একটি সাক্ষাৎকার : ছোট্টগল্প


ক।
কী নেবেন—চা না সরবত?
একজন সাহিত্যিক আমার কাছে জানতে চাইছেন, কী পান করব—চা নাকি সরবত। বেশ মজা লাগল। আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। এরকমটা যে হয় তা জানা ছিল না।
আমি যেমন সংকোচ করে থাকি, ঠিক সেই ভাবে বললাম, না না কিছু লাগবে না।
তিনি বললেন, তা কি হয়?
এই বলে বেশ জোরে আওয়াজ দিলেন, সোফি! চা দিয়ে যাও আমাদের।
সোফি নিশ্চয়ই এ বাড়ির কাজের লোক। নাম শুনে মেয়েই মনে হচ্ছে। সোফি কি সুন্দরী?
ভদ্রলোকের নাম নির্বাণ চক্রবর্তী। মূলত উপন্যাস লেখেন। সেই সঙ্গে ছোটগল্পের বই আছে চার খানা। কবিতা লেখেন কম। তবে দৈনিক কাগজে উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন নিয়মিত।
সোফি কাচের কাপে টকটকে লাল চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। এই ভাবে সে বহুবার যে চা নিয়ে প্রবেশ করেছে এই ঘরে তা তার চলন দেখে বোঝা যায়। সোফি কিশোরি। গায়ে ওড়না নেই। চুল প্লাস্টিক গার্ডার দিয়ে বাঁধা।
তাহলে আমাদের কথোপকথন এবার শুরু করা যাক? নির্বাণবাবু বললেন।
তিনি পরে আছেন ঢোলা পায়জামার সঙ্গে ঢিলে পাঞ্জাবি। পায়জামা সাদা, পাঞ্জাবি সবুজ। চোখে চশমা। বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে বসেছেন সোফায়। হাতে একটু পুরনো দিনের ঘড়ি।
আমি বললাম, আমাদের এবারের রবিবাসরীয় সংখ্যায় শুধুমাত্র আপনার সাক্ষাৎকার থাকবে।
জানি। আপনার সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়েছে।
আচ্ছা।
আমার লেখা আপনি পড়েছেন তো?
সাংবাদিকদের কাজই হল পরচর্চা করা, আমি হাসলাম।
ভদ্রলোকও হাসলেন।
আপনার লেখাই শুধুই পড়িনি, আপনার অনেক ব্যক্তিগত তথ্যই এখন আমার মুখস্থ।
বেশ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বারান্দায় কেউ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। সোফি নিশ্চয়ই। একটা বড় ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে সিলিং থেকে। সকলেরই চোখে পড়বে। এমন ঝাড়লণ্ঠন এখন আর কোনো বাড়িতে থাকে না।
প্রশ্ন শুরু করতে যাব, এমন সময় বাড়ির সদর দরজা ঠেলে একটি মেয়ে প্রবেশ করল। জিনসের সঙ্গে কুর্তি পরে আছে সে। বয়স একুশ বাইশ। কলেজ থেকে ফিরছে বোঝা যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ। বেশ সুন্দরী। চোখে গাঢ় করে কাজল লাগানো।
আমার মেয়ে, সঞ্চারী। ও প্রেসিডেন্সিতে সোশিওলজি নিয়ে পড়ে। থার্ড ইয়ার, বললেন ভদ্রলোক।
আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম। নির্বাণ চক্রবর্তীর মেয়ের তথ্য আমার কাছে আছে। দেখলাম প্রথম।
চোখ নামিয়ে বললাম, এই মফস্বল থেকে রোজ কলেজ স্ট্রিট যেতে ওর অসুবিধা হয় না?
ভদ্রলোক বললেন, আমি শহরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। ও-ই যেতে চাইল না। ওর তো মা নেই। এখানে নাকি মায়ের ছায়া আছে। সেই ছায়া ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না।
আপনার বাড়িটা সুন্দর, প্রশংসা করলাম। মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।
তিনি বেশ আনন্দ পেলেন বোঝা গেল।
আরেক কাপ চা বলি?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি চিৎকার করলেন, সোফি!
সোফি যেন এই ডাকেরই অপেক্ষা করছিল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। মলিন মুখ।
আরো দু কাপ চা দিয়ে যা। আদেশ দিলেন নির্বাণবাবু।
আমি বললাম, আর চা খাব না। আজ একটু তাড়া আছে। কয়েকটা কপি লিখতে হবে অফিসে ফিরেই। আরেকদিন আসব। আপনাকে শুধু বলি, সাক্ষাৎকারটি যেহেতু বেশ বড়, তাই আমি এটা কয়েক দিন ধরেই নিতে চাই। একদিনে সবটা নয়।
তিনি সোৎসাহে বললেন, ভালোই তো। কোনও আপত্তি নেই।
বেরনোর আগে দেখি, সঞ্চারী সুন্দর একটি ঢিলেঢালা পোশাক পরে পাশের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ফোন বাজছে। মেয়েটিকে সত্যিই ভারি মিষ্টি দেখতে। ও কি ওর মায়ের মতো হয়েছে?
বাড়িতে নির্বাণবাবুর স্ত্রীর কোনও ফটো দেখতে পেলাম না ।
সোফি শুধু দরজার পর্দা ধরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

খ।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে নির্বাণ চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস নিয়ে বিছানায় গেলাম। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী গনেশ পাইন। স্যাফ্রন, হলুদ আর আধিদৈবিক সব মুখের ছবি।
একটি অনুচ্ছেদে লেখক লিখছেন — রতন চায়নি তার মেয়ে হোক। সে দাবাড়ু হতে চেয়েছিল। তার ছেলে বড় হয়ে গ্র্যান্ড মাস্টার হবে। রতন সন্তানের জন্মের আগেই হলুদ জামা আর নীল প্যান্ট কিনে এনেছিল। কিন্তু রতনের স্ত্রী জন্ম দিল একটা কন্যা সন্তান। রতন ভদ্রলোক, জ্যোতিষে বিশ্বাসী। সে মেনে নেয়। শুধু প্ল্যান করে, এই স্ত্রীলোকটিকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে বইটার কোথায় পড়ছিলাম সেটা আর খুঁজে পাই না। তা নিয়ে কোনো উদ্বিগ্নতাও নেই আমার।
রোদের সঙ্গে সঙ্গে চা চলে এসেছে আমার পড়ার ঘরে। মা এখনও সকালের চা-টা দেয়।
মাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা তোমাকে কী ফুল দিত মা?
মায়ের মেজাজ আজ ভালো। বলল, ফুল নয় রে, কাচের চুড়ি কিনে দিত।
কী সস্তায় প্রেম হয়ে যেত তোমাদের মা!
কিন্তু প্রেমটা সস্তা হত না এখনকার মতো।
মা চলে গেল হাসতে হাসতে। শুধু বলল, কেউ জুটেছে নাকি বেড়ালের কপালে?
মা জানে তার বেড়ালটা অকর্মণ্য, ইঁদুর ধরে আজও খেতে শেখেনি বলে নিরামিষ ভোজনের প্রচারক হয়েছে। মাকে আজ খুব ফুটফুটে লাগল। মা কিন্তু স্নো পাউডার কখনো মাখে না। হাতে এখনও কাচের চুড়িই পরে।
মুশকিল হল অন্য জায়গায়।
নির্বাণ চক্রবর্তী সম্বন্ধে আরও পড়াশোনা করে জানলাম, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। কারণ অজ্ঞাত। খ্যাতনামা লেখক বলে সব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কেস হয়নি।
এমন কি পোস্টমর্টেমও না।
আরও নানা তথ্য জানতে পারছি কিন্তু সম্পাদক বলেছে নির্বাণবাবুর লেখক সত্তাকে তুলে আনতে হবে সাক্ষাৎকারে। ব্যক্তি নির্বাণ চক্রবর্তী নিয়ে তার কোনো আগ্রহ চোখে পড়ল না। ষাটের দশকের এই লেখক আর কোন কোন লেখকদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তা জানতে হবে। মানে গল্প বের করে আনতে হবে।
আজ এক জায়গায় যেতে হবে আগে। তারপর নির্বাণ চক্রবর্তীর বাড়ি।
আমি স্নানে ঢুকে পড়লাম।
ট্যাঙ্কে জল নেই।

গ।
কলেজ স্ট্রিটের গাছের পাতা গরমে শুকিয়ে উঠছে। সরবতের বরফ ক্রমাগত ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। ভিড় খুব। মেয়েরা লাল হলুদ গোলা খাচ্ছে। কিন্তু যে মেয়েটিকে আমার দরকার সে কলেজ থেকে এখনও বের হচ্ছে না।
পনেরো মিনিট পরে প্রায় বেরিয়ে এলো সঞ্চারী। আজ তার পরনে জিন্স টপ। মাথায় ছাতা।
এগিয়ে গেলাম।

চিনতে পারছেন? গতকাল আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।
সে চিনতে পেরেছে। একবার চোখাচোখি হয়েছিল, তাতেই সে চিনতে পারছে। স্মৃতি ভালো।
খুব শান্ত গলায় বলল, বলুন।
এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। চলুন কোথাও বসি।
প্রায় অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি তো বসি না। সে বলল।
কোনো ক্ষতি করব না আপনার। আসলে আপনার বাবার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে আমাদের কাগজে। তাই আপনার সাহায্য দরকার।
বাবার ইন্টারভিউয়ে আমি কী সাহায্য করতে পারি?
পারেন, অনেক সাহায্য করতে পারেন।

একটি কফি শপে আমরা মুখোমুখি বসলাম। ওকে ভারি সুন্দর লাগছে।
বললাম, আপনাকে ভারি সুন্দর লাগছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করতে চান? তাহলে বলি, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
না না, তা নয়। বলতে ইচ্ছে হল তাই বললাম। ভাবলাম, আপনি খুশি হবেন।
এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। যাইহোক, বলুন।
সরি।
সরি বলার প্রয়োজন নেই। বলুন কী জানতে চান।
আচ্ছা, আপনার মা কীভাবে মারা গেলেন?
প্রশ্ন শুনেই সঞ্চারীর মুখ গোমড়া হয়ে গেল।
আমি কিন্তু আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।
সে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, জল খাবেন?
আমার কাছে জল আছে।
পুরো বোতল নিঃশেষ না করেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। কিন্তু আপনি এত কুণ্ঠিত কেন?
কেউ যাতে শুনতে না পায় সেভাবে মুখ ঝুঁকিয়ে সে বলল, মায়ের মৃত্যু নিয়ে...
বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। বলল, আজ উঠি, অন্য একদিন বলা যাবে।
কফি পান না করেই সে উঠে চলে গেল।
মেয়েটিকে বিষন্ন করে দিয়ে আমার বেশ হালকা লাগছে।

ঘ।
পত্রিকার সম্পাদক ডেকে জানতে চাইলেন সাক্ষাৎকার কতদূর। সম্পাদক ভদ্র সভ্য মানুষ। লম্বা সাদাটে জুলফি, ব্লেজার পরেন। সেই একই নীল ব্লেজারটাই। রোজ। হাতে সব সময় সিগারেট জ্বলে।
শিগগিরই হাতে পাবেন।
তাকে আশ্বস্ত করলাম।
তিনি আবারও জোর দিলেন, আমার কিন্তু ষাটের দশকের সাহিত্যিক মহলের গল্প চাই, মনে আছে তো?
হ্যাঁ, মনে আছে।
কী বললেন এ পর্যন্ত?
তার প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি উপন্যাসকার বিজলি দেবীর বাড়ি ফেলে এসেছিলেন। কত ভালো উপন্যাস তা আপনি জানেন। বিজলি দেবীর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। তিনি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক রফিকউদ্দিন সাহেবের কাছে যান। উৎসব সংখ্যায় ছাপার জন্য নির্বাচিতও হয়ে যায় সেটা। নির্বাণবাবুর তখন পাগল হবার দশা। প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা যে বাজারে হিট করত সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। পরে হিটও করেছিল, আপনি জানেন। প্রথম উপন্যাসেই খ্যাতির চূড়ায়। তো যাইহোক, রফিক সাহেব একদিন নির্বাণবাবুকে জানান যে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন বিজলি দেবী। তিনি নির্বাণবাবুকে পড়তে দিতে চান। তারপর সব জানাজানি হয়ে গেল।

এ গল্পটা তো আমি জানতাম না। কতটা জানাজানি হল তাহলে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন সম্পাদক মশাই।

আসলে এই গল্পটি আমার বানানো। এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তাছাড়া, আমাদের সাক্ষাৎকার পর্ব তো এখনও শুরুই হয়নি। সেটা বলতে না পেরে এই গল্প ফাঁদতে হল।

সম্পাদক মশাই সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে ইন্টারভিউটা হিট করে যাবে।

জোর দিয়ে আমি বললাম, নিশ্চয়ই হিট করে যাবে।

গল্প গল্প। পাঠকের গপ্পো চাই।

দারুণ আর চমকপ্রদ গল্প এনে দেবো আপনাকে। নিশ্চিন্ত থাকুন।

এটা বাজার খেয়ে গেলে আপনার পরের অ্যাসাইনমেন্ট হবে কবি সুবিনয় ঘোষ।

দারুণ। আমার কাছে সাক্ষাৎকার একটা ইনভেস্টিগেশনের মতো।

আপনি ফিকশনটাও ট্রাই করতে পারেন।

চিন্তা করবেন না, আমি একটা ফিকশনের মধ্যে দিয়ে এখন যাচ্ছি।

সম্পাদক মশাই মৃদু হেসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
এখন আমাকে একটা সুরভি দেওয়া পান খেতে হবে।

ঙ।
নির্বাণবাবুর বাড়ির একটু দূরে যে বাজার সেখানে অপেক্ষা করছিলাম। নটা বাজে। জানি এই সময় সোফি আসবে বাজার করতে।
আমাকে দেখে সোফি একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর স্বভাবসুলভ মিষ্টি করে হাসল।
স্টেশনারি দোকানের পাশে সোফিকে ডেকে ওর হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে বললাম, খাও।
প্রথমে নিতে সংকোচ করলেও তারপর সহজ হয়ে নিল প্যাকেটটা। কিন্তু খেল না, ধরে রইল হাতে।
আমি বললাম, সোফি, তুমি কতদিন ওই বাড়িতে কাজ করছো?
৩ বছর।
তার আগে?
আমার বাড়ি গ্রামে। আমরা তিন বোন। স্যার আমাকে এখানে এনে রেখেছেন। আমার বিয়ে দেবে। সব খরচ করবে।

তুমি বাবুকে স্যার বলে ডাকো?

উনি আমাকে স্যার বলতে বলেছেন।

তোমাকে কি পড়ান অবসর সময়ে?

অবসর মানে?

অবসর মানে যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না।

না, পড়ায় না।

দিদিমণি কেমন?

ভালো।

তোমাকে ভালোবাসে?

হ্যাঁ।

স্যার তোমাকে ভালোবাসে?

এই প্রশ্নে সোফি বেশ হকচকিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকালো। তারপর কেঁদে ফেললো।

আমি খুব নরম ভাবে বললাম, কী হয়েছে সোফি?

