মশহুর গুলাটির নেপথ্যে


মশহুর গুলাটি জিনিয়াস । শাহরুখ খান, করণ জোহররা যতই কপিল শর্মাকে বলুক, ইউ আর দ্য বেস্ট।
অথচ মশহুর গুলাটি যখন সুনীল গ্রোভার তখন তিনি ফ্লপ। তার নিজের মুখ যে কেন সবাই অপছন্দ করে, কে বলবে?
কাল্ট হয়ে ওঠা মশহুর গুলাটি শুধু একজন কমেডিয়ান নয়, তিনি একজন ভালো অভিনেতা, তা কে অস্বীকার করতে পারে?
দ্য কপিল শর্মা শো যে কার্যত দ্য গুলাটি শো হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে পেরেছিল স্বয়ং কপিল শর্মা। তাই কি অস্ট্রেলিয়াতে গন্ডগোল বাঁধে নিজেদের মধ্যে? একটা ঈর্ষার বাতাবরণ টের পাওয়া যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। সোনি কর্তৃপক্ষও গুলাটি নির্ভর হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। কপিল কি বোঝেনি তা? নিশ্চয়ই বুঝেছে। স্ক্রিন স্পেশ ও স্ক্রিন টাইম নিয়ে তাদের বৈরিতা যে কোনো সচেতন, সজাগ দর্শক মাত্রই খেয়াল করেছে নিশ্চয়ই।
কপিল শুধু মাত্র একজন আলাপক হয়ে, মানে ইন্টারভিউয়ার হয়ে আটকে গেল, অথচ তার উত্থান স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে। শর্মা তার প্রিয় কাজটাই মিস করতে শুরু করেছিল বলে বোধ হয়। তাছাড়া সমস্ত করতালি যখন গুলাটি কুড়িয়ে নিয়ে যায় তখন দুর্বল জোক মারা কপিল কি প্রমাদ গোনেন না?
কপিল ম্যাজিক হারিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে যে বেশি দায়ী সে হল কপিল নিজে। কমেডি নাইট উইথ কপিল হিট হওয়ার পর তার মধ্যে একধরনের মালিক ও স্বৈরাচারী সত্তা জেগে ওঠে যে মনে করে সে যা বলবে তাতেই লোক হল্লা করে উঠবে হেসে। অথচ কমেডি নাইটের কন্টেন্টই ছিল কিং, কপিলরা যোগ্য সঙ্গত করেছিল মাত্র। দ্য কপিল শর্মা শো তে কন্টেন্ট বড় স্থূল ও নড়বড়ে। শুধু মাত্র প্রতিভা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও অভিনয় গুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মশহুর।
সুনীল গ্রোভার অনেক অনেক পর এই স্টারডম পেয়েছেন। তার স্ট্রাগল পিরিয়ডটা দীর্ঘ দিনের। সেটা অনেকটা নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির মতোই। তা কি কেউ খেয়াল করেছে? 

নিয়তি, যুক্তিবাদ, সফোক্লিস, কী দরকার?


নিয়তিবাদীরা চুপ। খানিক কোণঠাসা। যুক্তিবাদ ও পরা-যুক্তিবাদীদের সুরমরমার পর্ব এ। যুক্তিবাদের মৌলধর্ম হল ব্যক্তিগত বোধগম্যতা ও তার সূক্ষ্মতা —জোর। যার 'বোধ' নেই —নির্বোধ —বা অবোধ —তার কোনো 'যুক্তি' নেই। ফলত নেই আত্মকে প্রতিষ্ঠার পীড়া। নিজেকে বা নিজের চিন্তাকে 'জাস্টিফাই' করা লজিকের অনেকের বিশেষত্বের একটি।
নিয়তি অব্যাখ্যেয়, এমনই ধারণা। নিয়তি একটি 'ব্লক'। যুক্তিবাদ তাই নিয়তিকে অ-নিরাপদ দূরত্বে রেখে সংশয়-সন্দেহের তর্কে দেখে নিয়মিত। গ্রিক নাটককার সোফোক্লিসও যুক্তিবাদ দিয়ে ঈদিপাসের নিয়তিকে বিখন্ডিত করতে পারেননি। বলা ভালো, করেননি। যদিও তিনিই ছিলেন গ্রিক নাটকে যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিত্ববাদের পুরোধা। ইসকাইলাসকে মনে রেখেও তা বলা যায়।
নিয়তিবাদের সর্বোচ্চ পাহারাদার স্বয়ং মৃত্যুই। যুক্তিবাদীতা মৃত্যুর কাছে এসে নত-তর্ক হয়। এখন প্রশ্ন হল, প্রকৃতিই কি নিয়তিবাদের সংগঠক? পৃষ্ঠপোষক? তাহলে বলতে হবে, প্রকৃতি নিজেই নিয়তির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিতে যেতে পারেনি। সেও নিয়তি-নির্দিষ্ট, বলিপ্রদত্ত।
পৃথিবীর সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই প্রায় এই অসহ নিয়তিকে মানুষ প্রজাতির সখ্যে উঠিয়ে আনতে সদাচেষ্ট। ধর্ম যেহেতু নিয়তির উপরে ঈশ্বরকে স্থাপনা দিয়েছে, নিয়তিরও নিয়তি হল ঈশ্বর, তাই নিয়তি কার্যত ধর্মের একটি নিয়ন্ত্রক 'টুল' বৈ আর কিছু নয়। ধর্ম কি নিজেকে নিয়তির নীতি-নির্ধারক হিসেবে প্রচার করেনি? তবে একটা শুভবোধ আছে। রয়েছে সহৃদয়তা — সমতাবিধানের অভিপ্রায়। 'কর্মফল' - এর প্রসঙ্গ আনা হয়। বলা হয়, এক্ষেত্রে মানুষই হতে পারে 'নিয়তি' নামক খেয়ালি ঘোড়ার নিয়ামক ; চালক। কেননা ধর্মগ্রন্থ যখনই বলে সৎ কর্মশীলদের মৃত্যুর যন্ত্রণা লাঘব হবে বা প্রায় শূন্য এবং সততা ও কর্মশীলতা যেহেতু মানুষের ইচ্ছাধীন সেহেতু প্রকারান্তরে নিয়তির উঠে যাবার সম্ভাব্য পথনির্দেশনা ও ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় মানুষকেই।
ধর্ম নাকি ভয় দেখায় ; ধর্মের ভিত্তিপাথর নাকি সন্ত্রাস! আসলে কথাগুলি খাটবে ধর্মট্রেডারদের সম্বন্ধে যেহেতু তারা ধর্মের ডিলারশিপ নিয়ে বসে আছে ও টেন্ডার ডেকে ধর্মকে বিক্রি করতে চায়। মৌল ধর্মে তাহলে কেন নরকের উল্লেখ? সেটা কি ভয়ের উপমা নয়? স্বাভাবিক প্রশ্ন। তবে, এক্ষেত্রে স্বীকার্য, নরক-যাত্রার যাবতীয় শর্তাবলীর সঙ্গে সম্বন্ধ ইহজাগতিক জীবন ও যাপনের ভালো-মন্দের। অর্থাৎ এই জাহান্নম কার্যত ইহজাগতিক সব অশুভ-এর প্রসারিত অংশ এবং ঐহিক ভারসমতার রক্ষাকবচ।
তাই কি? জানি না। তবে, রাষ্ট্রীয় আইন ও পেনাল কোড কি ভয় দেখায় না? তাহলে আমরাই তাকে নিজেদের ওপর অর্পণ করেছি কেন? 

