ভারতীয় ইতিহাসবিদরা ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে’র মোকাবেলায় ব্যর্থ কেন? শোয়েব ড্যানিয়েল

ভারতে “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে”র বাড়বাড়ন্তের জন্য ইতিহাসবিদ উইলিয়ম ডালরিম্পল ভারতীয় ইতিহাসবেত্তাদেরকেই দায়ী করেছেন। ইতিহাসের ছদ্মবেশে ভুয়ো ব্যাখ্যা ছড়িয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্য (পড়ুন হিন্দুত্ববাদী) মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই কৌশলে। ডালরিম্পল বলেছেন, “আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, প্রায় ৫০-এর দশকের শুরু থেকে বর্তমান শতকের শুরু অবধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাসের যে চর্চা হয় তা শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং তাঁরা প্রায়শই এমন অস্পষ্ট ও ঝাপসা ভাষায় সাব অল্টার্ন বিদ্যা বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন যে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এর ফলে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস’ ও ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।” ভারতের পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদরা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই এমনটা ঘটছে। উইলিয়ম ডালরিম্পল ভারতীয় ঐতিহাসিকদের সমালোচনা করায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে না বা অনেকে স্বীকার করে নিয়েছেন তা হল—হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস। ভারতে আম আদমি সহজে ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়ায় এমন তীব্র সাংস্কৃতিক পরিণতি হয়েছে এবং ভুয়ো ইতিহাস তৈরি করা হচ্ছে ও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষেশ উদ্দেশ্যে। হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পিছনে এই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুয়ো ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডালরিম্পল উল্লেখ করেছেন, এই ছদ্ম ইতিহাস জেনে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির অস্তিত্ব ছিল, মহাভারতে পারমাণবিক বোমার ফর্মুলা রয়েছে এবং রামায়ণ হেলিকপ্টারের মতো আকাশযানের কথা বলেছে। তবে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক বিষয় হল, মধ্যযুগীয় ভারতের মুসলিম রাজা ও সম্রাটদের অত্যাচারী, নৃশংস ও কদর্য রূপে তুলে ধরা হচ্ছে। এই সম্রাটদের কয়েকজন মাত্র ধর্মীয় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সকল মুসলিম বাদশাহকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে এই ভার্চুয়াল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’। ভারতের শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে ডালরিম্পল যে মন্তব্য করেছেন তা সর্বৈব ভুল নয়। ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে’র এই তুমুল সাফল্যের আংশিক কারণ হল, গবেষণালব্ধ বিদ্যায়তনিক ইতিহাস সমাজের সব স্তরে পৌঁছায়নি। বরং ঐতিহাসিকদের একটা ছোট বৃত্তের মধ্যে এটা সব সময় আটকে গেছে। গবেষণার ফলে উঠে আসা প্রকৃত ইতিহাসের কাছে পৌঁছনো সাধারণ পাঠকের পক্ষে কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া, যে ভাষায় ও লব্জে বিদ্যায়তনিকে পাঠ্য ইতিহাস লেখা হয় তা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে এবং এ থেকে আন্দাজ করা যায়, ইতিহাস চর্চার ধারায় একটা বড় ঘাটতি বা সমস্যা রয়েছে। তবে, উইলিয়ম ডালরিম্পল সম্ভবত যেটা খেয়াল করতে ভুলে গেছেন তা হল, শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের দায়ী করা ঠিক নয়। হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থানের পিছনে রয়েছে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি। জনতার কাছে এই ইতিহাসের গ্রহণযোগ্যতা অনেক। তারা অনায়াসেই এগুলি বিশ্বাস করে ও অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয়। এর একটা কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেহরুর জমানায় এটা ঘটেনি। স্পষ্টতই সেই যুগের রাজনীতি এই ধরনের ভুয়ো ইতিহাসকে মদত দেয়নি, বরং গবেষণাভিত্তিক অ্যাকাডেমিক ভাষ্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন নিজেদের অন্ধ, গোঁড়া ও বিকৃত ভাষ্য, বয়ানকে প্রচার করতে দীর্ঘ সময়, প্রচেষ্টা ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এটা নিশ্চিত, বিদ্যায়তনিক ইতিহাসবিদরা যদি জনগণের সঙ্গে আরও বেশি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত থাকতেন তাহলে তাঁরা এই ভুয়ো ইতিহাসকে খানিকটা হলেও মোকাবেলা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা কি এটা পাল্টাতে পারতেন? সম্ভবত না। অনেকে মনে করেন, মানুষের কাছে পৌঁছনোর গুরুত্ব ও মূল্যকে বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিহাসবিদদের উপস্থিতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রাজনৈতিক ভাষ্যের পাঁকভর্তি নর্দমা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করছেন তাঁরা। ট্যুইটার (বর্তমানে এক্স), ইউটিউব, এমনকি ইন্সটাগ্রামেও ব্যবহারকারীরা গবেষণা-ভিত্তিক ইতিহাস খুঁজছেন এবং তাঁরা আলোর সন্ধান পাচ্ছেন। এটা আশার দিক। তাহলে কি এই সব গবেষণাপুষ্ট ইতিহাসবিদরা হিন্দুত্ববাদী “ইতিহাস”কে পরাস্ত করতে বা সমকক্ষও হয়ে উঠতে পারবে? এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে বলা যায়, এ লড়াই অসম। “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস” এতখানি ভাইরাল যে এর সঙ্গে মোকাবেলা করা কঠিন। একদল স্বেচ্ছাসেবী এগুলি ছড়ায় এবং তাদের সেই ধারণা সহজে মানুষ গ্রহণ করে কারণ এতে তাদের বদ্ধমূল ধারণা আরও জোরালো হওয়ার সুযোগ পায়। তবে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ, এই ইতিহাসবিদরা হারিয়ে যাননি, তাঁরা রয়েছেন এবং তাঁরা ভাল লড়াই দিচ্ছেন এই ভুয়ো ইতিহাসের প্রচারণার বিরুদ্ধে। রাজনীতি একটা লম্বা খেলা এবং প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার একমাত্র রাস্তা হল, রণক্ষেত্র থেকে সবাইকে হটিয়ে দেওয়া। নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধির জমানা থেকে হিন্দুত্ববাদী তাত্ত্বিকরা এটা খুব ভাল ভাবে বুঝতেন। কিন্তু কংগ্রেসের সেই যুগ তাঁদের জন্য অনুকূল ছিল না। বিদ্বেষপরায়ণ এই হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিপক্ষ যারা তাদের বইয়ের পাতা উল্টে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং জন পরিসরে তাদের উপস্থিতিকে টের পাইয়ে দিতে হবে। আজকের যুগে “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস” ও “হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়” আধিপত্য কায়েম করলেও এটা হেজেমনিক হয়ে উঠবে না এবং সাধারণ মানুষের জন্য পাল্টা যুক্তি যেন সব সময় হাজির থাকে ও সেই যুক্তি তারা যেন অনায়াসে লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করা দরকার।

গাহা: শুভদীপ মৈত্র


(একটি ক্রম বিবর্তনশীল কবিতা, যা লেখা হয়ে চলেছে এবং বদলে চলেছে আর তার বদলাতে থাকা চেহারা ব্লগে ফুটে উঠবে)


রাস্তাই এখন একমাত্র রাস্তা

ট্যাক্সির পেটের ভিতর থেকে দেখছি

জোনাকির মতো দপদপে পিছলে যাওয়া 

আলোকিত জানলাদের, আর হাওয়ার ঝাপটা 

আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিগত শতকে

এই হলুদ অ্যাম্বাস্যাডর ও তার বৃদ্ধ চালক 

সারথির মতো, অথবা টাইম মেশিন – 

শতবর্ষ আগের হুমায়ুন প্লেস অথবা লিন্ডসে থেকে

বালিগঞ্জের দিকে থ্রি-পিস স্যুট ও চুরুটে তরুণ 

বিভ্রান্ত যাতায়াতে – একটা পৃথিবী শেষ হচ্ছে 

আরেক নতুনের ঝাপসা অবয়বে সে বিমূঢ় 

এলিয়ট ও নাগরিকতার চর্চার শেষে পড়ে আছে

ঔপনিবেশিক অন্ধকার।


এভাবে আমিও দেখছি কনফেটির মতো আলো 

ছড়িয়ে পড়ছে সড়কের দু-পাশে। ফিরে যাচ্ছি।  

অথচ বাসার কোটর আমার জন্য নয়,

বই-পাড়া, ঐতিহ্যের সদাগরি 

মজ্জমান কলকাতা শহর ছেড়ে চলেছি

আশ্চর্য এই চার চাকার যানে।


২ 

শুধু একটা মূর্ছনার খোঁজে কবিতার কাছে আসা। 

অর্কেস্ট্রা 

অদৃশ্য কোনো কন্ডাকটরের হাতের ঈশারায় 

বেজে চলেছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে

এক কোষী প্রাণের স্পন্দন থেকে জটিলতম বিবর্তনে

সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে পর্বতের ঢেউয়ের গঠনে

দাবানলে, ঘনঘোর মৌসুমি বর্ষায়

কিশোরের শিশ্নে প্রথম চলকে ওঠা উত্তেজনায়

কিশোরীর বুকের বোঁটার প্রথম শিহরণে 

কবিদের কখনো না-লেখা সার্থক কবিতায়

সুর, মূর্ছনা, ছন্দ, স্পন্দন 

বেজে চলেছে অনিবার। 


শুধু এই মূর্ছনার খোঁজ দিতে পারলে

শয়তানের কাছে বন্ধক রাখা যেত আত্মাকে পাগানিনির মতো

অথবা সে সুরে পৌঁছলে,  বসন্তের শেষ কৃত্যে 

যেমন স্ট্রাভিনস্কি খেপিয়ে তোলেন সাধারণ্যের অভ্যস্ত কান

তাকে অবুঝ রাগে ধ্বংস করতে চায় সে জনতা

অসহনীয় তেমন সুন্দরের স্পর্শে শিউরে উঠি

মৃত্যুকেও সহজ মনে হয়।


 অথচ এর আভাসটুকু শুধু মধ্য চল্লিশে। 

১৪৩১ সন – বাতাসে বিষ, ঘৃণার উত্তাপ;

পাহাড় জঙ্গল হিমবাহ – দালির ঘড়ির মতো, 

ভয়ংকর বিকৃতিতে গলে পড়ছে, 

সংবিধান ও সংহিতা চরম নাস্তিতে বিলিয়মান,

অটুট স্বাস্থ্যের বদলে প্রাত্যহিক ছন্দপতনে 

শুকোচ্ছে আমের মুকুল। 

দরকচা দৈনন্দিনে অপার্থিব ভিনাস 

শরীর সর্বস্বতায় সামান্য স্ট্রিপার-সাজে 

নীল পর্দার মেটাচ্ছে খোরাকি,

ধর্ষকাম লালা ঝরাচ্ছে হাজারো জিভ

সুফির ‘মস্তি’ আজ ভোগীর পুংডন্ডে ঠেকেছে। 


হায়, সুর ও সোমরস... 

ইউনানি সাধনে শরীর ও মন, 

মননের উজ্জ্বল স্ফুরণে নাগরিক হতে চেয়েছিল

আদর্শ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটা ইঁট গাঁথার শুরুতে

ভাব ও বস্তুর স্বরূপের খোঁজ; 

সেখানেই সংগীত সেখানেই সংখ্যা,

আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়,

নীল ক্যাসিডির গাড়ি এসে থামে;

নাগরিক সংকীর্তন জ্যাজের আলাপে

বেজে ওঠে – হ্লাদিনী উন্মাদপারা

জাগরুক সে আজ মেটালের সুর বিস্তারে

পিনা বাউশ-এর পায়ের ছন্দে যেমন দেখেছি 

আবির্ভূত হন নটরাজ,

যেমন বিচ্ছেদ ও প্রেমে দ্বান্দ্বিক যাতায়াত

প্রলয়ের মাঝে সুন্দরের প্রকাশ – 

ত্রস্ত করে, প্রতি মুহূর্তে টানটান রাখে আমাদের৷ 

আমার জানলার নামানো কাঁচে

শহরের উচ্চতম বাড়ি পেরিয়ে, এখন  

ঠিকরে উঠছে ‘নক্ষত্রের রাত’ 

হলুদ ট্যাক্সির চালক গুনগুন করে উঠল 

বাবুল মোরা নৈহর ছুট যায়... 

আমি তাকিয়ে দেখলাম আকাশের তারাগুলো 

মরে যাচ্ছে একটা একটা করে। 



আমি একটা মন্ত্র-বর্জিত সুরের পিছু ধাওয়া করছি

পৌনঃপুনিকতায় যা আমাদের ভোঁতা করে দেয় না,

যেভাবে প্রত্যেক মুহূর্তে মেঘেরা আকাশের ক্যানভাসে 

নতুন বিন্যাস হয়ে ওঠে তার তলায় চলমান মানুষের 

স্রোতও বদলাতে থাকে – ক্যালাইডোস্কোপের মতো;

আমি শিকারির মতো নই, কাউবয়ও না, 

নেহাত ভুল করে বা গ্রহের ফেরে আনাড়ির বেওকুফিতে 

হলিউড ওয়েস্টার্নের সালোন গার্ল-এর টেবিলে উঠে নাচ 

আর পায়ের মলের শব্দে – সচকিত। 

               একটা নগ্ন মোলায়েম পা

ঘূর্ণিঝড়, দুলন্ত হ্যারিকেন, ক্যান্টনের আফিমের ঠেক

একই সঙ্গে ঝিম ও আলপিনের তীক্ষ্ণতা 

সার শরীরকে টার্ন-টেবলের মতো গীতিময় রাখছে। 

একটা টেবল ফ্যানের ফররাও কী ভাল 

বেসিনে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার শব্দ 

দুটো হুলো বেড়ালের টার্ফ-ওয়ার

লিখিত শব্দ বা ছাপা কবিতার থেকেও বাঙময়,

আমি স্বপ্ন দেখতে চাই না আর, বরং শুনতে চাই

শ্রুত স্বপ্নরা বেজে চলুক দিন রাত।  


সমস্ত মানুষের ঘুমের ভিতর থেকে উঠে আসা মন্তাজে 

সুর বসে যাচ্ছে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে;

হানাদারি ড্রোন মৌমাছির মতো গুঞ্জরণে উড়ছে,

কালো হাওয়ার ঝড়, হাওয়ায় আগুন আর বিষ

নিচে সরসর সরছে মাটি, তলিয়ে যাচ্ছে বসতি 

মাথার ভিতর যারা বুনেছিল সভ্যতা 

তাদের স্বপ্নের ভিতর ছায়া ফেলছে ধ্বংসবীজ,  

ফিলিস্তিন থেকে সবুজ-বাংলায়, তুষিত স্বর্গের বাগানে

ঘাতকের ই.ডি.এম বেজে চলেছে অনিবার 

ব্যাবিলনের, বাঘদাদের, লোথালের প্রতি রাতের খোয়াবে

স্বপ্ন-রাক্ষস এক শিশুদের নিয়ে যায় অগম দেশে।  


তবুও বৃষ্টির সামান্য দু-ফোঁটা আভাসে যেমন

জেগে ওঠে ঘাসের শিষেরা, সেভাবেই মানুষ ও মানুষীর 

প্রেমের আধো-বলা কথারা ভেসে উঠতেই দেখছি আরেক 

সুরের প্রতিরোধ, শত-শত নিলাজ শীৎকারের মধ্যে,

বন্ধুর হাতের স্পর্শের বিশ্বাসে – জেগে উঠছে কন্ট্রাপয়েন্ট,

শুধু শেষের কথা বোলো না আজ, 

           কিছু নতুন জন্মের কথাও শোনাও

                 নতুন বিন্যাসে জুড়ে যাবে মানুষেরা 

                       নিয়ে আসবে নবতম ম্যানিফেস্টো

সুরের মূর্ছনার ঘাত-প্রতিঘাতে আমরা পূর্ণতা পাব বলে। 


কোনো কিছুই বেসুরো লাগছে না তারিফ-অপ্রত্যাশী কানে,

শুনি নীলবসনা সুন্দরীর পিছু ধাওয়া করে দেবেন্দ্রবিজয়

না-কি দেবেন্দ্রবিজয়ের খোঁজে সে রহস্যময়ী?

ধরা দেবে কে কার কাছে জানা নেই অনক্ত বেলায়?

কেন-না রহস্য বস্তুটাই আসলে এরম

অনেকটা বাক্যের মতো, কবিতার থেকে টেনে আনলে 

যেমন অজস্র অর্থ আর অর্থহীনতার আলোছায়া,

তবুও দেবেন্দ্রবিজয় আছে, দাঁড়িয়ে ঈষৎ আড়ালে,

যেমন হামফ্রে বোগার্ট মলটিজ ফ্যালকনে স্থির – 

‘ব্রায়র পাইপ হাতে লোলচর্ম’ যাকে সে দেখে 

সেই জ্ঞানী-বৃষ, বেগুনী পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ও গরল 

গিলে ফেলে ছায়া ও ধোঁণার মেঘ নিয়ের ফেরে 

দেবেন্দ্রবিজয় তাই পারে না ঠাওড়াতে। 

দেবেন্দ্রবিজয় পুরনো পৃথিবীর সত্যান্বেষীদের মতো 

যুক্তিবাদে পোক্ত, তার্কিক, এককথায় 

রেনেসাঁস পুরুষের শেষতম খোঁয়াড়ি

সে জানে অবরোহী বা আরোহী কাঠামোয় ধাপেধাপে

পৌঁছনো যায় সিদ্ধান্তে, তারপর তাক লাগানো – এক্সপোজিশন। 

অথচ সে এই কবিতার ভিতর ঢুকে ক্লুহীন হয়েছে

ধোঁয়াটে পৃথিবীতে সে দেখছে 

               ক্রমশ প্রতিটা মানুষই তদন্ত সাপেক্ষ। 



এখনো তাদের ভাল লাগে শাদা পায়রার উড়াল

শারদ-নীল বিকেলের আকাশ যদি থাকে,

একখানা ডিঙি নৌকোর জল কেটে এগনো,

দু-হাতে দাঁড় টানা, অথবা কালাপোখরির পথে 

রাকস্যাক নামিয়ে পেঁজা-তুলো মেঘ মুঠো ভরে

বারান্দায় পা ছড়িয়ে শেষ শীতের রদ্দুর

ঝিম ধরা বৃষ্টিতে ওল্ড মংক রামে-ভেজা ঠোঁট

 - কিছু কিছু মানুষের মাথায় এসব দৃশ্য 

এখনো জন্ম নেয় বেগুনী জগতে, প্রযুক্তি যুগের

সুতানুটি শহরে বুঝি বিভ্রমের মতো

দিবাস্বপ্ন। নয়েজ। ভাইরাজ। এরর নম্বর ৩৫৭৯…

প্রচীন সারল্যের গোস্তাকি কেউ করে ফেলে

কে যেন ফিসফিউস করে বলে যায় 

ডিজিটাল শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই তার

এদেরই কি খুঁজে ফেরে জ্ঞানীবৃষ?

এদেরই কি খুঁজে ফেরে দেবেন্দ্রবিজয়? 


পূর্ব-পাঠ এই লিঙ্কে:

https://museumrural.blogspot.com/2024/05/blog-post.html?m=1


শ্যামল বৈদ্যকে পারলে না চিনে নিতে। প্রশান্ত হালদার



আজও আমরা শ্যামলকে জানলাম না

প্রচার করলাম না তার নাম;

না-দেখেই, না-বুঝেই কত না সংকীর্তন গাওয়া হলো বাংলার পথেঘাটে

ঢোল-কত্তাল নিয়ে, জোড় হাতে, দুহাত গৌরাঙ্গ করে—

তাও শ্যামলকে জানতে চাইলাম না


আধ্যাত্মিক এই ভারত তীর্থে শ্যামল বৈদ্যকে চিনে নেওয়া এতটা কঠিন!

আজও তার নামগান করলাম না, অথচ

'শ্যামল বৈদ্য ছাড়া মানুষের দ্বিতীয় পথ নেই'

গন্তব্যও নেই


দেখেছি, বাঁশের চ্যাড়া হাতে উদ্যত রাইফেল লক্ষ্য করে শ্যামল, নিজেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে নেয়, হেসে ওঠে ট্রিগার চালক, সেই হাসি, হাসিরা ও হাসিগুলি আত্মবিদ্রুপ হয়ে দুনিয়া ভ্রমণ করে, থামতে জানে না; শ্যামল বৈদ্য—তার ক্লান্তি নেই পরাজয়ে, আর বিজয়ী রাইফেল হাসতে হাসতে, হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়বে একদিন, এমনই শ্যামল দিন আসবেই, শ্যামল বৈদ্য তার হাসি মুখে, লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে পরাজয়ের নতুন অপেক্ষায় থাকবে প্রস্তুত, তাও তুমি শ্যামল বৈদ্যকে পারলে না চিনে নিতে!

পয়লা বৈশাখের কবিতা। শুভদীপ মৈত্র


রাস্তাই এখন একমাত্র রাস্তা

ট্যাক্সির পেটের ভিতর থেকে দেখছি

জোনাকির মতো দপদপে পিছলে যাওয়া 

আলোকিত জানলাদের, আর হাওয়ার ঝাপটা 

আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিগত শতকে

এই হলুদ অ্যাম্বাস্যাডর ও তার বৃদ্ধ চালক 

সারথির মতো, অথবা টাইম মেশিন – 

শতবর্ষ আগের হুমায়ুন প্লেস অথবা লিন্ডসে থেকে

বালিগঞ্জের দিকে থ্রি-পিস স্যুট ও চুরুটে তরুণ 

বিভ্রান্ত যাতায়াতে–একটা পৃথিবী শেষ হচ্ছে 

আরেক নতুনের ঝাপসা অবয়বে সে বিমূঢ় 

এলিয়ট ও নাগরিকতার চর্চার শেষে পড়ে আছে

ঔপনিবেশিক অন্ধকার।


এভাবে আমিও দেখছি কনফেটির মতো আলো 

ছড়িয়ে পড়ছে সড়কের দু-পাশে। ফিরে যাচ্ছি।  

অথচ বাসার কোটর আমার জন্য নয়,

বই-পাড়া, ঐতিহ্যের সদাগরি 

মজ্জমান কলকাতা শহর ছেড়ে চলেছি

আশ্চর্য এই চার চাকার যানে।


২ 

শুধু একটা মূর্ছনার খোঁজে কবিতার কাছে আসা। 

অর্কেস্ট্রা 

অদৃশ্য কোনো কন্ডাকটরের হাতের ঈশারায় 

বেজে চলেছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে

এক কোষী প্রাণের স্পন্দন থেকে জটিলতম বিবর্তনে

সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে পর্বতের ঢেউয়ের গঠনে

দাবানলে, ঘনঘোর মৌসুমি বর্ষায়

কিশোরের শিশ্নে প্রথম চলকে ওঠা উত্তেজনায়

কিশোরীর বুকের বোঁটার প্রথম শিহরণে 

কবিদের কখনো না-লেখা সার্থক কবিতায়

সুর, মূর্ছনা, ছন্দ, স্পন্দন 

বেজে চলেছে অনিবার। 


শুধু এই মূর্ছনার খোঁজ দিতে পারলে

শয়তানের কাছে বন্ধক রাখা যেত আত্মাকে পাগানিনির মতো

অথবা সে সুরে পৌঁছলে,  বসন্তের শেষ কৃত্যে 

যেমন স্ট্রাভিনস্কি খেপিয়ে তোলেন সাধারণ্যের অভ্যস্ত কান

তাকে অবুঝ রাগে ধ্বংস করতে চায় সে জনতা

অসহনীয় তেমন সুন্দরের স্পর্শে শিউরে উঠি

মৃত্যুকেও সহজ মনে হয়।


 অথচ এর আভাসটুকু শুধু মধ্য চল্লিশে। 

১৪৩১ সন–বাতাসে বিষ, ঘৃণার উত্তাপ;

পাহাড় জঙ্গল হিমবাহ–দালির ঘড়ির মতো, 

ভয়ংকর বিকৃতিতে গলে পড়ছে, 

সংবিধান ও সংহিতা চরম নাস্তিতে বিলীয়মান,

অটুট স্বাস্থ্যের বদলে প্রাত্যহিক ছন্দপতনে 

শুকোচ্ছে আমের মুকুল।  দরকচা দৈনন্দিনে 

অপার্থিব ভিনাস শরীর সর্বস্বতায় সামান্য স্ট্রিপার 

সাজে নীল পর্দার মেটাচ্ছে খোরাকি,

ধর্ষকাম লালা ঝরাচ্ছে হাজারো জিভ

সুফির ‘মস্তি’ আজ ভোগীর পুংদণ্ডে ঠেকেছে। 


হায়, সুর ও সোমরস... 

ইউনানি সাধনে শরীর ও মন, 

মননের উজ্জ্বল স্ফুরণে নাগরিক হতে চেয়েছিল

আদর্শ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটা ইঁট গাঁথার শুরুতে

ভাব ও বস্তুর স্বরূপের খোঁজ; 

সেখানেই সংগীত সেখানেই সংখ্যা,

আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়,

নীল ক্যাসিডির গাড়ি এসে থামে;

নাগরিক সংকীর্তন জ্যাজের আলাপে

বেজে ওঠে–হ্লাদিনী উন্মাদপারা

জাগরুক সে আজ মেটালের সুর বিস্তারে

পিনা বাউশ-এর পায়ের ছন্দে যেমন দেখেছি 

আবির্ভূত হন নটরাজ,

যেমন বিচ্ছেদ ও প্রেমে দ্বান্দ্বিক যাতায়াত

প্রলয়ের মাঝে সুন্দরের প্রকাশ – 

ত্রস্ত করে, প্রতি মুহূর্তে টানটান রাখে আমাদের৷ 

আমার জানলার নামানো কাচে

শহরের উচ্চতম বাড়ি পেরিয়ে, এখন  

ঠিকরে উঠছে ‘নক্ষত্রের রাত’ 

হলুদ ট্যাক্সির চালক গুনগুন করে উঠল 

বাবুল মোরা নৈহর ছুট যায়... 

আমি তাকিয়ে দেখলাম আকাশের তারাগুলো 

মরে যাচ্ছে একটা একটা করে। 


(একটি ক্রম বিবর্তনশীল কবিতা, যা লেখা হয়ে চলেছে এবং বদলে চলেছে আর তার বদলাতে থাকা চেহারা ব্লগে ফুটে উঠবে)

ছোটগল্প: উট। জিয়া হক


আজ নীচু তারে হাওয়া বইছে। বিছানার চাদর পরিপাটি, উড়ে যায়নি। মনে হচ্ছে, আজ সবার ভাল ঘুম হবে।
হাতের কাছে জল থাকা দরকার। নেই, তাই আমাকে উঠে বসার ঘরে যেতে হল। বসার ঘরে রঙিন মাছের ঘর, বনসাই করা বট ও বাঁশ, প্লাস্টিকের লতাপাতাফুল। পাশেই বারান্দা। বারান্দার জানালা খোলা। জানালা দিয়ে মহিষবাথান কলেজের অধ্যাপকের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অধ্যাপকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে দীঘার সমুদ্রের ধারে এক গ্রামে। বেড়াতে গিয়ে তাদের আলাপ হয়েছিল।
বসার ঘরে জল নেই। ডাক্তার বলেছে, দুশ্চিন্তা হলে জল খাবেন। আমার এখন দুশ্চিন্তা। কী নিয়ে চিন্তা ট্রেস করতে পারছি না, কিন্তু মাথা ভরাট হয়ে আছে। রান্নাঘরে জল থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পা ফেলতে হবে। দরজাও খুলতে হবে সন্তর্পণে। আলো জ্বালাতে হবে সন্তর্পণে। ডাক্তার বলেছিল, এবার থেকে আপনার গোটা জীবনটাই কাটাতে হবে সন্তর্পণে।
রান্নাঘরের অবস্থা ভাল নয়। চিমনি নেই। ঘুলঘুলি দিয়ে সব ধোঁয়া বের হয় না। কালি হয়ে গেছে দেওয়াল। অথচ আমার এখন জলের প্রয়োজন। পানীয় জলের সরবরাহ প্রায় বন্ধ গাজায়, মনে পড়ল। আমার আজকাল এই সব মনে পড়ে। কন্টেক্সট কী, কেন—মনে থাকে না।
তিনটে তাকিয়ায় সার সার বোতল। ছোট, বড়, মোটা, চ্যাপ্টা, দামি, সস্তা, রঙিন, সাদা, ময়লা, পরিষ্কার, গোল, সরু বোতল। এতে জল ভরা থাকে সারাদিন। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয় বোতলের জল নামতে থাকে। মাঝরাতে বোতল খাঁ খাঁ করে। কোনও বোতলে জল নেই। আমার মাথা আরও ভরাট হয়ে উঠছে। সবাই ঘুমোচ্ছে। বাড়িতে জল নেই, কেউ জানে না, গোপন করে রেখেছে। জলের কারণে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে আর দুশ্চিন্তার কারণে আমার জল দরকার।
ধীরে ধীরে গেট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। রাস্তার কলে কি জল পাওয়া যাবে না? আমাদের এই রাস্তায় পাঁচ মিনিট অন্তর একটা করে সরকারি কল। গোলপুকুরের মোড় অবধি কমপক্ষে তিনটে কল। তবে জল বন্টনের সময় নির্দিষ্ট। মাঝরাতে জল সরবরাহ হয় না সম্ভবত। কিন্তু আমি সোফায় বসে, বিছানায় শুয়ে সকালের অপেক্ষা করতে পারি না।
দুটো কুকুর সপরিবারে আমার পিছু নিয়েছে। চুক চুক, চুক চুক, আয় আয়—তাদের ডাকলাম। ইতিহাস নাকি জানিয়েছে, কুকুরই প্রথম বশ মেনেছিল। তারা বিশ্বস্ত সঙ্গী ও আজন্ম ভক্তিরসে ডুবে থাকা প্রাণী। সেবার যখন কুকুর ধরপাকড় শুরু হয়েছিল, ডিসেম্বরের শেষ দিকে, আমি চারটে কুকুরকে গুপ্তকক্ষে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সুতরাং, স্থানীয় কুকুররা আমাকে চেনে।
পর পর দুটো সরকারি কলই দেখলাম শুকনো। চাতাল শুকনো। শুধু ড্রেনে জল থৈ থৈ করছে। দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। এত রাতে ডাক্তারকে ফোন করা উচিত হবে না কারণ তার বাড়িতে জলের অভাব নেই। আমার একমাত্র আশা এখন গোলপুকুরের মোড়ের কল। এই কলের অনেক ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। যে রাস্তা দিয়ে আমি জলের সন্ধানে বেরিয়েছি তারও অনেক ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। আমি একবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের পরিবারে কেউ অনিদ্রায় ভোগেনি, দুশ্চিন্তা করেনি, স্নায়ুবিকারে যায়নি, আমি কেন ভিক্টিম হলাম।
গোলপুকুর মোড়ে কয়েকজন উর্দি পরা লোক। ঠিক উর্দি নয়, সাদা পোশাক। দাঁড়িয়ে একটা জাল-ঘেরা গাড়ি। চালক সিগারেট খাচ্ছে। গাড়ির রঙ গাঢ় সবুজ, হলুদ বর্ডার।
দুজন লোক এগিয়ে এসে বলল, এখানে কী করছেন?
আমি সুস্থ লোকের মতো বলি, বাড়িতে জল নেই। জল নিতে এসেছি।
তারা ভুরু কুঁচকে বলল, এত রাতে!
সরল বিশ্বাসে বললাম, দুশ্চিন্তা হলে জল খেতে হয়। কী করব?
তারা তফাতে চলে গেল।
তিন মিনিট পর ফিরে এসে বলল, গাড়িতে উঠুন।
আমি সহজভাবে জানতে চাই, কেন?
তারা বলল, আমরা আপনার জন্য জলের বন্দোবস্ত করেছি।
তারপর আমাকে দুজন মিলে ধরপাকড় করে গাড়িতে নিয়ে তুলল। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম, গোলপুকুরের কলটার মুখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। ভিজে চাতালে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঠিকরে উঠছে।
আমি আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে অনুনয় করে বললাম, আছে, জল এখানে আছে, আমাকে নামিয়ে দাও।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
আমার ডাক্তার বলেছিল, আপনার এই যে দুশ্চিন্তা, তার একটা ইতিহাস ও রাজনীতি আছে। বাকি জীবনটা আপনাকে চলতে হবে সন্তর্পণে।
আজ নীচু তারে হাওয়া বইছে আর অজ্ঞাত পরিচয় দুই লোকের মাঝখানে বসে আমি চলেছি পানীয় জলের কাছে। সবাই ঘুমোচ্ছে। শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ঘুম দরকার।
গাজার মানুষকেও একদিন জাল-ঘেরা গাড়িতে চাপিয়ে জল খাওয়াতে নিয়ে যাবে তেল আবিব। একদিন।

অপর্যাপ্ত গুচ্ছ কবিতা। পিয়াস মজিদ


 

মোটামুটি
________


তুমি ০১টা উইপিং উইলোর বাগান

কিন্তু কান্না তার গন্ধ ছড়ানোর আগেই

হাসি তার ছুরি ঝুলিয়ে যায় তোমার মুখে

তুমি তখন আশপাশে ঘন হওয়া

রঙের বারুদ জমা করো

কাচা কাঠ অপেক্ষায় থাকলেও

আগুনের যৌবন ফুরালে

বসে থাকাই বুড়ো হয় শুধু!



আছি
____


কাফকার লাশ থেকে
০১টা আগরবাতি
নিভে গিয়ে নদী
যার যা জ্বলার ছিল
কৌশলে পাচার করে
মেঘের ফুটপাথে
ক্লিভেজে দেখা গেলে
কান্না ও করতালি
তুমি সব গডব্লেসিং হাতিয়ে নিয়ে
পচা পানিতে খুঁজতে আছো
তাজা মাছের মঞ্জিল!

০২.

গালিবের গজলে অভিশপ্ত
কোনও মধ্যরাত
রতি থেকে ছেঁকে তুলতে চেয়ে
কয়েক ছটাক পেয়ার
তবু আমরাই বুঝেছি ভালো
কতটা গজলে গোসল করা
প্রতিটি শীৎকার!

০৩.

পৃথিবী চুপ করলে
শুরু হয় আমাদের ভাষা



চলাচল
______


গন্তব্য খুঁজি না

যতদিন আছি
রাস্তায় ঢেলে দিতে থাকি
চলাচলের রং

নিজে বিবিধ ক্ষুধা নিয়ে
রাস্তাকে দিয়ে গেছি
আমার সফরের স্বাদ

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল কী? কেমন এই নতুন কানুন? উৎকর্ষ আনন্দ

চলতি বছরে উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নামে প্রস্তাবিত আইন পুষ্কর সিং ধামির সরকারকে অনেক ব্যক্তিগত বিষয় সমাধানে বাধ্য করবে। এই বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, লিভ-ইন সম্পর্ক ও উত্তরাধিকার ইত্যাদি। ধর্ম নির্বিশেষে এই বিষয়গুলির দেখভাল করতে হবে।

এই বিল উত্তরাখণ্ড সরকারের অধীন প্রশাসনকে বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় বাধ্যতামূলক ভাবে নথিভুক্ত করতে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি, প্রথম বারের মতো লিভ-ইন সম্পর্ককে আইনি বৈধতা দিচ্ছে এই বিল এবং এই ধরনের সম্পর্ককে নথিভুক্ত করা যেতে পারে। এমনকি বিচ্ছেদ হলেও তা প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী নিবন্ধনযোগ্য। মজার বিষয় হল, নথিভুক্ত না করে এক মাসের বেশি লিভ-ইন সম্পর্কে থাকলে এই বিল তাকে অপরাধ বলে গণ্য করে। এর ফলে তিন মাস পর্যন্ত জেলও হতে পারে।

প্রস্তাবিত এই আইন অনুযায়ী বহুগামীতা ও বিবাহ করা গেলেও বিভিন্ন ধরনের তালাকের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ চাইলে তা দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং এর ফলে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।

১৯২ পৃষ্ঠার এই বিলে বিভিন্ন ধরনের নতুন নিয়মের উল্লেখ করা রয়েছে যা ধর্ম নির্বিশেষে এই রাজ্যের সকল বাসিন্দাদের উপর উত্তরাখণ্ড সরকার প্রয়োগ করতে সক্ষম। উত্তরাখণ্ড কীভাবে পার্সোনাল ল’কে লাগাম পরালো এবং সাংবিধানি বৈধতার প্রশ্নে এই বিল কতখানি দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। এই আইনকে কি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা উচিত? বেশ কয়েকটি রাজ্য একই ধরনের আইন লাগু করার ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই দিয়েছে বলে বিষয়টি নিয়ে চর্চার অবকাশ রয়েছে।

 

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও সংবিধান

ইউনিফর্ম সিভিল কোডের অর্থ হল, একগুচ্ছ সাধারণ আইন যা ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ মেনে চলতে বাধ্য। ব্যক্তিগত বিষয় যেমন বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, দত্তক, উত্তরাধিকার সম্পত্তি ইত্যাদির মতো ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য।

বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় পার্সোনাল ল’ দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত হয় যা দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আইনের নানা নিয়ম মেনে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ধরনের কয়েকটি আইন হল—হিন্দু বিবাহ আইন, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ভারতীয় খ্রিস্টানদের বিবাহ আইন, ভারতীয় ডিভোর্স আইন, পার্সি বিবাহ ও ডিভোর্স আইন ইত্যাদি। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বিধিবদ্ধ করা হয়নি এবং এই আইন তাদের ধর্মীয়গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যদিও এই আইনের বিশেষ কয়েকটি দিক স্বীকৃতি পেয়েছে যেমন শরিয়া প্রয়োগ আইন, মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন।

ভারতীয় সংবিধানের ৪৪ ধারা রাজ্যের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম নির্দেশক প্রিন্সিপাল। এই ধারায় বলা হয়েছে, সমগ্র ভারতে নাগরিকদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করার অধিকার রয়েছে দেশের। ৩৭ ধারায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, নির্দেশক প্রিন্সিপালকে কোনও আদালত বলপ্রয়োগ করে চাপিয়ে দিতে পারে না, বরং এতদসত্ত্বেও এটি দেশের শাসনের মৌলিক জায়গা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে এই প্রিন্সিপালকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আরোপ করা।

১৯৮০ সালের মিনার্ভা মামলায় বিচার বিভাগের এক কমিটি জানিয়েছিল যে, মৌলিক অধিকার ও রাজ্য নীতি নির্দেশক প্রিন্সিপালের মধ্যে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য বিধান করাই সংবিধানের প্রাথমিক কাঠামোর জরুরি বৈশিষ্ট্য। একই ভাবে, ১৯৯৬ সালে ডালমিয়া সিমেন্ট মামলায় সর্বোচ্চ আদালত জানায় যে, সংবিধানের প্রস্তাবনা, মৌলিক অধিকার ও নির্দেশক প্রিন্সিপাল—এই ত্রয়ী হল ভারতীয় সংবিধানের অন্তরাত্মা ও বিবেক। এই ধরনের বেশ কয়েকটি রায় থেকে জানা যায়, দেশের শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নির্দেশক প্রিন্সিপাল মৌলিক জায়গা এবং এখানে নির্দেশিত বিধিনিষেধ মেনে চলবে রাষ্ট্র।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউসিসি নিয়ে উত্তরাখণ্ড ৪৪ ধারার প্রসঙ্গ টেনে বলেছে, সাংবিধানি নিয়মতন্ত্রের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই বিধি বানানো হয়েছে এবং এই রাজ্যের বাসিন্দাদের একগুচ্ছ সাধারণ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

 

উত্তরাখণ্ডের ইউসিসি অনুযায়ী বিবাহ ও ডিভোর্স

প্রস্তাবিত এই আইনে বিবাহের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ১৮ বছর বয়সী মেয়ে ও ২১ বছর বয়সী ছেলেরা বিয়ে করতে পারবে। হিন্দু বিবাহ আইন, বিশেষ বিবাহ আইন, খ্রিস্টান বিবাহ আইন বা পার্সি বিবাহ ও ডিভোর্স আইনেও এই কথা বলা হয়েছে।

এদিকে, মুসলিম পার্সোনাল ল’তে মেয়েরা সাবালিকা বা ১৫ বছর বয়সে পদার্পণ করলে বিয়ের যোগ্য, এমনটা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এই নিয়মকে শুধু নিষিদ্ধই করে না, সেই সঙ্গে ৩২ ধারা অনুযায়ী, এই কাজে যুক্ত যুগলকে ছয় মাস পর্যন্ত জেলের নিদানও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জরিমানাও দিতে হবে। নিষিদ্ধ সম্পর্কে বিবাহের ক্ষেত্রেও একই শাস্তি প্রযোজ্য। এই ধরনের ৩৭টি সম্পর্কের তালিকা দেওয়া হয়েছে এই বিলে। বর  ও কনের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকলে তা নিষিদ্ধ বিবাহ বলে গণ্য করা হবে।

এই বিলে দ্বিতীয় বিবাহকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ধর্ম নির্বিশেষে বহুবিবাহ বা বহুগামীতাকে খতম করাই উদ্দেশ্য। হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও পার্সিদের পার্সোনাল ল’তে বহুবিবাহকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও ১৯৩৭ সালে শরিয়া আইন অনুযায়ী মুসলিমরা চারটি স্ত্রী রাখতে পারে।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার মেনে বিবাহ সম্পন্ন হলেও উত্তরাখণ্ডে তা নথিভুক্ত বা নিবন্ধন করতে হবে, যদি বিবাহের কোনও পক্ষ এই রাজ্যের বাসিন্দা হয় তাহলে এই আইন প্রযোজ্য। ২০১০ সাল থেকে বিবাহের নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে উত্তরাখণ্ড। পুরনো আইন  অনুযায়ী যে যুগল বা দম্পতিরা ইতোমধ্যেই নিবন্ধন করেছেন, তাঁদের পূর্বের নিবন্ধনের বিষয়ে ঘোষণাপত্র জমা দিতে হবে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ‘বাসিন্দা’ বলতে তাদেরকেই বুঝিয়েছে যারা এই রাজ্যে অন্তত এক বছর বাস করছে বা এই রাজ্যের সরকারের অধীনে কোনও প্রকল্পের সুবিধাভোগী বা এখানকার স্থায়ী কর্মচারী।

বিয়ের ৬০ দিনের মধ্যে দম্পতিকে যুগ্ম ভাবে একটি স্মারকলিপি স্বাক্ষর করতে হবে এবং সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে হবে। এমনটাই বলা আছে প্রস্তাবিত আইনে। পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রার বিয়ের শংসাপত্র ইস্যু করবেন বা নিবন্ধন বাতিলের কারণ জানাবেন দম্পতিকে। বিবাহ বাতিল করলে তা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে চ্যালেঞ্জ করা যাবে কেননা তিনি এই রাজ্যের সচিব-স্তরের কর্মকর্তা। কোনও দম্পতি যদি বিচ্ছেদ চান তাহলেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বিয়ের নিবন্ধন বা ডিভোর্স চাওয়ার সময় মিথ্যা বিবৃতি দিলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এর জন্য তিন মাস পর্যন্ত জেল হবে। এই বিলে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, বিয়ের নিবন্ধন না করা হলে বিয়ে বাতিল বা অবৈধ হয়ে যাবে না, তবে বিবাহের সাব-রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর জরিমানা চাপাবে ও অন্যান্য পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরও জানিয়েছে, কোনও বিবাহ কেবলমাত্র আদালতের নির্দেশেই বাতিল হতে পারে। এর ফলে মুসলিম পার্সোনাল ল’তে অনুমোদিত তালাক প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সকল প্রকার বিচার বিভাগ বহির্ভুত ডিভোর্সকে (তালাক-এ-হাসান, তালাক-এ-আশান, তালাক-এ-তাফইজ ও খুলা) অবৈধ বলে চিহ্নিত করেছে এই বিল। অথচ বিভিন্ন ধরনের তালাক মুসলিম পার্সোনাল ল’তে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইউসিসি বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ৩২ ধারায় বলা আছে, আদালতের নির্দেশনামা ছাড়া ডিভোর্স করা হলে তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হবে।

 

ইউসিসি নিয়ে এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান

১৯৮৫ সালে শাহ বানু মামলার মীমাংসা করার পর থেকে সুপ্রিম কোর্ট তাদের অসংখ্য রায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। সংবিধানের ৪৪ ধারার স্পিরিটে সর্বোচ্চ আদালত লাগাতার অভিন্নতার জন্য সওয়াল করেছে, তবে তারা কোনও নির্দেশ দেয়নি এই মর্মে। তারা জানিয়েছে, আইন প্রণয়ন হল সংসদের একচেটিয়া ও একান্ত অধিকার।

শাহ বানু মামলায় আদালত দুঃখপ্রকাশ করেছিল যে, সংবিধানের ৪৪ ধারার শব্দ-বাক্যগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। জাতীয় অখণ্ডতার প্রশ্নে সাধারণ দেওয়ানি বিধি সহায়তা করতে পারে। আইনে পরস্পরবিরোধী মতাদর্শ রয়েছে এবং এর প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে পরিহার করা দরকার। ১৯৯৫ সালে সরলা মুদগল মামলায় দ্বিপত্নী ও বিবাহ সংক্রান্ত পার্সোনাল ল’য়ের বৈপরিত্য নিয়ে সওয়াল-জবাবের সময় আদালত জোর দিয়ে বলেছি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা। তাদের বয়ানে, যতদিন না পর্যন্ত সাধারণ দেওয়ানি বিধি লাগু হচ্ছে ততদিন নানা রকম ছিদ্র থাকবে কারণ বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তারা সংবিধানের ৪৪ ধারার দিকে নতুন করে নজর দেওয়ার অনুরোধ করেছিল এবং নাগরিকদের উপর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করার পরামর্শ দিয়েছিল।

যাইহোক, ১৯৯৭ সালে আহমেদাবাদ উইমেন অ্যাকশন গ্রুপ মামলা ও ২০০০ সালে লিলি টমাস মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দেয় যে, সরলা মুদগল মামলায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করতে সরকারকে কোনও নির্দেশিকা দেওয়া হয়নি।

২০১৫ সালে দেখা গেল, এই বিষয় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দ্বিধাবিভক্ত। ওই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সুপ্রিম  কোর্ট যখন কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করে তারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনতে ইচ্ছুক কিনা তখনই এই সাধারণ বা অভিন্ন আইন নিয়ে আবার পুরনো বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহ, ডিভোর্স, দত্তক, দেখভাল ও উত্তরাধিকার নিয়ে নানা রকম মত থাকায় এই বিষয়টি তাদের ভাষায় “পুরোপুরি গোলমেলে।” তবে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আরেক বেঞ্চ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত একটি পিটিশনকে খারিজ করে দেয় এবং বলে যে, সাধারণ বা অভিন্ন আইন আরোপ করা হবে কিনা তা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত কেবলমাত্র “আশা ও প্রত্যাশা” করতে পারে, কিন্তু সরকারকে তারা নির্দেশ দিতে পারে না।

২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় অন্তত পাঁচটি পিটিশনের কথা উল্লেখ করে সর্বোচ্চ আদালতের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এই পিটিশনগুলি তিনি দায়ের করেছিলেন সকল ধর্মের পার্সোনাল ল’য়ের পরিবর্তে আইনে অভিন্নতা আনার দাবিতে। এই পিটিশনগুলিতে পৃথক ভাবে বিয়ের আইনি বয়স, ডিভোর্স, খোরপোষ, দত্তক, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ও পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আইনের দাবিও জানানো হয়েছিল। শীর্ষ আদালতে সেই পিটিশনগুলি এখনও ঝুলছে।

২০১৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় আইন ও বিচারমন্ত্রী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ সংক্রান্ত সকল বিষয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য ভারতের ল’ কমিশনকে দায়িত্ব দেন। তবে, এই বিষয়ে আইন কমিশন চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়নি, উল্টে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে “পরিবার আইনের সংস্কার” নিয়ে তারা একটি ‘কনসালটেশনপত্র’ হাজির করে। এই পত্রে বলা হয়েছিল, “এই পর্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির না আছে প্রয়োজন আর না তা কাম্য।” তারা সুপারিশ করেছিল, বিভিন্ন ধর্মে পরিবার সংক্রান্ত যে আইনগুলি রয়েছে তার সংশোধন জরুরি এবং পার্সোনাল আইনে পক্ষপাতদুষ্টতা ও অসাম্যকে মোকাবেলা করার জন্য এগুলি বিধিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। এই বিষয়ে পুনরায় আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ল’ কমিশন ২০২৩ সালের জুন মাসে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্ভব কিনা তা নতুন ভাবে খতিয়ে দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন স্বীকৃত ধর্মীয় সংগঠন ও সাধারণ মানুষের মতামত নিতে শুরু করে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আরোপ বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ হয়ে উঠেছে। তারা প্রায়শই গোয়ার উদাহরণ টেনে আনে কারণ এখানে গোয়া দেওয়ানি বিধি নামে একটি সাধারণ আইন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে ভুপালে বিজেপির কর্মীদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি আবার ইউসিসি লাগু করা নিয়ে জোরালো বার্তা দেন। তাঁর কথায়, একটা দেশ দুই রকম আইন দিয়ে কীভাবে চলতে পারে। তিনি অভিযোগ করেন, মুসলিম সম্প্রদায়কে ভুল পথে চালিত করতে ও উস্কানি দিতে বিরোধীরা ইউসিসিকে হাতিয়ার করছে।

উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করার মাধ্যমে একটা পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ইউসিসির মূল উদ্দেশ্য কতখানি চরিতার্থ হয় তা শুধু দেখা হচ্ছে না, সেই সঙ্গে একগুচ্ছ নিয়মের সাংবিধানিকতার দিকটিকেও পরীক্ষা করা হচ্ছে। ধর্মবিশ্বাস ও আচারের স্বাধীনতা, প্রিভেসির অধিকার ও ব্যক্তিগত বিষয়ে স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার কতখানি সুরক্ষিত থাকে তা নিরীক্ষা করে দেখার বিনিময়ে উত্তরাখণ্ড এই ‘জুয়াখেলা’য় নেমেছে।  

আমার কম্পন হইতে থাকে। জিয়া হক


 আমার কম্পন হইতে থাকে, কারণ বুঝি না। ভয় নানা প্রকার। ভয়ের কাঁপন! চারিদিকে শুধু মানুষের ছায়া। ভয়ের প্রতিচ্ছবি পড়ে না। নিজের মুখ কল্পনা করতে পারি না। আয়না দেখলে নিজেকে দেখতে পাই। ওষুধ আর কত সহায়তা করতে পারে! তবু খেতে হয়। আমার কম্পনে লোক হাসে। তারা আমার ক্ষয় দেখতে পায় না, সম্ভবও নয় হয়ত। হাসির পাত্র হয়ে আমার নিভৃত কান্নাগুলো আমি আতর মাখিয়ে তুলে রাখি। ভেবেছিলাম, আমার কোনও পিছুটান নেই। তাহলে কোথাও যেতে গেলে পা ভারী হয়ে আসে কেন! আমি একটা অচলায়তন। বান্ধব বাতাসের অপেক্ষারত এক অচলাবস্থা। আমাকে লোক অযোগ্য বললে আমি নিশ্চিন্ত হই। যার কোনও অর্জন নেই, পেশার নিরাপত্তা নেই, উপার্জনের নিশ্চয়তা নেই, সে কীভাবে যোগ্য হতে পারে! যোগ্য হলে তার প্রমাণ দিতে হয়, অযোগ্যের প্রমাণ দেবার দায় নেই। তারপরও উত্তেজনা আসে, ফসকে যায় মুখ, ভাষায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না, রাগ হয় নিজের উপর, সিদ্ধান্ত নিই যে, চুপ হয়ে যাব। প্রতিক্রিয়া, প্রত্যুত্তর থাকবে না, পাথরজীবন ঠেলে ঠেলে তুলব মরণোত্তর পাহাড়ের মাথায়। বিষণ্ণ লাগে, বিমর্ষ লাগে, আব্বা-মা ছাড়া কেউ নিজের নয়। রক্তাক্ত হলে আমাকেই রক্তপাতের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অথচ বুঝতে পারি, এই আব্বা-মা শেষ পর্যন্ত আমার কথিত পিছুটান। তাদের নিঃশর্ত স্নেহ-ভালবাসা আমার শৃঙ্খল। দূরে যেতে দেয় না। এক আবাসিক বিদ্যালয় থেকে চলে এসেছিলাম তাদের মুখ দেখব বলে, তাদের ছায়ায় রয়ে যাব বলে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা দাদার মুখ মনে পড়ে। দাদা ছিল, আজও আছে আমার সার্বিক আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রকাশের অংশ হয়ে। দূরত্ব হয়ত তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি গৃহবন্দি। এই বন্দিনিবাসে জানালা আছে উত্তর দিকে। সেদিক থেকে হু হু করে শীতল বাতাস বয়ে আসে আর আমার কম্পন হইতে থাকে। 

অযোধ্যাঃ এক মন্দিরের জন্ম ও এক সংস্কৃতির মৃত্যু। বিশেষ প্রতিবেদন


কেবলমাত্র ‘বিরক্ত ভিন্নমতাবলম্বী’রাই চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি এক মন্দিরের মহা-উদ্বোধনের মহা-উদযাপনকে রুচিহীন বলে মনে করেননি, সেই সঙ্গে অনেকেরই মত এমনটাই। বিরুদ্ধ স্বরের মানুষজনকে বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন প্রয়াত অরুণ জেটলি। যাইহোক, অযোধ্যার পুরনো বাসিন্দাদের কণ্ঠেও একই রকম উষ্মার প্রতিধ্বনি। এদের অনেককেই ছিন্নমূল করে দেওয়া হয়েছে এবং কোলাটেরল ক্ষতি হিসেবে তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাম অবতার, স্বপ্না মাধুকর ও মহম্মদ উমর এদেরই প্রতিনিধি। এদের উৎখাত করার কারণ ‘নতুন অযোধ্যা’ নির্মাণের জন্য পুরনো অযোধ্যাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তৈরি হচ্ছে এক দৈত্যাকার পরিসর। নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সাততারা কমিউন, বিলাসবহুল হোটেল, বহুস্তরীয় পার্কিং চত্বর এবং বাকি অংশে পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। গণমাধ্যম লাগাতার খবর দিয়ে চলেছে।


তীর্থক্ষেত্রের নামে এই রাজনৈতিক প্রকল্প তৈরির জন্য শুধু পুরনো বাসিন্দাদেরই সরানো হচ্ছে না, সেই সঙ্গে অযোধ্যার আগেকার জীবনপদ্ধতিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই শহরের পুরনো সংস্কৃতি যা বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্রিত করে রেখেছিল, সেই ইতিহাসকেই লুপ্ত করার কাজ চলমান। এখানকার তেহজিবকে মুছে ফেলা হচ্ছে। এই তেহজিব মেনে এখানকার বাসিন্দারা ‘ঈদ কি রাম রাম’ বলে একে অপরকে সম্ভাষণ করত (বিশ্বাস করুন আর না করুন, এটা সত্যি)।


এই রাজনৈতিক ব্যবসা এখানকার সংস্কৃতিকে সাফ করার এক উদ্যোগ। অযোধ্যার সংস্কৃতিতে “রঘুপতি রাঘব রাজা রামে”র মতো রামধুনের অস্তিত্ব ছিল। এই রামধুনে রয়েছে “ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম”। এক সময় এটা সম্ভব হয়েছিল।


রামের গল্পকে সাধারণ মানুষ যেভাবে বুঝতেন তাকে বদলে নতুন ভাবে সাজানোর এক প্রচেষ্টা এটি। রামকে তারা রাগী, যোদ্ধা ঈশ্বর হিসেবে দেখাতে চাইছেন যিনি “অপরে”র হাত থেকে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের উদ্ধার করেন। এবং এই “অপর” তাদের কাছে দানবীয়। বিজেপি-আরএসএস ‘অপর’ বলতে কাদের বোঝে তা আলাদা করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। এই দলগুলির স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণায় কারা “অপর” তা গোপন নয়।


২২ জানুয়ারির আগে গোটা দেশে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে ও অবাধে ‘রামরাজ্যে’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা আপনাকে যেটা ভুলিয়ে দিতে যায় তা হল, মাদকজনিত হ্যালুসিনেশনে আমাদের সভ্যতার মহানতা বা ভারতের কল্পিত ‘বিশ্বগুরু’ মর্যাদাকে মনে রেখে “মাথা উঁচু করে রাখা”ই শুধু রামরাজ্য ছিল না, বরং রামরাজ্য একটা সময়-স্থান-নৈতিকতা যেখানে সকল নাগরিক ন্যায়বিচার ভোগ করত, যেখানে রাজদরবারের কর্মচারীরাও রাজাকে প্রশ্ন করতে ও সমালোচনা করতে পারতেন। এই সময়কালকে এক সুখ, শান্তি ও প্রাচুর্য্যের কাল হিসেবে দেখা হয়েছে। এ সম্পর্কে ভক্তিকবি তুলসিদাস (১৫১১-১৬২৩) ব্যবহার করেছিলেন “পরস্পর প্রীতি” শব্দবন্ধটি, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ছিল।


রামরাজ্য যেদিন বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়ে উঠল সেদিনই হাজারবার মৃত্যু হয়েছিল আয়রনির। “মন্দির ওখানেই বানাব”-এর মতো স্লোগানের নগ্ন রমরমা থেকেই বোঝা গিয়েছে কী ধরনের রামরাজ্য বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কোন ধরনের রামরাজ্যের বাসিন্দা আমরা হতে চলেছি।


এখন আমরা যেহেতু পুরোপুরি জেনে গিয়েছি যে, তারা যখন ভারতের কোনও অংশকে তার পুরনো মহিমায় ফিরিয়ে আনতে চায়, তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুনরুদ্ধারের এই ঘোষণা ও দাবির অর্থ হল, কোনও সম্পত্তি দখলের জন্য লড়াই চালানোর চিরাচরিত কৌশল যা জবরদখল ও রূপান্তরণের মধ্যবর্তী বিন্দুগুলিকে পূরণ করবে, যেভাবে অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে সেই জায়গাকে মন্দিরের রূপ দেওয়া হল।


এমন পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশের সরকার বিজ্ঞাপন করছে, অযোধ্যাকে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে তোলা হবে। সেই বিজ্ঞাপনে সমস্ত খুঁটিনাটি উল্লেখ করা হচ্ছে। এটাই ঘটনাচক্রে বিকাশের (উন্নয়ন) একটা মডেল আর এই মডেলকেই অনেক এনআরআই ভালবাসেন। এই মডেলের বৈশিষ্ট্য হল, এখানে একটি কার্যকরী বিমানবন্দর থাকবে, পাঁচতারা বিলাসবহুল হোটেলে যাওয়ার মসৃণ রাস্তা থাকবে। প্রবাসীদেরকে জুলুজুলু চোখে বলতে শুনবেন, “ভারত বদলাচ্ছে।” দারুণ রাজপথ বানিয়ে যাতায়াতের সময়কে কমিয়ে আনাকেই এই বিকাশ বিজ্ঞাপন করতে চায়। আমাদের মানবিক উন্নয়ন সূচক একেবারে তলানিতে যতই নেমে আসুক, তাতে কী!


বিকাশ বা উন্নয়নের এই মডেলে চারধাম পরিযোজনায় চার সড়কের রাজপথ নির্মাণকে বেপরোয়া ভাবে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে, অথচ ভুলে যাওয়া হচ্ছে, হিমালয়ের সূক্ষ্ম ও ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এই প্রকল্প। ধর্মীয় পালে হাওয়া দিয়ে রাজনৈতিক বৈতরণী পার হতে সাহায্য করবে এটি এবং পর্যটন খাতে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আসবে। এটাই বিকাশের সেই মডেল যেটাকে অনেকে আমাদের সভ্যতার মহানতার গর্ব হিসেবে দেখে থাকে।


অযোধ্যার প্রতিবেশী নিচু জেলা গোণ্ডা, শ্রাবস্তী, বাহরাইচ, বরাবাঁকি ইত্যাদির নিরিখে এই বিকাশকে একবার ভেবে দেখুন। এইসব জেলার লাখ লাখ “নোংরা অপবিত্র” মানুষদের কথা একবার ভাবুন এবং জিজ্ঞাসা করুন, মহা-উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এফএমসিজির আদানি উইলমারের বিতরণ করা পুষ্পাকৃতির জিলিপি কাদের দেওয়া হবে, এতে লাভ কী হবে?


ঈশ্বর আমাদের এই “রামরাজ্য” থেকে রক্ষা করুন!

কার্টুন: কমল বসুর নৈরাজ্য






 

দুটি ছোট গদ্য। জিয়া হক


 

১.

আমার একটি সাইকেল আছে। তার দুইটি চাকা। গতি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তার জন্য ব্রেক ও বেল থাকে সাইকেলে। পরিভাষাবিদরা সাইকেলের বাংলা করেছেন 'দ্বিচক্র যান'। সাইকেল পরিবেশবান্ধব গাড়ি। অল্প সময়ে দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য এই গাড়ি উপযুক্ত নয়। গতি নিয়ে আপোসরফা ও সমঝোতা করতে পারলে এমন গাড়ির বিকল্প নেই। এইচ ই বেতসের একটি ছোটগল্প রয়েছে, নাম: অক্স। সেই গল্পে কোনও ষাঁড় নেই, রয়েছেন এক নারী ও তাঁর সব কাজের সহযোগী একটি সাইকেল। কে যে 'অক্স'—বুঝতে হবে। সাইকেল মানে নিম্নবিত্তের সহায় আর উচ্চবিত্তের বিলাসিতা ও পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতার বিজ্ঞাপন। মধ্যবিত্ত মারুতি ৮০০-এর স্বপ্নে বিভোর। সাইকেল উপন্যাস নয়, অসমাপ্য ছোটগল্প।


২.

ঘরের কাছে সমুদ্র নেই, উপসাগর আছে। স্বপ্ন ছিল, বঙ্গোপসাগরে একদিন সদলে মাছ ধরতে যাব। আমার মামা জমি বিক্রি করে ট্রলার কিনেছিলেন। মামার ব্যবসা-বুদ্ধি কম। কর্মচারী হিসেবে তিনি অসাধারণ, তবে এমপ্লয়ার হিসেবে তিনি ব্যর্থ। ছোট নদীতে আর মাছ কোথায়? একটা সংসার তাকিয়ে ওই লোটে আর কড়ে ভেটকি মাছের দিকে। অথচ মামা এমব্রয়ডারির সুদক্ষ মিস্ত্রি। শিল্পীও বলা যায়। বহু কারখানায় ধাক্কা খেতে খেতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। যথার্থ সম্মান তো দূর, পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাননি তিনি। হতাশ মামার সর্বশেষ বিনিয়োগের ট্রলার এখনও বাংলার দক্ষিণ প্রান্তের প্রায় মৎস্যহীন উপসাগরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

যার যা প্রাপ্য তা হয়ত পায় না। 

আজ এমপ্লয়ি অ্যাপ্রিসিয়েশন দিবস। মামার কথা মনে পড়ল। বিষয় হল, আমার সঙ্গে মামার দূরত্ব খুবই কম। মামা জীবনকে উপযুক্তভাবে তরজমা করতে পারেননি, আর আমি ভাষান্তরে নিযুক্ত থেকে ভুলতে বসেছি—জীবন কাকে বলে!

উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করে জল মাপছে বিজেপি! সাবা নকভি



উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিল এই রাজ্যের বিধানসভায় ৬ ফেব্রুয়ারি পেশ করা হয়েছিল। গোটা ভারতে এই বিল আরোপ করার সূচনা হল উত্তরাখণ্ডে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে কারণ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম মতাদর্শগত অঙ্গীকার ইউসিসি লাগু করা।

লোকসভা নির্বাচনের মুখে আমরা যেহেতু দাঁড়িয়ে রয়েছি, তাই এই প্রস্তাবিত আইন গভীর ভাবে রাজনৈতিক ও মারাত্মক রকম মতাদর্শিক। এই আইনের লক্ষ্য হল, মুসলিম পার্সোনাল ল’কে সংস্কার করার মাধ্যমে মুসলিম ধর্মগুরুদের কোণঠাসা করা। দাবি করা হচ্ছে, মুসলিম পার্সোনাল আইন নারীদের জন্য সুবিধাজনক নয়। একই ভাবে, এই আইনের আওতা থেকে আদিবাসী ও জনজাতিদের বাদ রাখা হচ্ছে কারণ সরকার আদিবাসীদের নিজস্ব যে আইন রয়েছে তা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায় না।

বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে যায় ছেলেদের হাতে। এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, সমাজের একাংশের নারীদের কি সম-অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত? রাষ্ট্রে ফের এমন একটা ইস্যু কেন তুলে আনবে যাতে মুসলিম সংখ্যালঘুরা আবার চাপে পড়ে যাবে?

এই বিলে অদ্ভুত কিছু অনুচ্ছেদ রয়েছে। আদিবাসী ও জনজাতি ছাড়া সকল নারীকে সমান ভাবে সম্পত্তি ও ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও এটি নাগরিকদের স্বাধীনতা ও লিবার্টিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এতে দাবি করা হয়েছে, অসম-লিঙ্গের ব্যক্তিরা লিভ-ইন সম্পর্কে থাকলে তা স্থানীয় থানায় নথিভুক্ত করতে হবে। নারীদের যাতে পরিত্যাগ করা না হয় তা রুখতে এমনটা করা হচ্ছে বলে ধারণা। উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিতে অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় (সঙ্গী বাছাই থেকে বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত), কিন্তু ‘থানায় নিবন্ধনে’র এই অনুচ্ছেদ গভীর ভাবে অস্বস্তিকর।

সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের রক্ষণশীল প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে কেউ সন্দেহ করতেই পারে যে, এটি আন্তঃধর্মীয় বা আন্তঃবর্ণীয় সম্পর্ক বা দাম্পত্যকে আটকানোর অভিপ্রায়েই করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবার, বংশ ও খাপ-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে তরুণ-তরুণীদের বেরিয়ে আসাকে আরও কঠিন করে তুলছে এই আইন। তাছাড়া কোন প্রাপ্তবয়স্করা একসঙ্গে জীবন যাপন করছে সেদিকে সহ-নাগরিক ও প্রতিবেশীদের উঁকিঝুঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে এটি।

সুতরাং ঠিক এই সময়ে এমন বিল আনার পিছনে প্রকৃত অভিপ্রায় কী তা নিয়ে ভাবতে বসে কেউ মনে করতেই পারেন যে, এটা শুধুমাত্র মতাদর্শগত বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। লিঙ্গ পরিচয়কে বিচারের আওতায় আনতে চাওয়ার মাধ্যমে এক সংগঠিত রক্ষণশীল সমাজ গড়ার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। জাতীয় স্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা হলে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার একটা পরীক্ষাও হচ্ছে উত্তরাখণ্ডে।

এই প্রসঙ্গে এটা বলা জরুরি, বিশ্বের সমস্ত কাস্টমারি আইন পুরুষদের দ্বারা লিখিত যারা ঐতিহাসিক ভাবে নারীদের সমান মনে করেনি। তাই, এই লেখকসহ বহু নারী ও পুরুষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ধারণাকে সমর্থন করতে পারেন নীতিগত ভাবে কারণ সভ্য সমাজে বিবাহ, উত্তরাধিকার, ডিভোর্স, দেখভাল ও শিশুর তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার থাকা উচিত।

তারপরও এই সময়ের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে অনেকেই উত্তরাখণ্ডের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ নিয়ে সংশয়ী হতে পারেন। ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর রাখুন: বিধানসভায় এই বিল পেশ হওয়ার পরে পরেই উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ্দ মৌর্য বলেন, উত্তরাখণ্ডের পর “উপযুক্ত সময়ে” তাঁর রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করা হবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, উত্তরাখণ্ডের পরিস্থিতির দিকে তিনি নজর রাখবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিজের রাজ্যে লাগু করবেন, কিন্তু এরই মধ্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে তিনি আইন নিয়ে আসবেন।

বিজেপি ও তার মতাদর্শগত পরিবার এই বছর মরিয়া হয়ে কাজে লেগে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে: জানুয়ারিতে রাম মন্দির, ফেব্রুয়ারিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ও মার্চ থেকে মে মাসে লোকসভা নির্বাচন। এই শাসক নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একদলীয় সিদ্ধান্ত ও নীতি-নির্ধারণের পথে হাঁটছে কারণ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তিনটি ইস্যুর একটি যাকে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। জোট সরকারের সময়, এমনকি প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর যুগেও। ৩৭০ ধারা রদ করতে এই সরকার সফল হয়েছে, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণেও সফল, এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সামনে রাখা হচ্ছে।

রাজনৈতিক ভাষ্যের নিরিখে তৃতীয় দফার জন্য নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ‘এক নেতা, এক জাতি, এক নির্বাচনে’র ধারণাকে প্রচার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যায় একটি সাধারণ আইন দিয়ে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি একই সঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় এই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তাই ইউসিসিকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখা দরকার। কেন্দ্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার এ এক সুচারু কৌশল এবং সেই সঙ্গে এই সাধারণতন্ত্রে নানা দিকে অভিন্নতা নিয়ে আসার সূক্ষ্ম ভাবনা কাজ করছে এখানে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুসলিম ধর্মগুরুদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাঁদের কথায়, এই আইন তাদের পার্সোনাল ল’তে হস্তক্ষেপ করছে। ১৯৮৬ সালে মুসলিম নারী (ডিভোর্সের অধিকার রক্ষা) আইন নামে এক পশ্চাদগামী নিয়মের মাধ্যমে দেওয়া রায়কে বদলে দিতে মুসলিম ধর্মগুরুরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির উপর চাপ দিয়েছিলেন। বিজেপি হঠাৎ একটা ইস্যু পেয়ে গিয়েছিল—মুসলিম পুরুষদের ‘তোষণ’ করছে কংগ্রেস। এখন প্রায় ৪০ বছর পর সেই ইস্যু আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

ইতোমধ্যে কী কী বদল হয়েছে? যারা নারীর অধিকার বৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তারা বিজেপির উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নিয়ে সন্দিহান। তাই, প্রগতিশীল নারী গোষ্ঠীগুলি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সংস্কারের পক্ষে এবং এই বৃহৎ দেশে আচার ও আইনের বৈচিত্র্য বজায় রাখার উপর জোর দিচ্ছে তারা। লিঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে যারা এক সময় অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সমর্থন করেছিল, তারা এখন দেখতে পাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে বিজেপির “আমরা-ওরা”র ভাষ্যে মুসলিম পুরুষদের দমনপীড়ন করার এ আরেক ইস্যু ভিন্ন আর কিছু নয়।

 

তরজমা: জিয়াউল হক

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু মর্যাদা সংক্রান্ত মামলা ও তারপর। বিশেষ প্রতিবেদন

 

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (এএমইউ) সংখ্যালঘু মর্যাদা সংক্রান্ত মামলার রায় স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ। তালিকা ১-এর এন্ট্রি ৬৩ অনুযায়ী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম যাকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি এমন মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠান হল বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এএমইউ আইনের অধীন এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২০ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনার ইতিহাসকে তিনটি পর্বে দেখা যেতে পারে—১) ১৮৭০-১৮৭৭ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা অনেকের মাথায় আসে এবং মুহাম্মদিন অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল (এমএও) কলেজ স্থাপন করা হয়েছিল। ২) ১৮৭৭-১৯১০ সালে মুহাম্মদিন ওরিয়েন্টাল কলেজ বা এমএও-কে রূপান্তরিত করার জন্য মিছিল করে মুসলিম সম্প্রদায় এবং চাপের মুখে সরকার এই এই কলেজকে পরিবর্তিত রূপ দিতে রাজি হয়। ৩) ১৯১০-১৯২০ সালে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা সক্রিয় ভাবে এই কাজে মনোনিবেশ করেন এবং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিতে সফল হন এবং সেদিনে মুহাম্মদিন ওরিয়েন্টাল কলেজ বর্তনামের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়।

সংবিধানের ৩০ ধারা মোতাবেক আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সংখ্যালঘু মর্যাদা’ দেওয়ার বিষয়টি বেশ জটিল। সংখ্যালঘু মর্যাদা কী? ভারতীয় সংবিধানের ৩০ ধারা ভারতের ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার দান করে। এই ধারা নির্দিষ্ট ভাবে সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনা ও পরিচালনার অধিকার দিয়েছে। মৌলিক অধিকার অনুযায়ী, এই ধরনের সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য ভর্তি সংক্রান্ত নীতিমালায় সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে পারে।

প্রতিষ্ঠানের সংখ্যালঘু চরিত্র রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেয় এই ধারা। এই আইনের লক্ষ্য হল, সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত স্বায়ত্বশাসন, পাশাপাশি শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের যুক্তিগ্রাহ্য বিধিনিয়মকে মান্যতা দেওয়া। আজিজ বাশা বনাম ভারত সরকারের মামলায় (১৯৬৭ সালে জেনেসিস অফ দ্য কনানড্রাম) ৭ বিচারপতির একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলে, ১৯৫১ ও ১৯৬৫ সালে সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রকৃত এএমইউ আইন বদল করা হয়েছিল কেন? সেই সঙ্গে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে অ-সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হল কেন?

তৎকালীন সিজিআই কে এন ওয়ানচু, বিচারপতি আর এস বাচাওয়াত, বিচারপতি ভি রামাস্বামী, বিচারপতি জি কে মিত্র ও বিচারপতি কে এস হেগড়ের বেঞ্চ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের দিকে নজর দেয় এবং জানানো হয়, এএমইউ-এর প্রতিষ্ঠাতারা মুসলিম ছিলেন বলে এটা বলা যেতে পারে না যে, এএমইউ ৩০ ধারা অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের দ্বারা স্থাপিত ও পরিচালিত হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে আসার কারণ ছিল, বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছিল যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে প্রাক-সাংবিধানিক পন্থায়। এই পন্থায় এটি স্থাপিত হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্বারা নয়। ১৯২০ সালের এএমইউ আইন চতুর্থবারের মতো ১৯৮১ সালে সংশোধিত হয়। তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছিল—প্রথমত, ১৯৮১ সালের আইনের ২(১) ধারা “বিশ্ববিদ্যালয়” শব্দটিকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলে এটি “ভারতের মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত”। দ্বিতীয়ত, সংশোধনী আইনের ৫ ধারাকে সংস্কার করে ভারতের মুসলিমদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৃতীয়ত, ১৯২০ সালের আইনের প্রস্তাবনা থেকে “প্রতিষ্ঠিত” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এই বদলগুলি করা হয়েছিল বেগ কমিটি ও ভারতের সংখ্যালঘু কমিশনের সুপারিশ মেনে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে সংখ্যালঘু মর্যাদা দেওয়ার পিছনে এই বদলগুলির প্রভাব ছিল।

আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বনাম মলয় শুক্লা মামলায় ২০০৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট মুসলিম প্রার্থীদের সংরক্ষণ নীতি নিয়ে আইনি লড়াইয়ের দিকে জোর দেয়। এএমইউয়ের নীতিতে বলা হয়েছিল, স্নাতকোত্তর কোর্সের ৫০ শতাংশ আসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত হবে যা আসলে পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তারদের জন্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তি দিয়েছিল, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধনী আইন ১৯৮১) বাশা মামলার রায়ের ফলে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তবে, একক বেঞ্চ শেষ পর্যন্ত জানিয়েছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচ্য নয়। একক বেঞ্চের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ স্থির করে যে, সংখ্যালঘু ব্যক্তির দ্বারা স্থাপিত হলেও সেই ভাবে একে সংখ্যালঘু দ্বারা পরিচালনা বা পরিচালনার দাবি ওঠেনি, তাই এটি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না। হাইকোর্ট রায় দেয়—ক) বাশা মামলার রেশিওর দিকে তাকিয়ে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় একটি অ-সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে বহাল থাকবে এবং ৩০ ধারা মোতাবেক একে দাবি করা যাবে না। খ) ১৯৮১ সালের আইনের এস ২(১) ও ৫(২)(সি)-কে বাতিল বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। গ) ১৯২০ সালের আইনের প্রস্তাবনা থেকে ১৯৮১ সালের আইন দ্বারা “প্রতিষ্ঠিত এবং” শব্দগুলি সরানো অবৈধ এবং এই শব্দগুলি প্রস্তাবনায় থাকবে। ঘ) পিজিসির জন্য ৫০ শতাংশ মুসলিম কোটার দাবি অসাংবিধানিক এবং ভবিষ্যতে এই নীতি মানা যাবে না। ঙ) ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্র আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত সংখ্যালঘু মর্যাদাকে পরীক্ষা করে দেখতে বলে এবং মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের বিষয়টিকে খারিজ করা হয়। ২০১৯ সালে দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন ৩ বিচারপতির বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ের অনুষঙ্গে ৭ জন বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২০০৬ সালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানির সময় সেই প্রসঙ্গ ফিরে এসেছিল।

আদালত কি ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন ভুলে গেছে? টি কে রাজলক্ষ্মী


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের এক বছর আগে পার্লামেন্টে উপাসনাস্থল (বিশেষ বিধি) আইন, ১৯৯১ পাশ হয়েছিল। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও উপাস্থনাস্থলকে বদলানো বা রূপান্তরিত যাবে না। সেই সঙ্গে এই আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত টিকে থাকা যে কোনও ধরনের উপাসনাস্থল পরিচর্যা ও দেখভাল করা যাবে। কোনও ধর্মীয় উপাসনাস্থলকে সেই ধর্মের অন্য গোষ্ঠী বা অন্য ধর্মের উপাসনাস্থলে পরিবর্তন করতে পারবে না কেউ। এমনটাই বলা হয়েছে। রাম জন্মভূমি-বাবরি  মসজিদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযুক্ত হয়নি। জম্মু ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য। এই আইনকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন বিজেপির মুখপাত্র ও আইনজীবী অশ্বিনী কুমার উপাধ্যায় ও বিশ্ব ভদ্র পূজারি পুরোহিত মহাসংঘ।


এই আইনের ৪ ধারা বলেছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবধি থাকা কোনও উপাসনাস্থলকে রূপান্তরিত করা সংক্রান্ত ঝুলে থাকা মামলা, আপিল বা অন্যান্য বিচারপ্রক্রিয়া “উড অ্যাবেট আপঅন দ্য অ্যাক্ট কামিং ইন্টু ফোর্স।” এইভাবে নতুন করে মামলা বিষয়ে দাঁড়ি টেনেছে এই আইন। ৪ ধারায় আরও বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পরে ধর্মীয় গৃহ পরিবর্তন করা হয়েছে, এই দাবিতে কোনও মামলা বা আপিল উপাসনাস্থল আইন পাশ হওয়ার আগে যদি করা হয় তাহলে তার গুরুত্ব হ্রাস করা হবে না।


উক্ত আইনের বয়ান মসৃণ নয়। ১৯৯১ সালের দশম লোকসভায় সংসদে যে বিতর্ক হয়েছিল তা থেকেই বোঝা যায় এই আইনের পথ এত সুগম ছিল না। এই বিল পেশ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চবন বলেছিলেন, ধর্মীয় উপাসনাস্থল নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক দেখা দিচ্ছে যা সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে অস্থির করে তুলছে, একে থামানোর লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই আইনের অভিপ্রায় হল, নতুন করে কোনও বিতর্ক সৃষ্টিকে রোধ করা বা পুরনো বিতর্ক যা মানুষ ভুলে গেছে সেগুলি নিরসন করা। (লোকসভা বিতর্ক, ভলিউম ৫, নং ৪১-৪৯, পৃষ্ঠা ৪৪৮)।


বিজেপি সদস্যরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমা ভারতী বলেছিলেন, “১৯৪৭ সালের স্ট্যাটাস কুয়ো বজায় রাখার মাধ্যমে আপনারা তোষণের নীতি নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।” সিপিআই(এম)-এর সোমনাথ চ্যাটার্জি তাঁর দলের আরেক সাংসদ জয়নাল আবেদিনের পেশ করা এক রেজল্যুশনের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। এই রেজল্যুশনে আলোচনা করা হয়েছিল, উপাসনাস্থল আইনের মতো বিধি কেন একান্ত প্রয়োজন। বিল যখন চালু করা হয় তখন এই রেজল্যুশন তুলে নেওয়া হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অশোক সিংহল সাংসদদের যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা পাঠ করে শোনান সোমনাথ চ্যাটার্জি। এই চিঠিতে বলা হয়েছিল, হিন্দু মুসলিমদের আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চান ধর্মাচার্যরা এবং এই ইস্যুকে ভবিষ্যতের জন্য সমাপ্ত করে দিতে ইচ্ছুক, তবে তাঁরা একটি বিনীত দাবি করেছেন আর তা হল, কেবলমাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থল যেমন অযোধ্যা (শ্রীরামের জন্মভূমি), মথুরা (শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি) ও বারাণসী (শ্রীবিশ্বনাথ মন্দির)-কে পুনরুদ্ধার করার অনুমতি যেন দেওয়া হয়। চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছিলেন, দেশের জন্য গুরুতর বিষয়গুলিকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে দেশ যদি আজ “ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে নিজের শক্তি ক্ষয় করে তাহলে তা হবে আমাদের জন্য দুঃখের দিন।”


ওই বিলকে সিপিআই(এম) সমর্থন জানিয়েছিল এবং সোমনাথ চ্যাটার্জি বলেছিলেন, ধর্মীয় উপাসনাস্থল মসজিদ হোক বা মন্দির তা নিয়ে বিতর্কই যখন মূল চিন্তার বিষয় তখন তা এখানে ও এখনই শেষ করে দেওয়া উচিত বিলের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। অযোধ্যার বিষয়ে বলা যেতে পারে, একে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বা বিচারবিভাগীয় রায়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টকে ‘কাট-অফ’ তারিখ কেন ধরে নেওয়া হল সে প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)-এর সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওই তারিখেই (১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট) সমস্ত বর্বরতাকে চিরদিনের জন্য পিছনে ফেলে আমরা আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত হয়েছি বলে মনে করা হয়।  ওই তারিখ থেকেই আমরা নিজেদের পৃথক করতে পেরেছি। এমন একটা দেশ যার কোনও সরকারি ধর্ম নেই এবং যে দেশ সকল ধর্মকে সমানাধিকার দান করে। তাই, অতীতে যা কিছু ঘটে থাক, আমরা প্রত্যাশা করি ওই তারিখ থেকে অতীতে দিকে আমরা আর ফিরব না।


রাম বিলাস পাসোয়ান বলেছিলেন, অন্য সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহকে নিজেদের দাবি করে নির্দিষ্ট কিছু শক্তি সহিংসতায় যে ভাবে উস্কানি দেয় তা বন্ধ হবে এই আইনের ফলে। বর্তমানে আমাদের প্রধান ইস্যু হল সংবিধান। ভারতকে রক্ষা করাই ইস্যু, যে ভারতের স্বাধীনতার জন্য হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানরা লড়াই করেছিলেন এবং সংবিধানকে রক্ষা করা ভারতের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।


এই আইনের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝতে হলে ২০১৯ সালে অযোধ্যা শীর্ষক মামলার জন্য পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিল তা দেখা জরুরি। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, ভারতীয় রাজনীতির ধর্মনিরপক্ষে চরিত্র বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বানানো এই বিধি এক আইনি হাতিয়ার। তারা জানিয়েছিল, হিন্দু উপাসনলয়ের বিরুদ্ধে মুঘল শাসকরা কী করেছিলেন সেই সংক্রান্ত দাবিকে আজকের আদালত গুরুত্ব দিতে পারে না। প্রাচীন শাসকদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ যদি সান্ত্বনা বা প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে এই আইন তার উত্তর নয়। আমাদের ইতিহাসে এমন সব ঘটনা রয়েছে যা নীতিগত ভাবে বেঠিক বলে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এমনকি আজও উত্তপ্ত মতাদর্শিক বিতর্কের জন্ম দিতে তা সক্ষম। আদালত জানিয়েছিল, আই আইন আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে এবং পশ্চাদপসরণকে কঠোর ভাবে প্রতিরোধ করে।

রাফাহের ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার ইসরাইলি পরিকল্পনা—সত্য নাকি গল্প? মার্ক আওয়েন জোনস


গাজা ভূখণ্ডের রাফাহ শহরে পরিকল্পিত আক্রমণের আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিভি চ্যানেল এবিসি-কে রবিবার এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমেরিকানসহ পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সতর্কতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেন। পশ্চিমা নেতারা বলেছিল, রাফাহতে আক্রমণ করলে ব্যাপক পরিমাণে বেসামরিক নাগরিদের মৃত্যু হবে। নেতানিয়াহু বলেন, “বেসামরিক মানুষ যাতে এলাকা ছাড়তে পারে তার জন্য নিরাপদ রাস্তা দিয়েই আমরা যা করার করতে চলেছি।”


ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জোনাথন কার্ল প্রশ্ন করেছিলেন, ১৪ লক্ষ ফিলিস্তিনি যাবে কোথায়? এর উত্তরে নেতানিয়াহু বলেন, “রাফাহের উত্তরে যে ফাঁকা অঞ্চল রয়েছে সেখানে, প্রচুর জায়গা রয়েছে ওখানে, তবে এটা করার আগে আমরা বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি।” নেতানিয়াহু নিজের বক্তব্য নিয়ে সন্তুষ্ট এমনটাই শোনাচ্ছিল।


একদিন আগে, ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি লন্ডনে অবস্থিত এলবিসি রেডিওতে বক্তব্য রাখেন এবং তাঁকে যখন চারবার প্রশ্ন করা হয় যে, রাফাহের ফিলিস্তিনিরা যাবে কোথায়? লেভি কোনও উত্তর দিতে পারেননি। তিনি সামান্য যেটুকু বলতে পেরেছেন তা হল, “গাজা ভূখণ্ডে ফাঁকা জায়গা রয়েছে এবং আরেকটি বিকল্প হল, ফাঁকা এলাকাতে বেসামরিক নাগরিকদের পাঠাতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলিকে আমাদের সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।” এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ম্যাট ফ্রেই যখন জিজ্ঞাসা করেন, ওই ফাঁকা জায়গা কোথায়? এর কোনও উত্তর তিনি দেননি।


নেতানিয়াহু ও লেভি একটা সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না কারণ তাঁরা উভয়েই জানেন, ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে ইচ্ছুক নয়, অন্তত এখনও পর্যন্ত করেনি। তাঁরা জানেন, ফিলিস্তনিদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ নয় এবং রাফাহতে আক্রমণ শুরু হলে তাদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ থাকবে না। তারা এও জানেন, গাজা ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ইসরাইল, তাদের সেখানে রাখতে নয়।


 


গাজায় নেই নিরাপদ স্থান


গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলের সরকার ভুয়ো তথ্য প্রচার বৃদ্ধি করেছে। ইসরাইল যখন দাবি করে যে, সে দেশের সেনা “নিরাপদ পরিসর” তৈরি করছে গাজার মানুষদের জন্য বা তাদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এর চেয়ে মিথ্যা দাবি আর নেই। গত ভয়াবহ চার মাসে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।


প্রথমত, ইসরাইল গাজার মানুষদের বলেছিল, দক্ষিণাঞ্চল নিরাপদ থাকবে। গাজাবাসী যখন এলাকা খালি করতে শুরু করেছিল, ইসরাইলি বাহিনী বেসামরকি নাগরিকদের গাড়িবহরের উপর বোমাবর্ষণ করেছিল। ফিলিস্তিনিরা যখন দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছায় তখনও তাদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। “নিরাপদ যাত্রাপথে” যেখানে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের উপর বোমা ফেলা হয়নি, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে স্নাইপাররা গুলি করেছে বা আটক করেছে এবং জোর করে তাদের বেপাত্তা করে দিয়েছে।


খান ইউনিসের আগের “নিরাপদ অঞ্চলে” ইসরাইলি সেনা যখন আক্রমণ করেনি তখন তারা বেসামরিক নাগরিকদের বলেছিল হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে থেকে যেতে। মানুষ যখন হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে পৌঁছতে চেয়েছে তখন স্নাইপাররা তাদের গুলি করেছে এবং তারপর বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।


ইসরাইলি সেনা বাহিনী ফিলিস্তিনিদের খান ইউনিস পরিত্যাগ করতে বলার পর তারা যখন পালাচ্ছিল তখন তাদেরকে নিশানা করা হয়। আরেক “নিরাপদ অঞ্চল” রাফাহতে কিছু ফিলিস্তিনি হাজির হয়েছিল, তখন তাদের বলা হয় সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। এখন মানুষজনকে রাফাহ ছেড়ে “ফাঁকা এলাকা”তে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। অন্য “ফাঁকা এলাকা” বলতে পড়ে রয়েছে মাওয়াসি। এখানে আগেও মানুষজনকে চলে যেতে বলা হলেও বারবার নিশানা করা হয়েছে।


মানুষকে এলাকা খালি করতে বলার এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তাদের হত্যা করার অভিপ্রায়। ইসরাইলের সেনা ও সরকার ইংরেজিতে যাবতীয় ঘোষণা করে থাকে এবং পশ্চিমা মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দাবি করছে, “বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে” তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইভাকুয়েশনের পথ অনিরাপদ বা সেই পথের মানচিত্রকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা তার পাশাপাশি বড় প্রশ্ন হল, তারা একটা সত্য গোপন করতে চেষ্টা করছে আর সেই সত্য হল, গাজায় কোনও নিরাপদ স্থান নেই।


 


শ্রুডিঙ্গারের হামাস


চলমান যুদ্ধের মতো অতীতেও ইসরাইল বারবার সাধারণ মানষের হত্যার জন্য হামাসকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকেও দায়ী করেছে। তারা বারবার দাবি তুলেছে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ও কমান্ডাররা বেসামরিক নাগরিকদের “মানবিক ঢাল” হিসেবে ব্যবহার করছে।


তবে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী যে তথ্য প্রকাশ  করেছে তার সঙ্গে এই দাবি মিলছে না। জানুয়ারি মাসে ইসরাইল দাবি করেছিল, তারা ১০ হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে (গাজায় ৯ হাজার ও ইসরাইলের মধ্যে ১ হাজার জনকে) এবং ৮ হাজার জনকে জখম করেছে, ২৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছে ও হামাসের রেজিমেন্টের দুই-তৃতীয়াংশকে উৎখাত করেছে। তারা এও বলেছে, তারা গাজা ভূখণ্ডে ৩০ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে “আঘাত” হেনেছে।


নিজেদের মূল্যায়নে বিশ্বের সবচেয়ে নীতিবান ইসরাইলি সেনা বাহিনী কেবলমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে “হামলা” করে। কেউ ভাবতে পারেন, কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা বা জখম করা যেতে পারত। আমরা যদি নেতানিয়াহুর দাবি শুনি, তাহলে একজন ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, এর ফলে আমরা মৃতের যে সংখ্যা পাই তা ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ খারিজ করে দেবে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সংখ্যাকে আপাত ভাবে ব্যবহার করছে ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ। অথচ সেই সংখ্যা নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন তুলেছে ইসরাইলের সরকার।


অন্য ভাবে বললে, ইসরাইলের সেনার দেওয়া তথ্য নিশ্চিত করে, তারা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করছে এবং গাজা ভূখণ্ডে বেসামরিক নাগরিক-সামরিক বাহিনীর মৃত্যুর হার নিয়ে নেতানিয়াহু মিথ্যা বলছেন। তবে, ইসরাইল সরকারের ভাষ্য নিয়ে আরেকটি বৈপরিত্য রয়েছে এবং তা এই তথ্য থেকেই বেরিয়ে পড়ছে।


ইসরাইলের অনুমান, যুদ্ধের আগে হামাসের কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল। ইসরাইলি সেনার দাবি, তারা গাজা ভূখণ্ডে যেখানে আক্রমণ চালিয়েছে সেখান থেকে হামাস যোদ্ধাদের উৎখাত করেছে এবং রাফাহ হল “হামাসের শেষ ঘাঁটি”, এই কথা যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এর অর্থ হল, জানুয়ারি মাসে রাফাহতে কমপক্ষে ১০ হাজার ছিল অথচ সেই সময় ফিলস্তিনিদের বলা হচ্ছিল যে, এই এলাকা নিরাপদ।


হামাস যদি ইসরাইলের দাবি মতো মানবিক ঢাল ব্যবহার করে থাকে তাহলে ইসরাইল স্বীকার করে নিচ্ছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের সেই সব এলাকার দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে যেখানে হামাস রয়েছে এবং তাদেরকে নিশানা করার অজুহাত দেওয়া যায়। ইসরাইলের মূল মন্ত্র হল—হামাস যেখানে যায়, সাধারণ মানুষ সেখানে যায়। সাধারণ মানুষ যেখানে যায়, হামাস সেখানে যায়। হামাসকে পরাস্ত করতে হলে বেসামরিক নাগরিকদেরও নিশ্চিহ্ন করতে হবে।


 


“নাকবা হল নিরাপত্তা”


ইসরাইলের সরকার দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করছে ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপদ্বীপে নির্বাসন দেওয়ার; এই তথ্য আর গোপন নেই। গত অক্টোবরে ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নথি ফাঁস হয়ে গিয়েছিল যাতে গাজার ফিলিস্তিনিদের মিশরীয় অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


নেতানিয়াহু একে “ভাবনাপত্র” বলে তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছিলেন এবং এর তথ্য-বিষয়বস্তুকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অবাক হতে হয় যখন এবিসির সাক্ষাৎকারে “প্রচুর এলাকা” শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় নেতানিয়াহু ঢোক গিলেছিলেন। বিধ্বস্ত গাজা ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি বসতির উন্নয়নের জন্য কি তাহলে রিয়েল এস্টেটের পরিকল্পনা করা হচ্ছে? নাকি গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলিদের পুনরায় বসতি স্থাপনের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে?


গত চার মাসে ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে মিশরের একেবারে কাছে অর্থাৎ দক্ষণাঞ্চলে কোণঠাসা করা হয়েছে। এদিকে, ইসরাইলের সেনা বাহিনী ও সরকারের “নিরাপত্তা” ও “ইভাকুয়েশন” শব্দগুলি তাদের মিথ্যাচারকে ঢাকা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে। “গণহত্যার প্রযুক্তি”র অংশ হিসেবে যেভাবে বয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে ইসরাইলের জন্য আরেকটি নাকবার পথ প্রশস্ত করছে এবং তার নকশা তৈরি করা হচ্ছে। ইসরাইলের মিত্রশক্তি ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।


বস্তুত, এই পশ্চিমা শক্তি ইসরাইলের এই ভয়াবহ আগ্রাসনের মদতদাতা এবং ওই নকশা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইসরাইলের গণহত্যামূলক প্রচারণাকে “একটু বাড়াবাড়ি” বলে বিষয়টিকে লঘু করে দিতে সাহায্য করে। যুদ্ধের বাস্তবতায় রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে সত্য নিগৃহীত হয় এবং মিথ্যা তথ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধে আরেক ভুয়ো তথ্যের।


জর্জ ওরওয়েলের বিখ্যাত ধ্রুপদী রচনা ‘১৯৮৪’-তে রয়েছে, “যুদ্ধই শান্তি। স্বাধীনতাই দাসত্ব। অজ্ঞতাই শক্তি।” এর সঙ্গে যোগ করতে হয়, “নাকবাই নিরাপত্তা” কেননা গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিভীষিকার এটাই বাস্তব রূপ।


 


তরজমাঃ জিয়াউল হক

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে? আব্দুল বারি মাসুদ


উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপের পর, আরও এক বিজেপি-নেতৃত্বাধীন রাজ্য অসমের সরকার ১৯৩৫ সালের অসম মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন বাতিল করেছে ২৩ ফেব্রুয়ারি। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সভাপতিত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম রাজ্য হিসেবে উত্তরাখণ্ড অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার তিন সপ্তাহ পরে এই ঘটনা ঘটল। এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, দ্রুত এগিয়ে আসা লোকসভার আগে শাসক দল বিজেপি কতখানি মরিয়া। অনেকের মতে হতে পারে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মীয়মাণ রাম মন্দির উদ্বোধন করেও বিজেপি তাদের কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে। প্রাচীন মসজিদগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করা, ধ্বংস করে দেওয়া, ঘৃণাভাষণ ও হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ গত কয়েক মাসে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।


কোনও ইতিবাচক ইস্যু বা স্লোগান না থাকায় হিন্দুত্ববাদী বাহিনী হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে সাধারণত তিনটি বিষয় ব্যবহার করে—গরু, পাকিস্তান ও মুসলিম। ২০১৯ সালের নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাকিস্তান এবং এই ইস্যু বিজেপিকে ভোট পেতে সাহায্য করেছিল। ২০১৪ সালে তথাকথিত গরু-সংক্রান্ত ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছিল তারা। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে মুসলিমদের সরাসরি নিশানা করা হবে। লক্ষণীয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে কম-তীব্রতার (ছোট খাটো) সংঘাত বানিয়ে তোলা হচ্ছে।


সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা বানিয়ে তোলা সংঘাতের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঘটনাগুলি হল, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর অসম্পূর্ণ রাম মন্দির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিতরে হিন্দুদের পূজার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, দিল্লির মেহরাউলি এলাকায় কুতুব মিনারের কাছে ৮০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বাঘপতে বারনাওয়া জেলায় শেখ বদরুদ্দিনের দরগা ও সেই সঙ্গে ১০০ হেক্টর জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, হলদোয়ানিতে একাধিক মাদ্রাসা ও মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এবং পুলিশের গুলিতে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, বিজেপির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করছে। সর্বোপরি, সংসদে পেশ করা সাম্প্রতিক বাজেটে সংখ্যালঘু বিষয়ক নানা তহবিল ও একাধিক কর্মসূচি বাতিল বা ব্যাপক ভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে যেমন মৌলানা আজাদ এডুকেশন ফাউন্ডেশন (এমএইএফ) বন্ধ করা হয়েছে।


২০২১ সালের মে মাসে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসমের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে লাগাতার মুসলিমদের নিশানা করা হয়েছে, অথচ এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশই মুসলিম। শর্মা মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডকে অকেজো করে দিয়েছেন। এই বোর্ড ব্রিটিশ আমল থেকে টিকে ছিল। ৬১০টি সরকার-চালিত মাদ্রাসাকে শর্মা হাই স্কুলে রূপান্তরিত করেছেন। এই রাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় জমি জবরদখল বন্ধ করার নামে তিনি উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছেন। ২০২১ সালের মে মাস থেকে ৬৪৫০টির বেশি পরিবারকে, যাদের অধিকাংশই বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম, তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এইসব এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই বাংলাভাষী মুসলিম। অসমের প্রশাসন দুটি মসজিদও ভেঙে দিয়েছে। এ থেকে মনে হয়, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসী-অধ্যুষিত রাজ্যকে হিন্দুত্বের নতুন গবেষণাগারে পরিণত করেছেন। ১৯৩৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন নিয়ে শর্মার সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, “প্রাক-স্বাধীনতা যুগের অচল” এই আইনকে বাতিল করা হয়েছে শিশুবিবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে। শর্মা এক্স (সাবেক ট্যুইটার) হ্যান্ডেলে লিখেছেন, এই আইনে এমন নিয়ম আছে যাতে বর ও কনে ২১ ও ১৮ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই বিয়ের জন্য নিবন্ধন করতে পারে। অসমের মন্ত্রিসভায় শর্মার আরেক সহকর্মী জয়ন্ত মল্লবড়ুয়া এই সিদ্ধান্তকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মুসলিমদের বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সমস্ত ইস্যুতে বিশেষ বিবাহ আইন প্রয়োগ করা হবে। গণমাধ্যম কর্মীদের মল্লবড়ুয়া বলেছেন, নতুন আইনি কাঠামো অনুযায়ী মুসলিম বিবাহ ও ডিভোর্স নিবন্ধনের দায়িত্ব পাবেন জেলা কমিশনার ও জেলা নিবন্ধক। বাতিল আইন মোতাবেক নিযুক্ত ৯৪ জন মুসলিম রেজিস্ট্রারকে তাঁদের পদ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে এককালীন ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।