সে কিছু না বলে, কিছু না কিনে বাড়ির দিকে দৌড় মারল।

আমি তার মলিন ফ্রকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দৌড়ে যাওয়া লক্ষ করলাম।

দাদা, একটা চা দিন তো।

চ।
আজ বুধবার । লু বইছে সকাল দশটা থেকেই। রাস্তায় সবাই নাকমুখ ঢেকে চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে, সৌদি আরবে এসে পড়েছি। পাসপোর্ট আছে তো? একবার পকেটে হাত গেল তারপর মনে মনে হেসে ফেললাম।

নির্বাণবাবুকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি আর তিনি প্রসন্ন মুখে তার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
কীভাবে লিখতে শুরু করলেন, তার বাল্যকাল কেমন কেটেছে, কাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছেন, একই সঙ্গে সাহিত্যের এতগুলো সংরূপ কীভাবে সামলান, উপন্যাস কীভাবে শুরু করেন —কীভাবে শেষ করেন, সমাজ নিয়ে তার কী ভাবনা, তার লেখায় নারীরা কেন এত অবহেলিত, ইত্যাদি সব প্রশ্ন।
তবে নারীদের প্রসঙ্গে এসে তিনি এক অদ্ভুত গল্প শোনালেন।
গল্পটি সংক্ষেপে এরকম :
তিনি মায়ের স্নেহ পাননি। তার জন্মের কয়েক মাস পরে তার মা অন্য এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যান। মায়ের মুখ ভালো করে তার মনে পড়ে না। সেই ছোট থেকেই তার বাবা তাকে মাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। শেখাতেও হয়নি, মায়ের প্রতি ঘৃণাটা সহজ ভাবেই এসে গিয়েছিল তার মধ্যে। বাবা আর বিয়ে করেননি। অনেক পরে, যখন তিনি কলেজে পড়েন তখন খবর পান যে, তার মা অন্য আরেকটি পুরুষের সঙ্গে তখন ঘর করছে।
বাবা তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনিও একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ে জিনিসটাকে ঘৃণাই করতেন।
তারপর সঞ্চারীর মায়ের সঙ্গে হঠাৎ প্রেম হয়ে যায়। তার বাবাও প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন।
তার খালি মনে হত সঞ্চারীর মা তার মায়ের মতো কারো সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের অদ্ভুত লীলা। সঞ্চারীর জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করে বসেন।
নারীদের তিনি তাই সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন বলে আর ভালোবাসতে পারেননি।
যাইহোক, আরও নানা প্রশ্নের পর আমি বিদায় জানিয়ে অফিসে ফিরে এলাম।
সম্পাদক মশাইকে বললাম শনিবার রাতে কপি জমা দেবো।
তিনি আরেকটি হিট সাক্ষাৎকারের আশায় নারাজ ভাবে শুধু বললেন, বেশ।

ছ।
সোমবার। পত্রিকার দপ্তরের ফোনগুলো ক্রমাগত বেজে চলেছে। অসংখ্য প্রশ্ন পাঠকদের। এ কীভাবে সম্ভব। এতদিন পর এসব আবার কী! যা ছাপা হয়েছে রবিবাসরীয় সাক্ষাৎকারের জায়গায় তা কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার। একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের এখনই জেল হয়ে যাবে। লেখকের স্ত্রীর ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতার ছবিও ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি লেখক সম্পর্কে নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সম্পাদক মশাই বিচলিত। আমাকে ডেকেছেন তার ঘরে। বেশ গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার উপর ভরসা করে সাক্ষাৎকারের কপি না দেখে ছাপতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এসব আপনি কী লিখেছেন?

এক বর্ণ মিথ্যে লিখিনি স্যার।

এখন যদি নির্বাণবাবু পত্রিকার বিরুদ্ধে কেস করেন তাহলে কী হবে?

আমার কাছে যথেষ্ট এভিডেন্স আছে। অযথা চিন্তা করছেন।

কিসের এভিডেন্স যে তিনিই তার স্ত্রীকে খুন করেছেন? আর কাজের মেয়েকে রেপ করেছেন দিনের পর দিন?

হ্যাঁ। তিনি একজন খুনি এবং রেপিস্ট।

কী সব বলছেন আপনি? কোথায় আপনার এভিডেন্স?

শুনুন তাহলে :
প্রথম দিন নির্বাণবাবুর কাজের মেয়ে সোফি, তার নিজের মেয়ে সঞ্চারী মুখ খুলতে চায়নি। তারপর আমি আবারও তাদের আলাদা আলাদা ভাবে মিট করি। সঞ্চারী আমার প্রেমে পড়েছে। সে তার বাবার সব কথা আমাকে বলে দেয়। এমনকি তার মায়ের যে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা নির্বাণবাবু তার দেরাজে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন সেটাও সে আমাকে দিয়েছে। সেই ডায়েরিতে সঞ্চারীর মা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে তাকে তার স্বামী খুন করে ফেলবে। যেদিন তিনি ওই ডায়েরি লিখেছেন তার দু দিন পরে তার ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটে। শুধু তাই নয়, খুনের হুমকির কথাও ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন লেখকের স্ত্রী।
সঞ্চারী নিজেও জানত না যে তার বাবা সোফিকে নির্যাতন করে।
সোফির জবানবন্দি টেপ করে যখন তাকে শোনাই সে আকাশ থেকে পড়ে এবং শুধু তাই নয়, তার বাবার কুকর্ম এক রাতে সে দেখেওছে তারপর।
মায়ের শোক সে ভুলেই ছিল কিন্তু সোফির যন্ত্রণা তাকে আবার তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে এখন তার বাবার শাস্তি চায়। কোর্টে বয়ান দিতেও তার আপত্তি নেই।

সম্পাদক মশাই ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। চোখ এসি মেশিনটার দিকে বোধহয়। কী বলবেন, কী করবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না।

আপনি গল্প চেয়েছিলেন না?

কিন্তু...

এই হল গল্প। ষাটের দশকের একটি খুনের গল্প যার এই একুশ শতকের প্রথম দশকে নিষ্পত্তি হল।
পরের সাক্ষাৎকারের কাজটা কি শুরু করব?

সম্পাদক স্যার প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে বললেন, আগে একটা রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে যান।


জিয়া হক

একটি নিরীক্ষা 

এই ছলনাই আমার দেশ, ইহাই নীতিরাজ


এখন সর্বত্র অতিকথন। অতিরিক্ত কথা এবং অতি মাত্রায় কথা। শব্দ আয়ত্ত আছে বলেই কিছু কইতে হবে?
-তাহলে কি নীরবতাই শ্রেয়?
-যেখানে কথা বলা আবশ্যক, সেখানে নীরবতা অপরাধ।
-কোথায় আবশ্যক?
মুশকিল হল, এই বোধটাই নেই। কোথায়, কতটা মুখ খুলতে হয়, তার অজ্ঞানতাই আমাদের বাধা। মুখ এক ধরনের খাপ, কথা এক ধরনের তলওয়ার। আমরা ফলত আহত করে ফেলি, আক্রান্তও যে হই না, তা নয়। কেননা প্রত্যেকেই এই অর্থে সশস্ত্র। ধর্মে ততদূর অবধিই বাক-স্বাধীনতা স্বীকৃত যতদূর তা অহৈতুকী ও সহিংস না হয়ে যায়। ধর্মের রেজিমেন্টেশন নিয়ে প্রায় সকলেরই উষ্মা। আমাদের মনে হয়েছে, এই পরিখাপদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণেচ্ছার মৌল অভিপ্রায় থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি বলেই, তা জেলখানা ঠেকে। মানুষের মনের মৌলিক কাঠামোয় হিংসার একটি প্রকট জায়গা রয়েছে। সামাজিকতা যেহেতু একটি বানিয়ে তোলা ব্যবস্থা এবং সমাজ নিজেই ব্যক্তিহিংসা-নিরপেক্ষ নয়, তাই সমাজ-সত্য ও সমাজ-চোখ, সমাজ-মন একে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ। এখানে ধর্ম যে কাজটি করে তা হল শুদ্ধির জায়গা। একটি মানুষ নিয়ে তার আগ্রহ। কেননা একজন করে বদলে গেলে সমষ্টিই বদলে যাবে। মানুষ-নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হয়?
তাহলে এই যে ধর্মীয় হিংসা? তাহলে কি হিংসার বীজ নেই ধর্মের কোথাও? এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ধর্মের রাজনৈতিক সত্তাটি বেশ ভোঁতা। ধর্মকে নিয়ে রাজনীতির জায়গাটি তীক্ষ্ণ। প্রসঙ্গত, ধর্ম যে একেবারে রাজনীতি বিবর্জিত, তা নয়। তবে ধর্ম-প্রদত্ত নেতার যে আদর্শ, তা কি সুলভ? ইসলাম ধর্মে যে চার খলিফা—আবু বকর, ওমর ফারুক, উসমান গনি, হযরত আলী—সকলেই তো সুফি সাধকদের মতো জীবনযাপন করেছেন। ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে পরলোকে গিয়েছেন। খালিফা বা রাজার ব্যক্তিগত ঋণ? কল্পনাতীত। সমকালিক ধারণায়, শাসকের ঋণ মানে রাষ্ট্রীয় ঋণ, দলীয় ঋণ। জনগণের ঋণ। সদ্যজাত শিশুও সেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে।
আমি চাই মানবোন্নয়ন। কেবল নগরোন্নয়ন বা গ্রামোন্নয়ন নয়। এই বিভাজনগুলি কার্যত মানুষ নামের জৈব প্রতিষ্ঠানকে খন্ডিত করে। ভেদবুদ্ধির উৎস এগুলিই। রাষ্ট্র কল্পতরু নয়, তবে তার কল্পতরুর ভান করার প্রশ্নটাও এখানে আলোচ্য। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দিকটিই হওয়া দরকার ছিল সহায়কের, তার বদলে তা হয়েছে অনাক্রমণ চুক্তিভিত্তিক শোষকের। তাই উঠে আসে আঞ্চলিকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের মতো অ-সংসদীয়, অ-সাংবিধানিক বিষয়গুলি। এর কারণই হল, রাষ্ট্র নিজেই তার সাংবিধানিক শুদ্ধতাকে রোজ হত্যা করে। ‘ব্যবহার’ করে। প্রয়োজনে সংবিধানকে মুষড়ে ফেলার চেষ্টা করে যায়। জুডিসিয়ারি সিস্টেম যতই নিরঙ্কুশ ও স্বতন্ত্র হোক না কেন, তা যে রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনকে একেবারে অস্বীকার করে এগিয়ে চলেছে তা বলা যায় না। কোনও কিছুই প্রভাবমুক্ত নয়। তাই বলা যায়, বিচারব্যবস্থা একটি কলহান্তরিতার মতো আর রাষ্ট্রও অসূর্যম্পশ্যা নয়।

জিয়া হক

ভারতীয় পাখিদের অপমৃত্যু


ছড়িয়ে দিয়েছি দুটো পাখি
চলে যাবে আকাশের দিকে
তুলে খাবে তারাদের
পুং পাখি চুমু খাবে স্ত্রীকে

এই ভাবে কোনও একদিনে
আকাশও হয়ে যাবে সাদা
শাড়ি পরতে চায় সেই পাখি
হয়ে যেতে চায় কালো রাধা

নায়িকা হবার কিছু লোভ
ছিল তার সিনেমা ও গানে
ক্যামেরা বা যে কোনো যন্ত্রই
পাখিটিকে আজীবন টানে

আকাশের কোনো এক ঢালে
ভাসছিল রাধা নাম্নী পাখি
যন্ত্র খালি থুতু ফেলেছিল
তাহাতেই রক্ত মাখামাখি

নায়কের কাছে যেতে হলে
উড়তে হয় অনেক ভিলেন
ভারতীয় সেই খুকু পাখি
নিরক্ষর, ভদ্র ছিলেন

জিয়া হক

আলাপ ও বিস্তার


কোথাও শীতঠাণ্ডা জল আমাকে বলে, গণমাধ্যমে যাও
ওখানে উষ্ণপাতা উড়ছে যা দেবে মিত্রপক্ষের সফলতা
কী দেব তার বিনিময়ে, আমি বলি
নাবালৌকিক কথা শুনে এই সব, সেও হাসে খিল্লিধর্মী হাসি
যে যায় শহরে সে হয় বেশ্যা, তুমি জানো?
আর ঘরে যারা থাকে, তারা কি শোভা ওই তুলসীপত্রের?
প্রশ্নকারীরা গ্লুকোজ ছাড়া কিছুই পায় না, শেখো
শেখো, কীভাবে নর্দমা পাপ বইতে থাকে অথচ
সবাই চায় সুনির্মিত নর্দমা সুসজ্জিত ঘরবাড়ির পাশে
জানতে চাও, শহরে কি মহিলা যায় শুধু? পুরুষকে বেশ্যা কেউ বলে?
অজ্ঞান লোকেদের চুপ থাকা স্বাস্থ্যকর ভেবে
নখ খাই, চাঁদ দেখি, গুরুবাদী হই
শীতঠাণ্ডা জল তবু আমাকেই ডাকে, বলে, ঠিক আছে
ডুব দিয়ে দেখো, দোষারোপ করো না কখনও,
মুক্তো খুব ঝুটা হয়, রাখি না ফলত,
তবে কিছু পানকৌড়ি পেয়ে যেতে পারো আর পচা জুতো,
দু একটা ভদ্রলোক হয়ত বসে আছে, ভদ্র গ্রাম্য মেয়ে

জিয়া হক 

প্রবাসী আতর এসে লাগে


কোথায় যাব এই সামান্য আলিঙ্গন নিয়ে, চাহিদা ছিল
পাঁচ মিনিট বা তারও তিন মিনিট বেশি
প্রার্থী আমি, হাত শুধু প্রস্ফুটিত নয়, এই মাত্র
এই আশ্রম আমার বন্দীশালা, গোয়াল, আস্তাবল
আমি কি লোকায়ত ষাঁড়, অবসরপ্রাপ্ত কোনো ঘোড়া?
অনেকেই জানে, হ্রদে যেখানে অনেক উচ্চতা থেকে
জনবহুল বাস পড়ে যায়, তার পথ বেশি আপ্যায়ন করে
মাসাধিক কাল বৃষ্টি হল বলে ভিজে এই জামা-পায়জামা
আলিঙ্গন সংক্ষিপ্ত করো কেননা জানো
কোন গাছে আতাফল সুমিষ্ট হয়, আর কে মুদ্রাবিহীন

জিয়া হক 

মিথ্যুকবৃক্ষের ফল


এই মিথ্যুকবৃক্ষের ফল খাবে না কখনও যদি চাও —
মাথামোটা জীবন কাটাবে গোপালন করে
যদি চাও সুচাকুরে পাত্রীর সন্ধান বন্ধ করে দেবে
অভুক্তভোগীরা বিল ছাপায়, অনুষ্ঠান করে, কুড়ি ফন্টে নাম
দয়ার শরীরে বসে মশা ও মশাই, আয়ু পান করে
কেন জানি মিথ্যুকবৃক্ষের নিচে সত্যিকার মেয়েলোক আসে
সে জানে কত অংশ তার বিক্রয়যোগ্য আর
কতখানি ব্যানার হিসেবে কাজ করে
আদম হিসেবে আমি জানি, ভাষা ব্যবহারে অদক্ষ লোকই
অপরাধী ; ভাবুকের বুক থাকতে পারে, কখনও থাকে না —
সাদা জামা,
বুক পকেট
কলার খোসার মতো জুতো, তার থাকে
স্থির বলে একে সব প্রদক্ষিণ করে —ভাবে, এই তো ভ্রমণ
যে বিছানা ঘুম দেয় রোজ, যেই ঘর আলুচোখা দেয়
সেখানেও থেকে তুমি নিজেকেই পর্যটক ভাবো?
বৃক্ষ হইতে সাবধান, তারা তোমার ভালো চায় জানো
এই কি নয় যথেষ্ট মন্দ বিষয়?

জিয়া হক

নাথুরাম ও রামরাজ্য


কতরকমের গাছপালা হয়ে আছে, অজ্ঞাত পরিচয়
এই বনে ছিল আমাদের খেলা ; সরল গনিত
কেউ কি আওরঙ্গজেব হতে চায় এই দিনে?
অনেকেই স্বপ্ন দেখে নাথুরাম হবে : হবে গ্রন্থ প্রণেতা
এই বনে ছিল আমাদের ছাপাখানা, খানাখন্দ খেলা
আজ মৌ এসেছিল, সে কিন্তু মাছি নয় —মেয়ে
তার গালেই ছিল বটের পাতার মতো রোঁয়া, বটফল
সে চায়, দূরত্ব বজায় রেখে আমি শুধু দেখি
আমি চাই, ছুঁয়ে তাকে, ছেনে তাকে —দেখি
আমার রাজত্ব আছে, মহারানি পদে লোক নিয়োগ হবে —
সে ভাবে
কোটালপুত্র আমি, ফেলে যাওয়া রুটি ভোগ করি,—
সে তো জানে না
তার জন্যে মীরকাশিম খুঁজি রাস্তায় রাস্তায়, পানের দোকানে
লোকমুখে বীর হলে হবে, বীরত্ব যে পিঁপড়েরও থাকে

কতরকম ঘরবাড়ি হয়ে আছে ; নেমপ্লেট সহ
এইসব সংশোধনাগারে কারা থাকে? ভাষা কি বিদেশি?
কার পক্ষ নেয়? সুপাত্র আছে? নিরামিষ খায়?
চিন্তাবিদ নই, তবে মৌদের কথা ভাবি ইদানীং
যেহেতু, অনেক খেলেছি এই বনে

জিয়া হক

সুজাত বুখারী : বন্য উপত্যকায় ঘুম


এই যে, এই যে সেই লোক যার স্বাভাবিক মৃত্যু হল এক রাতে
ঘড়িটি ছিলই তাকের উপরে অক্ষমতা নিয়ে
ঘোরেনি বহুদিন তাই হিসাবশাস্ত্রে জ্ঞান নেই
কে কোথায় কতদিন বন্দী রয়েছে —জানে না
এখানে মাংস বহুমূল্য এখন;— ব্রাশ করে নরখাদকেরা
মুড়িজল পশুখাদ্য এখানে, চিনিতে সুগার
স্বাভাবিক পা ফেলে ফেলে কেউ চলে যাবে এমন সুদিন
ভিনদেশে আছে বলে দেশীয়রা ভাবে
ভাবে মহাপুরুষেরা, মহামহিলারা উৎসবের জন্ম দিয়ে গেছে
আর ভাবে তিনিও তাদেরই একজন

কর্তা! ফল গাছে ফল হয়, ফুল গাছে কর্মফুল ফোটে
অনেক আদর হয়, প্রকৃত চুম্বন তবে মোটে
আসে একখানা
কোথাকার স্ত্রীলোক, কবেকার ত্যাজ্য জেনানা
দিয়ে যায় ঠিক
সবারই অপমৃত্যু, এভাবেই কিছু স্বাভাবিক

জিয়া হক

কুৎসিত প্রার্থনা আর নর্দমার মধু


পরে এসো, এখন ব্যস্ততা আমার নেই
যখন খুব ভেঙে পড়ে থাকব, দেখতে এসো না
এই আমি শিল্পমেলায় যাচ্ছি, চারুকলা ভবনে,
বিদেশি সুখাদ্যের কাচ ঘেরা দোকানে পাটে,
ই-চিঠি লিখছি অপাত্রে দান করব বলে,
কাজ করছে মন, সাজিয়ে বলতে পারছি ভাষা,
মুখস্থ আছে কোন ফুল রাত্রে ফোটে, গন্ধ বেশি হয়,
কীভাবে খোলা চুলে আঙুল চালাতে হয়,
সেই দিন এসো
আমার লুঙ্গি পরা ছবিখানি তুমি দেখে ফেলো, চাই না
আত্মজীবনী লুকিয়ে রাখতে চাই ওই লজ্জাস্থান —
ঢাকার কাপড়ে — তারপরও যদি ঝরে পড়ে বীজ,
ভিজে গিয়ে দেখা হয়ে যায়
ফিরে যেতে অনুরোধ করি, এ বড় বিনীত আর আদেশানুসারে

জিয়া হক 

অর্গ্যাজম কত প্রকার ও কি কি?


পুরুষ, তোমার কি অর্গ্যাজম হলে লজ্জা লাগে না?
তাকিয়ে দেখেছো পাশে শুয়ে আছে যে মহিলাটি
তার সবে ঘুম ভাঙল এই, কী নরম তার মুখ যেন
কতদিন বৃষ্টি হয়নি প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ভালোবাসা কি সেই বাতি যা শুধু নিভে যাবে
নিভে যাবে আর তুমি ঘষে দিলেই আলো?
যে গাছের যা দায়িত্ব তা সে না মানে যদি, কী করো?
এরপরও মা আমাকে খেতে দেয়, করুণা করে না
খুকি, মানুষকে অপশন ভাবতে লজ্জা লাগে না?
গোপনাঙ্গ বিনিয়োগ করে কী কিনবে বলো?
তুমি কি জানো না কার বিনিময়ে কী তুমি পাও?
যে-মাটির বীজ মরে যায়, খেয়ে যায় কাক, তার ব্যথা বোঝ?
তোমার অজ্ঞাত কিছু নেই, কান ওই বাতাসের মতো বড়
প্রতিটি পাতার শুকিয়ে যাবার শব্দও পেয়েছো, মনে হয়
আমার লজ্জাস্থান আমাকেই নিয়ে যায় নষ্ট অন্ধকারে

জিয়া হক 

কবি শোভন ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার : প্রশ্নে কবি প্রসূন মজুমদার

প্রশ্ন ১) কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোর কথা একটু বলো

উত্তর— আক্ষরিক অর্থে কবিতা লেখা শুরুরও বেশ কয়েকবছর আগে, খেলাচ্ছলে কিছু প্রেমপত্র লিখতে গিয়ে আমি টের পাই, সেই কৃত্রিম লেখাগুলোর ভেতর দিয়েও, আমার যোগ্যতার অতিরিক্ত কিছু সৌন্দর্য ও সুষমা, আমার সম্পূর্ণ অবচেতনেই প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। সেসব চিঠি যে শুধু নিজের জন্যই লিখতাম তা নয়, বরং বন্ধুবান্ধব অনেকের বকলমেই সেই পাপ আমি করেছি। করতে করতে এক বিপজ্জনক খেলায় নিজেও জড়িয়ে পড়েছি। ১৭/১৮ বছরের উন্মত্ত কৈশোরে জড়িয়ে পড়েছি ফিল্মি আবেগ নির্ভর মিথ্যে প্রেমের যন্ত্রণাদায়ক সম্পর্কে। কম বয়সের মোহে সেই সম্পর্কের রেশ টেনেছি বছর তিনেক। তারপর যথারীতি তা একদিন ফুরিয়ে যাবার সময় এসেছে। দু’জনের পথ, প্রাকৃতিকভাবেই পৃথক হয়ে পড়েছে একদিন। কিন্তু ফর্মুলাবদ্ধ সমাজের চোখে ঘোরতর অন্যায় হয়ে দাঁড়াল সেই বিচ্ছেদ। পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আমার আত্মীয় বন্ধু প্রায় সকলেই সেই বিচ্ছেদের জন্য আমার অপদার্থতা আর সামাজিক অযোগ্যতাকেই দায়ী করতে থাকল। আমি ভয়াবহভাবে একা হয়ে গেলাম। এমনকী আমার বাড়ির লোকেরাও সে সময় আমাকে করুণার চোখেই দেখতে শুরু করেছিল। তখন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতকস্তরের ছাত্র। দিনের বেলা কলেজ সেরে, বাড়ি ফিরতাম বিকেলে। তারপর সন্ধে অব্দি বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম, যতক্ষণ না অন্ধকার নেমে আসে চারপাশে। দিনের বেলা  আলোয় বাড়ির বাইরে বেরতে আমার ইচ্ছেই করত না। আমিও কারুর মুখ দেখতে চাইতাম না, অন্য কেউ আমাকে দেখুক তাও চাইতাম না। সন্ধের আবছায়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে পৌঁছতাম পাটুলি সংলগ্ন বাইপাসের ধারে। তখন সবে নির্মিয়মান বাইপাসের ধারগুলোয় শুধু অন্তহীন মাছের ভেড়ি। ভেড়ির পর ভেড়ি। দুটো ভেড়ির মাঝ বরাবর চলে গেছে সরু সরু আলপথের মতো রাস্তা, মিশে গেছে দূরের ঘন অন্ধকারে। এখন যেখানে ‘বেণুবনছায়া’, সেখানে তখন নিশ্ছিদ্র কুয়াশাঘন অন্ধকার, জলায় জলায় জমাট বেঁধে থাকত। পুবদিকের অন্ধকার চিরে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলে যেত গড়িয়া স্টেশনের দিকে। তারপর সোনার থালার মতো চাঁদ উঠত রেললাইনের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে। আমি একা জলের ধারে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, সন্ধের পর সন্ধে। বসে বসে দেখতাম কালো জলের ওপর কেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঝকঝকে তারায় ভরা রাত্রির আকাশ। দূরে, আলপথের কুয়াশা ভেদ করে, চাদর জড়ানো দিনমজুরের দল বিড়ি টানতে টানতে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত রেললাইনের দিকটায়… সেইসময় নিজের অজান্তেই আমি ধ্যানস্থ হয়ে পড়তাম যেন। সেই নির্জন, নৈসর্গিক অন্ধকারে, তারায় ভরা অন্তহীন আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমার একবিন্দু প্রাণ যেন এক মহাজাগতিক জীবনের ইশারা অনুভব করত। বেশ কিছুদিন এইরকম চলার পর বুঝলাম, অনেক অনেক কথা যেন জমা হচ্ছে আমার ভেতরে, কিন্তু সেইসমস্ত আকাশকুসুম ভাব প্রকাশের ভাষা যে আমি জানি না। বুকের ভেতর কী যে জমাট সেই অবস্থা, আজও বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তাছাড়া সেইসব কথার ভাব এমনই, যে তা ভাষায় যদি প্রকাশ করাও যায়, শুনবেটা কে? এই বিশ্বচরাচরে আমার পরিচিত এমন কোনও মানুষের মুখ তখন মনে পড়ত না, যাকে গিয়ে আমার মনের কথা বলতে পারি। সেই কথা কিন্তু কোনও সম্পর্ক ভাঙার কাঁদুনিমাত্র নয় মোটেই। ফেলে আসা সম্পর্কের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে, বরং সেইসমস্ত কথা যেন আমার এই একলা হয়ে পড়ার অপেক্ষাতেই বুকের ভেতর নির্মমভাবে ঘাপটি মেরে ছিল এতকাল। ক্রমান্বয়ে সেই কথাগুলোই আমাকে চাপ দিতে থাকল লেখার। গর্ভস্থ শিশু যেমন প্রসবের জন্য মায়ের পেটে চাপ দেয়, সেইরকমই অনেকটা। একটা দুটো লেখার সূত্রপাত হয় তখনই। কিন্তু কবিতা লেখা তো দূর, সমসাময়িক কবিতা পড়ার দীক্ষাও তো তখন আমার ছিল না, ফলে কাঁচা ভাষায় অনিয়ন্ত্রিত আবেগের স্রোত বয়ে যেত সেসব লেখার ভেতর দিয়ে। তখন এক বন্ধু আমায় একদিন ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা ওদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে দেখাল। ওর এক পিসিকে সেই বই উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং লাবণ্য দাশ। উপহারের পাতায় তার ‘নির্জন স্বাক্ষর’ দেখে খুবই শিহরিত হয়েছিলাম, মনে আছে। সেই আমার প্রথম, পাঠক্রমের বাইরে, জীবনানন্দ পড়ার শুরু। তার কিছুদিনের মধ্যেই ঈশ্বরের কৃপায়, আর দু’একজন বন্ধুর সাহয্যে হাতে এল ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’, ‘উৎপল কুমার বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা’(কবিতা সংগ্রহেরও অনেক আগে বেরিয়েছিল)… এইসব। ফলে জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা হলো আমার। তখন একদিন জানলাম, আমাদের পাড়ার বাপ্পা দা নাকি এই সময়কার (নয়ের দশকের) একজন উজ্জ্বল কবিতাপ্রয়াসী। পোশাকি নাম যার সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। গেলাম ওর কাছে। ও তখন একটা বিশাল উপকার করেছিল আমার। বলেছিল, হাজার বছরের বাংলা কবিতায় নিয়মনিষ্ঠ ছন্দের ভূমিকার কথা। উৎসাহ দিয়েছিল ছন্দ শেখার। সেটা ৯৫ সাল হবে। আমি ছন্দ শেখায় যত্নবান হলাম। সেসময় নয়ের দশকের এক ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল তরূণ-কবি দীপঙ্কর বাগচীর সঙ্গে আমার আলাপ। ওর কাছেও ছন্দ এবং কবিতা বিষয়ক কিছু সাহায্য তখন পেয়েছি। এর পরের দু-তিন বছর, ছন্দ শিখতে শিখতে যাকিছু লিখেছি, তার কিছুই আর পরবর্তী সময় কোথাও রাখিনি, কারণ আমি কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছিলাম-- কবিতার চেহারা আর কবিতা এক জিনিস নয়। সেটাই ছিল আমার কবিতা-জীবনের প্রথম এবং কঠিনতম পরীক্ষা। ছন্দে লিখব, কিন্তু ছন্দ লিখব না, লিখব বিশুদ্ধ কবিতা। সেই পরীক্ষা বা সাধনার প্রথম সিদ্ধাই আমার প্রথম কবিতার বই ‘ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি’। রচনাকাল ৯৮, ৯৯ । এই সময়কালেই আমি স্পষ্ট করে টের পাই, কবিতা আমি লিখি না, বরং আমাকে রচনা করে কবিতা স্বয়ং। বুকের ভেতর জমাট হয়ে থাকা কথাগুলো কেমন যেন আপনাআপনি ছন্দবদ্ধ হয়ে আমার কলমের ডগায় নেমে আসে প্ল্যানচেটের মতো। সেইসময়কার আদিতম রচনাটির অংশবিশেষ ছিল এইরকম—
‘কবিতার দোষে আমি কাপালিক হয়ে যেতে পারি। / যে দেহ শব্দের লাশে ব্যোম হয়ে ছুঁয়েছে স্তব্ধতা, / গোপন পাঁজরে আজ স্বীকার করেছি যার কথা, / আগুন যজ্ঞের নীচে পুড়ে যাওয়া সে দেহ আমারই...
...কবিতার দোষে আমি কাপালিক হয়ে যেতে পারি / অর্থাৎ কবিতা লিখে কবি হতে পারিনা কক্ষনো...
যা কিছু রচনা নয়, ততটাই লিখে রাখা চলে; / যেমন আড়াল গেঁথে, হয়তো কেউ তাকে স্পর্ধা বলে।’
এই লেখাটির সূত্র ধরেই একদিন নয়ের দশকের অন্যতম প্রধান কবি অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ এবং সেই সূত্রেই কলেজস্ট্রিট কফিহাউসের ‘গান্ধার’ পত্রিকাগোষ্ঠীর বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার সূত্রপাত। অনেকটা এইরকমই আমার কবিতা লেখা শুরুর দিনগুলো।   


প্রশ্ন ২) তুমি তো উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পছন্দ করো, এই অভ্যেসটা কী করে হলো?