প্রথম মুনাজাত



আমাকে ক্ষমা করো ও আল্লাহ আমার
অজ্ঞাতসারে আমি অবাধ্য এক
কুঁয়োয় পড়েছি, তুমি জানো।
জল ও অন্ধকার নিয়ে সে তো
প্রস্তুত ছিল,
         গ্রহণেরও অনেক অভিজ্ঞতা তার আছে
আমি যে বেমালুম পড়ে গেলুম ও আমার আল্লাহ

খালি আলোর দিনগুলো,
দিনের আলোদের কথা মনে পড়ে —
এটা শাস্তি, এটুকুই শান্তি এখানে
উপর ও নিচ এই মনে পড়াটুকুতেই আটকে রয়েছে
তুমি সবই জানো।
আফিয়াত দাও, ওই দরজাখানি খুলে রেখো
যেটা দিয়ে জান্নাত দেখা যায় আর তার বাতাস।
পৃথিবীর জানালাদের আমি এ-কারণেই
সমীহ করি, বর্ষাপর্বে ছাঁট ও ঝাপটা উপহার দেয়।
দূরের নক্ষত্রে দুপুরের স্কুল ছুটির ঘন্টা শুনব বলে
কান পেতে থাকি।
আমি কি ধরে নেব স্কুলখানি নেই? করণিক ভাতঘুমে
গেছে? ছুটিগুলি মৌখিক ঘোষণা?
মনোবিদ, নাক-কান-গলাবিদের কাছে যেতে হবে?
আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করো,
আমি পাতার লেফাফা ভেবে কুঁয়োয় পড়েছি,
তুমি জানো সবিশেষ তাই আফিয়াত দাও
সরু জল যেন কাদা করে না বসি
        ইত্যবসরে 

গগনেন্দ্র পাঠশালার ছাত্রী


গগনেন্দ্র পাঠশালা দূরে
দেখে যায় খোজা লোক, দেখে যায় শাকাশী কুকুরে
নেই তার ছাত্রই একখানি
ছিল এক রান্নাঘর আর এক অন্ধ কেরানি
বেতন আসত ছয় মাসে
পরিবার বার্লি খায়, শিশুরাই মুখ দিত ঘাসে
ঘাসে থাকে পোকা আর
ঘাসে ছিল পুস্তকের দানা
পুষ্টিতত্ত্বে নুন নেই
তবে কিন্তু মিটে যায়
রাত্রিকালীন ভোজখানা

গগনেন্দ্র পাঠশালা মায়ের মতোই ছিল একা
আমার যেটুকু বিদ্যা, তার সব ওখানেই শেখা
আমি চাই, আমাদের বড়ছোট মেয়ে
পুত্রদের পাশে বসে এমনই আপেল ধুয়ে খেয়ে
উঠে যাক আকাশে একদিন
যাকে আমি মা বলি, সম্পর্কে আমার বহিন
লতার মতোই তার গলা
বিজ্ঞান প্রেমিক তার, অথচ পড়েছে শিল্পকলা
কেউ কি দেখেছে তাকে ভিড়ে?
মহামানবেরা আট দিন ধরে
তাদেরই সাগরতীরে...
থাক এই কথা, সিনেমার কথা হোক
যারা ডুবে যায়, যারা গৃহে ভাসে
তারা কি যোগ্য লোক?
এমন প্রশ্ন তুলে আনে গবেষণা
সব উঠে আসে, সব তোলা হয়
কন্যাটিকে তুলেও আনে না


জিয়া হক


October : a story of every season : a film review ****


'যদি মরে যাই 
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই'

বিরাট পর্দার সামনে এই লাইনগুলো আমার কানে বাজছিল বার বার। রুটিনমাফিক সাজিয়ে দিতে পারি এইভাবে যে গল্পটা অমন ছিল, ক্যামেরা ছিল ব্যাপক, সাংঘাতিক এডিটিং আর অভিনয়টাও বেশ ভালো। সকলের দেখা উচিত। খেল খতম পয়সা হজম। ব্লা ব্লা ব্লা!
কিন্তু আবেশকে তো ওভাবে বলা যায় না। ভালোবাসা বিধৃত হয়না এত সরলে। বাবার মৃত্যু পিকুকে যেখানে ছেড়ে গিয়েছিল শিউলি হয়তো সেখান থেকে শুরু করে। ঘাসের ভেজা সবুজে আনমনা পড়ে থাকা বাংলার শিউলিগুচ্ছ আলতো হাতে তুলে নেয় শিউলি নামেরই আয়তচোখের এক মেয়ে; তার মুখে তখন নরম রোদ আর চারপাশে হোটেল ম্যানেজমেন্টের ইনটার্নশিপ আর নিয়ম না-মানা,একটি শুভ ছেলে ড্যান। ছাদ থেকে হাত পিছলে পড়ে যাওয়ার আগে তার শেষ বাক্যটাও ছিল ওই ড্যানকে নিয়েই। 'হোয়ারিস ড্যান?' এরপর থেকে কাহিনি আর শিউলির থাকে না, পুরোটাই হয়ে ওঠে ড্যানের। শুধু কাহিনি নয়, শিউলির মা, শিউলির ভাই-বোন, শিউলির হসপিটালের বিছানা, নার্স, কেয়ার টেকার, একটা বর্ষাকাল, ডাক্তার, ওষুধ, তর্ক, আশাবাদ এমনকি শিউলির চোখ মেলাটাও ড্যানেরই হয়ে ওঠে। নিয়ম না-মানা, পথের উল্টো পানে হাঁটতে থাকা ড্যান যেন এতদিন এমনকিছুরই অপেক্ষায় ছিল। একটা খাঁটি উদ্দেশ্য যার জন্যে রাতের পর রাত জাগা যায়, কাজে পাহাড় প্রমান ফাঁকি দেওয়া যায়, মিথ্যে বলা যায়, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা যায় হিসেবহীন টাকা তবু আশা ছাড়া যায় না যে হসপিটাল বেডে এতগুলো মাস প্রায় ভেজিটেবল হয়ে থাকা শিউলি একদিন জাগবে না। প্রকৃত পুরুষ তো এরকমই। তার শুশ্রুষা লাগে না, ভালোবাসা লাগে না, একটা চুমুও লাগে না। তার লাগে একটা ছোট্ট উদ্দেশ্য যাতে সে প্রাণপাত করলেও করতে পারে। আমরা ওই পুরুষটার কথা ভুলে যাই যে শুধু হসপিটাল আর হোটেলে তার জীবন থামিয়ে রাখতে পারে। নিজের মায়ের কথাও তার মনে পড়ে না। অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা (একটি সিঙ্গেল শটও বোধহয় রিপিট হয়নি এত অনাবিল সুন্দর, নির্ভার সেই ক্যামেরা) আর শান্তনু মৈত্রের সুর-করুণা সেই বিপ্রতীপে ড্যানের সাথে আমাদেরও কনস্ট্যান্ট দাঁড় করিয়ে রাখে। তবে অপেক্ষাতেই শেষ নয়, ড্যান কোনো এক শিউলি-সম্ভাবনার সাথে শেষাবধি নিশ্চয়ই থেকে যায়। সব ড্যানদের পক্ষেই তা সম্ভব শুধু আমরা বোধহয় তাদের সেই উদ্দেশ্যটা দিতে পারি না যা রাত্রি শেষে তাদের একেকজনকে এক অজানা সুগন্ধে রূপান্তরিত করতে পারে।
ছবি সমাপ্তিতে হলের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ছাড়ছিল না, পায়ে পায়ে জড়িয়ে নামছিল বাকি লাইনগুলো,

'যে ফুলের নেই কোনো ফল 
যে ফুলের গন্ধই সম্বল 
যে গন্ধের আয়ু একদিন 
উতরোল রাত্রে বিলীন 
যে রাত্রি তোমার দখলে 
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে 
আপন সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।'...

সুজিত সরকার এরকমই।💖

একা নায়ক, বোকা নায়ক


আজ
বৃষ্টি হল বেশ
ভেঙে গেল
ঘুমকাতুরে
ভিতর প্রদেশ
কাদা হল খুব
পায়ের সঙ্গীত হয়
চপ্পলেরা চুপ—
থাকে না কোথাও
বড় ভিজে
কুকুরের ভিক্ষাপাত্র
বেজে ওঠে ব্রিজে
প্রশাসক আজ
চোখ মারে, ফেলে রাখে
টেবিলের কাজ
সেহেতু মুশকিল
মরে যায় স্বাভাবিক
বৃহৎ টেবিল
বসে শোকসভা
জড়ো হয় চুরি করা
অহেতুক জবা
যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে ওঠে
গাঁদা গাছে গাঁদা নয়
জবা যেন ফোটে
এমনই নির্দেশ
আজ
তবে
বৃষ্টি
হল
বেশ

জিয়া হক 

যেভাবে পদ্য লেখা হয়


যখন আমি কবিতা —কবিতাই লিখতে চেয়েছি
তখন হারিয়ে গেল আমার শব্দবোধ
নিজেকে লিখতে গিয়েছি যখন
তখন পেলাম শব্দের পাহাড়
সেই পাহাড়ে গুহা আছে, বনদপ্তর নেই,
বনমানুষেরা চাকরি করতে যাবে তাই
ঝর্নায় চুল ধুতে গেছে

জিয়া হক 

আমার হরিণী-কন্যা, বনপথে একা


গৃহস্থের গ্রামজীবন আমি কাটাবো অনেক
কন্যা তুলতে যাবে ফুল আর জবার খুশবাই
সে যাকে অনুমতি দেবে সে-ই তার নদীতে প্রবেশ
পুলিশেরা বাড়িতে ঘুমোবে, থানা হবে খুকির সাজঘর
অথচ সে আর সাজাবে না তার ভুরু ও পল্লব
এমনি এমনিই সে হয়ে যাবে কারোর ঘরণী
সোনালি জেওর যত পড়ে থাকবে পাঠের টেবিলে
নাকফুল সে হয়ে ফুটবে উঠোনে, একদিন
জঙ্গলে সে যাবে একা, হবে সন্ধ্যা, বাঘও আসবে সেই পথে
কিছু কিছু মতবাদ তার জানা আছে, আর
শরণাপন্ন নয় সে সহিংস সংঘের, তাই
অরণ্য ঘোরাবে বাঘ প্রদর্শক হয়ে
আমার কন্যা তাকে বিবাহেও বেঁধে আনতে পারে
আমার কন্যা পারে দত্তক নিতে ওই ব্যাঘ্রশাবক
কাটাবো জীবন আমি গেরস্তের মতোই শহরে

জিয়া হক 

কেন ও কীভাবে বেলাল চৌধুরী? ও একটি পদ্য


বেলাল চৌধুরী কৃত্তিবাসী হয়েও স্বতন্ত্র। ভারতীয়  কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বাংলাদেশি প্রতিনিধি। তবে, সীমান্তরেখাকে অস্বীকার করাই কবির কাজ। তিনি তা করেছেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই সীমান্তহীন। যদিও তাঁর 'বিচিত্র' জীবনের চর্চা যতটা হয়, যেমনটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে, ততটা তাঁর কবিতা নিয়ে হয় কি? শক্তির কবিতা নিয়ে কিন্তু কম আলোচনা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গীয় একটি তথাকথিত সাহিত্য আন্দোলনের ভাষ্যে ব্যক্তি বেলাল চৌধুরী যে মর্যাদা পান, তাঁর কবিতা কি তা পায়? অন্তত ভারতে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে?

পুনশ্চ : তাঁর একটি 'বহুল পঠিত' কবিতা দেওয়া গেল।

জিয়া হক

কীটমানুষ এবং যা যা গাভীপনা


কীটমানুষ
..............
কীটনাশক এইখানে পড়িয়াছ‌ে কম
জঙ্গলের গাছে কেউ সার মারে নাকি
বাক্য দিয়ে আমি তাকে বুঝিতে সক্ষম
শস্যদের খাদ্য হওয়া
                     এখনও যে মাসাধিক বাকি

আমি তো পচনশীল, হাটে ও বাজারে
জঙ্গলের গাছে আহা সার কেউ মারে?

পরিচর্যাহীনভাবে আমি আছি দেখো
লক্ষ রাখি
               শস্য ধান্য কণা
গতরের ঠিক দাম আজও জানিনেকো
ফলত শ্রমের ক্রেতা
                    ধন্যবাদ-
সহ আট আনা
দেয়।  আজ সূর্য উঠল খুব
মুঘল যুগের যেন সেনা
পাখা থেকে হাওয়া পড়ে —টুপ
গ্রন্থপঞ্জি
            আমাকে জানবে না


জিয়া হক 

ও ধর্ষক, হস্তমৈথুন প্র্যাকটিস করুন


প্রথমেই আমাকে বলো তুমি কী কী হারিয়ে আজ এখানে অনুচ্চকিত মুখে প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছো?

এখানে আঙুরফল মিষ্টান্ন নয়, তাই সকলেই
কমবেশি শেয়াল আর উপকথাকার। এইবার
বলো তোমার গল্প।


সেই হাভাতের গল্পটা জানেন যে বন্ধুর বদলে চেয়েছিল
নদী, অন্তত একটা শুকরভর্তি নর্দমা?

এগুলো বড় রোমান্টিক আর
ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর ও শিশুখেলা।

তাহলে সেই গল্পটা জানেন নিশ্চয়ই যেখানে
এক হাভাতে নদী নয়, আকাশ নয়,
 সবুজ নক্ষত্রের ঘাসভূমি নয়, চেয়েছিল
এক পেয়ালা ধান কেননা সে শুধু চাল চায়নি
তুঁষ আর খুঁদ তার দরকার ছিল।

এ আবার কেমন হাভাতে? তুমি কি চাও আমি
বারবার আশ্চর্য হয়ে যাই?

আপনি গল্প খুবই কম জানেন, শুধু জবা তুলেছেন
পরিচর্যা করেননি কোনো জবার।

আপনার ব্যধি কি দুরারোগ্য?

ওই যে দূরে ঢিবি দেখেন, ওটা শুধু মাটির স্তূপ নয়,
ওটা কবর, কে শুয়ে আছে জানেন ওখানে?

একটি ব্যতিক্রমী উত্তরের আশা রাখছি। বলুন।

আপনাকে হতাশ করাই আমার করণীয় আজ। তাই
ওখানে রয়েছে এক জাগ্রত কুকুরছানার দেবতা,
একদিন ভক্ত আসবে ওখানে,
থালাভর্তি হয়ে আসবে চালধান, প্রার্থনা, আঙুর।

বেশ মজার লোক আপনি।

অতীত বিক্রেতারা জ্ঞানী আর ভবিষ্যত নিয়ে যারা
কথা বলে, তারা নিজস্ব নারী নেই বলে
মৈথুনে হস্তনির্ভর। কুটির শিল্পী স্থানভেদে। আর
হাতকে গোপনাঙ্গ ভাবে

জিয়া হক 

মুরাকামি, মাই লাভ


মুরাকামি
.............
আমি। যন্ত্রণা পাচ্ছি খুব। খুবই, হ্যাঁ।
সমুদ্রতটে কাফকা পড়তে পড়তে বুঝতে
পারছি আমার অপরাধগুলো কী ও কীভাবে
আমাকে মৃত্যুর, থাক, না না হত্যার, ওহো
ভিজে যাচ্ছে মন্ডল, এই মুখমণ্ডল,
কার্পণ্য করেছি কি বিলিবন্দোবস্তে?
সামাজিক হওয়ার কৌশল শেখার বিদ্যালয়—
যেতে চাই, না, কেউ আসুন, সেকি, হ্যাঁ
এই দুপুর, বসন্তের দুপুর থেকে অনুসন্ধানী
আত্মীয়রা কী করতে আসে?
যেদিন যন্ত্রণা, যেখানে খুব, আমি
বসি আততায়ীর মতো, হয়ত এ ধর্মভাব কোনো
পূজার্চনা, নামাজের মতো আত্মহত্যারোধী
সহযোগী চাই যে বৃষ্টির দিনে
আম কুড়িয়ে দেবে, পতনেও সহমর্মী হবে,
পুকুর থেকে তুলে আনবে অজানা বৃক্ষের ছায়া
তার খালি হাতে গাছ আছে ভেবে চুম্বন করিব

জিয়া হক 

অজানা জ্বর : প্রশান্ত হালদার। একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া


অজানা জ্বর –সংক্রামক ও স্বাস্থ্যকর
জিয়া হক

অজানা জ্বর। শিল্পবস্তুর ‘নামকরণের সার্থকতা’ নামে একটি বিষয় বেশ প্রচলিত রয়েছে ‘জ্ঞান’মাধ্যমে। যদিও আলোচক যে কোনও উপায়ে ‘প্রমাণ’ করে দেন যে শিল্পবস্তুর নামটি একেবারে অকাট্য ও সর্বৈব সার্থক। শিল্পী বেঠিক নাম দিতেই পারেন না, এমন একটা ধারণার বিদ্যায়তনিক শিক্ষাপ্রকরণে চল রয়েছে। তাহলে ‘অজানা জ্বর’ সম্বন্ধে সেই আলোচক সম্প্রদায় কী বলবেন জানতে কৌতুহল হয়। তিনি কি একটি কবিতার জায়গা থেকে দেখতে চাইবেন, সমগ্র সংকলনটির ক্ষেত্র থেকে ‘বিচার’ করবেন, নাকি লেখকের অবস্থানকে ‘অজানা’ ও ‘জ্বর’ শব্দদ্বয় দিয়ে বুঝে নিতে চাইবেন? একটি প্রশ্ন সচরাচর ওঠে, কাব্যগ্রন্থের কি ‘নাম’ দেওয়া যায়? এত কবিতা, এত এত বিষয়, এত ভাবনা, এত এত কৌশল—তা একটি নাম-এর আয়ত্তাধীন থাকে কীভাবে? একটি নামের মধ্যে হয়ত সবকে, সব কিছুকে ‘ধরতে’ চাওয়াও হয় না হয়ত। যদি তাই হতো তাহলে পৃথিবীর সমস্ত শিল্পবস্তুর নাম হয়ে যেত হয়ত ‘জীবন’। জীবনের বাইরে আর কী লেখা হল এতদিন? কেবল ধরন-এর পরিবর্তন ঘটে। ‘ধরন’ মানে কি জীবনের ধরন? তা ঠিক নয়। প্রকাশনার ধরন। ধরনের সঙ্গে কার্যত মিল রয়েছে ধারণার। ‘ধারণা’ যেহেতু স্থান ও কাল ভেদে বদলায়। তবে সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে খেয়াল করা যায় যে, এই ধারণারও একটি স্থানিক ও কালিকতার বাইরে সমত্ব রয়েছে। একজন নিউ ইয়র্কারের ভাবনার সঙ্গে একজন ঢাকাই কবির চিন্তার সমত্ব থাকতেই পারে, অসম্ভব কিছু নয়, বলাই বাহুল্য। কেবল লাতিন আমেরিকার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সমতা আছে বলে দাবী করে গার্সিয়া মার্কেজকে নিজস্ব করে নেওয়ার যে প্রচল রেওয়াজ তাকে প্রশ্ন করে কেউ বলতে পারে, একজন সুইডিশ বা ডাচ বা পর্তুগিজ কি গার্সিয়া মার্কেজকে ‘গ্রহণ’-এ বাধা পাবেন? তবে এর বাইরেও নানা অসমাধেয় ব্যাপার-আশয় রয়েছে। বলার আরও নানা পরিসর ও বহু ‘মুখ’ আছে। আন্তর্জাতিক প্রশাসক ও প্রশাসিতের রাজনীতিগত সচেতন বেখায়ালিপনা, খামখেয়াল রয়েছে—আর এখানেই হয়ত সাযুজ্যের প্রশ্নটা, সমত্বের প্রশ্নটা আসে। আসলে প্রশান্ত হালদারের ‘অজানা জ্বর’ এমন একটি কবিতার বই যা যে কোনও দেশকালের হয়ে উঠতে পারে। ‘বেঁচে থাকার পরাধীনতা কেউ কেউ/ মৃত্যুর স্বাধীনতা দিয়ে মাপতে চাইছে/ ভাবনার ভয় সরিয়ে/ স্বপ্নে ঘুমুচ্ছি... সাধারণ চিকিৎসার বিজ্ঞাপনে/ ঢেকে যাচ্ছে যাবতীয় সমস্যা’—এমন  পংক্তি কোন রাষ্ট্রে সত্য নয়? এখানে কবিতার মান, তার হয়ে ওঠা, ছন্দ, মাত্রা, অলংকার—এমন সব ‘নন্দনতাত্ত্বিক’ প্রতর্ক অপ্রয়োজনীয়। ‘ভালো’ পংক্তি আর ‘জরুরি’ পংক্তির দ্বন্দ্ব আছেই, থাকেই। তবে জরুরি বিষয়টি যদি ভালোত্বে হাজির হয়, তাহলে তা ‘স্থায়ী’ হয় কিনা, বা ‘মহাকাল’ মনে রাখে কিনা তার মীমাংসা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। মহাকালও কাঁটা বেছে খায় কিনা। মহাকালের কাব্যবোধও প্রশ্নাতীত নয় কিনা। যেমন বিনয় মজুমদার বা উৎপলকুমার বসু ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালির কাব্য-শো-অফের অংশ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিকে। কেউ বলবেন, এটাই মহাকালের বিচার। তার নির্বাচনে তো উঠে এসেছে ‘যথার্থ’ নামগুলি? এ এক সান্ত্বনা বৈ আর কী? তবে মহাকালের পদ্ধতিটি হোমিওপ্যাথেটিক। যদিও অনেকে বহিরাগত থেকে যান। উত্তম দত্তকে,নিশীথ ভড়কে, শম্ভু রক্ষিতকে, শোভন ভট্টাচার্যকে, অরূপ ঘোষকে, বিশ্বনাথ পুরকাইতকে মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হবে? এখন প্রশ্ন হল, কী দিয়ে ‘তৈরি’ হয় এই মহাকাল? কাল দিয়ে নাকি মানুষ দিয়ে? মহাকাল একটি ভাঁওতা। আমাদের জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধির অক্ষমতার দায় ঝেড়ে ফেলবার একটি ডাস্টবিন। আমরা ‘সহৃদয়’ পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। পাঠক স্ব হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ‘হৃদয়’ অধিকাংশ সময় ‘খারাপ’ থাকে। ‘স্বীকৃতি’ দেবে কে? এখন প্রশ্ন হল, স্বীকৃতির দরকারটাই বা কী? দরকার আছে। কেননা এই স্বীকৃতির সঙ্গে কোথাও জড়িয়ে আছে কালের স্বর। আর এই ‘কালিক স্বর’ বহুমাত্রিক। তবে, এর সঙ্গে শিল্পের ইউটিলিটির একটা সূক্ষ্ম যোগ রয়েছে। ‘মৃত লেখক’রাই সবচেয়ে বেশি জীবিত—এমন সব মন্তব্যের উৎসের সঙ্গেও এর যোগাযোগ রয়েছে। প্রশান্ত হালদার ভীষণভাবে জীবিত এবং তাঁর লেখা প্রণিধানযোগ্য। 


.....................................................................................
অজানা জ্বর। প্রশান্ত হালদার। প্রকাশক- ‘মুক্তাঞ্চল’। প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৭। দাম— ৪০ টাকা। 

Artisans of soap-oil etc


প্রথমেই আমাকে বলো তুমি কী কী হারিয়ে আজ এখানে অনুচ্চকিত মুখে প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছো?

এখানে আঙুরফল মিষ্টান্ন নয়, তাই সকলেই
কমবেশি শেয়াল আর উপকথাকার। এইবার
বলো তোমার গল্প।

সেই হাভাতের গল্পটা জানেন যে বন্ধুর বদলে চেয়েছিল
নদী, অন্তত একটা শুকরভর্তি নর্দমা?

এগুলো বড় রোমান্টিক আর
ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর ও শিশুখেলা।

তাহলে সেই গল্পটা জানেন নিশ্চয়ই যেখানে
এক হাভাতে নদী নয়, আকাশ নয়,
 সবুজ নক্ষত্রের ঘাসভূমি নয়, চেয়েছিল
এক পেয়ালা ধান কেননা সে শুধু চাল চায়নি
তুঁষ আর খুঁদ তার দরকার ছিল।

এ আবার কেমন হাভাতে? তুমি কি চাও আমি
বারবার আশ্চর্য হয়ে যাই?

আপনি গল্প খুবই কম জানেন, শুধু জবা তুলেছেন
পরিচর্যা করেননি কোনো জবার।

আপনার ব্যধি কি দুরারোগ্য?

ওই যে দূরে ঢিবি দেখেন, ওটা শুধু মাটির স্তূপ নয়,
ওটা কবর, কে শুয়ে আছে জানেন ওখানে?

একটি ব্যতিক্রমী উত্তরের আশা রাখছি। বলুন।

আপনাকে হতাশ করাই আমার করণীয় আজ। তাই
ওখানে রয়েছে এক জাগ্রত কুকুরছানার দেবতা,
একদিন ভক্ত আসবে ওখানে,
থালাভর্তি হয়ে আসবে চালধান, প্রার্থনা, আঙুর।

বেশ মজার লোক আপনি।

অতীত বিক্রেতারা জ্ঞানী আর ভবিষ্যত নিয়ে যারা
কথা বলে, তারা নিজস্ব নারী নেই বলে
মৈথুনে হস্তনির্ভর। কুটির শিল্পী স্থানভেদে।

জিয়া হক 

Sugar dad


কহতব্য নয় এ মদীয় যন্ত্রণা
ভালবাসা বয়ে আনে কুকুর প্রস্তাবনা
লেজ যেভাবে বক্র এবং যেভাবে লেজ ব্যথা
স্তন্যপায়ী কুকুরশিশু জানে না কে পিতা
তেমন একটা জন্তু আমার হাড়ের ভেতর জাগে
আনুষ্ঠানিক পানমশালায় কান্না কান্না লাগে
হৃদয় যাদের পাতার মতো শীতপ্রবাহে ভিজে
নিজের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধে শয্যাগত নিজে
এমন লোকই বলে, 'বাবা, কোন জায়গায় লাগা?'
অজস্র লাল জলের মধ্যে নৈর্ব্যক্তিক থাকা-
আমি কেবল নানারকম নাট্য বলতে থাকি
ভিজে মানুষ বলেই শুধু—  বুঝেছি, বাদবাকি?
খবরকাগজ পড়েন যারাই ভালো থাকতে পারে?
'মাঝিসদৃশ তুমি কেন যাবে গো দরবারে?'
নৌকো আমার সজনে কাঠের, সমুদ্রে তার যাওয়া
ছদ্ম হাওয়ার বৃদ্ধ হাওয়ার প্রাচ্যদেশী হাওয়া
অসহায়ক, পাহাড় প্রমাণ বৃষ্টিতে দেয় নুড়ি

বারুইপুরের যাত্রী তবে যাচ্ছি শিলিগুড়ি

এ কি কোনো খামখেয়ালি কুকুরপনা খেলা?

আমার বাড়ি ভাঙছে কিন্তু শান্ত আমার জেলা

জিয়া হক

কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার: প্রশ্নে কবি প্রসূন মজুমদার


১) প্রথমেই তোমার নিজস্ব কবিতা-অভিপ্রায় সম্বন্ধে জানতে চাই।মানে কবিতার কাছ থেকে তুমি কী পেতে চাও?আর কী দিতে চাও কবিতায়?

আমার কাছে, কবিতার কাছ থেকে কিছু পেতে চাওয়া এবং কবিতাকে কিছু দিতে চাওয়ার বিষয়টি এক। একটু কনফিউজিং শোনাতে পারে। ব্যাখ্যা করছি। আমি মনে করি শিল্পী, বিজ্ঞানী, ভাবুক  হলেন আধার মাত্র। লেখনীও বলা চলে। প্রকৃতি কিছু কথা বলছে। আমি সেই সব কথার লেখনী কতদূর হয়ে উঠতে পারছি, তার উপর নির্ভর করে আমি কতদূর সেই কথাকে অনুবাদ করতে পারছি। আমি কিছু লিখছি না আসলে। লিখছে বা বলছে প্রকৃতিই। আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখছি প্রকৃতির কাছ থেকে আসা সেই বার্তাটুকুর জন্য। এই নিজেকে সর্বসময়ের আধার বা লেখনী হিসেবে প্রস্তুত করে রাখার নাম হল সাধনা। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি কবি আদৌ কিছু করছেন না? লিখছেন না তিনি? কথা বলছেন না? নিজে কিছু আবিষ্কার করছেন না? ধরুন বিজ্ঞান থেকে সুরকার থেকে কবি-- কে নতুন কিছু আবিষ্কার করছে বলুন তো? প্রকৃতিতে যা আসছে, তাকেই খুঁজে বের করছে। ডিসকভারি বলা যেতে পারে, প্রায় গোয়েন্দা বা ভ্রমণকারীর মতো বা এক বিজ্ঞানীর মতোই। যিনি মহাকাশে অনুভূতি পেতে আছেন, মহাকাশের রহস্যকে সামান্য হলেও জানার জন্য, তিনিও একপ্রকার কবিতাই লিখছেন। কিন্তু তাঁর খুঁজে যাওয়াটি হচ্ছে ভিন্ন পথে। আমরা সকলেই আসলে মহাবিশ্বজীবনের স্রোতের মধ্যে অবগাহন করে চেতনাকে বা চৈতন্যকে খোঁজার চেষ্টা করছি। আর প্রকৃতিই তার বার্তা আমার কাছে / আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত পাঠাচ্ছে। এই প্রতিনিয়ত পাঠানোর মধ্যে মধ্যে প্রকৃতি বিশেষ কোনও বার্তা বিশেষ ভাবে কখনও কখনও পাঠাচ্ছে। তাকে নির্বিশেষও বলা যেতে পারে। তখন শিল্পীর কাজ হল সেই নির্বিশেষকে বিশেষে অনুবাদ করা। তার লেখনীটিকে এই প্রকৃতির নির্বিশেষ থেকে বিশেষে অনুবাদ করার সময় প্রাসঙ্গিক, বোধসম্পন্ন, সময়ের ভাষায় শাণিত করে রাখাটাই শিল্পীর কাজ। এই সময়ের মধ্যে আবার মিশে থাকে সাম্প্রতিক ছাড়িয়ে সময়চেতনার সময়। কারণ একটি লেখার মধ্যে যেমন বর্তমান থাকে, তেমন থাকে অতীত এমনকী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এই সময়কে বলা যায় আবহমান সময়। আবহমান সময়কে সমসময়ে অনুভব করার কাজটি এবং সমসময়ের মধ্যে আবহমান সময়কে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতাই একজন লেখকের। আর এই কাজটি যিনি করতে পারেন, লেখার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পান। সারাজীবনের কবিতায় এই ব্যক্তিত্বকে খুঁজে চলা এবং আত্মবিশ্বস্ত থাকাটিই এক কবির উদ্দেশ্য। ফলে, আমার চাওয়া না চাওয়ার উপর কিছু নির্ভর করে না। আসল বিষয়টি হল, নিজেকে এক যোগ্য আধার হিসেবে প্রস্তুত রাখা। নিজেকে প্রকৃতির লেখনী করে তোলা। কবি কেবল উপলক্ষ্য মাত্র। আর কিছু না। 




২) এই মুহূর্তে দেশে চলছে একধরণের সংকীর্ণ হিন্দু-মৌলবাদের রাজত্ব। এই বিষয়ে তোমার ভাবনা আর ভিসনটা যদি স্পষ্ট করো...

ভিশন আর কী হবে! দেখতে পাচ্ছি গোটা দেশটাই চলেছে ফ্যাসিবাদের পথে। এক চরম মেরুকরণ চলছে। ইতিহাস বিকৃতি চলছে। এই সংকীর্ণ হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের এক সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নামা উচিত। প্রত্যক্ষ বিরোধিতা না করলে পরে এই ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। 



৩) মৃত্যুকে তুমি তো টেবিল - দূরের সন্ধ্যার মতো দেখে এলে,তাই জানতে চাইছি মৃত্যু সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?

উপনিষদ  তো অনেক আগেই ভাবা হয়েছে অনেক কিছু। বার্গম্যান ভেবে গেছেন। দাবা খেলার মতো। অনেক ধরনের ভাবনা আছে। আলাদা ভাবে কোনও ভাবনাকে আমি সত্য বলে মনে করি না। কারণ গোটাটাই তো কল্পনা।

৪) গদ্য আর কবিতা দুই ভাষাতেই লিখেছো তুমি।দুটো মাধ্যমের আঙ্গিকগত পার্থক্য নিয়ে কী ভাবো?

এ আবার কী প্রশ্ন! গদ্য আর কবিতা আলাদা কোনও ভাষা কি? আলাদা দুটি আঙ্গিক। একটা গদ্য আর একটা কবিতা। এখানেই তো পার্থক্য। আবার কী পার্থক্য হবে!

৫) প্রাতিষ্ঠানিকতা কী কবির বা লেখকের ক্ষতি করে বলে মনে হয়?

প্রশ্নের প্রাতিষ্ঠানিকতা বলতে যদি বোঝায় কোনও বিশেষ বা বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে লেখার বিষয়, তাহলে বলি এসব কোনও কবি বা লেখকের ক্ষতি আদৌ করে না। কোনও লেখক যদি তাঁর ব্যক্তিত্ব, ভাবনাকে অক্ষুন্ন রেখে প্রতিষ্ঠানে লিখতে পারেন, তবে তিনি সজাগ এবং জীবিত লেখক। আর একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক যদি নিজের লেখার প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে হেরে যান, বা বিশেষ কোনও মতবাদ বা গোষ্ঠীবাদ বা বিশেষ কিছু কিছু মানুষের ভাবনা দ্বারা চালিত হন, তাহলে তিনি ঘোষিত সরব অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও মৃত লেখক। অপ্রাতিষ্ঠানিকতার অর্থ নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া। নিজেকে বারবার ভাঙা। এ যুদ্ধ প্রতিষ্ঠানে লিখেও হয়। ক্ষতিটা আসলে তখন হয়, যদি সেই লেখক নিজের আপাত সফল ইমেজের কাছে হেরে গিয়ে তাকেই বারবার রিপিট করতে থাকেন, নিজেকে আক্রমণ করেন না। আর এই সময়ে তো এই প্রাতিষ্ঠানিকতা বা অপ্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনার মানে নেই। কারণ বিষয়গুলি আর সেভাবে নেই। বরং লেখকদের ভাবা উচিত  কীভাবে নিজের কথাগুলি বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর এটি এক প্রকৃত সাবভারসিভ রাজনীতির কাজ। তথাকথিত রাজনীতির না, রাজনীতিকেও যা চালায়, তার কাজ। 



৬)রুচির শুদ্ধতায় বিশ্বাস করো?

রুচিবোধে বিশ্বাস করি, তবে শুদ্ধতা বলতে কী বোঝায়? সব ভীষণ আপেক্ষিক। তথাকথিত পুণ্যবান হওয়ার চেয়ে বরং পাপ করা ভাল। রুচি বলতে ভাবনার সততা বললে অবশ্যই তার শুদ্ধতায় বিশ্বাস করি। নির্মিত সত্যই হল রুচির অশুদ্ধতা। এই ম্যানুফ্যাকচার্ড বা ম্যানিপুলেটেড সত্যই হল বিকৃত রুচি।

৭) শহরের জীবনে বাংলা ভাষার যে বিপর্যয় সেটা নিয়ে কী ভাবছো?

দ্য চেয়ার ইজ সো ছোট দ্যাট আই হ্যাভ টু সিট হাঁটুমুড়ে। এই তো আজকের ভাষা। এই বিপর্যয় বাংলা ভাষার শহুরে বিপর্যয় ডেকে আনছে সন্দেহ নেই। তবে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের বেটন তো কলকাতা বা নগর গুলো ধরে নেই। ধরে আছে মফস্বল, গ্রাম, জেলা, বাংলাদেশ, প্রবাসী বাঙালি এবং ইন্টারনেট। ফলে একটা কাউন্টার স্ট্রাগলও চলছে। কলকাতার কিছু হবে না। এখানে বাঙালিরাও নিজেদের শ্রদ্ধা করে না আর। আশা করি অন্যত্র তা থাকবে না।

৮) ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছো?

ভাবছি, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইজরায়েলের কোনও কবি কী ভাবছে।

৯) পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভাবনা কী?

হয় বিজেপি আসবে নয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রবল হিন্দু করে ছাড়বে। এই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। তাতে তারা সফল। এখানে তাদের বিরোধীরাও রামনবমী আর হনুমানজয়ন্তী পালন করে। তারা আর হিন্দুত্বের বিরোধিতা কী করে করবে! এখানে কয়েকদিনের মধ্যে না রিয়ালিটি শো হয়-- প্রমাণ কর, কারা প্রকৃত হিন্দু! 
এক কথায় অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তবু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই চলছে আর চলবেও। কিন্তু অর্গানাইজড ফ্যাসিস্ট পলিটিক্সের বিরুদ্ধে লড়ার মতো মতাদর্শগত লড়াইটাই বা কই?

১০) সম্প্রতি একটি পত্রিকা আর তার ব্লগ ভার্সান-এর সম্পাদক তুমি।সম্পাদক হিসাবে তোমার ভাবনা যদি জানাও.

আবহমান একটি ছ মাস অন্তর মুদ্রণ পত্রিকা এবং এক মাস অন্তর ওয়েব ভার্সন পত্রিকা। আমরা চেষ্টা করছি বাংলা সাহিত্যের আবহমান যে ধারা তাকেই তুলে ধরতে। বাংলা মেন্সট্রিম সাহিত্যে গদ্যসাহিত্য- গল্প , উপন্যাস এগুলির তো খুব খারাপ অবস্থা। বলা যেতে পারে বাংলা মেনস্ট্রিমের গল্প উপন্যাস পড়লে ( আর যদি কেউ বিশ্ব সাহিত্য পড়ে থাকেন, বা বাংলার আবহমান গদ্য সাহিত্য) মনে হয় বিশ্ব সাহিত্য যদি মেসি হয়, তাহলে বাংলা সাহিত্য ষষ্ঠী দুলে। অবশ্য সমস্যা হল রোনাল্ডো, নেইমাররা নির্জনেই লিখে যাচ্ছেন। তাঁদের লেখাপত্র নিয়মিত প্রকাশ করাটিও আমাদের একটি উদ্দেশ্য। আর ঠিকঠাক সমালোচনা সাহিত্যের একটি ধারা তৈরি করাও আমাদের একটি লক্ষ্য। নতুনদের প্রাধান্যই দিচ্ছি এবং তার সাথে প্রকৃত মেজর কবি সাহিত্যিকদের লেখা তুলে ধরছি। অনেক তরুণ কবিই অনেক কিছু পড়েননি। তাঁদের দোষ না। সঠিক বইগুলি যদি এখন পাওয়া না যায় কী করা যাবে। সাহিত্য নিয়ে সিরিয়াস কাজ করাটাই লক্ষ্য। অনেকটা স্প্যানিশ গ্রানাডার মতো। দেখি, পারি কিনা।

The boy and his longing for heaven


যারা স্বর্গীয় হয়
......................
সব শান্তই ছিল। টব ছিল টবের জায়গায়। আলনা, আলমারি, জলের ডাবর, জুতোর র্্যাক ছিল যে যার জায়গায়। ছেলেটি ছিল না।
কোথায় গেল সে?
সামাজিক হতে গিয়ে সে স্বর্গীয় হয়েছে।
কেমন সে স্বর্গের যাত্রাপথ?
অজ্ঞ লৌহের আর বৈদ্যুতিন সে পথ।
তার কি এঁটেল ছিল না প্রেম?
যেখানে শস্য ভালো হয়, সেখানে ব্রোকার জন্মায়।
ইংরেজি এখানে বেশরকম ত্যাজ্য ডিয়ার।
ডিয়ার এখনও যথেষ্ট গৃহীত ও প্রিয়।
শ্যাওলা শৈবাল পথে আঙুলের পরিশ্রম হবে।
আক্রান্ত বোধ করো বৃষ্টিহীন সান্ধ্য বাতাসে?
বলিনি তো, বলেছি ধীরে চলো ঘরে।
ঘর? সে কি প্রাতিষ্ঠানিক বন?
ছেলেটি কি ঘর চেয়েছিল? শহরতলির কোনো গ্রামে?
দ্বিতীয় ভাগ বর্ণপরিচিতির, সে চেয়েছে।
সূর্যোদয় হয়নি তার সুতির থলিতে?
বর্ণ তার চন্দ্রালোক, বর্ণ তাকে অন্ধ করে দিল।
কেন তার চিকিৎসা হল না?
বিশেষ রোগের বিশেষ ডাক্তারের প্রাচুর্য এখন।
ছেলেটি কি স্বর্গে ভালো আছে?
প্রকৃতিগতভাবে ভালো কেননা সেখানে তো নেই অজ্ঞ লোহা, অনক্ষর বিদ্যুৎ আর মেধাহীন মাংসের প্রহার।
তাকে তুমি সমর্থনই করো, এ আমার জানা।
ছেলেটির মেটে বাবার চোখ দুটি ধার দিতে চাই, আর হাড়, আর গলা, আর ধুতির সুতোয় বোনা নীল লুঙ্গিখানি


জিয়া হক


A few lines and by lanes



গর্দভ এক খোকা
........................
প্রেরণাজাত শহরের যত লগি
ঠেলে আনে রোগা
সেই কালো মনোরোগী

হয় হয় রাত
ডাকে পেঁচা আর লোকে
আসে সাইকেল
বায়ুপ্রাণ এসে ঢোকে

আধা শহরের ভারবাহী সব দিক
দেখে যায় খালি
বোকা ওই মানসিক...

সান্ধ্য বিড়ির উপযোগিতার মতো
এমন লোকেরা ড্রেনে হয় নির্গত
আগুনে পোড়ে না, জলেও কি ডোবে এরা?
এদের তীরেই দেবতার ঘোরাফেরা




কীটমানুষ 
.............. 
কীটনাশক এইখানে পড়িয়াছ‌ে কম 
জঙ্গলের গাছে কেউ সার মারে নাকি 
বাক্য দিয়ে আমি তাকে বুঝিতে সক্ষম 
শস্যদের খাদ্য হওয়া 
                     এখনও যে মাসাধিক বাকি 

আমি তো পচনশীল, হাটে ও বাজারে 
জঙ্গলের গাছে আহা সার কেউ মারে? 

পরিচর্যাহীনভাবে আমি আছি দেখো 
লক্ষ রাখি 
               শস্য ধান্য কণা 
গতরের ঠিক দাম আজও জানিনেকো 
ফলত শ্রমের ক্রেতা 
                    ধন্যবাদ-
সহ আট আনা 
দেয়।  আজ সূর্য উঠল খুব 
মুঘল যুগের যেন সেনা 
পাখা থেকে হাওয়া পড়ে —টুপ 
গ্রন্থপঞ্জি 
            আমাকে জানবে না 




কুকুরভর্তি মাথা 
...................... 
ফলত এখানে জাগতিক কোনো পিঠা 
হয়নি বানানো, জানতে চাইছো মঙ্গলপদ কী তা ? 
নয়া সন্দেশ গড়ে ওঠে ভান্ডারে 
লোক নেই তাই মাছি আসে কিনিবারে 
মালিক প্রয়াত, কুকুরেরা ডাকে খুব 
গেটে তালা ঝোলে, কাঁচা পাতাদের স্তূপ 
পোড়ে না অথচ নাকে মুখে এসে লাগে 
যেদিন বৃষ্টি সেদিনের পুরোভাগে 
একটি বৃদ্ধা পাতা কুড়নোর ছলে 
বলে ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বলে 
হোটেল যেখানে, উনিশ শ দুই সালে 
বুনো ঝোপ আর শেয়ালের গোলমালে 
ভেঙে গিয়েছিল যত ছিল সেরা ফুল 
ভিজে যায় শুধু সাদা বুড়িমার চুল 
ছিল কি বিপদ, ছিল কি শান্তি এত? 
রেলগাড়ি আসে, হয়নি কি উন্নত? 
প্রাচীন লোকেরা গায় যত লোককথা 
অঞ্চলে তত নেমে পড়ে নীরবতা 
আকাশে কত না বিদ্যুৎ জন্মালো 
'এসো সখি আজ বোরখাটি খুলে ফেল।'
দেখো মোহরের ছড়াছড়ি ওই দেশে 
লোক নেই তাই মাছি বসে সন্দেশে 



জিয়া হক 


De-lit


সাহিত্য কী?
................
জনৈক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করলেন, সাহিত্য কী?
বললাম, জানি না স্যার।
আমার সামনেই বসে ছিলেন এক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বললেন, সে কি, সাহিত্যে এম এ করেও সাহিত্য কী জানো না? সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
আমি বললাম, একটা নতুন বিষয় জানলাম স্যার। অনেক ধন্যবাদ।
এরপর থেকে কেউ সাহিত্যের সংজ্ঞা জানতে চাইলে বলি, সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
কালবৈশাখী সবে শান্ত হয়েছে। বাতাবরণ ঠান্ডা। এক কবিবান্ধব জিজ্ঞেস করল একই প্রশ্ন, সাহিত্য কী?
কেন, সাহিত্য হল সমাজের দর্পণ।
দর্পণ মানে?
দর্পণ মানে তো আয়না, তাই না?
সাহিত্য কি আয়না হয়ে সমাজকে তার শরীর দেখিয়ে দেয়?
দেয় না?
তাহলে খবরের কাগজ সাহিত্য?
উত্তর দিতে না পেরে বললাম প্রধান শিক্ষকের থেকে জেনে এসে বলব।
প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রশ্নটি শুনে বললেন, খবরের কাগজ কোনদিন সাহিত্য হতে পারে? ও তো রিপোর্ট। সাহিত্যে মনের প্রতিফলন হয়।
আমি জেনে এসে কবিবান্ধবকে বললাম। সে বলল, তাহলে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাইকায়াট্রি বিভাগের বইগুলো সাহিত্য?
আমি প্রধান শিক্ষককে বললাম এ কথা। তিনি বললেন, মন সাধারণত দুই প্রকার। এক হল ব্যক্তিমন, দুই হল সমাজমন। সাহিত্য হল ওই সমাজমনের দর্পণ।
এই শুনে কবিবান্ধব বলল, সমাজ-মনস্তত্ত্বের বইগুলো তাহলে সাহিত্য, তাই তো?
এইবার প্রধান শিক্ষক বললেন, সাহিত্য মানে সহিতত্ত্ব, মানে মিলন, মানে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনই হল সাহিত্য।
কবিবন্ধু এই শুনে বলল, তাহলে তো বিয়ের চেয়ে বড় সাহিত্য আর কিছু নেই। সেখানে তো সাহিত্য আবার গর্ভবতী হয়ে কচি কচি সাহিত্যের জন্ম দিচ্ছে, তাই না?
আমি পড়লাম আতান্তরে। সাহিত্যের সংজ্ঞা জানতে চাইলে আমি শুধু বলি, জানি না তবে আলোচনা চলছে। মীমাংসা হলে জানাব।
কয়েক মাস পর একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে প্লুটো গ্রহকে নিয়ে একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হল। আমি গল্পটি নিয়ে সেদিন সকালেই প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলাম। বললাম, স্যার, এই গল্পটিকে কি সাহিত্য বলা যাবে, এখানে তো প্লুটোর কথা বলা হয়েছে, পৃথিবীর কথা, সমাজের কথা নেই?
তিনি বললেন, কিন্তু বেরিয়েছে তো পার্থিব মস্তিষ্ক থেকে। অতএব এ সাহিত্যই। তাছাড়া প্রথম শ্রেণীর দৈনিক ছেপেছে, তা কি সাহিত্য না হয়ে পারে?
সন্ধ্যায় কবিবান্ধব সে-কথা শুনে বলল, অর্থাৎ পার্থিব মগজ থেকে যা বেরবে তা-ই সাহিত্য? মানে খুনের কৌশলও সাহিত্য, তাই তো? আর প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে যা ছাপা হয় তাই সাহিত্য? ওটা কি সাহিত্য-মিটার?
প্রধান শিক্ষক মহাশয় বললেন, তোমার বন্ধুটিকে একবার এনো তো।
কবিবন্ধু বলল, তোমার প্রধান শিক্ষককে একবার দেখতে চাই।
দুজনকেই আমার বাড়িতে এক রবিবার নিমন্ত্রণ করলাম। কথা হল, দুপুরে আমার বাড়িতে তাঁরা খাবেন আলাপ, আলোচনা হবে।
যথারীতি পরের রবিবার যতটুকু সামর্থ্য সুখাদ্যের আয়োজন করলাম। ওঁরা আসবেন। মা কে বললাম, নতুন শাড়ি পরো। আব্বাকে বললাম, নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দাও।
সাড়ে বারোটা বেজে গেল, কারও দেখা নেই। মা বলল, একবার ফোন করে দেখ না।
প্রথমে প্রধান শিক্ষককে ফোন করলাম। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। তাঁর ফোনের সুইচ অফ।
তারপর কবিবন্ধুকে কল দিলাম। তার ফোনও বন্ধ।
এরপর থেকে কেউ আমাকে সাহিত্য কী জানতে চাইলে বলি,
সাহিত্য মানে 'আপনি যে নম্বরে কল করেছেন, সেই নম্বরটি বর্তমানে সুইচ অফ আছে। ধন্যবাদ।'


জিয়া হক