অসম সরকারের এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এআইডিএফ সভাপতি ও সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল বলেছেন, এই রাজ্যের বিজেপি সরকারের মৃত্যু ঘন্টা বাজাবে এটি। গুয়াহাটিতে এক কর্মসূচির ফাঁকে সংবাদদাতাদের আজমল বলেন, তারা মুসলিমদের প্ররোচিত করতে ও নিজেদের পক্ষে ভোটারদের মেরুকরণ ঘটাতে চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, “আমরা অবশ্যই এই আইনের বাতিলীকরণের বিরোধিতা করব, তবে তা নির্বাচনের পর। এখন আমরা নীরব থাকব।” কাজিদের দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বিষয়ে আজমল বলেন, কাজিরা ভিখারি নন। এরপর আজমল বলেছেন, “গণমাধ্যমের মারফত আমি তাঁদের বলব, তাঁরা যেন সরকারের কাছ থেকে এক পয়সাও না নেন।”


সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে প্রতি মাসে নজরদারি চালায় এবং তারা জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসে পাঁচটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে চারটিই সরাসরি অযোধ্যাতে মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই চারটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে দুটি সংঘটিত হয়েছে মুম্বই, নাগপুর অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে, একটি বদোদরাতে অর্থাৎ গুজরাতে এবং একটি মধ্যপ্রদেশে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ সবগুলিই বিজেপি-শাসিত রাজ্য। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০২২ ও ২০২৩ সালে গোটা ভারতে সংঘটিত ২৮টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সরাসরি ভাবে রাম নবমী মিছিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত মাসে রাম মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে ও পরে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা ভয়ানক। এই সকল ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক মিথের উপর নির্ভরশীল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

 

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কেন বিক্ষোভ কৃষকদের? হরবীর সিং

 


কৃষকরা শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির নিশ্চয়তার দাবিতে পুনরায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আমাদের এখন দেখা প্রয়োজন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি সীমান্তে চলা কৃষকদের আগের বিক্ষোভ থেকে এবারের বিক্ষোভ কোথায় ও কতখানি আলাদা। আগের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল, কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা ছিল ঐচ্ছিক দাবি।

পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা মনে করেছিলেন, উক্ত আইনের নিয়মাবলি যেমন সরকার কর্তৃক শস্য সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বাজার কমিটি (এপিএমসি) আইনের অধীন মান্ডি ব্যবস্থা ও চুক্তিভিত্তিক চাষ তাঁদের প্রভাবিত করবে। তাই, সেই সময়, ওইসব রাজ্যের কৃষকরা মূল ইস্যু নিয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন কারণ মান্ডি ও শস্যসংগ্রহ ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছিলেন তাঁরা।

বিহার যেখানে এপিএমসি মান্ডি নেই এবং মধ্য ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশ যেখানে এপিএমসি মান্ডির তেমন সুবিধা পাওয়া যায় না, সেখানকার কৃষকরা কৃষি আইনের সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত বা সম্পৃক্ত হননি। তবে সকল কৃষকই তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য চান এবং এ জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি জরুরি। এই বিশ্বাসই এমএসপির আবেদনকে সর্বজনীন করে তুলেছে। এই কারণে ২০২৪ সালের কৃষক আন্দোলনের গোটা দেশে সাড়া ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছর পাঁচ রাজ্যের প্রায় ৬০০ জন কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি এমনই একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। শস্যের স্বল্প মূল্য ও গ্রামীণ পরিবারগুলির ক্রমবর্ধমান সমস্যাই ছিল তাদের সাধারণ উদ্বেগ ও যন্ত্রণার বিষয়। রাজস্থানের যোধপুর, উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর, ওড়িশার ভুবনেশ্বর, মেঘালয়ের শিলং ও তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের কৃষক ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম। ছয় মাস ধরে আমরা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলাম। দিল্লি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর পর।

একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ভাল মূল্য প্রাপ্তিকেই সমস্যার সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেন। দেশের সমস্ত প্রান্তের কৃষকরা কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যই শুধু চান না, সেই সঙ্গে এমএসপির নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টিও চান। প্রায় তিন মাস পরে দিল্লির উদ্দেশে মিছিল শুরু হয়েছিল পুনরায়। পঞ্জাবের দুটি স্বল্প পরিচিত কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাঁদের দাবি দেশের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন কৃষক সংগঠনগুলি দিল্লি সীমান্ত থেকে ফিরে গিয়েছিল, সম্যুক্ত কিষাণ মোর্চাকে (এসকেএম) লেখা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব সঞ্জয় আগারওয়াল বলেছিলেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত ইস্যুর সমাধান বের করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আগারওয়ালের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে, এমএসপির পাশাপাশি তাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে কৃষির ব্যয় ও পণ্যের মূল্য বিষয়ে কমিশনের কর্মকাণ্ড, প্রাকৃতিক ও জৈব কৃষি ইত্যাদি। এসকেএম-এর তিন প্রতিনিধিকে এই কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এসকেএম তা গ্রহণ করেনি এবং ওই কমিটিতে যোগ দেয়নি। সেই কমিটির রিপোর্ট এখনও আসেনি। এর ফলে যে কৃষকরা বলেছিলেন এই কমিটি গঠন আসলে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার তাঁদের কথাই সত্যি হয়েছে। সরকার সম্ভবত উপলব্ধি করেনি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ইস্যুটি এত সহজে যাওয়ার নয়।

গোটা দেশে কৃষকদের আয় হয় খুব কম, নয়ত হ্রাসের দিকে। যে সব রাজ্যে ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, সেখানকার উৎপাদনশীলতা পড়তির দিকে এবং কৃষির ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। আমরা বলতে পারি, কৃষকরা যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে তার সামান্যই তাঁরা ফিরে পান। গত চার দশকে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হওয়ায় কৃষকদের উপার্জন হ্রাস পেয়েছে এবং এর ফলে তাঁদের জীবন যাপনের মানের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবধান ব্যাপক হয়েছে। এদিকে, তথ্যের বিস্ফোরণের ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার যা কিছুই দাবি করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ অনেক গুণ বেড়েছে, অথচ এই সব ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবে কৃষিক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষক পরিবারের সন্তানদের কাজের সুযোগ কমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের একটা সর্বজনীন আবেদন রয়েছে কারণ এটি কৃষকদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কৃষকরা ফসলের উৎপাদন ও মূল্য নিয়ে বর্ধিত অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে চান। গম, ধান, আখ, আলু, পেঁয়াজ বা নারকেল—যা-ই চাষ  করুন না কেন, কৃষকরা তাঁদের শস্যপণ্যের ভাল ও স্থায়ী মূল্য চান। আমাদের দৃষ্টিকোণ বদলানো উচিত এবং চিন্তা করা উচিত যে, ভারত ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। এই দেশ নিউজিল্যান্ড বা চিলির মতো নয় যেখানে কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উপায় হিসেবে ভাবা হয়।

বিপুল সংখ্যক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হয় আমাদের এবং আমরা কেবলমাত্র আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভর করতে পারি না। কৃষি উৎপাদনকে আমাদের কৌশলী ক্ষেত্র হিসেবে দেখা উচিত এবং একে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। দেশে প্রায় ১৪ কোটি জমি-মালিকানা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের কল্যাণই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কাছ থেকে আমাদের বুঝে নিতে হবে, তারা দেশের ২০ লক্ষ কৃষকের উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কারণ তারা শুধুমাত্র খাদ্য আমদানির উপর নির্ভর করে বসে থাকতে চায় না। আমাদের উপভোক্তাদের মানসিকতাও বদলানো জরুরি। তাদের ভাবতে হবে, কৃষকরা তাদের পেট ভরান এবং সে জন্য তাঁদের ভাল মূল্য পাওয়া উচিত। উপভোক্তাদের সঙ্গে কৃষকদের দ্বন্দ্ব তৈরি করার পরিবর্তে যখন আমরা ১২ টাকায় এক কিলোগ্রাম আলু ও ১৫ টাকায় এক কিলোগ্রাম পেঁয়াজ কিনি তখনই এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন: দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কি যায়নবাদকে আড়ালের চেষ্টা! । রামজি বারৌদ

 


ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অনস্তিত্ব সমস্যা নয়, যায়নাবাদ স্বয়ং এক মূর্তিমান সমস্যা ও বিপদ। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করে কী হবে যদি বর্ণবাদী মতাদর্শ হিসেবে যায়নাবাদ ইসরাইলের প্রথম পরিচয় হয় এবং এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসরাইলের এই চরিত্র যদি ফিলিস্তিনের উপর ক্রমাগত চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্ব কোথায়?

এই মতাদর্শ অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের জীবনের মূল্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের বিশুদ্ধ বর্ণবাদী রাষ্ট্র কায়েম করাই লক্ষ্য। তাদের এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে বা আহত করেছে।

যায়নাবাদকে যদি সার্বিক ভাবে পরাস্ত করা না যায় তাহলে দ্বি-রাষ্ট্র বা একক-রাষ্ট্রের সমাধান দিয়ে কিছু করা যাবে না। যায়নবাদকে সংস্কার বা ‘সারিয়ে’ তোলা নয়, একেবারে একে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। গাজা ভূখণ্ডে নজিরবিহীন ভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে যখন সেই সময় পশ্চিমা রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। কিন্তু এখন কেন? ইসরাইল যখন সব রকমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে তখন এই রাজনীতিকরাই ও তাঁদের সরকার নীরব থেকেছে বা ইসরাইলের বর্বর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়েছে।

তাঁদের নৈতিক মূল্যবোধ বা বিবেক জাগ্রত হয়নি। ইসরাইল যখন নিয়ম করে ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করছে তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁরা স্বদেশের মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ-র সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস গানস বলেছিলেন, “মানব ইতিহাসে এটাই প্রথম গণহত্যা যেটা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে।” এই গণহত্যা বর্তমানে আরও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে কারণ ফিলিস্তিনিরা অনাহারে মারা যেতে বসেছে। আবার সেখানকার বহু মানুষ রোগ, দূষিত জলের কারণে মারা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলের বোমা ও গুলিবর্ষণ তো রয়েছেই।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতো অনেকেই বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া “দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি”। কিন্তু এটা হল এই বিষয়ে ন্যূনতম কথা। কেননা প্রতিদিন যারা বাঁচার জন্য লড়াই করে চলেছে তাদের কাছে পশিমা রাজনীতিকদের এটা আরও একটা ফাঁপা বুলি ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়। এ নিয়ে তারা ভাবিতও নয়। গাজা ভূখণ্ডে যে গণহত্যা চলছে তা আমাদের বলে দেয়, এই ইস্যু কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, সেই সঙ্গে এটা মতাদর্শেরও। পশ্চিমা নেতারা যখন “দীর্ঘমেয়াদি শান্তি”র কথা বলেন, তখন ইসরাইল তাদের সহিংসতা ও জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় ও বাড়িয়ে তোলে।

চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গির বলেছিলেন, “এমন পরিস্থিতি কখনও আসতে পারে না যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নারী ও শিশুরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। সবাইকে (…) বুলেটবিদ্ধ করা হবে।”

গাজা ভূখণ্ডে সহিংসতা ব্যাপকাংশে অসুস্থকর। ইউরো-মেড মনিটর নামে এক অধিকার সংগঠন ১২ ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, “ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটককৃতদের অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দেখার জন্য দশ-কুড়ি জন করে ইসরাইলি সাধারণ মানুষকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা হাসতে হাসতে সেই দৃশ্য রেকর্ড করে।” ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর মারাত্মক নিগ্রহ ও নির্যাতন করে ইসরাইলি সৈন্যরা।

এই সব কর্মকাণ্ডের কোনও যৌক্তিক রাজনৈতিক ন্যায্যতা থাকতে পারে না। এগুলির (গণহত্যার ভাষা, গণহত্যা স্বয়ং ও বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত করার হুমকি) শিকড় যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক তত্ত্বে নেই, রয়েছে যায়নাবাদে। সমস্যা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে কারণ আমরা সমস্যাটিকে সমাধান করতে চাইছি না। প্রকৃত প্রস্তাবে, অনেকে ঠিক এর উল্টোটা করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সরকারগুলি যায়নাবাদের সমালোচনা ও সেমিটিজম-বিরোধীতাকে সমগোত্রীয় প্রমাণ করতে আইন পাশ করেছে বা করছে। এমনকি, ফেসবুকও ‘যায়নবাদী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ করতে চায় যদি তা ইসরাইলকে সমালোচনা করতে ব্যবহার করা হয়।

ইসরাইলের হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু ৫ নভেম্বরে গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন যখন,  সেই সময় অনেকে তাঁর নিন্দা করেছিলেন অনুপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করার জন্য। অথচ পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা নিয়ে কেউ সমালোচনা করেননি। ইসরাইলের কয়েকজন কর্মকর্তাও এলিয়াহুর সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তা মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের ভাবমূর্তি ক্ষতি করার জন্য।

যাইহোক, ইসরাইলের ওই মন্ত্রী কেবলমাত্র রাগে উন্মত্ত হয়ে ওই মন্তব্য করেননি। তিনি জেনেবুঝেই বলেছিলেন কারণ তারপর থেকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা করার এই ইচ্ছা সত্যিই তাদের মধ্যে রয়েছে।

টিকে থাকার জন্য যায়নবাদীরা যা কিছু করতে পারে এবং তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে আছে কাল্পনিক শত্রুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উপর। বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক বা এমনকি সাংস্কৃতিক ভাবে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে যে জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান চালানো হয়েছিল তা নাকবা নামে পরিচিত। ইসরাইলের সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতেই এই মারাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘শত্রু’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র টিকে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধ অব্যাহত রাখায় ও তাদের সমষ্টিগত অধিকার দাবি করায় ইসরাইলের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা।

যদি গাজার পতন হয় তাহলে বাকি ফিলিস্তিনের সকল ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে ইসরাইলি সহিংসতা, জাতিগোষ্ঠী সাফাই ও প্রয়োজন হলে গণহত্যার। নতুন রাজনৈতিক সমাধান সূত্র সন্ধান করার নামে ইস্যুটিকে লঘু ও খাটো করার অর্থ হল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে মিথ্যা আশা বিক্রি করা এবং মূল ইস্যু অর্থাৎ ইসরাইলের যায়নবাদী মতাদর্শকে আড়াল করার চেষ্টা। সমস্ত বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মতো যায়নাবাদও উপনিবেশিত ভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শূন্য-দায়বদ্ধতার নীতি নিয়ে চলে। তাদের মূল কথা হল, জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ ও গণহত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার।

“দীর্ঘস্থায়ী শান্তি”র জন্য যায়নবাদ নির্মূল হওয়া প্রয়োজন।

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক