কবীর দেব-এর কবিতা : অনুবাদ ঔরশীষ ঘোষ


প্রাদুর্ভাব

চতুর্দিকে চাপচাপ অন্ধকার
আর খাঁচা বন্দী মানুষের দল
পরিবার ও সঞ্চয় ঘিরে জমাট বেঁধেছে
বিপণি এখন তুচ্ছ মনে হয়
বাতাস আতঙ্কে ঘনীভূত আর ধুলোসর্বস্ব রাস্তায়
দেখেছি আশার আলো উড়ন চাকীর মত
মাথার ভিতর, যেন ফড়িঙের ডানার কল্লোল
তীব্রতর হচ্ছে আরো

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়

বহুকাল ধরে আমি
আমাদের বিশৃঙ্খলায় দেখেছি
জমি বা জুতোর জন্য বা শব্দের অমোঘ আকর্ষণে
কবর দিয়েছি মৃত অর্ঘ্য,
ভুলে গেছি পিতা ও পুত্রের বাক্যালাপ, মায়ের আদর

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়

এমন সময় অভিপ্রেত ছিল
পৃথিবীর ঘড়ি যাতে ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে
যখন পাখিরা পুনরুদ্ধার করবে তাদের আশ্রয়
শীলমাছ নির্ভয়ে সাঁতরাবে হিমগ্ন স্রোতে
আর ভালুকেরা ফুলের নেশায় ফিরে আসবে
আজ মনে হয় এমনই হওয়ার কথা ছিল
হয়তো আমার ভুল, কিন্তু এমন চিন্তার মধ্যে
দেখা পাই আত্মবসন্তের

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়

কবিতা ও সঙ্গীতের নেশায় মাতাল হয়ে
চিরশান্ত ঘুম নেমে আসে চোখে
আর যে ভয় তাড়া করতো কখনো আমাকে
মৃত্যুর অপ্রীতিকর পরিনাম, প্রতিশোধ মাখা
জামায় যে মন্ত্র লেখা আছে, একটি সুন্দর লাইন
বিষণ্ণ গাছের নিচে, 'মুহুর্ত বিশ্বাস করে,
একদিন অসুস্থতা ভবিষ্যৎ আগলাবে'

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়

কোনও না কোনওভাবে
একদিন সকলেই মরে যায় প্রিয়
এবং নিজের মৃত্যু আমরা নির্বাচন করি না
কিভাবে মরণ দেখা দেবে, এবং যন্ত্রণা কত তীব্র হবে
তা কখনো কারো সম্মতির অপেক্ষা করেনি
কিন্তু আমি বেছে নিতে পারি বাঁচার উপায়
তা কখনো পূর্বনির্ধারিত নয়, আর পরবর্তী দুঃস্বপ্নে
যখন সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে, জানি
আবার সকলে আমরা মাতোয়ারা হব উৎসবে

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়

সময় এসেছে
যখন মানুষ মানুষের জন্য দুশ্চিন্তায়
কিভাবে সে বাঁচবে আর নিজের শিশুকে
শেখাবে লড়াই করতে, এবং মানিয়ে নিতে
ভয়ংকর প্রলয়ের সাথে
এখন ওষুধ হয় আরেকটু নিঃশ্বাস দেবে ফুসফুসে
অথবা রক্তের নদী বয়ে যাবে অদৃষ্টের দিকে
আমাদের অর্ঘ্য তবু পারে ফিরিয়ে আনতে
আরেকটি নতুন ভোর

এটি কোনও ঈশ্বরের অভিশাপ বা আশ্চর্য নয়
শুধু বহু মানুষের উন্মাদনা- কিন্তু কেন?
শুধু আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য
কারা ক্ষমতায় আছে
________________________

ইমরুল কায়েসের কবিতা : আরবি কবিতা



একক নারীর ঘরে কত দিন, কত রাত্রি আর কাটিয়ে যাব আমি
রেখা দিয়ে গড়া মূর্তির মতোই সংক্ষিপ্ত ও মেয়ে
মোমের নরম আলোর উজ্জ্বলতা নিয়ে আসে যখন সে
তার সঙ্গীর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়
উদার আগুন নিয়ে তার স্তন জ্বলজ্বল করে  
পাহাড় বরাবর উত্তরে দক্ষিণে মরুযাত্রীর
তাঁবুর কিনারে উতল বাতাসের ভেতর
শৈত্যপীড়িত লোক মরুস্থলে জাগায় যে আগুন, তেমন

কৈশোরেই মুখ তার এতখানি স্পষ্ট ও আনন্দনিকেতন যে
ভুলে যাই আমি আমার জামা ও কাপড় চলে যাবার সময়
বালিয়াড়ির মতো গোলাকার যেমন
ভালোবাসার শিশুদের মসৃণ আর ভেলভেট স্পর্শের কল্যাণ পাবো ব’লে
চেয়ে বসে থাকি
সবটুকু চেয়ে যখন ছেলেটি তাকে মুক্ত করে পোশাকের বন্দিদশা থেকে
ধীরে ও নরমে সে ঝুঁকে পড়ে, সরু তার কোমর আর বিষময় ঠোঁট থেকে
দ্রুত তার শ্বাস নেমে আসে তখন সে দৃঢ় ।

চিত্র : নেট থেকে সংগৃহীত
ভাবানুবাদ : জিয়া হক

পথচারী আজ কোথায়? : জলকণা রাহমান



একটা নৌকো নদীর ধারে পড়িয়াছিল। তাহার শরীর ছিল রুগ্ন। মাঝি তাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল, তাই সে একটা আবাসন হইয়া উঠিয়াছিল পাখিদের। এক ঘুঘু দম্পতি তাহার ভিতর বাসা বানাইয়া বসবাস করিতে লাগিল।
কয়েক মাহিনা পর, তাহাদের ছানা জন্মাইলো। ছানারা কিচিরমিচির করিয়া উঠিল। নদীতীরস্থ শান্ত নির্জন প্রাকৃতিক সমাজে উৎসব পড়িয়া গেল।
ছানারা উড়িতে শিখিল একদিন। তাহারা উড়িয়া দূরদেশে ভ্রমণ করিতে চাহিল। তাহাদের পিতামাতা বলিল, ডোন্ট গো, উই ওন্ট লিভ উইদাউট ইউ।
তাহারা শুনিল না। তাহারা চলিয়া গেল। চতুর্দিকে ডানা ঝাপটানোর উচ্চরোল উঠিল। তাহাদের পিতামাতা কেবল নৌকোর চতুর্পাশ্বে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাঁদিল।
তিন দিবস তাহারা বাসা হইতে বাহির হইল না। কেবল কাঁদিল। কিছু খাইল না। কেবল কাঁদিল। 
এই নদীতীরে এক কচ্ছপ পরিবার বাস করিত। তাহাদের আবাসন ছিল ওই নৌকোর নিকটেই। তাহারা এই ঘুঘুদ্বয়ের দুঃখে বড় পীড়িত বোধ করিল।
এক সন্ধ্যায় কচ্ছপজায়া তাহার একটি ছানা লইয়া আসিল ঘুঘুর নৌকো-বাড়িতে। আসিয়া দেখিল দুটি ঘুঘু ডানা এলাইয়া, পাখনা ছড়াইয়া কাষ্ঠ পাটাতনে শুইয়া রহিয়াছে। তাহাদের চোখের জল তখনও শুকাইয়া যায় নাই।
কচ্ছপজায়া আসিয়া ঘুঘুজায়াকে জাগাইয়া বলিল, ডোন্ট বি আপসেট দিদি, উই আর হেয়ার উইথ ইউ, আফটার অল এ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ ফ্রেন্ড ইনডিড। সো মি অ্যান্ড মাই হাজব্যাণ্ড থট দ্যাট উই শুড ডু সামথিং ফর ইউ অ্যাণ্ড উই আর গোয়িং টু গিভ ইউ ওয়ান অফ মাই চিলড্রেন। উড উই হ্যাভ ওয়ান?
ঘুঘুজায়া অশ্রু মুছিয়া বলিল, সো কাইণ্ড অফ ইউ। উই উইল বি গ্ল্যাড টু হ্যাভ ওয়ান বাট ওন্ট ইউ বি মিসিং ইওর চাইল্ড? ক্যান ইওর চাইল্ড অ্যাডজাস্ট উইথ আস অ্যাজ উই আর কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট স্পিসিস।
কচ্ছপজায়া হাসি মুখে বলিল, নো দিদি, ইট উইল নট বি অফ গ্রেট প্রবলেম, আই উইল ফ্রিকোয়েন্টলি কাম অ্যান্ড এভরিথিং উইল বি ফাইন। বাট রাইট নাও ইউ ব্যাডলি নিড সামওয়ান।
কচ্ছপের লড়কা রহিয়া গেল। সে ঘুঘুমাতাকে 'মা' ডাকিল, ঘুঘুপিতাকে 'আব্বা' ডাকিল এবং কণাশস্য খাইতে লাগিল।
একদা সে বয়ঃপ্রাপ্ত হইল এবং ঘুঘুমাতা ও ঘুঘুপিতার নিকট অনুমতি চাহিল যে সে দূরদেশে যাইতে চায় কেননা পৃথিবীটা দেখিয়া লওয়া খুব দরকার।
ঘুঘু দম্পতি পুনরায় মহা ফাঁপরে পড়িল। অনেক অনুরোধ করিল তাদের কচ্ছপ পুত্রকে। কিন্তু সে শুনিল না। সে চলিয়া গেল।
ঘুঘু পরিবার আবার শোকাভিভূত হইল। তাহারা ডানা এলাইয়া, পাখনা ছড়াইয়া শুইয়া রহিল। দিবসেই রাত্রি নামিয়া আসিল।
এই নদীতীরেই এক শামুক দম্পতি বসবাস করিত। তাহারা ছিল বড় কোমল হৃদয়ের।
এক সন্ধ্যায় শামুকজায়া তাহার একটি ছানা লইয়া উপস্থিত হইল ঘুঘুজায়ার নিকটে। সে তখনও শুইয়াছিল। তাহার অশ্রু তখনও শুকাইয়া যায় নাই।
শামুকজায়া আসিয়া ঘুঘুজায়াকে জাগাইয়া বলিল, ডোন্ট বি আপসেট দিদি, উই আর হেয়ার উইথ ইউ, আফটার অল এ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ ফ্রেন্ড ইনডিড। সো মি অ্যান্ড মাই হাজব্যাণ্ড থট দ্যাট উই শুড ডু সামথিং ফর ইউ অ্যাণ্ড উই আর গোয়িং টু গিভ ইউ ওয়ান অফ মাই চিলড্রেন। উড উই হ্যাভ ওয়ান?
ঘুঘুজায়া অশ্রু মুছিয়া বলিল, সো কাইণ্ড অফ ইউ। উই উইল বি গ্ল্যাড টু হ্যাভ ওয়ান বাট ওন্ট ইউ বি মিসিং ইওর চাইল্ড? ক্যান ইওর চাইল্ড অ্যাডজাস্ট উইথ আস অ্যাজ উই আর কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট স্পেসিস।
শামুকজায়া হাসি মুখে বলিল, নো দিদি, ইট উইল নট বি অফ গ্রেট প্রবলেম, আই উইল ফ্রিকোয়েন্টলি কাম অ্যান্ড এভরিথিং উইল বি ফাইন। বাট রাইট নাও ইউ ব্যাডলি নিড সামওয়ান।
শামুকের লড়কি রহিয়া গেল। সে ঘুঘুমাতাকে 'মা' ডাকিল, ঘুঘুপিতাকে 'আব্বা' ডাকিল এবং কণাশস্য খাইতে লাগিল।
একদা সে বয়ঃপ্রাপ্ত হইল এবং ঘুঘুমাতা ও ঘুঘুপিতার নিকট অনুমতি চাহিল যে সে দূরদেশে যাইতে চায় কেননা পৃথিবীটা দেখিয়া লওয়া খুব দরকার।
ঘুঘু দম্পতি পুনরায় মহা ফাঁপরে পড়িল। অনেক অনুরোধ করিল তাদের শামুক কন্যাকে। কিন্তু সে শুনিল না। সে চলিয়া গেল।
এইভাবে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়া গেল।
এক রাত্রে ঘুঘুজায়া বলিল, সি, অল অফ মাই চিলড্রেন, নট ওনলি মাই চিলড্রেন, অল অফ দেম ওয়ান্টেড টু গো অ্যাব্রড অর সাম ফরেন ল্যাণ্ডস। উই নেভার স্টপড দেম ফ্রম গোয়িং। বাট ইন দিস ওল্ড এজ, উই আর অ্যালোন। ইয়েস্টারডে আই ওয়াজ থিঙ্কিং সামথিং।
ঘুঘুকর্তা বলিল, হোয়াট ওয়াজ দ্যাট?
ঘুঘুজায়া আর্দ্র স্বরে বলিল, হোয়াই ডোন্ট উই গো অ্যান্ড ডিসকভার নিউ ল্যাণ্ডস, অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ আওয়ারসেলভস?
ঘুঘুকর্তা বলিল, ওয়েল, দেন লেটস ফ্লাই।
তাহার উড়িয়া চলিল। উড়িতে লাগিল। উড়িতে লাগিল। মেঘের মধ্য দিয়া, আকাশের কিনারা ঘেঁষিয়া উড়িয়া চলিল।
তারপর আসিল আশ্চর্য হইবার পালা।
ঘুঘু দম্পতি একে একে খুঁজিয়া পাইল তাহাদের সন্তানদের। ঘুঘু, কচ্ছপ ও শামুক--সকলেই খুব ভালো রহিয়াছে। তাহারা পিতামাতাকে ফিরিয়া পাইয়া আহ্লাদিত হইল, যারপরন্যায় আপ্যায়ন করিল। সন্তানেরা এখন পিতামাতা হইয়াছে। কিন্তু বাড়িতে নাতি-নাতনিদের দেখিতে পাওয়া গেল না।
ঘুঘুজায়া জিজ্ঞাসা করিল, হোয়্যার আর দে?
তাহারা বলিল, দে হ্যাভ গন টু ফুলফিল দেয়ার ড্রিমস ।


উপদেশ : লেট দেম গো। ডোন্ট হোল্ড এনিওয়ান ব্যাক। দেয়ার মাস্ট বি আ রিইউনিয়ন।
……………………………………………………………………………………………




রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা—পাঠ-প্রতিক্রিয়া : দেবায়ন চৌধুরী


‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি রণজিৎ দাশ লিখেছিলেন- “ যদিও লিখছি দীর্ঘকাল ধরে, কিন্তু বেশি পরিমাণ কবিতা লিখতে পারিনি কখনও। ফলে, এতাবৎ প্রকাশিত আমার পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ঠাঁই পেয়ে গেল এই সংকলনে। এতে সুবিধের হল এই যে, কার্যত শ্রেষ্ঠ কবিতার বিপজ্জনক দাবি রইল না এই সংকলনটির, শুধু ঐতিহ্যবাহী নামকরণের গৌরবটুকু রয়ে গেল। আর, অদৃশ্য বিচারকের মতো, রয়ে গেলেন পাঠক। কবিতার পাঠক—এক শুদ্ধ, নির্জন, অলৌকিক মানুষ। তাঁকে নমস্কার।”— ২০০১ সালের জুলাই মাসে এই কথাগুলি বলার পর পেরিয়েছে অনেকটা সময়। দ্বিতীয় সংস্করণে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু নতুন কবিতা, আর ভূমিকায় উঠে এসেছে মানব চৈতন্যের অভিমুখ ও তাঁর কবিতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের আন্তরিক পরিচয়। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ শুরু হয়েছে যে কবিতাটি দিয়ে, কবির নন্দনতত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে তা বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠতে পারে-
 “ আমাদের লাজুক কবিতা, তুমি ফুটপাতে শুয়ে থাকো কিছুকাল
  তোমার লাজুক পেটে লাথি মেরে হেঁটে যাক বাজারের থলে- হাতে
                                                  বিষণ্ণ মানুষ
  শুদ্ধ প্রণয়ভুক তোমার শরীরে কেউ ছ্যাঁকা দিক বিড়ি জ্বেলে—
                                                   নিতান্ত ঠাট্টায়
  তুমি স্থির শুয়ে থাকো, কষ্ট সয়ে, মানুষের দীর্ঘতম ফুটপাত জুড়ে
  শুধু লক্ষ্য রেখো, অন্ধে না হোঁচট খায়, কোনো ভিক্ষাপাত্র ভুল করে
       তোমার কাছে না চলে আসে
  ধীরে ধীরে রোদ- ঝড়-শীতের কামড়ে তোমার সোনার অঙ্গ কালি হবে
  ওই পোড়ামুখে তবে ফুটবে তামাটে আভা পৃথিবীর, তাই দেখে
  ফুটপাতশিশুরা ভারি ঝলমলে হাততালি দেবে
   তাদেরকে দিও ছন্দজ্ঞান, লজেন্স দিও না। ’’ বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না কবিতা ও কাব্যগ্রন্থের নাম – ‘আমাদের লাজুক কবিতা’। ১৯৬৮- ১৯৭৭ সময়সীমায় লেখা এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। রণজিৎ দাশকে সত্তরের কবি হিসেবেই জানি আমরা। উত্তাল সত্তর দশক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বড়ো বাঁক নিয়ে এসেছে। সত্তরের কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা ছিল, ছিল আপাত নির্লিপ্তি উদাসীনতা, কিন্তু সময়ের ছোঁয়াচ এড়িয়ে যেতে পারেননি কেউ। সময়ের ভেতরের আগুনের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন প্রত্যেকেই, নিজস্ব প্রবণতা অনুযায়ী ‘অ্যাসিড বিক্রিয়া’ ঘটেছিল কবিদের মনে ও মননে। সত্তরের কবিদের মধ্যে স্বভাবত স্বতন্ত্র রণজিৎ দাশের সপ্রতিভ সময়নিরীক্ষণে, মৌলিকতায়, মেধাবী শব্দব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন বিশিষ্ট সমালোচকেরা। কবিকে বুঝতে চেয়ে এবারে তাঁর জীবনের দিকে চোখ রাখা যেতে পারে। ঢাকা বিক্রমপুরে পৈতৃক নিবাস, কবির জন্ম শিলচরে, ১৯৪৯ সালে। কবিতা লেখার প্রথম জীবনে ‘অতন্দ্র’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলকাতা চলে আসেন ৭১ সালে। ৭৬-এ চাকরি জীবন শুরু। ৭৭- এ প্রথম কবিতার বই। কবির একটি সাক্ষাৎকারে সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি-  তিনি গর্ভস্থ হয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে আর ভূমিষ্ঠ হয়েছেন ভারতে। বাংলা সাহিত্যের তিনটি ভুবন জুড়েই তাঁর অস্তিত্ব। সারা জীবন জুড়ে ব্যাপক স্থানান্তর, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির স্পর্শে জারিত হয়ে তিনি কি নিজের মত গড়ে তুলতে চেয়েছেন ‘এক কবির অহং এর উপনিবেশ’? যে রাজ্যে তিনি একক অধীশ্বর। ফিরে আসি আবার ‘লাজুক কবিতা’র প্রসঙ্গেই। রণজিৎ দাশের মত অনুযায়ী কবি ও কবিতা- দুয়েরই লাজুক হওয়া উচিত। তবে ‘লাজুক’ শব্দটি এখানে ‘আইরনিকাল’ কেননা নাম কবিতাতেই স্পষ্ট তিনি কবিতাকে লাজুকতা ছেড়ে সমাজসচেতন হয়ে উঠতে বলেছেন। আর তাই কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে- “ ফুটপাত শিশুরা ভারি ঝলমলে হাততালি দেবে/ তাদেরকে দিও তুমি ছন্দজ্ঞান, লজেন্স দিও না।” এর পরের কবিতাই ‘প্রকৃতির দিকে’, যে কবিতার শেষে কবি বলছেন- “ শুধু মনে হয়, এই অভ্যস্ত ফেস্টুন কাঁধে দিগ্বিদিকে ছোটাছুটি/ ঠিক নয়, ঠিক নয়/ যেন মনে হয়, বোধিপরবাস থেকে একদিন প্রত্যেকেই/ ফিরে যাবে প্রকৃতির দিকে”। ঠিক নয় ঠিক নয় কথাগুলি যেন নিজেকেই বলা হচ্ছে। আত্মগত মনে হওয়া কীভাবে আমাদের সকলের ‘বোধিপরবাস’ নিয়ে ভাবায়। মায়াভবনের পথে দেখা হয়ে যায়...

(২)
বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কবি রণজিৎ দাশ তাঁর কবিতাভাবনাকে খুব সুন্দর ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন- “আমি খুব সচেতনভাবেই বলছি, যে কবিরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, শুধু আমি নই, প্রত্যেকে, সেই আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, প্রত্যেকের কবিতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবার্থসম্পন্ন। সেই ভাবার্থটাই বিষয়। যে কল্পনাটি আসছে সেটি বিষয়, যে চিত্রকল্পটি আসছে সেটি বিষয়।” কবিতায় দুর্বোধ্যতা কিংবা বিষয়হীনতা তাঁর অভিপ্রেত নয়। নিজেকে আধুনিক কবি বলে অভিহিত করতে তিনি নারাজ কেননা তাঁর মতে আধুনিকতা নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। সুধীন্দ্রনাথের বিরূপ বিশ্বে মানুষের একাকী থাকার চেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ – বেশি প্রিয় উচ্চারণ হয়ে ওঠে তাঁর। অসীম রহস্যময় জগতের আনন্দ-বেদনাপ্রবাহকে, মানুষের বেঁচে থাকাকে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে চান তিনি। বামপন্থায় বিশ্বাসী কবি শ্লোগাননির্ভর কবিতা পছন্দ করেন না। সমাজের কাছে কবির দায়বদ্ধতা ভালো কবিতা লেখা। আর ভালো কবিতায় সময়ের ক্ষতচিহ্ন মুদ্রিত হবেই। আলাদাভাবে সময়কে ধরে রাখার আরোপিত চেতনা কবির কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। কবির মতে, কবিতার মূল রহস্য যদি থাকে জীবন রহস্যের উদ্‌ঘাটনের মধ্যে, তবে ‘সময়ের ভাষ্যকার’ কথাটির আলাদা গুরুত্ব থাকে না। কবিতা কাকে বলা হবে এর উত্তরে কবি রণজিৎ দাশ বলেছিলেন কবিতার লাইনে ক্লাসিক গুণাবলীর কথা- “ ক্লাসিক গুণাবলী সংক্ষেপে বলা যায় কাব্যভাষার সৌন্দর্য কল্পনার চমৎকারিত্ব, গভীর হৃদয়বত্তা এবং কবির জীবনদৃষ্টির মৌলিকতা।’’ কথারা অনিবার্যভাবেই প্রস্তাব করছে কবিতা- পড়ার। কবিতার নাম- ‘ইতিহাস’--
ছাতে বসে দেখছি রাত্রির আকাশ। একটানা দুঃসহ বৈশাখ। শুকিয়ে- যাওয়া টবের
ফুলগাছটি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার কোণে, শেয়ালদা স্টেশনের পকেটমার ছেলেটির
মতো। বৃষ্টির প্রতীক্ষা করছে সমস্ত শহর। রাত্রির ঘননীল আকাশপথে অবিশ্রান্ত
গতিতে উড়ে যাচ্ছে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ। যেন অতিকায় ম্যাজিক লন্ঠনের ছবি।
বিরামহীন, গত দু’রাত ধরেই চলেছে এই মেঘের দল। যেন ৪৭ সালের
সীমান্ত- পেরিয়ে- আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুর্দা, ঐ
দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে- পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা।

অনেক রাতে ভেসে গেল সুঠাম, অভিজাত দুটি মেঘ পাশাপাশি- মনে হল নেহরু
আর এডুইনা মাউন্টব্যাটেন।

কবিতাটি আমাদের স্তব্ধ করে দেয় কবি কথিত ক্ল্যাসিক গুণাবলীতে। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কবি তার মধ্যে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করছেন। শুকিয়ে যাওয়া টবের ফুলগাছ আর শেয়ালদা স্টেশনের পকেটমার—দুজনের জন্যই অন্ধকার কোণ। উদ্বাস্তুদের মিছিলের ছবি অব্যর্থ। কবি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই লেখেন কিন্তু সে একটি মাত্র ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়। অমিয়ভূষণ মজুমদার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “ আমার তো মনে হয়, প্রতিভা অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে সেই ক্ষমতাও, যা বহুর অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করে একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে অভিজ্ঞ করে তুলতে পারে।’’ এবং  “ ... যেহেতু কবির অভিজ্ঞতা বর্তমানের এবং অতীতের অন্য অনেকের অভিজ্ঞতার এবং তার নিজের অভিজ্ঞতার যোগফল, তেমনি কবির শব্দচয়নে তার সৃষ্ট ভ্যালুজের মধ্যে অন্য অনেকের অভিজ্ঞতার, ভ্যালুজের পুনর্জন্ম দেখতে পাই। ’’—এই পুনর্জন্ম শব্দটির মধ্য দিয়েই ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে নেহরু আর এডুইনা-র পাশাপাশি অবস্থান হয়ত কারণ হয়ে দাঁড়ায় উদ্বাস্তু মিছিলের। কাব্য মূলত ইতিহাস- কবি এক অর্থে ঐতিহাসিক। ছাতের দূরত্ব থেকে তিনি রাতের আকাশ যেভাবে দেখেন, ১৯৮৭- ১৯৯২ সময়পর্বে লেখা ‘বন্দরে কথ্যভাষা’ কবিতা-বইয়ের ‘ইতিহাস’ কবিতাটি সেভাবেই হয়তো সময়ের দূরত্বে লেখা হয়। যে দূরত্ব হয়ে ওঠে অমোঘ,গভীর। আমরা জানি কবি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মেঘের সূত্রে ইতিহাস- দর্শন আমাদের নিয়ে যেতে পারে কবির ‘ইশ্বরের চোখ’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার শেষ অংশে- “ সবকিছুর মীমাংসা রণরক্তে, আমি ভাবি। ভাবি সেই কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের কথা, যাঁরা মনে করতেন, ‘ গভীরতর বাস্তবতা’ বলে কিছু নেই...’’ পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে এক নতুন জলের কল্পনা করেছিলেন জীবনানন্দ, সমস্ত দীপ ছেড়ে এক নতুন প্রদীপ, নতুন এক ব্যবহারের কল্পনাও ; জীবনের সঙ্গে যার ‘গোপনীয় সুড়ঙ্গলালিত’ সম্বন্ধ। সুড়ঙ্গের কথা ভাবলেই অন্তর্ঘাত শব্দটি হানা দেয় মনে। সময় ও পৃথিবীর অভিজ্ঞতায় কবি যে বাস্তবকে নির্মাণ করেন, তার অনুষঙ্গে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে দেবর্ষি সারগীর ‘ভ্রমণসঙ্গী ঈশ্বর’ উপন্যাসের দুটি বাক্য- “ শব্দ শুধু বাস্তবতা বহন করে না, বহন করে প্রজ্ঞাও, যা নিছক বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে আমরা নাও লাভ করতে পারি। বাস্তবতা যা আমাদের শেখাতে ব্যর্থ হয়, শব্দ তা শেখায়।” এবারে পড়ে নেব আরেকটি কবিতা।

বংশী সামন্ত
সেদিন আর নেই যখন নকশালদের ভয়ে ডাক্তারেরা নামমাত্র ফিজ দিয়ে রোগী
দেখত। রিক্সাচালক বংশী সামন্ত সেই ভাগ্যবান রোগীদের একজন। কঠিন অসুখ
হয়েছিল তার, হৃদপিন্ডের, স্রেফ অচিকিৎসায় মারা যেত, যদি না নকশাল
ছেলে তাকে এক বিলেতফেরত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। মাত্র পাঁচ টাকা
এবং অদৃশ্য পাইপগানের বিনিময়ে। পরে পুলিশের গুলিতে সেই ছেলেটি মারা
গেছে। কিন্তু সুস্থদেহে বেঁচে আছে বংশী। বেঁচে আছেন সেই ডাক্তারটি-ও, তাঁর
ফিজ এখন দুশো টাকা, বংশী শুনেছে। ক্বচিৎ- কখনো গাড়িতে ওঠার মুখে বংশীর
সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তিনি এখনো হেসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভালো আছো তো?’
বংশী কৃতার্থ হয়ে যায়। তার মনে হয় যেন সেই ছেলেটির স্মৃতি এখনো ডাক্তারকে
সম্পূর্ণ ছেড়ে যায়নি, না হলে ওর মতো নগণ্য লোককে তিনি এতদিন মনে
রাখবেন কেন। রাজনীতি বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বংশী, এখনো, প্রায়ই সেই ছেলেটির
কথা চিন্তা করে।

সত্তরের দশক মুক্তির দশক। বংশী সামন্ত নামটি বেশ ভাবায়। নকশাল ছেলেটি আজ নেই কিন্তু রোগী আর ডাক্তার তাকে মনে রেখেছে। কবিতাটিকে নকশাল আন্দোলনের মূল্যায়ন হিসেবে পড়া যেতে পারে কি? গল্পের গঠনের মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে। রাজনীতি বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বংশীর সেই ছেলেটির কথা চিন্তা করাকে কীভাবে দেখতে পারি আমরা? স্মৃতি এখানে সত্তার কথা বলে। চিন্তা অস্তিত্ববাচক। বিশেষ থেকে নির্বিশেষে পৌঁছুনোর প্রবণতা বারবার ধরা পড়ে কবির কবিতায়। তিনি ভালো- মন্দের মধ্যে দোলাচলতা দেখাতে চান। তাঁর কবিতার দর্শনে থাকে উত্তরণের কথা। সে উত্তরণ অবশ্যই মানবিক। ভাষার সংযোগের সঙ্গে নীরবতা মিশে নতুন এক ভাষা তৈরি করে। যার মধ্য দিয়ে হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে কবিতার বোঝাপড়া।


(৩) 


     বাবাকে
   
     ভাতকাপড়ের দুশ্চিন্তা করেই
     সমস্ত জীবন কাটলো আপনার।

     কোনো শিল্প, কোনো সম্ভোগ, কোনো উদাসীনতা
     আপনাকে স্পর্শ করলো না।

     আপনার কথা লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।
     আপনি আমার লেখার জগৎ থেকে একটু দূরে রয়েছেন,
     যেমন শহর থেকে একটু দূরে থাকে পাওয়ার স্টেশন।

‘মাত্রাচেতনা’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন- “ শ্রেষ্ঠ কবিতা- অন্য যে কোনো শ্রেষ্ঠ শিল্পের মতো কবিমানসের আপন অভিজ্ঞতাকে যতদূর সম্ভব অক্ষুণ্ণ রেখে-নিঃস্বার্থ জিনিস।” - কথাটি এই কবিতা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সম্ভ্রমজনিত দূরত্বের আঁচ আমরা পেয়েছি ছেলের বাবাকে আপনি সম্বোধনের মধ্যেই। ভাতকাপড়ের দুশ্চিন্তার জীবনে যে শিল্প, সম্ভোগ, উদাসীনতা স্পর্শ করতে পারল না, এর দায় বাবার একার নয়। ছেলের লেখার জগৎ থেকে বাবা দূরে থাকেন অনুপ্রেরণা হয়ে। পাওয়ার স্টেশন আলোর কথা বলে। আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে বাবা যে আলো তুলে দিয়েছেন ছেলেকে। এই কবিতাটি পড়লে অদ্ভুত কষ্ট হয়। মনে হয় এ কথা আমার, আমাদের। মনে হয় বাবাদের কথা সেভাবে লেখা হল না বাংলা কবিতায়।  গরম ভাতের গন্ধে কত কিছু যে মিশে থাকে, সে কথা ভাবতে ভাবতে চোখ চলে যায় পরের পাতায়। পড়ে ফেলি ‘কলকাতা’ কবিতাটি—

এ শহরে মাটি বিক্রি হয়।

বেতের ঝুড়িতে করে চাপ চাপ অন্ধকার মাটি
ক্লান্ত মাথায় নিয়ে ফেরি করে উদোম বালক

চোখে পড়ামাত্র, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।

‘ইতিহাসচেতনা’ আর ‘কালজ্ঞান’কে সম্যকভাবে আত্মস্থ করেছেন বলেই এমন দৃশ্যকে কবি তুলে আনতে পারেন শব্দে। রণজিৎ দাশের কবিতার মিতায়তন তাঁর মনের বিশেষ প্রবণতাকে চিনিয়ে দিতে পারে। ‘পাঠকই কবিতা’ শীর্ষক লেখায় জয় গোস্বামী এই কবিতা সম্বন্ধে বলেছিলেন- “ সত্যি সত্যি এটি একটি শ্বাসরোধী কবিতা। অত্যন্ত স্বল্প কয়েকটি শব্দ এবং স্পেস ব্যবহারের নীরবতা এক দমচাপা ভাব ধরে রেখেছে। এবং মাটির আগে ব্যবহৃত হয়েছে চাপ চাপ অন্ধকার শব্দ দুটি। যদিও প্রথম লাইনটিতে, আপাতনিরীহ প্রথম লাইনটিতে মাটির আগে কোনো বিশেষণ নেই। একটা সামান্য স্টেটমেন্ট যেন। প্রায় কবিতার লাইনই নয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে পঙ্‌ক্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে কবির স্তব্ধ হতভম্ভ ভাব, তাঁর মর্মাহত বিস্ময় ধরা পড়ে। অর্থাৎ-- এমনকি, এই শহরে মাটি পর্যন্ত বিক্রি হয়।” এই কবিতাটি পড়তে পড়তে সত্তর দশকের অন্যতম কবি নির্মল হালদারের ‘অনাথপিন্ডদ’ কবিতার কথা মনে পড়ে- “মাটি বিক্রি করতে গেলে মনে হয়/ মাকে বিক্রি করছি/ মায়ের চোখ নেই মুখ নেই হাত পা নেই/ মা কেবল বুক পেতে দিয়েছে/ এক ঝুড়ি মাটির দাম আট আনা।” মাটির কথা এল, এল মায়ের কথাও। ‘শ্মশানছবি’ কবিতার শেষ পঙক্তিদুটি মনে হলেই সমস্ত দেহমনে শিহরণ ওঠে- “ ... সৌরশ্মশানের বুকে শীলমোহরের মতো জেগে থাকে সেই দৃশ্য:
                             মায়ের মুখাগ্নি করে সন্তানের অকৃতজ্ঞ হাত!”
শব্দের পবিত্র শিখা ছুঁয়ে থাকে আমাদের। পুড়ে যায় নিঃস্বতার আত্মঅহংকার।


(৪)

আমাদের শহরে
প্রত্যেক ধর্মের মানুষদের জন্য
ভিন্ন ভিন্ন দেবালয়;
কিন্তু সকল ধর্মের মানুষদের জন্য
একটিই বেশ্যালয়—

কোনো সমস্যা নেই। (আমাদের শহরে)  
কবি আমাদের চেনা পৃথিবীকেই হাজির করেন এমন গভীর তাৎপর্যে, চমক লাগে যেন। প্রত্যেক মানুষের ধর্মাচরণের জন্য আলাদা স্থান, কিন্তু যৌনতার পীঠস্থান একটি— ‘কোনো সমস্যা নেই’ শব্দবন্ধ ধর্ম নিয়ে মানুষের পারস্পরিক হানাহানির দিকেই দৃষ্টি আরোপ করে। আবার ‘খাটাল’ কবিতায় আমরা দেখি, একটি খড়ে ঠাসা মৃত বাছুরের মাথা মোষের সামনে এগিয়ে দিয়ে কীভাবে ‘অনর্গল ফেনা-ভর্তি দুধে ভরে ওঠে শহরের বালতি’। মা জানে না সন্তান মৃত, অপ্রাকৃত স্নেহের নিঃসরণ হয়েই চলে। শহরের খন্ড খন্ড অংশগুলো যেভাবে সিনেমাপোস্টারে সেঁটে থাকে, তাকে জড়ো করে গুছিয়ে রাখতে থাকেন স্রষ্টা। ‘সোডিয়াম আলোয় বি.টি রোড ঘোড়ার লিঙ্গের মতো লাল’, ‘তামাম চৌরঙ্গী তখন নিয়ন আলোর বাবলগাম’—অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে ওঠে লেখায়। ওনিডা টিভির শয়তানের কথা যখন বলেন ‘ টেলি- খুশি’ কবিতায়, ‘ সুপার মার্কেটের কবিতা’–য় লেখেন—“নতুন মানুষ এক বেরিয়েছে নতুন মার্কেটে/ ড্রেস্‌ড্‌ চিকেন- এর মতো/ নিজেকে বিক্রয় করে—স্বপ্ন ও কবিতার ডানাদুটি ছেঁটে” তখন বিশ্বায়িত সময়ের নিখুঁত আয়না হিসেবে কবিতাগুলিকে পড়তে অসুবিধা হয় না। আধুনিকতার নীরব সন্ত্রাসকেও প্রত্যক্ষ করতে পারি তাঁর কবিতায়। যৌনতার নতুন ভাষ্য তৈরি হতে থাকে মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। ‘মানুষের জীবন হচ্ছে ঈশ্বরের অসুখ’ লিখেছিলেন কবি ‘মিশেল ফুকো’ কবিতায়। ‘ঈশ্বরের চোখ’ কাব্যগ্রন্থে ‘সুড়ঙ্গ’ কবিতায় জানিয়েছিলেন- “প্রকৃত নিজের কাছে যাওয়া এক অকল্পনীয় অন্তর্ঘাত”। এক সন্ধ্যার পাগল বসে থাকে ফুটপাতে, গির্জার মাঠের গোলপোস্টে ঢুকে যায় চাঁদ, ‘নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের কথা’ কবিতাটি মনে পড়ে। মাছ ও জলের সংসারে তিনি এত একা কেন, এর উত্তরে যা বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে--
“এখানে আমার কোনো নিকট- আত্মীয় নেই, শুধু
 এক দূরসম্পর্কের ঈশ্বর আছেন।”



(৫)

প্রেমের কবিতার আলোচনা ছাড়া ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। ‘একটি প্রেমের কবিতা’র পর কীভাবে গ্রন্থিত হয় ‘প্রত্যাখ্যান’- এর পংক্তিমালা – “ সকল বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে/ জেনেছি যে, প্রত্যাখ্যান অনিবার্য।” প্রত্যাখ্যানের অতীত এক সম্পর্ক রচনাই কবির কাম্য হয়ে ওঠে। ‘দৃষ্টিবিনিময় একটি সম্পূর্ণ বিবাহ’ কথাটি ভাবতে থাকি। সমস্ত জীবন জুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুটে থাকার স্বপ্নে বিভোর মন, আপনজনকে দেওয়া ‘প্রথম লিরিক’--
“ আজ আবিষ্কার করি—
 পথের ধুলো ও ঘাস, ছায়া, প্রেম, কৃষ্ণচূড়া—এত বাস্তবিক।

দ্রুত হাতে লিখে রাখি কালো মেয়েটির জন্য প্রথম লিরিক।” স্মরণযোগ্যতা যদি কবিতার অন্যতম মাপকাঠি হয়, তবে এই লাইনগুলি আলাদা মাত্রা রাখতে পারে। ‘বন্দরে কথ্যভাষা’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির সূত্রে পড়া যেতে পারে ‘সমুদ্র সংলাপ’ বইয়ের ‘একটি জেন- কবিতা’কে। কবিতার বিষয় আর প্রকরণ মিলে প্রেমের দর্শনকে যেভাবে তুলে ধরেছে, তার তুলনা নেই—
  তুমি আমার বাড়িতে এলে।
  টেবিলে-রাখা আমার কবিতার বইটা
  ছুঁয়েও দেখলে না।
  
  গল্প করলে জঙ্গলের এবং জিপগাড়ির।
  আমি একটা সুদৃশ্য জাপানি পেয়ালায়
  তোমাকে চা দিলাম।

  তুমি বললে, ‘বাঃ পেয়ালাটা কী সুন্দর!’
  সেই পেয়ালায় চা খেয়ে তুমি
  উঠে চলে গেলে।

  আমার সব ক’টি কবিতা তুমি
  পড়ে চলে গেলে।

সৎ কবিতার স্পর্শে এসে আমাদের নিহিত অভিজ্ঞতার পুনরুত্থান ঘটে বলে জীবনানন্দের মনে হয়েছিল। সার্থক শিল্প আমাদের নিজের কাছে ফিরতে শেখায়। স্মৃতির বসত জুড়ে কত মুখের আদল ভেসে ওঠে। মানুষ যেভাবে বাঁচে, যেভাবে বাঁচতে চায় কিংবা বাঁচতে পারে—এই সবটুকু মিলে মানবিক অস্তিত্বকেই চিনতে শিখি আমরা। শ্রেষ্ঠ কবিতা সব অসঙ্গতির জট কাটিয়ে নিয়ে যায় অসীম আনন্দের দিকে।
বুঝি বৃষ্টি নেমে আসে। ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। টাটকা মেঘের জলে ভাসতে থাকে আমাদের মনকেমনের নৌকোরা… শুদ্ধ, নির্জন, অলৌকিক হয়ে উঠতে থাকে পাঠক কিংবা রণজিৎ দাশের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’।.

.......................................................………
রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা
দে’জ পাবলিশিং
কলকাতা
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০২
প্রচ্ছদশিল্পী- মিলন বন্দ্যোপাধ্যায়


জয়দীপ রাউতের চারটি কবিতা


নিশি

দিনগুলি রক্তে ভেসে যায়।

যন্ত্রণায়
দীর্ঘ রাত্রি একা জাগি

আর এক ভীষণ রাক্ষসী মাগি
আঙুল কামড়ে দাঁতে

অঘোরে ঘুমায়


বৈশাখী

এই তো একটু আগে ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে
এখনো কাঁপছে রুগ্ন মাধবীলতা

আমিও সাহায্য নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি আজ
যেই হাতে ব্যথা আর সহনশীলতা


নৈবেদ্য

তাঁকে দেব ব'লে
সাজিয়ে রেখেছি এই
মাংসের ছিন্নভিন্ন
রক্ত পুঁজ ঘাম

আসলে আরোগ্য এক
অতি ধীর

দেবতার ডাকনাম


নখ

চিৎকার কখনো করিনি
আমি শুধু বুঝে নিতে
চেয়েছি আমার
যন্ত্রণার
প্রকৃত স্বরূপ

সে সময় এক অপরূপ
চাঁদ উঠেছিল আকাশের কোণে

এসব দেখেছি আমি আঘাত লাগার পর—
খসে যাওয়া নখদর্পণে



শোভন ভট্টাচার্যের দুইটি কবিতা


আণবিক পৃথিবীর অতিবাস্তবতা

পৃথিবীতে আছে যত মানুষ, মনুষ্যেতর, একেকটা পৃথিবী;
পৃথিবীতে আছে যত উদ্ভিদ, পতঙ্গ, পশু, একেকটা পৃথিবী;

সকলেই ঘোরে তার অদৃষ্টপ্রবণ মায়াময় কক্ষপথে;
কোনো পৃথিবীর সাথে কোনো কোনো পৃথিবীর নাক্ষত্রিক যোগ দেখা যায়।

অরণ্য-পৃথিবী টানে কোনো কোনো বিবাগীহৃদয় পৃথিবীকে;
বাজার-পৃথিবী তানে কৌশলী কর্মঠ কর্তাভজা কৃতীটিকে…

কোনো কোনো দুঃখে যার প্রাণ কাঁদে, সে আবার কোনো দুঃখ পাশকাটিয়ে যায়;
কোনো কোনো সুখে যার হর্ষ হয়, সে আবার কোনো সুখ দেখেও দ্যাখে না।

বস্তুর আদিতে পাক খায় যত লক্ষকোটি অণু-পরমাণু
সেরকমই পাশাপাশি, ঘেঁষাঘেঁষি পাক খায় বিন্দুবিন্দু অজস্র জীবন।

একেকটা পৃথিবী তার নিয়তি নক্ষত্রালোকে নিজস্ব গোকুল খুঁজে পায়;
একেকটা পৃথিবী ঘোরে বহু পৃথিবীর পাশে, বড়জোর হয় মুখচেনা।

একেকটা পৃথিবী মানে প্রাণ কিংবা পাষাণের একেকটি একক;
বাঁচে-মরে ব্যক্তিগত প্রারব্ধ বা কর্মফলে, ভোগ আর ভোগান্তিলেখায়। 


মায়া প্রপঞ্চ

যতই তুমি করো না-শোনার ভান
যতই তুমি ঘুরিয়ে নাও চোখ
আমি কিন্তু বুঝেছি সম্যক
মর্মভেদী বাজে একটা গান

গহীন গান, ধারালো এক ছোরা
নিঝুম গান, রাতের ঝুমঝুমি
যতই অন্যমনস্ক হও তুমি
ঢেউ দিয়ে যায় নিহিত তান-তোড়া

যতই অন্য কারুর গান গাও
যতই মুখে বলো অন্যের কথা
মনের কথার হয় না অন্যথা
শুনতে তুমি চাও বা না-ই চাও

একটা সুর ধনুক-টানা মিড়
একটা প্রেম এমনই পরপুরুষ
কুল-মান যায়, ফেরে না তাও হুঁশ
এমনই মায়া প্রপঞ্চ প্রকৃতির 


অশোকপ্রস্তাব


.................... 
ব্যথিত করোনি বলে আমি ওই ব্যথার 
পাশে পাশে নিজেকে দেখলাম 
নিজেকে দেখলাম দূর জ্যোতিষ্কের মৃত্যুশয্যার ধোঁয়ায় গর্জনে 
পড়ে যাওয়া উপকারী কেননা আরও কিছু অভিজ্ঞ হলে 
দশদিকে ঘর, প্রতিটি বাড়িই তো কবরের রূপ ধরে আছে 
গোলাপজলের ছিটা প্রতিটি চাদরে 
এই যে খুশবু-পরিবার, এই যে যথারীতি ফুলের প্রয়োগ 
তুমি একটু শিল্পী হলে আর 
আমি হই পণ্যবিজেতা 
ভয় পাওয়া অনৈতিক নয় কেননা স্নায়ুর সুস্থতা 
এক্ষেত্রে প্রমাণিত হল 
প্রমাণপত্র ভিন্ন ভালবাসা হয়েছে আংশিক 
বিকশিত হও আর উচ্চ থেকে মহল্লাকে দেখো 
বৃহৎ কাফন ছাড়া মতাদর্শ কিছু দেখা যাবে 
দেখা যাবে বহু বহু বাস, যার ছাদে শুয়ে আছে 
সেইসব ডুবোজাহাজেরা যারা ডুবেছিল ভেসে উঠবে ব'লে 
তারপর ডুবে গিয়েছিল 
খুশি যেহেতু ব্যাখ্যাকার নয়, নিজে তার যাত্রী আছিলাম 

জিয়া হক 

সৌভিক বসু'র তিনটি কবিতা


ভোজ
......... 
পূর্বপুরুষের প্রতি ক্ষোভ জাগে আমার ভিতর 
জ্ঞানহীন মুন্ডুগুলি চেপে ধরি আগুনের গায়ে 
শব্দ করে খুলি ফাটে মধ্যরাতে ডাকিনী প্রহর 
বুকের পাঁজরে ঢেলে ভোজ রাখি ছাদের কোনায়


চলন
........ 
জিন্সের পকেটে হাত, বাড়ি ফিরি আড্ডা মেরে একা 
রাস্তা থেকে গলিপথ ক্রমশ জটিল বাড়িঘর 
ছেড়ে ছেড়ে যায় পার্ক, পুরনো পুকুর

এভাবে একার মানে পাহাড়ে বরফ পড়া বলে!
দু'একটা লোক ধীরে চলে গেলো সাইকেলে চেপে...

কলোনি পাড়ার ঘরে গান বাজে  টিভির ভেতরে 
দরজায় দরজায় তালা আর দোকানে শাটার 
চায়ের দোকান শুধু খোলা থাকে রাতে 
কুকুরকে দূর থেকে বিস্কুটের লোভ কাছে টানে 

এইসব দেখি আমি 
আড্ডা মেরে ফেরার সময় 
ভুলে যাই কটুকথা, ভুল বাক্য, চোরের চালাকি 

জিন্সের পকেটে হাত,  উদাসীন গলিপথে একা
নিজ মনে শিস দিতে থাকি...


বইমেলা 
............ 
হাওয়ায় এলোমেলো মেয়েটি এসেছিল 
পেরিয়ে যানজট বইমেলায় 
সোনালী গোল মুখ চেনে না কাউকেই 
আমাকে বলেছিল- আসবে তো? 

আকাশে ঘন মেঘ দুচোখে সংশয় 
বা-কাঁধে ছিল ব্যাগ, অনেক ভার 
আমিও ভীড় ঠেলে ধরেছি হাতদুটো 
বলেছি সবটুকু আমাকে দাও 

দুজনে পা ফেলে দেখেছি বই ঘেটে 
কিভাবে কবিতায় সন্ধ্যা হয় 
পাখিরা মুখে করে নিয়েছে খড়কুটো 
হয়ত সেও কিছু বলতে চায় 

অচেনা লোকজন দেখেও দেখছিনা 
গিটারে মন নেই একটুও 
জ্যোৎস্না ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘের ঘরবাড়ি 
আমরা চলেছিলাম সেইদিকে

জানিনা আর কবে, হয়ত দেখা হবে 
পলাশে ঢাকা মাঠ বসন্তের 
মেয়েটি ফিরে যায় বৃষ্টি ভেজা পথ
দেখেছি দূর থেকে একটানা


সৌভিক বসু'র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
১. অলীক ভ্রমণ চিঠি / সোঁতা
২. দুমুঠো গল্পের মতো / জানলা





New Faith : Zia Haque


আমি কি এখন কিছুই পড়তে পারব না? পড়তে গেলেই মাথা ধরে যাবে? শব্দের ভেতরে প্রবেশাধিকার কি আমার হারালো? তাহলে কেন অক্ষরকে কিছু জ্যামিতিক আঁক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না? তবে কি অসীমের সঙ্গে সামান্য যে-সূত্রে জুড়ে ছিলাম সেই সূত্রটুকু ছিঁড়ে গেল? নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা টের পাই এই প্রকাণ্ড রাত্রির এক প্রান্তে শুয়ে। কেউ যেন গায়ের কাঁথাটি সরিয়ে নিয়ে গেছে। নিজের ঘুমন্ত মুখ কখনও দেখিনি। গায়ের হারিয়ে যাওয়া কাঁথায় কোন রঙের সুতোয় কী নকশা ছিল, ভুলে গেছি। স্বপ্নে আলাদিন এসে বলেছিল, 'আমার জ্বিনটি তুমি ধার নেবে?' আমি প্রত্যাখ্যান করেছি, 'আমার তো সুপরিচিত সমুদ্র নেই, কোথায় পাড়ি দেব? তাছাড়া, জ্বিনও তো এক মখলুক, ওকে ওভাবে আটকে রেখো না, মুক্ত করে দাও, দেখো তুমিও মুক্তি পাবে কোনও এক কালে।' মর্জিনাকে বলেছি, মর্জিনা! তুমিও কি সুখী নও আবদুল্লার যা আছে? চোরের মোহর তুমি চুরি করে সুখ পাও? শাকান্ন তোমার দেশে এতই দুর্লভ? স্বপ্নে আমি দু'খানা দেশ আবিষ্কার করেছি। দুই দেশ শস্যে শস্যে ভরা। সকলেই কৃষিকাজ করে, সকলেই বস্ত্র বুনে তোলে, ধর্মগৃহ নেই তাই তাদের সকল গানে তাদেরই উল্লেখ। আমি তো রাতের এপার থেকে গেছি বিশিষ্ট অন্ধকার ঠেলে, প্রশ্ন করি, 'তোমাদের দেবদেবীরা কোথায়?' তারা বলে, 'এই দেশে মৃত্যুভয় নেই, ভয়েরও প্রয়াণ ঘটেছে, আমাদের উপাস্য এত দূরে আছে, ভুলে গেছি। এত কাছে আছে, ভুলে গেছি।'

জিয়া হক 

On Society : Zia Haque



ওখানে কচুগাছ ছিল তখন। ওখানে মুক্তা পাওয়া যেত।
আমি তো পেয়েছি।
তুমি পাবে না কেন? তুমি তো পাপ করোনি।
আমার যেমন কোনও পাপ নেই, তবে পাপবোধ আছে।
আমি এখন আর লিখতে পারছি না। এর কারণ, আমি চিন্তা করতে পারছি না। অতীত একটা ক্রমে সাজানো থাকে স্মৃতিতে। সেই জন্য আমরা বলতে পারি কোন ঘটনার পরে কোন ঘটনা ঘটেছে। সেই স্মৃতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লে তা থেকে ঘটনা উদ্ধার করা শক্ত। যেভাবে আমি আপাতত উদ্ধার করতে পারছি না। হয়ত পরে পারব। নিশ্চিত নই, নিশ্চিন্ত নই। কেন চিন্তা করতে পারছি না, এই নিয়েই এখন আমার দুশ্চিন্তা। আমার সমস্যা আমি কাউকে বলতে পারি না পাছে লোকে আমাকে অস্বাভাবিক ভাবে। এই সমাজকে ছোটবেলা থেকেই ভয় পাই, তারপরও যেখানে যাই সেখানে গিয়ে দেখি সেখানেও একটা সমাজ আছে। আমি সমাজকে ত্যাগ করলেও সমাজ আমাকে ত্যাগ করে না। এর মানে এই নয় যে সমাজ কত উদার, কত মহান, কত গ্রহিষ্ণু। এর মানে হল সমাজ এমন একটা পেট যার সব সময় খাদ্য দরকার। আমি সমাজকে পরিপাক করতে পারি না, সমাজই আমাকে পরিপাক করে ছিবড়ে করে ফেলে। এবার ভাবতে বসি, সমাজ আমাকে কী কী দিয়েছে? আমি সমাজকে কী কী দিয়েছি? ভেবে দেখেছি, সমাজ আমাকে অস্বীকৃতি দিয়েছে এবং আমিও সমাজকে অস্বীকৃতি দিয়েছি। সে আমাকে ঘেন্না করেছে, আমি তাকে ঘেন্না করেছি। এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে সমাজ মানে কয়েকজন মানুষ নয়। তবে এই বড় সমাজের মধ্যে আমি কয়েকজনকে নিয়ে একটা ছোট সমাজ বানিয়ে নিতে চেয়েছি। কিন্তু এই ছোট সমাজটাও সময় বিশেষে বড় সমাজের মতো আচরণ করে আর তখনই তাকে ভয় পেয়ে পরিত্যাগ করে বসি। সমাজ একটা বাজার ছাড়া আর কিছু নয়। প্রয়োজন হলে যাও তার কাছে, তারপর ফিরে এসো। আর বাজারের ধর্ম অনুযায়ী সমাজও যে তোমাকে ঠকাবে, সেই বিষয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার। মানুষ সামাজিক জন্তু —এই কথাটা একটু বাড়াবাড়ি। মানুষের সঙ্গ দরকার, সঙ্গী দরকার, তার মানে এই নয় যে তার সমাজ দরকার। এই সমাজের ধর্মই হল নিজেকে ক্রমাগত বাড়াতে বাড়াতে এগিয়ে চলা, সব কিছু গ্রাস করা আর এইভাবে একদিন প্রসব বেদনা ওঠে সমাজের এবং জন্ম হয় রাষ্ট্রের। আমাদের আরও সংগঠিতভাবে পরিপাক করার জন্য। তোমাকে ছিবড়ে করে ফেলবার জন্য।  আমার ছিবড়ে হয়ে যেতে আপত্তি আছে। কেননা আমি জানি, আমি ওই কচুপাতার মতো যে নোংরা জলকেও আলোকবিন্দু করে মাটিতে ঝরিয়ে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

Delhi 2020 : Zia Haque


একটা 'উত্তম' বাক্যের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে চাই 'আকাশের' গঠনশৈলী । বকযন্ত্রে নিজেকে দেখেছি,— তাই / এরকম বসন্তের রাতে / হারাব পৃথিবী যেন শব্দের সংঘাতে /

তারপর চিঠি দেব তাকে / বলে দেব, মনের নাপাকে / ধরা মানা এই পত্রখানি / মানুষের প্রত্যাদেশ মানুষেরই মতো / ধুলোছাই যাই হোক, হবে না সম্মত /

জানি, তবু কিছু অনুরোধে / রোদ আসে, বৃষ্টি হয় বোধে / নিভে যায় পশুদের দিন / কলাবতী! কলাবতী!
এসেছে শ্রীহীন /
যায়,—যাবে পত্রবাহকেরা / যে-টেবিল দূরবর্তী / সুনির্মিত অন্ধকারে ঘেরা / চলে যাবে একটি পায়া যেন / কেন আর তাকে নানা শহরে ফেরানো?

চারিদিকে জীবনের ছায়া / রসিকতা করে, তবু একখানা পায়া / ক্ষয়ে গেছে দিনে / অাঙুল না দিতে পারো, চাকাটুকু দাও গতিহীনে /

চিঠিতে কী ছিল বলা ঠিক? / শান্ত হও ভিক্ষাপাত্র —আমি খালি বহন শ্রমিক

জিয়া হক 

Of books and of water


I got you and forgot you. You will get me and forget me. In between getting and forgetting, there is a morbid number which both of us wrote on a piece of stone and threw into the pocket of narcissism. We were ready to leave everything for love but instead of everything we left the very idea of love. We smiled but no one felt the warmth of that smile. Whenever we laughed, at the end we laughed at each other. You took me as a sailor who had no ships and I took you as a reader who spent her life sleeping in a library. We were happy with ourselves as both of us were liar and we knew it. One day, I truly had a chance to be the captain of a ship and you woke up in the library and started reading. That day, we parted. And love took shelter in books and water.

The Master


What a thought so futile! Cacophonic bats hover all around my house, around my room. They perhaps want a delightful conversation with me. Though I know none of them, not a single face. What I can remember is only you. You, the master. You taught me things unknown, took me to a Xanadu, asked me to stay there. But my poor soul didn't listen to you. I somehow heard a whisper of an unfamiliar bat telling me to plunge into a valley of mist and dead flowers on death-beds. I should rather have been deaf to a voice that causes melancholy. Having gazed at the sky where I used to see your tender light, found nothing but a giant horse pulling a cart filled with dead bats. I cried for you, I cried for the bats as they had all the right to live a life of their own though venomous. I tried to compose an elegy in memoriam of those dead creatures who died for no reason, but felt empty inside. In search of words, I now have been an infiltrator to the dictionary. My beloved master! Pardon me. Between you and me, between us, now there lies a dictionary full of unknown signs. 

যানবাহনের গল্প


প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখলাম অদূরে ছড়ানো আলো। তিরিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি। এমনই হয়। আমি জানি, দরকারী ট্রেন প্রেমিকার মতো হয়। এই কথা বলা উচিত হল না। আমি যেন পুরুষের পক্ষ থেকে কিছু ঘোষণা করলাম। ছেলেরা কি অপেক্ষা করায় না কার্যক্ষেত্রে? আমি একজন মেয়েকে জানি যার প্রেমিক সব সময় দেরি করে আসত আর মেলা গল্প শুনিয়ে মেয়েটিকে শান্ত করার চেষ্টা করত। এক বছর চার মাস পরে খবর পেয়েছিলাম, নিয়মানুবর্তীতার গ্রাউন্ডে ছেলেটিকে রিজেক্ট করে মেয়েটি এক আইটি কর্মীকে বিয়ে করে দিল্লিবাসী হয়েছে। আর ছেলেটি? সে এখন নামকরা গল্পলেখক।

ট্রেন দেরি করলেই আমার তাদের কথা মনে পড়ে। এই মনে পড়ার কারণ কী? আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে কেন জানি না ছেলেটিকে আমি সমর্থন করি। তার প্রতি সহানুভূতিও আমার যথেষ্ট। আমাকে ভুল বুঝবেন না। অপেক্ষা করানো একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই পাপ মানুষকে নরকগামী করে। সব সত্যি কথা, তারপরও বলি, ছেলেটির কোনো চালাকি ছিল না, কোনো লুকনো পরিকল্পনাও ছিল না। সাধারণত যা হয়। তারা আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারত, এটুকুই বলতে পারি।

ট্রেন একেবারে ফাঁকা। যেন একটা বইয়ের আলমারি যেখানে কোনো বই নেই। লোকাল ট্রেন এত খালি কখনো হয় না, যাত্রী মাত্রই জানে। কিন্তু আমি এই ট্রেনে উঠব না। এমনটা মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তার প্রতি আগ্রহটাই মাটি হয়ে যায়। এই কারণে আমার তবলা শেখা হয়নি। এক বছর ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন আমাকে তবলা কিনে দেওয়া হল, ততদিনে আমার আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে। পড়ে রইল। তবে অনেক পরে বুঝেছিলাম, আমার যখন আগ্রহ ছিল তখন বাবার সামর্থ্য ছিল না। আমরা সব কিছুই বড় দেরিতে বুঝি। এর একটা ইতিবাচক দিক আছে —সব বুঝে গেলে জীবন আর জীবন থাকে না, আমরা বিস্মিত হতে ভুলে যাব, কল্পনায় আর কোথাও যেতে চাইব না। এ বড় আত্মঘাতী ব্যাপার।

ট্রেন চলে গেল। রাত এখন দশটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনই এক রাত দশটায় আমাকে সদরপাড়ার গোরস্থানে নিয়ে যাবে বলেছিল মতিকাকু। গোরস্থানে কী এমন দেখবার আছে? শয়ে শয়ে মৃত লোক, জীবদ্দশায় কেউ ছিল কবি, কেউ কাপুরুষ, কেউ মৌলানা, কেউ পরশ্রীকাতর, কেউ দালাল, কেউ সঙ, শুয়ে আছে, মাটির উঁচু উঁচু ঢিবি তাদের উপরে, লতানে গাছের শিকলে বাঁধা স্তব্ধতা চারদিকে। কী আর দেখবার আছে এখানে? সত্যি, সমাধিক্ষেত্রে দেখবার মতো কিছু নেই, তবে এখানে কখনোসখনো নিজের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।

আমি তখন ছোট। এই এতটুকু। এ সব বুঝি না। এখনও যে বুঝি তা নয়, তবে ছোটবেলার মন আকাশপাতাল ভাবলেও সেই আকাশ ও পাতালের ছোট এক কোণায় সে আশ্রয় নেয় এবং তাকেই সম্পূর্ণ জ্ঞান করে। মতিকাকু কখনো গোরস্থানে নিয়ে যায়নি। রাত দশটার আগেই সে কোথায় পালিয়ে যেত। কয়েক মাস ঘোরানোর পর একদিন মতিকাকু বলল যে সে গোরস্থানে যেতে ভয় পায়। আমি বললাম, কেন?
মতিকাকু বলল, আমি পাপী মানুষ, মৃত্যুকে ভয় পাই আর গোরস্থানে পর পর লাইন দিয়ে মৃত্যু সাজানো আছে, আমি পারব না রে।

মতিকাকুর দোষ ছিল না। আমারও দোষ ছিল না। দোষটা হল, একজন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আর একজন সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে বসে থাকে। তাহলে আমরা প্রতিশ্রুতি দিই বা কেন? মতিকাকু বলেছিল, আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে ভালবাসি। আমি এর কোনো বিশ্বস্ত ব্যাখ্যা পাইনি।

বাড়ি ফেরার অনেক পথ। পথ অনেক হলে কোনো পথেই যেতে ইচ্ছে জাগে না। কিন্তু রাত বাড়ছে, বাসেই ফিরব মনস্থির করলাম। মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এগারোটার মধ্যে বাড়ি ঢুকব। রোজ বারোটা বেজে যায় বলে বাড়িতে অশান্তি হয়েছে। যুবকদের তো একটু রাত হয়ে যাবেই —বাড়ি বোঝে না। সন্ধ্যারাত্তিরে বাড়ি ফেরা আমার কাছে অশোভন ঠেকে। যারা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসেন তাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে, শ্রদ্ধা আছে, তাদের এই উদ্যোগকে আমি শর্তহীনভাবে সাধুবাদ জানাই। এ নিয়মটা একেবারে আমার নিয়ম। আপনারা প্ররোচনায় মাথা দেবেন না। পরিবারের প্রতি আপনাদের দায়বদ্ধতা আমাকে সলাজ মুগ্ধ করে। সান্ধ্যকালীন ট্রেনবাসের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।

বাসগুলো একেক করে চলে গেল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত আর ঘড়ির মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। তারা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। রাত সাড়ে দশটা।

অটোর অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে জানি না, তবে আজ আমার অপেক্ষা করতে ভীষণ ভালো লাগছে। এরকম হয় নাকি? যুক্তির প্রতি আনুগত্য আমাদের শিখিয়েছে যারা খেয়াল ও খুশি মতো জীবনযাপন করে তারা ঠিক স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হতে সকলেরই ভয় লাগে। তাছাড়া, সবারই কিছু না কিছু কন্ডিশন থাকে। একটা রোগ আছে, যে রোগে আক্রান্ত লোক দুঃখ হলে, রাগ হলে, যন্ত্রণা পেলে কেবল হাসে। বেদম সে হাসি। যারা জানে না এই রোগ সম্বন্ধে তারা কী ভাববে? লোকটা বদ্ধ পাগল। সে কিন্তু পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারে। বদ্ধ পাগলেরা পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারে না। তারা হারিয়ে যায় মহাশূন্যে।

কিন্তু মেয়েটি ফিরে এসেছে। দিল্লি থেকে। আইটি কর্মীকে ছেড়ে কলকাতায় সেই লেট লতিফ গল্পকারের কাছে। চার বছরের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। ছেলেটি জোনাকি রঙের টি-শার্ট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত জানা গন্ধ কেন ওর গায়ে?

'তুমি কি কখনও ইনস্ট্রুমেন্ট বাজানোর কথা ভেবেছ? মানে কাউকে বাজাতে দেখে তোমার কি মনে হয়েছে —আমিও চাই এমন করে বাজাতে। তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা গিটার পেলে আর কিছু চায় না।' বলতে থাকে গল্পকার।
ছোট ছেলেটি বুঝতে পারে না কী বলবে। তাছাড়া, একজন অপরিচিত লোক তার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছেই বা কেন। চার বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা আর কী ভাবতে পারে বলে মনে হয়?
সে একবার তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, একবার এই লোকটার দিকে। মায়ের মুখ দেখে সে বুঝেছে যে তার মা চায় সে একটা উত্তর দিক।
ছোট ছেলেটি আড়ষ্ট ভাবে বলে, আমার তবলা ভালো লাগে।

এই রকমভাবে অনেক কিছু মিলে যায়, এর ব্যাখ্যা হয় না। একে কি সত্যি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? আমাদের এতদিনের সাধনার গণিত, বিজ্ঞান কী অসহায় এসবের কাছে। তবলাই কেন বলল ওই ছেলে? হয়ত পুরোটাই কাকতালীয় ঘটনা। হ্যাঁ, তাই-ই হবে। সর্বত্র মিল খুঁজে বেড়ানো কাজের কথা নয় ; হতাশই করে ; এর কোনো মানে হয় না।

গল্পকার সেই ছোট্ট ছেলেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে তাকে তবলা কিনে দেবে আর একদিন গোরস্থান দেখাতে নিয়ে যাবে। ছোট ছেলেটি জানতে চায়, গোরস্থানে কেন? সেখানে তো ভয় থাকে।
সে তার সদ্যপ্রাপ্ত সন্তানকে বলেছে, গোরস্থানে প্রচুর জোনাকিও থাকে, বাবা।

গল্পকার এখন ট্রেন, বাস ছেড়ে দিয়ে অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার এখন তাড়া নেই। তার কখনোই তাড়া ছিল না।


জিয়া হক

৭ ডিসেম্বর ২০১৯

আমার কেবলই সিনেমা দেখতে ইচ্ছে হয় আজকাল। শুধু ঘটনাক্রমের দিকে জান্তব তাকিয়ে থাকা। চলমান চিত্র দেখতে দেখতে কিছুই ভাবি না। না ভেবে ভেবে দিন ডুবে যাচ্ছে। কষ্ট হয়। নিজের সঙ্গে কথাটুকু বলা হয় না। আমি যেন একজোড়া চোখ ছাড়া আর কিছু নয়। অক্ষর গুলিয়ে যায়। ভেদ করতে পারি না স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণে। বইগুলোও স্থিরচিত্র ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে হয়। বহুদিন ডাক্তারের কাছে যাই না। তাঁর সোনামুখ মনে পড়ে। তাঁর ব্যবস্থাপত্র আমার কাছে মহাগ্রন্থের ছিন্ন পাতা মনে হয়েছে কখনও কখনও। এই এখন ট্রেনে বসে আছি, বাড়ি ফিরছি, গৃহস্থ হব, শয্যাশায়ী হব, তাঁর কথা এই নাতিশীতল রাতে কাচ ঢাকা ট্রেনের জানালার পাশে অজ্ঞাত পরিচয় লোকের পাশে বসে ভাবছি। আমাদের ছোটগল্পগুলো স্থানের বর্ণনায় বড় বেশি স্থানিক হয়ে আছে। সমাজ আমার বিবাহ নিয়ে চিন্তিত। খেয়াল করে দেখেছি, বিয়ে নয়, আমি সমাজ নিয়ে দুশ্চিন্তিত। বিবাহ করা মানে আরও একটা আস্ত সমাজকে আমূল বাড়ির মধ্যে প্রবেশাধিকার দেওয়া। আমার রাতের গন্তব্য আইনি বাঁধনে পাওয়া কোনও স্ত্রীলোক নয়, আমার গন্তব্য আমি। 

তকদির


...................
আমি শুয়েই ছিলাম। যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে, শুনেছিলাম এক মৌলবীর মুখে, ছোটবেলায়। তখন কত আর বয়স হবে আমার? এগারো কি বারো। আমার পাশে বালাপোষ গায়ে দিয়ে আমারই ভাগ্য শুয়ে আছে, ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। ভাগ্যের এত অলস হওয়া মানায় না। উচিতও নয়। সে বসবে ঘোড়ার পিঠে আর সেই ঘোড়া দৌড়বে সেই মহল্লার মধ্যিখানের রাস্তা দিয়ে যেখানে প্রচুর ঘরবাড়ি, সুন্দরী রমণী, লোকের অরণ্য, সবার দৃষ্টি প্রবল তাই চশমা পরে না, মানুষকে মাপার ফিতে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহকর্ত্রী, যেখানে সবাই সবাইকে 'আপনি' বলে সম্ভাষণ করে, দিশি কুত্তাবিহীন এক অঞ্চল। অথচ আমার ভাগ্য শুয়েই রইল, মশারিটাও আমাকেই টাঙিয়ে দিতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠেছে, ভুলে যাই যে, সূর্য উঠেছে বলেই সকাল হয়েছে আর সকাল হয়েছে বলে আমি জেগে উঠেছি। মুর্খদের সঙ্গে বাস করা কঠিন। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে যাব কোথায়? কোথাও যাওয়ার না পেয়ে টিউশন পড়াতে বসি। প্রথম টিউশন শুরু করি ২০১১ সালে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর শুরুতেই আমি পড়াতে শুরু করি একটি শিশুকন্যাকে। তার নাম জানতে চাইবেন না। কারণ তাকে আপনারা চিনতে পারবেন না কিন্তু সে যদি দুর্ভাগ্যবশত এই লেখাটি পড়ে তাহলে সে আমাকে চিনতে পারবে। কেন তার অনুমতি ছাড়াই তার নাম ব্যবহার করেছি তা নিয়ে সে প্রশ্ন তুলতে পারে। ভয় আছে। আমি সাধারণত যে ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই তা হল :
১. কবিতা কীভাবে লেখা হয়?
২. রাজনীতিকরা কি সাইকোটিক?
৩. মানুষ পাগল হয়ে যায় কীভাবে?
৪. সত্য মানে ট্রুথ কী?
৫. ঈশ্বর আছে?
এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই কারণ এদের কোনও সদুত্তর নেই। আর সদুত্তর নেই বলেই যা-কিছু চিন্তা করা যায়। মাথা সচল থাকে। কিন্তু মুশকিল হল, আমার তৎকালীন ছাত্রীর বয়স ছিল ৬ বা ৭ বছর। সে রঙিন সব জামাকাপড় পরে আমার সামনের চেয়ারে এসে বসত। দুজনের মাঝখানে একটা পেল্লায় টেবিল। ওর মা 'এরকম-সচরাচর-পাওয়া-যায়-না' স্বাদের অপরূপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। পুত্রসন্তান নেই বলে তাঁর বড় আক্ষেপ ছিল। কীভাবে বুঝলাম? একদিন তিনি নিজেই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। তারপর যেভাবে সামাল দিতে হয়, সেভাবে সামালও দিয়েছিলেন। তাঁর দুই কন্যা। আমার ছাত্রীটি ছোট। ছোট হলে কী হবে, সে একদিন এক আশ্চর্য কথা শোনালো। বলল, জানো স্যার, আজ আমাদের স্কুলে একটা ছেলে আমার সামনে এসে বলছে 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত'। বলেই সে কি হাসি। আমি ভাবছিলাম, যে ছেলেটি বলেছে ধরে নিচ্ছি এই বয়সেই সে সব বোঝে, কিন্তু এ এত হাসে কেন? বুঝলাম, এও কম বোঝে না। যখন এই বোঝা ও পড়া চলছিল তখন আমার ভাবোদয় হল যে, আমি এই কন্যাকে কিছুই শেখাতে পারছি না, বরং রোজ আমিই শিখে বাড়ি আসছি আর তার বদলে বেতন নিচ্ছি। এভাবে তো চলে না। তাছাড়া, অভিভাবকরা তো বছরের শেষে নম্বর দেখবেন। অর্থের ব্যয় অনুপাতে নম্বরের আয় কত হল? আমিই অকৃতকার্য হব। একদিন ছাত্রীর বাবাকে ডেকে বললাম, ওর জন্য শিক্ষক নয়, নার্স প্রয়োজন, যে ওকে নারিশ করবে। আমি ওর কোনও উপকারেই লাগছি না, আমাকে বিদায় করুন। শিক্ষক বিনীত হলে অভিভাবক তাঁকে আরও মহান শিক্ষক ভাবতে শুরু করেন। তিনি আমাকে ছাড়তে নারাজ আর আমিও নাছোড় যে ছাড়বই। তারপর একটা রফা হল : ও আরেকটু বড় হলে আমি আবার পড়াতে আসব। তা-ই সই। কিন্তু এখন যে আমি টিউশন পড়াতে ছাদের ঘরে এলাম, এটা আপাতত আমার জীবিকা সংগ্রহের বিবিধ উপায়ের একটি। যে শুধুমাত্র জীবিকার জন্য পড়াতে বসে, পড়ানোটা যার জীবন নয়, সে শিক্ষকই নয়। তার অন্য কাজ দেখা উচিত। অন্তত আলুবিক্রেতা হতে পারে। আমার পুঁজি নেই আর সকলেই জানে টিউশন একটা বিনাপুঁজির ব্যবসা। আমি ফলত শিক্ষক নই, একজন ব্যবসায়ী। ছাত্র-ছাত্রীরা আলাদা করে ভক্তিশ্রদ্ধা দেখালে তাই আমার লজ্জা লাগে। আমি তাদের হাতগুলো আমার পা থেকে ক্রমাগত সরিয়ে দিই। এই পায়ে পাঁচ পাঁচ দশটা আঙুল ছাড়া আর কিছু নেই, তদুপরি রয়েছে ময়লাজমা নখ। পড়িয়ে নিচে নেমে প্রথমে বারান্দায় যাই না, আব্বামায়ের সামনে যাই না, যাই আমার বিছানার পাশে যেখানে তখনও আমারই ভাগ্যখানি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ভাগ্য নিজে কি স্বপ্ন দেখে? সে তো স্বপ্ন দেখায় আর এক সুন্দরী সকালে সত্যে রূপান্তরিত হয়ে মথ থেকে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়। উড়ে গিয়ে সে মেঘ হয়, মেঘ মানে প্রথমত ছায়া, তারপর জল। সব তাপ কেটে যায়, সবকিছু নাতিশীতোষ্ণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ জীবনের লোভ জন্ম নেয় এই মেঘের গর্ভে। অথচ আমার ভাগ্য এমন নিষ্পাপীর মতো ঘুমোচ্ছে যে তাকে জাগাতে আমার মায়া হল। কে কাকে জাগাবে? আমি তাকে নাকি সে আমাকে?
আমাকে অফিসে যেতে হবে। বলা উচিত কাজে যেতে হবে। আসলে সবাই 'অফিস' যেতে চায়। আমার পরিচিত একজনের স্ত্রী তার স্বামী কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করলে বলত, অফিসে গেছে। তার মেয়েকেও সেভাবে শেখানো হয়েছে। সেও বলে, বাপি অফিসে গেছে। লোকটা ছিল প্লাম্বার।
আমিও যেমন একজন অনুবাদক ছাড়া আর কিছু নই। একটা পত্রিকার দফতরের এক কোণায় বসে হরেক মাল অনুবাদ করি। ভুঁইফোঁড় কোম্পানির ত্রৈমাসিক বা অর্ধবর্ষের অনিরীক্ষিত আর্থিক ফলাফল, ব্যাঙ্কের দখল বিজ্ঞপ্তি, দাবি বিজ্ঞপ্তি, সরকারি টেন্ডার নোটিশ, সম্পত্তি নিলাম ও বিক্রয়ের বিজ্ঞপ্তি—এর শেষ নেই। আমি রাতে বাড়ি ফিরে খলিল জিবরান অনুবাদ করব কিনা ভাবি, ভাবতে গিয়ে দেখি কবিতাগুলি বিজ্ঞপ্তি হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না, পরিভাষা ছাড়া অন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। কবির কাজ পরিভাষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, আমি রোজ তারই দাসত্ব করি, আমি কি আর কখনও-ই জিবরান অনুবাদ করতে পারব না?
এই দফতরে নানা কিসিমের লোকের সঙ্গে এই অল্প কয়দিনে আলাপ হল। একদিন সৃজিত মুখার্জির মতো সিনেমা বানাবে—এই স্বপ্ন নিয়ে এক তরুণ উত্তর ২৪ পরগনা থেকে রোজ বিকেলে এসে রাজনৈতিক খবর লেখে। সে অনেক বিদেশি সিনেমার নাম বলল। সব সে দেখেছে। কিন্তু সে বক্স অফিস চায়। তাহলে ওই বিদেশি ছবিগুলি দেখে সে কী শিখেছে? 'সিনেমাকে ভালবাসতে শিখেছি', 'লাভ-চাইল্ড'-এর মুখের গড়ন কেমন হবে? শ্রী মুখার্জির মতো। বানাক না, সে যা চায়, যেমনটা চায়, বানাক। আমরা বড় বেশি দাগ টেনে দিই। আমি বরং সেই তরুণের গল্প বলি যে ডিটিপি অপারেট করে আর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পশুচিকিৎসকদের হেল্পারের কাজ করে। সে ফরেন কুকুরের নামগুলি সংক্ষেপে বলে। সে যে একজন ভেটারেন ভেট তা বোঝাতে চেষ্টা করে। আনন্দ পাই। চোখ বড় বড় করে একদিন বলল, একটা ল্যাবের তিনটে বাচ্চা হয়েছে, একটা মরা, এইটুকু মাথা। আঙুল গোল গোল করে দেখালো। আর একদিন বলল, 'আজ দুটো কুকুরের ইউট্রাস অপারেশন হল।' আমি বললাম, ইউটেরাস? সে এক মুখ লজ্জাবন্ধ হাসি নিয়ে বলল, ওই হল দাদা, আমাদের লাইনে সব চলে।
তার আঙুল চলছে কী-বোর্ডে আর মনিটরে নানান মুদ্রায় ফুটে উঠছে অক্ষর। ওর কি এত অর্থের প্রয়োজন? নাকি ভাগ্য ওর সহায়?
আরেকজনের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এই দফতরে সবাই পেশাগতভাবে দ্বৈত পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি মরে যাচ্ছি।
দফতর থেকে বাড়ি ফিরে আব্বামার সঙ্গে কথা বলা হয় না। ভালো থাকে না মেজাজ। আয়নায় নিজেকে দেখলে যেমন করুণা জাগে, তেমনই তাদের দেখলেই যেন রাগ হয়, তারা কি একবারও বলতে পারে না যে করতে হবে না এমন চাকরি যা তোকে আরও বিমর্ষ আর বিষন্ন করে তুলছে দিন দিন? তারা বিশ্বাস করে, যুবকদের ব্যস্ত থাকা ভালো। উচিত। আমি এই বিধিবদ্ধ ঔচিত্যে আটকে থাকতে থাকতে তাদের থেকে ক্রমশ দূরবর্তী হয়ে পড়ছি, তা তারা বোঝে না। আমি ভুলে যাই কী দিয়ে কথা শুরু করব তাদের সঙ্গে। মনে করতে পারি না আমাদের পারিবারিক সংলাপের পরম্পরা কোন অবধি এসে থমকে আছে। বাড়িটা প্রতিদিন একটু একটু করে হোটেল হয়ে উঠছে। আমি হোটেলে থাকতে চাইনি কখনও। চাই না।
দফতর থেকে বাড়িতে সোজাসুজি না ফিরে চলে এলাম গঙ্গার কাছে। পাপ এতে ডোবে কি না জানি না তবে জীবন ডুবে যায়।
লাফ দিলাম গঙ্গায়। জোয়ার তখন। একটি উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে ছোটগল্প হয়ে, লাফ দেওয়ার আগে এই সব ভাবছিলাম। আমি নেই মানে আমার ভাগ্যও নেই? তার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখখানা মনে পড়ছিল। সে যদিও এখনও বিছানায় আর আমি একা একা পালিয়ে যাচ্ছি জীবনাঞ্চল থেকে। সে আমার সঙ্গে থেকেছে আজীবন কিন্তু সখ্য হয়নি। চললাম সঙ্গী, তুমিই এবার আমার সওয়ার হও। অথচ বিপরীতটা হতে পারত আর হলে তুমিও দীর্ঘায়ু হতে। যাইহোক।
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাগ্য, আমি একটি নৌকোর পাটাতনে শুয়ে আছি। বেঁচে আছি তাহলে? কীভাবে সম্ভব? কে বাঁচালো? একে কি কৃপা বলা যাবে? যদি যায়, তাহলে কার এই কৃপা?
'আমার', ভাগ্য বলল বেশ উদাসীনভাবে, 'আমার সম্পর্কে তোমার যা ধারনা আর আমি যা, আমার কাছে রোজ তুমি যা চাও আর রোজ আমি তোমাকে যা দিই, যাকগে, বাড়ি চলো, আমাদের আব্বামা অপেক্ষা করে আছে। তারা এখনও খায়নি।'

জিয়া হক 

আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে


..............................................
কী পুছহ, জিজ্ঞাসিত বুঝিতে না পারি
বর্ণ যেন শব্দে এসে
গড়ে তোলে বদহজমী
বাক্যের তরকারি
কী পুছহ, কী প্রশ্ন খুকি
দরজায় মেহগনি
তদুপরি দ্বাররক্ষী
কোন জ্ঞানে ঢুকি?
দেখনি, কী উত্তেজক জল!
হারাম হালাল করে
ডাকে ওই মূত্রদ্বারে
যেখানেই তির্পল
পাতা ছিল শয্যা হবে তাই
প্রশ্নপত্র যথাযথ
বানানও বিধিবদ্ধ
শয্যাশায়ী শিশুছাত্র নাই

জিয়া হক 

প্রতি প্রতিষ্ঠান



...................................
কী আলো তোমাদের কথায় বাসা বেঁধে আছে
কুক্কুট মাংস ইহাতেই প্রসিদ্ধ হয়ে যেতে পারে
যে শোনে, সে শ্রোতা, যেভাবে আমি ও কুকুর
তার ধর্মভাব বেশি তাই কলহ করে না
যে বক্তার অঙ্গভঙ্গি নেই, সে কতখানি বক্তা হল শেষে
যে-দেবতা আরাধ্য, তাকে নগরের পথে
আমি হারিয়ে ফেলেছি
সে-দেবতা কি আমাকে আমারই মতো খুঁজিতেছে—
ভিড়ে, আস্তাকুড়়ে?
প্রচলিত গান শুনে বুঝি বিপ্লবীরা গুপ্তভাবে সভা করে কেন
হে জনের মাধ্যম, হে ছাপার বাক্যবর্ণযতি
থাক, বৃথা এই 'হে' বলে ডাকা, পাখা ডাকি, ক্লান্ত হয়েছো
মরুভূমিকে তুমি, তুমিই সমুদ্র বলে ব্যাখ্যা করতে পারো যেহেতু
সংস্থা আর বালিও খেয়েছো অঞ্জলিভরে, পাদপদ্মে বসে

জিয়া হক 

দ্বিজাতীয়


........................
কন্যা কি চলে যায় ভিজে
উঠে আসে তোমাদের
আমাদের
মাংসের দহলিজে?
বালক কি চলে যায় একা
উঠে পড়ে পল্লি ট্রেনে
দক্ষিণের
নদীর অদেখা—
কোনো গ্রামে?
দুজনের প্রতি দেখো
দেবতার
ইবলিশের
কথামালা নামে

'মিলে যাও,
ঢুকে যাও দেহে
তুমি ঠিক ছোট নও
        আমি ঠিক বড় নই
                     শংসাপত্রী
দৈবশাস্ত্র চেয়ে'

ফলবতী নিম ছিল দূরে
ডুবে গেছে পৃষ্ঠা যার
সুমিষ্ট ভক্তি আর
ষান্মাসিক নিহত রোদ্দুরে
সান্ধ্যকালে সূর্য ধরে গান
নামকরণ ভুল নয়?
গোত্রে তারা একপ্রকার?
সুচিন্তিত মেলে ধরে
                       লোক-অভিধান

অতঃপর বৈধ পেঁচা বলে
মিলে গেলে কেমন কৌশলে

এই দেশে?





জিয়া হক
চিত্র : ভ্যান গখ

আমাদের যা নয়

......................
আমাদের বাক্য হল ছোট, আমাদের 'আমি'ই গেল ডুবে
আমাদের অন্ত্যমিলের বাজার
                  পড়ে গেল হাজার একটা কূপে
আমাদের খাদ্য মাটি মাটি, আমাদের পেটের মধ্যে ধান
আমাদের যন্ত্রে কান্না বাজে
           ফুলে ওঠে চোখের বাসস্থান
আমাদের কোমলমতি চারা, আমাদের মৃত্যুশয্যা ঘিরে
আমাদের পেলাস্টিকের গৃহে
                   খেলা করে উদ্বাহু আর স্থিরে

জিয়া হক