October : a story of every season : a film review ****


'যদি মরে যাই 
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই'

বিরাট পর্দার সামনে এই লাইনগুলো আমার কানে বাজছিল বার বার। রুটিনমাফিক সাজিয়ে দিতে পারি এইভাবে যে গল্পটা অমন ছিল, ক্যামেরা ছিল ব্যাপক, সাংঘাতিক এডিটিং আর অভিনয়টাও বেশ ভালো। সকলের দেখা উচিত। খেল খতম পয়সা হজম। ব্লা ব্লা ব্লা!
কিন্তু আবেশকে তো ওভাবে বলা যায় না। ভালোবাসা বিধৃত হয়না এত সরলে। বাবার মৃত্যু পিকুকে যেখানে ছেড়ে গিয়েছিল শিউলি হয়তো সেখান থেকে শুরু করে। ঘাসের ভেজা সবুজে আনমনা পড়ে থাকা বাংলার শিউলিগুচ্ছ আলতো হাতে তুলে নেয় শিউলি নামেরই আয়তচোখের এক মেয়ে; তার মুখে তখন নরম রোদ আর চারপাশে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ইনটার্নশিপ আর নিয়ম না-মানা,একটি শুভ ছেলে ড্যান। ছাদ থেকে হাত পিছলে পড়ে যাওয়ার আগে তার শেষ বাক্যটাও ছিল ওই ড্যানকে নিয়েই। 'হোয়ারিস ড্যান?' এরপর থেকে কাহিনি আর শিউলির থাকে না, পুরোটাই হয়ে ওঠে ড্যানের। শুধু কাহিনি নয়, শিউলির মা, শিউলির ভাই-বোন, শিউলির হসপিটালের বিছানা, নার্স, কেয়ার টেকার, একটা বর্ষাকাল, ডাক্তার, ওষুধ, তর্ক, আশাবাদ এমনকি শিউলির চোখ মেলাটাও ড্যানেরই হয়ে ওঠে। নিয়ম না-মানা, পথের উল্টো পানে হাঁটতে থাকা ড্যান যেন এতদিন এমনকিছুরই অপেক্ষায় ছিল। একটা খাঁটি উদ্দেশ্য যার জন্যে রাতের পর রাত জাগা যায়, কাজে পাহাড় প্রমান ফাঁকি দেওয়া যায়, মিথ্যে বলা যায়, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা যায় হিসেবহীন টাকা তবু আশা ছাড়া যায় না যে হসপিটাল বেডে এতগুলো মাস প্রায় ভেজিটেবল হয়ে থাকা শিউলি একদিন জাগবে না। প্রকৃত পুরুষ তো এরকমই। তার শুশ্রুষা লাগে না, ভালোবাসা লাগে না, একটা চুমুও লাগে না। তার লাগে একটা ছোট্ট উদ্দেশ্য যাতে সে প্রাণপাত করলেও করতে পারে। আমরা ওই পুরুষটার কথা ভুলে যাই যে শুধু হসপিটাল আর হোটেলে তার জীবন থামিয়ে রাখতে পারে। নিজের মায়ের কথাও তার মনে পড়ে না। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা (একটি সিঙ্গেল শটও বোধহয় রিপিট হয়নি এত অনাবিল সুন্দর, নির্ভার সেই ক্যামেরা) আর শান্তনু মৈত্রের সুর-করুণা সেই বিপ্রতীপে ড্যানের সাথে আমাদেরও কনস্ট্যান্ট দাঁড় করিয়ে রাখে। তবে অপেক্ষাতেই শেষ নয়, ড্যান কোনো এক শিউলি-সম্ভাবনার সাথে শেষাবধি নিশ্চয়ই থেকে যায়। সব ড্যানদের পক্ষেই তা সম্ভব শুধু আমরা বোধহয় তাদের সেই উদ্দেশ্যটা দিতে পারি না যা রাত্রি শেষে তাদের একেকজনকে এক অজানা সুগন্ধে রূপান্তরিত করতে পারে।
ছবি সমাপ্তিতে হলের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ছাড়ছিল না, পায়ে পায়ে জড়িয়ে নামছিল বাকি লাইনগুলো,

'যে ফুলের নেই কোনো ফল 
যে ফুলের গন্ধই সম্বল 
যে গন্ধের আয়ু একদিন 
উতরোল রাত্রে বিলীন 
যে রাত্রি তোমার দখলে 
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে 
আপন সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।'...

সুজিত সরকার এরকমই।💖

একা নায়ক, বোকা নায়ক


আজ
বৃষ্টি হল বেশ
ভেঙে গেল
ঘুমকাতুরে
ভিতর প্রদেশ
কাদা হল খুব
পায়ের সঙ্গীত হয়
চপ্পলেরা চুপ—
থাকে না কোথাও
বড় ভিজে
কুকুরের ভিক্ষাপাত্র
বেজে ওঠে ব্রিজে
প্রশাসক আজ
চোখ মারে, ফেলে রাখে
টেবিলের কাজ
সেহেতু মুশকিল
মরে যায় স্বাভাবিক
বৃহৎ টেবিল
বসে শোকসভা
জড়ো হয় চুরি করা
অহেতুক জবা
যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে ওঠে
গাঁদা গাছে গাঁদা নয়
জবা যেন ফোটে
এমনই নির্দেশ
আজ
তবে
বৃষ্টি
হল
বেশ

জিয়া হক 

যেভাবে পদ্য লেখা হয়


যখন আমি কবিতা —কবিতাই লিখতে চেয়েছি
তখন হারিয়ে গেল আমার শব্দবোধ
নিজেকে লিখতে গিয়েছি যখন
তখন পেলাম শব্দের পাহাড়
সেই পাহাড়ে গুহা আছে, বনদপ্তর নেই,
বনমানুষেরা চাকরি করতে যাবে তাই
ঝর্নায় চুল ধুতে গেছে

জিয়া হক 

আমার হরিণী-কন্যা, বনপথে একা


গৃহস্থের গ্রামজীবন আমি কাটাবো অনেক
কন্যা তুলতে যাবে ফুল আর জবার খুশবাই
সে যাকে অনুমতি দেবে সে-ই তার নদীতে প্রবেশ
পুলিশেরা বাড়িতে ঘুমোবে, থানা হবে খুকির সাজঘর
অথচ সে আর সাজাবে না তার ভুরু ও পল্লব
এমনি এমনিই সে হয়ে যাবে কারোর ঘরণী
সোনালি জেওর যত পড়ে থাকবে পাঠের টেবিলে
নাকফুল সে হয়ে ফুটবে উঠোনে, একদিন
জঙ্গলে সে যাবে একা, হবে সন্ধ্যা, বাঘও আসবে সেই পথে
কিছু কিছু মতবাদ তার জানা আছে, আর
শরণাপন্ন নয় সে সহিংস সংঘের, তাই
অরণ্য ঘোরাবে বাঘ প্রদর্শক হয়ে
আমার কন্যা তাকে বিবাহেও বেঁধে আনতে পারে
আমার কন্যা পারে দত্তক নিতে ওই ব্যাঘ্রশাবক
কাটাবো জীবন আমি গেরস্তের মতোই শহরে

জিয়া হক 

কেন ও কীভাবে বেলাল চৌধুরী? ও একটি পদ্য


বেলাল চৌধুরী কৃত্তিবাসী হয়েও স্বতন্ত্র। ভারতীয়  কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বাংলাদেশি প্রতিনিধি। তবে, সীমান্তরেখাকে অস্বীকার করাই কবির কাজ। তিনি তা করেছেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই সীমান্তহীন। যদিও তাঁর 'বিচিত্র' জীবনের চর্চা যতটা হয়, যেমনটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে, ততটা তাঁর কবিতা নিয়ে হয় কি? শক্তির কবিতা নিয়ে কিন্তু কম আলোচনা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গীয় একটি তথাকথিত সাহিত্য আন্দোলনের ভাষ্যে ব্যক্তি বেলাল চৌধুরী যে মর্যাদা পান, তাঁর কবিতা কি তা পায়? অন্তত ভারতে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে?

পুনশ্চ : তাঁর একটি 'বহুল পঠিত' কবিতা দেওয়া গেল।

জিয়া হক

কীটমানুষ এবং যা যা গাভীপনা


কীটমানুষ
..............
কীটনাশক এইখানে পড়িয়াছ‌ে কম
জঙ্গলের গাছে কেউ সার মারে নাকি
বাক্য দিয়ে আমি তাকে বুঝিতে সক্ষম
শস্যদের খাদ্য হওয়া
                     এখনও যে মাসাধিক বাকি

আমি তো পচনশীল, হাটে ও বাজারে
জঙ্গলের গাছে আহা সার কেউ মারে?

পরিচর্যাহীনভাবে আমি আছি দেখো
লক্ষ রাখি
               শস্য ধান্য কণা
গতরের ঠিক দাম আজও জানিনেকো
ফলত শ্রমের ক্রেতা
                    ধন্যবাদ-
সহ আট আনা
দেয়।  আজ সূর্য উঠল খুব
মুঘল যুগের যেন সেনা
পাখা থেকে হাওয়া পড়ে —টুপ
গ্রন্থপঞ্জি
            আমাকে জানবে না


জিয়া হক 

ও ধর্ষক, হস্তমৈথুন প্র্যাকটিস করুন


প্রথমেই আমাকে বলো তুমি কী কী হারিয়ে আজ এখানে অনুচ্চকিত মুখে প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছো?

এখানে আঙুরফল মিষ্টান্ন নয়, তাই সকলেই
কমবেশি শেয়াল আর উপকথাকার। এইবার
বলো তোমার গল্প।


সেই হাভাতের গল্পটা জানেন যে বন্ধুর বদলে চেয়েছিল
নদী, অন্তত একটা শুকরভর্তি নর্দমা?

এগুলো বড় রোমান্টিক আর
ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর ও শিশুখেলা।

তাহলে সেই গল্পটা জানেন নিশ্চয়ই যেখানে
এক হাভাতে নদী নয়, আকাশ নয়,
 সবুজ নক্ষত্রের ঘাসভূমি নয়, চেয়েছিল
এক পেয়ালা ধান কেননা সে শুধু চাল চায়নি
তুঁষ আর খুঁদ তার দরকার ছিল।

এ আবার কেমন হাভাতে? তুমি কি চাও আমি
বারবার আশ্চর্য হয়ে যাই?

আপনি গল্প খুবই কম জানেন, শুধু জবা তুলেছেন
পরিচর্যা করেননি কোনো জবার।

আপনার ব্যধি কি দুরারোগ্য?

ওই যে দূরে ঢিবি দেখেন, ওটা শুধু মাটির স্তূপ নয়,
ওটা কবর, কে শুয়ে আছে জানেন ওখানে?

একটি ব্যতিক্রমী উত্তরের আশা রাখছি। বলুন।

আপনাকে হতাশ করাই আমার করণীয় আজ। তাই
ওখানে রয়েছে এক জাগ্রত কুকুরছানার দেবতা,
একদিন ভক্ত আসবে ওখানে,
থালাভর্তি হয়ে আসবে চালধান, প্রার্থনা, আঙুর।

বেশ মজার লোক আপনি।

অতীত বিক্রেতারা জ্ঞানী আর ভবিষ্যত নিয়ে যারা
কথা বলে, তারা নিজস্ব নারী নেই বলে
মৈথুনে হস্তনির্ভর। কুটির শিল্পী স্থানভেদে। আর
হাতকে গোপনাঙ্গ ভাবে

জিয়া হক 

মুরাকামি, মাই লাভ


মুরাকামি
.............
আমি। যন্ত্রণা পাচ্ছি খুব। খুবই, হ্যাঁ।
সমুদ্রতটে কাফকা পড়তে পড়তে বুঝতে
পারছি আমার অপরাধগুলো কী ও কীভাবে
আমাকে মৃত্যুর, থাক, না না হত্যার, ওহো
ভিজে যাচ্ছে মন্ডল, এই মুখমণ্ডল,
কার্পণ্য করেছি কি বিলিবন্দোবস্তে?
সামাজিক হওয়ার কৌশল শেখার বিদ্যালয়—
যেতে চাই, না, কেউ আসুন, সেকি, হ্যাঁ
এই দুপুর, বসন্তের দুপুর থেকে অনুসন্ধানী
আত্মীয়রা কী করতে আসে?
যেদিন যন্ত্রণা, যেখানে খুব, আমি
বসি আততায়ীর মতো, হয়ত এ ধর্মভাব কোনো
পূজার্চনা, নামাজের মতো আত্মহত্যারোধী
সহযোগী চাই যে বৃষ্টির দিনে
আম কুড়িয়ে দেবে, পতনেও সহমর্মী হবে,
পুকুর থেকে তুলে আনবে অজানা বৃক্ষের ছায়া
তার খালি হাতে গাছ আছে ভেবে চুম্বন করিব

জিয়া হক 

অজানা জ্বর : প্রশান্ত হালদার। একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া


অজানা জ্বর –সংক্রামক ও স্বাস্থ্যকর
জিয়া হক

অজানা জ্বর। শিল্পবস্তুর ‘নামকরণের সার্থকতা’ নামে একটি বিষয় বেশ প্রচলিত রয়েছে ‘জ্ঞান’মাধ্যমে। যদিও আলোচক যে কোনও উপায়ে ‘প্রমাণ’ করে দেন যে শিল্পবস্তুর নামটি একেবারে অকাট্য ও সর্বৈব সার্থক। শিল্পী বেঠিক নাম দিতেই পারেন না, এমন একটা ধারণার বিদ্যায়তনিক শিক্ষাপ্রকরণে চল রয়েছে। তাহলে ‘অজানা জ্বর’ সম্বন্ধে সেই আলোচক সম্প্রদায় কী বলবেন জানতে কৌতুহল হয়। তিনি কি একটি কবিতার জায়গা থেকে দেখতে চাইবেন, সমগ্র সংকলনটির ক্ষেত্র থেকে ‘বিচার’ করবেন, নাকি লেখকের অবস্থানকে ‘অজানা’ ও ‘জ্বর’ শব্দদ্বয় দিয়ে বুঝে নিতে চাইবেন? একটি প্রশ্ন সচরাচর ওঠে, কাব্যগ্রন্থের কি ‘নাম’ দেওয়া যায়? এত কবিতা, এত এত বিষয়, এত ভাবনা, এত এত কৌশল—তা একটি নাম-এর আয়ত্তাধীন থাকে কীভাবে? একটি নামের মধ্যে হয়ত সবকে, সব কিছুকে ‘ধরতে’ চাওয়াও হয় না হয়ত। যদি তাই হতো তাহলে পৃথিবীর সমস্ত শিল্পবস্তুর নাম হয়ে যেত হয়ত ‘জীবন’। জীবনের বাইরে আর কী লেখা হল এতদিন? কেবল ধরন-এর পরিবর্তন ঘটে। ‘ধরন’ মানে কি জীবনের ধরন? তা ঠিক নয়। প্রকাশনার ধরন। ধরনের সঙ্গে কার্যত মিল রয়েছে ধারণার। ‘ধারণা’ যেহেতু স্থান ও কাল ভেদে বদলায়। তবে সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে খেয়াল করা যায় যে, এই ধারণারও একটি স্থানিক ও কালিকতার বাইরে সমত্ব রয়েছে। একজন নিউ ইয়র্কারের ভাবনার সঙ্গে একজন ঢাকাই কবির চিন্তার সমত্ব থাকতেই পারে, অসম্ভব কিছু নয়, বলাই বাহুল্য। কেবল লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সমতা আছে বলে দাবী করে গার্সিয়া মার্কেজকে নিজস্ব করে নেওয়ার যে প্রচল রেওয়াজ তাকে প্রশ্ন করে কেউ বলতে পারে, একজন সুইডিশ বা ডাচ বা পর্তুগিজ কি গার্সিয়া মার্কেজকে ‘গ্রহণ’-এ বাধা পাবেন? তবে এর বাইরেও নানা অসমাধেয় ব্যাপার-আশয় রয়েছে। বলার আরও নানা পরিসর ও বহু ‘মুখ’ আছে। আন্তর্জাতিক প্রশাসক ও প্রশাসিতের রাজনীতিগত সচেতন বেখায়ালিপনা, খামখেয়াল রয়েছে—আর এখানেই হয়ত সাযুজ্যের প্রশ্নটা, সমত্বের প্রশ্নটা আসে। আসলে প্রশান্ত হালদারের ‘অজানা জ্বর’ এমন একটি কবিতার বই যা যে কোনও দেশকালের হয়ে উঠতে পারে। ‘বেঁচে থাকার পরাধীনতা কেউ কেউ/ মৃত্যুর স্বাধীনতা দিয়ে মাপতে চাইছে/ ভাবনার ভয় সরিয়ে/ স্বপ্নে ঘুমুচ্ছি... সাধারণ চিকিৎসার বিজ্ঞাপনে/ ঢেকে যাচ্ছে যাবতীয় সমস্যা’—এমন  পংক্তি কোন রাষ্ট্রে সত্য নয়? এখানে কবিতার মান, তার হয়ে ওঠা, ছন্দ, মাত্রা, অলংকার—এমন সব ‘নন্দনতাত্ত্বিক’ প্রতর্ক অপ্রয়োজনীয়। ‘ভালো’ পংক্তি আর ‘জরুরি’ পংক্তির দ্বন্দ্ব আছেই, থাকেই। তবে জরুরি বিষয়টি যদি ভালোত্বে হাজির হয়, তাহলে তা ‘স্থায়ী’ হয় কিনা, বা ‘মহাকাল’ মনে রাখে কিনা তার মীমাংসা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। মহাকালও কাঁটা বেছে খায় কিনা। মহাকালের কাব্যবোধও প্রশ্নাতীত নয় কিনা। যেমন বিনয় মজুমদার বা উৎপলকুমার বসু ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালির কাব্য-শো-অফের অংশ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিকে। কেউ বলবেন, এটাই মহাকালের বিচার। তার নির্বাচনে তো উঠে এসেছে ‘যথার্থ’ নামগুলি? এ এক সান্ত্বনা বৈ আর কী? তবে মহাকালের পদ্ধতিটি হোমিওপ্যাথেটিক। যদিও অনেকে বহিরাগত থেকে যান। উত্তম দত্তকে,নিশীথ ভড়কে, শম্ভু রক্ষিতকে, শোভন ভট্টাচার্যকে, অরূপ ঘোষকে, বিশ্বনাথ পুরকাইতকে মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হবে? এখন প্রশ্ন হল, কী দিয়ে ‘তৈরি’ হয় এই মহাকাল? কাল দিয়ে নাকি মানুষ দিয়ে? মহাকাল একটি ভাঁওতা। আমাদের জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধির অক্ষমতার দায় ঝেড়ে ফেলবার একটি ডাস্টবিন। আমরা ‘সহৃদয়’ পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। পাঠক স্ব হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ‘হৃদয়’ অধিকাংশ সময় ‘খারাপ’ থাকে। ‘স্বীকৃতি’ দেবে কে? এখন প্রশ্ন হল, স্বীকৃতির দরকারটাই বা কী? দরকার আছে। কেননা এই স্বীকৃতির সঙ্গে কোথাও জড়িয়ে আছে কালের স্বর। আর এই ‘কালিক স্বর’ বহুমাত্রিক। তবে, এর সঙ্গে শিল্পের ইউটিলিটির একটা সূক্ষ্ম যোগ রয়েছে। ‘মৃত লেখক’রাই সবচেয়ে বেশি জীবিত—এমন সব মন্তব্যের উৎসের সঙ্গেও এর যোগাযোগ রয়েছে। প্রশান্ত হালদার ভীষণভাবে জীবিত এবং তাঁর লেখা প্রণিধানযোগ্য। 


.....................................................................................
অজানা জ্বর। প্রশান্ত হালদার। প্রকাশক- ‘মুক্তাঞ্চল’। প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৭। দাম— ৪০ টাকা। 

Artisans of soap-oil etc


প্রথমেই আমাকে বলো তুমি কী কী হারিয়ে আজ এখানে অনুচ্চকিত মুখে প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছো?

এখানে আঙুরফল মিষ্টান্ন নয়, তাই সকলেই
কমবেশি শেয়াল আর উপকথাকার। এইবার
বলো তোমার গল্প।

সেই হাভাতের গল্পটা জানেন যে বন্ধুর বদলে চেয়েছিল
নদী, অন্তত একটা শুকরভর্তি নর্দমা?

এগুলো বড় রোমান্টিক আর
ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর ও শিশুখেলা।

তাহলে সেই গল্পটা জানেন নিশ্চয়ই যেখানে
এক হাভাতে নদী নয়, আকাশ নয়,
 সবুজ নক্ষত্রের ঘাসভূমি নয়, চেয়েছিল
এক পেয়ালা ধান কেননা সে শুধু চাল চায়নি
তুঁষ আর খুঁদ তার দরকার ছিল।

এ আবার কেমন হাভাতে? তুমি কি চাও আমি
বারবার আশ্চর্য হয়ে যাই?

আপনি গল্প খুবই কম জানেন, শুধু জবা তুলেছেন
পরিচর্যা করেননি কোনো জবার।

আপনার ব্যধি কি দুরারোগ্য?

ওই যে দূরে ঢিবি দেখেন, ওটা শুধু মাটির স্তূপ নয়,
ওটা কবর, কে শুয়ে আছে জানেন ওখানে?

একটি ব্যতিক্রমী উত্তরের আশা রাখছি। বলুন।

আপনাকে হতাশ করাই আমার করণীয় আজ। তাই
ওখানে রয়েছে এক জাগ্রত কুকুরছানার দেবতা,
একদিন ভক্ত আসবে ওখানে,
থালাভর্তি হয়ে আসবে চালধান, প্রার্থনা, আঙুর।

বেশ মজার লোক আপনি।

অতীত বিক্রেতারা জ্ঞানী আর ভবিষ্যত নিয়ে যারা
কথা বলে, তারা নিজস্ব নারী নেই বলে
মৈথুনে হস্তনির্ভর। কুটির শিল্পী স্থানভেদে।

জিয়া হক 

Sugar dad


কহতব্য নয় এ মদীয় যন্ত্রণা
ভালবাসা বয়ে আনে কুকুর প্রস্তাবনা
লেজ যেভাবে বক্র এবং যেভাবে লেজ ব্যথা
স্তন্যপায়ী কুকুরশিশু জানে না কে পিতা
তেমন একটা জন্তু আমার হাড়ের ভেতর জাগে
আনুষ্ঠানিক পানমশালায় কান্না কান্না লাগে
হৃদয় যাদের পাতার মতো শীতপ্রবাহে ভিজে
নিজের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধে শয্যাগত নিজে
এমন লোকই বলে, 'বাবা, কোন জায়গায় লাগা?'
অজস্র লাল জলের মধ্যে নৈর্ব্যক্তিক থাকা-
আমি কেবল নানারকম নাট্য বলতে থাকি
ভিজে মানুষ বলেই শুধু—  বুঝেছি, বাদবাকি?
খবরকাগজ পড়েন যারাই ভালো থাকতে পারে?
'মাঝিসদৃশ তুমি কেন যাবে গো দরবারে?'
নৌকো আমার সজনে কাঠের, সমুদ্রে তার যাওয়া
ছদ্ম হাওয়ার বৃদ্ধ হাওয়ার প্রাচ্যদেশী হাওয়া
অসহায়ক, পাহাড় প্রমাণ বৃষ্টিতে দেয় নুড়ি

বারুইপুরের যাত্রী তবে যাচ্ছি শিলিগুড়ি

এ কি কোনো খামখেয়ালি কুকুরপনা খেলা?

আমার বাড়ি ভাঙছে কিন্তু শান্ত আমার জেলা

জিয়া হক

কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার: প্রশ্নে কবি প্রসূন মজুমদার


১) প্রথমেই তোমার নিজস্ব কবিতা-অভিপ্রায় সম্বন্ধে জানতে চাই।মানে কবিতার কাছ থেকে তুমি কী পেতে চাও?আর কী দিতে চাও কবিতায়?

