আজ নীচু তারে হাওয়া বইছে। বিছানার চাদর পরিপাটি, উড়ে যায়নি। মনে হচ্ছে, আজ সবার ভাল ঘুম হবে।
হাতের কাছে জল থাকা দরকার। নেই, তাই আমাকে উঠে বসার ঘরে যেতে হল। বসার ঘরে রঙিন মাছের ঘর, বনসাই করা বট ও বাঁশ, প্লাস্টিকের লতাপাতাফুল। পাশেই বারান্দা। বারান্দার জানালা খোলা। জানালা দিয়ে মহিষবাথান কলেজের অধ্যাপকের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অধ্যাপকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে দীঘার সমুদ্রের ধারে এক গ্রামে। বেড়াতে গিয়ে তাদের আলাপ হয়েছিল।
বসার ঘরে জল নেই। ডাক্তার বলেছে, দুশ্চিন্তা হলে জল খাবেন। আমার এখন দুশ্চিন্তা। কী নিয়ে চিন্তা ট্রেস করতে পারছি না, কিন্তু মাথা ভরাট হয়ে আছে। রান্নাঘরে জল থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পা ফেলতে হবে। দরজাও খুলতে হবে সন্তর্পণে। আলো জ্বালাতে হবে সন্তর্পণে। ডাক্তার বলেছিল, এবার থেকে আপনার গোটা জীবনটাই কাটাতে হবে সন্তর্পণে।
রান্নাঘরের অবস্থা ভাল নয়। চিমনি নেই। ঘুলঘুলি দিয়ে সব ধোঁয়া বের হয় না। কালি হয়ে গেছে দেওয়াল। অথচ আমার এখন জলের প্রয়োজন। পানীয় জলের সরবরাহ প্রায় বন্ধ গাজায়, মনে পড়ল। আমার আজকাল এই সব মনে পড়ে। কন্টেক্সট কী, কেন—মনে থাকে না।
তিনটে তাকিয়ায় সার সার বোতল। ছোট, বড়, মোটা, চ্যাপ্টা, দামি, সস্তা, রঙিন, সাদা, ময়লা, পরিষ্কার, গোল, সরু বোতল। এতে জল ভরা থাকে সারাদিন। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয় বোতলের জল নামতে থাকে। মাঝরাতে বোতল খাঁ খাঁ করে। কোনও বোতলে জল নেই। আমার মাথা আরও ভরাট হয়ে উঠছে। সবাই ঘুমোচ্ছে। বাড়িতে জল নেই, কেউ জানে না, গোপন করে রেখেছে। জলের কারণে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে আর দুশ্চিন্তার কারণে আমার জল দরকার।
ধীরে ধীরে গেট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। রাস্তার কলে কি জল পাওয়া যাবে না? আমাদের এই রাস্তায় পাঁচ মিনিট অন্তর একটা করে সরকারি কল। গোলপুকুরের মোড় অবধি কমপক্ষে তিনটে কল। তবে জল বন্টনের সময় নির্দিষ্ট। মাঝরাতে জল সরবরাহ হয় না সম্ভবত। কিন্তু আমি সোফায় বসে, বিছানায় শুয়ে সকালের অপেক্ষা করতে পারি না।
দুটো কুকুর সপরিবারে আমার পিছু নিয়েছে। চুক চুক, চুক চুক, আয় আয়—তাদের ডাকলাম। ইতিহাস নাকি জানিয়েছে, কুকুরই প্রথম বশ মেনেছিল। তারা বিশ্বস্ত সঙ্গী ও আজন্ম ভক্তিরসে ডুবে থাকা প্রাণী। সেবার যখন কুকুর ধরপাকড় শুরু হয়েছিল, ডিসেম্বরের শেষ দিকে, আমি চারটে কুকুরকে গুপ্তকক্ষে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সুতরাং, স্থানীয় কুকুররা আমাকে চেনে।
পর পর দুটো সরকারি কলই দেখলাম শুকনো। চাতাল শুকনো। শুধু ড্রেনে জল থৈ থৈ করছে। দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। এত রাতে ডাক্তারকে ফোন করা উচিত হবে না কারণ তার বাড়িতে জলের অভাব নেই। আমার একমাত্র আশা এখন গোলপুকুরের মোড়ের কল। এই কলের অনেক ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। যে রাস্তা দিয়ে আমি জলের সন্ধানে বেরিয়েছি তারও অনেক ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। আমি একবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের পরিবারে কেউ অনিদ্রায় ভোগেনি, দুশ্চিন্তা করেনি, স্নায়ুবিকারে যায়নি, আমি কেন ভিক্টিম হলাম।
গোলপুকুর মোড়ে কয়েকজন উর্দি পরা লোক। ঠিক উর্দি নয়, সাদা পোশাক। দাঁড়িয়ে একটা জাল-ঘেরা গাড়ি। চালক সিগারেট খাচ্ছে। গাড়ির রঙ গাঢ় সবুজ, হলুদ বর্ডার।
দুজন লোক এগিয়ে এসে বলল, এখানে কী করছেন?
আমি সুস্থ লোকের মতো বলি, বাড়িতে জল নেই। জল নিতে এসেছি।
তারা ভুরু কুঁচকে বলল, এত রাতে!
সরল বিশ্বাসে বললাম, দুশ্চিন্তা হলে জল খেতে হয়। কী করব?
তারা তফাতে চলে গেল।
তিন মিনিট পর ফিরে এসে বলল, গাড়িতে উঠুন।
আমি সহজভাবে জানতে চাই, কেন?
তারা বলল, আমরা আপনার জন্য জলের বন্দোবস্ত করেছি।
তারপর আমাকে দুজন মিলে ধরপাকড় করে গাড়িতে নিয়ে তুলল। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম, গোলপুকুরের কলটার মুখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। ভিজে চাতালে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঠিকরে উঠছে।
আমি আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে অনুনয় করে বললাম, আছে, জল এখানে আছে, আমাকে নামিয়ে দাও।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
আমার ডাক্তার বলেছিল, আপনার এই যে দুশ্চিন্তা, তার একটা ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। বাকি জীবনটা আপনাকে চলতে হবে সন্তর্পণে।
আজ নীচু তারে হাওয়া বইছে আর অজ্ঞাত পরিচয় দুই লোকের মাঝখানে বসে আমি চলেছি পানীয় জলের কাছে। সবাই ঘুমোচ্ছে। শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ঘুম দরকার।
গাজার মানুষকেও একদিন জাল-ঘেরা গাড়িতে চাপিয়ে জল খাওয়াতে নিয়ে যাবে তেল আবিব। একদিন।
ছোটগল্প: উট। জিয়া হক
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe