Wordly God

মুহূর্তের অনিবার্যতা

..........................
শব্দ তাঁর অধীন। ধ্বনি, বর্ণ, বাক্য তাঁর দাস। অনুপ্রাস, যমক, সমাসোক্তি, বক্রোক্তি তাঁর। তাহলে কবিতা কে 'রচনা' করেন? কবি নাকি তিনি? তিনি তো সর্বজ্ঞ, অদ্বৈত, ভাবনাতীত — তাঁর রচনা-নির্মাণ কেমনতর? আদিতম ও শেষতম পদকর্তা কি তিনিই? তাহলে মানুষ যা 'গড়ে', তা কী? সবই কি প্রতিফলন মাত্র? মূলের অনুকরণ? মৌলিকতা শব্দটিই কি ততটাও 'মৌলিক' নয়? সকলেই যে মৌল বস্তু যা কিনা সার তার সন্ধান করে নিয়মিত। তাহলে এ সবই অনর্থক? শ্রম কি পন্ড এইখানে? নিরীশ্বরবাদীরা বলবেন, এ সবই অজ্ঞানতা, ভীতিজনিত আনুগত্যের প্রচারণা, শক্তির চিরকেলে সাধনার যুক্তি, পলায়নপর নির্বিঘ্নতার চর্চা। প্রমাণ কই, তথ্য কোথায়, দৃশ্যমান কি কিছু আছে? শুধু বিশ্বাসের কী মূল্য আছে? 'বিশ্বাস' ততক্ষণ নিরপরাধ যতক্ষণ তা 'অপর'কে আহত না করে। কারও বিশ্বাস, এখানেই বিশেষ মসজিদটি ছিল। অতএব যা সাম্প্রতিকের নির্মাণ, 'বাস্তবতা' তা অপসারণযোগ্য। এই বিশ্বাসের অাড়ালের বাস্তবতার দিকে দেখা দরকার জরুরি অবস্থায়। কোন যুক্তি, কাদের যুক্তি, কেমন যুক্তি ক্রিয়াশীল আছে নিহিত বৈঠকে। এই বিশ্বাস কি অনায়াস নাকি ম্যানুফ্যাকচারড। এই বিশ্বাসে ভক্তি নেই, আছে হিংসা। সমষ্টির কল্যাণকামনা থাকে এমন বিশ্বাসে? শিবরাম চক্রবর্তীর 'দেবতার জন্ম' ছোটগল্পটি স্মর্তব্য এ প্রসঙ্গে। কীভাবে গড়ে ওঠে একটি 'বিশ্বাস' চাঁই তা শিব্রামীয় শৈলীতে জানা গেছে। যে পাথরখন্ড গল্পকথককে আহত করত রোজ, সেই পাথরই হয়ে উঠল শিবের অংশ এবং ফলত তার নিমিত্তে মানুষ বানিয়ে তুলল মন্দির। 'সবার' বিশ্বাস যে পাথরের চাঁইটির গতায়াত পাতাল অবধি যার কিয়দংশ মানবকল্যাণে উপরিতলে জেগে রয়েছে। এ অপার্থিব, এ দৈব। নিরীশ্বরবাদী গল্পকথকও শেষাবধি রোগ-মৃত্যুভয়ে প্রণাম করে বসে পারিপার্শ্ব খেয়াল করেন। কেন তাকে পারিপার্শ্ব দেখতে হয়? এখানেও সেই মধ্যবিত্তীয় ভাবমূর্তি সচেতনতার আদুল বিজ্ঞাপন। তবে প্রশ্নটি অন্যত্র। ভাবছি, যে-লোকটি অ-গোচরে একটি নিরীহ পাথরকে পুঁতে তার উপর দেবত্ব আরোপ করে এমন খুঁতবিহীন 'নাটক'-এর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন, তাঁর 'বিশ্বাস'-এর জায়গাটা ঠিক কেমন? শিবরাম চক্রবর্তী সেই লোকটির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেননি। কেননা তাঁর সমালোচনার লক্ষ্য 'আম' জনতা। গল্পকথক এই ভিড়-এরই প্রতিনিধি। আমাদের ভাবনা হল, তাঁকে বিশ্বাস করার জন্য যেমন কেউ যুক্তির সন্ধান করে, বিপরীতে তাঁকে অবিশ্বাস করবার জন্যও কেউ খোঁজে যুক্তিপ্রমাণাদি। দুজনেই সময় হন্তারক। কী সাবলীলায় তারা অনর্থের চর্চা করে। বিবেক ও অনুভব যদি বলে তিনি আছেন, তো তিনি নিশ্চয়ই আছেন। এরা যদি বলে নেই, তাহলে তিনি আপনার কাছে, আপনার জন্য নেই। আপনি এবার যখন রচনা করছেন কবিতা তখন কবিতার উপাদানগুলি আপনার স্বোপার্জিত। ভাষাবিশ্ব থেকে চয়ন করে এনেছেন যা অমোঘ ও অনিবার্য। ইশ্বরবাদী কবিতালেখকের ক্ষেত্রেও তাই। তিনি শুধু বলবেন, আমি কেবল দানা রুয়েছি মাত্র, প্রাণ দিয়েছেন তিনি। সেই তিনি।
কেউ বলেন, আমি শব্দের সন্ধানে বের হই। কেউ বলেন, আমার কাছে শব্দ আসে। বিষয়টি বেশ জটিল, যেমন জটাধারী ওই প্রক্রিয়াটি। শব্দ কি কোনও গাছ, বাজার, দোকান যে তার কাছে যেতে হয়? শব্দ কি বৃষ্টি, হাওয়া, আওয়াজ যে এসে যাবে? মস্তিষ্কের ডিভাইসে শব্দভান্ডার তো রয়েইছে। তা শুধু একটু উস্কানির অপেক্ষায় থাকে। এই 'উস্কানি'টি কারও বাইরে থেকে আসে, কারও ভেতর থেকে। যদিও এই কথাও সম্পূর্ণ সত্য নয়। 'বাহির'-এর যে উদ্দীপনা প্র-তাড়িত করে কবিতালেখককে, তা কি আর বাইরের থাকে? সে তো হয়ে ওঠে অন্তর্গত। আভ্যন্তরীণ। একটি কবিতা তাই বাইরে-ভেতরে দু জায়গায়  'পড়ে' থাকে। তাদের দেখা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটি কবিতার মুহূর্ত।


নমস্কার
জিয়া হক 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Share. Comment. Subscribe