শান্তি এক ধরনের চুক্তি। তাবারুক খাঁ বলল।
তাবারুক খাঁর বয়স একত্রিশ। পান খেতে ভালোবাসে। তার জামায় পানের পিক লেগে থাকে সব সময়।
যদি তুমি মনে করো শান্তি আর সহ্য হচ্ছে না, সেদিনই তুমি চুক্তিটা ভেঙে ফেলতে পারো। অশান্তিতে থাকার অন্তত দেড়শো খানা পথ তোমার সামনে খোলা।
আমি খুবই চিন্তিত মুখে তার কথা শুনছি কেননা সবে সবে আমার শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
তাবারুক খাঁ এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর পান চিবোচ্ছে। পানে সে সুরভি জর্দা খায়। নামে জর্দা, সুরভি আসলে এক ধরনের সুবাস। তাবারুক আসলে নেশা করে না। নেশা কী জিনিস সেটা বোঝার চেষ্টা করে।
আমি সেদিন একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। পান করছিলাম বলা উচিত। সে যাকগে। চা-টা বড় সুন্দর। খেতে খেতে আমার মায়ের হাতের চায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
তাবারুক বলে চলেছে।
আমার মা চিরকাল ভাবত আমি কিছু একটা অঘটন ঘটাবোই। হয় কোনো মেয়েকে নিয়ে পালাবো, হয় কাউকে রেপ করব, নয় তো তিনটে বিয়ে করবই।
তাবারুক মুচকি হাসল।
সব মেয়েঘটিত ব্যাপার—দেখতে পেলে তো? আসলে হয়েছিল কি, আমার মা একবার আমাকে হস্তমৈথুন করতে দেখে ফেলেছিল। তারপর থেকেই মা এই সব ভাবত। কিন্তু দেখো, আমার বয়স এই তিরিশ বছর সাত মাস হল, আমি কাউকে নিয়ে এখনও পালাইনি, কাউকে এখনও বলাৎকার করিনি আর বিয়ে? দেখতেই তো পাচ্ছো ভাই —তিনটে তো দূর, একজনকেও জোটাতে পারিনি।
বলেই তাবারুক পানের পিক ফেলল মেটে লাল। খানিকটা তার জামায় এসে পড়ল।
তা যা বলছিলাম, মায়ের কথা মনে উঠতেই আমার চায়ের শান্তিটা আর সহ্য হল না। দিলাম গরম চা একজনের উরুতে ঢেলে।
কপাল মন্দ হলে পরিকল্পনা কাজ করে না।
আমাকে মারধোরের বদলে সে লোক আরো সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, দাদা, আপনার হাত পুড়ে যায়নি তো?
কিছু ভালো লোকের থাকায় পৃথিবীটা একেবারে থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।
তাবারুক খাঁর মনের উপর খুব চাপ পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। তার মনটা খুব খারাপ।
পানটা থুঃ করে ফেলে দিয়ে বলল, কী আর বলি তোমাকে?
আমি সকৌতূহলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি দেখে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বলল, শান্তিতে বেশিদিন থাকতে নেই। তুমি শান্তিতে আছো মানে তোমার জীবনের স্ট্রাগল শেষ। একটা স্ট্রাগলহীন জীবন —ছি ছি ছি ছি।
তাকে দেখে মনে হল, সত্যি শান্তি একটা অশ্লীল জিনিস। শান্তিতে থাকা একটা অপরাধ।
তিন মাস। তিন মাস শান্তিতে থাকার পর ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার। এভাবে জীবন চলে না। তা করলাম কী, পাড়ার মসজিদে চাঁদা দিতাম। মাসিক দশ টাকা। ইমাম সাহেবকে খানা দিতাম মাসে একদিন। তো এক জুম্মাবারে মসজিদে ঘোষণা দিলাম যে আমি আর মসজিদে চাঁদা দেব না, মৌলানাকে খাওয়াতেও পারব না।
তাবারুক খাঁ থামল।
দেখলাম, একটা দল আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে। খুব শান্তি লাগল। এটাই তো চেয়েছিলাম। একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললাম, যে চাঁদা চাইতে যাবে তাকেই ঠ্যাঙাবো। এতে করে আরো কিছু লোক ক্ষেপে গেল। আমার যে কী আনন্দ! আরো একধাপ চড়ে গিয়ে বললাম, আমি ধর্মই মানি না, আজই আমার শেষ মসজিদে আসা। তখন আমার সমর্থনে আর একজনও রইলো না।
আর একটা সুরভি জর্দা পান কৌটো খুলে মুখে দিলো তাবারুক খাঁ।
বলল, আমাকে ঠ্যাঙাবে বলে সবাই আলাপ করতে শুরু করেছে। আমিও ভাবলাম, যাক এতদিনে একটু শান্তিমুক্ত জীবন কাটানো যাবে, কিন্তু কী আর বলি তোমাকে!
আমি বললাম, কেন, এইবার তো আপনার সুসময়।
না রে ভাই, যা ভাবা হয় তার বাইরে কিছু ঘটনা থাকে।
সবাই ঠ্যাঙাবে আমাকে, আমিও কদিন খুব অশান্তিতে থাকব, এটা ভেবেই আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি এসে হাজির হল। এ হল আজাব —যন্ত্রণা। এই শান্তি থেকে নিজেকে আর বের করতে পারলাম না।
আমাদের পাশে বসেছিলেন এক মৌলানা গোছের ভদ্রলোক। দাড়ি, জোব্বা, চোখে সুরমা। তাকে খেয়াল করিনি। তিনি নিজে থেকেই বললেন, আপনি একেবারে যথার্থ বলেছেন। শান্তি খুব ভালো জিনিস নয় আর পৃথিবীতে মন্দ মানুষের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে আসছে। সামনে ভীষণ দুর্দিন।
লোকটা কথায় কথায় 'ভীষণ' শব্দটা ব্যবহার করেন। এটা তেমন কোনো সমস্যা না।
আমি বললাম, আপনার তারিফ?
তিনি বললেন, আমি নানা অনিরাময় যোগ্য রোগের তদবির করি। আমার একটা দাওয়াখানা আছে। তাবিজ, মাদুলি, কবচ —এই হল আমার ওষুধ। বশীকরণে আমার ভীষন সুনাম আছে।
একটু থেমে বললেন, আমি আপনার অশান্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
এই শুনে তাবারুক খাঁর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, দিন তাহলে ব্যবস্থা করে।
লোকটা বললেন, তার জন্য আপনাকে আমার দাওয়াখানায় আসতে হবে। আমি রাস্তাঘাটে চিকিৎসা করি না।
এই বলে একটা ঠিকানা লেখা কার্ড ধরিয়ে দিলেন তিনি তাবারুকের হাতে।
সামনের শুক্রবার চলে আসুন, জুম্মাবার, শুভ —বলে তিনি উঠে চলে গেলেন।
শুক্রবার আমি আর তাবারুক খাঁ মৌলানা গোছের লোকটার দাওয়াখানায় হাজির হলাম। একটা শতরঞ্চি পাতা। একটা ছোট নিচু টুলের ওধারে তিনি বসে আছেন। এধারে আমরা। টুলটা সবুজ চাদরে মোড়া। ঘরের দেয়ালে আরবি নানা অক্ষর। মক্কা মদিনার ছবির ক্যালেন্ডার।
লোকটা বললেন, ৫ হাজার টাকা দিন আর এই নিন তাবিজ। গলায় পরবেন। ৫ দিনের মধ্যে আপনার জীবনে অশান্তি আসবে। গ্যারান্টি। গ্যারান্টি দিয়ে আমি কাজ করি। বিফলে মূল্য ফেরত।
৫ হাজার টাকা!
তাবারুক খাঁ ইতস্তত করছে দেখে তিনি বললেন, কাজ না হলে আমাকে পুলিশে দেবেন। এবার ঠিক আছে?
তাবারুক খাঁ পকেট থেকে দুটো ২ হাজার টাকার নোট আর ২ টো ৫০০ টাকার নোট নিয়ে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল।
—তাবিজটা কখন পরতে হবে?
—আজ রাত ঠিক পৌনে বারোটার সময় নিমপাতা দিয়ে গোসল করে দু দানা চিনি মুখে রেখে এই তাবিজ ধারণ করবেন। দেখবেন যেন শনিবার না হয়ে যায়।
আমরা তাবিজ নিয়ে লোকটাকে সালাম করে উঠে পড়লাম।
৫ দিন পর চায়ের দোকানে তাবারুকের সঙ্গে দেখা। দেখলাম সে খুব রেগে রয়েছে। বলল, আমি ঠকে গিয়েছি, পাঁচ দিন হয়ে গেল কিন্তু মনে এতটুকু অশান্তি নেই। বরং মনটা যেন বড্ড বেশি ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আমার ভীষন রাগ হচ্ছে। আমি তাবারুক খাঁ, আমাকে ঠকিয়ে চলে গেল এক মৌলানা!
এইটুকু ছাড়া আমার আর কোনো অশান্তি নেই।
আমি বললাম, তাহলে কী করবে?
সে বলল, লোকটাকে পুলিশে দেবো। কার পাল্লায় পড়েছে সে জানে না।
তার মুখ রাগে আরও লাল হয়ে গেছে।
—তাহলে চলো দাওয়াখানায়?
—নিশ্চয়ই যাবো।
দাওয়াখানায় গিয়ে দেখি ঘর বন্ধ। তালা দেওয়া। এই দেখে তাবারুকের মাথা আরও তেতে উঠল। দরজায় সজোরে সে একটা লাথি মারল। গলার তাবিজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল দূর করে।
সে কিছু একটা করে বসবে বলে মনে হল। রগ চটে উঠলে কিছু একটা করা অসম্ভব না।
তিন দিন পর আবার দাওয়াখানায় গিয়ে পাওয়া গেল লোকটাকে। তাবারুক খাঁ তো তাকে এই মারে কি সেই মারে।
তার হলুদ পাঞ্জাবি ধরে টানতে টানতে থানায় নিয়ে চলল। মাঝপথে লোকটা বলল, জল খাবো। আসলে বলা উচিত জল পান করবো। সে যাকগে, তাবারুক খাঁ বলল, এক ফোঁটা জল তোকে দেব না, আগে থানায় চল।
এত রাগতে তাবারুককে আগে দেখিনি। সে সব সময় হালকা মেজাজে থাকে। আর নানা রকম ফন্দি ফিকির মস্করা করে বেড়ায় । এ যেন অন্য লোক।
লোকটা এবার জোর করে তাবারুক খাঁকে দাঁড় করালো। তারপর বলল, কী জীবনে অশান্তি এসেছে?
—মানে?
—মানে তো ভীষণ সহজ —আমার চিকিৎসা ১০০ ভাগ সফল।
তাবারুক খাঁ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, যান আমার চোখের সামনে থেকে। আর কখনও যেন না দেখি। উফ, পৃথিবীতে ভালো মানুষ বলে আর কেউ রইলো না।
অশান্তিকে চিহ্নিত করতে পারলে শান্তি আছে, আবার শান্তিকে চিহ্নিত করতে না পারায়ও অশান্তি রয়েছে। তাবারুক খাঁ সাহেবরা বোঝে না।
জিয়া হক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe