অজানা জ্বর : প্রশান্ত হালদার। একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া


অজানা জ্বর –সংক্রামক ও স্বাস্থ্যকর
জিয়া হক

অজানা জ্বর। শিল্পবস্তুর ‘নামকরণের সার্থকতা’ নামে একটি বিষয় বেশ প্রচলিত রয়েছে ‘জ্ঞান’মাধ্যমে। যদিও আলোচক যে কোনও উপায়ে ‘প্রমাণ’ করে দেন যে শিল্পবস্তুর নামটি একেবারে অকাট্য ও সর্বৈব সার্থক। শিল্পী বেঠিক নাম দিতেই পারেন না, এমন একটা ধারণার বিদ্যায়তনিক শিক্ষাপ্রকরণে চল রয়েছে। তাহলে ‘অজানা জ্বর’ সম্বন্ধে সেই আলোচক সম্প্রদায় কী বলবেন জানতে কৌতুহল হয়। তিনি কি একটি কবিতার জায়গা থেকে দেখতে চাইবেন, সমগ্র সংকলনটির ক্ষেত্র থেকে ‘বিচার’ করবেন, নাকি লেখকের অবস্থানকে ‘অজানা’ ও ‘জ্বর’ শব্দদ্বয় দিয়ে বুঝে নিতে চাইবেন? একটি প্রশ্ন সচরাচর ওঠে, কাব্যগ্রন্থের কি ‘নাম’ দেওয়া যায়? এত কবিতা, এত এত বিষয়, এত ভাবনা, এত এত কৌশল—তা একটি নাম-এর আয়ত্তাধীন থাকে কীভাবে? একটি নামের মধ্যে হয়ত সবকে, সব কিছুকে ‘ধরতে’ চাওয়াও হয় না হয়ত। যদি তাই হতো তাহলে পৃথিবীর সমস্ত শিল্পবস্তুর নাম হয়ে যেত হয়ত ‘জীবন’। জীবনের বাইরে আর কী লেখা হল এতদিন? কেবল ধরন-এর পরিবর্তন ঘটে। ‘ধরন’ মানে কি জীবনের ধরন? তা ঠিক নয়। প্রকাশনার ধরন। ধরনের সঙ্গে কার্যত মিল রয়েছে ধারণার। ‘ধারণা’ যেহেতু স্থান ও কাল ভেদে বদলায়। তবে সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে খেয়াল করা যায় যে, এই ধারণারও একটি স্থানিক ও কালিকতার বাইরে সমত্ব রয়েছে। একজন নিউ ইয়র্কারের ভাবনার সঙ্গে একজন ঢাকাই কবির চিন্তার সমত্ব থাকতেই পারে, অসম্ভব কিছু নয়, বলাই বাহুল্য। কেবল লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সমতা আছে বলে দাবী করে গার্সিয়া মার্কেজকে নিজস্ব করে নেওয়ার যে প্রচল রেওয়াজ তাকে প্রশ্ন করে কেউ বলতে পারে, একজন সুইডিশ বা ডাচ বা পর্তুগিজ কি গার্সিয়া মার্কেজকে ‘গ্রহণ’-এ বাধা পাবেন? তবে এর বাইরেও নানা অসমাধেয় ব্যাপার-আশয় রয়েছে। বলার আরও নানা পরিসর ও বহু ‘মুখ’ আছে। আন্তর্জাতিক প্রশাসক ও প্রশাসিতের রাজনীতিগত সচেতন বেখায়ালিপনা, খামখেয়াল রয়েছে—আর এখানেই হয়ত সাযুজ্যের প্রশ্নটা, সমত্বের প্রশ্নটা আসে। আসলে প্রশান্ত হালদারের ‘অজানা জ্বর’ এমন একটি কবিতার বই যা যে কোনও দেশকালের হয়ে উঠতে পারে। ‘বেঁচে থাকার পরাধীনতা কেউ কেউ/ মৃত্যুর স্বাধীনতা দিয়ে মাপতে চাইছে/ ভাবনার ভয় সরিয়ে/ স্বপ্নে ঘুমুচ্ছি... সাধারণ চিকিৎসার বিজ্ঞাপনে/ ঢেকে যাচ্ছে যাবতীয় সমস্যা’—এমন  পংক্তি কোন রাষ্ট্রে সত্য নয়? এখানে কবিতার মান, তার হয়ে ওঠা, ছন্দ, মাত্রা, অলংকার—এমন সব ‘নন্দনতাত্ত্বিক’ প্রতর্ক অপ্রয়োজনীয়। ‘ভালো’ পংক্তি আর ‘জরুরি’ পংক্তির দ্বন্দ্ব আছেই, থাকেই। তবে জরুরি বিষয়টি যদি ভালোত্বে হাজির হয়, তাহলে তা ‘স্থায়ী’ হয় কিনা, বা ‘মহাকাল’ মনে রাখে কিনা তার মীমাংসা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। মহাকালও কাঁটা বেছে খায় কিনা। মহাকালের কাব্যবোধও প্রশ্নাতীত নয় কিনা। যেমন বিনয় মজুমদার বা উৎপলকুমার বসু ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালির কাব্য-শো-অফের অংশ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিকে। কেউ বলবেন, এটাই মহাকালের বিচার। তার নির্বাচনে তো উঠে এসেছে ‘যথার্থ’ নামগুলি? এ এক সান্ত্বনা বৈ আর কী? তবে মহাকালের পদ্ধতিটি হোমিওপ্যাথেটিক। যদিও অনেকে বহিরাগত থেকে যান। উত্তম দত্তকে,নিশীথ ভড়কে, শম্ভু রক্ষিতকে, শোভন ভট্টাচার্যকে, অরূপ ঘোষকে, বিশ্বনাথ পুরকাইতকে মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হবে? এখন প্রশ্ন হল, কী দিয়ে ‘তৈরি’ হয় এই মহাকাল? কাল দিয়ে নাকি মানুষ দিয়ে? মহাকাল একটি ভাঁওতা। আমাদের জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধির অক্ষমতার দায় ঝেড়ে ফেলবার একটি ডাস্টবিন। আমরা ‘সহৃদয়’ পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। পাঠক স্ব হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ‘হৃদয়’ অধিকাংশ সময় ‘খারাপ’ থাকে। ‘স্বীকৃতি’ দেবে কে? এখন প্রশ্ন হল, স্বীকৃতির দরকারটাই বা কী? দরকার আছে। কেননা এই স্বীকৃতির সঙ্গে কোথাও জড়িয়ে আছে কালের স্বর। আর এই ‘কালিক স্বর’ বহুমাত্রিক। তবে, এর সঙ্গে শিল্পের ইউটিলিটির একটা সূক্ষ্ম যোগ রয়েছে। ‘মৃত লেখক’রাই সবচেয়ে বেশি জীবিত—এমন সব মন্তব্যের উৎসের সঙ্গেও এর যোগাযোগ রয়েছে। প্রশান্ত হালদার ভীষণভাবে জীবিত এবং তাঁর লেখা প্রণিধানযোগ্য। 


.....................................................................................
অজানা জ্বর। প্রশান্ত হালদার। প্রকাশক- ‘মুক্তাঞ্চল’। প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৭। দাম— ৪০ টাকা। 

1 টি মন্তব্য:

  1. লেখাটি এক কবির কবিতার বই এর মতব্য; মন্তব্য বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন মনে করি না... শুধু প্রশান্ত হালদার এর কবিতা বিষয়ে বলতে পারি... প্রায়শই একগাদা আবর্জনার স্তূপে কিছু সুখাদ্য অবহেলায় পড়ে থাকে, থাকে বলেই আমার মতো ভিখিরিরা থা খেয়ে বেঁচে থাকে... না থাকলে আমরা কীভাবে যে বাঁচতাম....

    উত্তরমুছুন

Share. Comment. Subscribe