেজিমকে দোষী সাব্যস্ত না করে। গণহত্যা, দাসত্ব ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চিনের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এই ইস্যুর সমাধানের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর এবং সেই সঙ্গে চিনা রেজিমের হাত থেকে উইঘুরদের রক্ষা করাও তাদের কর্তব্য।


অনুবাদ : জিয়া হক

তারপর যা হওয়া উচিত । জিয়া হক

ব্যাঘ্রশাবক অরণ্য পরিদর্শনে বাহির হইয়া দেখিল এক রুগ্ন, শীর্ণ ও প্রৌঢ় কাঠুরে ঘামিতে ঘামিতে একটি বাবলা গাছের মোটা শিকড় কাটিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার লাল গামছা মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ব্যঘ্রশাবকের বড় করুণা হইল। কাঠুরেটির কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। একটি জলজ্যান্ত ব্যাঘ্র দেখিয়া ভয় পাইয়া দুই পা পিছাইয়া গেল কাঠুরে। পালাইবার পথ খুঁজিতে সে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল। কিন্তু সে তো জানিত না, সকল ব্যাঘ্র অনুরূপ হয় না। ব্যাঘ্রশাবক বিনীত ভাবে করজোড়ে বলিল, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষ খাওয়া শিখিনি। নররক্তের স্বাদ কী তা আমার অজানা। কাঠুরে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, আমি কি তোমার প্রথম খাদ্য হব? দুঃখমিশ্রিত হাসিতে সেই শিশু ব্যাঘ্রের মুখখানি মলিন হইয়া গেল। সে বলিল, আপনি কাঁপা বন্ধ করুন। একটা জরুরি কথা আপনাকে এখন বলতে চাই, মন দিয়ে শুনুন। আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আপনার কাঠ আমিই কেটে দেব। আপনি শুধু সেগুলো বেঁধে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবেন। এমন আশ্বাস ও অভয়বাণী শুনিয়া কাঠুরে শান্ত হইল। তাহার চোখে জল আসিল। মাটি হইতে গামছা তুলিয়া চোখ মুছিয়া সে বলিল, তুমি নিশ্চয়ই বনেদি বংশের। তোমার শরীরে এক বিন্দু হলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই তোমাকে মানুষ করে দেন। আজ আমি চলি। এই বলিয়া কাঠুরে তাহার ছোট কাঠের বোঝাটি মাথায় চাপাইয়া চলিয়া গেল বাজারের দিকে। শিশু ব্যাঘ্রটি আবার চলিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে দেখিল, প্রখর রৌদ্রে এক কৃষক কাদা-জলে দাঁড়িয়ে ধানের চারা পুঁতিয়া দিতেছে। তাহার শরীর অনাহারে অর্ধাহারে পাকাটির মতো হইয়া গিয়াছে। দর দর করিয়া ঘামিতেছে অথচ কাজে বিরাম নাই। এই দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটির বড় মায়া জন্মিল। গুটি গুটি পায়ে সে কৃষকটির পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। কত দূর ধানের চারা পোঁতা হইল তা দেখিবার জন্য পিছনে ফিরিয়া কৃষকের চক্ষু চড়ক গাছে উঠিল। সে উল্টাইয়া কাদাজলে পড়িয়া গেল। সেই দৃশ্য দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটি মুচকি হাসিল। তারপর বলিল, আমাকে অনুগ্রহ করে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষের মাংস খাই না। নররক্তের স্বাদ কেমন তা আজও আমার জানা হয়নি। কৃষকটি বলিল, তাহলে আমাকে দিয়েই কি শুরু করবে, বাবা? শিশু ব্যাঘ্রটি বলিল, আমাকে বাবা বলেছেন মানে আমি আপনার সন্তান হলাম। বাবার প্রতি সন্তানের একটা দায়িত্ব থাকে না? কৃষক জানাইল, আমার তো তিন ছেলে। কেউই তাদের দায়িত্ব পালন করল না। আমাকে খেয়ে তুমিই সেই দায়িত্বটা পালন করে দাও, বাবা। আপনি অযথা ভয় করছেন। আমি এখন একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন আমিই আপনার ধানের চারা পুঁতে দেব। ধান বড় হলে কেটে, বেঁধে, ঝেড়ে, বস্তা বোঝাই করে ধান আপনার গোলায় তুলে দিয়ে আসব। আপনি শুধু বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসবেন। কৃষক বলিল, তুমি কোন বাড়ির ছেলে বাছা? তোমার মনে এত মায়া কোথা থেকে এলো বাছা? তুমি নিশ্চয়ই বাঘবেশী কোনও দেবতা। যদি দেবতা না-ও হও, তাহলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত এক ফোঁটা হলেও তোমার শরীরে বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই যেন তোমাকে মানুষ করে দেন। এই বলিয়া কৃষক বাড়ির পথ ধরিল। ব্যাঘ্রশাবকটিও চলিয়া গেল। গুহায় ফিরিয়া বাবা-মা'কে যা যা দেখিয়াছিল সব কথা বিস্তারিত বলিতে লাগিল ব্যাঘ্রশাবকটি। শুনিয়া তাহার অভিভাবকরা চমকাইয়া উঠিল। সন্তানের এমত মতিগতি তাহাদের ভাল ঠেকিল না। তাহারা বুঝিল বিপদ আসন্ন। মনুষ্যপ্রজাতির হাতেই তাহাদের সন্তানের অনিষ্ট হইবে। পুত্র যাহাতে বুঝিতে না পারে সেইভাবে তাহারা ভিন্ন ভাষায় আলাপ করিতে লাগিল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইয়ে জাগা ইসকে লিয়ে ঠিক নেহি। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, কিসি দুসরে জাগা পর ইসকো লে জানা চাহিয়ে। -তুমহারি শ্বশুরাল জিস জঙ্গল মে হ্যায়, ওঁহা পর জানা সব সে সেফ হ্যায়। -ঠিক কাহা আপনে। চলো, কাল হি নিকাল পড়তে হ্যায়। ব্যাঘ্রশিশুটি পিতামাতার কোনও কথা বুজিতে না পারিয়া আকাশ দেখিতে লাগিল। অরণ্যানির মর্মরধ্বনি, দূরের ঝর্নার কলকল শব্দ, পাখির বিচিত্র গুঞ্জন, শুষ্ক পত্র ঝরিবার খসখস আওয়াজ শুনিতে লাগিল। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা কী বলছ গো? ব্যাঘ্রমাতা বলিল, অনেক দিন এই বনে আছি। কাল আমরা তোর মামার বাড়ি যাব। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসব। তোর মামা খবর পাঠিয়েছে। পরের দিন তাহারা বাহির হইয়া পড়িল। সকাল হইয়াছে। চারিদিকে কেবলই আলো। রাস্তা নির্জন বলিয়া ঘাসেদের তখন ঘুম ভাঙে নাই। ব্যাঘ্র-পরিবার সন্তর্পণে লোকালয়ের পাশ দিয়া চলিতে লাগিল। ব্যাঘ্রশিশুটি পুনঃ পুনঃ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া তাহাদের পুরাতন অরণ্যখানি দেখিতে লাগিল। তাহার মুখে খানিক দুঃখ লাগিয়া রহিয়াছে। অকস্মাৎ এক কাণ্ড ঘটিল। তাহারা দেখিল, পথের পাশে এক কাঠুরে তাহার পরিবারসহ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার হাতে গুড়-মুড়ি-বাতাসা-চিঁড়ে। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইনি কে? ব্যাঘ্রশিশুটি বলিল, প্রকৃত মানুষ। তাহারা আবার চলিতে লাগিল। আরও একটি লোকালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখিল কেউ যেন কিছু হাতে লইয়া কারও জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কাছে যাইতে তাহারা দেখিল--এক কৃষক। তাহার হাতে রুটি-তরকারি। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, ইনি কে খোকা? ব্যাঘ্রখোকা বলিল, প্রকৃত মানুষ।

চিরাচরিতমালা : নিজেকে সমবেদনা : জিয়া হক



 

মাথার ভিতরে কারা হেঁটে বেড়াচ্ছে শব্দ করে। 

সেই শব্দে শব্দে আমি জেগে রয়েছি। 

রাত্রির কাছে আমি দেহী পাখার বিস্তার নয়, দাবি করি ঘুম। 

অনুরোধ শুনতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ কখনও দাবি শুনতে চায় না। 

কষ্ট হতে থাকে। 

কষ্টের কথা ডাক্তার ছাড়া কাউকে বলতে নেই। 

তিনি কষ্ট শোনার দাম নেন, চেষ্টা করেন উপশম করে দেওয়ার। 

মনে মনে খুঁজি সেই লোকটাকে 

যাকে সব কথা খুলে বলা যায় 

এবং যিনি হেফাজত করবেন সেই অসহায় কথামালা। 

কান থেকে কানে, মুখ থেকে মুখে কথারা ভেসে ভেসে সাত সাগর সতেরো নদী পেরিয়ে যায়। 

দশদিক চঞ্চল হয়ে ওঠে, বসে বিচারসভা, এখানে সকলেই জাজ।

লক্ষাধিক রায় বেরোয়। 

আসামির লক্ষবার সাজা হয়। 

সংবিধান চুপ করে থাকে যেন সে  কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো পিতা, 

সন্তানদের কলহ উদাসীন দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট নেই।

কল্যাণপুরে কল্যাণ থাকে না, 

যেভাবে সংসদে শংসাপত্র হাতে বিষধর মানুষচূর্ণ। 

শক্তি দাও। স্মৃতির শক্তি। 

যদি অতীত ভুলে যাই, আমি যে আমিই তা প্রমাণ করব কীভাবে? 

নিজেকে নিজের কাছে কখনও-সখনও প্রমাণ করতে হয়। 

আত্মপক্ষ সমর্থনের করতে গিয়ে 'আত্ম'বিস্মৃত বোধ করলে মামলা খারিজ হয়ে যায়। 

এই মামলায় হারা মানে শূন্যে গিয়ে দাঁড়ানো। 

সেখানে দাঁড়ানো যায়? ভেসে বেড়ানো যায়। 

যা ওড়ে তা যেমন পাখি নয়, যে ভাসে সে-ই মেঘমালা নয়। 

তার বারিধারা হয়ে ঝরে পড়বার সৌভাগ্য নেই। 

সে সাড়ে তিন হাত ঘুমোতে চায়। 

জায়গা পায়, সহমর্মী গাঁদার আপ্যায়ন পায় না বলে 

রাত্রির কাছে দুপুর আর দুপুরের কাছে রাতের প্রার্থী হয়ে 

হাত তুলে থাকে। 

বিদ্যুতের অসীম জেওরে সাজিয়ে রেখেছে আধা-বৃষ্টির প্রায়ান্ধকার রাত্রির আকাশ। 

দর্শক-শূন্য এই বায়বীয় মাঠের খেলাধুলা। 

প্রতিটি মানুষ নিজস্ব গোয়াল ও খোঁয়াড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবী শীতলতর হয়েছে ভেবে। 

তার কথা ভাবি যে সুষম তর্কের পুষ্টি পেতে চেয়ে অাগলবিহীনভাবে কথা বলে যায়। 

প্রতিটি কথায় সে বিস্ময়সূচক চিহ্ন বসায় আর বিস্মিত হতে হতে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। 

সে বেঁচে আছে। বাঁচবার প্রণোদনা দেয়। 

সবাইকে সে বর্জন করেছে বলে দাবি করে, তবে জ্ঞাতার্থে জানাই, তার শুভ বিবাহে অন্তত এক হাজার অতিথি দেখেছি। 

রস আছে তাই রসিকতা আছে। 

সন্ন্যাসী রাজা হয়, রাজাও সন্ন্যাসী। 

গানটুকু রয়ে যায়। কে গায় ঐ? 

উচ্চবংশীয় প্রলাপ মধুর। 

বংশ মানে বাঁশ। তার যাত্রা সভ্যতার পায়ুপথ ধরে। 

সিদ্ধান্ত শোনাবে বলে প্রাচীনা আলমারি থেকে বের করো নৈয়ায়িক ধুতি। 

শ্রাবণের দিনগুলো আষাঢ়ের স্মৃতি নিয়ে গর্ববোধ করে কেননা আকাশে নেই বৃষ্টি-উদ্রেককারী মেঘ, 

গত মাসে ছিল। 

রাখাল ছেলের গল্প : জিয়া হক



রাক্ষসবাড়ি পাহারা দেবার ছলে
ঘুমিয়ে পড়েছে রাখালের কচি খোকা
স্বপ্নে দেখছে মায়ের অট্টালিকায়
স্নেহ ধরে আছে সোনামন থোকা থোকা

পাহাড়ের নিচে শাঁপলা দেশের খুকি
ফুল তোলে আর তাড়া করে প্রজাপতি
পরনে ময়লা ছেঁড়া ছেঁড়া নীল শাড়ি
চোখে জল তার, কে এই দুঃখমতী?

রাখালবালক বাজাবে কি যাদুবাঁশি?
যাবে নাকি ওই নীল মেয়েটির পাশে?
চোখের জল তো হীরের চাইতে দামি
ঝরে যেতে দেওয়া ঠিক নয় বৃথা ঘাসে

হয়ত মেয়ের নাকের গয়নাখানি
হারিয়ে গিয়েছে ঝর্নার বুনো জলে
ফুটে গেছে পায়ে লতাগুল্মের কাঁটা
বালক আসছে একাই সদলবলে

একাকী বালক রাক্ষসপুর দেখে
সে পারবে না বালিকার কাছে যেতে?
গান্ডীবে তার অস্ত্র বলতে বাঁশি
ব্যথা পারবে না ব্যথাকে উদ্ধারিতে?

পুষ্প হাতে আকাশের দেবতারা
ঢেলে দেবে বলে উন্মুখ সারিসারি
নাকফুল তুমি লুকিয়ে কোথায় আছো
পৃথিবীর কাছে তুমি খুব দরকারি

ঘুম ভেঙে যায় খড়ের গাদার নিচে
কোথায় কন্যা, রাক্ষসপুর, বাঁশি
রাখালের গাভী গেছে খাদ্যের খোঁজে
সেও কি হবে না সঙ্গীতে সন্ন্যাসী?

দূরে দেখে তার গাভী নিয়ে এক মেয়ে
ময়লা শাড়ির ছেঁড়া নীল পাড় দাঁতে
এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে ধীরে
খুব মিল তার দুঃখমতীর সাথে

কাছে এসে বলে, এই নাও প্রিয় পশু
বারবার বলো খুঁজে দেওয়া সম্ভব?
রাখাল বলল, ভালবাসো মেয়ে গাধা?
আমাকে রাখো না, আমি সেই গর্দভ

 


বাংলায় একটি 'শের' লিখতে চেয়েছিলাম



একটি নক্ষত্র আছে আরও এক নক্ষত্রের পাশে
দেখতে যদি চাও
একটি নক্ষত্র আছে আরও এক নক্ষত্রের পাশে
দেখতে চাও যদি

আমার চোখের দিকে দেখো

যদি বলো, এ তো শুধু চোখ; নেই সেই আলো
যদি বলো, এ তো শুধু চোখ; নেই সেই আলো
তাহলে জানাই

বহুদূর থেকে তারা তোমাকে দেখবে বলে পথে নেমে
ক্রমাগত নিষ্প্রভ হয়েছে--তাই
চোখে নয়, সুর্মা পরাই আমি মুখে,--যেহেতু

শব্দ আলো দেয়

শব্দের আলোয় আমি
তোমার মুখের পত্রখানি খুলে খুলে পড়ি
শুনতে চাও যদি
তোমার মুখের পত্রখানি খুলে খুলে পড়ি
শুনতে চাও যদি

আমার নামের ধ্বনি শোনো

জিয়া হক
চিত্র : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত


সঙ্গে সঙ্গে সাথে : জিয়া হক



…………………...............................................
পানার পুকুরে এই সবই ঝুঁকে পড়েছে।
ঝুঁকে পড়েছে কেননা বড়ো ভার।
ভার বইবার দেহখানি পুষ্টি পায়নি তাই
রাষ্ট্র করে দেয়, এখানে খাদ্য আছে আর আছে
কল্যাণকামী ছায়াভর্তি জল।
এখানে মানুষের দুইখানি পা, কৃষিকাজ করে বলে
এদেরকে কেউ মেধাবী বলে গণ্য করে না,
এইখানে চোখগুলি এত নুন ভরা, সামান্যতমতেই ঝরে পড়ে।  
ইঁটের বাড়িগুলি শ্রাদ্ধে বামুনের শ্রদ্ধার্ঘের গামছার মতো
আলো রাখলেই বেরিয়ে পড়ে
সেই আলো চাঁদের আলোর সাথে দেখা করতে চায়
তারা চায় স্থল ও শূন্যের মধ্যে যে মালপত্র আছে তার
গায়ে গাভীর দুধের মতো পুষ্টি রেখে যেতে


চিত্র : মনেঁ

দিন যায় বর্ষকালাধিক : জিয়া হক


আমার চিন্তা জটপাকানো উলের মতো গড়াতে গড়াতে নিম্নগগনের দিকে শূন্য-ঝাঁকা মনোহারি দ্রব্য বিক্রেতা হল।
৩ দিন পৃথিবীর মতো আর গ্রহ নেই, ৪ দিন এ আমি কোথায় এলাম। ৭ দিন আকাশে কুসুম, বাকি সাতে কুসুম আসে না।
মাসে মাসে জন্মদিন হয়, প্রতি মাসে বৃদ্ধ হয়ে যাই।
দেখে রাখি কোথায় সমাধি, সেখানেই বাড়ি বসে যায়।
১ সাল রাত্রি প্রেমোদ্ভব, ১ সাল ভানু দিবাকর।
ছেড়ে গেল দশকের অটো, ধরে থাকি হাজার হাতল



উপরিভাগে : জিয়া হকের কবিতা


অশ্রুনদীর ধারে আমি দুইখানি গর্ধব আর নিজেকে দেখলাম
তিনজন গর্ধবই ছিল, তিনজন পবনসন্তান
গাছে গাছে আম্র আর বিভীষণ আশেপাশে ছিল
আমার সুলক্ষণ চাই, আমাকে সীতা এনে দাও, বলি
এই সেই ব্যস্ত নালিখাত যার তীরে জয়ী--পরাজয়ী
সিজদানত ছুরি
কোথায় কেবলামুখ, কোনদিকে ওহুদের টিলা
অজ্ঞানতা আছে তাই কাবাঘর সব দিকে আছে
কোন বনে লুকিয়ে রয়েছো দুষ্ট প্রভু?
ছেঁড়ে দেহ কাঁটা ও শামুকে--তুমি কি শিকারে রয়েছো?
তিন প্রাণী, নদীর এপারে, গলা শুকনো, অশ্রু পান করে
গ্রন্থ পিঠে, অপৌরুষেয়, সুস্বাদ কোথায়?
কতদূর ঐশ্বরিক কচি ঘাসজমি?
তোমাকে চিবিয়ে বুঝবে ঘাসে তুমি কতটুকু আছো


কমদামী বাজার : জিয়া হকের দুইটি কবিতা


প্রথম
প্রয়োজন না হলে জাতির জন্যে লেখা গান কে আর সময় ব্যয় ক'রে শোনে

তার সুর আরোপিত, মনে হয় কেউ বলে, দেশের বিভিন্ন চার কোণে

আমাদের দলের ভেতরে

লৌকিকতার থেকে লোক মুছে গেছে

যাদের ভাসার ঢং
        ঘৃণা করেছিল

বীরখালি গ্রামে শুধু তাহাদের ছায়া পড়ে আছে

দ্বিতীয়
আমি, মনে হয়, গতিপ্রকৃতির নীচে নেমে গেছি
নীচে শুধু আমি ব'লে আমার মতন গতিপ্রকৃতির
কিছুজন থাকে।
যার যৌবন আসে, কাছে, দূরে, ছেড়ে চলে যায়
বালিশে মাথা দিয়ে না শুলে বালিশ ঠাণ্ডা হয়ে থাকে
পুকুর কাটার জন্যে পুকুরে নেমেছি। সেটা নীচে নামার
মতো ভীতি। আমি পেয়েছি। মানুষদের কাজে আসে ব'লে
মাছেদের, মাছিদের, কোনও কাজেই লাগে না এই জল। মাছেরা
অমূলক কথা কম বলে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তারা জেগে থাকে
মানুষের চেয়ে বেশিক্ষণ তাদের চোখ খোলা আছে। আমি বলি--
ওই ঘাটে বসা ঘষে রাখা রাত্রির ডিশখোলাদের
ব্যবহৃত হয় আর ব্যবহার করা মিলে সমাজের গতিপ্রকৃতির
নীচে নেমে বহু দেখি ওপর ব'লে কিছু নেই; সেখানে রাতের গায়ে
মানুষের কমদামী বাজার বসেছে;
জড়ুলের ঘষামাজা দেখে দেখে মাছের মতন চোখ
যাদের অসংখ্য খুলে গেছে,
আমি যাদবপুরে অনেককে দেখেছি, সার্কাসে কেউ কেউ ছিল
প্রতিভাপূর্ণ ব'লে পাশ কেটে সাধারণতের মধ্যে গেছি
সকলের কান আমি নীচ থেকে চিনতে পেরেছি
অ-নীচু, অ-উঁচুর তলা দিয়ে নিম্ন চলে যায়, চলাচল উচ্চ ক'রে থাকে
যাকে আমি মান্যতা দিয়েছি
হয় নম্রতাকে ভালোবাসে ব'লে কখনও সে নীচ হয় 


চিত্র : উইলিয়ম ব্লেক


বন্দীশালার ছড়া : এপ্রিল ২০২০


আলো আসে বঙ্গবিদ্যা, অ-পূর্বের জাফরি পথ ধরে
আমার কল্যাণ হয় বন্ধুবৃত্তে, যদিও তা কাল্পনিক স্তরে
বিদ্যা প্রাঞ্জল তাই বিদ্যাধরী তীর
ভুল মন্ত্র, ভুল কন্যা করেছেন অস্থির—
নাটকীয় যত ফুল
তুলে তুলে দেখি, তুলে তুলে দেখি
                         কতদূর নির্ভুল
বিদ্যা অল্প ব'লে
প্রজাপতি শুধু ঘুরে যায় আর প্রস্তাব যায় চলে
কাদের প্রস্তাবনা?
চিঠিতে জানাব, দুধ ফুটে ওঠে, আপাতত ভাববো না
জানো কি পত্র-রীতি?
প্রিয় বন্ধুতে শুরু আর জেনো শেষে আমাদের প্রীতি
যায় না এভাবে সুর?
যন্ত্র, বাদ্য, ব্যাকরণ ছাড়া যাবে যে অন্তঃপুর—
জাল বিজ্ঞান মতে
ভালোবাসা এক অপরাধ যার সমাপ্তি নাক ক্ষতে

জিয়া হক
চিত্রঋণ : হরিশ মণ্ডল

তার নামে বিদ্যালয় হবে : জিয়া হক


ভুলেই গিয়েছিলাম দিন আসছে ধীরে, রাত্রি দূরে নয়,
মাঠে মাঠে গাভীর পায়ের ছাপে জল ভরা আছে, আত্মজীবনীর সটীক সংলাপ ওই রাত্রিচরাচর জুড়ে
বেছানো রয়েছে,
বাগদী বুড়ির মতো তুলে আনতে হবে চুবড়ি ভর্তি করে, পেহচান কৌন বলে চোখ চেপে ধরে আমার অতীত,
কে ওই অনুল্লেখ্য লোক, পাতা খোঁজে জঙ্গলে জঙ্গলে,
উলঙ্গ তাই পোশাক বানাবে,
সে একটা নদীর মালিক,
এইমাত্র খনিজের জন্ম দিয়ে এলো, তার হাতে মহিলার খোঁপার উল্লাস অথচ চুম্বনরহিত,
প্রত্যাখ্যান পেয়ে পেয়ে সে আজ ব্রোঞ্জের ঝুরি হয়ে গেছে, শিশুর দোলনা হয়ে জীবন কাটায় এক প্রতিবেশী গ্রামে, পেহচান কৌন বলে কেউ তার পিছুও ডাকে না,
পেহচান কৌন বলে সে শুধু সময়ের চোখ চেপে ধরে।