আমার কাছে, কবিতার কাছ থেকে কিছু পেতে চাওয়া এবং কবিতাকে কিছু দিতে চাওয়ার বিষয়টি এক। একটু কনফিউজিং শোনাতে পারে। ব্যাখ্যা করছি। আমি মনে করি শিল্পী, বিজ্ঞানী, ভাবুক  হলেন আধার মাত্র। লেখনীও বলা চলে। প্রকৃতি কিছু কথা বলছে। আমি সেই সব কথার লেখনী কতদূর হয়ে উঠতে পারছি, তার উপর নির্ভর করে আমি কতদূর সেই কথাকে অনুবাদ করতে পারছি। আমি কিছু লিখছি না আসলে। লিখছে বা বলছে প্রকৃতিই। আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখছি প্রকৃতির কাছ থেকে আসা সেই বার্তাটুকুর জন্য। এই নিজেকে সর্বসময়ের আধার বা লেখনী হিসেবে প্রস্তুত করে রাখার নাম হল সাধনা। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি কবি আদৌ কিছু করছেন না? লিখছেন না তিনি? কথা বলছেন না? নিজে কিছু আবিষ্কার করছেন না? ধরুন বিজ্ঞান থেকে সুরকার থেকে কবি-- কে নতুন কিছু আবিষ্কার করছে বলুন তো? প্রকৃতিতে যা আসছে, তাকেই খুঁজে বের করছে। ডিসকভারি বলা যেতে পারে, প্রায় গোয়েন্দা বা ভ্রমণকারীর মতো বা এক বিজ্ঞানীর মতোই। যিনি মহাকাশে অনুভূতি পেতে আছেন, মহাকাশের রহস্যকে সামান্য হলেও জানার জন্য, তিনিও একপ্রকার কবিতাই লিখছেন। কিন্তু তাঁর খুঁজে যাওয়াটি হচ্ছে ভিন্ন পথে। আমরা সকলেই আসলে মহাবিশ্বজীবনের স্রোতের মধ্যে অবগাহন করে চেতনাকে বা চৈতন্যকে খোঁজার চেষ্টা করছি। আর প্রকৃতিই তার বার্তা আমার কাছে / আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত পাঠাচ্ছে। এই প্রতিনিয়ত পাঠানোর মধ্যে মধ্যে প্রকৃতি বিশেষ কোনও বার্তা বিশেষ ভাবে কখনও কখনও পাঠাচ্ছে। তাকে নির্বিশেষও বলা যেতে পারে। তখন শিল্পীর কাজ হল সেই নির্বিশেষকে বিশেষে অনুবাদ করা। তার লেখনীটিকে এই প্রকৃতির নির্বিশেষ থেকে বিশেষে অনুবাদ করার সময় প্রাসঙ্গিক, বোধসম্পন্ন, সময়ের ভাষায় শাণিত করে রাখাটাই শিল্পীর কাজ। এই সময়ের মধ্যে আবার মিশে থাকে সাম্প্রতিক ছাড়িয়ে সময়চেতনার সময়। কারণ একটি লেখার মধ্যে যেমন বর্তমান থাকে, তেমন থাকে অতীত এমনকী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এই সময়কে বলা যায় আবহমান সময়। আবহমান সময়কে সমসময়ে অনুভব করার কাজটি এবং সমসময়ের মধ্যে আবহমান সময়কে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতাই একজন লেখকের। আর এই কাজটি যিনি করতে পারেন, লেখার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পান। সারাজীবনের কবিতায় এই ব্যক্তিত্বকে খুঁজে চলা এবং আত্মবিশ্বস্ত থাকাটিই এক কবির উদ্দেশ্য। ফলে, আমার চাওয়া না চাওয়ার উপর কিছু নির্ভর করে না। আসল বিষয়টি হল, নিজেকে এক যোগ্য আধার হিসেবে প্রস্তুত রাখা। নিজেকে প্রকৃতির লেখনী করে তোলা। কবি কেবল উপলক্ষ্য মাত্র। আর কিছু না। 




২) এই মুহূর্তে দেশে চলছে একধরণের সংকীর্ণ হিন্দু-মৌলবাদের রাজত্ব। এই বিষয়ে তোমার ভাবনা আর ভিসনটা যদি স্পষ্ট করো...

ভিশন আর কী হবে! দেখতে পাচ্ছি গোটা দেশটাই চলেছে ফ্যাসিবাদের পথে। এক চরম মেরুকরণ চলছে। ইতিহাস বিকৃতি চলছে। এই সংকীর্ণ হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের এক সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নামা উচিত। প্রত্যক্ষ বিরোধিতা না করলে পরে এই ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। 



৩) মৃত্যুকে তুমি তো টেবিল - দূরের সন্ধ্যার মতো দেখে এলে,তাই জানতে চাইছি মৃত্যু সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?

উপনিষদ  তো অনেক আগেই ভাবা হয়েছে অনেক কিছু। বার্গম্যান ভেবে গেছেন। দাবা খেলার মতো। অনেক ধরনের ভাবনা আছে। আলাদা ভাবে কোনও ভাবনাকে আমি সত্য বলে মনে করি না। কারণ গোটাটাই তো কল্পনা।

৪) গদ্য আর কবিতা দুই ভাষাতেই লিখেছো তুমি।দুটো মাধ্যমের আঙ্গিকগত পার্থক্য নিয়ে কী ভাবো?

এ আবার কী প্রশ্ন! গদ্য আর কবিতা আলাদা কোনও ভাষা কি? আলাদা দুটি আঙ্গিক। একটা গদ্য আর একটা কবিতা। এখানেই তো পার্থক্য। আবার কী পার্থক্য হবে!

৫) প্রাতিষ্ঠানিকতা কী কবির বা লেখকের ক্ষতি করে বলে মনে হয়?

প্রশ্নের প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে যদি বোঝায় কোনও বিশেষ বা বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে লেখার বিষয়, তাহলে বলি এসব কোনও কবি বা লেখকের ক্ষতি আদৌ করে না। কোনও লেখক যদি তাঁর ব্যক্তিত্ব, ভাবনাকে অক্ষুন্ন রেখে প্রতিষ্ঠানে লিখতে পারেন, তবে তিনি সজাগ এবং জীবিত লেখক। আর একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক যদি নিজের লেখার প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে হেরে যান, বা বিশেষ কোনও মতবাদ বা গোষ্ঠীবাদ বা বিশেষ কিছু কিছু মানুষের ভাবনা দ্বারা চালিত হন, তাহলে তিনি ঘোষিত সরব অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও মৃত লেখক। অপ্রাতিষ্ঠানিকতার অর্থ নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া। নিজেকে বারবার ভাঙা। এ যুদ্ধ প্রতিষ্ঠানে লিখেও হয়। ক্ষতিটা আসলে তখন হয়, যদি সেই লেখক নিজের আপাত সফল ইমেজের কাছে হেরে গিয়ে তাকেই বারবার রিপিট করতে থাকেন, নিজেকে আক্রমণ করেন না। আর এই সময়ে তো এই প্রাতিষ্ঠানিকতা বা অপ্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনার মানে নেই। কারণ বিষয়গুলি আর সেভাবে নেই। বরং লেখকদের ভাবা উচিত  কীভাবে নিজের কথাগুলি বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর এটি এক প্রকৃত সাবভারসিভ রাজনীতির কাজ। তথাকথিত রাজনীতির না, রাজনীতিকেও যা চালায়, তার কাজ। 



৬)রুচির শুদ্ধতায় বিশ্বাস করো?

রুচিবোধে বিশ্বাস করি, তবে শুদ্ধতা বলতে কী বোঝায়? সব ভীষণ আপেক্ষিক। তথাকথিত পুণ্যবান হওয়ার চেয়ে বরং পাপ করা ভাল। রুচি বলতে ভাবনার সততা বললে অবশ্যই তার শুদ্ধতায় বিশ্বাস করি। নির্মিত সত্যই হল রুচির অশুদ্ধতা। এই ম্যানুফ্যাকচার্ড বা ম্যানিপুলেটেড সত্যই হল বিকৃত রুচি।

৭) শহরের জীবনে বাংলা ভাষার যে বিপর্যয় সেটা নিয়ে কী ভাবছো?

দ্য চেয়ার ইজ সো ছোট দ্যাট আই হ্যাভ টু সিট হাঁটুমুড়ে। এই তো আজকের ভাষা। এই বিপর্যয় বাংলা ভাষার শহুরে বিপর্যয় ডেকে আনছে সন্দেহ নেই। তবে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের বেটন তো কলকাতা বা নগর গুলো ধরে নেই। ধরে আছে মফস্বল, গ্রাম, জেলা, বাংলাদেশ, প্রবাসী বাঙালি এবং ইন্টারনেট। ফলে একটা কাউন্টার স্ট্রাগলও চলছে। কলকাতার কিছু হবে না। এখানে বাঙালিরাও নিজেদের শ্রদ্ধা করে না আর। আশা করি অন্যত্র তা থাকবে না।

৮) ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছো?

ভাবছি, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইজরায়েলের কোনও কবি কী ভাবছে।

৯) পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভাবনা কী?

হয় বিজেপি আসবে নয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রবল হিন্দু করে ছাড়বে। এই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। তাতে তারা সফল। এখানে তাদের বিরোধীরাও রামনবমী আর হনুমানজয়ন্তী পালন করে। তারা আর হিন্দুত্বের বিরোধিতা কী করে করবে! এখানে কয়েকদিনের মধ্যে না রিয়ালিটি শো হয়-- প্রমাণ কর, কারা প্রকৃত হিন্দু! 
এক কথায় অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তবু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই চলছে আর চলবেও। কিন্তু অর্গানাইজড ফ্যাসিস্ট পলিটিক্সের বিরুদ্ধে লড়ার মতো মতাদর্শগত লড়াইটাই বা কই?

১০) সম্প্রতি একটি পত্রিকা আর তার ব্লগ ভার্সান-এর সম্পাদক তুমি।সম্পাদক হিসাবে তোমার ভাবনা যদি জানাও.

আবহমান একটি ছ মাস অন্তর মুদ্রণ পত্রিকা এবং এক মাস অন্তর ওয়েব ভার্সন পত্রিকা। আমরা চেষ্টা করছি বাংলা সাহিত্যের আবহমান যে ধারা তাকেই তুলে ধরতে। বাংলা মেন্সট্রিম সাহিত্যে গদ্যসাহিত্য- গল্প , উপন্যাস এগুলির তো খুব খারাপ অবস্থা। বলা যেতে পারে বাংলা মেনস্ট্রিমের গল্প উপন্যাস পড়লে ( আর যদি কেউ বিশ্ব সাহিত্য পড়ে থাকেন, বা বাংলার আবহমান গদ্য সাহিত্য) মনে হয় বিশ্ব সাহিত্য যদি মেসি হয়, তাহলে বাংলা সাহিত্য ষষ্ঠী দুলে। অবশ্য সমস্যা হল রোনাল্ডো, নেইমাররা নির্জনেই লিখে যাচ্ছেন। তাঁদের লেখাপত্র নিয়মিত প্রকাশ করাটিও আমাদের একটি উদ্দেশ্য। আর ঠিকঠাক সমালোচনা সাহিত্যের একটি ধারা তৈরি করাও আমাদের একটি লক্ষ্য। নতুনদের প্রাধান্যই দিচ্ছি এবং তার সাথে প্রকৃত মেজর কবি সাহিত্যিকদের লেখা তুলে ধরছি। অনেক তরুণ কবিই অনেক কিছু পড়েননি। তাঁদের দোষ না। সঠিক বইগুলি যদি এখন পাওয়া না যায় কী করা যাবে। সাহিত্য নিয়ে সিরিয়াস কাজ করাটাই লক্ষ্য। অনেকটা স্প্যানিশ গ্রানাডার মতো। দেখি, পারি কিনা।

The boy and his longing for heaven


যারা স্বর্গীয় হয়
......................
সব শান্তই ছিল। টব ছিল টবের জায়গায়। আলনা, আলমারি, জলের ডাবর, জুতোর র্্যাক ছিল যে যার জায়গায়। ছেলেটি ছিল না।
কোথায় গেল সে?
সামাজিক হতে গিয়ে সে স্বর্গীয় হয়েছে।
কেমন সে স্বর্গের যাত্রাপথ?
অজ্ঞ লৌহের আর বৈদ্যুতিন সে পথ।
তার কি এঁটেল ছিল না প্রেম?
যেখানে শস্য ভালো হয়, সেখানে ব্রোকার জন্মায়।
ইংরেজি এখানে বেশরকম ত্যাজ্য ডিয়ার।
ডিয়ার এখনও যথেষ্ট গৃহীত ও প্রিয়।
শ্যাওলা শৈবাল পথে আঙুলের পরিশ্রম হবে।
আক্রান্ত বোধ করো বৃষ্টিহীন সান্ধ্য বাতাসে?
বলিনি তো, বলেছি ধীরে চলো ঘরে।
ঘর? সে কি প্রাতিষ্ঠানিক বন?
ছেলেটি কি ঘর চেয়েছিল? শহরতলির কোনো গ্রামে?
দ্বিতীয় ভাগ বর্ণপরিচিতির, সে চেয়েছে।
সূর্যোদয় হয়নি তার সুতির থলিতে?
বর্ণ তার চন্দ্রালোক, বর্ণ তাকে অন্ধ করে দিল।
কেন তার চিকিৎসা হল না?
বিশেষ রোগের বিশেষ ডাক্তারের প্রাচুর্য এখন।
ছেলেটি কি স্বর্গে ভালো আছে?
প্রকৃতিগতভাবে ভালো কেননা সেখানে তো নেই অজ্ঞ লোহা, অনক্ষর বিদ্যুৎ আর মেধাহীন মাংসের প্রহার।
তাকে তুমি সমর্থনই করো, এ আমার জানা।
ছেলেটির মেটে বাবার চোখ দুটি ধার দিতে চাই, আর হাড়, আর গলা, আর ধুতির সুতোয় বোনা নীল লুঙ্গিখানি


জিয়া হক


A few lines and by lanes



গর্দভ এক খোকা
........................
প্রেরণাজাত শহরের যত লগি
ঠেলে আনে রোগা
সেই কালো মনোরোগী

হয় হয় রাত
ডাকে পেঁচা আর লোকে
আসে সাইকেল
বায়ুপ্রাণ এসে ঢোকে

আধা শহরের ভারবাহী সব দিক
দেখে যায় খালি
বোকা ওই মানসিক...

সান্ধ্য বিড়ির উপযোগিতার মতো
এমন লোকেরা ড্রেনে হয় নির্গত
আগুনে পোড়ে না, জলেও কি ডোবে এরা?
এদের তীরেই দেবতার ঘোরাফেরা




কীটমানুষ 
.............. 
কীটনাশক এইখানে পড়িয়াছ‌ে কম 
জঙ্গলের গাছে কেউ সার মারে নাকি 
বাক্য দিয়ে আমি তাকে বুঝিতে সক্ষম 
শস্যদের খাদ্য হওয়া 
                     এখনও যে মাসাধিক বাকি 

আমি তো পচনশীল, হাটে ও বাজারে 
জঙ্গলের গাছে আহা সার কেউ মারে? 

পরিচর্যাহীনভাবে আমি আছি দেখো 
লক্ষ রাখি 
               শস্য ধান্য কণা 
গতরের ঠিক দাম আজও জানিনেকো 
ফলত শ্রমের ক্রেতা 
                    ধন্যবাদ-
সহ আট আনা 
দেয়।  আজ সূর্য উঠল খুব 
মুঘল যুগের যেন সেনা 
পাখা থেকে হাওয়া পড়ে —টুপ 
গ্রন্থপঞ্জি 
            আমাকে জানবে না 




কুকুরভর্তি মাথা 
...................... 
ফলত এখানে জাগতিক কোনো পিঠা 
হয়নি বানানো, জানতে চাইছো মঙ্গলপদ কী তা ? 
নয়া সন্দেশ গড়ে ওঠে ভান্ডারে 
লোক নেই তাই মাছি আসে কিনিবারে 
মালিক প্রয়াত, কুকুরেরা ডাকে খুব 
গেটে তালা ঝোলে, কাঁচা পাতাদের স্তূপ 
পোড়ে না অথচ নাকে মুখে এসে লাগে 
যেদিন বৃষ্টি সেদিনের পুরোভাগে 
একটি বৃদ্ধা পাতা কুড়নোর ছলে 
বলে ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বলে 
হোটেল যেখানে, উনিশ শ দুই সালে 
বুনো ঝোপ আর শেয়ালের গোলমালে 
ভেঙে গিয়েছিল যত ছিল সেরা ফুল 
ভিজে যায় শুধু সাদা বুড়িমার চুল 
ছিল কি বিপদ, ছিল কি শান্তি এত? 
রেলগাড়ি আসে, হয়নি কি উন্নত? 
প্রাচীন লোকেরা গায় যত লোককথা 
অঞ্চলে তত নেমে পড়ে নীরবতা 
আকাশে কত না বিদ্যুৎ জন্মালো 
'এসো সখি আজ বোরখাটি খুলে ফেল।'
দেখো মোহরের ছড়াছড়ি ওই দেশে 
লোক নেই তাই মাছি বসে সন্দেশে 



জিয়া হক 


De-lit


সাহিত্য কী?
................
জনৈক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করলেন, সাহিত্য কী?
বললাম, জানি না স্যার।
আমার সামনেই বসে ছিলেন এক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বললেন, সে কি, সাহিত্যে এম এ করেও সাহিত্য কী জানো না? সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
আমি বললাম, একটা নতুন বিষয় জানলাম স্যার। অনেক ধন্যবাদ।
এরপর থেকে কেউ সাহিত্যের সংজ্ঞা জানতে চাইলে বলি, সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
কালবৈশাখী সবে শান্ত হয়েছে। বাতাবরণ ঠান্ডা। এক কবিবান্ধব জিজ্ঞেস করল একই প্রশ্ন, সাহিত্য কী?
কেন, সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
দর্পণ মানে?
দর্পণ মানে তো আয়না, তাই না?
সাহিত্য কি আয়না হয়ে সমাজকে তার শরীর দেখিয়ে দেয়?
দেয় না?
তাহলে খবরের কাগজ সাহিত্য?
উত্তর দিতে না পেরে বললাম প্রধান শিক্ষকের থেকে জেনে এসে বলব।
প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রশ্নটি শুনে বললেন, খবরের কাগজ কোনদিন সাহিত্য হতে পারে? ও তো রিপোর্ট। সাহিত্যে মনের প্রতিফলন হয়।
আমি জেনে এসে কবিবান্ধবকে বললাম। সে বলল, তাহলে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাইকায়াট্রি বিভাগের বইগুলো সাহিত্য?
আমি প্রধান শিক্ষককে বললাম এ কথা। তিনি বললেন, মন সাধারণত দুই প্রকার। এক হল ব্যক্তিমন, দুই হল সমাজমন। সাহিত্য হল ওই সমাজমনের দর্পণ।
এই শুনে কবিবান্ধব বলল, সমাজ-মনস্তত্ত্বের বইগুলো তাহলে সাহিত্য, তাই তো?
এইবার প্রধান শিক্ষক বললেন, সাহিত্য মানে সহিতত্ত্ব, মানে মিলন, মানে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনই হল সাহিত্য।
কবিবন্ধু এই শুনে বলল, তাহলে তো বিয়ের চেয়ে বড় সাহিত্য আর কিছু নেই। সেখানে তো সাহিত্য আবার গর্ভবতী হয়ে কচি কচি সাহিত্যের জন্ম দিচ্ছে, তাই না?
আমি পড়লাম আতান্তরে। সাহিত্যের সংজ্ঞা জানতে চাইলে আমি শুধু বলি, জানি না তবে আলোচনা চলছে। মীমাংসা হলে জানাব।
কয়েক মাস পর একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে প্লুটো গ্রহকে নিয়ে একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হল। আমি গল্পটি নিয়ে সেদিন সকালেই প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলাম। বললাম, স্যার, এই গল্পটিকে কি সাহিত্য বলা যাবে, এখানে তো প্লুটোর কথা বলা হয়েছে, পৃথিবীর কথা, সমাজের কথা নেই?
তিনি বললেন, কিন্তু বেরিয়েছে তো পার্থিব মস্তিষ্ক থেকে। অতএব এ সাহিত্যই। তাছাড়া প্রথম শ্রেণীর দৈনিক ছেপেছে, তা কি সাহিত্য না হয়ে পারে?
সন্ধ্যায় কবিবান্ধব সে-কথা শুনে বলল, অর্থাৎ পার্থিব মগজ থেকে যা বেরবে তা-ই সাহিত্য? মানে খুনের কৌশলও সাহিত্য, তাই তো? আর প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে যা ছাপা হয় তাই সাহিত্য? ওটা কি সাহিত্য-মিটার?
প্রধান শিক্ষক মহাশয় বললেন, তোমার বন্ধুটিকে একবার এনো তো।
কবিবন্ধু বলল, তোমার প্রধান শিক্ষককে একবার দেখতে চাই।
দুজনকেই আমার বাড়িতে এক রবিবার নিমন্ত্রণ করলাম। কথা হল, দুপুরে আমার বাড়িতে তাঁরা খাবেন আলাপ, আলোচনা হবে।
যথারীতি পরের রবিবার যতটুকু সামর্থ্য সুখাদ্যের আয়োজন করলাম। ওঁরা আসবেন। মা কে বললাম, নতুন শাড়ি পরো। আব্বাকে বললাম, নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দাও।
সাড়ে বারোটা বেজে গেল, কারও দেখা নেই। মা বলল, একবার ফোন করে দেখ না।
প্রথমে প্রধান শিক্ষককে ফোন করলাম। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। তাঁর ফোনের সুইচ অফ।
তারপর কবিবন্ধুকে কল দিলাম। তার ফোনও বন্ধ।
এরপর থেকে কেউ আমাকে সাহিত্য কী জানতে চাইলে বলি,
সাহিত্য মানে 'আপনি যে নম্বরে কল করেছেন, সেই নম্বরটি বর্তমানে সুইচ অফ আছে। ধন্যবাদ।'


জিয়া হক

I am fake, as you are


ফলত এখানে জাগতিক কোনো পিঠা
হয়নি বানানো, জানতে চাইছো মঙ্গলপদ কী তা ?
নয়া সন্দেশ গড়ে ওঠে ভান্ডারে
লোক নেই তাই মাছি আসে কিনিবারে
মালিক প্রয়াত, কুকুরেরা ডাকে খুব
গেটে তালা ঝোলে, কাঁচা পাতাদের স্তূপ
পোড়ে না অথচ নাকে মুখে এসে লাগে
যেদিন বৃষ্টি সেদিনের পুরোভাগে
একটি বৃদ্ধা পাতা কুড়নোর ছলে
বলে ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বলে
হোটেল যেখানে, উনিশ শ দুই সালে
বুনো ঝোপ আর শেয়ালের গোলমালে
ভেঙে গিয়েছিল যত ছিল সেরা ফুল
ভিজে যায় শুধু সাদা বুড়িমার চুল
ছিল কি বিপদ, ছিল কি শান্তি এত?
রেলগাড়ি আসে, হয়নি কি উন্নত?
প্রাচীন লোকেরা গায় যত লোককথা
অঞ্চলে তত নেমে পড়ে নীরবতা
আকাশে কত না বিদ্যুৎ জন্মালো
'এসো সখি আজ বোরখাটি খুলে ফেল।'
দেখো মোহরের ছড়াছড়ি ওই দেশে
লোক নেই তাই মাছি বসে সন্দেশে

Evening dreamers

সন্ধ্যাগুলি নির্জন

.................................................
দেবতারা খুবই লাজুক মিছরিভাষী
ধুতিও তাদের মাড় দিয়ে বহু কাচা
নকল গোলাপ যেখানে বাজারে বসে
তার দূর থেকে এগোয় তাদের রুমাল

ধুলোগাড়িগুলো জল দিয়ে যাবে কবে
বসন্ত কবে আনবে না গুটিপোকা
কোথায় গঞ্জে পাঠাগারে লোক যাবে
কবে সন্ন্যাস ফিরে আসে পরিবারে

দেবতা হওয়ার উপকারিতাও আছে
হাসি আর শুধু হাসি দিয়ে ঘর ভরা
দ্বিতীয়ত থাকে পাদুকা মোছার জাতি
বিপদঘন্টি তৃতীয়ত বাজবে না

বাড়ি রং করে অফিসের করণিক
বর্ষাকাল কি কৃষির জন্য আসে?
দেবতা হওয়ার সহজ উপায় হল
স্ত্রীয়ের বাধ্য কুক্কুর হয়ে থাকা


জিয়া হক 

Shree Nagar

শ্রীনগর

...........
একদা এক বৃষ্টি হল ছাদে
প্রকাশ পায়নি স্থানীয় সুসংবাদে

দুটি কাক আর তিনটি শান্ত ছানা
হারিয়েছিল
পৈতৃক আস্তানা

দুইটি কাক ও তিনটি শান্ত ছানা
হারিয়েছিল সে
পিতামহ আস্তানা

বাড়ি মালিকের হারমোনিয়াম খুব
হেসে উঠেছিল
গাঁদাচারাগুলো চুপ

দূর থেকে বোকা দেখেছিল প্রজাপতি
জল ফেলবার
নেই তার অনুমতি

আসে লোকগান, শ্রোতা এক রোগা বট
মছলিবিহীন
সূতিখাল কালো মঠ

গীতিকার বলে, 'পিচ্ছিল নদী রাধা
ছড়িয়ে ফেলো না
ভারতীয় মর্যাদা'

বিদ্যাপতির পাতা হয়ে ওঠে লাল
গুলিবৃষ্টিকে
                বাদ দাও যদি
                                     ভাল ছিল গতকাল


জিয়া হক 

An unknown tree

আমলকি বন

....................
আমলকি বন কেঁপে গিয়েছিল বিশ শতকের শুরু
ফলত সংখ্যাগুরু
গুরুবাদ থেকে নেমে এসেছিল তুষারপাতের দিনে
আহত ঘাসের, নিহত বটের হিতকর দক্ষিণে
ছিল না বার্তা অনুকূল কোনো কাগজের পরিচয়ে
কানাপূর্ণত ভয়ে
একটি পায়রা শকুনের ছায়া এড়িয়ে চলবে বলে
শিখে নেয় কিছু যন্ত্রবিদ্যা উপনিবেশের কলে—
কারখানাগুলি মালের মতোই কাঁচা ঘরে তাকে রাখে
যেখানে পেয়েছে যাকে
এরই পরেই নামগান হয়, জাগে পল্লির রাধা
রাধাবল্লভী মাছিরা বসেই করে ফেলে দুধ সাদা
কাঁপে আমলকি বন
কাঁপে কলকাতা, কাঁপে পূর্বের সদ্যজাতীয় স্তন

