আরও দুটি পদ্য


যীশুর একদিন
.....................
পুরনো পুরনো সব লোক
বলে যায় অতীতের দিন
সাগরের ঢেউয়ে ছিল ব্যথা
খ্রিস্ট প্রাচীন

সাগরের ধারে ছিল গ্রাম
কৃষিকাজ মাছ ধরা পেশা
সবার পাপের ভার কাঁধে
বয়েছে হামেশা

পাপের বস্তা নয় বড়
রাস্তাও ছায়াযুক্ত পাকা
দিন যায় দিবসের শেষে
পলাতক চাকা

দিন থেকে খসে পড়ি আমি
কদলীতলার নীল বনে
সাগরীয় পাপ যত ভাসে
আমি কি করিনে?




এই দিল, মুশকিল
........................
নুয়ে পড়া লুব্ধ প্রেমকথা
ফল নাই পাতা নেই ফুটেছে অযথা
ঘোরে যত চতুষ্পদ প্রাণী
           ভাদ্র মাসে প্রেম হয় জানি

আর হয় নদী উপকূলে
বিপুল কাঁদছে বসে আরেক বিপুলে

সেই জল দেবীদের পায়ে
ফুটে ওঠে ছোটো পাত্রে
                         চালাঘরে চায়ে
খরিদ্দার আসে
বিপুলের কান্না ভালোবাসে

কোথাকার জল তারা জানে?
কোন কাব্য মেয়ে হয়ে বসেছে আখ্যানে?

পান করা হোক
বলে সব প্রস্তাবিত লোক

ভোজনের হাড়মাংসগুলি
শব্দ হয়ে বাক্য হয়ে ছড়ায় অঙ্গুলি

কে না জানে সব
প্রেম হল যৌনদেশে নম্র কলরব

জিয়া হক


দুটি পদ্য

আমাদের বাড়ি সরিষায়
..................................
আমি আমার ব্যক্তিগত ভুলে যাই
একটি কাঠ, তুমি কীভাবে থাকো অর্বাচীন?
সব ধুয়ে যায় —ধৌত হয় মহান
মহানের ধুলোবালি বেরিয়ে পড়ে
পুজো হয় পার্বনের মতো, —ধুতি পরা কিশোর দেবতা
নগর ভিক্ষুকেরা ছবি তোলে, তোলে কন্যা
সিটি বাজার সিটি বাজানোর বয়স পেরিয়ে যায়
এক শালপাত্র ভালোবাসা নেবে? কেউ বলে ঘেউঘেউ করে
ছলনার দোকান বন্ধ হয়? হয় না কখনও
কে নয় বাচিক শিল্পী, কার গায়ে কাঁটা নেই?
বাগান কি টবের দুঃখ বোঝে?
                               গান কি গায়কের পাকস্থলী জানে?
মুদ্রার ভাষাজ্ঞান পকেটের আছে? ফ্রিজ ঠান্ডা রাখে সব
সকলেই জানে আমাদের পংক্তিভোজে ভূত খেতে বসে
আমি কি ভূত হইনি, হওনি কি তুমি?
প্রকৃত ভূতেরা তবে গোপনাঙ্গ পরীক্ষা করে না,
গণহত্যা নেই : বসবাস সরিষায় নয়
         

জ্ঞানদাস একা
....................
শয্যাশায়ীদের খাট ভেঙে গেছে : ভেঙে গেছে গলা
তাই রাস্তাচলা
মাছের মতোন কোনো দ্বীপে
উঠবে কি উঠবে না —নিজেরই সিদ্ধান্ত কোনো ছিপে

কে তাহাকে প্রতারণা, কে বা তাকে খাদ্য জ্ঞান করে
মাননীয় চেয়ারের স্তরে
জ্ঞান হলে বুক খাওয়া ছাড়া
অন্যের বুকে তাকে দুই কামরা ভাড়া—
নিতে হয় নানা প্রয়োজনে
যেহেতু সে বেঁচে আছে অবহেলা করুণ মৈথুনে

শয্যাখানি পাতা আছে দূর
সেবাদাসী পাওয়া যায়, আসে না বন্ধুর
কোনো চিঠি
ইতি


জিয়া হক

ইসলামপুর

  
বন্দুকটা নামাও, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই : শাহবাজ বলল।


বন্দুক নামাতে পারব না, বন্দুক ছাড়া আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই : সিদ্দিকী প্রত্যাখ্যান করল।

এই কথা বলেই সে গুলি চালিয়ে দিল। গুলিটা গিয়ে লাগলো শাহবাজের বুকের বাম দিকে। তার বুক পকেটে একটা একশ টাকার নোট ছিল। নোটটা রক্তে ভিজে গেল। ওখানেই মারা গেল শাহবাজ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল সিদ্দিকীর। জেলে সে খুব নম্র আচরণ করত সহবন্দিদের সঙ্গে। সবাই জানত, সিদ্দিকী খুনের আসামী। এখানে অধিকাংশই খুনের আসামী।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে গেল সিদ্দিকী। সে জেলে বসেই ভেবে নিয়েছিল প্রথমে কোথায় তাকে যেতে হবে। জেলে সময়ের অভাব নেই।
জেল থেকে বেরিয়ে সে শাহবাজের বাড়ি এলো। শাহবাজের দুটো ছোট মেয়ে আর বৌ। বিয়ের প্রস্তাব দিল শাহবাজের বৌকে। মেয়েটা রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করে অন্য একটা শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করল। ছোট দুই মেয়ে তাদের সঙ্গেই আছে।
একটা কাঠ চেরাইয়ের কারখানায় যোগ দিল সিদ্দিকী। উপার্জন বেশি নয়, তবে তা দিয়ে তাদের চলে যেত। ছোট মেয়েদুটোকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তারা বিনুনি করে স্কুলে যায়। নতুন বাবাকে তারা মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। তবে এই লোকটাই যে তাদের বাবার খুনী তা তারা জানত না। তাদের মা কখনও বলেনি।
শাহবাজের একটি ছোট ভাই ছিল। মেধাবী ছাত্র, কিন্তু দাদা খুন হয়ে যাবার পর তার পড়াশুনা আর হল না। সে সব সময় খুঁজে বেড়ায় তার দাদার খুনীকে। একটা মস্তানবাহিনীর সে এখন সক্রিয় সদস্য।
সিদ্দিকীকে একদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। রাতে বাড়ি এলো না। তার বদলে বাড়ি এলো শাহবাজের ছোট ভাই। ভাবীকে বলল, জিনিসপত্র গোছাও, আমরা দেশে ফিরে যাব।
শাহবাজ-সিদ্দিকীর বৌ দেবরের কথা মতো সব বাঁধাছাদা করে রাতের অন্ধকারে দুই মেয়ের হাত ধরে দেবরের সঙ্গে পথে নামলো। মেয়েদুটো শুধু জিগেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তাদের মা বলল, জানি না।
শাহবাজের ছোট ভাইয়ের নাম শাহনওয়াজ। শাহনওয়াজ ভাবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। দেবরের প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করল। শাহনওয়াজের মা বৌকে তেমন সহ্য করতে পারে না। ঝগড়া লেগেই থাকে। ছোট মেয়েদুটোকে আবার স্কুলে ভর্তি করা হল। তারা বিনুনি নিজেরা বাঁধতে শিখে গেছে।
শাহবাজ - সিদ্দিকী - শাহনওয়াজের বৌ জরির কাজ করতে শুরু করে একটা কারখানায়। একজনের সঙ্গে আলাপ হল তার কারখানায়। শাহনওয়াজের আয় নেই বললেই চলে। সে কিছু করে না। বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। সে একটা সন্তান নিতে চেয়েছিল, তার বৌ রাজি হয়নি। রোজ ঝগড়া হয় তাদের। মেয়েদুটো দুলে দুলে ছড়া মুখস্থ করে। এতে শাহনওয়াজ আরো রেগে যায়।
জরির কাজ করে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করে ফেলে বৌটা। আরও কয়েক বছর কাজ করে এক নাগাড়ে। তারপর এক রাতে শাহনওয়াজকে খুন করে দুই মেয়েকে নিয়ে সেই বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেল দূরের এক শহরে। এখানে কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। তবে ইতিমধ্যে, শাহনওয়াজকে একটা বাচ্চা উপহার দিতে হয়েছে তাকে। তার এখন দুই মেয়ে এক ছেলে।
ছেলের নাম রেখেছে শাহরিয়ার।
অনেক অনেক বছর পরের কথা। শাহরিয়ার আঠারো বছরের যুবক। ভীষণ রাগি আর জেদি। খুনী রক্ত বইছে তার শিরায়। কীভাবে সে জানতে পেরে যায় যে, তার বাবাকে খুন করেছে তার মা। আর তার যে দুই দিদি তারা তার বড় কাকার মেয়ে। সে নিজের মাকে খুন করে। দুই দিদিকে এক দালালের হাতে তুলে দেয়। কোনো টাকা নেয় না।
পুলিশ অফিসার (থানার মেজবাবু) শোনাচ্ছিলেন এই সব কাহিনি। এই অব্দি বলার পর সিগারেট ধরালেন। দৃষ্টি উদাস।
আমি বলি, একটা পরিবারই তো পুরো শেষ হয়ে গেল! কী লাভ হল!
তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনার দাদা যদি খুন হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?
আমি চুপ করে রইলুম। একটা গান্ধীবাদী উত্তর দেব কিনা ভাবছি, তখন আমার মনে হল আমি কিন্তু সত্য গোপন করছি, যা করতে চাই তা না বলা মানে শুধু ফেক করা না, আমি কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেই পারলাম না, যা করার অর্থাৎ প্রতিশোধ নেবই, শুধু আপাতত ভালো মানুষ সেজে মিথ্যে কথা বলব, এই তো!
মেজবাবুকে বললাম, পরে একদিন এর উত্তর দেব আপনাকে, আজ যাই।
তার মানে আপনিও সহজ সরল কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, তাই তো? তিনি ঘড়ঘড় করে হাসলেন।
আমি উত্তর না দিয়ে শুধু জিগেস করলাম, সেই বন্ধুটার কী হল?
মেজবাবু বললেন, চা খান একটু, বলছি।
তিনি আমাকে বসিয়ে রাখলেন। এটা তার মজা। পুলিশদের কাছে কত রকম গল্প থাকে। যে গল্পগুলো শুনলে আমাদের রক্ত শুকিয়ে যায়, সেই গল্পগুলোও তাদের কাছে মজাই। এ তাদের ডেইলি জব। এখান থেকে তাদের উপরি আয়। সেদিক থেকেও তা মজার।
একজন ঢ্যাঙা কালো মতো লোক ঘরে ঢুকলেন চা নিয়ে। পরনে লুঙ্গি, চেক শার্ট, চুল পাকানো। বাম হাতটাতে একটু অসুবিধা আছে বলে মনে হল।
মেজবাবু বললেন, শাহজাদা, বসো ।
সে লোকটা মেঝেতেই বসে পড়ল। দেখে বোঝা যায় এভাবেই বসতে সে অভ্যস্ত। লুঙ্গিটা জড়িয়েমড়িয়ে দুই পায়ের মাঝখানে গুঁজে নিল ডান হাত দিয়েই। তার বাম হাত বিশেষ কাজ করে না।
আমি ইশারায় মেজবাবুকে বলতে চাইলাম, ইনি কে?
তিনিও ইশারায় বলতে চাইলেন, বসোই না।
বলো শাহজাদা, তোমার গল্প বলো : মেজবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন।
একজন কনস্টেবল দরজার বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করছে দেখে মেজাজ চড়িয়ে মেজবাবু বললেন, এখন লকাপে পুরে রাখো, রাতে কথা বলব।
মিনমিন করে কনস্টেবল বললেন, স্যার, মেয়ে কেস।
মেয়ে কেস! ভাবনায় পড়লেন মেজবাবু : রেপ-টেপ নাকি?
না স্যার, বৌকে পিটিয়েছে : কনস্টেবল বললেন।
ধুর শালা, আটকে রাখ —আটকে রাখ, পারলে দুটো রুল বাড়ির গুঁতো দিয়ে রাখ। শালা, প্রেম করবে, বিয়ে করবে, ছানাপোনা নেবে মৌজ করে, তখন কে আটকায়, তারপর বৌ পেটাবে, মেরে আগে মুতিয়ে দে, তারপর দেখছি। মেজবাবু থামলেন।
তাঁর উগ্র মুখ মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত : তো, শাহজাদা, বল তোর গল্প বল।
মেজবাবুর মেজাজ তিরিক্ষি দেখে জড়সড় হয়ে বসল শাহজাদা। তার চোখ বড় বড়। খুব রোগা শরীরে এত বড় চোখ মানায় না। সে বলতে শুরু করল :
সে পরের বৌ, আমি জানতাম। একই পাড়ায় থাকি। সবাই সব জানে, এ তো আর শহর নয়। আমার সঙ্গে জরির কারখানায় কাজ করতে আসত। ওর নাম ছিল মরিয়ম। মরিয়মের দুই মেয়ে, এক ছেলে। কাজ করত ঠিকই, কিন্তু সব সময় মন মরা থাকত। আমি একদিন যেচে আলাপ করি। ও একটাই ছাপা শাড়ি পরে রোজ আসত। পরা বলে না তাকে, জড়ানো বলে।
আমি একদিন একটা শাড়ি কিনে তাকে উপহার দিতে গেলে সে নিতে চায় না। বলে, বাড়িতে স্বামী - শাশুড়ি আছে। আমি বুঝতে পারি, শাড়িটা সে নিতে চায় কিন্তু ভয় পাচ্ছে। সে আমাকে জিগেস করে, কেন তাকে শাড়িটা দিতে চাই।
ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এটা না কোনো দয়া আর না কোনো ভালোবাসা —এটা উপহার, —শুধু উপহার।
ইতিমধ্যে কনস্টেবলটা আবার দরজার ফাঁকে মুখ বাড়ায় : স্যার, গৌতমবাবু এসেছেন।
সে কি গৌতমবাবু! কখন এলেন! চা দিয়েছিস? আসছি আসছি : বলে প্রায় দৌড় লাগালেন মেজবাবু। বললেন, একটু বসুন, আসছি।
ঘরের মধ্যে বসে আছি আমি আর শাহজাদা। সে-ই বলল, নিশ্চয়ই বখরা দিতে এসেছে।
আমি জিগেস করলাম, কে এই গৌতমবাবু? বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে।
কেউকেটা! হ্যাঁ, কেউকেটাই! শালা তোলাবাজ, সে আবার বাবু, ওফ্! খাতির দেখলে পোঁয়া চুলকোয়। কে যে পুলিশ বাল বোঝাও যায় না মাঝে মাঝে।
আমি চুপ করে যাই। কে এই শাহজাদা, কী তার গল্প, আমাকেই বা শোনানো হচ্ছে কেন তা না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। চুপ করে গালে হাত দিয়ে সিলিং ফ্যানের গড়িমসি করে ঘোরা দেখি। শাহজাদা বগল চুলকোচ্ছে।
প্রায় দশ মিনিট পরে ফিরে এসে নিজের টেবিলের সামনে এসে বসলেন মেজবাবু। তার মুখ খুশি খুশি। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। বেশ লম্বা সিগারেট। দামী।
খোশমেজাজে বললেন, তো শাহজাদা, আবার শুরু করো তোমার গপ্পো।
মেজাজ ভালো থাকলে তুই হয়ে যায় তুমি। এই যেমন এখন হল আর কি। মেজবাবুই একদিন বলছিলেন, মেজাজ ভালো থাকলে লকাপে ডিমভাজিও দেওয়া হয়। প্রশাসন মেজাজে চলে।
গপ্পো শুরু করার আগে বলে নিই, আপনার উত্তরটা কিন্তু এখনও পাইনি : আমার দিকে লক্ষ করে বললেন : তাড়াহুড়ো নেই, তবে ভেবে চিন্তে দিলে কিন্তু হবে না, আমি তাৎক্ষণিক ইন্সটিঙ্ক্টটা জানতে চাই, যাইহোক, বলো শাহজাদা।
আরও কয়েক মাস পরে বৌটা বলল, আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে? আমার দুটো মেয়ে আর একটা ছেলেও আছে, পারবে? শাহজাদা বলতে শুরু করল : আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলাম এই প্রস্তাবে। কোথায় নিয়ে যাব তাকে, তার পরিবার আছে, তারা ভীষণ খুনে প্রকৃতির, আমাকে মেরেই ফেলবে। এ কীভাবে সম্ভব!
তারপরও বললাম, যাবো, কোথায় যেতে চাও বলো?
তাকে দেখলে যে কারও মায়া হবে স্যার। এরকম জীবন সে পেল কেন, আমি তাই নিয়ে ভাবতাম। আল্লাহ কি চান আমি তার জন্যে একটু সুখের বন্দোবস্ত করি? কিন্তু আমার সামর্থ্য কতটুকু!  ক্ষমতাই বা কী!  জানতাম, তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানে আমার মৃত্যু। ওর বর ঠিক খুঁজে বের করে আমাকে খুন করবে কারণ এর আগেও সে খুন করেছে। কিন্তু লাশ খুঁজে মেলেনি বলে তার শাস্তি হয়নি।
বৌটাকে আবারও জিগেস করলাম, কোথায় যেতে চাও বলো? কোনো অচেনা শহরে?
সে বলল, ইসলামপুর।
ইসলামপুর! ইসলামপুর কেন? আগে কি ওখানে গিয়েছিলে? আমি জানতে চাই।
সে শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে বলে, না।
তাহলে অন্য কোনো শহরে চলো যাই : তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শেষে বলি, আচ্ছা ঠিক আছে, ইসলামপুরেই চলো।
ইসলামপুরে এসে দেখি ছোট মেয়েদুটো তাদের খেলার সঙ্গী পেয়ে গেছে। কত দিন পর যেন তাদের সঙ্গে দেখা। মরিয়মকেও অনেকে চিনতে পারছে। আমি একটু অবাকই হলাম। ও কি আগে এখানে এসেছে! এত জানপেহচান হল কেমন করে! আমি কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। তবে সন্দেহটা গেল না।
একদিন মেয়েদুটোকে জিগেস করে সব জানতে পারি। এই শহরে তারা আগে কয়েক মাস ছিল। ঘটনাচক্রে, যে পাড়ায় আমরা উঠেছি সেই পাড়ায়। তারপর যা শুনলাম তাতে আমার ভয় গলায় উঠে এলো।
মেজবাবু শাহজাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাকি গপ্পো পরে, আগে চা নিয়ে আয়, আর পারা যাচ্ছে না। এক গল্প এতবার বলবার পরও এত এনার্জি কোত্থেকে পাস বল তো? যা ভালো করে দু কাপ চা নিয়ে আয়।
শাহজাদা মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল চা আনতে। মেজবাবু আমার দিকে তাকালেন। জানি, তিনি সেই প্রশ্নটি করবেন —করলেনও। আমি হলে কী করতাম —প্রতিশোধ, না ক্ষমা?
আমি এবার বললাম, এখনই যদি জানতে চান আর এখনই যদি আমাকে উত্তর দিতে হয় তাহলে বলব ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না, আমি প্রতিশোধ নিতাম।
মেজবাবু শুধু মুচকি হাসলেন। তিনি কি এই উত্তরটাই চাইছিলেন? আমি যে কপটতা করিনি তাতে কি তিনি খুশি হয়েছেন? নাকি আমাকেই অপরাধী ভাবতে শুরু করেছেন —কে জানে!
চা নিয়ে ঢুকতেই শাহজাদাকে মেজবাবু বললেন, মেঝেতে নয়, তুই এই ভদ্রলোকের পাশের চেয়ারটাতে বস, তারপর বল বাকি ঘটনা।
শাহজাদা ইতস্তত করছে দেখে ধমক দিলেন মেজবাবু। সে উপায়ান্তর না দেখে আমার পাশের চেয়ারে আড়ষ্ঠ হয়ে বসে শুরু করল তার গল্প :
মেয়েদুটোর কাছে জানতে পারি আগে যে লোকটার সঙ্গে এই পাড়ায় তারা এসেছিল তার নাম সিদ্দিকী। সিদ্দিকী ভালোবাসতো তাদের। তাদের মাকেও সে ভালোবাসতো। তাদের স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিন সব গোলমাল হয়ে যায়। তাদের নতুন বাবা আর ফিরে আসে না। তার বদলে বাড়িতে হাজির হয় তাদের কাকা। তার নাম শাহনওয়াজ। এবং তাদেরকে জোর করে দেশের বাড়িতে নিয়ে চলে যায়।
রাতে কাজ থেকে ভয় ভয় করে বাড়িতে ফিরি। মরিয়ম তা যেন দেখে না।
মরিয়মকে একদিন বললাম : আমি সব জেনে গেছি।
সে নির্বিকার ভাবে বলল : কী জেনে গেছো? জানার আছেটা কী যা তুমি জানো না।
আমি সবটা জেনে গেছি। সবটা আমার খুব ভয় করছে : বলি।
মরিয়ম যেমন কষ্ট সহ্য করতে পারে, তেমনই কষ্ট দিতেও পারে। সে আমার কথায় পাত্তা দেয় না। আমাকে টেনে বিছানার মধ্যে নিয়ে যায়। সব কথা এখানে শেষ।
অনেক বছর আমরা ওই শহরে কাটালাম। আমাদের ছেলে শাহরিয়ার বড় হয়ে উঠল। সব বেশ থিতিয়ে এসেছে। শাহরিয়ার খুব মেধাবী, বাধ্য। স্কলারশিপ পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করল। আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলাম।
হঠাৎ একদিন রাতে শাহরিয়ার বাড়ি ফিরে মাকে মারতে আরম্ভ করল। আমি বাধা দেওয়ায় আমার বাম হাতে পড়ল শক্ত লাঠি। সেই থেকে আমার বাম হাত নষ্ট হয়ে গেল। মরিয়মকে পিটিয়ে মেরেই ফেলল ছেলেটা। আমি পালিয়ে গেলাম সেই রাতেই। পরে শুনলাম, বোন দুটোকে দালালের হাতে তুলে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ থেমে শাহজাদা বলল, মরিয়মকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি বলে উঠলাম : ও, আপনিই তাহলে জরির কারখানার সেই লোক?
এবার মেজবাবু বললেন, বাকিটা আমি বলি। শাহজাদা এর পর মস্তান দলে যোগ দেয়। ওর কাছে সব সময় তখন পিস্তল থাকত। আমিই ওকে সেই নোংরা ডেরা থেকে তুলে এনে থানার মধ্যে একটা চা দোকান করে দিই। তারপর থেকে ও এখানেই আছে। কিন্তু ওর দোকান খুঁজলে এখনও একটা আধটা পিস্তল আপনি পাবেন। কী শাহজাদা, ঠিক বলছি কিনা?
শাহজাদা চোখ নীচু করে টেবিলের উপর ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের ছায়া দেখে।
এইবার আসল কথা বলি, বলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন মেজবাবু : আপনি কি জানেন শাহরিয়ার এখন কোথায়? আপনার জানার কথাও নয়। শাহরিয়ার এখন এই শহরেই থাকে। এবার আমি শাহজাদাকে একটা প্রশ্ন করব। আচ্ছা, শাহজাদা, তুমি কি শাহরিয়ারকে ক্ষমা করে দিয়েছো, না প্রতিশোধ নিতে চাও?
শাহজাদা বেশ দৃঢ় ভাবে বলল : আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
মেজবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যেন অনেক জটিল কোনো বিষয়ের মীমাংসা করে দিয়েছেন এবং আমাদের মনস্তত্ত্বের অমীমাংসিত কোনো বিষয়কে উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন সাবলীল ভাবে।

আমি বললাম : শাহজাদা, তুমি যদি বন্দুকটা ফেলে দাও, তাহলে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি।

সে বেশ কেঠো গলায় বলল : বন্দুক ছাড়া আমার আর বিশ্বস্ত বন্ধু নেই, কেউ হবেও না, আমাকে ক্ষমা করবেন।

শাহজাদা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল : স্যার, যাই তাহলে?

বেশ তৃপ্তি নিয়ে মেজবাবু বললেন : এসো।
দরজা অব্দি গিয়ে ফের ফিরে এলো শাহজাদা নামের লোকটা। তারপর ইতস্তত করে বলল : একটা প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাচ্ছি না স্যার, জিজ্ঞেস করব?
মেজবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন : কী প্রশ্ন?
—মরিয়ম সব জেনেশুনে কেন আমাকে ইসলামপুরেই নিয়ে গিয়ে উঠল?
এই প্রশ্ন শুনে দারোগা সাহেব একেবারে থমথমে হয়ে গেলেন। মনোবিদ্যার সব অধ্যায়গুলো আবার যেন তিনি শুরু থেকে পড়তে শুরু করেছেন।


জিয়া হক

ইবলিশ


...........
আমি কামিয়াবি বলতে মনে করি জান্নাত। রোজ যে আমি গুনাহ থেকে পানাহ চাই, সে কি এই জন্য নয় যে আমার কাছে কামিয়াব সে যে জান্নাতি। আমি সংসার করব না বলছি না একবারও, কিন্তু সংসারের দাসত্ব আমি করতে পারব না।

মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনার যেখানে পায়রাদের বাসা সেই বাসায় জমানো দানা মুখে নিয়ে এক ঝাঁক পায়রা উড়ল পশ্চিম আকাশে। এবার মগরিবের আজান হবে। মসজিদে আসার এই ডাক আগে মাইকে হত না। তখন তো মাইক ছিল না। যখন গাড়ি তৈরি হয়নি মানুষ পশুর পিঠে চেপেছে, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে মাইলের পর মাইল। মুয়াজ্জেন গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই।

ওজুখানা বলতে একটা মোটা পুরু দেয়াল। তার একদিকে মেয়েরা ওজু করে, অন্যদিকে ছেলেরা ওজু করে। দেয়ালটা এত উঁচু যে কেউ কারো মুখ দেখতে পাবে না। তবে জল পড়ার শব্দ, কাচের চুড়ির শব্দ শোনা যায়। মেয়েরাও নিশ্চয়ই ছেলেদের ওজুর শব্দ শোনে। ওজুর জল যেভাবে পাথরের উপর পড়ে তাতে একটা সঙ্গীত আছে। এই সঙ্গীত ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মগরিবের আজান শেষ হয়। আজান শেষ হলে তার জবাবে একটা দোয়া পাঠ করতে হয়। ঢাকা শহরের যে আজান রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় সেখানে আজানের পরে পরে মুয়াজ্জেন দোয়াটাও মাইকেই পড়ে দেন। মিশরের ক্বারী বাসিতের আজান যেন একটানা কান্না, যেন সামনে বড় বিপদ, যেন আজই এই মুহূর্তটুকুই আমাদের কাছে অবশিষ্ট আছে তারপর পৃথিবী ফানাহ। নামাজ একটা অনুষ্ঠান আর তার আহ্বায়ক হল যে আজান দেয়।

এই শহরের মহিলারা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে। তাদের জন্য আলাদা ঘর, ঠিক পাশের ঘরটা পুরুষদের। মেয়েদের ওদিক থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মসজিদটা আর সব মসজিদের মতোই খুব নিস্তব্ধ। শুধু নামাজের ওয়াক্তে একটা সংযত পরিশীলিত মেলার সুর ওঠে। ইমামের ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বাজে। জানালাগুলো নীল। গাঢ় নীল।

সবুজ আলখাল্লা পরা মেয়েটা ফটকের ওধারে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে মুখ পরিষ্কার দেখা যায় না। সবাই নামাজ পড়ে চলে গেছে। জোহরের নামাজের পর খাবার তাকাযা থাকে। মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা আগে নামাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায়। কাজ থাকে। তারা নামাজে ফাঁকি দেয় তা কিন্তু নয়, তারা আসলে মসজিদকে কলতলা মনে করে না। ছেলেরা মসজিদে নামাজের আগে পরে যেটুকু সময় থাকে আড্ডা দিয়ে নেয়।

আমি তসবিহ গুনছিলাম। আঙুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের দানা। এই তসবিহটা খোদ সৌদি আরবের। একজন উপহার দিয়েছিলেন। আর দিয়েছিলেন এক শিশি আরবি আতর। সেটা কথা নয়, আমার মনে হচ্ছিল গোটা মসজিদগৃহে আমি আর মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই।

পর পর কয়েকদিন দেখলাম জোহরের নামাজের পরে মেয়েটা ফটকের লোহার শলাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না তা আমি জেনে গেছি। এই কয়দিনে আমি কাউকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার সঙ্গে যেতে দেখিনি। সে পুরুষদের মসজিদ কক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মাথা নীচু করে চলে যায়। আমি সেদিকে মাঝে মাঝে তাকাই আর তসবিহ গুণে যাই। যখন সুবহানআল্লাহ বলি তখন আল্লাহর উদ্দেশে বলি নাকি মেয়েটার সূদুর অস্তিত্বের সৌন্দর্যের জন্য বলি তা মনে থাকে না। মেয়েটা রোজ সবুজ আলখাল্লা পরে আসে।

আমি বললাম, আসসালাম আলাইকুম। একজন পুরুষ একজন অপরিচিত মহিলাকে সালাম দিতে পারে, হাত ধরতে পারে না।
সে চুপ করে রইলো। এতে সংকোচ কিসের! সালাম মানে কিন্তু আলাপ করার প্রস্তাবও নয় সব সময়। পিপীলিকার মতো এক ধরনের মৌখিক কানেক্টিভিটি শুধু। এতে আলাদা করে কোনো আবেগ বা ব্যক্তিগত অনুভূতি মেশানো নেই।
আরেকবার সালাম দেওয়ার পর মেয়েটা সলজ্জ ভাবে বলল, ওয়া আলাইকুম সালাম।
এতে লজ্জা পাবার কী আছে!
মেয়েটার বয়স বেশি নয় —একুশ বাইশ হবে। সুন্দর চেহারা। মুখে নাকাব নেই বলে পুরো মুখটাই দেখা যায়। চোখ রাঙানো। কালো কাজল সেই চোখে। ওজুর জলেও যা ধুয়ে যায় না।
তোমাকে এখানে রোজ জোহরের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আমি বলি।
হ্যাঁ, আমি রোজ জোহরের পর এখানে এই একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, সে বলে।

দূর থেকে মসজিদকে দেখতে খুব ভালো লাগে, তাই না?

সত্যি, মসজিদের ভেতর আর বাইরেটা কত আলাদা।

তার প্রাথমিক জড়তাটুকু কেটে গেছে। সালাম অনেক সময় অনেক কাজ সহজ করে দেয়।

আমি আবার বলি, তুমি কি শুধু, মানে শুধুই মসজিদকে দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকো?

সে বলল, অপেক্ষা করি।

কার অপেক্ষা?

ফেরেশতা আসে এই সময়ে। অধিকাংশ লোকেরই ধৈর্য্য নেই।

ঠিক, আমাদের ধৈর্য খুব কম।

আমি দেখেছি, যেখানেই যাই, খালি চলে যেতে পারলে, ফিরে আসতে পারলে যেন বাঁচি।

আমরা আমাদের বাড়িকে বেশি ভালোবাসি কিনা।

তাহলে মৃত্যুর পর কী হবে?

মেয়েটার লাবণ্য আছে তবে সেই লাবণ্য বড় বিষন্ন। আর এই মৃত্যুর কথা বলায় তার মুখের সাদা চামড়ার ওপরে যেন একটা মৃত পর্দার নাকাব চাপিয়ে দিল। যতটুকু পরিচয় হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি না, আজই, এখনই প্রথম দেখছি।

মেয়েটা চলে গেল মাথা নীচু করে। তার সবুজ আলখাল্লা বাতাসে পায়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে পাল তোলা নৌকার মতো তাকে গতিবেগ দিল যেন।

ছয় দিন পর ইমাম সাহেব বললেন, আপনি নাকি মসজিদের ভেতরে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন?

এই ছয় দিন রোজ দুপুরে জোহরের নামাজের পর মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেছি। মেয়েটা ফটকের ওধারে, আমি এ ধারে। একদিন তার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তার আঙুলগুলো করমর্দনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে যেন। সংযত করেছি নিজেকে। কেরামান - কাতিবিন আমার দুই কাঁধে বসে নেকি-বদীর তালিকা তৈরি করছে তো।

যদি মসজিদে এসে নিজের নফস, খাহেশাতকে সংযত করতে না পারেন তো কী হবে বলুন তো? ইমাম।

একটা সত্যি কথা বলব ইমাম সাহেব? নফস চাইছে ওর সঙ্গে শুয়ে পড়তে, কিন্তু,— কিন্তু দেখুন আমাকে কি ওর সঙ্গে শুতে দেখেছেন? সংযম আছে বলেই তো শুধু কথাটুকু বলি।

সেটাও না করাই উত্তম, বলে ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি জোহরের নামাজ শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলুম। এই ইমামকে আমার তেমন সহ্য হয় না। যদিও ইমামদের ভুল-ত্রুটি ধরা আমার মতো সাধারণ মানুষদের কাজ নয়। আলেম, উলেমারা আকাশের নক্ষত্র না হোক, উপগ্রহ তো বটে। এখন অমাবস্যা চলছে।

সুন্দর রোদ ঢেকে দিয়েছে মসজিদের মিনারগুলো। একটা দুটো পায়রা উড়ছে মিনারের ধারে ধারে। পুরনো গান ভেসে আসছে পাশের কোনো মহল্লা থেকে। সেই গান ছুঁয়ে যাচ্ছে মসজিদের সামনের ছোট একটুখানি জায়গায় চাষ করা ফুলের বাগানকে। পাতা, ফুল, কান্ড সব হালকা হাওয়া আর গানের ধাক্কায় দুলছে মৃদুমন্দ ভাবে।

মেয়েটাকে জিগেস করলাম : পেলে তোমার হারিয়ে যাওয়া ফেরেশতাকে?

সে ইতস্তত করে জবাব দিল : হারানো ফেরেশতা? কিন্তু আমার ফেরেশতা তো হারিয়ে যায়নি, আমি তাকে খুঁজছি মানে সে হারিয়ে গেছে তা নয়, হয়ত আমিই হারিয়ে গেছি আর সে প্রতিটা মসজিদের ফটকের সামনে জোহরের নামাজের পর আমার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে।

হ্যাঁ, কে যে হারিয়ে গেছে তা বলা মুশকিল, তবে কেউ একজন সন্ধান করছে মানে কেউ একজন হারিয়ে গেছে, হয়ত লুকিয়ে আছে : আমি বলি।

লুকিয়ে আছে? হবে হয়ত : ঈষৎ সন্দিগ্ধ ভাবে সে মাথা নেড়ে বলল। কাঁধ ঝাঁকালো।

আমি জিগেস করি : তুমি ফেরেশতাকে পেতে চাও, তাই তো, এতে কোনো ভুল নেই, আচ্ছা, ফেরেশতাকে পেলে তুমি কী করবে?

আমি শুধু তাকে পেতে চাই, পেলে কী করব এখনও ভেবে দেখিনি, হয়ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, হয়ত বলতে পারি আমাকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে চলো : খুব উদাসীন মুখ করে মেয়েটা বলল।

বেশ কয়েকদিন কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা কেন বারবার মৃত্যুর কথা বলে, সে কেন এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায়। তার আসলে পৃথিবীতে কেউ নেই আব্বা ছাড়া। তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না। তার ওজুর জলও মেয়েটাকে তুলে এনে দিতে হয়। মেয়েটা তাই একদিন বলেছিল, সে তার আব্বার জন্যে নতুন এক জোড়া চোখ উপহার চাইবে ফেরেশতার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে। আমি বলি, যখন চাইবে তখন বড় কিছু — স্থায়ী কিছু চাইবে না কেন? জান্নাত চাওয়া কি আরো ভালো নয়? সে বলে, তুমি আমার আব্বার কষ্ট দেখলে নিজের জন্যে জান্নাত চেয়ে পালিয়ে যেতে পারতে না।
পালিয়ে যাওয়া! এটা কি সত্যিই কাউকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া!
মেয়েটা আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তাতে আমার বেশ ভাল লাগে। মেয়েরা তুমি বললেই আমার মনে হয় আমরা যেন একটা ভালোবাসার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটার নাম জানি না। জিগেস করিনি। সেও আমার নাম জানতে চায়নি। নাম জিগেস করা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশাধিকার চাওয়ার মতো ব্যাপার। সন্ধ্যা বেলা আমাদের কখনও দেখা হয়নি।

আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? আমি বলি।

প্রশ্ন? যখন কেউ প্রশ্ন করার আগে অনুমতি চায় তখন বুঝতে হবে প্রশ্নটা বিশেষ। তো কি সেই বিশেষ প্রশ্ন? নিজে নিজে ব্যাখ্যা করে মেয়েটা।

হ্যাঁ, বিশেষ মনে করলেই বিশেষ। এটা পুরোপুরি মনে করার ব্যাপার। আসলে আমি তোমার নাম জানতে চাই : আমি বলি।

নাম? আমার নাম — মনে করো সবুজ পোশাক পরা মেয়েটা, এটাই আমার নাম, বা ধরো ফটকের ওধারের কন্যা, হ্যাঁ, এটাও একটা ভালো নাম হতে পারে আমার : সে এইভাবে বলল।

আমি খুব লজ্জা পেলাম। আমার হয়ত নাম জানতে চাওয়া উচিত হয়নি। কেউ আড়াল চাইতেই পারে। আমি কি এই কয়দিনে তাকে বড় আপন ভাবতে শুরু করেছি বলে সে ভাবল? আমার লজ্জা লাগল, ধরা পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক। মসজিদের ফুলগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে আনন্দ প্রকাশ করছে। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। ছায়া পড়েছে, রোদ নেই। আজ মঙ্গলবার।

দু দিন জোহরের নামাজে মসজিদে যাইনি।
 শুক্রবার জুম্মার দিন। লোকের ভিড় অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। যারা কখনও নামাজে আসে না তারাও এই দিন আসে। পাপের ভয়? মাফের আশা? জানি না, তবে আসে। মসজিদ গমগম করে ওঠে। ধোয়া মোছা হয় মসজিদের ঘরগুলো। কাচা হয় কার্পেট, গালিচা, চাদর। পবিত্রতার গায়ে জল পড়লে আরও ঐশ্বরিক বলে মনে হয়। আমার নামাজে মন তেমন নেই। তসবিহ হাতে নেই, পাঞ্জাবির পকেটে রুমালের পাশে পড়ে আছে। আরবি আতর গায়ে। নামাজের অনুষ্ঠান কখন শেষ হয় তার অপেক্ষা করছিলুম।

গত দিন ইমাম সাহেব দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। ছ ফুট প্রায় লম্বা, সাদা জোব্বা পরা, পায়ে চামড়ার জুতো, হাতে তসবিহ, সব সময় জিকির করেন।
তিনি বললেন : মসজিদ একটা পবিত্র জায়গা।

মসজিদ নিঃসন্দেহে একটা পবিত্র জায়গা —স্থান বলা ভালো। হাদীসেই তো আছে, মসজিদ হল জান্নাতের টুকরো : বিনীত ভাবে আমি বলি।

সেই জান্নাতের টুকরোতে এমন কাজ আমাদের করা উচিত নয় যেটা অপবিত্র, নাজায়েজ।

হ্যাঁ, নাজায়েজ কাজ মসজিদ বাইরে অন্য জায়গায় করাই ভালো।

না, আমি তা বলিনি। নাজায়েজ কাজ কোথাও করাই ভালো নয়। আপনি আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আমি একটা মসজিদের ইমাম।

আপনি একটা মসজিদ শুধু নয়, বিশাল বড় মসজিদের শাহী ইমাম —আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সরকার আপনাকে মাসোহারা দেয় —এ যা-তা কথা নয়। আপনাকে আবারও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

তাঁর মুখমণ্ডল ভারি কঠিন হয়ে গেল।

আপনি হাদীস জানেন, একটু আগেই হাদীস বলছিলেন, না? তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়াকে সমর্থন করতেন না। ভেবে দেখেছেন যদি খারাপ কিছু একটা ঘটে যায়, পুরো সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তিনি মৃদু স্বরে বলে গেলেন।

হ্যাঁ, ওসমান গণি ইশার নামাজের পর রাতের অন্ধকারে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ভয় দেখিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর স্ত্রী আর মসজিদে যেতেন না, ভয় পেতেন : আমি বলি : মসজিদের সামনে ফুল চাষ করেন কেন?

তিনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যাওয়ার লোক নন। শুধু বললেন, ফুলগাছ আপনার জন্যে নাজায়েজ নয় আর আমি ধর্মের ভাষায় কথা বলি, সেটা আমার কাছে একটা সামাজিক সংবিধান। সে যদি মসজিদে যেতে কাউকে নিষেধ করার বিধান দিত তাহলে আমি বলতাম —আর মসজিদে যাবেন না।

হ্যাঁ, সংবিধান মানা খুব জরুরি। দেশের সংবিধানে যেমন ফাঁসি রয়েছে তেমন ধর্মের সংবিধানে আছে জাহান্নাম। খুব সিমিলার : বলি : আচ্ছা, পৃথিবীতে যার পৃথিবীর নিয়মে অপরাধের জন্যে ফাঁসি হয়েছে তার কি ধর্মের নিয়মেও জাহান্নমই হবে?

তিনি বিরক্ত হয়ে চলে যান।

জুম্মার নামাজের পর সবাই চলে গেছে। মসজিদ ফাঁকা। বাতাসের শব্দ শোনা যায়। কয়েকটা টকটকে লাল গোলাপ হাওয়ায় তির তির করে নৌকোর মতো কাঁপছে। দেখলাম, ফটকের ধারে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ মেরুন লাল একটা আলখাল্লা পরেছে। হাত দুটো পেছনে জড়ো করা।

মসজিদের ফুলবাগান থেকে কয়েকটা লাল গোলাপ তুলে হাতে করে পেছনে লুকিয়ে ফেললাম, তারপর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখে আজ বিষন্নতা নেই, বেশ হাসিহাসি। তাকে মেরুন লাল পোশাকে একটা হুরের মতো লাগছে। হুর জান্নাতে না গেলে দেখা যায় না।

সে জিগেস করল : দু দিন কোথায় ছিলে?

তুমি কি ফেরেশতার দেখা পেয়েছো? আমি জানতে চাই।

আমি কিন্তু এই এইখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম।

হাতে কী?

আমার হাতে! তোমার হাতে কী?

সে বলল : আল্লাহর উপহার, আব্বার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। তার চোখের অবস্থা খুব খারাপ কিনা। তুমি?

আল্লাহর উপহার, মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না : আমি বলি।

আকাশে হঠাৎ মেঘ জড়ো হতে হতে পুরো আকাশটাই মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। মেয়েটার হাসিহাসি মুখটা কিন্তু এই প্রায়ান্ধকারেও ম্লান হল না। ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত একটা মোমবাতির মতো সে যেন জ্বলছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। হালকা বৃষ্টি নয়, মুষলধারায় বৃষ্টি। চারদিক জলের পর্দায় ঝাপসা —যেন সমাজ, সভ্যতা, প্রকৃতি সব নাকাব পরে আছে।

মেয়েটা বলল, চলো মসজিদের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই।

মসজিদের কোন দিকে? ছেলেদের দিকটাতে নাকি মেয়েদের দিকটাতে? আমি জিগেস করি।

আমি ছেলেদের দিকে যাব না।

আমি মেয়েদের দিকে যাব না।

তাহলে চলো দুই দিকের মাঝখানে যে ওজুঘর আছে ওখানে গিয়ে দাঁড়াই : সে প্রস্তাব দিল।

হ্যাঁ, ওজুখানাই ভালো : আমি সম্মতি দিই।

জনহীন মসজিদ একটা কারখানার মতো। আমরা ওজুঘরে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, একটা প্রাণী আশেপাশে নেই, মসজিদের ফুলগাছগুলো বৃষ্টির আক্রমণে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দূরে ফটকটা এমনভাবে বন্ধ যেন আমরা একটা বিশাল দুর্গে আত্মগোপন করে আছি। শত্রুসৈন্যরা টের পেয়েও কাছে আসতে পারছে না। মেয়েটা মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে দিয়েছে। চুল ভিজে।

তুমি কি জানো যখন কোনো নারী পুরুষ নির্জনে থাকে তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হল শয়তান? আমি বলি।

শয়তান? এখানে? এ তো মসজিদ : সে আশ্বস্ত করে বলে।

কিন্তু ওজুখানার পাশেই তো ইস্তেঞ্জাঘর —শৌচাগার তো অপবিত্র। ওখানে তো শয়তান থাকতেই পারে আর আচমকা বেরিয়েও আসতে পারে আমাদের মাঝখানে।

তা তো ভেবে দেখিনি, তবে শুনেছি শয়তান ইবলিশ নাকি এক সময় ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। আদমকে সিজদা করেনি বলে আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয় : সে বলে।

তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?

তোমার কোন কথা বিশ্বাস করতে হবে? সে জানতে চাইলো।

আমি আমার মধ্যে শয়তানকে টের পাচ্ছি।

কীভাবে বুঝছো যে তোমার মধ্যে শয়তান এসে হাজির হয়েছে? মেয়েটা আবার জানতে চাইলো।

তোমার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি লজ্জিত মুখে বললাম।

সে বলল, আমারও তোমার হাত দুটো ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষের হাত ধরিনি। তবে হ্যাঁ, আব্বার হাত ধরেছি।

আমিও কোনো মেয়ের হাত ধরিনি আজ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, মায়ের হাত ধরেছি : আমি বলি।

যেভাবে বৃষ্টিটা আচমকা শুরু হয়েছিল সেভাবেই আচমকা থেমে গেল। রোদ বেরিয়ে পড়েছে। মেঘের পেটে যা জল ছিল সব যেন ঢালা হয়ে গেছে। মসজিদের ফুলগুলো রোদে নেচে উঠলো।

আমি আমার ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছি : মেয়েটা একটু দূরে সরে গিয়ে মাথায় ওড়না টেনে দিল।

কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে? কীভাবে পেলে? আমি জানতে চাই।

এই নাও দুটো লাল গোলাপ, এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম আব্বাকে দেব : পেছন দিক থেকে হাত ঘুরিয়ে সে গোলাপ দুটি আমার সামনে তুলে ধরল।

আমিও তোমাকে কয়েকটা গোলাপ দিতে চাই যেটা মাকে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে বললে না তো?

মেয়েটা ওজুঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বলল : আমি আমার মধ্যে এই পবিত্র জায়গায়ও শয়তানকে টের পেয়েছি।

শয়তানকে পেয়েছো তো, কিন্তু তুমি যে ফেরেশতার কথা বলছো?

সেও এক সময় ফেরেশতাই ছিল। যাইহোক, তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না।

এই বলে মেয়েটা মসজিদের ফটকের দিকে চলে গেল। তার দেওয়া গোলাপ দুটো হাতে ধরে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।

জিয়া হক









প্রতিশ্রুতি ও সহবাস


ভালোবাসা। সব সমাধান করে মুহূর্তে। কী সমাধানযোগ্য আর কোনটা অসমাধেয়? যেখানে 'বিকার' রয়েছে সামান্যও, তার মীমাংসা। নির্বিকার বলে হয় কি কিছু? আসলে ভালোবাসা কোথাও বিকৃতি দেখে না। তার সব সুন্দর। তার কাছে সুন্দর সবটুকু। ফুল তার কাছে ফুল তো বটেই, কাঁটাও তার কাছে ওই ফুলের সৌন্দর্যের বর্ধিত অংশ। যদি কাঁটা বিঁধে যায় হাতে? রক্তপতন হয় যদি? তাহলে? তাহলেও সেই রক্তে অসূয়া নেই, নেই সহিংসাত্মক মনোবেদনা। উপত্যকা-জোড়া ঘৃনা ও ঘৃন্যতার ভেতর যে রূহ সচল রাখে জনজীবন তা-ই ভালোবাসা। এখন প্রশ্ন হল, ভালোবাসা কী ও কেন, কীভাবে ও কেমন তা অনেকেই জানে, তারপরও কথা কেন এত? প্রেম কি কম পড়িয়াছ‌ে? পার্কে রেস্তোরাঁয় এত এত 'প্রেম', হৃদয়-চিহ্ন ভরা ইমোটিকনরাজি, অপ্রতিশ্রুত সহবাস —তারপরও? কোথাও কি বিপদঘন্টি বেজে চলেনি অজ্ঞাতসারে? মন জানে, মনই জানে। এমন কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে যাদের জ্বর আসে ঘন ঘন। অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসার দরকার হয়। অথচ তারা নাচতে বাধ্য হয় জমায়েতে। আসরে। যে নাচে তার প্রাপ্য ব্যথা আর যে নাচায় তার পাওনা মুদ্রা, হাততালি, কেয়াবাত জনাব। ভালোবাসা এখন, হ্যাঁ এখনই, সেই প্রাণীটি। পড়ে থাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি, রাবার ও লুব্রিক্যান্ট।

ভালোবাসাহীন মূল্যবোধের অস্তিত্ব আছে? যদি দেশকে ভালো না বাসা হয়, যদি দেশবাসীকে ভালোবাসা না হয়, যদি পৃথিবীর প্রতি না থাকে ভালোবাসা, মানুষের জন্য ভালোবাসা রাখা না থাকে যদি, তাহলে কেমন হয়? তাহলে প্রতিটি মানুষই হয়ে থাকে সুপ্ত ক্ষেপণ-উদগ্রীব সোরা যাকে একটি চিত্র, একটি বাক্যের কণা বিস্ফারে নিয়ে যেতে পারে। শান্তি যেমন একটি মানসিক চুক্তি, ভালোবাসা তা কিন্তু নয়। এ স্বতঃপ্রণোদনাময়। এ আসে ;ডেকে আনতে হয় না একে। ঘৃনা তাই ছড়ানো সহজ, কিন্তু ভালোবাসা? তাকে ছড়িয়ে দিলেই অঙ্কুরোদগম হয় না। এ জাগে ; একে জাগাতে হয় না। তবে চাইলেই সে জাগে না —আসে না। তার জন্য আধারকে প্রস্তুত করে রাখতে হয়। আমাদের রাষ্ট্র কি প্রস্তুত? ভালোবাসার এত এত ঐতিহ্য নাকি আমাদের ইতিহাসে। তাহলে কেন ধর্ম'পরিচয়ের নিরিখে কোতল হয়ে যায় কেউ? লিঙ্গ'পরিচয়ে বলাৎকার হয়ে যায় কেন একজন? বিত্ত'পরিচয়ে বিচ্ছিন্নতা বোধে রোজ আরও প্রান্তিক হয়ে ওঠে কেন কেউ? আমাদের ইতিহাসে ইসলামি শাসনই তো কেবল রক্তপাতের কথা বলে, এ অন্ধকার। আর কোথাও, কোনোখানে লাল চোখ, রক্ত নেই তো? বাকি সবটুকু কেবলই আলো আর আলো তো? তাদের আগে ও পরে? অতিথি আমাদের ঈশ্বর-সমগোত্রজ। এ-ই তো ভালোবাসা। এখন আঘাতের আগে প্রশ্ন করে নেওয়া হয় নিশ্চয়ই, কে অতিথি আর কে অনুপ্রবেশকারী। এই সুচিন্তিত ভালোবাসা, এই সু-নির্দিষ্ট ভালোবাসা, এই সু-বিশেষ ভালোবাসা বড় বিপদ-জনক।

অ-সভ্যেরা প্রেম বলতে বোঝে শরীর। সেখানে কুসুমের মন নাই। সভ্য মানুষ প্রেম বলতে কয়েকটি প্রশ্ন বোঝে —কাকে প্রেম, তার আধারসম্বলিত পরিচয় পত্র কোথায়, কতদূর প্রেম, কেনই বা প্রেম? এ প্রেম নির্বাচিত। এ প্রেম রেজিমেন্টেড। সে শুধু শরীর নয়, বোঝে পূর্ণত ও নিঃশর্ত অধিকার। এই প্রেম যেহেতু অভিনয়কলার নিকটবর্তী, তাই এই প্রেম বিজ্ঞাপনের।  এই প্রেমে নেই প্রেম, বিবাহ, দায়বোধ : যা আছে তা হল সহবাস ও প্রতিশ্রুতি। যদিও 'বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস' বিষয়টি সোনার পাথরবাটির মতো। একজন নিজেকে  'ভোগ্য পণ্য' ভাবছে শুরুতেই। বিনিময় মূল্য কী? না যৌনসম্মতি। তাছাড়া, তাকে কে বলে দিয়েছে যে একজনের সঙ্গে যৌনতা করলে অন্য কাউকে বিয়ের অধিকার সে হারিয়ে ফেলে? কুমারীত্বকে কি সে মূলধন ভাবে নাকি? এখানে আরেকটি তর্ক রয়েছে। যে-লোক, যে-সমাজ, যে-রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তার সঙ্গে সহাবস্থান করবে কীভাবে একজন? সে তো প্রত্যাখ্যানেরই যোগ্য।

আমাদের প্রেমিকসত্তাটিকে আত্মপ্রেমে মগ্ন করে রেখেছি আমরা। সে যত নিজেকে ভালোবাসতে যাচ্ছে ততই সে বিবিধের কাছে ঘৃণ্য হয়ে উঠছে অগোচরে। সে যতই নিজের মধ্যে ডুব দিতে যায় ততই তার বিপুল তুচ্ছতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মুশকিল হল, এই স্ব-প্রেমীটি নির্লোভী নয়। তার একটা ভাবমূর্তির প্রশ্ন আছে। সে রাতের গোপনে বৃক্ষ-হন্তারক আর দিনের প্রকাশ্যে বৃক্ষপ্রেমী সেজে থাকতে চায়। সে প্রকাশ্যে নিরামিষাশী আর গোপনে মাংস ছাড়া কিছু গ্রহণ করে না। এরাও ভালোবাসে কাউকে, ঘৃণাও করে এরা কাউকে। এই ঘেন্না ও ভালোবাসার রূপ কিন্তু সরল একরৈখিক নয়। এরাই সাম্প্রতিকে নেতৃত্বে। এরাই এখন পথপ্রদর্শক। এরাই নৈয়ায়িক। ফলত সমস্ত 'ন্যায়', সব 'পথ' এখন বিপদসঙ্কুল। অন্ধকার বিপথগামী।

জিয়া হক

বিমুদ্রাকরণ


.................
শান্তি এক ধরনের চুক্তি। তাবারুক খাঁ বলল।
তাবারুক খাঁর বয়স একত্রিশ। পান খেতে ভালোবাসে। তার জামায় পানের পিক লেগে থাকে সব সময়।
যদি তুমি মনে করো শান্তি আর সহ্য হচ্ছে না, সেদিনই তুমি চুক্তিটা ভেঙে ফেলতে পারো। অশান্তিতে থাকার অন্তত দেড়শো খানা পথ তোমার সামনে খোলা।
আমি খুবই চিন্তিত মুখে তার কথা শুনছি কেননা সবে সবে আমার শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
তাবারুক খাঁ এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর পান চিবোচ্ছে। পানে সে সুরভি জর্দা খায়। নামে জর্দা, সুরভি আসলে এক ধরনের সুবাস। তাবারুক আসলে নেশা করে না। নেশা কী জিনিস সেটা বোঝার চেষ্টা করে।

আমি সেদিন একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। পান করছিলাম বলা উচিত। সে যাকগে। চা-টা বড় সুন্দর। খেতে খেতে আমার মায়ের হাতের চায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
তাবারুক বলে চলেছে।

আমার মা চিরকাল ভাবত আমি কিছু একটা অঘটন ঘটাবোই। হয় কোনো মেয়েকে নিয়ে পালাবো, হয় কাউকে রেপ করব, নয় তো তিনটে বিয়ে করবই।
তাবারুক মুচকি হাসল।

সব মেয়েঘটিত ব্যাপার—দেখতে পেলে তো? আসলে হয়েছিল কি, আমার মা একবার আমাকে হস্তমৈথুন করতে দেখে ফেলেছিল। তারপর থেকেই মা এই সব ভাবত। কিন্তু দেখো, আমার বয়স এই তিরিশ বছর সাত মাস হল, আমি কাউকে নিয়ে এখনও পালাইনি, কাউকে এখনও বলাৎকার করিনি আর বিয়ে? দেখতেই তো পাচ্ছো ভাই —তিনটে তো দূর, একজনকেও জোটাতে পারিনি।
বলেই তাবারুক পানের পিক ফেলল মেটে লাল। খানিকটা তার জামায় এসে পড়ল।

তা যা বলছিলাম, মায়ের কথা মনে উঠতেই আমার চায়ের শান্তিটা আর সহ্য হল না। দিলাম গরম চা একজনের উরুতে ঢেলে।
কপাল মন্দ হলে পরিকল্পনা কাজ করে না।
 আমাকে মারধোরের বদলে সে লোক আরো সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, দাদা, আপনার হাত পুড়ে যায়নি তো?
কিছু ভালো লোকের থাকায় পৃথিবীটা একেবারে থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।
তাবারুক খাঁর মনের উপর খুব চাপ পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। তার মনটা খুব খারাপ।
পানটা থুঃ করে ফেলে দিয়ে বলল, কী আর বলি তোমাকে?
আমি সকৌতূহলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি দেখে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বলল, শান্তিতে বেশিদিন থাকতে নেই। তুমি শান্তিতে আছো মানে তোমার জীবনের স্ট্রাগল শেষ। একটা স্ট্রাগলহীন জীবন —ছি ছি ছি ছি।
তাকে দেখে মনে হল, সত্যি শান্তি একটা অশ্লীল জিনিস। শান্তিতে থাকা একটা অপরাধ।

তিন মাস। তিন মাস শান্তিতে থাকার পর ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার। এভাবে জীবন চলে না। তা করলাম কী, পাড়ার মসজিদে চাঁদা দিতাম। মাসিক দশ টাকা। ইমাম সাহেবকে খানা দিতাম মাসে একদিন। তো এক জুম্মাবারে মসজিদে ঘোষণা দিলাম যে আমি আর মসজিদে চাঁদা দেব না, মৌলানাকে খাওয়াতেও পারব না।
তাবারুক খাঁ থামল।

দেখলাম, একটা দল আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে। খুব শান্তি লাগল। এটাই তো চেয়েছিলাম। একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললাম, যে চাঁদা চাইতে যাবে তাকেই ঠ্যাঙাবো। এতে করে আরো কিছু লোক ক্ষেপে গেল। আমার যে কী আনন্দ! আরো একধাপ চড়ে গিয়ে বললাম, আমি ধর্মই মানি না, আজই আমার শেষ মসজিদে আসা। তখন আমার সমর্থনে আর একজনও রইলো না।
আর একটা সুরভি জর্দা পান কৌটো খুলে মুখে দিলো তাবারুক খাঁ।
বলল, আমাকে ঠ্যাঙাবে বলে সবাই আলাপ করতে শুরু করেছে। আমিও ভাবলাম, যাক এতদিনে একটু শান্তিমুক্ত জীবন কাটানো যাবে, কিন্তু কী আর বলি তোমাকে!

আমি বললাম, কেন, এইবার তো আপনার সুসময়।

না রে ভাই, যা ভাবা হয় তার বাইরে কিছু ঘটনা থাকে।
সবাই ঠ্যাঙাবে আমাকে, আমিও কদিন খুব অশান্তিতে থাকব, এটা ভেবেই আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি এসে হাজির হল। এ হল আজাব —যন্ত্রণা। এই শান্তি থেকে নিজেকে আর বের করতে পারলাম না।

আমাদের পাশে বসেছিলেন এক মৌলানা গোছের ভদ্রলোক। দাড়ি, জোব্বা, চোখে সুরমা। তাকে খেয়াল করিনি। তিনি নিজে থেকেই বললেন, আপনি একেবারে যথার্থ বলেছেন। শান্তি খুব ভালো জিনিস নয় আর পৃথিবীতে মন্দ মানুষের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে আসছে। সামনে ভীষণ দুর্দিন।

লোকটা কথায় কথায় 'ভীষণ' শব্দটা ব্যবহার করেন। এটা তেমন কোনো সমস্যা না।

আমি বললাম, আপনার তারিফ?

তিনি বললেন, আমি নানা অনিরাময় যোগ্য রোগের তদবির করি। আমার একটা দাওয়াখানা আছে। তাবিজ, মাদুলি, কবচ —এই হল আমার ওষুধ। বশীকরণে আমার ভীষন সুনাম আছে।
একটু থেমে বললেন, আমি আপনার অশান্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

এই শুনে তাবারুক খাঁর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, দিন তাহলে ব্যবস্থা করে।

লোকটা বললেন, তার জন্য আপনাকে আমার দাওয়াখানায় আসতে হবে। আমি রাস্তাঘাটে চিকিৎসা করি না।
এই বলে একটা ঠিকানা লেখা কার্ড ধরিয়ে দিলেন তিনি তাবারুকের হাতে।
সামনের শুক্রবার চলে আসুন, জুম্মাবার, শুভ —বলে তিনি উঠে চলে গেলেন।

শুক্রবার আমি আর তাবারুক খাঁ মৌলানা গোছের লোকটার দাওয়াখানায় হাজির হলাম। একটা শতরঞ্চি পাতা। একটা ছোট নিচু টুলের ওধারে তিনি বসে আছেন। এধারে আমরা। টুলটা সবুজ চাদরে মোড়া। ঘরের দেয়ালে আরবি নানা অক্ষর। মক্কা মদিনার ছবির ক্যালেন্ডার।

লোকটা বললেন, ৫ হাজার টাকা দিন আর এই নিন তাবিজ। গলায় পরবেন। ৫ দিনের মধ্যে আপনার জীবনে অশান্তি আসবে। গ্যারান্টি। গ্যারান্টি দিয়ে আমি কাজ করি। বিফলে মূল্য ফেরত।

৫ হাজার টাকা!
তাবারুক খাঁ ইতস্তত করছে দেখে তিনি বললেন, কাজ না হলে আমাকে পুলিশে দেবেন। এবার ঠিক আছে?

তাবারুক খাঁ পকেট থেকে দুটো ২ হাজার টাকার নোট আর ২ টো ৫০০ টাকার নোট নিয়ে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল।
—তাবিজটা কখন পরতে হবে?
—আজ রাত ঠিক পৌনে বারোটার সময় নিমপাতা দিয়ে গোসল করে দু দানা চিনি মুখে রেখে এই তাবিজ ধারণ করবেন। দেখবেন যেন শনিবার না হয়ে যায়।
আমরা তাবিজ নিয়ে লোকটাকে সালাম করে উঠে পড়লাম।

৫ দিন পর চায়ের দোকানে তাবারুকের সঙ্গে দেখা। দেখলাম সে খুব রেগে রয়েছে। বলল, আমি ঠকে গিয়েছি, পাঁচ দিন হয়ে গেল কিন্তু মনে এতটুকু অশান্তি নেই। বরং মনটা যেন বড্ড বেশি ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমার ভীষন রাগ হচ্ছে। আমি তাবারুক খাঁ, আমাকে ঠকিয়ে চলে গেল এক মৌলানা!
এইটুকু ছাড়া আমার আর কোনো অশান্তি নেই।

আমি বললাম, তাহলে কী করবে?

সে বলল, লোকটাকে পুলিশে দেবো। কার পাল্লায় পড়েছে সে জানে না।
তার মুখ রাগে আরও লাল হয়ে গেছে।
—তাহলে চলো দাওয়াখানায়?
—নিশ্চয়ই যাবো।

দাওয়াখানায় গিয়ে দেখি ঘর বন্ধ। তালা দেওয়া। এই দেখে তাবারুকের মাথা আরও তেতে উঠল। দরজায় সজোরে সে একটা লাথি মারল। গলার তাবিজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল দূর করে।
সে কিছু একটা করে বসবে বলে মনে হল। রগ চটে উঠলে কিছু একটা করা অসম্ভব না।

তিন দিন পর আবার দাওয়াখানায় গিয়ে পাওয়া গেল লোকটাকে। তাবারুক খাঁ তো তাকে এই মারে কি সেই মারে।
তার হলুদ পাঞ্জাবি ধরে টানতে টানতে থানায় নিয়ে চলল। মাঝপথে লোকটা বলল, জল খাবো। আসলে বলা উচিত জল পান করবো। সে যাকগে, তাবারুক খাঁ বলল, এক ফোঁটা জল তোকে দেব না, আগে থানায় চল।
এত রাগতে তাবারুককে আগে দেখিনি। সে সব সময় হালকা মেজাজে থাকে। আর নানা রকম ফন্দি ফিকির মস্করা করে বেড়ায় । এ যেন অন্য লোক।

লোকটা এবার জোর করে তাবারুক খাঁকে দাঁড় করালো। তারপর বলল, কী জীবনে অশান্তি এসেছে?
—মানে?
—মানে তো ভীষণ সহজ —আমার চিকিৎসা ১০০ ভাগ সফল।

তাবারুক খাঁ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, যান আমার চোখের সামনে থেকে। আর কখনও যেন না দেখি। উফ, পৃথিবীতে ভালো মানুষ বলে আর কেউ রইলো না।

অশান্তিকে চিহ্নিত করতে পারলে শান্তি আছে, আবার শান্তিকে চিহ্নিত করতে না পারায়ও অশান্তি রয়েছে। তাবারুক খাঁ সাহেবরা বোঝে না।

জিয়া হক





Corn গাছের কাব্য


কর্ন গাছ তুমি এইখানে শস্য দাও, ভালো থাকো ভায়া
তুমি একটি গাছ তবু ছায়া
নেই কেন?
যাইহোক যেনতেনপ্রকারেণ
তুমি থাকো
গুবরে পোকা, গাঙফড়িং ডাকো
আমি চাই কোনো একদিন
বলব কর্ন, আমার এ চুমুটুকু উপহার নিন

এই ভালো ভালোবাসা দানা
ফেলে রাখো রোদজলে কেহই খাবে না

অন্ত্যমিলে 'ছায়া' বড় ক্লিশে
যেভাবে 'শে' মিলে যায় প্রচলিত অহেতু বন্দিশে

জিয়া হক 

মানুষকে দেখা আজ দুঃখের ঘটনা


দুঃখ দেখে নয়, মানুষের কান্না দেখে ইদানীং কান্না পেয়ে যায়
কত ফুলদল দাহ হল, বাগান নিরুত্তর রয়েছে তারপরও
মৃত্যু একটা কোর্স —জেনেছি শেষ দিনে
নদী শুধু পার হয় নৌকো, গোল পার্থিব গ্রাম—
মহাপ্রয়াণ, গোরস্থান, বিধবা আশ্রম

খুব কি সস্তা হল স্নেহের বাজার?
পড়েই গেল কি আজ চুম্বনের দর?
কোর্স শেষে মুদ্রিত হতাশা আসে ঘরে?

কান্নাও নয়, মানুষকে দেখা আজ দুঃখের ঘটনা

জিয়া হক 

প্রজা-প্রতিবন্ধকতা


পাহাড়ের মধ্যে আমি আগুন দেখতে পেয়েছি
আর ঘরের মধ্যে
প্রজাপতি থাকত সেখানে সপরিবারে
গঙ্গাজল ছিল না দূরেকাছে, কোথাও, অাগুন-নির্বাপক
অনেক জঙ্গলের পরে শহর দেখা যায়, পড়ে এক গ্রাম
ওখানেও ভালোবাসা হয়
প্রত্যাখ্যান ওখানেও প্রচলিত আছে
চিকিৎসক গান গেয়ে অসুখ সারায় ওই দিকে

যা নেভে না, যা ক্রমান্বয়ে লাল হয়ে ওঠে
যে লাল মাংসের নয়, মনের গোস্ত থেকে ঝরে
তাকে মান্যতা দেয় প্রজাপতি —পতঙ্গভুক
প্রজাপতয়ে নমঃ, আরো কিছু শাদি হোক শীতে

জিয়া হক

গণহত্যা, গণতন্ত্র, গণকবর


আমরা মরে যাব ;
আমরা সবাই
একসঙ্গে
মরে যাই না কেন?
আমাদের পালিয়ে যেতে হবে ;
আমরা সবাই
একসঙ্গে
পালিয়ে যাই না কেন?
আসছে অনৈতিক ভোর, সাধারণ সূর্য, সর্বজনগ্রাহ্য কাশি
আমরা হেরে যাব ;
আমরা সবাই
একসঙ্গে
হেরে যাই না কেন?
লক্ষ করেছি তোমার শান্ত কালো বাতাস ; বেশ ভদ্র জামা
এই সবই
মারবে আমাকে, আমাদের কেননা কেননা
তাহলে কেন না
আমরা একসঙ্গে
ঘুমিয়ে পড়ি —স্বপ্ন দেখি

জিয়া হক 

অনবদ্য অন্ধকার চারিদিক


আমি কি নিজেকে অনবদ্য অন্ধকার উপহার দিচ্ছি রোজ?
হারিয়ে ফেলছি যোগাযোগের ভাষা ও গাড়ি
আর যা হারিয়ে যায় নদীতীরে তাকে শুধু
ফসলের জঙ্গলে পাওয়া যেতে পারে এমন ধারনা থেকে
কাটা হয়, কেটে ফেলা হয় শস্য খেত, ইচ্ছা ও আমাদের ঘর
কী অসম্ভব এই শহরপত্তন, নলকূপ, শাদী মুবারক
কী উৎসব ওই শ্রাদ্ধবাড়ি, শিশু ও লিঙ্গ নির্ধারণে
নৌকো চলে না ; নদী খালি পড়ে যায় সমুদ্রে —আর ধানক্ষেতে
কথা শুধু জমা হতে হতে সুদ হয়ে যায়, দূরত্ব কমে না
তোমাদের বাড়ি এই পায়ে হাঁটা পথ, তবু
যেতে চায় না আমাদের অটো — তোমার নিকটে
তোমার নিকটে ওড়ে কাক কেননা খাদ্য রয়েছো তুমি সেই
বাসে যেতে যেতে ভাবি, পা নয়, পাছা-ই যোগ্যতা আজ দিনে

জিয়া হক 

একটি সাক্ষাৎকার : ছোট্টগল্প


ক।
কী নেবেন—চা না সরবত?
একজন সাহিত্যিক আমার কাছে জানতে চাইছেন, কী পান করব—চা নাকি সরবত। বেশ মজা লাগল। আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। এরকমটা যে হয় তা জানা ছিল না।
আমি যেমন সংকোচ করে থাকি, ঠিক সেই ভাবে বললাম, না না কিছু লাগবে না।
তিনি বললেন, তা কি হয়?
এই বলে বেশ জোরে আওয়াজ দিলেন, সোফি! চা দিয়ে যাও আমাদের।
সোফি নিশ্চয়ই এ বাড়ির কাজের লোক। নাম শুনে মেয়েই মনে হচ্ছে। সোফি কি সুন্দরী?
ভদ্রলোকের নাম নির্বাণ চক্রবর্তী। মূলত উপন্যাস লেখেন। সেই সঙ্গে ছোটগল্পের বই আছে চার খানা। কবিতা লেখেন কম। তবে দৈনিক কাগজে উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন নিয়মিত।
সোফি কাচের কাপে টকটকে লাল চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। এই ভাবে সে বহুবার যে চা নিয়ে প্রবেশ করেছে এই ঘরে তা তার চলন দেখে বোঝা যায়। সোফি কিশোরি। গায়ে ওড়না নেই। চুল প্লাস্টিক গার্ডার দিয়ে বাঁধা।
তাহলে আমাদের কথোপকথন এবার শুরু করা যাক? নির্বাণবাবু বললেন।
তিনি পরে আছেন ঢোলা পায়জামার সঙ্গে ঢিলে পাঞ্জাবি। পায়জামা সাদা, পাঞ্জাবি সবুজ। চোখে চশমা। বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে বসেছেন সোফায়। হাতে একটু পুরনো দিনের ঘড়ি।
আমি বললাম, আমাদের এবারের রবিবাসরীয় সংখ্যায় শুধুমাত্র আপনার সাক্ষাৎকার থাকবে।
জানি। আপনার সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়েছে।
আচ্ছা।
আমার লেখা আপনি পড়েছেন তো?
সাংবাদিকদের কাজই হল পরচর্চা করা, আমি হাসলাম।
ভদ্রলোকও হাসলেন।
আপনার লেখাই শুধুই পড়িনি, আপনার অনেক ব্যক্তিগত তথ্যই এখন আমার মুখস্থ।
বেশ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বারান্দায় কেউ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। সোফি নিশ্চয়ই। একটা বড় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে সিলিং থেকে। সকলেরই চোখে পড়বে। এমন ঝাড়লণ্ঠন এখন আর কোনো বাড়িতে থাকে না।
প্রশ্ন শুরু করতে যাব, এমন সময় বাড়ির সদর দরজা ঠেলে একটি মেয়ে প্রবেশ করল। জিনসের সঙ্গে কুর্তি পরে আছে সে। বয়স একুশ বাইশ। কলেজ থেকে ফিরছে বোঝা যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ। বেশ সুন্দরী। চোখে গাঢ় করে কাজল লাগানো।
আমার মেয়ে, সঞ্চারী। ও প্রেসিডেন্সিতে সোশিওলজি নিয়ে পড়ে। থার্ড ইয়ার, বললেন ভদ্রলোক।
আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। নির্বাণ চক্রবর্তীর মেয়ের তথ্য আমার কাছে আছে। দেখলাম প্রথম।
চোখ নামিয়ে বললাম, এই মফস্বল থেকে রোজ কলেজ স্ট্রিট যেতে ওর অসুবিধা হয় না?
ভদ্রলোক বললেন, আমি শহরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। ও-ই যেতে চাইল না। ওর তো মা নেই। এখানে নাকি মায়ের ছায়া আছে। সেই ছায়া ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না।
আপনার বাড়িটা সুন্দর, প্রশংসা করলাম। মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।
তিনি বেশ আনন্দ পেলেন বোঝা গেল।
আরেক কাপ চা বলি?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি চিৎকার করলেন, সোফি!
সোফি যেন এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। মলিন মুখ।
আরো দু কাপ চা দিয়ে যা। আদেশ দিলেন নির্বাণবাবু।
আমি বললাম, আর চা খাব না। আজ একটু তাড়া আছে। কয়েকটা কপি লিখতে হবে অফিসে ফিরেই। আরেকদিন আসব। আপনাকে শুধু বলি, সাক্ষাৎকারটি যেহেতু বেশ বড়, তাই আমি এটা কয়েক দিন ধরেই নিতে চাই। একদিনে সবটা নয়।
তিনি সোৎসাহে বললেন, ভালোই তো। কোনও আপত্তি নেই।
বেরনোর আগে দেখি, সঞ্চারী সুন্দর একটি ঢিলেঢালা পোশাক পরে পাশের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ফোন বাজছে। মেয়েটিকে সত্যিই ভারি মিষ্টি দেখতে। ও কি ওর মায়ের মতো হয়েছে?
বাড়িতে নির্বাণবাবুর স্ত্রীর কোনও ফটো দেখতে পেলাম না ।
সোফি শুধু দরজার পর্দা ধরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

