গাজা ভূখণ্ডের রাফাহ শহরে পরিকল্পিত আক্রমণের আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিভি চ্যানেল এবিসি-কে রবিবার এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমেরিকানসহ পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সতর্কতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেন। পশ্চিমা নেতারা বলেছিল, রাফাহতে আক্রমণ করলে ব্যাপক পরিমাণে বেসামরিক নাগরিদের মৃত্যু হবে। নেতানিয়াহু বলেন, “বেসামরিক মানুষ যাতে এলাকা ছাড়তে পারে তার জন্য নিরাপদ রাস্তা দিয়েই আমরা যা করার করতে চলেছি।”
ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জোনাথন কার্ল প্রশ্ন করেছিলেন, ১৪ লক্ষ ফিলিস্তিনি যাবে কোথায়? এর উত্তরে নেতানিয়াহু বলেন, “রাফাহের উত্তরে যে ফাঁকা অঞ্চল রয়েছে সেখানে, প্রচুর জায়গা রয়েছে ওখানে, তবে এটা করার আগে আমরা বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি।” নেতানিয়াহু নিজের বক্তব্য নিয়ে সন্তুষ্ট এমনটাই শোনাচ্ছিল।
একদিন আগে, ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি লন্ডনে অবস্থিত এলবিসি রেডিওতে বক্তব্য রাখেন এবং তাঁকে যখন চারবার প্রশ্ন করা হয় যে, রাফাহের ফিলিস্তিনিরা যাবে কোথায়? লেভি কোনও উত্তর দিতে পারেননি। তিনি সামান্য যেটুকু বলতে পেরেছেন তা হল, “গাজা ভূখণ্ডে ফাঁকা জায়গা রয়েছে এবং আরেকটি বিকল্প হল, ফাঁকা এলাকাতে বেসামরিক নাগরিকদের পাঠাতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলিকে আমাদের সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।” এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ম্যাট ফ্রেই যখন জিজ্ঞাসা করেন, ওই ফাঁকা জায়গা কোথায়? এর কোনও উত্তর তিনি দেননি।
নেতানিয়াহু ও লেভি একটা সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না কারণ তাঁরা উভয়েই জানেন, ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে ইচ্ছুক নয়, অন্তত এখনও পর্যন্ত করেনি। তাঁরা জানেন, ফিলিস্তনিদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ নয় এবং রাফাহতে আক্রমণ শুরু হলে তাদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ থাকবে না। তারা এও জানেন, গাজা ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ইসরাইল, তাদের সেখানে রাখতে নয়।
গাজায় নেই নিরাপদ স্থান
গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলের সরকার ভুয়ো তথ্য প্রচার বৃদ্ধি করেছে। ইসরাইল যখন দাবি করে যে, সে দেশের সেনা “নিরাপদ পরিসর” তৈরি করছে গাজার মানুষদের জন্য বা তাদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এর চেয়ে মিথ্যা দাবি আর নেই। গত ভয়াবহ চার মাসে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রথমত, ইসরাইল গাজার মানুষদের বলেছিল, দক্ষিণাঞ্চল নিরাপদ থাকবে। গাজাবাসী যখন এলাকা খালি করতে শুরু করেছিল, ইসরাইলি বাহিনী বেসামরকি নাগরিকদের গাড়িবহরের উপর বোমাবর্ষণ করেছিল। ফিলিস্তিনিরা যখন দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছায় তখনও তাদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। “নিরাপদ যাত্রাপথে” যেখানে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের উপর বোমা ফেলা হয়নি, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে স্নাইপাররা গুলি করেছে বা আটক করেছে এবং জোর করে তাদের বেপাত্তা করে দিয়েছে।
খান ইউনিসের আগের “নিরাপদ অঞ্চলে” ইসরাইলি সেনা যখন আক্রমণ করেনি তখন তারা বেসামরিক নাগরিকদের বলেছিল হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে থেকে যেতে। মানুষ যখন হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে পৌঁছতে চেয়েছে তখন স্নাইপাররা তাদের গুলি করেছে এবং তারপর বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।
ইসরাইলি সেনা বাহিনী ফিলিস্তিনিদের খান ইউনিস পরিত্যাগ করতে বলার পর তারা যখন পালাচ্ছিল তখন তাদেরকে নিশানা করা হয়। আরেক “নিরাপদ অঞ্চল” রাফাহতে কিছু ফিলিস্তিনি হাজির হয়েছিল, তখন তাদের বলা হয় সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। এখন মানুষজনকে রাফাহ ছেড়ে “ফাঁকা এলাকা”তে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। অন্য “ফাঁকা এলাকা” বলতে পড়ে রয়েছে মাওয়াসি। এখানে আগেও মানুষজনকে চলে যেতে বলা হলেও বারবার নিশানা করা হয়েছে।
মানুষকে এলাকা খালি করতে বলার এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তাদের হত্যা করার অভিপ্রায়। ইসরাইলের সেনা ও সরকার ইংরেজিতে যাবতীয় ঘোষণা করে থাকে এবং পশ্চিমা মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দাবি করছে, “বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে” তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইভাকুয়েশনের পথ অনিরাপদ বা সেই পথের মানচিত্রকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা তার পাশাপাশি বড় প্রশ্ন হল, তারা একটা সত্য গোপন করতে চেষ্টা করছে আর সেই সত্য হল, গাজায় কোনও নিরাপদ স্থান নেই।
শ্রুডিঙ্গারের হামাস
চলমান যুদ্ধের মতো অতীতেও ইসরাইল বারবার সাধারণ মানষের হত্যার জন্য হামাসকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকেও দায়ী করেছে। তারা বারবার দাবি তুলেছে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ও কমান্ডাররা বেসামরিক নাগরিকদের “মানবিক ঢাল” হিসেবে ব্যবহার করছে।
তবে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে এই দাবি মিলছে না। জানুয়ারি মাসে ইসরাইল দাবি করেছিল, তারা ১০ হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে (গাজায় ৯ হাজার ও ইসরাইলের মধ্যে ১ হাজার জনকে) এবং ৮ হাজার জনকে জখম করেছে, ২৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছে ও হামাসের রেজিমেন্টের দুই-তৃতীয়াংশকে উৎখাত করেছে। তারা এও বলেছে, তারা গাজা ভূখণ্ডে ৩০ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে “আঘাত” হেনেছে।
নিজেদের মূল্যায়নে বিশ্বের সবচেয়ে নীতিবান ইসরাইলি সেনা বাহিনী কেবলমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে “হামলা” করে। কেউ ভাবতে পারেন, কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা বা জখম করা যেতে পারত। আমরা যদি নেতানিয়াহুর দাবি শুনি, তাহলে একজন ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, এর ফলে আমরা মৃতের যে সংখ্যা পাই তা ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ খারিজ করে দেবে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সংখ্যাকে আপাত ভাবে ব্যবহার করছে ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ। অথচ সেই সংখ্যা নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন তুলেছে ইসরাইলের সরকার।
অন্য ভাবে বললে, ইসরাইলের সেনার দেওয়া তথ্য নিশ্চিত করে, তারা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করছে এবং গাজা ভূখণ্ডে বেসামরিক নাগরিক-সামরিক বাহিনীর মৃত্যুর হার নিয়ে নেতানিয়াহু মিথ্যা বলছেন। তবে, ইসরাইল সরকারের ভাষ্য নিয়ে আরেকটি বৈপরিত্য রয়েছে এবং তা এই তথ্য থেকেই বেরিয়ে পড়ছে।
ইসরাইলের অনুমান, যুদ্ধের আগে হামাসের কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল। ইসরাইলি সেনার দাবি, তারা গাজা ভূখণ্ডে যেখানে আক্রমণ চালিয়েছে সেখান থেকে হামাস যোদ্ধাদের উৎখাত করেছে এবং রাফাহ হল “হামাসের শেষ ঘাঁটি”, এই কথা যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এর অর্থ হল, জানুয়ারি মাসে রাফাহতে কমপক্ষে ১০ হাজার ছিল অথচ সেই সময় ফিলস্তিনিদের বলা হচ্ছিল যে, এই এলাকা নিরাপদ।
হামাস যদি ইসরাইলের দাবি মতো মানবিক ঢাল ব্যবহার করে থাকে তাহলে ইসরাইল স্বীকার করে নিচ্ছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের সেই সব এলাকার দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে যেখানে হামাস রয়েছে এবং তাদেরকে নিশানা করার অজুহাত দেওয়া যায়। ইসরাইলের মূল মন্ত্র হল—হামাস যেখানে যায়, সাধারণ মানুষ সেখানে যায়। সাধারণ মানুষ যেখানে যায়, হামাস সেখানে যায়। হামাসকে পরাস্ত করতে হলে বেসামরিক নাগরিকদেরও নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
“নাকবা হল নিরাপত্তা”
ইসরাইলের সরকার দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করছে ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপদ্বীপে নির্বাসন দেওয়ার; এই তথ্য আর গোপন নেই। গত অক্টোবরে ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নথি ফাঁস হয়ে গিয়েছিল যাতে গাজার ফিলিস্তিনিদের মিশরীয় অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নেতানিয়াহু একে “ভাবনাপত্র” বলে তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছিলেন এবং এর তথ্য-বিষয়বস্তুকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অবাক হতে হয় যখন এবিসির সাক্ষাৎকারে “প্রচুর এলাকা” শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় নেতানিয়াহু ঢোক গিলেছিলেন। বিধ্বস্ত গাজা ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি বসতির উন্নয়নের জন্য কি তাহলে রিয়েল এস্টেটের পরিকল্পনা করা হচ্ছে? নাকি গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলিদের পুনরায় বসতি স্থাপনের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে?
গত চার মাসে ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে মিশরের একেবারে কাছে অর্থাৎ দক্ষণাঞ্চলে কোণঠাসা করা হয়েছে। এদিকে, ইসরাইলের সেনা বাহিনী ও সরকারের “নিরাপত্তা” ও “ইভাকুয়েশন” শব্দগুলি তাদের মিথ্যাচারকে ঢাকা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে। “গণহত্যার প্রযুক্তি”র অংশ হিসেবে যেভাবে বয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে ইসরাইলের জন্য আরেকটি নাকবার পথ প্রশস্ত করছে এবং তার নকশা তৈরি করা হচ্ছে। ইসরাইলের মিত্রশক্তি ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বস্তুত, এই পশ্চিমা শক্তি ইসরাইলের এই ভয়াবহ আগ্রাসনের মদতদাতা এবং ওই নকশা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইসরাইলের গণহত্যামূলক প্রচারণাকে “একটু বাড়াবাড়ি” বলে বিষয়টিকে লঘু করে দিতে সাহায্য করে। যুদ্ধের বাস্তবতায় রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে সত্য নিগৃহীত হয় এবং মিথ্যা তথ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধে আরেক ভুয়ো তথ্যের।
জর্জ ওরওয়েলের বিখ্যাত ধ্রুপদী রচনা ‘১৯৮৪’-তে রয়েছে, “যুদ্ধই শান্তি। স্বাধীনতাই দাসত্ব। অজ্ঞতাই শক্তি।” এর সঙ্গে যোগ করতে হয়, “নাকবাই নিরাপত্তা” কেননা গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিভীষিকার এটাই বাস্তব রূপ।
তরজমাঃ জিয়াউল হক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Share. Comment. Subscribe