মাঝপথে
(অনু নাটিকা)
জিয়া হক
...............
আনন্দী দল
গম্ভীরা দল
মধ্যবাসী দল
সূত্রধর
...............
সূত্রধর : নমস্কার সুধীবৃন্দ। আলাপ করিয়ে দিই। আমার ডাইনে রয়েছে আনন্দী দল। তাদের সবেতেই আনন্দ। তাদের পা খালি নেচে বেড়ায়। ছাড়া পেলেই আর খুঁজে পাওয়া ভার। তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট জুড়ে রয়েছে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমার পোস্টার পাশে ছবি, লং জার্নি, শর্ট জার্নি, মিডিয়াম জার্নি, উচ্চ মিডিয়াম জার্নি, নিম্ন মিডিয়াম জার্নির ছবি, এদের চামড়া কী সুখী! দেখুন হাসছে। এমন জ্বলজ্বলে কটনের ঘেরাটোপে থাকা চামড়াকে চামড়া বলা আমার অনুচিত হচ্ছে, এটা ১০০ ভাগ খাঁটি স্কিন।
এইবার আসি আমার বাম দিকে। এরা গম্ভীরা দল। এদের মুখে সূর্যোদয় হয় না। সবেতেই এরা গম্ভীর। এঁরা বাহুবলী দেখে না, মোমো খায় না, ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতলেও তাঁদের মুখের ন্যূনতম বিকৃতি হয় না। কপিল শর্মা, মশহুর গুলাটির যৌথ ট্যাবলেটেও এঁরা ঋষিসুলভ। কী শান্ত, কী সমাহিত! তাঁরা ফেসবুকে শুধু কেঁদো ভল্লুকের ছবি শেয়ার করেন আর বিপুল ভারতের বিপুল ডাস্টবিনের কিছু ছবি। তাঁরা লাইক-প্রত্যাশী নন। তারা না দার্শনিক, না রামগরুড়, কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে তাদের মনে তো নয়ই, সৌজন্যের মুখেও সুখ নেই।
এবার আলাপ করাই তিন নম্বর দলের সঙ্গে। এরা মধ্যবাসী। মাঝের পথ ধরে এরা হেঁটে চলেছে। এক গালে চাপড় খেলে এরা আরেকটা গাল বাড়িয়ে দেয় না আবার দূষিত গাল পেলেই কেবল চাপড়ে চলে না। এরা রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনে, হিমেশ রেশমিয়াও শোনে। চেতন ভগতকে এরা ক্ষমা করে দেয় অক্লেশে, সলমন রাশদিও বালিশের পাশে রাখে এরা। মধু চা কিম্বা চিনি হীন চা —কোনোটাতেই এদের আপত্তি নেই। আনন্দের গানে তারা নেচে ওঠে, বিষাদের গানে এদের মুখ হয় গম্ভীর।
পরিচয় পর্ব শেষ। এবার শুরু হবে নাটক। দেখুন না, কোনও স্ক্রিপ্ট নেই, কিন্তু তাও একটা নাটক। আসলে এদের জীবনটাই একটা ড্রামা। এনে ফেলুন না যে কোনো একটা বিষয়, দেখবেন শুরু হয়ে যাবে বিপুল বিশাল মহাভারতীয় ড্রামা।
(দর্শকদের মধ্যে বসে থাকবে নাটকদলের একজন প্রতিনিধি। তাকেই ডেকে মঞ্চে তুলবে সূত্রধর।)
এই দেখুন না, অচেনা অজানা আধারকার্ডহীন এই বালক একটা কথা শুধু এই দলের সামনে বলবে আর তাতেই কী বেঁধে যায় দেখুন।
সূত্রধর : আপনার নাম কী রাজন?
—আমার নামই তো রাজন। রাজন হালদার। আপনি কী করে জানলেন গুরুদেব?
সূত্রধর : (খানিকটা বিস্ময় ও খানিক শ্লাঘা মিশিয়ে) সে অনেক সাধনা রাজন। তা যাক গে, এই যে তিনটে দল দেখতে পাচ্ছেন, এদের সামনে যে কোনো একটা মন্তব্য করুন প্লিজ।
—কী মন্তব্য করব গুরুদেব?
সূত্রধর : এই রে তাও বলে দিতে হবে? (মনে মনে)। আপনার শিশুর বিষয়ে কোনো কথা বলুন হে রাজন। এরা শিশুপ্রেমিক কি না।
—যথা আজ্ঞা গুরুদেব।
রাজন ইতস্তত করে এগিয়ে যায় মঞ্চের মাঝখানে। তিনটে দলের দিকে আড়ষ্ট ভাবে তাকায়, তারপর আনন্দী দলের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার ছেলেটি বড্ড বেয়াদব।
তাই শুনে আনন্দী দল : ছেলে? হা হা হা হা হা হা
বড্ড? হা হা হা হা হা হা হা হা হা
বেয়াদব? হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা
রাজন : আপনারা হাসছেন কেন?
তাই শুনে আনন্দী দল : আমরা? হা হা হা হা হা হা
হাসছি? হা হা হা হা হা হা
কেন? হা হা হা হা হা
নিজেরাই জানি না। হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা
রবীন্দ্র সঙ্গীত শুরু হয়, —'বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও '
আনন্দী দল : বড্ড বড় আশা গো। হা হা হা হা হা হা হা
এসেছে? কিন্তু কার কাছে? হা হা হা হা হা হা হা হা
ডেকে লিবে নাকি তুলে লিবে অ্যা? হা হা হা হা হা হা হা
রাজন ঘাবড়ে যায়। সে এবার গম্ভীরা দলের দিকে তাকায়। বলে, আমার ছেলে জলকে বলে হিসি।
তাই শুনে গম্ভীরা দল : ছেলে? বলে কী লোকটা!!!
জল? ওমা সে কি!!!
হিসি? কী ভয়ানক, কী ভয়ানক!!!
রাজন : আপনারা এত গম্ভীর কেন?
তাই শুনে গম্ভীরা দল : আমরা? বলে কী লোকটা!!!
গম্ভীর? ওমা সে কি!!!!
কেন? কী ভয়ানক, কী ভয়ানক!!!!
নিজেরাই জানি না। উফ্
রবীন্দ্র সঙ্গীত শুরু হয়, —'পাগলা হাওয়া বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে '
গম্ভীরা দল : হাওয়া পাগল হয়ে গেছে! কী সর্বনাশ।
বাদল দিনের হাওয়া? লাগলেই সর্দি! হচ্ছেটা কী!
নেচে উঠছে সব! হায় হায়!
সূত্রধর সামনে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ। কী ঘটবে আনুপুঙ্খ তার জানা। মজা দেখছেন —এমন একটা ভাব তাঁর মুখে।
রাজন এইবার মধ্যবাসীদের দিকে তাকায় একবার, আরেকবার দর্শকদের দিকে তাকায়। কী বলবে সে বুঝতে পারে না। তারপর মুখ ফসকে আচমকা বলে ফেলে, আমার ছেলে ফেলু মাল।
তাই শুনে মধ্যবাসী দল : আপনি এখানে বসুন প্রথমে। কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।
১. আপনার ছেলের বয়স কত?
২. সে কোন ক্লাসে পড়ে?
৩. শুরু থেকেই কি সে ফেলু ছিল?
৪. কবে থেকে এমনটা ঘটল?
৫. পড়াশোনা ছাড়া আর কী করতে সে ভালবাসে?
সূত্রধর মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ান: আপনারা দেখছেন যে রাজন ইজ ইন সেফ হ্যান্ডস নাও। আনন্দী ও গম্ভীরা এরাও উদ্ধার কাজে নেমে আসতেই পারে। শুধু দরকার মানসিকতার যৎসামান্য বদল। দুশ্চিন্তা করবেন না, এই বদলে আপনাকে শনাক্ত করতে কারোরই অসুবিধা হবে না। আনন্দী ও গম্ভীরা —এই দুই দল এক জায়গায় মিশলেই কিন্তু সূত্রধর ভ্যানিশ।
খেলা দেখুন।
আনন্দী দল আর গম্ভীরা দল ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে। আর সূত্রধর পিছু হঠতে থাকেন।
আনন্দীদের হাসি মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে। গম্ভীরাদের বিষাদমুখ সহজ হয়ে আসে। তারা মধ্যবাসীদের সঙ্গে মিশে যায়। আর সূত্রধরকেও মঞ্চে খুঁজে পাওয়া যায় না।
নেপথ্যে সঙ্গীত বাজবে : আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে গাছে গাছে পাখি ডাকে
কত শোভা চারিপাশে
সমাপ্ত