খ।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে নির্বাণ চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস নিয়ে বিছানায় গেলাম। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী গনেশ পাইন। স্যাফ্রন, হলুদ আর আধিদৈবিক সব মুখের ছবি।
একটি অনুচ্ছেদে লেখক লিখছেন — রতন চায়নি তার মেয়ে হোক। সে দাবাড়ু হতে চেয়েছিল। তার ছেলে বড় হয়ে গ্র্যান্ড মাস্টার হবে। রতন সন্তানের জন্মের আগেই হলুদ জামা আর নীল প্যান্ট কিনে এনেছিল। কিন্তু রতনের স্ত্রী জন্ম দিল একটা কন্যা সন্তান। রতন ভদ্রলোক, জ্যোতিষে বিশ্বাসী। সে মেনে নেয়। শুধু প্ল্যান করে, এই স্ত্রীলোকটিকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে বইটার কোথায় পড়ছিলাম সেটা আর খুঁজে পাই না। তা নিয়ে কোনো উদ্বিগ্নতাও নেই আমার।
রোদের সঙ্গে সঙ্গে চা চলে এসেছে আমার পড়ার ঘরে। মা এখনও সকালের চা-টা দেয়।
মাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা তোমাকে কী ফুল দিত মা?
মায়ের মেজাজ আজ ভালো। বলল, ফুল নয় রে, কাচের চুড়ি কিনে দিত।
কী সস্তায় প্রেম হয়ে যেত তোমাদের মা!
কিন্তু প্রেমটা সস্তা হত না এখনকার মতো।
মা চলে গেল হাসতে হাসতে। শুধু বলল, কেউ জুটেছে নাকি বেড়ালের কপালে?
মা জানে তার বেড়ালটা অকর্মণ্য, ইঁদুর ধরে আজও খেতে শেখেনি বলে নিরামিষ ভোজনের প্রচারক হয়েছে। মাকে আজ খুব ফুটফুটে লাগল। মা কিন্তু স্নো পাউডার কখনো মাখে না। হাতে এখনও কাচের চুড়িই পরে।
মুশকিল হল অন্য জায়গায়।
নির্বাণ চক্রবর্তী সম্বন্ধে আরও পড়াশোনা করে জানলাম, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। কারণ অজ্ঞাত। খ্যাতনামা লেখক বলে সব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কেস হয়নি।
এমন কি পোস্টমর্টেমও না।
আরও নানা তথ্য জানতে পারছি কিন্তু সম্পাদক বলেছে নির্বাণবাবুর লেখক সত্তাকে তুলে আনতে হবে সাক্ষাৎকারে। ব্যক্তি নির্বাণ চক্রবর্তী নিয়ে তার কোনো আগ্রহ চোখে পড়ল না। ষাটের দশকের এই লেখক আর কোন কোন লেখকদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তা জানতে হবে। মানে গল্প বের করে আনতে হবে।
আজ এক জায়গায় যেতে হবে আগে। তারপর নির্বাণ চক্রবর্তীর বাড়ি।
আমি স্নানে ঢুকে পড়লাম।
ট্যাঙ্কে জল নেই।

গ।
কলেজ স্ট্রিটের গাছের পাতা গরমে শুকিয়ে উঠছে। সরবতের বরফ ক্রমাগত ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। ভিড় খুব। মেয়েরা লাল হলুদ গোলা খাচ্ছে। কিন্তু যে মেয়েটিকে আমার দরকার সে কলেজ থেকে এখনও বের হচ্ছে না।
পনেরো মিনিট পরে প্রায় বেরিয়ে এলো সঞ্চারী। আজ তার পরনে জিন্স টপ। মাথায় ছাতা।
এগিয়ে গেলাম।

চিনতে পারছেন? গতকাল আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।
সে চিনতে পেরেছে। একবার চোখাচোখি হয়েছিল, তাতেই সে চিনতে পারছে। স্মৃতি ভালো।
খুব শান্ত গলায় বলল, বলুন।
এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। চলুন কোথাও বসি।
প্রায় অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি তো বসি না। সে বলল।
কোনো ক্ষতি করব না আপনার। আসলে আপনার বাবার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে আমাদের কাগজে। তাই আপনার সাহায্য দরকার।
বাবার ইন্টারভিউয়ে আমি কী সাহায্য করতে পারি?
পারেন, অনেক সাহায্য করতে পারেন।

একটি কফি শপে আমরা মুখোমুখি বসলাম। ওকে ভারি সুন্দর লাগছে।
বললাম, আপনাকে ভারি সুন্দর লাগছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করতে চান? তাহলে বলি, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
না না, তা নয়। বলতে ইচ্ছে হল তাই বললাম। ভাবলাম, আপনি খুশি হবেন।
এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। যাইহোক, বলুন।
সরি।
সরি বলার প্রয়োজন নেই। বলুন কী জানতে চান।
আচ্ছা, আপনার মা কীভাবে মারা গেলেন?
প্রশ্ন শুনেই সঞ্চারীর মুখ গোমড়া হয়ে গেল।
আমি কিন্তু আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।
সে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, জল খাবেন?
আমার কাছে জল আছে।
পুরো বোতল নিঃশেষ না করেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। কিন্তু আপনি এত কুণ্ঠিত কেন?
কেউ যাতে শুনতে না পায় সেভাবে মুখ ঝুঁকিয়ে সে বলল, মায়ের মৃত্যু নিয়ে...
বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। বলল, আজ উঠি, অন্য একদিন বলা যাবে।
কফি পান না করেই সে উঠে চলে গেল।
মেয়েটিকে বিষন্ন করে দিয়ে আমার বেশ হালকা লাগছে।

ঘ।
পত্রিকার সম্পাদক ডেকে জানতে চাইলেন সাক্ষাৎকার কতদূর। সম্পাদক ভদ্র সভ্য মানুষ। লম্বা সাদাটে জুলফি, ব্লেজার পরেন। সেই একই নীল ব্লেজারটাই। রোজ। হাতে সব সময় সিগারেট জ্বলে।
শিগগিরই হাতে পাবেন।
তাকে আশ্বস্ত করলাম।
তিনি আবারও জোর দিলেন, আমার কিন্তু ষাটের দশকের সাহিত্যিক মহলের গল্প চাই, মনে আছে তো?
হ্যাঁ, মনে আছে।
কী বললেন এ পর্যন্ত?
তার প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উপন্যাসকার বিজলি দেবীর বাড়ি ফেলে এসেছিলেন। কত ভালো উপন্যাস তা আপনি জানেন। বিজলি দেবীর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। তিনি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক রফিকউদ্দিন সাহেবের কাছে যান। উৎসব সংখ্যায় ছাপার জন্য নির্বাচিতও হয়ে যায় সেটা। নির্বাণবাবুর তখন পাগল হবার দশা। প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা যে বাজারে হিট করত সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। পরে হিটও করেছিল, আপনি জানেন। প্রথম উপন্যাসেই খ্যাতির চূড়ায়। তো যাইহোক, রফিক সাহেব একদিন নির্বাণবাবুকে জানান যে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন বিজলি দেবী। তিনি নির্বাণবাবুকে পড়তে দিতে চান। তারপর সব জানাজানি হয়ে গেল।

এ গল্পটা তো আমি জানতাম না। কতটা জানাজানি হল তাহলে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন সম্পাদক মশাই।

আসলে এই গল্পটি আমার বানানো। এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তাছাড়া, আমাদের সাক্ষাৎকার পর্ব তো এখনও শুরুই হয়নি। সেটা বলতে না পেরে এই গল্প ফাঁদতে হল।

সম্পাদক মশাই সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে ইন্টারভিউটা হিট করে যাবে।

জোর দিয়ে আমি বললাম, নিশ্চয়ই হিট করে যাবে।

গল্প গল্প। পাঠকের গপ্পো চাই।

দারুণ আর চমকপ্রদ গল্প এনে দেবো আপনাকে। নিশ্চিন্ত থাকুন।

এটা বাজার খেয়ে গেলে আপনার পরের অ্যাসাইনমেন্ট হবে কবি সুবিনয় ঘোষ।

দারুণ। আমার কাছে সাক্ষাৎকার একটা ইনভেস্টিগেশনের মতো।

আপনি ফিকশনটাও ট্রাই করতে পারেন।

চিন্তা করবেন না, আমি একটা ফিকশনের মধ্যে দিয়ে এখন যাচ্ছি।

সম্পাদক মশাই মৃদু হেসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
এখন আমাকে একটা সুরভি দেওয়া পান খেতে হবে।

ঙ।
নির্বাণবাবুর বাড়ির একটু দূরে যে বাজার সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। নটা বাজে। জানি এই সময় সোফি আসবে বাজার করতে।
আমাকে দেখে সোফি একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর স্বভাবসুলভ মিষ্টি করে হাসল।
স্টেশনারি দোকানের পাশে সোফিকে ডেকে ওর হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে বললাম, খাও।
প্রথমে নিতে সংকোচ করলেও তারপর সহজ হয়ে নিল প্যাকেটটা। কিন্তু খেল না, ধরে রইল হাতে।
আমি বললাম, সোফি, তুমি কতদিন ওই বাড়িতে কাজ করছো?
৩ বছর।
তার আগে?
আমার বাড়ি গ্রামে। আমরা তিন বোন। স্যার আমাকে এখানে এনে রেখেছেন। আমার বিয়ে দেবে। সব খরচ করবে।

তুমি বাবুকে স্যার বলে ডাকো?

উনি আমাকে স্যার বলতে বলেছেন।

তোমাকে কি পড়ান অবসর সময়ে?

অবসর মানে?

অবসর মানে যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না।

না, পড়ায় না।

দিদিমণি কেমন?

ভালো।

তোমাকে ভালোবাসে?

হ্যাঁ।

স্যার তোমাকে ভালোবাসে?

এই প্রশ্নে সোফি বেশ হকচকিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকালো। তারপর কেঁদে ফেললো।

আমি খুব নরম ভাবে বললাম, কী হয়েছে সোফি?

সে কিছু না বলে, কিছু না কিনে বাড়ির দিকে দৌড় মারল।

আমি তার মলিন ফ্রকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দৌড়ে যাওয়া লক্ষ করলাম।

দাদা, একটা চা দিন তো।

চ।
আজ বুধবার । লু বইছে সকাল দশটা থেকেই। রাস্তায় সবাই নাকমুখ ঢেকে চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে, সৌদি আরবে এসে পড়েছি। পাসপোর্ট আছে তো? একবার পকেটে হাত গেল তারপর মনে মনে হেসে ফেললাম।

নির্বাণবাবুকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি আর তিনি প্রসন্ন মুখে তার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
কীভাবে লিখতে শুরু করলেন, তার বাল্যকাল কেমন কেটেছে, কাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছেন, একই সঙ্গে সাহিত্যের এতগুলো সংরূপ কীভাবে সামলান, উপন্যাস কীভাবে শুরু করেন —কীভাবে শেষ করেন, সমাজ নিয়ে তার কী ভাবনা, তার লেখায় নারীরা কেন এত অবহেলিত, ইত্যাদি সব প্রশ্ন।
তবে নারীদের প্রসঙ্গে এসে তিনি এক অদ্ভুত গল্প শোনালেন।
গল্পটি সংক্ষেপে এরকম :
তিনি মায়ের স্নেহ পাননি। তার জন্মের কয়েক মাস পরে তার মা অন্য এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যান। মায়ের মুখ ভালো করে তার মনে পড়ে না। সেই ছোট থেকেই তার বাবা তাকে মাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। শেখাতেও হয়নি, মায়ের প্রতি ঘৃণাটা সহজ ভাবেই এসে গিয়েছিল তার মধ্যে। বাবা আর বিয়ে করেননি। অনেক পরে, যখন তিনি কলেজে পড়েন তখন খবর পান যে, তার মা অন্য আরেকটি পুরুষের সঙ্গে তখন ঘর করছে।
বাবা তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনিও একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ে জিনিসটাকে ঘৃণাই করতেন।
তারপর সঞ্চারীর মায়ের সঙ্গে হঠাৎ প্রেম হয়ে যায়। তার বাবাও প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন।
তার খালি মনে হত সঞ্চারীর মা তার মায়ের মতো কারো সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের অদ্ভুত লীলা। সঞ্চারীর জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করে বসেন।
নারীদের তিনি তাই সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন বলে আর ভালোবাসতে পারেননি।
যাইহোক, আরও নানা প্রশ্নের পর আমি বিদায় জানিয়ে অফিসে ফিরে এলাম।
সম্পাদক মশাইকে বললাম শনিবার রাতে কপি জমা দেবো।
তিনি আরেকটি হিট সাক্ষাৎকারের আশায় নারাজ ভাবে শুধু বললেন, বেশ।

ছ।
সোমবার। পত্রিকার দপ্তরের ফোনগুলো ক্রমাগত বেজে চলেছে। অসংখ্য প্রশ্ন পাঠকদের। এ কীভাবে সম্ভব। এতদিন পর এসব আবার কী! যা ছাপা হয়েছে রবিবাসরীয় সাক্ষাৎকারের জায়গায় তা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার। একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের এখনই জেল হয়ে যাবে। লেখকের স্ত্রীর ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতার ছবিও ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি লেখক সম্পর্কে নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সম্পাদক মশাই বিচলিত। আমাকে ডেকেছেন তার ঘরে। বেশ গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার উপর ভরসা করে সাক্ষাৎকারের কপি না দেখে ছাপতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এসব আপনি কী লিখেছেন?

এক বর্ণ মিথ্যে লিখিনি স্যার।

এখন যদি নির্বাণবাবু পত্রিকার বিরুদ্ধে কেস করেন তাহলে কী হবে?

আমার কাছে যথেষ্ট এভিডেন্স আছে। অযথা চিন্তা করছেন।

কিসের এভিডেন্স যে তিনিই তার স্ত্রীকে খুন করেছেন? আর কাজের মেয়েকে রেপ করেছেন দিনের পর দিন?

হ্যাঁ। তিনি একজন খুনি এবং রেপিস্ট।

কী সব বলছেন আপনি? কোথায় আপনার এভিডেন্স?

শুনুন তাহলে :
প্রথম দিন নির্বাণবাবুর কাজের মেয়ে সোফি, তার নিজের মেয়ে সঞ্চারী মুখ খুলতে চায়নি। তারপর আমি আবারও তাদের আলাদা আলাদা ভাবে মিট করি। সঞ্চারী আমার প্রেমে পড়েছে। সে তার বাবার সব কথা আমাকে বলে দেয়। এমনকি তার মায়ের যে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা নির্বাণবাবু তার দেরাজে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন সেটাও সে আমাকে দিয়েছে। সেই ডায়েরিতে সঞ্চারীর মা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তাকে তার স্বামী খুন করে ফেলবে। যেদিন তিনি ওই ডায়েরি লিখেছেন তার দু দিন পরে তার ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটে। শুধু তাই নয়, খুনের হুমকির কথাও ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন লেখকের স্ত্রী।
সঞ্চারী নিজেও জানত না যে তার বাবা সোফিকে নির্যাতন করে।
সোফির জবানবন্দি টেপ করে যখন তাকে শোনাই সে আকাশ থেকে পড়ে এবং শুধু তাই নয়, তার বাবার কুকর্ম এক রাতে সে দেখেওছে তারপর।
মায়ের শোক সে ভুলেই ছিল কিন্তু সোফির যন্ত্রণা তাকে আবার তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে এখন তার বাবার শাস্তি চায়। কোর্টে বয়ান দিতেও তার আপত্তি নেই।

সম্পাদক মশাই ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। চোখ এসি মেশিনটার দিকে বোধহয়। কী বলবেন, কী করবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না।

আপনি গল্প চেয়েছিলেন না?

কিন্তু...

এই হল গল্প। ষাটের দশকের একটি খুনের গল্প যার এই একুশ শতকের প্রথম দশকে নিষ্পত্তি হল।
পরের সাক্ষাৎকারের কাজটা কি শুরু করব?

সম্পাদক স্যার প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে বললেন, আগে একটা রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে যান।


জিয়া হক

একটি নিরীক্ষা 

এই ছলনাই আমার দেশ, ইহাই নীতিরাজ


এখন সর্বত্র অতিকথন। অতিরিক্ত কথা এবং অতি মাত্রায় কথা। শব্দ আয়ত্ত আছে বলেই কিছু কইতে হবে?
-তাহলে কি নীরবতাই শ্রেয়?
-যেখানে কথা বলা আবশ্যক, সেখানে নীরবতা অপরাধ।
-কোথায় আবশ্যক?
মুশকিল হল, এই বোধটাই নেই। কোথায়, কতটা মুখ খুলতে হয়, তার অজ্ঞানতাই আমাদের বাধা। মুখ এক ধরনের খাপ, কথা এক ধরনের তলওয়ার। আমরা ফলত আহত করে ফেলি, আক্রান্তও যে হই না, তা নয়। কেননা প্রত্যেকেই এই অর্থে সশস্ত্র। ধর্মে ততদূর অবধিই বাক-স্বাধীনতা স্বীকৃত যতদূর তা অহৈতুকী ও সহিংস না হয়ে যায়। ধর্মের রেজিমেন্টেশন নিয়ে প্রায় সকলেরই উষ্মা। আমাদের মনে হয়েছে, এই পরিখাপদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণেচ্ছার মৌল অভিপ্রায় থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি বলেই, তা জেলখানা ঠেকে। মানুষের মনের মৌলিক কাঠামোয় হিংসার একটি প্রকট জায়গা রয়েছে। সামাজিকতা যেহেতু একটি বানিয়ে তোলা ব্যবস্থা এবং সমাজ নিজেই ব্যক্তিহিংসা-নিরপেক্ষ নয়, তাই সমাজ-সত্য ও সমাজ-চোখ, সমাজ-মন একে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ। এখানে ধর্ম যে কাজটি করে তা হল শুদ্ধির জায়গা। একটি মানুষ নিয়ে তার আগ্রহ। কেননা একজন করে বদলে গেলে সমষ্টিই বদলে যাবে। মানুষ-নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হয়?
তাহলে এই যে ধর্মীয় হিংসা? তাহলে কি হিংসার বীজ নেই ধর্মের কোথাও? এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ধর্মের রাজনৈতিক সত্তাটি বেশ ভোঁতা। ধর্মকে নিয়ে রাজনীতির জায়গাটি তীক্ষ্ণ। প্রসঙ্গত, ধর্ম যে একেবারে রাজনীতি বিবর্জিত, তা নয়। তবে ধর্ম-প্রদত্ত নেতার যে আদর্শ, তা কি সুলভ? ইসলাম ধর্মে যে চার খলিফা—আবু বকর, ওমর ফারুক, উসমান গনি, হযরত আলী—সকলেই তো সুফি সাধকদের মতো জীবনযাপন করেছেন। ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে পরলোকে গিয়েছেন। খালিফা বা রাজার ব্যক্তিগত ঋণ? কল্পনাতীত। সমকালিক ধারণায়, শাসকের ঋণ মানে রাষ্ট্রীয় ঋণ, দলীয় ঋণ। জনগণের ঋণ। সদ্যজাত শিশুও সেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে।
আমি চাই মানবোন্নয়ন। কেবল নগরোন্নয়ন বা গ্রামোন্নয়ন নয়। এই বিভাজনগুলি কার্যত মানুষ নামের জৈব প্রতিষ্ঠানকে খন্ডিত করে। ভেদবুদ্ধির উৎস এগুলিই। রাষ্ট্র কল্পতরু নয়, তবে তার কল্পতরুর ভান করার প্রশ্নটাও এখানে আলোচ্য। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দিকটিই হওয়া দরকার ছিল সহায়কের, তার বদলে তা হয়েছে অনাক্রমণ চুক্তিভিত্তিক শোষকের। তাই উঠে আসে আঞ্চলিকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের মতো অ-সংসদীয়, অ-সাংবিধানিক বিষয়গুলি। এর কারণই হল, রাষ্ট্র নিজেই তার সাংবিধানিক শুদ্ধতাকে রোজ হত্যা করে। ‘ব্যবহার’ করে। প্রয়োজনে সংবিধানকে মুষড়ে ফেলার চেষ্টা করে যায়। জুডিসিয়ারি সিস্টেম যতই নিরঙ্কুশ ও স্বতন্ত্র হোক না কেন, তা যে রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনকে একেবারে অস্বীকার করে এগিয়ে চলেছে তা বলা যায় না। কোনও কিছুই প্রভাবমুক্ত নয়। তাই বলা যায়, বিচারব্যবস্থা একটি কলহান্তরিতার মতো আর রাষ্ট্রও অসূর্যম্পশ্যা নয়।

জিয়া হক

ভারতীয় পাখিদের অপমৃত্যু


ছড়িয়ে দিয়েছি দুটো পাখি
চলে যাবে আকাশের দিকে
তুলে খাবে তারাদের
পুং পাখি চুমু খাবে স্ত্রীকে

এই ভাবে কোনও একদিনে
আকাশও হয়ে যাবে সাদা
শাড়ি পরতে চায় সেই পাখি
হয়ে যেতে চায় কালো রাধা

নায়িকা হবার কিছু লোভ
ছিল তার সিনেমা ও গানে
ক্যামেরা বা যে কোনো যন্ত্রই
পাখিটিকে আজীবন টানে

আকাশের কোনো এক ঢালে
ভাসছিল রাধা নাম্নী পাখি
যন্ত্র খালি থুতু ফেলেছিল
তাহাতেই রক্ত মাখামাখি

নায়কের কাছে যেতে হলে
উড়তে হয় অনেক ভিলেন
ভারতীয় সেই খুকু পাখি
নিরক্ষর, ভদ্র ছিলেন

জিয়া হক

আলাপ ও বিস্তার


কোথাও শীতঠাণ্ডা জল আমাকে বলে, গণমাধ্যমে যাও
ওখানে উষ্ণপাতা উড়ছে যা দেবে মিত্রপক্ষের সফলতা
কী দেব তার বিনিময়ে, আমি বলি
নাবালৌকিক কথা শুনে এই সব, সেও হাসে খিল্লিধর্মী হাসি
যে যায় শহরে সে হয় বেশ্যা, তুমি জানো?
আর ঘরে যারা থাকে, তারা কি শোভা ওই তুলসীপত্রের?
প্রশ্নকারীরা গ্লুকোজ ছাড়া কিছুই পায় না, শেখো
শেখো, কীভাবে নর্দমা পাপ বইতে থাকে অথচ
সবাই চায় সুনির্মিত নর্দমা সুসজ্জিত ঘরবাড়ির পাশে
জানতে চাও, শহরে কি মহিলা যায় শুধু? পুরুষকে বেশ্যা কেউ বলে?
অজ্ঞান লোকেদের চুপ থাকা স্বাস্থ্যকর ভেবে
নখ খাই, চাঁদ দেখি, গুরুবাদী হই
শীতঠাণ্ডা জল তবু আমাকেই ডাকে, বলে, ঠিক আছে
ডুব দিয়ে দেখো, দোষারোপ করো না কখনও,
মুক্তো খুব ঝুটা হয়, রাখি না ফলত,
তবে কিছু পানকৌড়ি পেয়ে যেতে পারো আর পচা জুতো,
দু একটা ভদ্রলোক হয়ত বসে আছে, ভদ্র গ্রাম্য মেয়ে

জিয়া হক 

প্রবাসী আতর এসে লাগে


কোথায় যাব এই সামান্য আলিঙ্গন নিয়ে, চাহিদা ছিল
পাঁচ মিনিট বা তারও তিন মিনিট বেশি
প্রার্থী আমি, হাত শুধু প্রস্ফুটিত নয়, এই মাত্র
এই আশ্রম আমার বন্দীশালা, গোয়াল, আস্তাবল
আমি কি লোকায়ত ষাঁড়, অবসরপ্রাপ্ত কোনো ঘোড়া?
অনেকেই জানে, হ্রদে যেখানে অনেক উচ্চতা থেকে
জনবহুল বাস পড়ে যায়, তার পথ বেশি আপ্যায়ন করে
মাসাধিক কাল বৃষ্টি হল বলে ভিজে এই জামা-পায়জামা
আলিঙ্গন সংক্ষিপ্ত করো কেননা জানো
কোন গাছে আতাফল সুমিষ্ট হয়, আর কে মুদ্রাবিহীন

জিয়া হক 

মিথ্যুকবৃক্ষের ফল


এই মিথ্যুকবৃক্ষের ফল খাবে না কখনও যদি চাও —
মাথামোটা জীবন কাটাবে গোপালন করে
যদি চাও সুচাকুরে পাত্রীর সন্ধান বন্ধ করে দেবে
অভুক্তভোগীরা বিল ছাপায়, অনুষ্ঠান করে, কুড়ি ফন্টে নাম
দয়ার শরীরে বসে মশা ও মশাই, আয়ু পান করে
কেন জানি মিথ্যুকবৃক্ষের নিচে সত্যিকার মেয়েলোক আসে
সে জানে কত অংশ তার বিক্রয়যোগ্য আর
কতখানি ব্যানার হিসেবে কাজ করে
আদম হিসেবে আমি জানি, ভাষা ব্যবহারে অদক্ষ লোকই
অপরাধী ; ভাবুকের বুক থাকতে পারে, কখনও থাকে না —
সাদা জামা,
বুক পকেট
কলার খোসার মতো জুতো, তার থাকে
স্থির বলে একে সব প্রদক্ষিণ করে —ভাবে, এই তো ভ্রমণ
যে বিছানা ঘুম দেয় রোজ, যেই ঘর আলুচোখা দেয়
সেখানেও থেকে তুমি নিজেকেই পর্যটক ভাবো?
বৃক্ষ হইতে সাবধান, তারা তোমার ভালো চায় জানো
এই কি নয় যথেষ্ট মন্দ বিষয়?

জিয়া হক

নাথুরাম ও রামরাজ্য


কতরকমের গাছপালা হয়ে আছে, অজ্ঞাত পরিচয়
এই বনে ছিল আমাদের খেলা ; সরল গনিত
কেউ কি আওরঙ্গজেব হতে চায় এই দিনে?
অনেকেই স্বপ্ন দেখে নাথুরাম হবে : হবে গ্রন্থ প্রণেতা
এই বনে ছিল আমাদের ছাপাখানা, খানাখন্দ খেলা
আজ মৌ এসেছিল, সে কিন্তু মাছি নয় —মেয়ে
তার গালেই ছিল বটের পাতার মতো রোঁয়া, বটফল
সে চায়, দূরত্ব বজায় রেখে আমি শুধু দেখি
আমি চাই, ছুঁয়ে তাকে, ছেনে তাকে —দেখি
আমার রাজত্ব আছে, মহারানি পদে লোক নিয়োগ হবে —
সে ভাবে
কোটালপুত্র আমি, ফেলে যাওয়া রুটি ভোগ করি,—
সে তো জানে না
তার জন্যে মীরকাশিম খুঁজি রাস্তায় রাস্তায়, পানের দোকানে
লোকমুখে বীর হলে হবে, বীরত্ব যে পিঁপড়েরও থাকে

কতরকম ঘরবাড়ি হয়ে আছে ; নেমপ্লেট সহ
এইসব সংশোধনাগারে কারা থাকে? ভাষা কি বিদেশি?
কার পক্ষ নেয়? সুপাত্র আছে? নিরামিষ খায়?
চিন্তাবিদ নই, তবে মৌদের কথা ভাবি ইদানীং
যেহেতু, অনেক খেলেছি এই বনে

জিয়া হক

সুজাত বুখারী : বন্য উপত্যকায় ঘুম


এই যে, এই যে সেই লোক যার স্বাভাবিক মৃত্যু হল এক রাতে
ঘড়িটি ছিলই তাকের উপরে অক্ষমতা নিয়ে
ঘোরেনি বহুদিন তাই হিসাবশাস্ত্রে জ্ঞান নেই
কে কোথায় কতদিন বন্দী রয়েছে —জানে না
এখানে মাংস বহুমূল্য এখন;— ব্রাশ করে নরখাদকেরা
মুড়িজল পশুখাদ্য এখানে, চিনিতে সুগার
স্বাভাবিক পা ফেলে ফেলে কেউ চলে যাবে এমন সুদিন
ভিনদেশে আছে বলে দেশীয়রা ভাবে
ভাবে মহাপুরুষেরা, মহামহিলারা উৎসবের জন্ম দিয়ে গেছে
আর ভাবে তিনিও তাদেরই একজন

কর্তা! ফল গাছে ফল হয়, ফুল গাছে কর্মফুল ফোটে
অনেক আদর হয়, প্রকৃত চুম্বন তবে মোটে
আসে একখানা
কোথাকার স্ত্রীলোক, কবেকার ত্যাজ্য জেনানা
দিয়ে যায় ঠিক
সবারই অপমৃত্যু, এভাবেই কিছু স্বাভাবিক

জিয়া হক

কুৎসিত প্রার্থনা আর নর্দমার মধু


পরে এসো, এখন ব্যস্ততা আমার নেই
যখন খুব ভেঙে পড়ে থাকব, দেখতে এসো না
এই আমি শিল্পমেলায় যাচ্ছি, চারুকলা ভবনে,
বিদেশি সুখাদ্যের কাচ ঘেরা দোকানে পাটে,
ই-চিঠি লিখছি অপাত্রে দান করব বলে,
কাজ করছে মন, সাজিয়ে বলতে পারছি ভাষা,
মুখস্থ আছে কোন ফুল রাত্রে ফোটে, গন্ধ বেশি হয়,
কীভাবে খোলা চুলে আঙুল চালাতে হয়,
সেই দিন এসো
আমার লুঙ্গি পরা ছবিখানি তুমি দেখে ফেলো, চাই না
আত্মজীবনী লুকিয়ে রাখতে চাই ওই লজ্জাস্থান —
ঢাকার কাপড়ে — তারপরও যদি ঝরে পড়ে বীজ,
ভিজে গিয়ে দেখা হয়ে যায়
ফিরে যেতে অনুরোধ করি, এ বড় বিনীত আর আদেশানুসারে

জিয়া হক 

অর্গ্যাজম কত প্রকার ও কি কি?


পুরুষ, তোমার কি অর্গ্যাজম হলে লজ্জা লাগে না?
তাকিয়ে দেখেছো পাশে শুয়ে আছে যে মহিলাটি
তার সবে ঘুম ভাঙল এই, কী নরম তার মুখ যেন
কতদিন বৃষ্টি হয়নি প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ভালোবাসা কি সেই বাতি যা শুধু নিভে যাবে
নিভে যাবে আর তুমি ঘষে দিলেই আলো?
যে গাছের যা দায়িত্ব তা সে না মানে যদি, কী করো?
এরপরও মা আমাকে খেতে দেয়, করুণা করে না
খুকি, মানুষকে অপশন ভাবতে লজ্জা লাগে না?
গোপনাঙ্গ বিনিয়োগ করে কী কিনবে বলো?
তুমি কি জানো না কার বিনিময়ে কী তুমি পাও?
যে-মাটির বীজ মরে যায়, খেয়ে যায় কাক, তার ব্যথা বোঝ?
তোমার অজ্ঞাত কিছু নেই, কান ওই বাতাসের মতো বড়
প্রতিটি পাতার শুকিয়ে যাবার শব্দও পেয়েছো, মনে হয়
আমার লজ্জাস্থান আমাকেই নিয়ে যায় নষ্ট অন্ধকারে

জিয়া হক 

কবি শোভন ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার : প্রশ্নে কবি প্রসূন মজুমদার

প্রশ্ন ১) কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোর কথা একটু বলো

উত্তর— আক্ষরিক অর্থে কবিতা লেখা শুরুরও বেশ কয়েকবছর আগে, খেলাচ্ছলে কিছু প্রেমপত্র লিখতে গিয়ে আমি টের পাই, সেই কৃত্রিম লেখাগুলোর ভেতর দিয়েও, আমার যোগ্যতার অতিরিক্ত কিছু সৌন্দর্য ও সুষমা, আমার সম্পূর্ণ অবচেতনেই প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। সেসব চিঠি যে শুধু নিজের জন্যই লিখতাম তা নয়, বরং বন্ধুবান্ধব অনেকের বকলমেই সেই পাপ আমি করেছি। করতে করতে এক বিপজ্জনক খেলায় নিজেও জড়িয়ে পড়েছি। ১৭/১৮ বছরের উন্মত্ত কৈশোরে জড়িয়ে পড়েছি ফিল্মি আবেগ নির্ভর মিথ্যে প্রেমের যন্ত্রণাদায়ক সম্পর্কে। কম বয়সের মোহে সেই সম্পর্কের রেশ টেনেছি বছর তিনেক। তারপর যথারীতি তা একদিন ফুরিয়ে যাবার সময় এসেছে। দু’জনের পথ, প্রাকৃতিকভাবেই পৃথক হয়ে পড়েছে একদিন। কিন্তু ফর্মুলাবদ্ধ সমাজের চোখে ঘোরতর অন্যায় হয়ে দাঁড়াল সেই বিচ্ছেদ। পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আমার আত্মীয় বন্ধু প্রায় সকলেই সেই বিচ্ছেদের জন্য আমার অপদার্থতা আর সামাজিক অযোগ্যতাকেই দায়ী করতে থাকল। আমি ভয়াবহভাবে একা হয়ে গেলাম। এমনকী আমার বাড়ির লোকেরাও সে সময় আমাকে করুণার চোখেই দেখতে শুরু করেছিল। তখন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতকস্তরের ছাত্র। দিনের বেলা কলেজ সেরে, বাড়ি ফিরতাম বিকেলে। তারপর সন্ধে অব্দি বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম, যতক্ষণ না অন্ধকার নেমে আসে চারপাশে। দিনের বেলা  আলোয় বাড়ির বাইরে বেরতে আমার ইচ্ছেই করত না। আমিও কারুর মুখ দেখতে চাইতাম না, অন্য কেউ আমাকে দেখুক তাও চাইতাম না। সন্ধের আবছায়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে পৌঁছতাম পাটুলি সংলগ্ন বাইপাসের ধারে। তখন সবে নির্মিয়মান বাইপাসের ধারগুলোয় শুধু অন্তহীন মাছের ভেড়ি। ভেড়ির পর ভেড়ি। দুটো ভেড়ির মাঝ বরাবর চলে গেছে সরু সরু আলপথের মতো রাস্তা, মিশে গেছে দূরের ঘন অন্ধকারে। এখন যেখানে ‘বেণুবনছায়া’, সেখানে তখন নিশ্ছিদ্র কুয়াশাঘন অন্ধকার, জলায় জলায় জমাট বেঁধে থাকত। পুবদিকের অন্ধকার চিরে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলে যেত গড়িয়া স্টেশনের দিকে। তারপর সোনার থালার মতো চাঁদ উঠত রেললাইনের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে। আমি একা জলের ধারে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, সন্ধের পর সন্ধে। বসে বসে দেখতাম কালো জলের ওপর কেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঝকঝকে তারায় ভরা রাত্রির আকাশ। দূরে, আলপথের কুয়াশা ভেদ করে, চাদর জড়ানো দিনমজুরের দল বিড়ি টানতে টানতে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত রেললাইনের দিকটায়… সেইসময় নিজের অজান্তেই আমি ধ্যানস্থ হয়ে পড়তাম যেন। সেই নির্জন, নৈসর্গিক অন্ধকারে, তারায় ভরা অন্তহীন আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমার একবিন্দু প্রাণ যেন এক মহাজাগতিক জীবনের ইশারা অনুভব করত। বেশ কিছুদিন এইরকম চলার পর বুঝলাম, অনেক অনেক কথা যেন জমা হচ্ছে আমার ভেতরে, কিন্তু সেইসমস্ত আকাশকুসুম ভাব প্রকাশের ভাষা যে আমি জানি না। বুকের ভেতর কী যে জমাট সেই অবস্থা, আজও বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তাছাড়া সেইসব কথার ভাব এমনই, যে তা ভাষায় যদি প্রকাশ করাও যায়, শুনবেটা কে? এই বিশ্বচরাচরে আমার পরিচিত এমন কোনও মানুষের মুখ তখন মনে পড়ত না, যাকে গিয়ে আমার মনের কথা বলতে পারি। সেই কথা কিন্তু কোনও সম্পর্ক ভাঙার কাঁদুনিমাত্র নয় মোটেই। ফেলে আসা সম্পর্কের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে, বরং সেইসমস্ত কথা যেন আমার এই একলা হয়ে পড়ার অপেক্ষাতেই বুকের ভেতর নির্মমভাবে ঘাপটি মেরে ছিল এতকাল। ক্রমান্বয়ে সেই কথাগুলোই আমাকে চাপ দিতে থাকল লেখার। গর্ভস্থ শিশু যেমন প্রসবের জন্য মায়ের পেটে চাপ দেয়, সেইরকমই অনেকটা। একটা দুটো লেখার সূত্রপাত হয় তখনই। কিন্তু কবিতা লেখা তো দূর, সমসাময়িক কবিতা পড়ার দীক্ষাও তো তখন আমার ছিল না, ফলে কাঁচা ভাষায় অনিয়ন্ত্রিত আবেগের স্রোত বয়ে যেত সেসব লেখার ভেতর দিয়ে। তখন এক বন্ধু আমায় একদিন ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা ওদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে দেখাল। ওর এক পিসিকে সেই বই উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং লাবণ্য দাশ। উপহারের পাতায় তার ‘নির্জন স্বাক্ষর’ দেখে খুবই শিহরিত হয়েছিলাম, মনে আছে। সেই আমার প্রথম, পাঠক্রমের বাইরে, জীবনানন্দ পড়ার শুরু। তার কিছুদিনের মধ্যেই ঈশ্বরের কৃপায়, আর দু’একজন বন্ধুর সাহয্যে হাতে এল ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’, ‘উৎপল কুমার বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা’(কবিতা সংগ্রহেরও অনেক আগে বেরিয়েছিল)… এইসব। ফলে জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা হলো আমার। তখন একদিন জানলাম, আমাদের পাড়ার বাপ্পা দা নাকি এই সময়কার (নয়ের দশকের) একজন উজ্জ্বল কবিতাপ্রয়াসী। পোশাকি নাম যার সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। গেলাম ওর কাছে। ও তখন একটা বিশাল উপকার করেছিল আমার। বলেছিল, হাজার বছরের বাংলা কবিতায় নিয়মনিষ্ঠ ছন্দের ভূমিকার কথা। উৎসাহ দিয়েছিল ছন্দ শেখার। সেটা ৯৫ সাল হবে। আমি ছন্দ শেখায় যত্নবান হলাম। সেসময় নয়ের দশকের এক ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল তরূণ-কবি দীপঙ্কর বাগচীর সঙ্গে আমার আলাপ। ওর কাছেও ছন্দ এবং কবিতা বিষয়ক কিছু সাহায্য তখন পেয়েছি। এর পরের দু-তিন বছর, ছন্দ শিখতে শিখতে যাকিছু লিখেছি, তার কিছুই আর পরবর্তী সময় কোথাও রাখিনি, কারণ আমি কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছিলাম-- কবিতার চেহারা আর কবিতা এক জিনিস নয়। সেটাই ছিল আমার কবিতা-জীবনের প্রথম এবং কঠিনতম পরীক্ষা। ছন্দে লিখব, কিন্তু ছন্দ লিখব না, লিখব বিশুদ্ধ কবিতা। সেই পরীক্ষা বা সাধনার প্রথম সিদ্ধাই আমার প্রথম কবিতার বই ‘ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি’। রচনাকাল ৯৮, ৯৯ । এই সময়কালেই আমি স্পষ্ট করে টের পাই, কবিতা আমি লিখি না, বরং আমাকে রচনা করে কবিতা স্বয়ং। বুকের ভেতর জমাট হয়ে থাকা কথাগুলো কেমন যেন আপনাআপনি ছন্দবদ্ধ হয়ে আমার কলমের ডগায় নেমে আসে প্ল্যানচেটের মতো। সেইসময়কার আদিতম রচনাটির অংশবিশেষ ছিল এইরকম—
‘কবিতার দোষে আমি কাপালিক হয়ে যেতে পারি। / যে দেহ শব্দের লাশে ব্যোম হয়ে ছুঁয়েছে স্তব্ধতা, / গোপন পাঁজরে আজ স্বীকার করেছি যার কথা, / আগুন যজ্ঞের নীচে পুড়ে যাওয়া সে দেহ আমারই...
...কবিতার দোষে আমি কাপালিক হয়ে যেতে পারি / অর্থাৎ কবিতা লিখে কবি হতে পারিনা কক্ষনো...
যা কিছু রচনা নয়, ততটাই লিখে রাখা চলে; / যেমন আড়াল গেঁথে, হয়তো কেউ তাকে স্পর্ধা বলে।’
এই লেখাটির সূত্র ধরেই একদিন নয়ের দশকের অন্যতম প্রধান কবি অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ এবং সেই সূত্রেই কলেজস্ট্রিট কফিহাউসের ‘গান্ধার’ পত্রিকাগোষ্ঠীর বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার সূত্রপাত। অনেকটা এইরকমই আমার কবিতা লেখা শুরুর দিনগুলো।   


প্রশ্ন ২) তুমি তো উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পছন্দ করো, এই অভ্যেসটা কী করে হলো?

উত্তর-- সুরের প্রতি অনুরাগ আমি পেয়েছি মামাবাড়ির সূত্রে। মা-মাসিদের গানের গলা ছিল বড্ড সুরেলা। যে-সমস্ত গায়ক গায়িকার গলায় ধ্রুপদী দক্ষতা বেশি, তাঁদের বিশেষ ভক্ত ছিল আমার মা-মামা-মাসিরা সবাই। তাছাড়া আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের বাড়িতেই ছিল একটা গানের স্কুল। সারা বিকেল-সন্ধে জুড়ে নানান রাগরাগিণীর তালিম চলত। আমি যে খুব মন দিয়ে শুনতাম তা নয়, কিন্তু পরবর্তী সময় দেখেছি সেইসব সুর আমার অবচেতনে কেমন অলৌকিকভাবেই সঞ্চিত হয়ে থেকে গিয়েছিল। ওই যে একলা দিনগুলোর কথা বলছিলাম, সেই সময়ই একদিন ঘুরতে ঘুরতে আমি ঢুকে পড়েছিলাম ‘দক্ষিণী সঙ্গীত সম্মেলন’-এর বার্ষিক আসরে। টালিগঞ্জে, আমার বাড়ির কাছে, সেই আসর এখনো বসে প্রতি জানুয়ারির ৮/১০ তারিখ নাগাদ। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বসছে। সেই যে একবার ঢুকে পড়লাম, তারপর থেকে গত বাইশ-তেইশ বছর যাবত আমি ঘোরতর আসক্ত হয়ে আছি ভারতীয় সঙ্গীতের অলৌকিক সৌন্দর্যময় ঐশ্বর্যে। কিছু কিছু রাগরাগিণী, উপযুক্ত পরিবেশনায় শুনে মনে হয়েছে এই সুর তো আমার বহুকালের চেনা। সেই চেনার বয়সকাল যেন বা আমার তৎকালীন বয়সের তুলনায় অনেকগুন বেশি। যেন কয়েক জন্মান্তরের ব্যবধান। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের গাওয়া দেশ রাগ শুনে, বিদুষী মালিনী রাজুরকারের জৌনপুরি শুনে, বিদুষী কিশোরী আমনকারের বাগেশ্রী শুনে এই অনুভূতি আমার বারবার হয়েছে। এসব নিয়ে বেশ কিছু কবিতাও আমি বিভিন্ন সময় লিখেছি। জন্মান্তরের আখ্যানগুলো, বৃহত্তর অর্থে সঙ্গীত শোনার আগে পর্যন্ত আমার কাছে গল্প বলেই মনে হতো, এমনকী জাতকের কাহিনীও। কিন্তু ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আমাকে জন্মান্তরের স্পষ্ট আভাস দিয়েছে। আমি জীবনে প্রথম বেনারস যাবার অন্তত ১৫/২০ বছর আগে থেকেই গভীরভাবে অনুভব করেছি যে বেনারসের সঙ্গে আমার জন্মান্তরের কোনও না কোনও যোগাযোগ আছে। সেই টান ব্যাখ্যাতীত। আমার ‘যে আরতি মণিকর্ণিকার’ বইটিতে সেই বিস্ময় আংশিকভাবে লিপিবদ্ধ।
বছর কুড়ি আগে যখন ডোভার লেন সহ অন্যান্য মিউজিক কনফারেন্স শোনা শুরু করি, টিকিট কাটারও পয়সা থাকত না। এর-তার থেকে টিকিট বা পাস জোগাড় করে কোনোক্রমে ঢুকতাম। সারারাত খিদের জ্বালায় ছটফট করতে করতেও গোগ্রাসে গানবাজনা শুনতাম, কিন্তু কিছু কিনে যে খাব, তার উপায় কোথায়? পকেট যে গড়ের মাঠ। আমার গানবাজনা শোনার দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বর্ণেন্দু সরকার তেমনই অনেক অসহায় এবং আনন্দঘন রাত্তিরে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে খাইয়েদাইয়ে। তবু সঙ্গীতের ওপর আমার আসক্তি দিন-কে-দিন বেড়েছে বৈ কমেনি। জন্ম থেকেই আমার গলায় সুর ছিল পর্যাপ্ত, মায়ের তাই ইচ্ছে ছিল গান শেখানোর, কিন্তু বাবার একার রোজগারে আর সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবুও যত দিন গেছে, আমি সঙ্গীতের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি ততই। আজ অনুভব করি, আমার লেখার পেছনেও সেই সঙ্গীত-প্রেমের ভূমিকা অপরিসীম। শব্দ বা বাক্যে প্রাণসঞ্চার করার ক্ষেত্রে সুরের ভূমিকা খুবই অলৌকিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া সঙ্গীত-প্রীতির হাত ধরেই আমি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়েছি অধ্যাত্মবাদে। অনুভব করেছি, সঙ্গীত, ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথনের শ্রেষ্ঠ এবং সূক্ষ্মতম পথ। আমরা তো গৃহী মানুষ, খাঁটি সাধু বা সাধক দেখার সুযোগ আমাদের খুবই কম, কিন্তু সঙ্গীতই আমার জীবনে সেই পরিসর, যা আমাকে শিখিয়েছে সাধক চিনতে। সাধনা বস্তুটিও ঠিক কী জিনিস আমি বুঝতে শিখেছি সেইসব সাধক শিল্পীদের দেখেই। আরো একটা ব্যাপার, আমাদের সমাজে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো রয়েছে বহুকাল যাবত, যা অবচেতনে বেশিরভাগ মানুষকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তার হাত থেকেও আমি চিরতরে মুক্তি পেয়েছি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরই কৃপায়। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত ভাস্কর বুয়া বাখলে, উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর জীবনকথা, আমাকে এই অভিশপ্ত সাম্প্রদায়িক সমাজ থেকে বহুদূরের এক জন্নতে পাকাপাকিভাবে অধিষ্ঠিত করেছে, সম্ভবত বাকি সারা জীবনের জন্য।
এখন আমার মেয়ে সেতার শিখছে, আমি চাই ওর জীবনে, ওর সমগ্র জীবনব্যাপী, সঙ্গীত যেন প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়, ক্রিয়াশীল থাকে। তাহলে আমার সঙ্গীত-প্রেম আরোই অর্থবহ হয়ে উঠবে আশা করি। আমি তো ঈশ্বর বিশ্বাসী, তাই মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো আমার মেয়ে একদিন প্রত্যক্ষ সঙ্গীতচর্চা করবে বলেই পরম রহস্যময়, করুণাময় ঈশ্বর আমাকে এত বছর ধরে পাক খাইয়েছেন এত অজস্র আসরে, মজলিশে।     


প্রশ্ন ৩) গানের কথা আর কবিতার কথার মধ্যে ফারাক করবে? করলে সেটা কী?

উত্তর— গানের কথা অনেক ক্ষেত্রে কাব্য হয়ে উঠতেই পারে, যেমন কবীর-লালন-রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবীর সুমনের বহু গান, কিন্তু তা সত্বেও গানের কথা আর কবিতার কথা সমার্থক নয় কিছুতেই। মনে রাখতে হবে, যে-গানকে সূক্ষ্মতম শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে, তা মূলত সুরপ্রধান। কথা সম্বলিত গান সেই জায়গা কোনোদিনই দাবী করতে পারে না। সেটা একটা মিথোজীবী শিল্প। একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কথা লিখতে গেলে সুরের কথা, সুর করতে গেলে কথার কথা মাথায় না রেখে উপায় থাকে না। কিন্তু কবিতা তার তুলনায় অনেক স্বাধীন। ছন্দের ছাঁচও যে কবিকে মানতেই হবে, তেমনও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সারাজীবন ছন্দে না লিখেও কেউ ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো চিরস্মরণীয় কবি হতেই পারেন। এমনকী গীতি-কবিতার ক্ষেত্রেও যে গীতলতা, সেও কিন্তু সুরের ভরসায় থাকে না। আবার দ্যাখো, গানের কথায় কখনোই ভারী শব্দের ব্যবহার বা ভাবের অতিরিক্ত বিমূর্ততা কাম্য নয়, সেক্ষেত্রেও কবিতার পক্ষে অনেকটাই স্বাধীনচেতা, স্বেচ্ছাচারী হওয়া সম্ভব।


প্রশ্ন ৪) তোমার কবিতা ভাবনায় একটা ধ্রুপদী চিন্তন লক্ষ করা যায়। এই ব্যাপারটা এল কীভাবে? মানে নয়ের দশকে যখন সশব্দ হাততালির কবিতা বাহবা পাচ্ছে, তখন তুমি সেদিকে না গিয়ে থাকলে কী করে?

উত্তর-- কবিতা লেখার অন্যতম শর্ত হিসেবে একজন কবিকে প্রথমে একজন শ্রেষ্ঠ কবিতা-পাঠক হয়ে উঠতে হয়। এই কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিগত কাব্য সংস্কার। আমি যখন বাংলা কবিতা বা বিশ্ব-কবিতার পাঠ নিতে শুরু করেছি, তখন থেকেই লক্ষ করতাম, যাঁদের যাঁদের কবিতা আমার ভালো লাগে তাঁদের মধ্যে একটা গভীর সাদৃশ্য আছে কোথাও যেন। সেই সাদৃশ্যটি হলো ওই Sense of eternity বা শাশ্বতের ধারণা। হয়তো সেসব বিভিন্ন কবির বাহ্যিক জীবনযাপন, এমনকী কবিতার ভাষা একেবারেই আলাদা। কেউ ধরো খুব শান্ত, স্থিতধী, যেমন রবীন্দ্রনাথ বা রিলকে… আবার কেউ বেদম উন্মত্ত, উড়নচণ্ডী, যেমন বোদলেয়ার বা মধুসূদন… কিন্তু এই সমস্ত কবিকেই যে একই সঙ্গে আমার প্রাণে ধরল, তার প্রধান কারণ ওই মহাজাগতিক চিরন্তনতার বোধ, যা থেকে প্রকাশ পায় বিশ্বমানবতার আবহমান চেতনা। তার পাশাপাশি লক্ষ করে দেখলাম, যে আমার প্রিয় কবিদের সকলেরই কবিতায় আছে আশ্চর্য মন্ত্রশক্তি। খুব সম্ভব ওই চিরন্তনতার বোধের সঙ্গে এই মন্ত্রশক্তির একটা ব্যাখ্যাতীত সম্পর্ক আছে। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ, রুমি-হাফিজ থেকে জিব্রান-গালিব কিংবা কীট্‌স্‌-ব্লেক থেকে ইয়েট্‌স্‌-ফ্রস্ট সকলের মধ্যেই ওই দু’টি জিনিসের আশ্চর্য সম্মেলন আমি লক্ষ করেছি অতি যত্নসহকারে। আর সেখান থেকেই আমার মধ্যে ‘ধ্রুপদী চিন্তন’-এর সূত্রপাত হয়তোবা। তারই দাবী অনুযায়ী আমি কবিতা লেখার প্রায় শুরু থেকেই ধ্রুপদী আঙ্গিকের চর্চাও সযত্নেই করেছি। আমার সামান্য সংখ্যক পাঠকমাত্রেই জানেন যে আমি সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতায় সবিশেষ অনুরক্ত। তবে প্রিয় কবিতা বাছার ক্ষেত্রে আমি ধ্রুপদী আঙ্গিকের চেয়ে ধ্রুপদী ভাবনাকেই বেশি প্রাধান্য দিই, যার জন্য ওয়াল্ট হুইটম্যানও আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম। ঠিক যেমন করে হিমেনেথের ‘Platero and I’ আমার অন্যতম প্রিয় কবিতার বই।
যেহেতু আমি কবিতার ব্যাপারে ভয়ানক সংস্কারাচ্ছন্ন, নাকউঁচু, তাই আমার সমসময়ের অধিকাংশ কবি এবং কবিতাকে আমি করুণাই করে এসেছি চিরকাল। যতই তারা হাততালি পান, যতই তারা বগল বাজান মিডিয়ায়, আমি ফিরে দেখারও প্রয়োজন বোধ করিনি। আমার খুব সৌভাগ্য যে অল্প হলেও আমার সমসময়ে আমি এমন কয়েকজন কবিবন্ধুকে পেয়েছি যারা কবিতার ব্যাপারে আমার মতোই বা আমার চেয়েও বেশি সংস্কারাচ্ছন্ন, আমার মতোই, তারাও ধ্রুপদী চিন্তনে ধারাবাহিক আস্থা রেখে আসছে। সেই সূত্রেই হয়তো কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়েছিল আমাদের, যার ফলে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে লাভ হয়েছে হয়তো সবারই। 


প্রশ্ন ৫) তোমার দশকের কবিতা নিয়ে তোমার মতামত কী?

উত্তর— অন্যান্য দশকের মতোই, নয়ের দশকের কবিতাকেও আমি স্পষ্ট দুটো ধারায় ভাগ করতে পারি। একদল গোড়া থেকেই দাদা-ধরা, প্রতিষ্ঠানমুখী, যশলোলুপ। নাচন-কোঁদন যা কিছু করেই হোক না কেন, নাম তাদের করতেই হবে। তাই তারা প্রথম থেকেই খাঁটি কবিতার ধারেকাছে ঘেঁষেনি কোনও দিন। বরং কবিতার শরীর ধার নিয়ে তারা লিখেছে সমসাময়িক বাজার অনুমোদিত চলতি-বিষয় এবং চালু-ভাষা অবলম্বনে বিচিত্র কিছু ছড়া। যেহেতু যোগ্যতার পরিবর্তে তাদের যোগাযোগ দক্ষতাই ছিল প্রধান সম্বল, তাই তেলখোর দাদাবাবুদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাই ছিল বেশি। সময় মতো তারা তার স্বীকৃতিও পেয়েছে। নয়ের দশকের প্রধান কবি হিসেবে তাদেরকেই চিনেছেন সাধারণ অভাগা মানুষ।
অথচ এই নয়ের দশকেই লেখা হয়েছে এমন কিছু কবিতার বই, যার যথাযোগ্য সংকলন হলে জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারণা অনেকটাই বদলে যেতে পারে। যেসমস্ত কবিতার বই, তুমি চাইলে, পৃথিবীর যে কোনও সেরা কবিতার বইয়ের পাশাপাশি রেখেও পড়তে পারো। সেইসমস্ত অনামজাদা কবি, নিজেদের মনের আনন্দে মগ্ন হয়েই কবিতা লিখে চলেছে এখনও। ক্ষমতাবান দাদা-বাবুরা তাদের নানান লোভ দেখিয়েও বশে আনতে পারেননি। অথচ সেই বাবুসমাজ প্রবলভাবে চেয়েছিলেন, নিজেদের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী করার খাতিরে এইসমস্ত শক্তিশালী পথের কাঁটা যেনতেন ভাবে সরিয়ে ফেলতে। তার জন্য তাঁদের উদ্যোগের কোনও অভাবও ছিল না। তারপরেও তাঁরা বিশেষ পাত্তা তো পানইনি বরং উপেক্ষিতই হয়েছেন বারবার। তাই তাঁরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে এমন কিছু বন্ধ্যা ছড়াকারকেই বসিয়েছেন, যারা হাজার বছর রাজা হয়ে বসে থাকলেও পূর্ববর্তী সম্রাটের প্রভাব লঘু হবে না একফোঁটাও। 
কিন্তু আমি বলি কী, এইসব ছকবাজি তো আজকের নতুন ব্যাপার নয়, তারপরেও জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালদের কোনোভাবেই আটকে দেওয়া গেছে কি? নয়ের দশকের অনালোচিত কবিদের মধ্যে অন্তত এমন তিনজন এখনও লেখার ভেতর আছে, যারা নিজেদের সমকালীন কাব্য-ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে একদিন। কারণ আমি যাদের কথা বলছি, তাদের লেখায় রয়েছে সেই অতিদুর্লভ Sense of eternity, যা খাঁটি কবিকে, মৃত্যুর ২০০ বছর পরেও আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। উল্টোদিকে, সমসাময়িক উত্তেজনাপ্রসূত কবিতা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফিকে হয়ে আসে আপনাআপনি।   


প্রশ্ন ৬) পরবর্তী কবিদের লেখাকে কী চোখে দেখছ?

উত্তর— নয়ের দশকের কবিতা সম্পর্কে যা বললাম, তা শুধু নয়ের দশকেরই গল্প তো নয়, সাতের দশকেও এই একই গল্প ছিল, যা আজ সময়ের ব্যবধানে খুবই প্রকটভাবে পরিস্ফুট। কিন্তু নয়ের দশকে এসে সেই গল্পের প্যাটার্ন বদলেছে। আবার এই শতাব্দীর কবিদের মধ্যেও সেই একই ট্রেন্ড আমি লক্ষ করছি। একদল নির্লজ্জভাবে তেল দিচ্ছে প্রকাশ্যে, আবার একদল এসব থেকে সচেতনভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের কবিতায় সাধনার পরিসরকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নয়ের দশকের তুলনায় এই গল্পের প্যাটার্নও আবার বদলে গেছে অনেকটা। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে আজকের এই প্যাটার্ন চেঞ্জ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল নয়ের দশকে কম্পিউটার এবং গ্লোবালাইজেশনের আবির্ভাব। কিন্তু যদি তুমি শাশ্বতের ধারণা থেকে বিষয়টা দ্যাখো, তাহলে দেখবে, খণ্ডচিত্রগুলোর বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও আসলে মূল বিষয়টা থেকে গেছে একই। যোগ্যতার তুলনায় যোগাযোগ দক্ষতার কদর যে কোনও যুগেই বেশি। অথচ কবিতার ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি তাতে বিশেষ। ক্ষতি হয়েছে পাঠকের, পাঠরুচির। পাঠক নিজের সমকাল থেকে ক্রমশই পিছিয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবির খোঁজ পাওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাচ্ছে তার আহ্লাদের আয়ুষ্কাল।


প্রশ্ন ৭) সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তোমার ভাবনার জায়গাটা ঠিক কী?

উত্তর— আমার এযাবৎ কথাবার্তা থেকে এটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে ‘সমকাল’ বিষয়টা আমার কাছে ‘চিরকাল’-কে চেনারই একটা উপকরণমাত্র। সমকালীন ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব জুড়েই যে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধের রাজনীতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, নাক্ষত্রিক উচ্চতা থেকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে এসব কোনও নতুন ঘটনাই নয়। এর মধ্যেও যা শাশ্বত, তা হচ্ছে একশ্রেণির শোষণ আর এক শ্রেণির শোষিত হওয়ার ইতিহাস, যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সভ্যতার পর সভ্যতাব্যাপী। সেই নিয়মেই মার খেতে খেতে আজও জেগে উঠছে দলিত সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায়... ধারাবাহিক আত্মহত্যার বিষাদ কাটিয়ে দীর্ঘতম মিছিল থেকে ডাক পাঠাচ্ছে কৃষকসমাজ... সমকালীন রাজনীতি আমাকে এমনই কিছু চিরকালীন বার্তা দিয়ে যায়, যা দলগত রাজনীতির ধারণা থেকে বহু দূরের ব্যাপার। সম্ভবত অন্য পৃথিবীর। 


প্রশ্ন ৮) বিশ্ব-পরিস্থিতি, মানে প্যালেস্তাইন, গাজা, এসব তোমার লেখাকে প্রভাবিত করে?

উত্তর— এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কবিতাই বরং উদ্ধৃত করতে চাই, তা থেকেই যা বোঝার বোঝা যাবে আমার ধারণা—
আতঙ্কবাদীকে লেখা চিঠি
আসুন আতঙ্কবাদী, পৃথিবীর ক্ষীণ শেষবেলায়
সিরিয়া ভারত ফ্রান্স বাংলাদেশ কিংবা কেনিয়ার
যেকোনও সূর্যাস্ত-প্রান্তে দু’মিনিট একটু বসা যাক;
লুটিয়ে ঘাসের গায়ে আগ্নেয়াস্ত্র, নিশ্চিন্তে বসুন।

দিনের ওপারে যায় দেখুন কীভাবে দিনমণি;
কীভাবে সমস্ত তেজ ত্যাগ-মন্ত্রে করে সম্বরণ;
কেননা তাকেও সরে যেতে হয়, রাতের হাতেই
সন্তানের, সভ্যতার, প্রতিপালনের ভার দিয়ে।

তিনি কি পারেন না নিজ-তেজে হতে আত্মঘাতী ছাই?
তিনি কি পারেন না রাগে অন্ধ হয়ে চির অন্ধকার
করে দিতে এ জগত?    বিশেষত এই আমাদের
লোভ হিংসা ব্যাভিচারে রক্তারক্তি সংসার যখন...

তা তো তিনি করেন না কখনও; সে কি তেজের অভাব?
বরং সৃষ্টির ধর্ম এই তার, প্রেমধর্ম, স্নেহধর্ম এই...
তেজের মহিমা শুধু সম্বরণে হয় ফলপ্রদ;
ফলস্বরূপ সেই শিশু, আপনারও কি তেজঃবীর্যে নেই?


প্রশ্ন ৯) সাম্প্রতিককালে শঙ্খবাবু আর সুমনকে নিয়ে তোমার করা মন্তব্যে প্রচুর বাদ-বিবাদ হয়। এই দুই ব্যক্তিত্ব এবং তাদের কাজ বিষয়ে তোমার মতামত ঠিক কী?

উত্তর— শঙ্খ ঘোষ, একজন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক, সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে আমার কাছে বরাবরই শ্রদ্ধেয়। ওঁর বিষয়ে শুধু দুটো কথা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়। প্রথমটি হল— শঙ্খ ঘোষের কবিতা। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ বইটিতে আমি একজন সংবেদনশীল প্রেমিকের দেখা পাই, বৃহদর্থে ব্যথা পাই আনন্দ পাই তার ছোঁয়ায়। কিন্তু তার পর থেকেই আমি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় পেতে শুরু করি সামাজ-শিক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত  একজন আচার্যকে। যিনি প্রচার করে চলেন নানান সামাজিক বার্তাসকল। সমসময়ের কাছে সাময়িক গুরুত্ব পাওয়া ছাড়া বৃহত্তর কাব্য-ইতিহাসে যাদের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই বলেই আমার মনে হয়। ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ যিনি লেখেন তিনি যদি এমন সমাজসর্বস্ব হন, তাহলে তো লোকে ওঁর সম্পর্কে আলবাত বলবে-- সামাজিক বড়ো, মূর্খ নন মোটেই। হ্যাঁ, কবিতায় মূর্খের বিস্ময়, শিশুর বিস্ময় অবশ্যম্ভাবী শর্ত বৈ কী। একমাত্র ত্রিকালদর্শী স্থিতপ্রজ্ঞ লেখক ছাড়া, কাউকেই কবিতায় অত দায়িত্ববান দাদাবাবু হলে চলে না।  দ্বিতীয়টি হলো— একজন মানুষ, যাঁর জীবনে অধ্যাত্মবাদের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই, উপরন্তু, অধ্যাত্মবাদ প্রসঙ্গে যাঁকে নানারকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও আমি প্রত্যক্ষ করেছি স্বয়ং, তিনি সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথকে ঠিক কী চোখে দেখলেন, সেটাই আমি ভেবে পাই না। অথবা রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞই বা হয়ে উঠলেন কোন ম্যাজিক, কোন মন্ত্রবলে? কেননা রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম প্রকৃতি সমাজ, সবের ভেতর দিয়েই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ। অধ্যাত্মবাদের অর্থ যে পূজা-অর্চনা-ব্রত-রোজা-নমাজেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটাতেও একটা গভীর আধ্যাত্মিক বিস্ময় আছে। এসব আড়াল করার চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথকে আদৌ বোঝা যায় কি? অথচ শঙ্খবাবু যেন সারাজীবন সেই ব্যর্থ চেষ্টাই চালিয়ে গেলেন। কিন্তু ওঁর ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘শব্দ আর সত্য’ ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ জাতীয় প্রবন্ধের বই কিংবা ধরো, ‘সকালবেলার আলো’, ‘সুপুরিবনের সারি’ জাতীয় গদ্যরচনা আমার বিশেষ প্রিয়। এমনকী প্রাবন্ধিক হিসেবে ওঁর অভিভাবকত্বও আমার কাছে খুবই প্রার্থনীয়। ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ বইটি আমার সারাজীবনের পাঠক্রমে চির অমলিন হয়ে থাকবে, এ আমার স্থির বিশ্বাস।
কবীর সুমন আমার কাছে একটা ট্র্যাজেডি। আমি সুমনের আবির্ভাব থেকেই ওঁর গানের পরম ভক্ত। ওঁর লিরিক তুলনাহীন, ওঁর বিচিত্রগামী সুরের ধারণাও আমাকে বেশ অবাক করত। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল থেকে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত, সবরকম সুরেই ওঁর গানের গতিবিধি দেখে মুগ্ধ হতাম খুবই। কিন্তু লোকটা নিজের সীমা জানেন না। জানেন না, উনি ছাড়াও নানান মানুষ এখনও এই বাংলায় জীবিত আছেন যাঁরা নিয়মিত উঁচু দরের গানবাজনার খবর রাখেন। ওঁকে, শিল্পী হিসেবে আমি তবু হয়তো শ্রদ্ধা করতে পারতাম, যদি উনি এই বুড়োবয়সে বাংলা খেয়ালের নাম করে নিজের দুর্বিনীত অযোগ্যতার বদ-ঢেঁকুরটি না তুলতেন। উনি এত জানেন, আর এটা জানেন না যে ধ্রুপদী সংগীত মঞ্চে উঠে গাইতে গেলে গুরুকৃপা চাই, দীর্ঘদিনের সাধনামগ্ন তালিম চাই। ওঁর তো এসব কিছুই নেই। গলা থেকে সুরও বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। তারপরেও যদি কোনও যশলোলুপ বামন চাঁদে হাত দিতে চায়, তার সম্পর্কে আর কীইবা বলার থাকতে পারে?
আর ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুমন সবদিক থেকেই অতি নিকৃষ্ট, অতি ধান্দাবাজ। তাই ব্যক্তি সুমন সম্পর্কে আমার কিছুই বলার ছিল না কোনও দিন, আজও নেই।


১০) তোমার এবং তোমার বন্ধুবৃত্তের কবিদের নিয়ে একধরণের কথা বাংলা কবিতা-বাজারে প্রচলিত।সেটা হল যে,তোমরা জীবনানন্দ, বিনয়ের অনুসারী এবং যখন তোমরা এক বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে যাও তখন একই সঙ্গে একই দিকে চলো। এই অভিযোগ সম্বন্ধে কি বলবে?

উত্তর— অভিযোগটি আংশিক সত্য বৈ কী। তবে সেই অংশটা এতই নগণ্য যে তা নিয়ে কখনও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ভাবিনি। নয়ের দশকের শেষের দিকে জীবনানন্দের কাব্যে নানান আবিষ্কারের আলো এসে পড়ছিল, যার ফলে তখন জীবনানন্দের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের কাছেও বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছিল। আমার ধারণা, তরুণ কবিদের ওপর অত বড় একজন কবির প্রভাব পড়াটাই সুস্থতার লক্ষণ। তাছাড়া আমরা দেখেছি গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের অধিকাংশ প্রধান কবির লেখায় জীবনানন্দ অনুসারী হবার প্রবণতা স্পষ্ট। শক্তি বিনয় উৎপল এই তিন প্রধান কবিই ভাষাগত দিক থেকে এবং আংশিকভাবে ভাবের দিক থেকেও, স্পষ্টতই জীবনানন্দ অনুসারী। আগুন থেকেই তো আগুন জ্বলে। আর বিনয়ের কবিতা বিষয়ে আমাদের বিশেষ শ্রদ্ধা তখনও ছিল, এখনও আছে। এই পর্যন্ত অভিযোগকারীদের সঙ্গে আমি একমত।
অভিযোগটির নগণ্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এইবার। যারা অভিযোগটি করেন, তারা তাদের আংশিক অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এই খবরগুলি সংগ্রহে রাখতে ভুলে গেছেন যে ‘গান্ধার’ পত্রিকা গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়, উৎপলকুমার বসুর কবিতায় গভীর ভাবে আচ্ছন্ন থেকেছে দীর্ঘকাল। আরও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে চাই এই প্রসঙ্গে। কফি হাউসের ওই আড্ডায় যোগ দেওয়ার পরেই আমি জানতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একজন বড় কবি, অবশ্যমান্য কবি। তার আগে পর্যন্ত তো আধুনিকতার ধ্বজাধারীরা আমাদের কানে অনবরত মন্ত্র দিয়ে চলতেন যে রবীন্দ্রনাথ অনাধুনিক, তার কাব্যে আধুনিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত নেই, উনি বুর্জোয়া, জমিদার বাড়ির ছেলে, ক্ষুধার্ত সর্বহারা মানুষের জীবন থেকে তাঁর জীবন দর্শন অনেক দূরবর্তী... এইসব...  সুতরাং গান্ধারের কবিগোষ্ঠী যে শুধু জীবনানন্দ দাশ বা বিনয় মজুমদারের অনুগামী ছিল তা একেবারেই নয়, তাদের চেতনায় বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের বহু শ্রেষ্ঠ কবির প্রভাবই কাজ করেছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও বলছি, কবিতা কোনও দলগত কাজ নয়। হয়তো সেকারণেই আমাদের গোষ্ঠীটিও অবলুপ্ত হয়েছে একদিন। না কোনও ঝঞ্ঝাট ঝামেলা নয়। অয়ন চক্রবর্তী ছিল তখন ওই আড্ডার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।  অয়ন ব্যস্ত হয়ে পড়ল সাংবাদিকতার কাজে। অন্যান্যরাও জীবিকার তাড়না অনুভব করল একে একে। ফলে সেই আড্ডা নিয়মিত ধরে রাখার মতো পরিস্থিতি আর রইল না। যদিও তার রেশ, একটা টেবিল ঘিরে এখনও আছে, কিন্তু তা আর আগের মতো কবিতাপ্রধান আড্ডা নয় মোটই।
দলের কথা তো গেল, এবার নিজের দু’একটা কথা বলি। আমি বাংলা কাব্যে চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ সুধীন্দ্রনাথ শক্তি বিনয় যুগান্তর পার্থপ্রতিম প্রমুখ এবং বিশ্ব কবিতায় রুমি, জিব্রান, কিটস্‌, ব্লেক, ইয়েটস্‌, হুইটম্যান, পুশকিন, বোদলেয়ার, রিলকে, পাস্তেরনাক, ফ্রস্ট, হিমেনেথ প্রমুখ কবির কবিতার অনুসারী। আমার প্রভাবিত হওয়ার ধরনটি সর্বগ্রাসী। পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ কবির দ্বারা, এমনকী অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার জন্য আমার মন সবসময়ই উদগ্রীব হয়ে থাকে।


প্রশ্ন ১১)কবিতা লিখে রাষ্ট্রের পুরস্কার বা পত্রিকা গোষ্ঠির পুরস্কার, এগুলো নিয়ে কী ভাবো?

উত্তর—পুরস্কার নিয়ে এখন আর কিছুই ভাবি না। আগে একসময় ভাবতাম, যখন মনে করতাম, কবিতায় পুরস্কার দেওয়া হয় ভালো লেখার জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত এইসব রাষ্টীয় এবং পত্রিকাগোষ্ঠীসমূহের দেওয়া পুরস্কারের সার্কাস দেখতে দেখতে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে ভালো লেখার জন্য কোনও পুরস্কারই দেওয়া হয় না আদৌ, তার পেছনে অন্য নানান সমীকরণ কাজ করে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাবান ব্যক্তির তাঁবেদারি না করে, আমাদের রাজ্যে বা দেশে, কেউ কোনও পুরস্কারই পায় বলে আমার মনে হয় না। কেউ কেউ যদি দৈবাৎ পেয়েও যায় বা যান, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম বলে ধার্য হওয়া উচিত। সুতরাং কেউ পুরস্কার পেলেও পেল, না পেলে না পেল, নিলেও নিল, না নিলে না নিল, ব্যাপারটা এইরকম। কেননা পুরস্কার ব্যাপারটা এতোই বাহ্যিক যে সেটা নিয়ে না ভাবলেও কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই।


প্রশ্ন ১২) তোমার নিজের লেখা সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়, মানে নিজের ক্ষমতা নিয়ে, সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছু ভেবেছ?

উত্তর—নিজের ক্ষমতা নিয়ে নিজে মুখে কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। কারণ আমি আগেই বলেছি, কবিতা আমি লিখিনা, বরং কবিতাই আমাকে রচনা করে স্বয়ং। আমার কাজ আধার হিসেবে নিজেকে নিমগ্ন রাখা। সেটা হতে পারে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের মাধ্যমে, আগ্রাসী কবিতা পাঠের মাধ্যমে, অন্যান্য পড়াশুনোর মাধ্যমে, ছন্দ শিক্ষার মাধ্যমে, গান শোনার মাধ্যমে, ফুটপাথে ফুটপাথে অকারণ ঘুরে ফেরার মাধ্যমে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে, নিভৃত কোনও অবকাশে আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে, আত্মবিলোপের মাধ্যমে। সেই প্রসঙ্গে আজ এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এখনও পর্যন্ত আমার কবিতাজীবনে সীমাবদ্ধতা বিপুল। জীবন যে অফুরন্ত ভাণ্ডার আমার সামনে মেলে ধরেছে এযাবৎকাল, তার খুব কম অংশই আমি সার্থক কবিতা হিসেবে ধরে রাখতে পেরেছি। আসলে কবিতার জন্য যে সমর্পণের জীবন দরকার, তা আমি গত কয়েকবছর সার্বিকভাবে যাপন করে উঠতে পারছি না। জীবিকার তাড়নাতেই জীবনের অনেকটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। লিখেওছি সেই কথা। ‘স্বপ্নে আগুনের মন্ত্র দিয়েছিলে / জ্বালানি কুড়োতেই জীবন জেরবার’। ফলে আধার হিসেবে নিজেকে সবসময় টনটনে সজাগ রাখার অবকাশ না পাওয়া, আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা এখন। আগে বহুদিন সেই যাপন করতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও পারব আশা রাখি। তখন এই বর্তমান সীমাবদ্ধতাও অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পারব, আমার ধারণা। অন্তত কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা তো করবই। দেখা যাক জীবন সেই সুযোগ আমাকে আদৌ দেয় কিনা, বা দিলেও, কবে দেয়। 

মতামত ব্যক্তিগত