আমি ছাদে উঠতে ভালোবাসি।
ছাদে উঠলে নিজেকে দূর্গ রক্ষক মনে হয়।
কিন্তু ছাদ বানিয়ে দেয় আব্বা।
আমার তৈরি করা কোনো ছাদ নেই বলে বৃষ্টিতে
যেখানেই দাঁড়াই মনে হয় ভিজে যাচ্ছি।
আব্বা যখন ছোট ছিল তখন তালপাতার ঘরে
দুই ভাই এক বোন বর্ষাকালে ভিজত। সারারাত।
শুধু তারা নয়, সারা পাড়া জেগে বসে থাকত উবু হয়ে।
একে তারা কোনোমতে একটা ফিল্মি খেলা মনে
করতে পারত না। পাখি বলতে পেঁচা। তারই ডাক
শোনা যেত। বাদাম গাছে সে বসে থাকত।
বাদাম গাছ দেখলে তাই ভয় করত। তবে ভোরে
খালের জলে বাদাম ভাসত। যেন অপুষ্ট ভ্রূণ।
কঞ্চির ডগা দিয়ে পাড়ে তুলে আনা হত। বাদামের
ভেতরে ছোট বাদামের সাদা আত্মা। সুস্বাদু।
এখানে অগ্রজদের কবর। কবরের উপর বাঁশের বাগান।
এই বাগানে জুতো পরে যাওয়া নিষেধ। এটুকুই শ্রদ্ধা।
কেউ কখনও ভাবেনি আমার আব্বা সারাজীবনে
ছয়তলা বাড়ি বানাবে। ঘর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবে।
পরামর্শদাতা হবে। জলের প্রতিপক্ষ হবে।
আমি মাইলোভুট্টার উপকথা শুনেছি, কখনও দেখিনি।
ভাত কোথায় সবদিন। দুধ কোথায়। ছিল বার্লি আর
মাইলোভুট্টার ছাতু। এগুলো গল্প হয়ে গেছে কাটাপোনা
আর ব্রকোলির পাশে।
এ আমারই গল্প, অথচ এ আমার একার গল্প নয়।
আমাকে কেউ নক্ষত্র দেখাতে বসেনি। কুমার শানু শুনেছি।
মনে হয়েছে, কুমার শানুর চেয়ে বড় নক্ষত্র আর কে আছে?
আব্বা বলত, পড়াশোনাই তোমাদের ব্যবসা।
পুঁজি বলতে বর্ণপরিচয়, আদর্শলিপি, বিদ্যাসাগর।
কেউ জানে না দুপুরে কোথায় চলে যেতাম।
খুব হাওয়া হত দক্ষিণ দিক থেকে, পতঙ্গ উড়ত।
জেট বিমান বছরে একবার অন্তত যেত আমাদের
মাথার উপর দিয়ে, তার সাদা ধোঁয়ায় পথ পড়ত আকাশে।
আমি টের পেতাম, আমার মতো হুবহু কেউ কোনো
রাজার বাড়ি বড়ো হচ্ছে, হয়ত দ্বিতীয় আমি রাজার বাড়ির
আস্তাবলে শুয়ে ঘাসের বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ঘোড়াদের
বিনোদন করে আর তাকে ঘিরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে
নগরগর্দভ থেকে শিশুপ্রজা —সবাই।
বোম্বে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সে রোজ ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি পার্শ্বচরিত্রই হতে চেয়েছি তাই আমার কাহিনিতে
নায়কের মুখ ঢাকা থাকত কালো কাপড়ে।
সবাই বলে, নেতৃত্ব দাও, সব গুণ তোমার রয়েছে,
হিংসা ও ক্ষমা, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় —তুমি সবই পারো
তারা তো জানে না, আমি ঘুমোতে ভালবাসি আর
পক্ষ নিয়ে ফেলি, শত্রুভাবাপন্ন নই, জিতে গেলে
আমি দুঃখিত হই, হতাশা আসে, কান্না কান্না পায়
অযথা প্রস্তাবও তাই আমি বিবেচনা করে দেখি।
আমার মুখ মায়ের মতো, আমি ঠাকুরদার নকল,
নিজস্বতা আমার কিছু নেই, এইভাবে
বেঁচে থাকা সহজ কাজ নয়, কে বুঝবে?
রিহার্সাল ছাড়াই আমি মঞ্চে এসে পড়েছি ;
দর্শক মহোদয়গণ এই নটকে ক্ষমা করুন যেভাবে
কাকের আওয়াজ মেনেই নিয়েছেন, সেই ভাবে।
ছাদে যেতে এখন আমার নিজেকেই করুণা।
ওই নক্ষত্রভরা ছাদ আমি পেরিয়ে চলে যেতে চাই,
চাই সেখানে যেন দিঘার সমুদ্রের মতো কিছু থাকে
চাহিদা যার নেই সে গাছে ওঠে না, কুড়িয়ে নিয়ে আসে
জিয়া হক