জিয়া হক 

Kept

কেপ্ট 

...........
বলিউড কি কেবলই বম্বে (অধুনা মুম্বই, তবে কি মলিউড হবে!)? গোটা ভারতবর্ষ একটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। ভারতবর্ষ বানান যদি 'বি' দিয়ে শুরু হয় তাহলে টলিউড, কলিউড না, বলিউডই থাকছে। পুনেতে ছবির ইন্ডাস্ট্রি হলে নাম হত পলিউড। পলিউড আর পলিউট —কী কাছাকাছি, তাই না! কেন এমন মনে হল? যদিও আমার মনের ঠিক নেই। এখন একজন বেঠিক মনের লোকের কথা কেন পড়বেন? তবে এখানে কোনও পুঙ্গবের নাম রাহুল হলেই পয়লা আলাপে কোনো তন্বীকে (সৌন্দর্য কি শুধুই রোগাত্বের বিষয়? মনে হয় না) বলবে, রাহুল —নাম তো শুনা হোগা। আপনি বলবেন, তরুণরা এমনই হয়। তাহলে একজন মাঝবয়সী গলা ও গাল ভরাট করে কেন আলোচ্য তরুণটিকেই কেন বলবে, রিস্তে মে হাম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যায়। এটা ভারি মজার। যদি ওই ভদ্রলোকের কোনো তন্বী (আবার তন্বী! স্বভাবদোষ এসব, সমাজদোষও বলা যেতে পারে) থাকে তাহলে তরুণটি তাঁকেই বলবে, বাপই তো, আপনি মাই বাপ ; আ সিমরান আ, জি লে আপনি জিন্দেগি।

আশ্চর্য লাগে। এই গল্পটিও এক সিমরানের। সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্কলার, তন্বী, ফ্যাব ইন্ডিয়ার স্লিং ব্যাগ ব্যবহার করে, রোজই নতুন লং স্কার্ট, হাতে থাকে জাঁ কেরুয়াক বা অ্যালেন গিনসবার্গ। হবে না কেন? তার বাবা রাজ্য সরকারের সচিব। কোন বিভাগের তা আজ আর মনে নেই। বাবার পদ আর পদবী মনে রাখতে গেলে যে কেউ ভাবতে পারে সিমরান নয়, আমি ভালবেসেছি তার আব্বাজানকে। সেটা সর্বৈব অসত্যি।

মাথাটা কেন খারাপ হয়ে গেল? শ্যামলশোভা বসুর চেম্বারে কে আর যেতে চায়? তাঁর পেশেন্ট মানে সমাজ তাকে মনোরোগী বা মানসিকভাবে পীড়িত বলে না, বলে পাগল। এটা খুব মুশকিলের। যে গতদিন অবধিও জানত এই সমাজের চোখে পাগলের জন্য কী কাঁটার পশমিনা পাতা রয়েছে সে শ্যামলশোভা বসুর আত্মীয় হলেও আত্মপরিচয় গোপন করবে। পশ্চিম দিকে সূর্যদয় হলে পৃথিবীর মৃত্যু আসন্ন। ধর্মগ্রন্থ বলে। কোন ধর্ম? থাক না। সিমরানের ওয়েলিংটনের ফ্ল্যাটটা কী নির্জনই না ছিল।
রিজাকে কে ভুলতে পারে? রিজা —রিজাউদ্দিন হায়দর, আমাদের পাহারাদার। রোগা, দাড়ি, পাঞ্জাবি, নকল রিস্ট ওয়াচের রিজাকে আমরা তিন বন্ধু ভুলতে পারি না। তবে এখানে একটা কথা আছে। তার রিস্ট ওয়াচই সব সময় ঠিক সময়টা দিত। অনুপম, শঙ্খশুভ্র, আর আমি। ত্রয়ী। অন্যায়টা দেখুন, রিজা কিন্তু আমাদেরই ছায়াসঙ্গী ছিল। একজন ছায়াসঙ্গীকে বন্ধু যে হবেই তা হয়ত অতি-যুক্তিবাদি মন নানা প্রমাণ সাজিয়ে নাকচ করে দেবে কিন্তু আমাদের অপরাধটা অন্য জায়গায়। ছিঃ ছিঃ। তাকে বলতাম তুই আমাদের প্রিয় বন্ধু। আসলে সে ছিল তিন অভিজাত 'সভ্য' - এর ফরমাশ খাটার মুনীষ। অনুপম প্রেমিকার সঙ্গে বাইক নিয়ে ড্রেনে পড়ে থাকলে রিজা দৌড়বে উদ্ধার করতে। শঙ্খশুভ্রের মাঝরাতে সিগারেট পান করতে ইচ্ছে জেগেছে, মিন্ট ফ্লেভার খুঁজে নিয়ে হাতে দিয়ে আসবে রিজা। সে রেসকিউ ওয়ার্ডেন কিন্তু সে স্বীকৃতি পাবে না, দাবিও করতে পারবে না। আর আমি তাকে কীভাবে ব্যবহার করেছি? ছিঃ ছিঃ।

মিষ্টি সিমরান। রাজ্য সরকারের সচিবের একমাত্র কন্যা। সেটা বড় কথা না। সে স্কলার। জে আর এফ। ভারতীয় দর্শন, বৈদান্তিক দর্শন —কী সব জটিলতার মধ্যেও মেয়েটি কেরুয়াক পড়ে। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। বিষ্ণু দে নিয়ে একদিন সাড়ে সাতশো প্রশ্ন করেছিল, মনে আছে। আমি তাকে জীবনানন্দ আর সুধীন্দ্রনাথ পড়তে অনুরোধ করেছিলাম। বুদ্ধদেব বসু নয় কেন? তুমি কাকে দেখে ভয় পাবে, আশ্চর্য হবে —বনের বাঘ না খাঁচার বাঘ? এ সব আলোচনা রিজা কিছুই বোঝে না। পারিবারিক কারণেই তার পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। ওর অশিক্ষাই ছিল, ছিঃ ছিঃ, আমাদের মূলধন।

পাহারা দিত রিজা। আমার বাড়িতে মা বাবা নিচের তলায় থাকত। বাবা ধুতি, মাড়হীন ফতুয়ার কমিউনিস্ট। মা কৃষ্ণপূজারিনী। রিজা বসে থাকবে সিঁড়িতে আর আমি সিমরানের বুকে মুখ রেখে শুয়ে থাকব আমার দোতলার পাঠকক্ষে। জ্বরো ভল্লুকের মতো সে বসে থাকত। এরপরও সিমরানের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল চোখে পড়বার মতো। যেন কেউ কোনো পাপ করছে না। অশ্লীলতা করছে না। আমাদের যৌনতা পরবর্তী জলও সে সম্ভ্রমের সঙ্গে জোগান দিয়েছে। গুরুমাকে যেভাবে প্রণাম করে শিষ্যেরা, তার চোখেও সিমরানের জন্য তেমনই একটা ফুটফুটে প্রণাম রাখা ছিল।

ব্যানানা ফ্লেভার এনে দিয়েছিল সেবার সে-ই। ওয়েলিংটনের ফ্ল্যাটে সেদিন শঙ্খশুভ্র এসেছে। সে ইংরেজি সাহিত্য একবছর পড়ে ছেড়ে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে সাত মাস ক্লাস করে এখন বাংলা সাহিত্যে ফিরতে চায়। ও খুব ইন্সটিংটিভ। ভীষণ মেধাবীও। যা ভাল লাগবে না তা সে যতই অর্থকরী হোক ও সেটা ছাড়বে। একই কারণে কেমিস্ট্রিও ছেড়েছিল। ও যে পারেনি তা ভাবলে ভুল হবে। ওর ভাল লাগেনি। একটা বিষয় হল, যে মেধাবীটি বিজ্ঞান ত্যাগ করে, সামাজিক স্নেহাকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে শুধু ভালবেসে বাংলা পড়তে আসছে সে ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিচ্ছে। এই বিষয় বদল এমন কিছু মহান ব্যাপার না। যেভাবে বিজ্ঞান শেষ কথা নয়, যেভাবে সাহিত্য শেষ কথা হতে পারে না। কিন্তু তারপরও ঔদ্ধত্য বলছি তার কারণটা ছিল সমাজ রিয়ালিটিতে। বাংলা কেন মেধাবীরা পড়বে? এ এক অপরাধ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র একটা অপভাষা। শঙ্খশুভ্রের বাবা তার হাতখরচ বন্ধ করেছে। মটন কষা আর লাচ্চা পরোটা খাইয়ে তার আত্মাকে শান্তি দেয় সিমরান। হোটেলে যাবে কে? বাড়ির গেটে রেজা যখন আছে, আমাদের চিন্তার কিছু ছিল না। হঠাৎ সিমরান ব্যানানা ফ্লেভারের কথা বলে।  ব্যবহারকারী কারা? আমি ও সিমরান। ক্রেতা কে? ক্রেতা অবশ্যই রিজা। মটন পরোটা খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে শঙ্খ। আমরা দরজা বন্ধ করি। দরজার বাইরে বসে থাকে রিজাউদ্দিন হায়দর। রিজা ।

ত্যাজ্য পুত্র একজন হয়ে যাবে। ছেলেকে ত্যাগ তো সেই বাবাও করতে চাইবে না যে-বাবা জানে তার ছেলেটি আসলে তার নয়, বৌয়ের জিম ট্রেনারের। কঠিন কাজ ত্যাগ করা। ত্যাজ্য কন্যা আরো বিরল। অমরীশ পুরি তো শেষে হাত ছেড়ে দিলেন সিমরানের। কিন্তু সেই হস্তান্তর তো সম্পূর্ণ ত্যাগ নয়। বরং কন্যার চরিত্রের যে শেডসগুলি তিনি অনবহিত ছিলেন তা গ্রহণ করা। অনুপমকে আমার বাবা একদিন বাড়িতে ডেকে কমিউনিস্টদের কায়দায় তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করল। অনুপম যে ততদিনে রাসেল পড়েছে তা তিনি জানেন না। সে তর্কের পদ্ধতি জানে, কী গোপনীয়, কতটুকু প্রকাশযোগ্য তা তার জানা। সে প্রেম আর বন্ধুত্বের সংজ্ঞা জানতে চায়। ঠিক কোথায় গেলে একটা বন্ধু প্রেমিক হয়ে যাবে? বিছানায়? না, সে বিছানার কথা বলেনি। সে তো জেনে গেছে প্রতিপক্ষকে দিয়ে কীভাবে বলিয়ে নিতে হয়, চুপ করিয়ে দিতে হয়। আমার বাবা তাকে সেন্টিমেন্টাল জায়গায় এনে ফেলে। কিন্তু রাসেলের ছাত্রের কাছে সেন্টিমেন্টের মূল্য জিরো। বাবা আক্রমণের পথ নেয়, জানি না মেয়েটাকে নিয়ে তনুময় দরজা বন্ধ করে দেয়? আসলে এই জেরাটা রিজাকে করা দরকার ছিল, বাবা বোঝেনি। যেখানেই যাই সেক্সম্যানিয়াক মেয়েদের চক্রে পড়ে যাই বলে সারা পশ্চিমবঙ্গে বাবা আমাকে নিয়ে চাকরিতে বদলি নিয়েছে। সেক্সম্যানিয়াক শব্দটি বাবাই উচ্চারণ করেছে। সেটা আমাদের ভোকাবিউলারিতে রসশব্দ হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু অনুপম সমস্ত জেরা জরিমানার অনেক ঊর্ধ্বে। যে ছেলে নিজের ধর্ম মায়ের মেয়েকে বুদ্ধগয়া যাওয়ার পথে মোটর গাড়িতে চুমু খায় সেই ধ্যানতাপসের থেকে তথ্য জোগাড় করা লেনিনেরও ক্ষমতার বাইরে। ধর্ম বোনের সে কী কান্না! ধর্মভাইয়ের চুমু? ছি ছি, এ তো ব্লাসফেমি। তোকে বিয়ে করব, বিয়ে করব, কাঁদিস না, অনুপম ধর্মবোনের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। বিখ্যাত বা বি সি এস অফিসার না হলে ধর্মবোন বিয়ে করবে না —শর্ত। ডব্লিউ বি সি এস-এর জন্য তখন পড়াই তার প্রেম নিবেদন। শুধু আর্জেন্টিনার রাজধানীটা গুলিয়ে যায়। মারাদোনাকে ঘৃণা করতে শুরু করে ব্রাসিলিয়াতে যোগ দেওয়া অনুপম বিখ্যাত 'বড়' মানুষদের আত্মজীবনী পড়ে ধর্মবোনের অজ্ঞাতে। আমার বাবা তাকে শ্রেণিশত্রু ভাববে কিনা ঠিক করতে পারে না।

২০ কোটি টাকার মালকিন। অবাস্তব শোনালেও এটাই সত্যি। সিমরান তখনই কুড়ি কোটির মালকিন। ওয়েলিংটনের মোড়ে তাদের তিন তলা বাড়ির দামই তো কয়েক কোটি। হিসাবরক্ষকের জাতি বাকি হিসেব নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে। প্রেম তার কাছে খানিকটা কেয়ার টেকার নির্বাচনের মতো, যে আগলাতে জানবে, অকর্মা হলেই ভাল। এখানেই এত কাজ। আমি একা না, সে বহু দোকানে পুরুষ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পরে বুঝেছি। সে কারো পোষ্য নয়, সে-ই পুষবে। প্রেম তার কাছে কতখানি 'প্রেম', তা নিয়ে সন্দেহ হবে যে কোনো 'এলিটিস্ট' মধ্যবিত্তের। আমাদের প্রেমটা ধীরে ধীরে দরজা খোলা আর দরজা বন্ধ করার মধ্যে ঢুকে পড়ছিল। ফ্লেভারড প্লাস্টিক কিছু মাঝখানে। সলমন রুশদি পড়ছে সিমরান। তার বৈদান্তিক দর্শনের আচার্যদের নাম জানি না। বিষয়টি খুব সহজ। তাকে বোদলেয়র সাজেস্ট করলে বইপাড়া থেকে কেনে কিন্তু সে কখনও দর্শনের কোনো বইয়ের পরামর্শ দেয় না। ছিটকিনিটা ভেঙেই গেল।

আমাদের ব্রেক আপ হল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কৃতি ছাত্র, আমলার পুত্রদের সঙ্গে তাকে দেখা যেতে লাগল। ব্রেক আপের পর আলিয়াকে পেলাম। কার্ভি, মধ্যমেধাবী, শাড়ির আলিয়া। কুমার শানুর ভক্ত। তার পদবী দাস চক্রবর্তী। নানা রকমের খোঁপা বাঁধা জানত। একদিন কুঞ্জবন পার্কের গেটে সিমরানের সঙ্গে দেখা। তার পাশে নাদুসনুদুস এক ছেলে। চোখে চশমা। সফটওয়্যারের লোক বলেই মনে হবে। বুট ভীষণ চকচকে। এত চকচকে যে প্রণাম করতে হলে হাত ধুতে হয়। আলিয়া 'গাওয়া হ্যা, চান্দ তারে গাওয়া হ্যা' গুনগুন করছে, নিশ্চয়ই আমার কোনো কথায় এমন কিছু ইঙ্গিত পেয়েছে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী, তবে সে বড়ই 'অন্তর্নিহিত অর্থ' খোঁজে সব কথায়। সিমরান তাকালোও না। সে হয়ত আমাদের গ্রুপের যাবতীয় স্মৃতি ময়লার স্তূপে ফেলে দিয়েছে ততদিনে। ঘাস একটা তুলতে নেই, ঝাড় তুলতে হয়।

বিয়ে করছে সিমরান। ন'মাস পরের কথা এটা। হঠাৎ খবর পেলাম। আমরা তিন বন্ধু খুবই আশ্চর্য হয়েছি। যদিও তিনজন নয়, আশ্চর্য হয়েছি দু জন কেননা তথ্যটি এনেছে অনুপম। সে বড্ড চুপ। কিন্তু বিয়ে? সিমরান? কাকে? কোনো কোটিপতির বাচ্চাকে নিশ্চয়ই। তবে সে তো কারো পোষ্য হবে না, পোষ মানাবে। কেন একজন ধনীপুঙ্গব তাহলে ওই তন্বীকে বিয়ে করবে কেননা সেও হতেই পারে তার সমমনস্ক। ফিট করবে কেন সে, ফিট সে করাবে তো বরং। অনুপম চুপ।
শঙ্খ বাংলা সাহিত্য নিয়ে ইতিমধ্যেই যাদবপুরে ভর্তি হয়ে গেছে। কবিতার একটা ছোট পত্রিকা প্রকাশ করতে চায়। তার দাবি একটাই, কৃত্তিবাস, হাংরি-শ্রুতি আন্দোলনকে ডুবিয়ে দিতে হবে। সিগারেট ধরেছে কয়েক মাস। চারমিনার ধরিয়ে 'যার জন্যে শ্যামল বসুর কাছে যেতে হল তনুময়কে, তাকে ছাড়া অন্য একজনকে বিয়ে করছে জঘন্যটা!' বলে সে থুতু ফেলে, 'দার্শনিক স্লাট, শালী।  কোন জন্তুকে বিয়ে করছে রে? '। শঙ্খ ভীষণ উত্তেজিত।
'কাকে বিয়ে করছে সে? কাকে?'
কে সে?
অনুপম শান্তভাবে বলল, রিজাকে। তুষারপাতের মতো খবরপাত হল।

বোঝা যায়। বলিউডে ক্রিস্টোফার নোলান নেই। কী হবে শেষে বোঝাই যায়। এখানে টুইস্টের বড় অভাব। তারপরও গোটা ভারতবর্ষ তার রক্ষিতা। হলের একদম পেছনের সিটগুলো আমার পছন্দের। পাশের সিটে ফাঁকা থাকলে আরও ভাল লাগে। আমি নীল অন্ধকারে দর্শকদের দেখতেও ভালবাসি। তারাও বড়তর সিনেমার অংশ। কিন্তু কেন সিনেমা চলাকালীন একজন পাহারাদার বাইরে বসে থাকে? লাইট ম্যানদের মুখে কখনও হাসি দেখিনি। পাহারাদার কি এই কারণে থাকে যে কেউ যেন দর্শকদের মগ্নতার সুযোগ নিতে না পারে? খুব কমই শুনেছি যে পাহারাদারই হয়ে উঠেছে হলের মালিক। অস্বীকার করব না, সিনেমা বিষয়ে আমি খুবই কম জানি।



নমস্কার
জিয়া হক

Wordly God

মুহূর্তের অনিবার্যতা

..........................
শব্দ তাঁর অধীন। ধ্বনি, বর্ণ, বাক্য তাঁর দাস। অনুপ্রাস, যমক, সমাসোক্তি, বক্রোক্তি তাঁর। তাহলে কবিতা কে 'রচনা' করেন? কবি নাকি তিনি? তিনি তো সর্বজ্ঞ, অদ্বৈত, ভাবনাতীত — তাঁর রচনা-নির্মাণ কেমনতর? আদিতম ও শেষতম পদকর্তা কি তিনিই? তাহলে মানুষ যা 'গড়ে', তা কী? সবই কি প্রতিফলন মাত্র? মূলের অনুকরণ? মৌলিকতা শব্দটিই কি ততটাও 'মৌলিক' নয়? সকলেই যে মৌল বস্তু যা কিনা সার তার সন্ধান করে নিয়মিত। তাহলে এ সবই অনর্থক? শ্রম কি পন্ড এইখানে? নিরীশ্বরবাদীরা বলবেন, এ সবই অজ্ঞানতা, ভীতিজনিত আনুগত্যের প্রচারণা, শক্তির চিরকেলে সাধনার যুক্তি, পলায়নপর নির্বিঘ্নতার চর্চা। প্রমাণ কই, তথ্য কোথায়, দৃশ্যমান কি কিছু আছে? শুধু বিশ্বাসের কী মূল্য আছে? 'বিশ্বাস' ততক্ষণ নিরপরাধ যতক্ষণ তা 'অপর'কে আহত না করে। কারও বিশ্বাস, এখানেই বিশেষ মসজিদটি ছিল। অতএব যা সাম্প্রতিকের নির্মাণ, 'বাস্তবতা' তা অপসারণযোগ্য। এই বিশ্বাসের অাড়ালের বাস্তবতার দিকে দেখা দরকার জরুরি অবস্থায়। কোন যুক্তি, কাদের যুক্তি, কেমন যুক্তি ক্রিয়াশীল আছে নিহিত বৈঠকে। এই বিশ্বাস কি অনায়াস নাকি ম্যানুফ্যাকচারড। এই বিশ্বাসে ভক্তি নেই, আছে হিংসা। সমষ্টির কল্যাণকামনা থাকে এমন বিশ্বাসে? শিবরাম চক্রবর্তীর 'দেবতার জন্ম' ছোটগল্পটি স্মর্তব্য এ প্রসঙ্গে। কীভাবে গড়ে ওঠে একটি 'বিশ্বাস' চাঁই তা শিব্রামীয় শৈলীতে জানা গেছে। যে পাথরখন্ড গল্পকথককে আহত করত রোজ, সেই পাথরই হয়ে উঠল শিবের অংশ এবং ফলত তার নিমিত্তে মানুষ বানিয়ে তুলল মন্দির। 'সবার' বিশ্বাস যে পাথরের চাঁইটির গতায়াত পাতাল অবধি যার কিয়দংশ মানবকল্যাণে উপরিতলে জেগে রয়েছে। এ অপার্থিব, এ দৈব। নিরীশ্বরবাদী গল্পকথকও শেষাবধি রোগ-মৃত্যুভয়ে প্রণাম করে বসে পারিপার্শ্ব খেয়াল করেন। কেন তাকে পারিপার্শ্ব দেখতে হয়? এখানেও সেই মধ্যবিত্তীয় ভাবমূর্তি সচেতনতার আদুল বিজ্ঞাপন। তবে প্রশ্নটি অন্যত্র। ভাবছি, যে-লোকটি অ-গোচরে একটি নিরীহ পাথরকে পুঁতে তার উপর দেবত্ব আরোপ করে এমন খুঁতবিহীন 'নাটক'-এর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন, তাঁর 'বিশ্বাস'-এর জায়গাটা ঠিক কেমন? শিবরাম চক্রবর্তী সেই লোকটির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেননি। কেননা তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য 'আম' জনতা। গল্পকথক এই ভিড়-এরই প্রতিনিধি। আমাদের ভাবনা হল, তাঁকে বিশ্বাস করার জন্য যেমন কেউ যুক্তির সন্ধান করে, বিপরীতে তাঁকে অবিশ্বাস করবার জন্যও কেউ খোঁজে যুক্তিপ্রমাণাদি। দুজনেই সময় হন্তারক। কী সাবলীলায় তারা অনর্থের চর্চা করে। বিবেক ও অনুভব যদি বলে তিনি আছেন, তো তিনি নিশ্চয়ই আছেন। এরা যদি বলে নেই, তাহলে তিনি আপনার কাছে, আপনার জন্য নেই। আপনি এবার যখন রচনা করছেন কবিতা তখন কবিতার উপাদানগুলি আপনার স্বোপার্জিত। ভাষাবিশ্ব থেকে চয়ন করে এনেছেন যা অমোঘ ও অনিবার্য। ইশ্বরবাদী কবিতালেখকের ক্ষেত্রেও তাই। তিনি শুধু বলবেন, আমি কেবল দানা রুয়েছি মাত্র, প্রাণ দিয়েছেন তিনি। সেই তিনি।
কেউ বলেন, আমি শব্দের সন্ধানে বের হই। কেউ বলেন, আমার কাছে শব্দ আসে। বিষয়টি বেশ জটিল, যেমন জটাধারী ওই প্রক্রিয়াটি। শব্দ কি কোনও গাছ, বাজার, দোকান যে তার কাছে যেতে হয়? শব্দ কি বৃষ্টি, হাওয়া, আওয়াজ যে এসে যাবে? মস্তিষ্কের ডিভাইসে শব্দভান্ডার তো রয়েইছে। তা শুধু একটু উস্কানির অপেক্ষায় থাকে। এই 'উস্কানি'টি কারও বাইরে থেকে আসে, কারও ভেতর থেকে। যদিও এই কথাও সম্পূর্ণ সত্য নয়। 'বাহির'-এর যে উদ্দীপনা প্র-তাড়িত করে কবিতালেখককে, তা কি আর বাইরের থাকে? সে তো হয়ে ওঠে অন্তর্গত। আভ্যন্তরীণ। একটি কবিতা তাই বাইরে-ভেতরে দু জায়গায়  'পড়ে' থাকে। তাদের দেখা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি কবিতার মুহূর্ত।


নমস্কার
জিয়া হক 

Little laureate and

ছোট লোক, বড় লোক

................................
—তিনি শিশু সাহিত্যিক।
— তিনি শিশু? নাকি সাহিত্যিক?
— তিনি সাহিত্যিক। তবে শুধু শিশুদের জন্য লেখেন।
— শিশু মানে কত বছরের?
— যারা সদ্য পড়তে শিখেছে তারাই মূলত তাঁর পাঠক।
— ও মানে তিনি বর্ণপরিচয় ধরনের বই লেখেন, তাই তো?
— না, তা কেন হবে। আসলে আমার বলতে একটু ভুল হয়েছে। তিনি ছোটদের জন্য লেখেন।
— ছোট আর শিশুর মধ্যে পার্থক্য কী?
— শিশু মানে যারা স্তন্যপায়ী আর ছোট মানে যারা মানসিকভাবে এখনও পাকাপোক্ত নয়।
— অনেক বড় লোক তো ওই যে বললেন 'মানসিকভাবে' এখনও 'পাকাপোক্ত' নয়, তারা কি এর আওতাভুক্ত?
— বড় লোকেদের 'ছোট' হয়ে থাকাটা সমস্যা কিন্তু যারা শিশু তাদের ছোট হয়ে থাকাটা সমস্যা না।
— কিন্তু যে ছোটরা বেশ 'বড়', মানে যাকে আপনারা ইচড়ে পোক্ত বলেন আর কি, তারা কি ওই লেখকের পাঠক? আর 'পাকা' বলতে আপনি কতটা কম 'কাঁচা' বোঝাচ্ছেন?
— পাকা মানে যারা প্রেম, যৌনতা, রাষ্ট্র, কমিউনিজম, কিউবিজম বোঝে। আর কাঁচা বলতে যারা ক্ষিদে, কান্না, হিসি, বেড়ু, কোল বোঝে।
— কমিউনিজম, কিউবিজম তো আমিই বুঝি না, তাহলে আমি কি শিশু শ্রেণিভুক্ত? আর কাঁচা বলতে যা যা বললেন তা ছাড়া আমি অন্য সব বিষয় অল্পই বুঝি, তাহলে আমি কি কাঁচা?
— না না, একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। আপনি সেটা পেরিয়ে গেছেন।
— বয়সসীমা কত ধার্য হয়েছে? কোন সংগঠন ধার্য করল?
— সেভাবে সাল তারিখের বয়সসীমা নেই তবে যারা নিজে হাতে ভাত মেখে খেতে পারে তারা আর শিশু নয়।
— আমার এক কাকার ডান হাত অকেজো। তাঁকে এখনও ভাত মেখে দিতে হয়। তিনি কি শিশু হতে পারবেন?
— তা কেন হবে। রোগশোক অন্য জিনিস। এ তো ব্যতিক্রম। তবে তিনি যদি জড় প্রকৃতির হন তাহলে অন্য কথা।
— প্রকৃতি তো জড়ই।
— আমি সে জড়র কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি, মানসিকভাবে পোক্ত যদি না হন।
— তিনি মানসিকভাবে খুবই দুর্বল। সামান্যতেই ভেঙে পড়েন।
— না না আমি ও ভেঙে পড়ার কথা বলছি না। মানসিক প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে চাইছি।
— হ্যাঁ, তার মনে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। তিনি ভীষণ কৃপণ। মনকে প্রতি মুহূর্তে বন্ধ করে রাখেন।
— না, এ লোক শিশু নন। শিশু মানে ধরো যে চাঁদকে একটা দূরের বাল্ব মনে করবে।
— চাঁদকে যদি ঝলসানো রুটি মনে করে তাহলে হবে না?
— না।
— কিন্তু শিশুদের তো এই লেখা পড়তে হয় অনেক সময়। তাহলে তারা কি অনধিকার প্রবেশকারী?
— দেখুন, শিশু সাহিত্যিক হতে গেলে 'বাড়ি'র সঙ্গে 'গাড়ি'র মিল দিতে হবে।
—'আড়ি' বা 'হাঁড়ি' দিলে হবে না?
— হ্যাঁ, তাও হবে।
— কী দেওয়া যাবে না?
— বাড়ির সঙ্গে তরবারি বা নরনারীর মিল চলবে না।
— আপনারা কি কোনও তালিকা প্রকাশ করেছেন? এমন একটা মহাগ্রন্থ হাতের কাছে থাকলে বড় সুবিধে হয়।
— ঠিক বলেছেন। শিশুদের জন্য লেখা ভীষণরকম কঠিন একটা কাজ।
— গাড়ি-বাড়ি মেলানো ভীষণরকম কঠিন কাজ বলছেন?
— আপনি অস্বীকার করছেন মানেই তো শিশুদের কাগজে আপনার লেখা বন্ধ হয়ে গেল। আচ্ছা যাইহোক, পিসির সঙ্গে কী মিল দেবেন বলুন তো?
— সহজ তো — হিসি।
— হল না। ছোটদের আপনি অপভাষা শেখাতে পারেন না। তারা ছোট বলে তাদেরকে ছোট করবেন না।
— তাহলে কী মিলবে বলে দিন।
— সব বলে দেব। তার আগে বলুন, পাখির সঙ্গে কার মিল দেবেন?
— কেন ডাকি, রাখি, চাখি, কাকি, বাকি, মাখি, দেখি, ফাঁকি, নাকি, লাখ-ই, কত হয়।
— কিন্ত আপনি 'খি'র সঙ্গে 'কি'  মেলাচ্ছেন। শিশুরা কি বুঝবে এত জটিলতা?
— তাহলে কী মিলবে?
— সেটা শিশু সাহিত্যিককে সাধনার মাধ্যমে বের করতে হবে।
— সাধনা?
— কী ভেবেছেন আপনি, এতই সহজ সব? কা-এ কা মেলানো, গা-এ গা মেলানো, পা-এ পা মেলানো — অনেক সাধনা করতে হয়।
— ওই শিশু সাহিত্যিক কি একজন সাধক?
— সে কি আর প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে?
— তিনি নিশ্চয়ই শিশুদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়?
— জনপ্রিয় বলবেন না, বলুন শিশুপ্রিয়। জন বললেই বড় লোক বোঝায়। এগুলো বুঝতে হবে।
— কিন্তু আমার পরিবারে সব মিলিয়ে প্রায় ৭জন শিশু আছে।  কই তাদের তো কখনও তাঁর নাম করতে শুনিনি।
— আপনি শিশুদের ভাষা বোঝেন? শিশুদের ভাষা আর পাখিদের ভাষা এক। বোঝা যায় না।
— তাহলে তিনি নিশ্চয়ই পাখিমহলেও খুব জনপ্রিয়?
— আবার ভুল করছেন। পাখিরা জন হবে কী করে?
— হ্যাঁ ঠিক, পাখিপ্রিয়।
— এই তো, এই তো... এবার ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারছেন।
— কিন্তু, শিশু সাহিত্যসভায় শিশুদের দেখতে পাই না কেন?  একজন শিশু অনেকজন শিশুর জন্য একটা শিশুকবিতা লিখে পাঠ করছে —এটা কি আরও ভাল না? আমি তো শিশু সাহিত্য উৎসবেও বুড়োদেরই দেখি।
— আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন।
— কী কথা?
— শেক্সপিয়রের সেই বাণী, মনে করে দেখুন।
— কী সেই বাণী?
— আরে আপনি তো দেখছি কিছুই জানেন না। শেক্সপিয়র বলেছিলেন, বার্ধক্য হল দ্বিতীয় শৈশব।
— তাতে কী প্রমাণ হল?
— শিশু সাহিত্যসভায়, শিশু সাহিত্য উৎসবে তাই বুড়োদের ভিড়।


জিয়া হক

MD Rafi and sons

রফি মহম্মদ

...............
মানুষখেকোদের উচ্চাঙ্গ গান শোনো এই ভোরবেলা
এই ভোরবেলা পোকারাও থাকে অসন্তোষে কেননা
শুরু হল পাখিদের জাগার কৌতুক
মহম্মদ রফির গান কে বাজায় ঐ? সে কি জানে
গায়কের মজহব্ কত চিন্তাশীল করে জনান্তিকে?

আচার শুকোনো রোদ এসে পড়েছে জগতে
কীর্তনীয়া যা গায় তা কি ধর্মগত প্রাণ?
সেখানে নেই ওম প্রীতি,
                      ফাতিহার ভিন্ন ব্যাখ্যাকারী?
আজ বড় সুসময় হায়দার কেননা
ঘুমনোর আগেভাগে কুকুরেরই চিন্তা শোনা যায়
তাদের রাত্রিগুলি হাড়ের স্বপ্ন দেখে কাটে
উৎসবে তারা নেই, অস্ত্রও কেনে না দিবাশেষে
   শুধু জানি, চুম্বন পেতে হলে
কামিজ দোকানে গিয়ে
              ভাগ্যখানি গুনে দেখতে পারো


জিয়া হক

Kafaan

কাফনকরুণা

এত সৎ ঋতু আমি আগে আর কখনও দেখিনি
আমাকে হত্যা করে সৎ শীতকাল ;
এ বিষয়ে সে এক করুণাময় নয়।
'করুণা করুণা' করে কে ডাকে এই ব্যর্থ বর্ষায়
এই নামে এ অঞ্চলে আর কি কেউ থাকে?
শুধু চা নয়,  বাতাসা ও জল দেয় যে —সে-ই করুণা
চা, জল, বাতাসাও নয় ; যে বলে,
'আমাকেও ভুলে তো যাবে না? '— করুণা সে-ও
শীতের সততা আমি আগে টের খানিকও পেয়েছি
খানিক পেয়েছি তাই
                       বর্ণনার পদ্ধতি জানি না
তবু বলি, আমার চাদর
অসংখ্য প্রার্থনা সত্ত্বেও,
                     লালফুল ধুয়েমুছে সাদা হয়ে গেল —
এক শীতে — যা ছিল বাহার আমার
কী বলি,  সে-ই কাফন


জিয়া হক

Che and urban pox

পক্স

নগরের গল্প নগরবাসীর কাছে শুনি। যেহেতু
আমার কান আছে
এই কান থাকে বলে দেওয়ালেরা প্রাণী বলে গণ্য
                             হল দেশে।
রোগের আসর বসে তাসের সভায়। সবাই বৃহৎ বৃদ্ধ
                                      ওষুধের দয়ায় হাস্মুখ

রাস্তার প্রযত্ন থেকে দূর যারা বসবাস করে
প্রাতঃরাশে হরলিক্স না থাকলে কর্নফ্লেক্স খায়
জীবন-দর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা রাখে
নিরাপদে তারা? তাদের শিশুশ্রেণি বাসপিষ্ট হবে না কখনও?
খানিকটা পরাজিত যারা,
                           সুযোগ্য সুযোগ তার রয়ে গেছে গৃহে
এমন ছায়াচিত্র তাদের দেখাও যেখানে
                                পরাজিত নট-বিনোদিনী
                                 আজও জীবিত — কোনওভাবে
কিছু কিছু দৃশ্য থাকে আপতকালীন —যা নয়
বসন্তের ঘরমুখী বাস,  যা নয় বসন্তের বাসন্তী অসুখ
এমন দৃশ্যাবলী পাঠক্রমের চেয়ে বড় বই

অথচ পুস্তক বানায় যারা—নির্মাণকারী —
   বর্ষার মেঘে ঝুলে থাকে
এত ধুলো, এত ভার, তবু তার পতনও হয় না

এটাই নরক তার, এটাই জান্নাত
     ধর্মালয়ে তবু তাকে চাঁদা দিতে হবে
তাহার পেটে কি যায় ধাতু ও কাগজ?
বদহজমে তিনিও কি জড়িবুটি নেন?
এমন প্রশ্নে শুধু ভাবমূর্তি থাকে ;
 কবিত্বে মিশে যায় চে গুয়েভারা
গেভারা কার্যত জঙ্গলবাসী —প্রচল রাস্তা থেকে দূর,  এক পথ
            মূর্তি, ভাব, তাম্বাকুর লোভে আমরা
তার পিছু এতটা এসেছি

জিয়া হক

Neglected nazms by Gulzar


গুলজ়ার । অবহেলিত পদগুচ্ছ

১।
এই মাটিভূমি
যা তুমিই দিয়েছ যেখানে
সাজাতে পারি ঘর
যে ঘর তোমারই

এসো
অবশিষ্ট কাজ শেষ হয়ে এলে
হতে পারে আগামী কোনও সপ্তাহান্তে
                                            এসো


২।

এক কবিতার পংক্তি-সন্ধানে

শব্দের ঘন বনে একটি কবিতার
ধ্বনি ও পংক্তির খোঁজে
ঘুরে ঘুরে প্রিয়তম বাক্য যখন
ডাল ভেঙে আনি
         হাতময় ক্ষত-দাগ হয়
ছিঁড়ে যায় মাংসের আঙুল
কী এক রসে ডুবে যায় জিভ যখন
মুখে রাখি ওই শব্দগুলি

৩।
এক যে ছিল ভাবনা

ছিল এক চিন্তা। ধার। ভীষণ যেন করাত।
কেটে কেটে এগিয়ে চলল আমাকে
রক্তের পেয়ালা উপচে গিয়ে
মিশে গেল আমার শরীরে

বরফ হয়ে এলো যখন,  বিন্দুতে ফোঁটায়,
সে তখন জল
বয়ে গেল
প্রস্ফুটিত কাব্যের কলমীর বাগানে

উর্দু থেকে ভাবানুবাদ
জিয়া হক



Children are hookers


একটি প্রাণ জন্মালো মানে একটি মৃত্যু জন্মালো। কে তাকে হনন করবে?  এই সদ্য জাগা ছানাটি তা জানে না। কে তাকে কেনই বা নিয়ে এলো এই উপত্যকায় —সে জানে না। সে শুধু জানে, ঘুম পেলে কাঁদতে হয়, খিদে পেলে, যন্ত্রণা পেলে, পেচ্ছাপ পায়খানা পেলে কাঁদতে হয়। আর এই কাঁদনকে গুরুত্ব দেবার জন্য একজন মহিলা আছে।  একে যে চরাচরে মা শব্দ দিয়ে ধরা হয়েছে তা তার অজ্ঞাত। ল্যাংগুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস তখনও বিদ্যুৎবাহিনীর নাগাল পায়নি বলে অকেজো। বাকযন্ত্রের কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়নি। তার যে প্রগলভতা একদিন খেয়ে নিতে পারে, অতি উৎপাদনের জেরে কত সখাবিচ্ছেদ হবে —এইগুলি পাঠক্রম হয়ত জানাবে তাকে। আইয়াপ্পা পানিকর তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবন্দোবস্তকে একহাত নিয়েছিলেন শিক্ষার সার্কাস কবিতায়।  কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা বিষয়ক বহু দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।  তাঁকে মার্টিন লুথার হয়ে যেতে দেখে নেহাতই ভালো লাগে। এই ভালো লাগা খানিকটা বাটারস্কচ খাওয়ার মতো নয়। কে জানে মায়ের গালের কোন চুমুতে সন্তানের বাৎসল্য আর কোন স্পর্শে কামনা লেগে রয়েছে? যে জেনেছে সে পারতপক্ষে নিরাপদ দূরত্বে বর্জিত থাকে। কোনও দূরত্বই নিরাপত্তা দেয় না, যা দেয় তা হল স্মৃতিভ্রংশী এক ঘুম। কিছু ঘুম থাকে যেগুলো জেগে থাকার মতো। নেশাদ্রব্য যেভাবে অপ্রকৃতিস্থ করে, চেতনের সাইকেলের চাকা বাস্তব থেকে দু আঙুল উঁচুতে তুলে ভাসিয়ে রাখে, এই নিদ্রা কি তেমনই মাদক?  স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো স্বেচ্ছাজাগর এই ঘুম। কিন্তু ঘুমের মধ্যে পালিয়ে শিশু কতদূর যাবে?  ততদূরই কি যেখানে এমন এক রাষ্ট্র যার পরিচালক থলি নিয়ে বাজারে যায়, মাছের দরদাম করে, মুরগিওয়ালার থেকে গিলেমেটে চেয়ে নেয়, যে দেশে নদী দিয়ে শুধু জল বয়ে যাচ্ছে, মৃতদেহ নয়। কিন্তু এমন দেশ তো কল্পনার সামগ্রী। কল্পলোক, স্বপ্নলোক, ঘুমজগৎ —এরা তো এক লোক নয়। আলাদা আলাদা লোক, আলাদা আলাদা মুখ। শিশু তো সবেমাত্র স্বর্গভ্রষ্ট। মা নারকীয় ব্যথায় বাস করে তাকে স্বর্গ রচে দিয়েছিল। মায়ের অভিশাপের দিন গত হয়েছে। শিশু এবার লোকসর্বস্ব হয়ে লৌকিক হল। এতদিন তার বাস ছিল অভিভাবকের অলৌকিকে।

প্রাণই কি প্রাণের জন্ম দেয়?  এমন প্রশ্ন তুলেছিল সেই থুরথুরে বুড়োটা যার একটাও খুকি বাঁচেনি।
তার দিকে করুণাভরে তাকালো সদ্য যে যুবক আব্বা হয়েছে।
কেউ এর উত্তর দেবার চেষ্টা করল না এই কারণে নয় যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে মনস্তত্ত্ব রাখেনি বা তারা এতটাই ধার্মিক যে যে-ক‌োনো ব্যাখ্যা ঈশ্বরবিরোধী হয়ে যায় কি না এই ভয়ে ভীত। তারা চুপ রইলো।
আরও দুজন থুরথুরের কানে তাম্বাকু গোঁজা ছিল। তারা উদাসীন কেননা এখানে পুনরায় দেখবার মতো আকর্ষক কিছু আর পড়ে নেই। তাদের চোখ ফুলে ভিজে জবজবে হয়ে আছে যেন দুটো আরোগ্যহীন ঘা।
দ্বিতীয় থুরথুরে বলল,  তুই বড্ড জ্ঞানগর্ভ কথা বলিস।
তৃতীয়জন বলল,  জ্ঞানগর্ভ না ছাই, ও বড্ড কথা বলে আর এটাই মূল কথা।
প্রথম থুরথুরে বলল,  এই দেখো কী মস্ত ভুলটা তুমি করে বসলে।
তৃতীয় বলল,  ভুল আর আমি? তাও মস্ত?  তোর কি মাথায় ছানি পড়েছে?
দ্বিতীয় হাসছে। যুবকটি চুপ করে আছে।
প্রথম : নিজের কথাটাই যে 'মূল' কথা —এটা কারা বলে?
তৃতীয় : যে সত্য সে সত্যির খানিকটা টের পায়। এর বিজ্ঞান, ব্যাখ্যা নেই।
প্রথম : বেশ কথা। কিন্ত কতটুকু টের পাও বললে? খানিকটা, তাই না?
দ্বিতীয় : একটু খৈনী হবে?
তৃতীয় : খানিকটা বলেছি বিনয়বশত। আসলে অনেকটা।
দ্বিতীয় : বলছি খানিকটা খৈনী নিলে হত না?
প্রথম : অনেকটা কিন্তু সবটা নয় —এ সহজ কথা তুমি জানো বলেই জানি।
যুবক বলল, মূল আলোচনাটা ছিল কিন্তু শিশু নিয়ে।
দ্বিতীয় : ঠিক ঠিক। এরা কেউ কাজের নয়।
তৃতীয় : কী কাজ চাই তোর, বল তো!
দ্বিতীয় : তাহলে আলোচনায় শিশু কই?  আর একটু খৈ মানে খৈনী হলে ভালো হতো।
প্রকৃতই, কেউ ভাবে মাদক নিলে নিয়মাতিরিক্ত হওয়া যায়, 'অপ্রকৃতিস্থ'  বলে যাবতীয় প্রকৃতির বিপরীতে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। ঘটনাক্রম থেকে বেরিয়ে একটা দূরবর্তী টিলার উপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবার মতো করে সবকিছুর অস্তাচলমানতা দেখা যায়। এ ধারণা নিয়ে আমাদের কোনও অসূয়া নেই। ধারনার সুবিধা হল সে বুদ্ধির খাপ-খোপ মেনে দেহ নেয় অথচ অশরীরী। এই শরীরশূন্যতাও তাকে আঘাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। সে আহত হয় বলেই সেও সন্ত্রাসী হয়। নমনীয়তার সন্ধান তার অনবরত চলে। নরম জমি, নাবাল জমি শুধু পরমতসহিষ্ণু নয়, সুখহীনভাবেই সে দণ্ড নেয় নরমে। শস্য ফলানো তার কাছে সততই সুখের নয়, ব্যথারও ।
—আপনি শিশুদের ভালোবাসেন না?
—জ্বি না জনাব।
—কেন?
—শিশু হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো। না, ভুল বললাম। গুছিয়ে বলি,  শিশু হল বলিউডের মতো খানিকটা।
—বলিউড মানে যারা মূলত মিউজিক ভিডিও বানায়?
—জ্বি জনাব, আপনে সহি পকড়া হ্যায়।
—হিন্দি কহ কেন? কোনো এজেন্ডা নেই তো আবার।
—মূল কথা হল, শিশু একটা বিনোদন। তাকে দেখে আনন্দ, তাকে শুনে আনন্দ, তাকে ছুঁয়ে আনন্দ, তাকে চেঁটে আনন্দ।
—চেঁটে?
—শিশুর আঙুল, মুখে আপনি জিভ কখনও ঠেকাননি?
—আপনি শিশু ভালোবাসেন না, সেটা নিশ্চিত?
—জ্বি জনাব, আমি শিশুদের ঘৃণা করি।
—কিন্তু সাধারণ লোকও বলবে যে আপনি কি একদিন শিশু ছিলেন না?
—সেটা কি আমার সমস্যা? সেটা কি প্রাকৃতিক পদ্ধতিগত সমস্যা নয়?
—আপনি একজন বাস্টার্ড।
—জ্বি জনাব।

যে তার্কিক রাগ-প্রধান, সে তার্কিক জ্ঞানচর্চার মতামতবহুল বিচিত্রানুষ্ঠানে দয়ার পাত্র হয়ে উঠবেন। তাঁরও যে জ্ঞান আছে, সেই জ্ঞান যখন অগ্রাহ্যতা ও গালাজপদ্ধতি নেন, তখনই তিনি 'জ্ঞান'কেই মুক্ত করে দিয়ে বহিরাগত হয়ে পড়েন কেননা তাঁর আত্ম-প্রদেশ এতটাই সার্বভৌম যে সেখানে সকলেই 'বহিরাগত'। নীতির নিয়মই হল সে নির্ধারককেও আহত করে। আর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই জাগিয়ে দেয় কখনও কখনও ফাঁকতালীয় তত্ত্ব যা 'দেখতে' তত্ত্বের মতো, কার্যত ছদ্ম। উদাহরণ অজ্ঞাত নয়।
—ফেমিনিজম কি তেমনই একটা তত্ত্ব?
—এই তত্ত্ব সমতার কথা বলে কিন্ত পদ্ধতিটি বড় দ্বেষপূর্ণ। একমাত্রিক আর পূর্ণাঙ্গ মানব-সম্প্রদায় নিয়ে তার ব্যথা নেই। আংশিক আর ক্ষুদ্রলক্ষ্য এই বক্তব্যের।
—কিন্তু ফেমিনিস্টদের তর্কগুলো? তার তো সামান্য হলেও সার আছে।
—নিশ্চয়ই আছে, আর তা ওই সামান্যই।
শিশু থেকে নারীবাদে গেল কেন তর্কালোচনা? শিশুও কি নারীবাদীদের 'তত্ত্ব'-এ নরম উপাদান হয়ে ফিরে আসে? এটা কি একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা? কোন তত্ত্বে রাজনৈতিকতা নেই?
—আপনারা কে কার পক্ষে গুলিয়ে যাচ্ছে।
—জ্বি জনাব।
—এতেও জ্বি জনাব?
—আসলে কী বলুন তো, বাস্টার্ডদের আব্বাজানগুলোও গুলিয়ে যায় কিনা ।

জিয়া হক



The blind shop


ও অচঞ্চল লঘুকালো মাথা 
বাঁকা চুল, পাকা চুল, নুন ও মরিচ 
এই শৈত্যের প্রকাণ্ড গর্তড্রেনপথে 
এসেছো বার্লি, বাজরা আর কল্যাণের খোঁজে? 
সাহসী বলেই তুমি পারো, তবে 
তুমি কারও পোষ্য জীব গাধাটি নও তো? 
নেই কারও হাত যেটা নোনাধরা বোঝার সদৃশ? 
লালি চায় লেবু দেয় 
অবসর প্রাপ্ত বৈকাল 
পট্ট ব্যাগ পাটভাঙা রমণীর দিকে মৌলালির ভিড়ে 
সোহাগের সৌজন্য পেতে শাদী করে লোকে 
এখানে পুরুষ যেভাবে মেয়েও সেভাবে মেলে 
অন্ধ দোকানে 
ও কপাল দধি! 
দুয়ার শব্দে রোগ সেরে যায় যদি 
কে আর বিজ্ঞান শেখে, অস্ত্রোপচার 
দেবতারা পাপ বোঝে, সে মতো বিচার 
বেড়ালিনী ছানাসহ মন্দিরের পাশে 
পরিবারে সুখ নাকি বইছে সন্ন্যাসে 
অজ্ঞতার লোম পেতে বসে আছে রোদ 
    ছানাগুলো তার কাছে শ্রীহীন সরোদ 

জিয়া হক 

A birthday boy's neglected date and data


সব হারানোর বনে একটা ফুটিয়াছিল দেহ
প্রেম চাইবার পাত্রে শুধু ফেলত চেয়ে স্নেহ
বিরাগভাজন রাত্রিকালীন মিষ্টি মুখের খুকি
সে তো নিতে রাজিই ছিল প্রসবকালীন ঝুঁকি
দেহ কেবল মনের মতো মনের কথা বলে
চায়ের পাত্র নামিয়ে রাখে মাদক রাখার স্থলে
সন্দেহী যারা, তর্কপ্রবণ কালো কফি নেওয়া পেশা
এই ধরনেরা ওই ধরনের সান্ধ্যভ্রমনে মেশা —
মেশামেলা ছাড়া এমন বস্তু দূরবর্তীর কাছে
বাবা হইবার যাবতীয় পথ তালা বন্ধনে আছে

জিয়া হক 

পোকাব্য


তুমি একটি পোকা আর পোকাদের খাদ্য পোকারা
অথচ বোকারা
বিরাট সাইকেল নেয় অন্ধকার জ্বেলে
এ আলো যতদূর যায় তেলতেলে
পিছলে যায় অট্টালিকা চাকা
'মেলা-ই মেলাবে লোক ', বলে পিছু পাকা
ঝরে না তবুও এত গৃহে পক্ব ফল
ডোবা তবে তল
তার এত নীচু মেলে মুক্তো, ব্যথা
যথা
কাটা ঘা, নুন মরিচ, কাশ্মীরি ঝাল
 প্রসাধনকক্ষ জানে তার গায়ে আদিম অস্ত্রাল
বুনো ফুল?
 পোকাদের আহার হৃদয়, আর ওড়ে অস্তগামী চুল

জিয়া হক