উত্তর-- সুরের প্রতি অনুরাগ আমি পেয়েছি মামাবাড়ির সূত্রে। মা-মাসিদের গানের গলা ছিল বড্ড সুরেলা। যে-সমস্ত গায়ক গায়িকার গলায় ধ্রুপদী দক্ষতা বেশি, তাঁদের বিশেষ ভক্ত ছিল আমার মা-মামা-মাসিরা সবাই। তাছাড়া আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের বাড়িতেই ছিল একটা গানের স্কুল। সারা বিকেল-সন্ধে জুড়ে নানান রাগরাগিণীর তালিম চলত। আমি যে খুব মন দিয়ে শুনতাম তা নয়, কিন্তু পরবর্তী সময় দেখেছি সেইসব সুর আমার অবচেতনে কেমন অলৌকিকভাবেই সঞ্চিত হয়ে থেকে গিয়েছিল। ওই যে একলা দিনগুলোর কথা বলছিলাম, সেই সময়ই একদিন ঘুরতে ঘুরতে আমি ঢুকে পড়েছিলাম ‘দক্ষিণী সঙ্গীত সম্মেলন’-এর বার্ষিক আসরে। টালিগঞ্জে, আমার বাড়ির কাছে, সেই আসর এখনো বসে প্রতি জানুয়ারির ৮/১০ তারিখ নাগাদ। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বসছে। সেই যে একবার ঢুকে পড়লাম, তারপর থেকে গত বাইশ-তেইশ বছর যাবত আমি ঘোরতর আসক্ত হয়ে আছি ভারতীয় সঙ্গীতের অলৌকিক সৌন্দর্যময় ঐশ্বর্যে। কিছু কিছু রাগরাগিণী, উপযুক্ত পরিবেশনায় শুনে মনে হয়েছে এই সুর তো আমার বহুকালের চেনা। সেই চেনার বয়সকাল যেন বা আমার তৎকালীন বয়সের তুলনায় অনেকগুন বেশি। যেন কয়েক জন্মান্তরের ব্যবধান। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের গাওয়া দেশ রাগ শুনে, বিদুষী মালিনী রাজুরকারের জৌনপুরি শুনে, বিদুষী কিশোরী আমনকারের বাগেশ্রী শুনে এই অনুভূতি আমার বারবার হয়েছে। এসব নিয়ে বেশ কিছু কবিতাও আমি বিভিন্ন সময় লিখেছি। জন্মান্তরের আখ্যানগুলো, বৃহত্তর অর্থে সঙ্গীত শোনার আগে পর্যন্ত আমার কাছে গল্প বলেই মনে হতো, এমনকী জাতকের কাহিনীও। কিন্তু ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আমাকে জন্মান্তরের স্পষ্ট আভাস দিয়েছে। আমি জীবনে প্রথম বেনারস যাবার অন্তত ১৫/২০ বছর আগে থেকেই গভীরভাবে অনুভব করেছি যে বেনারসের সঙ্গে আমার জন্মান্তরের কোনও না কোনও যোগাযোগ আছে। সেই টান ব্যাখ্যাতীত। আমার ‘যে আরতি মণিকর্ণিকার’ বইটিতে সেই বিস্ময় আংশিকভাবে লিপিবদ্ধ।
বছর কুড়ি আগে যখন ডোভার লেন সহ অন্যান্য মিউজিক কনফারেন্স শোনা শুরু করি, টিকিট কাটারও পয়সা থাকত না। এর-তার থেকে টিকিট বা পাস জোগাড় করে কোনোক্রমে ঢুকতাম। সারারাত খিদের জ্বালায় ছটফট করতে করতেও গোগ্রাসে গানবাজনা শুনতাম, কিন্তু কিছু কিনে যে খাব, তার উপায় কোথায়? পকেট যে গড়ের মাঠ। আমার গানবাজনা শোনার দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বর্ণেন্দু সরকার তেমনই অনেক অসহায় এবং আনন্দঘন রাত্তিরে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে খাইয়েদাইয়ে। তবু সঙ্গীতের ওপর আমার আসক্তি দিন-কে-দিন বেড়েছে বৈ কমেনি। জন্ম থেকেই আমার গলায় সুর ছিল পর্যাপ্ত, মায়ের তাই ইচ্ছে ছিল গান শেখানোর, কিন্তু বাবার একার রোজগারে আর সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবুও যত দিন গেছে, আমি সঙ্গীতের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি ততই। আজ অনুভব করি, আমার লেখার পেছনেও সেই সঙ্গীত-প্রেমের ভূমিকা অপরিসীম। শব্দ বা বাক্যে প্রাণসঞ্চার করার ক্ষেত্রে সুরের ভূমিকা খুবই অলৌকিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া সঙ্গীত-প্রীতির হাত ধরেই আমি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়েছি অধ্যাত্মবাদে। অনুভব করেছি, সঙ্গীত, ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথনের শ্রেষ্ঠ এবং সূক্ষ্মতম পথ। আমরা তো গৃহী মানুষ, খাঁটি সাধু বা সাধক দেখার সুযোগ আমাদের খুবই কম, কিন্তু সঙ্গীতই আমার জীবনে সেই পরিসর, যা আমাকে শিখিয়েছে সাধক চিনতে। সাধনা বস্তুটিও ঠিক কী জিনিস আমি বুঝতে শিখেছি সেইসব সাধক শিল্পীদের দেখেই। আরো একটা ব্যাপার, আমাদের সমাজে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো রয়েছে বহুকাল যাবত, যা অবচেতনে বেশিরভাগ মানুষকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তার হাত থেকেও আমি চিরতরে মুক্তি পেয়েছি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেরই কৃপায়। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত ভাস্কর বুয়া বাখলে, উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর জীবনকথা, আমাকে এই অভিশপ্ত সাম্প্রদায়িক সমাজ থেকে বহুদূরের এক জন্নতে পাকাপাকিভাবে অধিষ্ঠিত করেছে, সম্ভবত বাকি সারা জীবনের জন্য।
এখন আমার মেয়ে সেতার শিখছে, আমি চাই ওর জীবনে, ওর সমগ্র জীবনব্যাপী, সঙ্গীত যেন প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়, ক্রিয়াশীল থাকে। তাহলে আমার সঙ্গীত-প্রেম আরোই অর্থবহ হয়ে উঠবে আশা করি। আমি তো ঈশ্বর বিশ্বাসী, তাই মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো আমার মেয়ে একদিন প্রত্যক্ষ সঙ্গীতচর্চা করবে বলেই পরম রহস্যময়, করুণাময় ঈশ্বর আমাকে এত বছর ধরে পাক খাইয়েছেন এত অজস্র আসরে, মজলিশে।     


প্রশ্ন ৩) গানের কথা আর কবিতার কথার মধ্যে ফারাক করবে? করলে সেটা কী?

উত্তর— গানের কথা অনেক ক্ষেত্রে কাব্য হয়ে উঠতেই পারে, যেমন কবীর-লালন-রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবীর সুমনের বহু গান, কিন্তু তা সত্বেও গানের কথা আর কবিতার কথা সমার্থক নয় কিছুতেই। মনে রাখতে হবে, যে-গানকে সূক্ষ্মতম শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে, তা মূলত সুরপ্রধান। কথা সম্বলিত গান সেই জায়গা কোনোদিনই দাবী করতে পারে না। সেটা একটা মিথোজীবী শিল্প। একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কথা লিখতে গেলে সুরের কথা, সুর করতে গেলে কথার কথা মাথায় না রেখে উপায় থাকে না। কিন্তু কবিতা তার তুলনায় অনেক স্বাধীন। ছন্দের ছাঁচও যে কবিকে মানতেই হবে, তেমনও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সারাজীবন ছন্দে না লিখেও কেউ ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো চিরস্মরণীয় কবি হতেই পারেন। এমনকী গীতি-কবিতার ক্ষেত্রেও যে গীতলতা, সেও কিন্তু সুরের ভরসায় থাকে না। আবার দ্যাখো, গানের কথায় কখনোই ভারী শব্দের ব্যবহার বা ভাবের অতিরিক্ত বিমূর্ততা কাম্য নয়, সেক্ষেত্রেও কবিতার পক্ষে অনেকটাই স্বাধীনচেতা, স্বেচ্ছাচারী হওয়া সম্ভব।


প্রশ্ন ৪) তোমার কবিতা ভাবনায় একটা ধ্রুপদী চিন্তন লক্ষ করা যায়। এই ব্যাপারটা এল কীভাবে? মানে নয়ের দশকে যখন সশব্দ হাততালির কবিতা বাহবা পাচ্ছে, তখন তুমি সেদিকে না গিয়ে থাকলে কী করে?

উত্তর-- কবিতা লেখার অন্যতম শর্ত হিসেবে একজন কবিকে প্রথমে একজন শ্রেষ্ঠ কবিতা-পাঠক হয়ে উঠতে হয়। এই কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিগত কাব্য সংস্কার। আমি যখন বাংলা কবিতা বা বিশ্ব-কবিতার পাঠ নিতে শুরু করেছি, তখন থেকেই লক্ষ করতাম, যাঁদের যাঁদের কবিতা আমার ভালো লাগে তাঁদের মধ্যে একটা গভীর সাদৃশ্য আছে কোথাও যেন। সেই সাদৃশ্যটি হলো ওই Sense of eternity বা শাশ্বতের ধারণা। হয়তো সেসব বিভিন্ন কবির বাহ্যিক জীবনযাপন, এমনকী কবিতার ভাষা একেবারেই আলাদা। কেউ ধরো খুব শান্ত, স্থিতধী, যেমন রবীন্দ্রনাথ বা রিলকে… আবার কেউ বেদম উন্মত্ত, উড়নচণ্ডী, যেমন বোদলেয়ার বা মধুসূদন… কিন্তু এই সমস্ত কবিকেই যে একই সঙ্গে আমার প্রাণে ধরল, তার প্রধান কারণ ওই মহাজাগতিক চিরন্তনতার বোধ, যা থেকে প্রকাশ পায় বিশ্বমানবতার আবহমান চেতনা। তার পাশাপাশি লক্ষ করে দেখলাম, যে আমার প্রিয় কবিদের সকলেরই কবিতায় আছে আশ্চর্য মন্ত্রশক্তি। খুব সম্ভব ওই চিরন্তনতার বোধের সঙ্গে এই মন্ত্রশক্তির একটা ব্যাখ্যাতীত সম্পর্ক আছে। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ, রুমি-হাফিজ থেকে জিব্রান-গালিব কিংবা কীট্‌স্‌-ব্লেক থেকে ইয়েট্‌স্‌-ফ্রস্ট সকলের মধ্যেই ওই দু’টি জিনিসের আশ্চর্য সম্মেলন আমি লক্ষ করেছি অতি যত্নসহকারে। আর সেখান থেকেই আমার মধ্যে ‘ধ্রুপদী চিন্তন’-এর সূত্রপাত হয়তোবা। তারই দাবী অনুযায়ী আমি কবিতা লেখার প্রায় শুরু থেকেই ধ্রুপদী আঙ্গিকের চর্চাও সযত্নেই করেছি। আমার সামান্য সংখ্যক পাঠকমাত্রেই জানেন যে আমি সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতায় সবিশেষ অনুরক্ত। তবে প্রিয় কবিতা বাছার ক্ষেত্রে আমি ধ্রুপদী আঙ্গিকের চেয়ে ধ্রুপদী ভাবনাকেই বেশি প্রাধান্য দিই, যার জন্য ওয়াল্ট হুইটম্যানও আমার প্রিয় কবিদের অন্যতম। ঠিক যেমন করে হিমেনেথের ‘Platero and I’ আমার অন্যতম প্রিয় কবিতার বই।
যেহেতু আমি কবিতার ব্যাপারে ভয়ানক সংস্কারাচ্ছন্ন, নাকউঁচু, তাই আমার সমসময়ের অধিকাংশ কবি এবং কবিতাকে আমি করুণাই করে এসেছি চিরকাল। যতই তারা হাততালি পান, যতই তারা বগল বাজান মিডিয়ায়, আমি ফিরে দেখারও প্রয়োজন বোধ করিনি। আমার খুব সৌভাগ্য যে অল্প হলেও আমার সমসময়ে আমি এমন কয়েকজন কবিবন্ধুকে পেয়েছি যারা কবিতার ব্যাপারে আমার মতোই বা আমার চেয়েও বেশি সংস্কারাচ্ছন্ন, আমার মতোই, তারাও ধ্রুপদী চিন্তনে ধারাবাহিক আস্থা রেখে আসছে। সেই সূত্রেই হয়তো কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়েছিল আমাদের, যার ফলে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে লাভ হয়েছে হয়তো সবারই। 


প্রশ্ন ৫) তোমার দশকের কবিতা নিয়ে তোমার মতামত কী?

উত্তর— অন্যান্য দশকের মতোই, নয়ের দশকের কবিতাকেও আমি স্পষ্ট দুটো ধারায় ভাগ করতে পারি। একদল গোড়া থেকেই দাদা-ধরা, প্রতিষ্ঠানমুখী, যশলোলুপ। নাচন-কোঁদন যা কিছু করেই হোক না কেন, নাম তাদের করতেই হবে। তাই তারা প্রথম থেকেই খাঁটি কবিতার ধারেকাছে ঘেঁষেনি কোনও দিন। বরং কবিতার শরীর ধার নিয়ে তারা লিখেছে সমসাময়িক বাজার অনুমোদিত চলতি-বিষয় এবং চালু-ভাষা অবলম্বনে বিচিত্র কিছু ছড়া। যেহেতু যোগ্যতার পরিবর্তে তাদের যোগাযোগ দক্ষতাই ছিল প্রধান সম্বল, তাই তেলখোর দাদাবাবুদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাই ছিল বেশি। সময় মতো তারা তার স্বীকৃতিও পেয়েছে। নয়ের দশকের প্রধান কবি হিসেবে তাদেরকেই চিনেছেন সাধারণ অভাগা মানুষ।
অথচ এই নয়ের দশকেই লেখা হয়েছে এমন কিছু কবিতার বই, যার যথাযোগ্য সংকলন হলে জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারণা অনেকটাই বদলে যেতে পারে। যেসমস্ত কবিতার বই, তুমি চাইলে, পৃথিবীর যে কোনও সেরা কবিতার বইয়ের পাশাপাশি রেখেও পড়তে পারো। সেইসমস্ত অনামজাদা কবি, নিজেদের মনের আনন্দে মগ্ন হয়েই কবিতা লিখে চলেছে এখনও। ক্ষমতাবান দাদা-বাবুরা তাদের নানান লোভ দেখিয়েও বশে আনতে পারেননি। অথচ সেই বাবুসমাজ প্রবলভাবে চেয়েছিলেন, নিজেদের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী করার খাতিরে এইসমস্ত শক্তিশালী পথের কাঁটা যেনতেন ভাবে সরিয়ে ফেলতে। তার জন্য তাঁদের উদ্যোগের কোনও অভাবও ছিল না। তারপরেও তাঁরা বিশেষ পাত্তা তো পানইনি বরং উপেক্ষিতই হয়েছেন বারবার। তাই তাঁরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে এমন কিছু বন্ধ্যা ছড়াকারকেই বসিয়েছেন, যারা হাজার বছর রাজা হয়ে বসে থাকলেও পূর্ববর্তী সম্রাটের প্রভাব লঘু হবে না একফোঁটাও। 
কিন্তু আমি বলি কী, এইসব ছকবাজি তো আজকের নতুন ব্যাপার নয়, তারপরেও জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালদের কোনোভাবেই আটকে দেওয়া গেছে কি? নয়ের দশকের অনালোচিত কবিদের মধ্যে অন্তত এমন তিনজন এখনও লেখার ভেতর আছে, যারা নিজেদের সমকালীন কাব্য-ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে একদিন। কারণ আমি যাদের কথা বলছি, তাদের লেখায় রয়েছে সেই অতিদুর্লভ Sense of eternity, যা খাঁটি কবিকে, মৃত্যুর ২০০ বছর পরেও আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। উল্টোদিকে, সমসাময়িক উত্তেজনাপ্রসূত কবিতা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফিকে হয়ে আসে আপনাআপনি।   


প্রশ্ন ৬) পরবর্তী কবিদের লেখাকে কী চোখে দেখছ?

উত্তর— নয়ের দশকের কবিতা সম্পর্কে যা বললাম, তা শুধু নয়ের দশকেরই গল্প তো নয়, সাতের দশকেও এই একই গল্প ছিল, যা আজ সময়ের ব্যবধানে খুবই প্রকটভাবে পরিস্ফুট। কিন্তু নয়ের দশকে এসে সেই গল্পের প্যাটার্ন বদলেছে। আবার এই শতাব্দীর কবিদের মধ্যেও সেই একই ট্রেন্ড আমি লক্ষ করছি। একদল নির্লজ্জভাবে তেল দিচ্ছে প্রকাশ্যে, আবার একদল এসব থেকে সচেতনভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের কবিতায় সাধনার পরিসরকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নয়ের দশকের তুলনায় এই গল্পের প্যাটার্নও আবার বদলে গেছে অনেকটা। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে আজকের এই প্যাটার্ন চেঞ্জ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল নয়ের দশকে কম্পিউটার এবং গ্লোবালাইজেশনের আবির্ভাব। কিন্তু যদি তুমি শাশ্বতের ধারণা থেকে বিষয়টা দ্যাখো, তাহলে দেখবে, খণ্ডচিত্রগুলোর বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও আসলে মূল বিষয়টা থেকে গেছে একই। যোগ্যতার তুলনায় যোগাযোগ দক্ষতার কদর যে কোনও যুগেই বেশি। অথচ কবিতার ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি তাতে বিশেষ। ক্ষতি হয়েছে পাঠকের, পাঠরুচির। পাঠক নিজের সমকাল থেকে ক্রমশই পিছিয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবির খোঁজ পাওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাচ্ছে তার আহ্লাদের আয়ুষ্কাল।


প্রশ্ন ৭) সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে তোমার ভাবনার জায়গাটা ঠিক কী?

উত্তর— আমার এযাবৎ কথাবার্তা থেকে এটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে যে ‘সমকাল’ বিষয়টা আমার কাছে ‘চিরকাল’-কে চেনারই একটা উপকরণমাত্র। সমকালীন ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব জুড়েই যে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধের রাজনীতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, নাক্ষত্রিক উচ্চতা থেকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীতে এসব কোনও নতুন ঘটনাই নয়। এর মধ্যেও যা শাশ্বত, তা হচ্ছে একশ্রেণির শোষণ আর এক শ্রেণির শোষিত হওয়ার ইতিহাস, যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সভ্যতার পর সভ্যতাব্যাপী। সেই নিয়মেই মার খেতে খেতে আজও জেগে উঠছে দলিত সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায়... ধারাবাহিক আত্মহত্যার বিষাদ কাটিয়ে দীর্ঘতম মিছিল থেকে ডাক পাঠাচ্ছে কৃষকসমাজ... সমকালীন রাজনীতি আমাকে এমনই কিছু চিরকালীন বার্তা দিয়ে যায়, যা দলগত রাজনীতির ধারণা থেকে বহু দূরের ব্যাপার। সম্ভবত অন্য পৃথিবীর। 


প্রশ্ন ৮) বিশ্ব-পরিস্থিতি, মানে প্যালেস্তাইন, গাজা, এসব তোমার লেখাকে প্রভাবিত করে?

উত্তর— এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কবিতাই বরং উদ্ধৃত করতে চাই, তা থেকেই যা বোঝার বোঝা যাবে আমার ধারণা—
আতঙ্কবাদীকে লেখা চিঠি
আসুন আতঙ্কবাদী, পৃথিবীর ক্ষীণ শেষবেলায়
সিরিয়া ভারত ফ্রান্স বাংলাদেশ কিংবা কেনিয়ার
যেকোনও সূর্যাস্ত-প্রান্তে দু’মিনিট একটু বসা যাক;
লুটিয়ে ঘাসের গায়ে আগ্নেয়াস্ত্র, নিশ্চিন্তে বসুন।

দিনের ওপারে যায় দেখুন কীভাবে দিনমণি;
কীভাবে সমস্ত তেজ ত্যাগ-মন্ত্রে করে সম্বরণ;
কেননা তাকেও সরে যেতে হয়, রাতের হাতেই
সন্তানের, সভ্যতার, প্রতিপালনের ভার দিয়ে।

তিনি কি পারেন না নিজ-তেজে হতে আত্মঘাতী ছাই?
তিনি কি পারেন না রাগে অন্ধ হয়ে চির অন্ধকার
করে দিতে এ জগত?    বিশেষত এই আমাদের
লোভ হিংসা ব্যাভিচারে রক্তারক্তি সংসার যখন...

তা তো তিনি করেন না কখনও; সে কি তেজের অভাব?
বরং সৃষ্টির ধর্ম এই তার, প্রেমধর্ম, স্নেহধর্ম এই...
তেজের মহিমা শুধু সম্বরণে হয় ফলপ্রদ;
ফলস্বরূপ সেই শিশু, আপনারও কি তেজঃবীর্যে নেই?


প্রশ্ন ৯) সাম্প্রতিককালে শঙ্খবাবু আর সুমনকে নিয়ে তোমার করা মন্তব্যে প্রচুর বাদ-বিবাদ হয়। এই দুই ব্যক্তিত্ব এবং তাদের কাজ বিষয়ে তোমার মতামত ঠিক কী?

উত্তর— শঙ্খ ঘোষ, একজন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক, সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে আমার কাছে বরাবরই শ্রদ্ধেয়। ওঁর বিষয়ে শুধু দুটো কথা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়। প্রথমটি হল— শঙ্খ ঘোষের কবিতা। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ বইটিতে আমি একজন সংবেদনশীল প্রেমিকের দেখা পাই, বৃহদর্থে ব্যথা পাই আনন্দ পাই তার ছোঁয়ায়। কিন্তু তার পর থেকেই আমি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় পেতে শুরু করি সামাজ-শিক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত  একজন আচার্যকে। যিনি প্রচার করে চলেন নানান সামাজিক বার্তাসকল। সমসময়ের কাছে সাময়িক গুরুত্ব পাওয়া ছাড়া বৃহত্তর কাব্য-ইতিহাসে যাদের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই বলেই আমার মনে হয়। ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ যিনি লেখেন তিনি যদি এমন সমাজসর্বস্ব হন, তাহলে তো লোকে ওঁর সম্পর্কে আলবাত বলবে-- সামাজিক বড়ো, মূর্খ নন মোটেই। হ্যাঁ, কবিতায় মূর্খের বিস্ময়, শিশুর বিস্ময় অবশ্যম্ভাবী শর্ত বৈ কী। একমাত্র ত্রিকালদর্শী স্থিতপ্রজ্ঞ লেখক ছাড়া, কাউকেই কবিতায় অত দায়িত্ববান দাদাবাবু হলে চলে না।  দ্বিতীয়টি হলো— একজন মানুষ, যাঁর জীবনে অধ্যাত্মবাদের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই, উপরন্তু, অধ্যাত্মবাদ প্রসঙ্গে যাঁকে নানারকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও আমি প্রত্যক্ষ করেছি স্বয়ং, তিনি সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথকে ঠিক কী চোখে দেখলেন, সেটাই আমি ভেবে পাই না। অথবা রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞই বা হয়ে উঠলেন কোন ম্যাজিক, কোন মন্ত্রবলে? কেননা রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম প্রকৃতি সমাজ, সবের ভেতর দিয়েই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ। অধ্যাত্মবাদের অর্থ যে পূজা-অর্চনা-ব্রত-রোজা-নমাজেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটাতেও একটা গভীর আধ্যাত্মিক বিস্ময় আছে। এসব আড়াল করার চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথকে আদৌ বোঝা যায় কি? অথচ শঙ্খবাবু যেন সারাজীবন সেই ব্যর্থ চেষ্টাই চালিয়ে গেলেন। কিন্তু ওঁর ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘শব্দ আর সত্য’ ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ জাতীয় প্রবন্ধের বই কিংবা ধরো, ‘সকালবেলার আলো’, ‘সুপুরিবনের সারি’ জাতীয় গদ্যরচনা আমার বিশেষ প্রিয়। এমনকী প্রাবন্ধিক হিসেবে ওঁর অভিভাবকত্বও আমার কাছে খুবই প্রার্থনীয়। ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ বইটি আমার সারাজীবনের পাঠক্রমে চির অমলিন হয়ে থাকবে, এ আমার স্থির বিশ্বাস।
কবীর সুমন আমার কাছে একটা ট্র্যাজেডি। আমি সুমনের আবির্ভাব থেকেই ওঁর গানের পরম ভক্ত। ওঁর লিরিক তুলনাহীন, ওঁর বিচিত্রগামী সুরের ধারণাও আমাকে বেশ অবাক করত। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল থেকে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত, সবরকম সুরেই ওঁর গানের গতিবিধি দেখে মুগ্ধ হতাম খুবই। কিন্তু লোকটা নিজের সীমা জানেন না। জানেন না, উনি ছাড়াও নানান মানুষ এখনও এই বাংলায় জীবিত আছেন যাঁরা নিয়মিত উঁচু দরের গানবাজনার খবর রাখেন। ওঁকে, শিল্পী হিসেবে আমি তবু হয়তো শ্রদ্ধা করতে পারতাম, যদি উনি এই বুড়োবয়সে বাংলা খেয়ালের নাম করে নিজের দুর্বিনীত অযোগ্যতার বদ-ঢেঁকুরটি না তুলতেন। উনি এত জানেন, আর এটা জানেন না যে ধ্রুপদী সংগীত মঞ্চে উঠে গাইতে গেলে গুরুকৃপা চাই, দীর্ঘদিনের সাধনামগ্ন তালিম চাই। ওঁর তো এসব কিছুই নেই। গলা থেকে সুরও বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। তারপরেও যদি কোনও যশলোলুপ বামন চাঁদে হাত দিতে চায়, তার সম্পর্কে আর কীইবা বলার থাকতে পারে?
আর ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুমন সবদিক থেকেই অতি নিকৃষ্ট, অতি ধান্দাবাজ। তাই ব্যক্তি সুমন সম্পর্কে আমার কিছুই বলার ছিল না কোনও দিন, আজও নেই।


১০) তোমার এবং তোমার বন্ধুবৃত্তের কবিদের নিয়ে একধরণের কথা বাংলা কবিতা-বাজারে প্রচলিত।সেটা হল যে,তোমরা জীবনানন্দ, বিনয়ের অনুসারী এবং যখন তোমরা এক বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে যাও তখন একই সঙ্গে একই দিকে চলো। এই অভিযোগ সম্বন্ধে কি বলবে?

উত্তর— অভিযোগটি আংশিক সত্য বৈ কী। তবে সেই অংশটা এতই নগণ্য যে তা নিয়ে কখনও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে ভাবিনি। নয়ের দশকের শেষের দিকে জীবনানন্দের কাব্যে নানান আবিষ্কারের আলো এসে পড়ছিল, যার ফলে তখন জীবনানন্দের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের কাছেও বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছিল। আমার ধারণা, তরুণ কবিদের ওপর অত বড় একজন কবির প্রভাব পড়াটাই সুস্থতার লক্ষণ। তাছাড়া আমরা দেখেছি গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের অধিকাংশ প্রধান কবির লেখায় জীবনানন্দ অনুসারী হবার প্রবণতা স্পষ্ট। শক্তি বিনয় উৎপল এই তিন প্রধান কবিই ভাষাগত দিক থেকে এবং আংশিকভাবে ভাবের দিক থেকেও, স্পষ্টতই জীবনানন্দ অনুসারী। আগুন থেকেই তো আগুন জ্বলে। আর বিনয়ের কবিতা বিষয়ে আমাদের বিশেষ শ্রদ্ধা তখনও ছিল, এখনও আছে। এই পর্যন্ত অভিযোগকারীদের সঙ্গে আমি একমত।
অভিযোগটির নগণ্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এইবার। যারা অভিযোগটি করেন, তারা তাদের আংশিক অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এই খবরগুলি সংগ্রহে রাখতে ভুলে গেছেন যে ‘গান্ধার’ পত্রিকা গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়, উৎপলকুমার বসুর কবিতায় গভীর ভাবে আচ্ছন্ন থেকেছে দীর্ঘকাল। আরও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে চাই এই প্রসঙ্গে। কফি হাউসের ওই আড্ডায় যোগ দেওয়ার পরেই আমি জানতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একজন বড় কবি, অবশ্যমান্য কবি। তার আগে পর্যন্ত তো আধুনিকতার ধ্বজাধারীরা আমাদের কানে অনবরত মন্ত্র দিয়ে চলতেন যে রবীন্দ্রনাথ অনাধুনিক, তার কাব্যে আধুনিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত নেই, উনি বুর্জোয়া, জমিদার বাড়ির ছেলে, ক্ষুধার্ত সর্বহারা মানুষের জীবন থেকে তাঁর জীবন দর্শন অনেক দূরবর্তী... এইসব...  সুতরাং গান্ধারের কবিগোষ্ঠী যে শুধু জীবনানন্দ দাশ বা বিনয় মজুমদারের অনুগামী ছিল তা একেবারেই নয়, তাদের চেতনায় বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের বহু শ্রেষ্ঠ কবির প্রভাবই কাজ করেছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও বলছি, কবিতা কোনও দলগত কাজ নয়। হয়তো সেকারণেই আমাদের গোষ্ঠীটিও অবলুপ্ত হয়েছে একদিন। না কোনও ঝঞ্ঝাট ঝামেলা নয়। অয়ন চক্রবর্তী ছিল তখন ওই আড্ডার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।  অয়ন ব্যস্ত হয়ে পড়ল সাংবাদিকতার কাজে। অন্যান্যরাও জীবিকার তাড়না অনুভব করল একে একে। ফলে সেই আড্ডা নিয়মিত ধরে রাখার মতো পরিস্থিতি আর রইল না। যদিও তার রেশ, একটা টেবিল ঘিরে এখনও আছে, কিন্তু তা আর আগের মতো কবিতাপ্রধান আড্ডা নয় মোটই।
দলের কথা তো গেল, এবার নিজের দু’একটা কথা বলি। আমি বাংলা কাব্যে চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ সুধীন্দ্রনাথ শক্তি বিনয় যুগান্তর পার্থপ্রতিম প্রমুখ এবং বিশ্ব কবিতায় রুমি, জিব্রান, কিটস্‌, ব্লেক, ইয়েটস্‌, হুইটম্যান, পুশকিন, বোদলেয়ার, রিলকে, পাস্তেরনাক, ফ্রস্ট, হিমেনেথ প্রমুখ কবির কবিতার অনুসারী। আমার প্রভাবিত হওয়ার ধরনটি সর্বগ্রাসী। পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ কবির দ্বারা, এমনকী অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার জন্য আমার মন সবসময়ই উদগ্রীব হয়ে থাকে।


প্রশ্ন ১১)কবিতা লিখে রাষ্ট্রের পুরস্কার বা পত্রিকা গোষ্ঠির পুরস্কার, এগুলো নিয়ে কী ভাবো?

উত্তর—পুরস্কার নিয়ে এখন আর কিছুই ভাবি না। আগে একসময় ভাবতাম, যখন মনে করতাম, কবিতায় পুরস্কার দেওয়া হয় ভালো লেখার জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত এইসব রাষ্টীয় এবং পত্রিকাগোষ্ঠীসমূহের দেওয়া পুরস্কারের সার্কাস দেখতে দেখতে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে ভালো লেখার জন্য কোনও পুরস্কারই দেওয়া হয় না আদৌ, তার পেছনে অন্য নানান সমীকরণ কাজ করে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাবান ব্যক্তির তাঁবেদারি না করে, আমাদের রাজ্যে বা দেশে, কেউ কোনও পুরস্কারই পায় বলে আমার মনে হয় না। কেউ কেউ যদি দৈবাৎ পেয়েও যায় বা যান, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম বলে ধার্য হওয়া উচিত। সুতরাং কেউ পুরস্কার পেলেও পেল, না পেলে না পেল, নিলেও নিল, না নিলে না নিল, ব্যাপারটা এইরকম। কেননা পুরস্কার ব্যাপারটা এতোই বাহ্যিক যে সেটা নিয়ে না ভাবলেও কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই।


প্রশ্ন ১২) তোমার নিজের লেখা সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়, মানে নিজের ক্ষমতা নিয়ে, সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছু ভেবেছ?

উত্তর—নিজের ক্ষমতা নিয়ে নিজে মুখে কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। কারণ আমি আগেই বলেছি, কবিতা আমি লিখিনা, বরং কবিতাই আমাকে রচনা করে স্বয়ং। আমার কাজ আধার হিসেবে নিজেকে নিমগ্ন রাখা। সেটা হতে পারে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের মাধ্যমে, আগ্রাসী কবিতা পাঠের মাধ্যমে, অন্যান্য পড়াশুনোর মাধ্যমে, ছন্দ শিক্ষার মাধ্যমে, গান শোনার মাধ্যমে, ফুটপাথে ফুটপাথে অকারণ ঘুরে ফেরার মাধ্যমে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে, নিভৃত কোনও অবকাশে আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে, আত্মবিলোপের মাধ্যমে। সেই প্রসঙ্গে আজ এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এখনও পর্যন্ত আমার কবিতাজীবনে সীমাবদ্ধতা বিপুল। জীবন যে অফুরন্ত ভাণ্ডার আমার সামনে মেলে ধরেছে এযাবৎকাল, তার খুব কম অংশই আমি সার্থক কবিতা হিসেবে ধরে রাখতে পেরেছি। আসলে কবিতার জন্য যে সমর্পণের জীবন দরকার, তা আমি গত কয়েকবছর সার্বিকভাবে যাপন করে উঠতে পারছি না। জীবিকার তাড়নাতেই জীবনের অনেকটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। লিখেওছি সেই কথা। ‘স্বপ্নে আগুনের মন্ত্র দিয়েছিলে / জ্বালানি কুড়োতেই জীবন জেরবার’। ফলে আধার হিসেবে নিজেকে সবসময় টনটনে সজাগ রাখার অবকাশ না পাওয়া, আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা এখন। আগে বহুদিন সেই যাপন করতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও পারব আশা রাখি। তখন এই বর্তমান সীমাবদ্ধতাও অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পারব, আমার ধারণা। অন্তত কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা তো করবই। দেখা যাক জীবন সেই সুযোগ আমাকে আদৌ দেয় কিনা, বা দিলেও, কবে দেয়। 

মতামত ব্যক্তিগত



অবসর গৃহীত হয় না, দেওয়া হয়


আমাদের গৃহবাড়ি তত কি আর আদর্শ ভাষায় কথা বলে?
এখানে বক্তা খুবই সংকুচিত থাকে কেননা
অবসরপ্রাপ্তদের হতে নেই যথেষ্ট মননশীল, ভোঁতা
অনাক্রমণ চুক্তি তারা করে নেয় নিজে নিজে
পেশি নেই, পালানোর বয়স গিয়েছে বহু দূর,
বিবাহ ছাড়া বিবাহবার্ষিকীতে থাকে না কেউ
পরিবেশ থেকে পরি নামে রোগবাহী বাদুড়ের মতো
আমি চাই, যারা অসফল, ঘুমলোভী অথচ বখাটে
যারা মাছের তৈলে ভাজে তেলাপিয়া, গাঁদা ও পুস্তক
যাদের লজ্জাবোধ সৃজনশীল নয় তবু
মুখ টিপে, নিঃশব্দে হাসে
তারা যেন কৃষিকাজ শিখে নিতে পারে, অন্তত
সুতো কাটা, জাহাজ নির্মাণ
গেরস্তের দ্বীপ থেকে পালাবার অসহায় যান
পাওয়ার দরকার আছে মগ্ন হ্রদ, কোনো এক নদী
প্রায়শ মরার আগে মরতে চাও যদি

জিয়া হক 

সিসিটিভি: একটি ছোট্টগল্প


লোকটা চুপ করেই ছিল। সাদা লিনেন প্যান্ট, নীল টি শার্ট, স্লিপার্স জুতো, হাতে সোনাটা ঘড়ি। চোখে চশমা নেই। চুল খুব পরিপাটি নয়, তবে আগোছালোও নয়। চুলে হালকা পাক ধরেছে। জুলফির ধারটা প্রায় সাদা।
তিনি বেশ মৃদু ভাবে বললেন, তোমাদের এমনটা মনে হচ্ছে কেন?
কফিশপটা ছোট। সবাই সবাইকে দেখতে পায়। সোফা দিয়ে ছোট ছোট ঘেরাটোপ করা। সোফার সামনে একটা করে কাচের টি টেবল। তাতে সুন্দর ফুলদানি। অজানা ফুল ঘাড় ঘুরিয়ে রয়েছে।
একজন বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, মানে?
বিস্মিত হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রতিবেশি টেবিল থেকে কেউ হঠাৎ আগ বাড়িয়ে আলোচনায় ঢুকে পড়লে অবাক হওয়া যায় বৈকি।
লোকটা বললেন, আমি আপনাদের আলোচনা মন দিয়ে শুনছি অনেকক্ষণ ধরে।
পাশের ঘেরাটোপে তিন জন বসেছিলেন। শুভঙ্কর—একজন সাংবাদিক। প্রমোদ—একজন স্কুল শিক্ষক। জয়—একজন কলেজের অধ্যাপক। প্রথম কথাটি বলেছিলেন শুভঙ্করই।
আমাদের ভাবনায় সমস্যাটা কোথায়? জানতে চাইলেন প্রমোদ।
লোকটা বললেন, কফিশপে এসব নিয়ে আলোচনা আমি করতে চাই না। একদিন আমার বাড়িতে আসুন আপনারা।
ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর কি কিছু লাগবে আপনার?
না, বিল দিয়ে দিন, বলে উঠে পড়ার আগে তিনটে ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে গেলেন শুভঙ্করের হাতে।
শপের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলে কার্ডের দিকে নজর দিল তিন জন। তাতে লেখা—অনির্বাণ মুখার্জি, ১২ বি ফুলতলা রোড, কলকাতা ৩২। লোকটা কী করেন, কী পড়াশুনো করেছেন, যোগাযোগের ফোন নম্বর—কিছুই লেখা নেই। অদ্ভুত একটা ভিজিটিং কার্ড।
তিন জন পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
কোনও মানে হয় না। প্রমোদ বললেন।
জয় জানতে চাইলো, মানে?
মানে, ওর বাড়ি যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।
তিন জনই সায় দিল—নাহ, এভাবে কোথাও, কখনও যাওয়া অনুচিত।

খ।
পরের দিন শনিবার। আকাশ পরিষ্কার। শরৎকালের আকাশ। গাভীর মতো মেঘ চরছে আকাশে তবে সেই মেঘ দুগ্ধবতী নয়।
অনির্বাণবাবু তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, কে আসতে পারে আজ? সেদিনের কফিশপের চশমাপরা ছেলেটিই আসবে।
কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেল।
দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলেন, গেটের খাঁজে খবরের কাগজ গোঁজা আর ঠিক গেটের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে চশমাপরা ছেলেটা।
গুড মর্নিং, শুভঙ্কর বললেন।
সুপ্রভাত। দাঁড়ান, গেট খুলছি, বলে ভেতরের গেটটা প্রথমে খুললেন অনির্বাণবাবু।
সকালে এখানে গরম সিঙাড়া ভাজে দেখলাম, তাই আপনার জন্য কয়েক পিস নিয়ে এলাম, সিঙাড়া খেতে আপত্তি নেই তো? শুভঙ্কর জানতে চাইলেন।
মৃদু হেসে অনির্বাণবাবু বললেন, একেবারে অপরিচিত লোকের আনা জিনিস তো আমি খাই না শ্রী...
আমি শুভঙ্কর। শুভঙ্কর মজুমদার।
আসুন শুভঙ্করবাবু। আমার এই কুটিরে আপনাকে স্বাগত।
খবরের কাগজটা টেবিলের ওপরে রাখলেন ভদ্রলোক। ঠিক দুই গ্লাস জল খেলেন। তারপর নিজের বিছানায় পা মুড়ে বসে গায়ে একটা ফিনফিনে সাদা চাদর জড়িয়ে বললেন, আমি জানতাম আপনি আজ আসবেন।
সিঙাড়াটা তখনও হাতে ধরে রয়েছেন শুভঙ্করবাবু। মুখে খানিকটা বিস্ময়,  আপনি জানতেন আমি আসব?
হ্যাঁ, আপনাকেই আগে আসতে হতো।
এবার শুভঙ্করবাবু তাঁর সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে ফিরে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আরো দু জন ছিল। তারা নয় কেন?
অনির্বাণবাবু বললেন, সিঙাড়াগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখুন। চা খাবেন?
অপরিচিত কারো কাছে আমি চা খাই না, শুভঙ্করবাবু বললেন।
আপনি আমাকে নকল করছেন শুভঙ্করবাবু। বি ইয়োরসেলফ। মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।
আপনি এখনও আমার কথার জবাব দিলেন না।
দাঁড়ান, তার আগে চা-টা বসিয়ে দিই। আমার কোনও কাজের লোক নেই।
বিয়ে করেননি?
বৌকে কি কাজের লোক মনে করেন?
এমন আসতে পারে শুভঙ্করবাবু বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন।
রান্না, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার যাওয়া—সব আমাকেই করতে হয় বলে আমার ঘরে সব জিনিস দেখুন অল্প। আমরা তখনই সব অতিরিক্ত করি যখন আমাদের অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার সামর্থ্য থাকে।
শুভঙ্করবাবু এবার নিজের ফর্মে ফিরে এলেন। বললেন, সব ঠিক আছে কিন্তু আপনার সব একটু আমার অদ্ভুত ঠেকছে মশাই।
নির্বিকার মুখে মন্থরভাবে অনির্বাণবাবু বললেন, এর জন্য দায়ী সেট থিয়োরি।
সেট থিয়োরি? আলগা কৌতূহল জেগে উঠল শুভঙ্করবাবুর মুখে।
এটা এমন কিছু নয়, খুবই সিম্পল। আসলে জগৎ সম্বন্ধে আমাদের ধারনাগুলো ধীরে ধীরে এমন বাঁধাধরা হয়ে যায় যে তার বাইরে কোনও কিছু দেখলে তাকে অদ্ভুত মনে হয়। আমারও এমন মনে হত।
এখন আর হয় না বলছেন?
না।
একটা অবিশ্বাস ফুটে উঠল শুভঙ্করবাবুর চোখে।
অবিশ্বাস্য ঠেকছে তো? অস্বাভাবিক নয়। এটা একটা প্র্যাকটিস। এর জন্য একটু উদাসীনতা দরকার। আর কী দরকার জানেন?
কী? বেশ গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন শুভঙ্করবাবু।
সব কিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বন্ধ করা। অনির্বাণবাবু তার ইলেকট্রিক কেতলি থেকে কাচের কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন শুভঙ্করবাবুর দিকে।
পারফেক্ট টি বললে কম বলা হয়। যথাযথ চিনি, যথাযথ লিকার। দুধ নেই। দুধে বায়ুরোগ হয়।
আপনি কি সাইকোলজিস্ট? আপনার কার্ডে তো কিছুই লেখা ছিল না... আমতা আমতা করে শুভঙ্করবাবু জানতে চাইলেন।
না, আমি সাইকোলজিস্ট নই, আমি সাইকায়াট্রিস্ট। হেড স্রিঙ্কারও বলতে পারেন, এই বলে মুচকি হাসলেন অনির্বাণবাবু।
হেড স্রিঙ্কার কেন হতে যাবেন?
না, ইউরোপ, আমেরিকায় সাইকায়াট্রিস্টদের এই নামে ডাকার চল রয়েছে। যাইহোক, আপনি তো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াতে চেয়েছিলেন?
এই কথা শুনে শুভঙ্করবাবু নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ অনির্বাণবাবুর মুখের দিকে। সত্যিই তো তিনি কখনও সাংবাদিক হতে চাননি। হতে চেয়েছিলেন প্রফেসর। নামের আগে ডক্টর ডিগ্রি। শুধু প্রফেসর নয়, জনপ্রিয় প্রফেসর হতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হল কই। কয়েকবার নেট-সেট দিয়েও পেলেন না। তেমন যোগাযোগও ছিল না। কিন্তু এ সব কথা ইনি জানলেন কী করে। নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, আমি যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই না তা কি করে জানলেন?
না, তা হতে পারে না, আপনাকে যতটুকু স্টাডি করেছি তাতে এটুকু আমি নিশ্চিত, তবে সরি, আজ আমাকে এখন উঠতে হবে। পরে কখনও কথা হবে।
চেম্বারে যাবেন নাকি?
না, আমার কোনও চেম্বার নেই, তবে চেম্বারের বাইরেও প্রচুর পেশেন্ট থাকতে পারে। থাকতে পারে কেন বলছি, আছে।
তবে আমি কী করি তা তো আপনি বললেন না।
সেটা বলা আমার কাজ নয়, আমি মিসির আলি নই। তবে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনও কাজই করেন।
শুভঙ্করবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি সাংবাদিক। আরম্ভ কাগজে আমি ক্রাইম বিট-টা দেখি।
আরম্ভ এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বহুল প্রচারিত প্রথম সারির দৈনিক কাগজ। শুভঙ্করবাবুর বেতন কম করে ৪৫ হাজার টাকা।
আপনি যে এসেছিলেন, সে কথা আপনার বন্ধুদের বলবেন না। বেশ গাঢ় স্বরে বললেন ভদ্রলোক।
একটু অবাক হয়ে শুভঙ্করবাবু বললেন, কেন?
বললাম তো, বলবেন না। ব্যাখ্যা দিতে পারব না। তবে তারা আপনার ভালো চায় না। এতটুকুই। এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু বলি, তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।
কী বলেছে তারা আমার নামে? আপনি কি সত্যিই এখন বেরবেন?
না, এখনই বেরব না, প্রথমে পেপার পড়ব। তারপর আরও কিছু কাজ আছে, সেগুলো সারবো, তারপর বেরবো। তবে এবার আপনাকে উঠতেই হবে। আর হ্যাঁ, সিঙাড়াগুলো রেখে যান। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। এখন খেতে পারি।

গ।
আজকের আরেকজন আসবেন। কে আসতে পারে? রবিবার সকালবেলা বিছানায় একই ভাবে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন অনির্বাণবাবু। তাদের ভাবনার সমস্যা কোথায় জানতে চেয়েছিল যে ছেলেটি সে আসবে। তাঁর যা বয়স তাতে করে এই তিন জনকে লোক না বলে ছেলেই বলতে পারেন। বেশি বয়সের কিছু সুবিধা রয়েছে।
কিছুক্ষুণ পরে প্রমোদ এসে ঢুকলো অনির্বাণবাবুর শোবার ঘরে। আগের দিন যেভাবে বসেছিলেন সাদা চাদর জড়িয়ে ঠিক সেইভাবে বিছানায় বসে রয়েছেন ভদ্রলোক। সামনের বেতের চেয়ারে শুভঙ্করের বদলে প্রমোদ। শুরুতেই প্রমোদ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্কুলে পড়ান।
কেউ কোনও তথ্য দিলে অনির্বাণবাবু নির্বিকারভাবে শোনেন। কোনও প্রত্যুত্তর করেন না। যেন তিনি সবই জানেন। নতুন করে কেন বলা।
প্রমোদবাবু শুরুতেই বললেন, আমাদের সেদিনের আলোচনায় আপনি দূর থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আমি এটা করে থাকি।
অন্যের কথা শোনাকে আড়িপাতা বলে আর আড়িপাতা অন্যায় তা কি জানেন না? প্রমোদ বেশ গড়গড় করে বলে যান।
না, ওটা আড়িপাতা ছিল না।
কেন?
কারণ আপনারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। আড়িপাতার সংজ্ঞা একটু আলাদা।
প্রমোদবাবু একটু দমে যান। তিনি এরপরে কী বলবেন মনে মনে সাজাতে থাকেন।
অনির্বাণবাবু এই ফাঁকে বললেন, আমি এরকমটা করে থাকি। তবে আড়ি  পাতি না। তা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। এই বলে ইলেকট্রিক কেতলি থেকে চা ঢেলে প্রমোদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এই নিন বৈদ্যুতিন টি।
অনির্বাণবাবু চায়ে সামান্য চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি তো স্কুল শিক্ষক কিন্তু হতে তো চেয়েছিলেন কোনও মিডিয়া হাউসের বড় কর্তা।
এই কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন প্রমোদবাবু। এ তো এক্কেবারে ঠিক কথা। স্কুলে চাকরিতে ঢোকার আগে কম করে হলেও চোদ্দটা মিডিয়া হাউসে তিনি পরীক্ষা, ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তার মধ্যে আরম্ভ পত্রিকায় তিন বার। প্রতিবারই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন কিন্তু ইন্টারভিউতে গিয়ে কেটে গেছে।
ইতস্তত করে প্রমোদবাবু বললেন, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
এ সব জানা খুব বড় কোনও ব্যাপার না। এই বলে আবার চায়ে চুমুক দিলেন অনির্বাণবাবু।
আপনি কি জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা করেন? প্রমোদবাবু এবার একটু রাগিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন ভদ্রলোককে।
আপনি আমাকে রাগিয়ে দিতে পারবেন না প্রমোদবাবু। এই মানবিক গুণগুলো আমি বহুকাল আগে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।
আপনি কি মহাপুরুষ নাকি? একই রকম উত্তেজিত প্রমোদবাবু।
না, সাধারণ মানুষ। আমার বাবা আমাকে মহাপুরুষ হওয়ার শিক্ষাও দেননি কখনও।
পেশা কী আপনার?
পেশা-টেশা কিছু নেই। লোককে স্টাডি করা আমার কাজ। আমি একজন হেড স্রিঙ্কার মানে সাইকায়াট্রিস্ট।
নিজেকে হেড স্রিঙ্কার বলতে সংকোচ হচ্ছে না আপনার?
বললাম যে, এই সব মানবিক গুণগুলো ছেড়ে বহুকাল আমি বেরিয়ে এসেছি।
খুব বড় মতলববাজরা আপনার মতো করে কথা বলে, তা কি জানেন? প্রমোদ ইচ্ছা করেই এই কড়া কড়া কথাগুলো বলছেন যাতে ভদ্রলোক সত্যিই রাগ, ক্রোধ, লোভ, মোহ, কাম, লজ্জা, এইসব বিষয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কিনা তা জানতে।
ঈষৎ শব্দ করে হাসলেন অনির্বাণবাবু। তাঁর হাতের চায়ের পেয়ালাটা কেঁপে উঠল তাতে করে। বিছানার এক পাশে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে গায়ের চাদরটা আরো একটু আঁটোসাটো করে জড়িয়ে বললেন, মতলব শব্দটির আভিধানিক অর্থ জানেন? জানলে বুঝতেন, সকলেই মতলববাজ। আপনি আমাকে ফেরেব্বাজ বলতে পারতেন। সকলে ফেরেব্বাজ হয় না।
ধীর, শান্ত গলা ভদ্রলোকের। তাতে রাগের লেশমাত্র নেই। কীভাবে সম্ভব এমনটা?
প্রমোদবাবু এবার কথা ঘুরিয়ে বললেন, কিন্তু সেদিন কফিশপে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছিলাম সেখানে ভুলটা কী ছিল?
আজকের মতো আপনার সময় শেষ প্রমোদবাবু। আমাকে একটু বেরতে হবে। পরে কখনও এলে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাবে।
প্রমোদবাবু একটু যেন অপমানিত বোধ করলেন। হাতের চা-টা নামিয়ে রেখে বললেন, বেশ, তাহলে আজ উঠি। কখনও এলে আবার কথা হবে কিন্তু আপনি এইভাবে উত্তর না দিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন না।
আমি কী করতে পারি আর কী পারি না সেটা আমাকেই ডিসাইড করতে দিলে ভালো হয়। ধন্যবাদ আসার জন্য। তবে আপনি যে এসেছিলেন সেটা আপনার বন্ধুদের না বলাই উত্তম।
এক চুমুকও চা না খেয়ে কাপ নামিয়ে রেখে বেগে বেরিয়ে গেলেন প্রমোদবাবু। তাঁকে যদি বলা হতো, আপনার আসার কথা বন্ধুদের বলবেন না, তাহলে তিনি হয়ত বলে দিতেন কিন্তু অনির্বাণবাবু যেভাবে নির্দেশটা দিয়েছেন তাতে তিনি আর বলবেন বলে মনে হয় না। কারণ এই নির্দেশের সঙ্গে আরো একটা কথা জুড়ে দিয়েছেন অনির্বাণবাবু। সেটা হল, আপনার বন্ধুরা কিন্তু আপনার মোটেও ভালো চান না। কারণ তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে খুব নিন্দেমন্দ করে গেছেন।
বিছানার উপর পেপারটা ছড়িয়ে বসে মন দিয়ে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে লাগলেন ভদ্রলোক।

ঘ।
বৃহষ্পতিবার মহালয়ার ছুটি। তৃতীয় বন্ধুটির দেখা নেই। তবে অনির্বাণবাবু জানেন, তিনি আসবেন। আর আজ, এই মহালয়ার দিনেই আসবেন।
একই ভাবে দু জন বসে রয়েছেন—বিছানায় সাদা চাদর গায়ে অনির্বাণবাবু আর তাঁর সামনের বেতের চেয়ারে অধ্যাপক জয়। জয় সরকার। সুন্দর পাঞ্জাবি আর জিন্স। চোখে বেশ বিনয়। হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে কোলের উপর রাখা। জয়বাবুর কপালটা একটু বড়।
অনির্বাণবাবুই কথা শুরু করলেন, কত দিন কিছু লেখেননি?
হ্যাঁ, অনেক দিন কোনও লেখা আসছে না। কিন্তু রোজ রাত বারোটার পর খাতাপেন নিয়ে বসি। জয়বাবু বেশ লাজুকভাবে বলে গেলেন।
আপনার স্ত্রী চান না আপনি লেখালিখি করুন। নারী আর স্ত্রীয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
ঠিক বলেছেন।
আপনার প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। এই যুগে হলে কলকাতাতেই তাঁর ভালো চিকিৎসা হতে পারত।
এবার একটু বিস্মিত হলেন জয়বাবু। তিনি যে নজরুলের কবিতা ভীষণ পছন্দ করেন আর কলেজে নজরুল পড়ান তা তো এই ভদ্রলোকের জানার কথা নয়। তাছাড়া, সবার কাছে তিনি জীবনানন্দের নামই বলেন। খুব ঘনিষ্ঠ মহল ছাড়া তাঁর যে প্রিয়তম কবি নজরুল তা কেউ জানে না।
অনির্বাণবাবু বলে চললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কী বলতে পারেন? তারপরও তাঁকে সেই দেশের জাতীয় কবি করার কোনও মানে ছিল? শামসুর রাহমান, আল মাহমুদরা ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় কবি বলে কিছু হয়? সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতটাই তো অন্য কবির লেখা।
ইচ্ছা করেই এই সব প্রসঙ্গ তুলে আনছেন অনির্বাণবাবু। আসলে তিনি এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনাই করতে চান না। এটা তাঁর একটা কায়দা। অন্তত অধ্যাপকদের জন্য বিশেষ কায়দা তো বটেই। তাঁরা কিছু ভারি ভারি বিষয় নিয়ে না কথা বলতে পারলে, ভাবতে পারলে মনে করেন সময়টা বেকার যাচ্ছে।
গম্ভীর হয়ে ভাবছেন জয়বাবু। হাতে বৈদ্যুতিন চায়ের পেয়ালা। কাচের পাত্রে মদের মতো রঙ।
আপনি কি চাননি কবি হতে, জয়বাবু? খুব বড় কবি। সব পত্র-পত্রিকাতে আপনার লেখা বেরবে। সম্বর্ধনা পাবেন। কবিতা পাঠের আসরে সভাপতির আসন উজ্জ্বল করে বসে থাকবেন।
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কখন মাথা নেড়ে ফেলেছেন খেয়াল করেননি জয়বাবু। চা-টা পাশে একধারে রেখে তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, ঠিকই বলেছেন অনির্বাণবাবু, আমি কবিই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিবারিক কারণে কবিতা লেখা ছাড়তে হয়েছিল এক সময়। নেট পাশ করার জন্য দু বছর লাগাতার পরিশ্রম করেছি। তখন শুধু কোন উপন্যাসে কোন কথাটি কে বলেছে, কোন কবিতার বই কত সালে কততম মুদ্রণ হয়েছে, কোন নাটকে কত নম্বর দৃশ্যে কী ঘটেছে—এই শুধু মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কবিতা তখন হারিয়ে যায়। আজও আমি তাকে খুঁজছি।
আপনি শ্রী গুপ্তর কাছে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন, তাও হল না।
এবার বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে জয়বাবু বললেন, আমার সম্পর্কে এতসব জানলেন কীভাবে বলুন তো?
আপনার গবেষণার বিষয় ছিল বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে নগর।
কী করব, কবিতা নিয়ে সুখময়বাবু কাজ করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই যেটা পাওয়া গেল তাই নিয়েই শুরু করলাম কাজ। কিন্তু আপনি কীভাবে...!
আপনাকে আজ উঠতে হবে জয়বাবু। অন্য কখনও এলে আবার কথা হবে। আমাকে একটু বেরতে হবে। তবে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।
আরেকটু সময় কথা বলা যায় না অনির্বাণবাবু? গলায় ভীষণ কাতরতা জয়বাবুর।
না, আজ আর নয়। আপনি আসুন। তবে আপনি যে এসেছিলেন তা যেন বাকি বন্ধুরা না জানে। কেননা তাঁরাও এসেছিলেন আর আপনার সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ভীষণ কুৎসিত। যাইহোক, ভালো থাকবেন।
আমি আবার আসব।
জয়বাবু অনিচ্ছুকভাবে বেরিয়ে যেতেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। আজকের মহালয়া। পরের দিন কাগজ বন্ধ থাকবে। একটা কাগজে দু দিন চালাতে হবে।

ঙ।
সেই কফিশপে তিন বন্ধু বসে এস্প্রেসোর অর্ডার দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। অন্য দিন শুভঙ্করই প্রথম নানা বিষয় উত্থাপন করে। আজ তার মুখ বন্ধ। আবহাওয়া নিয়েই কথা শুরু করা ছাড়া উপায় নেই যেন।
কালো কফি এস্প্রেসো এলো।
তিন বন্ধু মুখ বুজে কফি পান করে চলেছে। তাদের চোখ পাশের ঘেরাটোপগুলোর দিকে ঘোরাফেরা করছে। কাউকে যেন খুঁজে চলেছে তিন জোড়া চোখ। কিন্তু আজ কফিশপ বেশ ফাঁকা। এক জোড়া তরুণ-তরুণী একে অপরের নাকের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তাদের গায়ের পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে এসির বাতাসে।
প্রমোদই বললেন, কোনও মানে হয় না।
শুভঙ্কর বললেন, সত্যিই কোনও মানে হয় না এর।
জয় বললেন, কী ব্যাপার বলো তো?
ওই অনির্বাণ মুখার্জি না কে, তার বাড়িতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। এরকম অচেনা ফেরেব্বাজ লোকের অভাব আমাদের শহরে কম নেই। যে লোক আড়ি পাতে অন্যের আলোচনায় সে আর যাই হোক সুবিধের লোক নয়। তাও এমন একটা ভিজিটিং কার্ড যেখানে না আছে তার ডিগ্রি, না আছে তার প্রফেশন। আজব। এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন প্রমোদ।
জয় বললেন, ঠিক কথা। এই রকম আনকেনি লোকের খপ্পরে না পড়াই ভালো।
শুভঙ্কর হঠাৎ বললেন, আমরা এক সঙ্গে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম, মনে আছে তোমাদের?
জয় বললেন, সে আর মনে থাকবে না? এই তো বছর খানেক আগের কথা।
ঠিক, বছর খানেকই হবে। সেখানেই আমাদের আলাপ। তার আগে কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতামও না। সূর্যতোরণ হোটেলের লবিতে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আলাপ।
প্রমোদ বললেন, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তখনও কেউ কাউকে ভালো ভাবে চিনিও না।
সবাই চুপ হয়ে গেলেন।
শুভঙ্কর নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে বললেন, আজও কি আমরা পরষ্পরকে ভালো ভাবে চিনি?
এই কথায় আড্ডা আরও শান্ত হয়ে গেল। সত্যিই কি তারা সবাই সবাইকে প্রকৃত চেনা বলতে যা বোঝায়, সেভাবে চেনে? তারা কি এত দিন শুধু বোকার মতো সময় কাটিয়ে এসেছে এক সঙ্গে? শুভঙ্কর যেদিন আরম্ভ পত্রিকায় প্রমোশন পেয়ে ক্রাইম বিটের হেড হল সেদিনের পার্টিতে বাকি দুই বন্ধুর মুখ কি একটু ফ্যাকাশে হয়ে ছিল? যেদিন জয় কলেজের বিভাগীয় প্রধান হল, সেদিন শুভঙ্কর, প্রমোদের মনের অবস্থা কেমন ছিল? সাহিত্য পত্রিকায় যখন প্রমোদের গুচ্ছ কবিতা বেরিয়েছিল, তখন? সবাই মনে করার চেষ্টা করে, কোথাও কি কোনও সমস্যা রয়ে গিয়েছে?
সেদিনের আড্ডা জমল না। কফির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিন বন্ধু। শুভঙ্কর যাবেন এক মন্ত্রীর আমলার বাড়িতে, কিন্তু বললেন, শরীর ভালো নেই, বাড়ি চলে যাবেন রেস্ট নিতে। প্রমোদের যাওয়ার কথা সুকান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের বাড়ি, অথচ অক্লেশে বললেন, তাঁর একটু কেনাকাটা আছে, বাজারে যাবেন। প্রমোদ যাচ্ছেন ‘স্বদেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু বললেন যে মায়ের শরীর খারাপ, তাই তাকেও বাড়ি যেতে হবে।
প্রত্যেকে যে প্রত্যেককে সন্দেহ করছে তা তাদের চোখমুখ দেখে বোঝা যায়।
আরও দু জন তরুণ-তরুণী কফিশপে এসে ঢুকল। তারা বেরিয়ে পড়লেন।
অন্য দিন, পরের দেখা হওয়ার দিন ফিক্সড করে তারপর তারা বেরোন। আজ তারা ভুলে গেল সে কথা।
চুপচাপ তিন জন তিন জনের দিকে হাত তুলল শুধু।

চ।
পাঁচ দিন পর রেজিস্ট্রি ডাকে একটা চিঠি এসে পৌঁছলো শ্রী মুখার্জির বাড়ি। বালিগঞ্জের কোনও একটি এলাকার ঠিকানা উপরে লেখা। দুপুর বেলা। খুব নিস্তব্ধ চারধার।
চিঠি খুলে শ্রী মুখার্জি প্রথমে প্রেরকের নাম দেখলেন। পাঠিয়েছেন শ্রীমতী জয়া সরকার। চিঠির বয়ান খুবই সংক্ষিপ্ত। চিঠিটি এইরকম—
শ্রী অনির্বাণ মুখার্জি শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
আমি অধ্যাপক জয় সরকারের স্ত্রী। আপনার কথা আমার স্বামীর কাছে অনেক শুনেছি। আপনি একজন সাইকায়াট্রিস্ট। ভারি বিড়ম্ববনায় পড়ে আপনাকে চিঠি লিখছি। সমস্যাটা আমার স্বামীকে নিয়ে। চিঠিতে কিছু লিখতে চাই না। আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। অনুগ্রহ করে যদি একটু সময় দেন তাহলে বাধিত হব।
ইতি
জয়া সরকার
চিঠিটা পড়ে শ্রী মুখার্জি মৃদু মৃদু হাসলেন। কিন্তু তিনি তো মহিলাদের সঙ্গে পারতপক্ষে সাক্ষাৎ করেন না। মহিলাদের খুব সন্দেহের চোখে দেখেন। তারা অনেকেই ইকুয়ালিটির কথা বলেন, কিন্তু ইকুয়ালিটিতে তাদের বিশ্বাস নেই। এটা স্রেফ একটা ভড়ং। অধিকাংশ মহিলাই যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না। তাদের কোনও প্ল্যান ‘এ’ নেই। কিন্তু প্ল্যান এ-র ভান আছে। অনেক পুরুষ সম্বন্ধেও কথাগুলি খাটে।
দুপুরে আজ রান্নার জন্য জাপানি পুঁটি এনেছেন। জাপানি পুঁটি ভাজা আর ভাত। সঙ্গে একটু ঘি নেবেন।
ইলেকট্রিক কেতলিতে চায়ের জল বসিয়ে তিনি ভাবলেন, জয়া সরকারের সঙ্গে দেখা করা উচিত হবে কিনা। কেননা তিনি জানেন যে জয়বাবুর কী সমস্যা হতে পারে। জয়বাবু কলেজ যাওয়া বন্ধ রেখে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন। কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন না। কফিশপে যাওয়াও বন্ধ। মেজাজ খিটখিটে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাও অসম্ভব নয়।
চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে স্নানে গেলেন। আজ বেশ গরম। এই চিঠির কোনও উত্তর তিনি দেবেন না।

ছ।
গত পনেরো দিনের মধ্যে তিন বন্ধু আলাদা আলাদা ভাবে শ্রী মুখার্জির বাড়ি এসেছেন। একে অপরের প্রতি এত অভিযোগ জমা হয়েছিল তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। সুখের কথা, জয় সরকার বললেন, তিনি আবার কবিতা ফিরে পাচ্ছেন। দুঃখের কথা, তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে চান। আর কম্প্রোমাইজ ভালো লাগছে না তাঁর। প্রমোদবাবু বললেন, তিনি স্কুল ছেড়ে আবার মিডিয়া হাউসে ঢোকার চেষ্টা শুরু করেছেন। কোনও এক নিউজ পোর্টালে হয়ত একটা চাকরি হয়েও যাবে। শুভঙ্কর মজুমদার বলে গেলেন, যে তিনি আবার পড়াশুনো শুরু করেছেন। তাছাড়া তাঁর এখন অনেক যোগাযোগ। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি হয়ে যাবে। তারপর অপরাধজগৎকে বিদায় জানিয়ে কলেজে ঢুকে পড়বেন। একটা ভারি ফ্রেমের চশমার অর্ডারও দিয়েছেন।
জয়বাবুকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন শ্রী মুখার্জি, আপনারা তিন বন্ধু কি কখনও পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
খানিকটা অবাক হয়ে তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। মাউন্ট আবু।
আপনার কি মনে হয়নি, কেউ আপনাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে?
আসলে এমন কিছুই হয়নি। তিন জনই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কে আর কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে?
কিন্তু সম্মোহিতের মতো জয়বাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার একবার মনে হয়েছিল, কেউ যেন আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে চাইছে।
আপনি আর কখনও কফিশপে যাবেন না, শ্রী মুখার্জি বেশ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন জয়বাবুকে।
শুধু জয়বাবুকেই নয়, কফিশপে যেতে নিষেধ করেছেন বাকি দুই বন্ধুকেও।
এটা তাঁর একটা খেলা। এবং তিনি জানেন, এরা কেউই আর ওই কফিশপে কখনও যাবেন না।

জ।
একদিন সন্ধ্যাবেলা সেই কফিশপে ঢুকলেন শ্রী মুখার্জি। আজ বেশ ভিড়। গমগম করছে। ঘেরাটোপগুলো যেন উপচে পড়ছে। কফিশপের মালিক সম্বিত মিত্র তাঁর পরিচিত। তিনি কাউন্টারে বসেন না। ভেতরে এক ঘুপচি ঘরে তিনি বসে সিসিটিভিতে সব লক্ষ্য রাখেন।
আজ আর সোফায় না গিয়ে সরাসরি মিস্টার মিত্রের চেম্বারে প্রবেশ করলেন শ্রী মুখার্জি।
আসুন, আসুন—সম্ভাষণ জানালেন মিস্টার মিত্র।
কেমন আছেন?
ফাইন, অ্যাজ অলওয়েজ। আপনার খবর কী বলুন?
সব ঠিক আছে। আচ্ছা, যে তিন বন্ধু আপনার এখানে রোজ এসে আড্ডা দিত তাদের তো বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি না। কী ব্যাপার?
হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি, তারা আর আসছেন না।
আমার সঙ্গে একটা বেট করবেন?
আপনার সঙ্গে আগের বেট-এ হেরেছি। আর নয়। আমার ২৫ হাজার টাকা গচ্চা গেছে। না, আর আপনার সঙ্গে বেট নয়। বেলতলায় বারবার নয়।
এবারে কিন্তু আমি হেরেও যেতে পারি।
বলছেন?
হ্যাঁ, বলছি।
তা, কী বিষয়ে বেট বলুন তো?
ওই তিনটে ছেলে আর কখনও আসবে না আপনার কফিশপে।
ধুর, তা হয় নাকি? ওরা আমার পার্মানেন্ট ভিজিটর। তাছাড়া, আমার এই সস্তার কফিশপ ছাড়া এই শহরে আর আড্ডা দেবেটাই বা কোথায়?
তাহলে ধরুন বেট।
বেশ, রইলো বেট। এবার কত টাকার?
৪৫ হাজার।
আপনি কিন্তু এবার হারছেন। তা হারলে ভালই আমার আগের ২৫টা ফেরত পাবো।
হোক, আপনারই জয় হোক, বলে কফিশপ থেকে বেরিয়ে পড়লেন শ্রী মুখার্জি।

ঝ।
হাফ মাস পরে সম্বিত মিত্রের সঙ্গে দেখা করলেন শ্রী মুখার্জি। এই পনেরো দিনে রোজ কফিশপটায় গিয়েছেন ভদ্রলোক। একদিনও তিন বন্ধু আসেননি।
মিস্টার মিত্রের মুড খারাপ। আবার ৪৫ হাজার টাকা হারার দুঃখে বেশ মুহ্যমান।
শ্রী মুখার্জি সরাসরি কফিশপের ভেতরের ঘুপচি ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে বললেন, কী মিস্টার মিত্র, কোথায় আপনার পার্মানেন্ট ভিজিটর্স?
গালে হাত দিয়ে চুপ করে রয়েছেন কফিশপের মালিক। এবারের টাকাটা প্রায় হাফ লাখ। গায়ে লাগছে। তার চেয়ে গায়ে লাগছে বারবার হেরে যাওয়াটা।
খুব আলগা ভাবে বললেন, বসুন। কফি খেয়েছেন?
নাহ, আজ কফি খেতে আসিনি। আজ টাকাটা নিতে এসেছি। দিন আমার পাওনাগন্ডা।
সে আপনি পাবেন তো বটেই। সম্বিত মিত্রের কথার নড়চড় হয় না, সে আপনি ভালো মতোই জানেন।
মিস্টার মিত্রের সামনের ডেস্কের এপারের চেয়ারে বসে পড়লেন শ্রী মুখার্জি। তাঁর মুখে ঈষৎ হাসি খেলা করছে। তবে হাসিটা চাপার চেষ্টা করছেন। মুহ্যমান লোকের সামনে হাসতে নেই, তাতে তার যন্ত্রণা আরও বাড়ে। আত্মহত্যা করে ফেলাও অসম্ভব নয় এমন অবস্থায়।
বেল বাজিয়ে ওয়েটারকে ডাকলেন মিস্টার মিত্র। দু কাপ কফি দিতে বললেন। তারপর স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কীভাবে সম্ভব বলুন তো? পর পর দুবার আপনার প্রেডিকশন মিলে গেল। টাকা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনার টাকা আপনি পেয়ে যাবেন। ক্যাশে নেবেন না চেকে নেবেন, বলুন। কিন্তু আজ আপনাকে বলতেই হবে এটা কীভাবে আপনি করেন।
মুচকি হেসে এবার শ্রী মুখার্জি বললেন, তার মানে এটাই আমার সঙ্গে আপনার শেষ বেট, তাই তো?
তা কেন হবে? আবার আমরা বেট করব পরে।
কিন্তু আমার ট্রেড সিক্রেট বলে দিলে তো ওই বাজির আর কোনও মানে থাকবে না।
আপনি তো একজন সাইকায়াট্রিস্ট। সেটাই তো আপনার ট্রেড। এসব আবার আপনার ট্রেড হল কবে থেকে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন মিস্টার মিত্র।
দেখুন মিত্রবাবু, আমার কাছে সবাই রোগী। না, একেবারে রোগী না হলেও আমার পর্যবেক্ষণের বিষয় মানে এলিমেন্ট। আপনিও কিন্তু তার বাইরে নন।
এই কথায় নড়েচড়ে বসলেন মিস্টার মিত্র, আমিও?
হ্যাঁ, আপনিও।
আপনি তো বেশ বিপজ্জনক লোক মশাই। যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক গুণ বেশি বিপজ্জনক,--এখন মিত্রবাবুর মুড অনেকটা হালকা হয়েছে। হাস্য সহকারে কথাগুলো বলে কফিতে চুমুক দিলেন।
আমার স্বীকার করতে কোনও অস্বস্তি নেই যে আমি লোকটা বেশ বিপজ্জনকই। তবে আজ থেকে আর আমি আপনার কাছে বিপজ্জনক থাকব না। বারবার একই লোককে হারাতে ভালো লাগে না।
এবার বেশ গুছিয়ে এসিটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মিস্টার মিত্র বললেন, তাহলে বলুন, কীভাবে আপনি বলে দিলেন যে ওই তিন বন্ধু আর আমার কফিশপে আসবেন না?
ডেটা।
ডেটা? সে আবার কী?
সিম্পল স্টাডি আর ডেটা অ্যানালিসিস। আমি কেন যে কেউই পারবে। তবে ধৈর্য্য দরকার এর জন্য।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। একটু বিশদে ব্যাপারটা বলুন না,--উৎকণ্ঠা গলায় মিস্টার মিত্রের। তিনি জানতে উদগ্রীব।
শুনুন তাহলে। ওই তিন বন্ধু যে টেবিলে এসে রোজ বসত আমি ঠিক তার পাশের টেবিলে দিনের পর দিন এসে বসতাম। আপনি খেয়াল করেননি হয়ত। এটা খেয়াল করা সম্ভবও নয়। যাইহোক, তারা যথেষ্ট উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলত। সেই কথাগুলো আমি নোট নিতাম। সেখান থেকেই পেয়ে যাই তাদের সম্বন্ধে যাবতীয় ডেটা। কে কী করেন, কী ভালোবাসেন, কার স্ত্রী কেমন, কার ছেলে পড়াশোনায় ভালো, কে কোথায় বাজার করেন, এমনকি তাদের কোমরের মাপও। এই রকম অজস্র তথ্য। আপনার এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে, তা দিয়ে আপনি সবার উপর নজর রাখেন। আমারও একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। আমি তা দিয়ে যার উপর চাই তার উপর নজর রাখতে পারি। যাইহোক, এরপর আমি একটা ভিজিটিং কার্ড বানাই। যে কার্ডটা আর পাঁচটা ভিজিটিং কার্ডের মতো নয়। এটা করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল কৌতূহল জাগানো। গড়পড়তা জিনিস মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আর দৃষ্টি আকর্ষণ না করলে মনও আকর্ষণ করে না। আমি তারপর তাদেরকে আমার কার্ডটা দিই। আমি জানতাম সেটা তারা উপেক্ষা করতে পারবেন না। আমার বাড়িতে আসবেনই। এবং এটাও জানতাম তারা এক সঙ্গে আসবেন না কেননা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চরিত্র, ভালো লাগা-মন্দ লাগা, সব ডেটা আমার হাতে। তারা এলেনও। একা একা। আলাদা আলাদা ভাবে। সেটাই ছিল আমার জন্য সুযোগ। আমি একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি তারপর। তারা যে আপনার কফিশপে আর আসছেন না সেটা আমিই তাদের মানা করেছিলাম।
আর তারা আপনার নিষেধ শুনলেন?
সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।
এটা কীভাবে সম্ভব হল?
কারণ ততদিনে তারা আমার হাতের মুঠোয়। আমি তাদের সম্পর্কে যা বলি সব মিলে যায়। এতে করে তারা আমাকে এক অলৌকিক মানুষ ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমার বলা কথাগুলো তো মিলবেই কেননা তাদের সব তথ্য তো আমার হাতের মুঠোয়।
কী কান্ড মশাই। এ তো দিন দুপুরে চুরি। মানে তথ্য চুরি,--মিস্টার মিত্র উত্তেজিত হয়ে চেকে সই করছেন।
চেকটা হাতে নিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, সিম্পলি এটা ডেটা চুরির গল্প। আর কিছু নয়।

জিয়া হক

রমাজানের একটি বিকল্প দুয়া


আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ও আমার আল্লাহ। তুমি প্রিয়।
তুমিই আমাকে প্রাণ দিয়েছো। মৃত্যু তুমিই আমাকে দেবে।
এই যে সজীব আমি ব্যবহার করে চলেছি বিবিধ
অঙ্গ প্রত্যঙ্গ —সবই তোমার দেওয়া। যা খাই, যা পরি, যেখানে যাই —সবই তোমার। তুমি আমাকে নিয়ত প্রত্যক্ষ করো। আমার সব কথাই তুমি শোনো। যা ভাবি তা জানো।
তুমি ক্ষমা করো আমাকে।
প্রদত্ত দানের আমি অপচয়কারী। নিজেকে সেখানেও নিয়ে গিয়ে তুলেছি যে জায়গায় সীমালঙ্ঘনকারীরাই যায়। যা নিষিদ্ধ তাতে আমি অংশ নিয়েছি। অনুপুঙ্খ তুমি জানো।
পাপ গোপন নেই। সবই তোমার সম্মুখে।
এখন তোমার দয়া ছাড়া আমার আর কোনো আলো
অবশিষ্ট নেই। আমি নিজেই যেন একখণ্ড অন্ধকার।
ক্ষমা করো।
যে পথ সহজ, যে পথ সরল, যে পথ তোমার দিকেই শুধু
গেছে সেই পথ আমাকেও দাও।
আলো থেকে দূরে চলে যাওয়া যে কী যন্ত্রণা তা আমি
টের পাচ্ছি আল্লাহ।
মায়ের চেয়ে কত কত গুণ ভালোবাসো তুমি।
মা আমাকে ক্ষমা করে — তুমিও ক্ষমা করে দাও।
জান্নাতের বাসিন্দা কোরো।
আমার যা কিছু অশালীন, তুমি ধুয়ে দাও।
আমার সকল অভিপ্রায়কে ঠিক করে দিও।
তুমি যে আশ্রয় আমার, তুমি যে ঠিকানা।
ক্ষমা।

জিয়া হক