কেবলমাত্র ‘বিরক্ত ভিন্নমতাবলম্বী’রাই চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি এক মন্দিরের মহা-উদ্বোধনের মহা-উদযাপনকে রুচিহীন বলে মনে করেননি, সেই সঙ্গে অনেকেরই মত এমনটাই। বিরুদ্ধ স্বরের মানুষজনকে বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন প্রয়াত অরুণ জেটলি। যাইহোক, অযোধ্যার পুরনো বাসিন্দাদের কণ্ঠেও একই রকম উষ্মার প্রতিধ্বনি। এদের অনেককেই ছিন্নমূল করে দেওয়া হয়েছে এবং কোলাটেরল ক্ষতি হিসেবে তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাম অবতার, স্বপ্না মাধুকর ও মহম্মদ উমর এদেরই প্রতিনিধি। এদের উৎখাত করার কারণ ‘নতুন অযোধ্যা’ নির্মাণের জন্য পুরনো অযোধ্যাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তৈরি হচ্ছে এক দৈত্যাকার পরিসর। নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সাততারা কমিউন, বিলাসবহুল হোটেল, বহুস্তরীয় পার্কিং চত্বর এবং বাকি অংশে পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। গণমাধ্যম লাগাতার খবর দিয়ে চলেছে।
তীর্থক্ষেত্রের নামে এই রাজনৈতিক প্রকল্প তৈরির জন্য শুধু পুরনো বাসিন্দাদেরই সরানো হচ্ছে না, সেই সঙ্গে অযোধ্যার আগেকার জীবনপদ্ধতিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই শহরের পুরনো সংস্কৃতি যা বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্রিত করে রেখেছিল, সেই ইতিহাসকেই লুপ্ত করার কাজ চলমান। এখানকার তেহজিবকে মুছে ফেলা হচ্ছে। এই তেহজিব মেনে এখানকার বাসিন্দারা ‘ঈদ কি রাম রাম’ বলে একে অপরকে সম্ভাষণ করত (বিশ্বাস করুন আর না করুন, এটা সত্যি)।
এই রাজনৈতিক ব্যবসা এখানকার সংস্কৃতিকে সাফ করার এক উদ্যোগ। অযোধ্যার সংস্কৃতিতে “রঘুপতি রাঘব রাজা রামে”র মতো রামধুনের অস্তিত্ব ছিল। এই রামধুনে রয়েছে “ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম”। এক সময় এটা সম্ভব হয়েছিল।
রামের গল্পকে সাধারণ মানুষ যেভাবে বুঝতেন তাকে বদলে নতুন ভাবে সাজানোর এক প্রচেষ্টা এটি। রামকে তারা রাগী, যোদ্ধা ঈশ্বর হিসেবে দেখাতে চাইছেন যিনি “অপরে”র হাত থেকে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের উদ্ধার করেন। এবং এই “অপর” তাদের কাছে দানবীয়। বিজেপি-আরএসএস ‘অপর’ বলতে কাদের বোঝে তা আলাদা করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। এই দলগুলির স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণায় কারা “অপর” তা গোপন নয়।
২২ জানুয়ারির আগে গোটা দেশে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে ও অবাধে ‘রামরাজ্যে’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা আপনাকে যেটা ভুলিয়ে দিতে যায় তা হল, মাদকজনিত হ্যালুসিনেশনে আমাদের সভ্যতার মহানতা বা ভারতের কল্পিত ‘বিশ্বগুরু’ মর্যাদাকে মনে রেখে “মাথা উঁচু করে রাখা”ই শুধু রামরাজ্য ছিল না, বরং রামরাজ্য একটা সময়-স্থান-নৈতিকতা যেখানে সকল নাগরিক ন্যায়বিচার ভোগ করত, যেখানে রাজদরবারের কর্মচারীরাও রাজাকে প্রশ্ন করতে ও সমালোচনা করতে পারতেন। এই সময়কালকে এক সুখ, শান্তি ও প্রাচুর্য্যের কাল হিসেবে দেখা হয়েছে। এ সম্পর্কে ভক্তিকবি তুলসিদাস (১৫১১-১৬২৩) ব্যবহার করেছিলেন “পরস্পর প্রীতি” শব্দবন্ধটি, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ছিল।
রামরাজ্য যেদিন বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়ে উঠল সেদিনই হাজারবার মৃত্যু হয়েছিল আয়রনির। “মন্দির ওখানেই বানাব”-এর মতো স্লোগানের নগ্ন রমরমা থেকেই বোঝা গিয়েছে কী ধরনের রামরাজ্য বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কোন ধরনের রামরাজ্যের বাসিন্দা আমরা হতে চলেছি।
এখন আমরা যেহেতু পুরোপুরি জেনে গিয়েছি যে, তারা যখন ভারতের কোনও অংশকে তার পুরনো মহিমায় ফিরিয়ে আনতে চায়, তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুনরুদ্ধারের এই ঘোষণা ও দাবির অর্থ হল, কোনও সম্পত্তি দখলের জন্য লড়াই চালানোর চিরাচরিত কৌশল যা জবরদখল ও রূপান্তরণের মধ্যবর্তী বিন্দুগুলিকে পূরণ করবে, যেভাবে অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে সেই জায়গাকে মন্দিরের রূপ দেওয়া হল।
এমন পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশের সরকার বিজ্ঞাপন করছে, অযোধ্যাকে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে তোলা হবে। সেই বিজ্ঞাপনে সমস্ত খুঁটিনাটি উল্লেখ করা হচ্ছে। এটাই ঘটনাচক্রে বিকাশের (উন্নয়ন) একটা মডেল আর এই মডেলকেই অনেক এনআরআই ভালবাসেন। এই মডেলের বৈশিষ্ট্য হল, এখানে একটি কার্যকরী বিমানবন্দর থাকবে, পাঁচতারা বিলাসবহুল হোটেলে যাওয়ার মসৃণ রাস্তা থাকবে। প্রবাসীদেরকে জুলুজুলু চোখে বলতে শুনবেন, “ভারত বদলাচ্ছে।” দারুণ রাজপথ বানিয়ে যাতায়াতের সময়কে কমিয়ে আনাকেই এই বিকাশ বিজ্ঞাপন করতে চায়। আমাদের মানবিক উন্নয়ন সূচক একেবারে তলানিতে যতই নেমে আসুক, তাতে কী!
বিকাশ বা উন্নয়নের এই মডেলে চারধাম পরিযোজনায় চার সড়কের রাজপথ নির্মাণকে বেপরোয়া ভাবে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে, অথচ ভুলে যাওয়া হচ্ছে, হিমালয়ের সূক্ষ্ম ও ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এই প্রকল্প। ধর্মীয় পালে হাওয়া দিয়ে রাজনৈতিক বৈতরণী পার হতে সাহায্য করবে এটি এবং পর্যটন খাতে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আসবে। এটাই বিকাশের সেই মডেল যেটাকে অনেকে আমাদের সভ্যতার মহানতার গর্ব হিসেবে দেখে থাকে।
অযোধ্যার প্রতিবেশী নিচু জেলা গোণ্ডা, শ্রাবস্তী, বাহরাইচ, বরাবাঁকি ইত্যাদির নিরিখে এই বিকাশকে একবার ভেবে দেখুন। এইসব জেলার লাখ লাখ “নোংরা অপবিত্র” মানুষদের কথা একবার ভাবুন এবং জিজ্ঞাসা করুন, মহা-উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এফএমসিজির আদানি উইলমারের বিতরণ করা পুষ্পাকৃতির জিলিপি কাদের দেওয়া হবে, এতে লাভ কী হবে?
ঈশ্বর আমাদের এই “রামরাজ্য” থেকে রক্ষা করুন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe