আদালত কি ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন ভুলে গেছে? টি কে রাজলক্ষ্মী


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের এক বছর আগে পার্লামেন্টে উপাসনাস্থল (বিশেষ বিধি) আইন, ১৯৯১ পাশ হয়েছিল। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও উপাস্থনাস্থলকে বদলানো বা রূপান্তরিত যাবে না। সেই সঙ্গে এই আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত টিকে থাকা যে কোনও ধরনের উপাসনাস্থল পরিচর্যা ও দেখভাল করা যাবে। কোনও ধর্মীয় উপাসনাস্থলকে সেই ধর্মের অন্য গোষ্ঠী বা অন্য ধর্মের উপাসনাস্থলে পরিবর্তন করতে পারবে না কেউ। এমনটাই বলা হয়েছে। রাম জন্মভূমি-বাবরি  মসজিদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযুক্ত হয়নি। জম্মু ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য। এই আইনকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন বিজেপির মুখপাত্র ও আইনজীবী অশ্বিনী কুমার উপাধ্যায় ও বিশ্ব ভদ্র পূজারি পুরোহিত মহাসংঘ।


এই আইনের ৪ ধারা বলেছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবধি থাকা কোনও উপাসনাস্থলকে রূপান্তরিত করা সংক্রান্ত ঝুলে থাকা মামলা, আপিল বা অন্যান্য বিচারপ্রক্রিয়া “উড অ্যাবেট আপঅন দ্য অ্যাক্ট কামিং ইন্টু ফোর্স।” এইভাবে নতুন করে মামলা বিষয়ে দাঁড়ি টেনেছে এই আইন। ৪ ধারায় আরও বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পরে ধর্মীয় গৃহ পরিবর্তন করা হয়েছে, এই দাবিতে কোনও মামলা বা আপিল উপাসনাস্থল আইন পাশ হওয়ার আগে যদি করা হয় তাহলে তার গুরুত্ব হ্রাস করা হবে না।


উক্ত আইনের বয়ান মসৃণ নয়। ১৯৯১ সালের দশম লোকসভায় সংসদে যে বিতর্ক হয়েছিল তা থেকেই বোঝা যায় এই আইনের পথ এত সুগম ছিল না। এই বিল পেশ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চবন বলেছিলেন, ধর্মীয় উপাসনাস্থল নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক দেখা দিচ্ছে যা সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে অস্থির করে তুলছে, একে থামানোর লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই আইনের অভিপ্রায় হল, নতুন করে কোনও বিতর্ক সৃষ্টিকে রোধ করা বা পুরনো বিতর্ক যা মানুষ ভুলে গেছে সেগুলি নিরসন করা। (লোকসভা বিতর্ক, ভলিউম ৫, নং ৪১-৪৯, পৃষ্ঠা ৪৪৮)।


বিজেপি সদস্যরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমা ভারতী বলেছিলেন, “১৯৪৭ সালের স্ট্যাটাস কুয়ো বজায় রাখার মাধ্যমে আপনারা তোষণের নীতি নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।” সিপিআই(এম)-এর সোমনাথ চ্যাটার্জি তাঁর দলের আরেক সাংসদ জয়নাল আবেদিনের পেশ করা এক রেজল্যুশনের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। এই রেজল্যুশনে আলোচনা করা হয়েছিল, উপাসনাস্থল আইনের মতো বিধি কেন একান্ত প্রয়োজন। বিল যখন চালু করা হয় তখন এই রেজল্যুশন তুলে নেওয়া হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অশোক সিংহল সাংসদদের যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা পাঠ করে শোনান সোমনাথ চ্যাটার্জি। এই চিঠিতে বলা হয়েছিল, হিন্দু মুসলিমদের আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চান ধর্মাচার্যরা এবং এই ইস্যুকে ভবিষ্যতের জন্য সমাপ্ত করে দিতে ইচ্ছুক, তবে তাঁরা একটি বিনীত দাবি করেছেন আর তা হল, কেবলমাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থল যেমন অযোধ্যা (শ্রীরামের জন্মভূমি), মথুরা (শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি) ও বারাণসী (শ্রীবিশ্বনাথ মন্দির)-কে পুনরুদ্ধার করার অনুমতি যেন দেওয়া হয়। চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছিলেন, দেশের জন্য গুরুতর বিষয়গুলিকে মোকাবেলা করার পরিবর্তে দেশ যদি আজ “ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে নিজের শক্তি ক্ষয় করে তাহলে তা হবে আমাদের জন্য দুঃখের দিন।”


ওই বিলকে সিপিআই(এম) সমর্থন জানিয়েছিল এবং সোমনাথ চ্যাটার্জি বলেছিলেন, ধর্মীয় উপাসনাস্থল মসজিদ হোক বা মন্দির তা নিয়ে বিতর্কই যখন মূল চিন্তার বিষয় তখন তা এখানে ও এখনই শেষ করে দেওয়া উচিত বিলের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। অযোধ্যার বিষয়ে বলা যেতে পারে, একে বোঝাপড়ার মাধ্যমে বা বিচারবিভাগীয় রায়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টকে ‘কাট-অফ’ তারিখ কেন ধরে নেওয়া হল সে প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)-এর সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য বলেছিলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওই তারিখেই (১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট) সমস্ত বর্বরতাকে চিরদিনের জন্য পিছনে ফেলে আমরা আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত হয়েছি বলে মনে করা হয়।  ওই তারিখ থেকেই আমরা নিজেদের পৃথক করতে পেরেছি। এমন একটা দেশ যার কোনও সরকারি ধর্ম নেই এবং যে দেশ সকল ধর্মকে সমানাধিকার দান করে। তাই, অতীতে যা কিছু ঘটে থাক, আমরা প্রত্যাশা করি ওই তারিখ থেকে অতীতে দিকে আমরা আর ফিরব না।


রাম বিলাস পাসোয়ান বলেছিলেন, অন্য সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহকে নিজেদের দাবি করে নির্দিষ্ট কিছু শক্তি সহিংসতায় যে ভাবে উস্কানি দেয় তা বন্ধ হবে এই আইনের ফলে। বর্তমানে আমাদের প্রধান ইস্যু হল সংবিধান। ভারতকে রক্ষা করাই ইস্যু, যে ভারতের স্বাধীনতার জন্য হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানরা লড়াই করেছিলেন এবং সংবিধানকে রক্ষা করা ভারতের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।


এই আইনের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝতে হলে ২০১৯ সালে অযোধ্যা শীর্ষক মামলার জন্য পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিল তা দেখা জরুরি। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, ভারতীয় রাজনীতির ধর্মনিরপক্ষে চরিত্র বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বানানো এই বিধি এক আইনি হাতিয়ার। তারা জানিয়েছিল, হিন্দু উপাসনলয়ের বিরুদ্ধে মুঘল শাসকরা কী করেছিলেন সেই সংক্রান্ত দাবিকে আজকের আদালত গুরুত্ব দিতে পারে না। প্রাচীন শাসকদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউ যদি সান্ত্বনা বা প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে এই আইন তার উত্তর নয়। আমাদের ইতিহাসে এমন সব ঘটনা রয়েছে যা নীতিগত ভাবে বেঠিক বলে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এমনকি আজও উত্তপ্ত মতাদর্শিক বিতর্কের জন্ম দিতে তা সক্ষম। আদালত জানিয়েছিল, আই আইন আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে এবং পশ্চাদপসরণকে কঠোর ভাবে প্রতিরোধ করে।

রাফাহের ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার ইসরাইলি পরিকল্পনা—সত্য নাকি গল্প? মার্ক আওয়েন জোনস


গাজা ভূখণ্ডের রাফাহ শহরে পরিকল্পিত আক্রমণের আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি টিভি চ্যানেল এবিসি-কে রবিবার এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আমেরিকানসহ পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সতর্কতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেন। পশ্চিমা নেতারা বলেছিল, রাফাহতে আক্রমণ করলে ব্যাপক পরিমাণে বেসামরিক নাগরিদের মৃত্যু হবে। নেতানিয়াহু বলেন, “বেসামরিক মানুষ যাতে এলাকা ছাড়তে পারে তার জন্য নিরাপদ রাস্তা দিয়েই আমরা যা করার করতে চলেছি।”


ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জোনাথন কার্ল প্রশ্ন করেছিলেন, ১৪ লক্ষ ফিলিস্তিনি যাবে কোথায়? এর উত্তরে নেতানিয়াহু বলেন, “রাফাহের উত্তরে যে ফাঁকা অঞ্চল রয়েছে সেখানে, প্রচুর জায়গা রয়েছে ওখানে, তবে এটা করার আগে আমরা বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি।” নেতানিয়াহু নিজের বক্তব্য নিয়ে সন্তুষ্ট এমনটাই শোনাচ্ছিল।


একদিন আগে, ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র আইলন লেভি লন্ডনে অবস্থিত এলবিসি রেডিওতে বক্তব্য রাখেন এবং তাঁকে যখন চারবার প্রশ্ন করা হয় যে, রাফাহের ফিলিস্তিনিরা যাবে কোথায়? লেভি কোনও উত্তর দিতে পারেননি। তিনি সামান্য যেটুকু বলতে পেরেছেন তা হল, “গাজা ভূখণ্ডে ফাঁকা জায়গা রয়েছে এবং আরেকটি বিকল্প হল, ফাঁকা এলাকাতে বেসামরিক নাগরিকদের পাঠাতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলিকে আমাদের সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।” এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ম্যাট ফ্রেই যখন জিজ্ঞাসা করেন, ওই ফাঁকা জায়গা কোথায়? এর কোনও উত্তর তিনি দেননি।


নেতানিয়াহু ও লেভি একটা সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না কারণ তাঁরা উভয়েই জানেন, ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে ইচ্ছুক নয়, অন্তত এখনও পর্যন্ত করেনি। তাঁরা জানেন, ফিলিস্তনিদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ নয় এবং রাফাহতে আক্রমণ শুরু হলে তাদের জন্য কোনও জায়গাই নিরাপদ থাকবে না। তারা এও জানেন, গাজা ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ইসরাইল, তাদের সেখানে রাখতে নয়।


 


গাজায় নেই নিরাপদ স্থান


গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলের সরকার ভুয়ো তথ্য প্রচার বৃদ্ধি করেছে। ইসরাইল যখন দাবি করে যে, সে দেশের সেনা “নিরাপদ পরিসর” তৈরি করছে গাজার মানুষদের জন্য বা তাদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এর চেয়ে মিথ্যা দাবি আর নেই। গত ভয়াবহ চার মাসে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।


প্রথমত, ইসরাইল গাজার মানুষদের বলেছিল, দক্ষিণাঞ্চল নিরাপদ থাকবে। গাজাবাসী যখন এলাকা খালি করতে শুরু করেছিল, ইসরাইলি বাহিনী বেসামরকি নাগরিকদের গাড়িবহরের উপর বোমাবর্ষণ করেছিল। ফিলিস্তিনিরা যখন দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছায় তখনও তাদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। “নিরাপদ যাত্রাপথে” যেখানে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের উপর বোমা ফেলা হয়নি, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে স্নাইপাররা গুলি করেছে বা আটক করেছে এবং জোর করে তাদের বেপাত্তা করে দিয়েছে।


খান ইউনিসের আগের “নিরাপদ অঞ্চলে” ইসরাইলি সেনা যখন আক্রমণ করেনি তখন তারা বেসামরিক নাগরিকদের বলেছিল হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে থেকে যেতে। মানুষ যখন হাসপাতাল ও আশ্রয় শিবিরে পৌঁছতে চেয়েছে তখন স্নাইপাররা তাদের গুলি করেছে এবং তারপর বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।


ইসরাইলি সেনা বাহিনী ফিলিস্তিনিদের খান ইউনিস পরিত্যাগ করতে বলার পর তারা যখন পালাচ্ছিল তখন তাদেরকে নিশানা করা হয়। আরেক “নিরাপদ অঞ্চল” রাফাহতে কিছু ফিলিস্তিনি হাজির হয়েছিল, তখন তাদের বলা হয় সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। এখন মানুষজনকে রাফাহ ছেড়ে “ফাঁকা এলাকা”তে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। অন্য “ফাঁকা এলাকা” বলতে পড়ে রয়েছে মাওয়াসি। এখানে আগেও মানুষজনকে চলে যেতে বলা হলেও বারবার নিশানা করা হয়েছে।


মানুষকে এলাকা খালি করতে বলার এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তাদের হত্যা করার অভিপ্রায়। ইসরাইলের সেনা ও সরকার ইংরেজিতে যাবতীয় ঘোষণা করে থাকে এবং পশ্চিমা মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দাবি করছে, “বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে” তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইভাকুয়েশনের পথ অনিরাপদ বা সেই পথের মানচিত্রকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা তার পাশাপাশি বড় প্রশ্ন হল, তারা একটা সত্য গোপন করতে চেষ্টা করছে আর সেই সত্য হল, গাজায় কোনও নিরাপদ স্থান নেই।


 


শ্রুডিঙ্গারের হামাস


চলমান যুদ্ধের মতো অতীতেও ইসরাইল বারবার সাধারণ মানষের হত্যার জন্য হামাসকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকেও দায়ী করেছে। তারা বারবার দাবি তুলেছে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধা ও কমান্ডাররা বেসামরিক নাগরিকদের “মানবিক ঢাল” হিসেবে ব্যবহার করছে।


তবে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী যে তথ্য প্রকাশ  করেছে তার সঙ্গে এই দাবি মিলছে না। জানুয়ারি মাসে ইসরাইল দাবি করেছিল, তারা ১০ হাজার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে (গাজায় ৯ হাজার ও ইসরাইলের মধ্যে ১ হাজার জনকে) এবং ৮ হাজার জনকে জখম করেছে, ২৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছে ও হামাসের রেজিমেন্টের দুই-তৃতীয়াংশকে উৎখাত করেছে। তারা এও বলেছে, তারা গাজা ভূখণ্ডে ৩০ হাজার লক্ষ্যবস্তুতে “আঘাত” হেনেছে।


নিজেদের মূল্যায়নে বিশ্বের সবচেয়ে নীতিবান ইসরাইলি সেনা বাহিনী কেবলমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে “হামলা” করে। কেউ ভাবতে পারেন, কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা বা জখম করা যেতে পারত। আমরা যদি নেতানিয়াহুর দাবি শুনি, তাহলে একজন ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, এর ফলে আমরা মৃতের যে সংখ্যা পাই তা ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ খারিজ করে দেবে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সংখ্যাকে আপাত ভাবে ব্যবহার করছে ইসরাইলের গোয়েন্দা বিভাগ। অথচ সেই সংখ্যা নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন তুলেছে ইসরাইলের সরকার।


অন্য ভাবে বললে, ইসরাইলের সেনার দেওয়া তথ্য নিশ্চিত করে, তারা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করছে এবং গাজা ভূখণ্ডে বেসামরিক নাগরিক-সামরিক বাহিনীর মৃত্যুর হার নিয়ে নেতানিয়াহু মিথ্যা বলছেন। তবে, ইসরাইল সরকারের ভাষ্য নিয়ে আরেকটি বৈপরিত্য রয়েছে এবং তা এই তথ্য থেকেই বেরিয়ে পড়ছে।


ইসরাইলের অনুমান, যুদ্ধের আগে হামাসের কমপক্ষে ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিল। ইসরাইলি সেনার দাবি, তারা গাজা ভূখণ্ডে যেখানে আক্রমণ চালিয়েছে সেখান থেকে হামাস যোদ্ধাদের উৎখাত করেছে এবং রাফাহ হল “হামাসের শেষ ঘাঁটি”, এই কথা যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এর অর্থ হল, জানুয়ারি মাসে রাফাহতে কমপক্ষে ১০ হাজার ছিল অথচ সেই সময় ফিলস্তিনিদের বলা হচ্ছিল যে, এই এলাকা নিরাপদ।


হামাস যদি ইসরাইলের দাবি মতো মানবিক ঢাল ব্যবহার করে থাকে তাহলে ইসরাইল স্বীকার করে নিচ্ছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের সেই সব এলাকার দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে যেখানে হামাস রয়েছে এবং তাদেরকে নিশানা করার অজুহাত দেওয়া যায়। ইসরাইলের মূল মন্ত্র হল—হামাস যেখানে যায়, সাধারণ মানুষ সেখানে যায়। সাধারণ মানুষ যেখানে যায়, হামাস সেখানে যায়। হামাসকে পরাস্ত করতে হলে বেসামরিক নাগরিকদেরও নিশ্চিহ্ন করতে হবে।


 


“নাকবা হল নিরাপত্তা”


ইসরাইলের সরকার দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করছে ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপদ্বীপে নির্বাসন দেওয়ার; এই তথ্য আর গোপন নেই। গত অক্টোবরে ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নথি ফাঁস হয়ে গিয়েছিল যাতে গাজার ফিলিস্তিনিদের মিশরীয় অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


নেতানিয়াহু একে “ভাবনাপত্র” বলে তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছিলেন এবং এর তথ্য-বিষয়বস্তুকে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অবাক হতে হয় যখন এবিসির সাক্ষাৎকারে “প্রচুর এলাকা” শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় নেতানিয়াহু ঢোক গিলেছিলেন। বিধ্বস্ত গাজা ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি বসতির উন্নয়নের জন্য কি তাহলে রিয়েল এস্টেটের পরিকল্পনা করা হচ্ছে? নাকি গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলিদের পুনরায় বসতি স্থাপনের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে?


গত চার মাসে ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে মিশরের একেবারে কাছে অর্থাৎ দক্ষণাঞ্চলে কোণঠাসা করা হয়েছে। এদিকে, ইসরাইলের সেনা বাহিনী ও সরকারের “নিরাপত্তা” ও “ইভাকুয়েশন” শব্দগুলি তাদের মিথ্যাচারকে ঢাকা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে। “গণহত্যার প্রযুক্তি”র অংশ হিসেবে যেভাবে বয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে ইসরাইলের জন্য আরেকটি নাকবার পথ প্রশস্ত করছে এবং তার নকশা তৈরি করা হচ্ছে। ইসরাইলের মিত্রশক্তি ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।


বস্তুত, এই পশ্চিমা শক্তি ইসরাইলের এই ভয়াবহ আগ্রাসনের মদতদাতা এবং ওই নকশা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইসরাইলের গণহত্যামূলক প্রচারণাকে “একটু বাড়াবাড়ি” বলে বিষয়টিকে লঘু করে দিতে সাহায্য করে। যুদ্ধের বাস্তবতায় রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে সত্য নিগৃহীত হয় এবং মিথ্যা তথ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধে আরেক ভুয়ো তথ্যের।


জর্জ ওরওয়েলের বিখ্যাত ধ্রুপদী রচনা ‘১৯৮৪’-তে রয়েছে, “যুদ্ধই শান্তি। স্বাধীনতাই দাসত্ব। অজ্ঞতাই শক্তি।” এর সঙ্গে যোগ করতে হয়, “নাকবাই নিরাপত্তা” কেননা গাজা ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিভীষিকার এটাই বাস্তব রূপ।


 


তরজমাঃ জিয়াউল হক

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে? আব্দুল বারি মাসুদ


উত্তরাখণ্ডে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপের পর, আরও এক বিজেপি-নেতৃত্বাধীন রাজ্য অসমের সরকার ১৯৩৫ সালের অসম মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন বাতিল করেছে ২৩ ফেব্রুয়ারি। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সভাপতিত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম রাজ্য হিসেবে উত্তরাখণ্ড অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার তিন সপ্তাহ পরে এই ঘটনা ঘটল। এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, দ্রুত এগিয়ে আসা লোকসভার আগে শাসক দল বিজেপি কতখানি মরিয়া। অনেকের মতে হতে পারে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মীয়মাণ রাম মন্দির উদ্বোধন করেও বিজেপি তাদের কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে। প্রাচীন মসজিদগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করা, ধ্বংস করে দেওয়া, ঘৃণাভাষণ ও হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ গত কয়েক মাসে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।


কোনও ইতিবাচক ইস্যু বা স্লোগান না থাকায় হিন্দুত্ববাদী বাহিনী হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে সাধারণত তিনটি বিষয় ব্যবহার করে—গরু, পাকিস্তান ও মুসলিম। ২০১৯ সালের নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাকিস্তান এবং এই ইস্যু বিজেপিকে ভোট পেতে সাহায্য করেছিল। ২০১৪ সালে তথাকথিত গরু-সংক্রান্ত ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছিল তারা। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে মুসলিমদের সরাসরি নিশানা করা হবে। লক্ষণীয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে কম-তীব্রতার (ছোট খাটো) সংঘাত বানিয়ে তোলা হচ্ছে।


সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা বানিয়ে তোলা সংঘাতের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঘটনাগুলি হল, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর অসম্পূর্ণ রাম মন্দির উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিতরে হিন্দুদের পূজার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, দিল্লির মেহরাউলি এলাকায় কুতুব মিনারের কাছে ৮০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, বাঘপতে বারনাওয়া জেলায় শেখ বদরুদ্দিনের দরগা ও সেই সঙ্গে ১০০ হেক্টর জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, হলদোয়ানিতে একাধিক মাদ্রাসা ও মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এবং পুলিশের গুলিতে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, বিজেপির অধীনে থাকা রাজ্য সরকারগুলি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরোপ করছে। সর্বোপরি, সংসদে পেশ করা সাম্প্রতিক বাজেটে সংখ্যালঘু বিষয়ক নানা তহবিল ও একাধিক কর্মসূচি বাতিল বা ব্যাপক ভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে যেমন মৌলানা আজাদ এডুকেশন ফাউন্ডেশন (এমএইএফ) বন্ধ করা হয়েছে।


২০২১ সালের মে মাসে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসমের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে লাগাতার মুসলিমদের নিশানা করা হয়েছে, অথচ এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশই মুসলিম। শর্মা মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডকে অকেজো করে দিয়েছেন। এই বোর্ড ব্রিটিশ আমল থেকে টিকে ছিল। ৬১০টি সরকার-চালিত মাদ্রাসাকে শর্মা হাই স্কুলে রূপান্তরিত করেছেন। এই রাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় জমি জবরদখল বন্ধ করার নামে তিনি উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছেন। ২০২১ সালের মে মাস থেকে ৬৪৫০টির বেশি পরিবারকে, যাদের অধিকাংশই বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম, তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এইসব এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই বাংলাভাষী মুসলিম। অসমের প্রশাসন দুটি মসজিদও ভেঙে দিয়েছে। এ থেকে মনে হয়, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসী-অধ্যুষিত রাজ্যকে হিন্দুত্বের নতুন গবেষণাগারে পরিণত করেছেন। ১৯৩৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন নিয়ে শর্মার সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, “প্রাক-স্বাধীনতা যুগের অচল” এই আইনকে বাতিল করা হয়েছে শিশুবিবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে। শর্মা এক্স (সাবেক ট্যুইটার) হ্যান্ডেলে লিখেছেন, এই আইনে এমন নিয়ম আছে যাতে বর ও কনে ২১ ও ১৮ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই বিয়ের জন্য নিবন্ধন করতে পারে। অসমের মন্ত্রিসভায় শর্মার আরেক সহকর্মী জয়ন্ত মল্লবড়ুয়া এই সিদ্ধান্তকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মুসলিমদের বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সমস্ত ইস্যুতে বিশেষ বিবাহ আইন প্রয়োগ করা হবে। গণমাধ্যম কর্মীদের মল্লবড়ুয়া বলেছেন, নতুন আইনি কাঠামো অনুযায়ী মুসলিম বিবাহ ও ডিভোর্স নিবন্ধনের দায়িত্ব পাবেন জেলা কমিশনার ও জেলা নিবন্ধক। বাতিল আইন মোতাবেক নিযুক্ত ৯৪ জন মুসলিম রেজিস্ট্রারকে তাঁদের পদ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে এককালীন ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।


অসম সরকারের এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এআইডিএফ সভাপতি ও সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল বলেছেন, এই রাজ্যের বিজেপি সরকারের মৃত্যু ঘন্টা বাজাবে এটি। গুয়াহাটিতে এক কর্মসূচির ফাঁকে সংবাদদাতাদের আজমল বলেন, তারা মুসলিমদের প্ররোচিত করতে ও নিজেদের পক্ষে ভোটারদের মেরুকরণ ঘটাতে চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, “আমরা অবশ্যই এই আইনের বাতিলীকরণের বিরোধিতা করব, তবে তা নির্বাচনের পর। এখন আমরা নীরব থাকব।” কাজিদের দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বিষয়ে আজমল বলেন, কাজিরা ভিখারি নন। এরপর আজমল বলেছেন, “গণমাধ্যমের মারফত আমি তাঁদের বলব, তাঁরা যেন সরকারের কাছ থেকে এক পয়সাও না নেন।”


সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে প্রতি মাসে নজরদারি চালায় এবং তারা জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসে পাঁচটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে চারটিই সরাসরি অযোধ্যাতে মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই চারটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে দুটি সংঘটিত হয়েছে মুম্বই, নাগপুর অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে, একটি বদোদরাতে অর্থাৎ গুজরাতে এবং একটি মধ্যপ্রদেশে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ সবগুলিই বিজেপি-শাসিত রাজ্য। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০২২ ও ২০২৩ সালে গোটা ভারতে সংঘটিত ২৮টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সরাসরি ভাবে রাম নবমী মিছিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত মাসে রাম মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার আগে ও পরে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা ভয়ানক। এই সকল ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক মিথের উপর নির্ভরশীল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

 

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কেন বিক্ষোভ কৃষকদের? হরবীর সিং

 


কৃষকরা শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপির নিশ্চয়তার দাবিতে পুনরায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আমাদের এখন দেখা প্রয়োজন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লি সীমান্তে চলা কৃষকদের আগের বিক্ষোভ থেকে এবারের বিক্ষোভ কোথায় ও কতখানি আলাদা। আগের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল, কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। শস্যপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা ছিল ঐচ্ছিক দাবি।

পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা মনে করেছিলেন, উক্ত আইনের নিয়মাবলি যেমন সরকার কর্তৃক শস্য সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বাজার কমিটি (এপিএমসি) আইনের অধীন মান্ডি ব্যবস্থা ও চুক্তিভিত্তিক চাষ তাঁদের প্রভাবিত করবে। তাই, সেই সময়, ওইসব রাজ্যের কৃষকরা মূল ইস্যু নিয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন কারণ মান্ডি ও শস্যসংগ্রহ ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছিলেন তাঁরা।

বিহার যেখানে এপিএমসি মান্ডি নেই এবং মধ্য ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশ যেখানে এপিএমসি মান্ডির তেমন সুবিধা পাওয়া যায় না, সেখানকার কৃষকরা কৃষি আইনের সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত বা সম্পৃক্ত হননি। তবে সকল কৃষকই তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য চান এবং এ জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি জরুরি। এই বিশ্বাসই এমএসপির আবেদনকে সর্বজনীন করে তুলেছে। এই কারণে ২০২৪ সালের কৃষক আন্দোলনের গোটা দেশে সাড়া ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছর পাঁচ রাজ্যের প্রায় ৬০০ জন কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি এমনই একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। শস্যের স্বল্প মূল্য ও গ্রামীণ পরিবারগুলির ক্রমবর্ধমান সমস্যাই ছিল তাদের সাধারণ উদ্বেগ ও যন্ত্রণার বিষয়। রাজস্থানের যোধপুর, উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর, ওড়িশার ভুবনেশ্বর, মেঘালয়ের শিলং ও তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের কৃষক ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম। ছয় মাস ধরে আমরা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলাম। দিল্লি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর পর।

একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ভাল মূল্য প্রাপ্তিকেই সমস্যার সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেন। দেশের সমস্ত প্রান্তের কৃষকরা কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যই শুধু চান না, সেই সঙ্গে এমএসপির নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টিও চান। প্রায় তিন মাস পরে দিল্লির উদ্দেশে মিছিল শুরু হয়েছিল পুনরায়। পঞ্জাবের দুটি স্বল্প পরিচিত কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাঁদের দাবি দেশের সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন কৃষক সংগঠনগুলি দিল্লি সীমান্ত থেকে ফিরে গিয়েছিল, সম্যুক্ত কিষাণ মোর্চাকে (এসকেএম) লেখা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব সঞ্জয় আগারওয়াল বলেছিলেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত ইস্যুর সমাধান বের করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আগারওয়ালের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে, এমএসপির পাশাপাশি তাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে কৃষির ব্যয় ও পণ্যের মূল্য বিষয়ে কমিশনের কর্মকাণ্ড, প্রাকৃতিক ও জৈব কৃষি ইত্যাদি। এসকেএম-এর তিন প্রতিনিধিকে এই কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এসকেএম তা গ্রহণ করেনি এবং ওই কমিটিতে যোগ দেয়নি। সেই কমিটির রিপোর্ট এখনও আসেনি। এর ফলে যে কৃষকরা বলেছিলেন এই কমিটি গঠন আসলে একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার তাঁদের কথাই সত্যি হয়েছে। সরকার সম্ভবত উপলব্ধি করেনি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ইস্যুটি এত সহজে যাওয়ার নয়।

গোটা দেশে কৃষকদের আয় হয় খুব কম, নয়ত হ্রাসের দিকে। যে সব রাজ্যে ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, সেখানকার উৎপাদনশীলতা পড়তির দিকে এবং কৃষির ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। আমরা বলতে পারি, কৃষকরা যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে তার সামান্যই তাঁরা ফিরে পান। গত চার দশকে জমির মালিকানার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হওয়ায় কৃষকদের উপার্জন হ্রাস পেয়েছে এবং এর ফলে তাঁদের জীবন যাপনের মানের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবধান ব্যাপক হয়েছে। এদিকে, তথ্যের বিস্ফোরণের ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার যা কিছুই দাবি করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ অনেক গুণ বেড়েছে, অথচ এই সব ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবে কৃষিক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃষক পরিবারের সন্তানদের কাজের সুযোগ কমে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের একটা সর্বজনীন আবেদন রয়েছে কারণ এটি কৃষকদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কৃষকরা ফসলের উৎপাদন ও মূল্য নিয়ে বর্ধিত অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে চান। গম, ধান, আখ, আলু, পেঁয়াজ বা নারকেল—যা-ই চাষ  করুন না কেন, কৃষকরা তাঁদের শস্যপণ্যের ভাল ও স্থায়ী মূল্য চান। আমাদের দৃষ্টিকোণ বদলানো উচিত এবং চিন্তা করা উচিত যে, ভারত ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। এই দেশ নিউজিল্যান্ড বা চিলির মতো নয় যেখানে কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উপায় হিসেবে ভাবা হয়।

বিপুল সংখ্যক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হয় আমাদের এবং আমরা কেবলমাত্র আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভর করতে পারি না। কৃষি উৎপাদনকে আমাদের কৌশলী ক্ষেত্র হিসেবে দেখা উচিত এবং একে খাদ্য নিরাপত্তার দিক দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। দেশে প্রায় ১৪ কোটি জমি-মালিকানা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের কল্যাণই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কাছ থেকে আমাদের বুঝে নিতে হবে, তারা দেশের ২০ লক্ষ কৃষকের উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কারণ তারা শুধুমাত্র খাদ্য আমদানির উপর নির্ভর করে বসে থাকতে চায় না। আমাদের উপভোক্তাদের মানসিকতাও বদলানো জরুরি। তাদের ভাবতে হবে, কৃষকরা তাদের পেট ভরান এবং সে জন্য তাঁদের ভাল মূল্য পাওয়া উচিত। উপভোক্তাদের সঙ্গে কৃষকদের দ্বন্দ্ব তৈরি করার পরিবর্তে যখন আমরা ১২ টাকায় এক কিলোগ্রাম আলু ও ১৫ টাকায় এক কিলোগ্রাম পেঁয়াজ কিনি তখনই এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন: দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কি যায়নবাদকে আড়ালের চেষ্টা! । রামজি বারৌদ

 


ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অনস্তিত্ব সমস্যা নয়, যায়নাবাদ স্বয়ং এক মূর্তিমান সমস্যা ও বিপদ। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করে কী হবে যদি বর্ণবাদী মতাদর্শ হিসেবে যায়নাবাদ ইসরাইলের প্রথম পরিচয় হয় এবং এই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসরাইলের এই চরিত্র যদি ফিলিস্তিনের উপর ক্রমাগত চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্ব কোথায়?

এই মতাদর্শ অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদের জীবনের মূল্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের বিশুদ্ধ বর্ণবাদী রাষ্ট্র কায়েম করাই লক্ষ্য। তাদের এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে বা আহত করেছে।

যায়নাবাদকে যদি সার্বিক ভাবে পরাস্ত করা না যায় তাহলে দ্বি-রাষ্ট্র বা একক-রাষ্ট্রের সমাধান দিয়ে কিছু করা যাবে না। যায়নবাদকে সংস্কার বা ‘সারিয়ে’ তোলা নয়, একেবারে একে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। গাজা ভূখণ্ডে নজিরবিহীন ভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে যখন সেই সময় পশ্চিমা রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। কিন্তু এখন কেন? ইসরাইল যখন সব রকমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে তখন এই রাজনীতিকরাই ও তাঁদের সরকার নীরব থেকেছে বা ইসরাইলের বর্বর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়েছে।

তাঁদের নৈতিক মূল্যবোধ বা বিবেক জাগ্রত হয়নি। ইসরাইল যখন নিয়ম করে ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করছে তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁরা স্বদেশের মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে ইউএনআরডব্লিউএ-র সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস গানস বলেছিলেন, “মানব ইতিহাসে এটাই প্রথম গণহত্যা যেটা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে।” এই গণহত্যা বর্তমানে আরও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে কারণ ফিলিস্তিনিরা অনাহারে মারা যেতে বসেছে। আবার সেখানকার বহু মানুষ রোগ, দূষিত জলের কারণে মারা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলের বোমা ও গুলিবর্ষণ তো রয়েছেই।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতো অনেকেই বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া “দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি”। কিন্তু এটা হল এই বিষয়ে ন্যূনতম কথা। কেননা প্রতিদিন যারা বাঁচার জন্য লড়াই করে চলেছে তাদের কাছে পশিমা রাজনীতিকদের এটা আরও একটা ফাঁপা বুলি ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়। এ নিয়ে তারা ভাবিতও নয়। গাজা ভূখণ্ডে যে গণহত্যা চলছে তা আমাদের বলে দেয়, এই ইস্যু কেবলমাত্র রাজনৈতিক নয়, সেই সঙ্গে এটা মতাদর্শেরও। পশ্চিমা নেতারা যখন “দীর্ঘমেয়াদি শান্তি”র কথা বলেন, তখন ইসরাইল তাদের সহিংসতা ও জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় ও বাড়িয়ে তোলে।

চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গির বলেছিলেন, “এমন পরিস্থিতি কখনও আসতে পারে না যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নারী ও শিশুরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। সবাইকে (…) বুলেটবিদ্ধ করা হবে।”

গাজা ভূখণ্ডে সহিংসতা ব্যাপকাংশে অসুস্থকর। ইউরো-মেড মনিটর নামে এক অধিকার সংগঠন ১২ ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, “ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটককৃতদের অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দেখার জন্য দশ-কুড়ি জন করে ইসরাইলি সাধারণ মানুষকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং তারা হাসতে হাসতে সেই দৃশ্য রেকর্ড করে।” ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর মারাত্মক নিগ্রহ ও নির্যাতন করে ইসরাইলি সৈন্যরা।

এই সব কর্মকাণ্ডের কোনও যৌক্তিক রাজনৈতিক ন্যায্যতা থাকতে পারে না। এগুলির (গণহত্যার ভাষা, গণহত্যা স্বয়ং ও বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত করার হুমকি) শিকড় যুক্তিগ্রাহ্য রাজনৈতিক তত্ত্বে নেই, রয়েছে যায়নাবাদে। সমস্যা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে কারণ আমরা সমস্যাটিকে সমাধান করতে চাইছি না। প্রকৃত প্রস্তাবে, অনেকে ঠিক এর উল্টোটা করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সরকারগুলি যায়নাবাদের সমালোচনা ও সেমিটিজম-বিরোধীতাকে সমগোত্রীয় প্রমাণ করতে আইন পাশ করেছে বা করছে। এমনকি, ফেসবুকও ‘যায়নবাদী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ করতে চায় যদি তা ইসরাইলকে সমালোচনা করতে ব্যবহার করা হয়।

ইসরাইলের হেরিটেজ মন্ত্রী আমিচাই এলিয়াহু ৫ নভেম্বরে গাজায় পরমাণু বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন যখন,  সেই সময় অনেকে তাঁর নিন্দা করেছিলেন অনুপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করার জন্য। অথচ পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা নিয়ে কেউ সমালোচনা করেননি। ইসরাইলের কয়েকজন কর্মকর্তাও এলিয়াহুর সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তা মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের ভাবমূর্তি ক্ষতি করার জন্য।

যাইহোক, ইসরাইলের ওই মন্ত্রী কেবলমাত্র রাগে উন্মত্ত হয়ে ওই মন্তব্য করেননি। তিনি জেনেবুঝেই বলেছিলেন কারণ তারপর থেকে গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা করার এই ইচ্ছা সত্যিই তাদের মধ্যে রয়েছে।

টিকে থাকার জন্য যায়নবাদীরা যা কিছু করতে পারে এবং তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে আছে কাল্পনিক শত্রুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উপর। বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক বা এমনকি সাংস্কৃতিক ভাবে ‘ধ্বংস’ করে দেওয়া নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে যে জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান চালানো হয়েছিল তা নাকবা নামে পরিচিত। ইসরাইলের সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতেই এই মারাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘শত্রু’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র টিকে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধ অব্যাহত রাখায় ও তাদের সমষ্টিগত অধিকার দাবি করায় ইসরাইলের মূলধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বর্তমানে জায়গা করে নিয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা।

যদি গাজার পতন হয় তাহলে বাকি ফিলিস্তিনের সকল ফিলিস্তিনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে ইসরাইলি সহিংসতা, জাতিগোষ্ঠী সাফাই ও প্রয়োজন হলে গণহত্যার। নতুন রাজনৈতিক সমাধান সূত্র সন্ধান করার নামে ইস্যুটিকে লঘু ও খাটো করার অর্থ হল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে মিথ্যা আশা বিক্রি করা এবং মূল ইস্যু অর্থাৎ ইসরাইলের যায়নবাদী মতাদর্শকে আড়াল করার চেষ্টা। সমস্ত বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মতো যায়নাবাদও উপনিবেশিত ভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শূন্য-দায়বদ্ধতার নীতি নিয়ে চলে। তাদের মূল কথা হল, জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নকরণ ও গণহত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার।

“দীর্ঘস্থায়ী শান্তি”র জন্য যায়নবাদ নির্মূল হওয়া প্রয়োজন।

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক

হলদোয়ানি সহিংসতা আসলে ইতিহাস মুছে ফেলার ছক: হর্ষ মন্দার

 



বিশেষ প্রতিবেদন

 

হর্ষ মন্দার। মানবাধিকার কর্মী। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নির্যাতিতদের প্রতি সংহতি জানাতে তিনি ‘কারওয়াঁ-এ-মহব্বত’ প্রচার শুরু করেছিলেন। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারিতে ঘটা হলদোয়ানি সহিংসতাকে তিনি “শরীরি নিগ্রহ ব্যতিরেকে মুসলিম আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন” করার প্রয়াস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে মন্দার সতর্ক করেছেন, ‘অখণ্ড ভারত’ নির্মাণের নামে গোটা ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ফিরে ফিরে আসতে পারে। মিডিয়ার একাংশসহ দক্ষিণপন্থীরা অখণ্ড ভারতের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ও এই ভাষ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে।

মন্দার বলেছেন, “এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, এটাই কি তার বহিঃপ্রকাশ? প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও হলদোয়ানি মেরুকরণের শিকার হয় রাজ্য সরকারের মদতে এবং এর ফলে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি পায়। তাই আমাদের বোঝা জরুরি, হলদোয়ানিতে ঠিক কী ঘটেছিল।”

উত্তরাখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা নৈনিতালে অবস্থিত হলদোয়ানি। এখানকার শাসক বিজেপির পুষ্কর সিং ধামি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ এলাকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার গ্রাসে চলে গেছে। মন্দার উল্লেখ করেছেন, গেরুয়া দলের বর্তমান লক্ষ্য হল, গোরস্থানের মতো ধর্মীয় জায়গা, স্মৃতিস্তম্ভ বা ধ্বংসাবশেষকে মুছে ফেলা।

 

হলদোয়ানি সহিংসতা: ২০২৪

জবরদখলের অভিযোগে বনভুলপুরা জেলা প্রশাসন একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ঘটে। বিপুল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ১০০-র বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে মোতায়েন করা হয়েছিল। পাশাপাশি, বাড়িঘরগুলি যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন স্থানীয় হিন্দুরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। এর ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।

সরকারি নথি বলছে, পুলিশের সঙ্গে এই সংঘর্ষে ছয়জন মারা গেছে। এদের অধিকাংশই মুসলিম। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরও এই সহিংসতার বলি হয়েছে। এই অশান্তির পর জেলা প্রশাসন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় এবং সমস্ত স্কুল ও কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দুই দিন পর, পুলিশ ১৯ জন নামধারী ও ৫ হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী, কথিত মূলচক্রী আব্দুল মালিক-সহ ৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

১৭ ফেব্রুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও উঠে আসে। তাতে দেখা যায়, এফআইআরে উল্লেখিত মালিক-সহ ৯ ব্যক্তির বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করছে পুলিশ। এক জেলা দেওয়ানি আদালত অভিযুক্তদের সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দেয়। পুলিশ কর্মকর্তারা এক অভিযুক্তের বাড়ির দরজা চুরমার করে দিচ্ছে, এমন ভিডিও ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকে।

 

পরিকল্পিত সহিংসতা

কারওয়াঁ-এ-মহব্বত ও অন্যান্য অধিকার গোষ্ঠীর সহায়তায় অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস একটি সত্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের শিরোনাম ‘বুলডোজিং পিস: স্টেট ভায়োলেন্স অ্যান্ড অ্যাপাথি ইন মুসলিম সেটলমেন্টস অফ হলদোয়ানি’। এতে অভিযোগ তোলা হয়েছে, হলদোয়ানির সহিংসতা মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুদের উপর পরিকল্পিত ও নিশানাকৃত সহিংসতা। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার ও র‍্যাডিকল দক্ষিণপন্থী নাগরিক গোষ্ঠীগুলি মিলিতি ভাবে মারাত্মক মেরুকৃত ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এর মধ্যে বহু ক্ষতিকর ও বিরক্তিকর বিষয় রয়েছে।

 

২০২২: অনুরূপ প্রচেষ্টা

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে হাইকোর্টের নির্দেশে রেলের জমি থেকে মানুষজনকে উৎখাত করার খবর পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত জমি বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের। এটাও ছিল হলদোয়ানির একই বনভুলপুরা এলাকায়। এই এলাকায় বসবাস করা হাজার হাজার বাসিন্দা রেলে জমি থেকে তাদের বাড়িঘর উপড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। পরিকল্পিত উচ্ছেদ অভিযানে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত এবং বলেছিল, একটা কার্যকরী সমাধান বের করতে হবে।

 

অন্যান্য নিশানাস্থল

চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে জবরদখল-বিরোধী অভিযানের নামে দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) আগাম নোটিশ ছাড়াই ৬০০ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নয়াদিল্লির মেহরাউলির আখন্দজি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ১২০০ সালের আগে। যাইহোক, ডিডিএ-র বক্তব্য অনুযায়ী, এই মসজিদ দাঁড়িয়েছিল জবরদখল করা জমিতে।

এই মসজিদের ইমাম জাকির হুসেনের মতে, ফজরের আজানের আগে গোটা ধ্বংসপ্রক্রিয়াটি ঘটেছিল। তাঁর অভিযোগ, মানুষের চোখের সামনে থেকে ধ্বংসযজ্ঞকে আড়াল করতে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, “ডিডিএ কর্মকর্তারা আমাকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেননি। কর্মকর্তারা জোর করে আমার ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন যাতে ধ্বংস চলাকালে আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি।” পাশাপাশি তিনি যোগ করেন, মসজিদের মধ্যে রাখা পবিত্র কুরআন বের করে আনারও অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডিডিএ পাঁচটি ইসলামি সৌধ ভেঙে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দরগা সুনেহরি বাবা ও দরগা হজরত কুতুব শাহি চিস্তি। এগুলি নয়াদিল্লির অশোক রোডে ভারতের নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরের বাইরে অবস্থিত।

 

হিন্দু-রাষ্ট্র নির্মাণ চলছে?

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ‘দিস উইক ইন এশিয়া’তে বলেন, ভারতকে কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ বানানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইসরাইলি সেনা বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনি জনগণের চলমান হত্যার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা যখন গণহত্যার কথা বলি, তখন এই গণহত্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সাংস্কৃতিক উচ্ছেদ বা বহিষ্কার। গাজাতে দেখুন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-স্মৃতি মুছে ফেলতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব-সম্বলিত পুরাতাত্ত্বিক সৌধ ও ভবনগুলিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ইসরাইল। একই ভাবে, ভারতে আরএসএসের এটাই লক্ষ্য।” অপূর্বানন্দ আরও বলেন, “অবৈধতা ও আক্রমণকারীদের প্রতীক বলে আপনারা মাজার ও মসজিদগুলিকে ভেঙে দিচ্ছেন এবং আদালতগুলিও মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে যেহেতু কোনও প্রাণহানি হয়নি। ফলত, আপনি দুটি বিষয় অর্জন করলেন—আপনি এক জনগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিলেন এবং হত্যা না করেই তাদেরকে ক্ষমতাহীন করে ফেললেন।”

 

তরজমাঃ জিয়াউল হক

বিবিধ মস্করা ও অন্যান্য দাবি। জিয়া হক



আমার ভিতরে একদিন নেমে যেতে যেতে

উপরে তাকিয়ে দেখি সে, যেন বলছে

উঠে এসো উঠে এসো

সে আমার অচেনা নয়, দেখেছি বাজারে

যেন বলি, নেমে এসো নেমে এসো,

যা যা চাও তুমি পাবে, হামলাকারীর খাজানা এখানে

আমার সমস্ত প্রসাধনী পড়ে আছে, সকল কৌশল

নিন্দা পাওয়া মুখ, আনন্দময় পিঠ, ধাক্কা খাওয়া গলা

সবই আছে, এসো, তোমারই সুবিধা হবে পরে

তদবির করে সে, বলে, সোনার সঞ্চয় কি নেই?

তোমারই গুহা এটা? তোমারই বিষ্ঠায় ভরপুর?

অপর জলাশয় দেব, সেইখানে নেমো, দেখবে

তুমি তত অত্যাচারী নও, তুমি নও যেমনটা সাব্যস্ত হল

প্রচুর প্রেমের ভারে আমি নুয়ে আছি, অনেক রক্তের ভারে


নেমে গেলে বহু পাবে? উঠে এলে পাবে না কিছুই?

বইপাঠ: কোহেনের কবিতা: তরজমায় অর্ণব চৌধুরী ও শুভ মৈত্র


 লিওনার্ড কোহেন এক জায়গায় বলছেন, তিনি ধাপ্পাবাজ; কখন ধাপ্পা দেন? আদর করার সময় তিনি এই আপাত অনৈতিক কাজটা করেন এবং লজ্জাহীনভাবে তিনি দাবি করছেন, ধাপ্পা দিতে 'দারুণ' লাগে তাঁর। আদরকালীন থমথমে মুহূর্তে কীভাবে প্রতারণা করা সম্ভব? তাহলে কি তিনি 'যৌন অসততা'র কথা বললেন? প্রেমে ফাঁকিবাজি থাকতে পারে সম্ভবত, কিন্তু আদরে? আনন্দের খবর হল, তিনিও মেয়েটার তথাকথিত ধাপ্পাবাজি ধরতে ও বুঝতে পারেন, টের পান, উপলব্ধি করেন এবং এ নিয়ে তিনি বিব্রত বা উদ্বিগ্ন নন; অর্থাৎ সার্বিক ও চূড়ান্ত পজেসিভনেশজনিত আধিপত্যবাদী দেহবাসনা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন এবং নিজেকেও চিনতে পারলেন এইভাবে যে, সম্পর্কে কাতরতাচিহ্নিত আর্তি একপাক্ষিক নয়। রাজা যেমন রাজার আচরণ প্রত্যাশা করেন, কোহেনও তেমনই চাইছেন, একজন প্রতারকের প্রাপ্য ধাপ্পাবাজিটুকুই। মানুষের সম্পর্ককে 'রসায়ন' বলে বিজ্ঞাপিত করা হলেও তা কার্যত অর্থনীতি ও রাজনীতি—এই কথাটুকু সহাস্যে ঘোষণা করলেন তিনি একটা কবিতায়। কোহেন এরকম 'ইনকারেক্টনেস' নিয়ে রয়ে গেছেন পণ্যবাজারে। 

বইটি নাগালে এলো বইমেলা থেকে।

চমৎকার অনুবাদ করেছেন কবি শুভদীপ মৈত্র ও অর্ণব চৌধুরী। ব্রতীন সরকার জহুরির মতো ময়দান থেকে যে মুক্তো সংগ্রহ করেছেন তা ঝুটো নয়।


নেলি হত্যালীলার ৪১ বছর। সুরজ গগৈ



নেলি হত্যালীলার ৪১ বছর: নয়া ভারতের এক প্রাক-গোধরা অধ্যায়


১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেলি হত্যালীলার পর ৪১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীন ভারতের অন্যতম ভয়াবহ সহিংসাত্মক ঘটনা হিসেবে একে দেখা হয়। সরকারি হিসেবে এই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ১৮০০ থেকে ২০০০ জনের মধ্যে, কিন্তু বেসরকারি খাতায় এই সংখ্যাটা ৭ হাজারের কাছাকাছি। এখন প্রশ্ন হল, অসমে ঘটা এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয় বা নিগৃহীতদের আত্মপরিচয়ের কাছে এই সংখ্যার গুরুত্ব কতখানি। ওই ম্যাসাকারের প্রতীকী সহিংসতা বর্তমানে অসমের সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে বেড়ায়।


নেলিতে সর্বোপরি ‘বাংলাদেশি’দের প্রতি একটা ভীতিমূলক ও ঘৃণাপূর্ণ ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছিল এবং অসমের “আদি” বাসিন্দাদের শত্রু হিসেবে তাদেরকে দেগে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯-১৯৮৫ সালে অসম আন্দোলনের সময় বিহারি ও নেপালিদেরও বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ ও এনআরসির মাধ্যমে আইনি ভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে। আজকের দিনে অসমে তারা গণশত্রু এবং তাদের মানবিক অস্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বিজেপি।


অসম আন্দোলনের আবহে ১৯৮৩ সালে অসমে সংঘটিত নেলি ও অন্যান্য ম্যাসাকারের নির্যাতিতরা বেশিরভাগই ছিল বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম এবং এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। বস্তুত, দেবব্রত শর্মার মতো গবেষকরা অনুসন্ধান করে বের করেছে, অসম আন্দোলনে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মূলত বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম, এসসি-এসটি-ওবিসি সংখ্যালঘু ও বাম কর্মীরা। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ও সত্য। এর ফলস্বরূপ বর্ণ অসমিয়ারা এক প্রকার “আদি বাসিন্দাসুলভ” সুবিধা ভোগ করে। অসমিয়া জাতীয়বাদের পরিণতিতেই সংঘটিত হয়েছিল নেলি হত্যাকাণ্ড।


হত্যাযজ্ঞের দিনই যুক্তিবোধকে খুন করা হয়েছিল এবং ঘরোয়া সহিংসতা এর সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। বর্ণ অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য উপযুক্ত মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল এটি। সেই সঙ্গে অসমিয়া জাতীয়বাদে বিশ্বাসীরা নৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। নেলিতে ওই ঘটনা না ঘটলে সিপাহঝড়ে মইনুল হকের সঙ্গে ওই নেক্রোফিলিয়াক আচরণ করতে পারত না বিজয় বনিয়া।


নেলি অসমিয়াদের মানসজগতকে আমূল বদলে দিয়েছিল এবং তা খারাপের দিকে। এই হত্যালীলা বর্ষপূর্তিতে অপরাধবোধহীনতা ও নীরবতা কার্যত সামাজিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরে। এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও নেলিকে ভুলে গেছেন। ফ্রাঞ্জ ফ্যানোঁ যথার্য বলেছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্ছিন্নতাতেই মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়। আঞ্চলিক গণমাধ্যমও এই বিষয়কে পরিত্যাগ করার পথে হাঁটছে ও গভীর নীরবতা পালন করছে। এরা কার্যত ওই বুদ্ধিবৃত্তিহীন মধ্যবিত্ত সমাজেরই সম্প্রসারিত অংশ। ফ্যানোঁ সঠিক ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে “রুদ্ধ সমাজ” হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এমন এক সমাজে যেখানে কারও রুচিবোধ নেই, “আইডিয়া ও মানুষ” অসৎ, নীতিভ্রষ্ট ও দুর্নীতিগ্রস্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই সমাজ গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ এবং এরা অগ্রগতি ও উদ্ভাবনের পরিপন্থী।


অসমে বড় হওয়ায় আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি, এটা একটা রুদ্ধ সমাজে পরিণত হয়েছে। বিদেশী অর্থাৎ ‘বাংলাদেশি’দের বাইরে তারা কিছু দেখার ক্ষমতা হারিয়েছে। বাংলাদেশিদের নিয়ে এই বদ্ধমূল ধারণা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একটা স্বতন্ত্র সামাজিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধারণার ভিত্তিমূলে রয়েছে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অসমের রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন এমন বহু লেখক এমনটাই যুক্তি দিয়েছেন।


আত্মপরিচয় নিয়ে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশিদেরকে ‘অবজেক্টিফাই’ করা ও অসমিয়াদের আত্মরতি রয়েছে। একজন বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখা হয় না, বরং তাদের সম্পর্কে গড়ে তোলা কিছু বদ্ধমূল ধারণা থেকে দেখা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮১-১৯৮২ সালে অসম সাহিত্য সভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন সীতানাথ ব্রহ্মচৌধুরী। তিনি ময়মনসিংহ বংশোদ্ভূত কৃষকদের “মাটি-লোভী” তকমা দিতেন। পূর্ব বাংলার অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে ১৯৩১ সালে করা সিএস মুলানের সেনসাস রিপোর্টের প্রভাব আমরা এ ক্ষেত্রে দেখতে পারি। মুলান শুধু অভিবাসীদের মাটি-লোভীই বলেননি, সেই সঙ্গে অভিযোগ তুলেছিলেন যে, এই অভিবাসীরা লাখ লাখ একর জমি জবরদখল করে নিচ্ছে। সমস্ত কৃষক ও অভিবাসীদের সম্পর্কে এই ধরনের মতামত শুধু সমস্যাজনক ও বেঠিকই নয়, পাশাপাশি আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে এই ধারণা।


নেলির মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল সাহিত্যিক সমাজও। একদল সাহিত্যিক লাগাতার অভিবাসীদের নিয়ে বিষোদ্গার করে গেছেন। ‘বিদেশী’দের প্রতি এতটাই তীব্র ও প্রসারিত ছিল সমষ্টিগত ঘৃণা। ডব্লিউ ই বি ডুবয়েসের থেকে একটা রূপক ধার করে বলা যায়, বাংলাদেশিদের দেহের উপর একটা আবরণ বা পর্দা তৈরি করেছিল নেলি। আর এই আবৃত দেহে বারবার নানা ধরনের হিংসাত্মক নিগ্রহ আছড়ে পড়েছে।


বাঙালি বংশোদ্ভূত মায়েদের মাতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের পরিবারগুলির নাগরিকত্বকে নাকচ করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের জমি, তাদের শরীরকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদেরকে বস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, তারা বিষাক্ত, কেউ তাদের চায় না। অসমিয়া সমাজ ও ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখানোর ফাঁদে তারা আটকে পড়েছে। দেওয়ালে যেমন পরজীবী লতাগুল্ম গজায় তেমনই নেলির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এদের সঙ্গে অব-মানবের আচরণ করা হচ্ছে।


মিয়া মুসলিমদের সম্পর্কে বর্তমান সরকারের বিবিধ রাজনৈতিক মন্তব্য ও একাধিক আইনি নিষেধাজ্ঞা আসলে ক্রমবর্ধমান ঘৃণাকেই প্রতিফলিত করে। অসম গবাদি পশু সুরক্ষা আইন ২০২১, অসম রিপিলিং আইন ২০২২ (এর মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষায় জনগণের অনুদানকে বন্ধ করা হয়েছে), নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা নির্ধারণ, সবজির মূল্যবৃদ্ধির জন্য মিয়া মুসলিমদের দায়ী করা (ফুড জিহাদ), প্রকাশ্যে ঘোষণা করা যে, নির্বাচনে জিততে মিয়াদের ভোট দরকার নেই বিজেপির, তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিযুক্ত করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং শিলচরে বন্যার পর তাদের বিরুদ্ধে ‘ফ্লাড জিহাদে’র অভিযোগ আনা—এই সবই যদি বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ না হয় তাহলে কাকে বলব বর্ণবাদ?


বর্তমানের ঘটনা পরম্পরা থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সূচনা-মুহূর্ত ছিল নেলির হত্যালীলা। সেই ম্যাসাকারের এত বছর পরও আরও সহিংসতার আয়োজন করা হচ্ছে তথাকথিত ‘বিদেশী’দের দেহভূমির উপর। ব্যাপক ঘৃণা জমে রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাদের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে আক্রমণ করার নানা রকম পথ বের করা হচ্ছে।


তরজমা: জিয়াউল হক 

বইপাঠ: সলতে পোড়া ছাই। সরোজ দরবারের উপন্যাস



একটি বই হাতে পেলাম। উপন্যাস। 'সলতে পোড়া গন্ধ'। এই বইয়ের শেষে দাবি করা হয়েছে, এটি 'কোনও অর্থেই সুখপাঠ্য নয়'। অথচ পাঠ করে সুখই পেয়েছি কেননা গদ্যটা ভাল। পাকা হাত। শব্দের বুনন ও বিন্যাস সম্পর্কে লেখকের ধারণা পরিষ্কার। গুরু-গাম্ভীর্যের ভিতর লঘুতার ভারসাম্য থেকে বোঝা যাবে, এই লেখক সতর্ক ও সচেতন। যতি ও অনুচ্ছেদ সম্বন্ধে স্পষ্ট চিন্তা রয়েছে। 

ব্লার্বকল্প লেখায় আরও দাবি, এই উপন্যাসে 'উচ্চকিত নাটকীয়তা নেই, মোচড় নেই'। তিনটি শব্দ ভাবাচ্ছে—উচ্চকিত, নাটকীয়তা ও মোচড়। এগুলির সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা কী? কোন উপাদানের হেরফেরে লেখা 'উচ্চকিত' হয়ে পড়ে? কথিত মোচড় কি একেবারেই নেই! 'উচ্চকিত' শব্দটি সুশীল সমাজে খানিক নেতিবাচক হয়ত। যদিও মাঝ-দুপুরের সূর্য, ভরা-জোয়ারের ঢেউ উচ্চকিতই। আর জীবন নিজেই অসংখ্য নাটক ও নাটকীয়তার সমাহার। তবে, লেখক সাযুজ্য বিধান করবেন, সুষমতা বজায় রাখবেন, এমনটাই অনেকের কামনা। 

এই বইয়ের গল্প বলব না। কিন্তু যদি বলতে পারতাম তাহলে উক্ত দাবিগুলি খতিয়ে দেখা যেতে পারত। একটি প্রমাদ চোখে পড়ল—বইটির নাম 'সলতে পোড়া গন্ধ' হলেও স্পাইনে লেখা হয়েছে 'সোনার বাড়ি জমি'। যাইহোক, রোকু নামের একজন প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন। প্রচ্ছদ-শিল্পী হিসেবে রোকুর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে হচ্ছে। সরোজ দরবার নামের এক ব্যক্তি এই বইয়ের রচয়িতা। তাঁর শব্দযান অক্ষয় হোক।


জিয়া হক 

রাফাহ, ফিলিস্তিন ও ইসরাইল। তরজমা


 

আমাকে নিয়ে চলো। গদ্য। জিয়া হক

 


আমাকে নিয়ে চলো।

তুমি তাহলে যেতে চাও?

হ্যাঁ।

এই বাড়ি, শহর, রাতের সুন্দর খাবার, সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো আর ভালো লাগছে না?

আমি একবারও বলিনি আমার এসব ভালো লাগছে না।

তাহলে?

ভালো লাগা থেকে কোথাও চলে যেতে পারে না কেউ?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারে। কোনও কারণ ছাড়াই চলে যেতে চাও?

আমি ঘুরতে ভালোবাসি না, জায়গায় জায়গায় ঘুরে ঘুরে নানারকম খাবার খাওয়ার লোভও আমার নেই, বরং পুনরাবৃত্তিই আমার প্রিয়, একটা বই একই জায়গায় আমি সব সময় পড়ে থাকতে দেখতে চাই, তারপরও আমি এবার যেতে চাই।

কিন্তু যেখানে যাবে সেখান থেকেও তো একদিন পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করবে।

তখন পালাবো।

তাহলে গিয়ে কাজ কী?

তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গরম করে নিয়ে আসি। এইখানে বসে থেকো। কোথাও উঠে যেও না। যেভাবে বসে আছো সেইভাবে বসে থাকবে। চুল যেমন আছে তেমন থাকবে, হাত বুলিয়ে অন্যরকম করে দেবে না। তুমি আমার কেউ নও, অথচ তোমার কাছে আমার কত দাবি, তাই না?


আমি ঠাণ্ডা চা-ই খাবো। তুমি বসো। বলো, আমার কাছে এত দাবি কেন তোমার?

গান শুনবে? একটা নতুন গান শিখেছি।

আগে উত্তর শুনবো। তারপর গান শুনবো।

জানালাটা খুলে দিই? মনে হয় মেঘ করেছে। মেঘলা আকাশ দেখতে তুমি পছন্দ করো। করো না?

তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো আমার প্রশ্ন যেটা আসলে তুমিই তুলেছিলে।

আমি তুলেছিলাম, আমিই চাপা দিয়ে দিচ্ছি। আর একে খুঁড়ে বের করে এনো না। খুঁড়লে সব সময় গুপ্তধন পাওয়া যায় না, কঙ্কালও উঠে আসে।

আমার গুপ্তধন চাই না, কঙ্কালও চাই না। আমি শুধু প্রশ্নের উত্তর চাই।

তোমাকে একটা গল্পের বই দেবো, সেখানে তোমার প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। আমি বলতে গেলে তেমন করে বলতে পারব না।

আমি তো বইয়ের কথা শুনতে চাই না। তোমার কথা শুনতে চাই।

তোমাকে একটা সিনেমা দেখাবো, সেখানে তোমার প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।

নিজের কথা বলে তোমার কিছু নেই? সব ধার করা?

কে কার কাছ থেকে ধার করেছে? আমি তাদের থেকে না তারা আমার থেকে? সব ছবি, গল্প, গানেই তো আমি আছি, তুমিও আছো। নেই?

জানি না। আমার জানার কথাও নয়। কথা কি?

তেমনই তো কথা ছিল বলে জানতাম। কবে সংশোধন হল জানতে পারলাম না কেন?

তুমি আমাকে সরল ভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছো না।

সারল্য বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?

যা জটিল নয়।

জটিলতা কী?

তুমি জটিল। এখন নিজেকে বিচার করে দেখো জটিলতা কেমন।

মানে তুমি সরল। তাহলে নিজেকে বিচার করে বলো সরলতা কেমন।

আমার প্রশ্নটা শুধু হারিয়ে গেল। সেটা কি ঠিক হল?


জিয়া হক 

 


উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে চিন! : রুশান আব্বাসের সাক্ষাৎকার


 

রুশান আব্বাস উইঘুর সমাজকর্মী। চিনে উইঘুর মুসলিমদের নৃশংস অত্যাচার নিয়ে তিনি সরব। আব্বাস জানিয়েছেন, গণহত্যা চালানো হচ্ছে এবং চিনা কনসেন্ট্রেশন শিবিরে বন্দি করে রাখা হচ্ছে উইঘুরদের। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস অঞ্চলে জন্ম আব্বাসের। ক্যাম্পেন ফর উইঘুর নামে একটি সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী অধিকর্তা। চিনের জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস রিজিয়ন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট ফরেন রিলেশনস কমিটিতে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিন কীভাবে মূর্তিমান বিপদ হয়ে উঠছে তা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তাঁর বড় দিদি গুলশান আব্বাসকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিনারা পণবন্দি করেছিল। প্রথমে চিনা সরকার সেই কথা স্বীকার করেনি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রী স্বীকার করেন যে, গুলশানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ চাপানো হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। রুশান ও তাঁর পরিবার এখনও জানেন না, গুলশান জীবিত রয়েছেন কি না। আইএএনএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উইঘুরদের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন রুশান।

প্রশ্নঃ বর্তমানে উইঘুর সমস্যা নিয়ে আমাদের বলুন।

উঃ কয়েক বছর ধরে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার শিকার। 'পুনর্পাঠে'র নামে লক্ষ লক্ষ উইঘুরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। কয়েক লক্ষকে আবার দাসে পরিণত করা হয়েছে। উইঘুর মেয়েদের শরীর এই গণহত্যার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাদের জোর করে বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে, গর্ভপাত করানো হচ্ছে এবং বলপূর্বক বিয়ে করানো হচ্ছে। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি তাদের অফিসিয়াল ট্যুইটারে প্রকাশ্যে এই ধরনের কাজকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তারা দাবি করছে, তাদের এই দুর্ব্যবহারের কারণে উইঘুর মহিলারা কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে। এক লক্ষ উইঘুর শিশুকে সরকার পরিচালিত অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেজিং-এর চরম জাতীয়তাবাদী নীতি, বর্ণ-বৈষম্য ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের জন্মভূমির উপর নিগ্রহ চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি থেকেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যায়।

প্রশ্নঃ আপনার দিদি গুলশান আব্বাসকে জোর করে চিনা সরকার ধরে নিয়ে গেছে এবং আপনার পরিবারের কাছে তাঁর সম্পর্কে কোনও খবর নেই। তাঁর সঙ্গে কী ঘটেছে বলে আপনার ধারণা? এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনগুলি থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

উঃ আজ আমি আমার প্রিয় বোনের স্বাধীনতার বিনিময়ে আন্দোলনের কাজ করে চলেছি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমার দিদি গুলশান আব্বাসকে তাঁর উরুমচির বাড়ি থেকে চিন সরকার পণবন্দি করে। এর ছয় দিন আগে, ওয়াশিংটন ডিসিতে এক চিন্তাবিদের সঙ্গে আমি চিনের গণহত্যাকারী নীতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমার হারিয়ে যাওয়া দিদির ঘটনা নিয়ে আমি যখন প্রশ্ন তুললাম তখন চিনের সরকারি মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে অন্যের ছবি চুরি ও আমার নিরুদ্দিষ্ট দিদির সম্পর্কে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ করে। তারপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিনের বিদেশ মন্ত্রক দিদির নামোল্লেখ করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগের ভিত্তিতে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কোনও বিচার নেই, কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনও খবর মেলেনি। পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার ও কথা বলার অধিকার কারাবন্দিদের থাকে। কিন্তু এ কেমন ধরনের কারাব্যবস্থা যেখানে এগুলিকে অনুমতি দেওয়া হয় না? আমার দিদি অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার এবং শান্তিপ্রিয় ও অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই তাঁর আটক ও কারাদণ্ডের মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে অন্যান্য উইঘুরদের চুপ থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। নীরব না থাকলে প্রিয়জনদের এমনই অবস্থা হবে।

প্রশ্নঃ চিনা সরকারের হাতে উইঘুররা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার। ঠিক কী হচ্ছে সেখানে, আমাদের জানান।

উঃ ১৯৪৯ সালে আমাদের জন্মভূমি দখল করে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর থেকে চিনের চাপানো কঠোর নীতির ভিতর দিয়ে দিনযাপন করছে উইঘুররা। সেই নীতি আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের বিরোধী। স্কুল ও কলেজে আমাদের ভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পাঠ্যে কাঁচি চালানো হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পালন ও অনুশীলন করার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে এবং কোনও রকম বাক-স্বাধীনতা নেই। এই ভাবে চিনা সরকার আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে উইঘুররা সক্রিয় গণহত্যার সম্মুখীন। জেনোসাইড কনভেনশনের ২ ধারায় যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে এই গণহত্যার। বর্তমান কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ হল নিম্নে বর্ণিত কোনও কাজ যদি কোনও জাতি, এথনিক, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে ঘটানো হয় তা গণহত্যা, যেমন--

ক) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে হত্যা করা : আমরা প্রত্যক্ষ রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানি যে, নির্যাতন, অপুষ্টি ও মৃত্যদণ্ডের কারণে কারাগার ও শিবিরে মানুষ মারা যাচ্ছে।

খ) কোনও গোষ্ঠীর সদস্যকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা : এখানে মানুষ শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। কারাবন্দিদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। খাদ্য দেওয়া হচ্ছে না। এমন পদার্থ তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা জোম্বিদের মতো অবস্থায় চলে যাচ্ছে।

গ) এই তথ্য সবাই জানে যে, উইঘুরদের, বিশেষত মহিলাদের, জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে হান চাইনিজদের সঙ্গে এবং বিয়ে করতে অস্বীকার করাকে উগ্রবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ফলে শিবির বা কারাগারে আটক করা হচ্ছে। উইঘুর জনসংখ্যাকে লঘু করে দেওয়া বা সংকর প্রজাতি সৃষ্টি করাই চিনের লক্ষ্য।

ঘ) গোষ্ঠীর জন্মনিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংকরায়ন ঘটানোর কাজ চলছে। শিবিরে আটকে রাখা বন্দিদের বলপূর্বক বন্ধ্যা করে দেওয়া হচ্ছে। গর্ভপাত করানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হচ্ছে। উইঘুর শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে। হান চাইনিজ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা ও কমিউনিজকে নতুন ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্নঃ চিন ও চিনপন্থীদের দাবি, আপনার আন্দোলনের পিছনে নির্দিষ্ট কিছু বিদেশি শক্তির মদত রয়েছে। এই সমালোচনার জবাব দেবেন কীভাবে?

উঃ এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমি একজন উইঘুর-আমেরিকান। ১৯৯৫ সালে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছি। আমেরিকান নাগরিক হিসেবে আমার সংবিধানে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তারই ভিত্তিতে আমি আন্দোলন করছি। আমার দিদির স্বাধীনতা ও যারা গণহত্যার শিকার তাদের জন্য আমার এই লড়াই।

প্রশ্নঃ দেশের মানুষদের অধিকার হরণ করে কি চিন বিশ্বশক্তি হয়ে উঠছে?

উঃ জোর করে শ্রমিক বানানো এমন এক অন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন যেটা চিন করে চলেছে। শিবিরে আটকে রাখা উইঘুরদের বলপূর্বক বৈদ্যুতিন, বস্ত্র ও অটোমোটিভ কারখানায় কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে কাজের পরিবেশ কদর্য। উইঘুরদের তা সহ্য করতে হয়। কাউকে সামান্য মজুরি দেওয়া হয়, কাউকে কিছুই দেওয়া হয় না। তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে যে পণ্য উৎপাদিত হয়ে আসে তা ব্যবহার করে অ্যাপল, অ্যামাজন, বিএমডব্লিউ, নাইকি ও অ্যাডিডাসের মতো বড় বড় ব্র্যান্ড। চিনকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করে তুলেছে যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই, সেখানেও এই শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় কাজ করতে এবং তারা নানা অধিকার ভঙ্গের সমস্যায় ভোগে।

প্রশ্নঃ তিয়ান-আনমেন স্কোয়ারের ম্যাসাকার চিনের জন্য একটা বড় কলঙ্ক। তারপরও কোনও নৈতিক দ্বিধা ছাড়াই এই দেশ এগিয়ে চলেছে। চিন সরকারের ভয়ে কি চিনের ছাত্র আন্দোলন ও মানবাধিকার কর্মীরা নীরব রয়েছেন?

উঃ আমার যখন ১৮ বছর বয়স, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন সরকারি নীতির (১৯৮৫ সালের ১২ ডিসেম্বরে)বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্র আন্দোলনের আমি ছিলাম সহ-সংগঠক। ঐতিহাসিক ভাবে বলছি, ছাত্র আন্দোলন শেষ করে দেওয়া হয় ছাত্রদের বরখাস্ত করে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়ন করে, বন্দি করার মাধ্যমে বা হত্যার মধ্য দিয়ে। চিনে আপনারা যে সব প্রতিবাদ দেখেন, এর অর্থ হল, গুরুতর কিছু ঘটছে যার জন্য মানুষ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।

প্রশ্নঃ চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে মানুষ কীভাবে দিন গুজরান করেন?

উঃ ১৯৪৯ সালে পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করার পর থেকে চিন সরকার অবিরাম চেষ্টা করেছে উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে ধ্বংস করে দিতে। পঞ্চাশের দশকে 'জাতীয়তাবাদী' তকমা দিয়ে উইঘুরদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। ষাটের দশকে তাদের বলা হল 'প্রতি-বিপ্লবী' এবং নয়ের দশকে তাদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হল 'বিচ্ছিন্নতাবাদী'র তকমা। ৯/১১ ট্রাজেডির পর, কমিউনিস্ট রেজিম তাদের অত্যাচার-লীলাকে 'সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে'র ছদ্মবেশে নতুন ভাবে সামনে এনেছে। বর্তমানে পূর্ব তুর্কিস্তানের মানুষ শি জিনপিং-এর আপন প্রকল্প 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড'-এর শিকারে পরিণত হয়েছে। গোটা এলাকাকে ঘিরে রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও ব্যাষ্টিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনা অপরাধে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। সব রকম রাজনৈতিক প্রতিরোধকে চিন 'ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' হিসাবে তুলে ধরছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছে এক নজরবন্দি রাষ্ট্রের। সংগ্রহ করা হচ্ছে ডিএনএ, চারিদিকে লুকনো ক্যামেরা, মুখ-চিহ্নতকারী সফটওয়্যার ও গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকিং লাগানো হয়েছে। শিবিরের এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, তথাকথিত 'কারিগরি প্রশিক্ষণে'র অর্থ হল সশস্ত্র বাহিনী, কাঁটাতার, উপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা ঘর, অপুষ্টি, পানীয় জলের অভাব, বেহাল শৌচব্যবস্থা। এর আরও অর্থ হল, ঘর ও পরিবার থেকে ছিন্নমূল করে দেওয়া, সংস্কৃতি ও ধর্মকে পিষে দেওয়া, জোর করে ধর্মান্তরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আমার জন্মভূমিতে চিনের সামরিকীকরণ অব্যাহত এবং এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সিসিপির কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গণ-পরিযায়ন চলছেই, বদলে যাচ্ছে পূর্ব তুর্কিস্তানে জনবিন্যাস এবং এতে লাভবান হচ্ছে হান চিনারাই। তাই, বহু দেশের স্বীকৃতি ও মিডিয়ার চোখের সামনে সব ঘটার পরও গোটা বিশ্ব যেন নিথর হয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শিবিরে আটকে রাখা লক্ষ লক্ষ উইঘুরদের জোর করে শ্রমিক বানানো হচ্ছে। তাদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। শিবিরের বাইরে বাস করা উইঘুরদের সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখা হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন প্ল্যাটফর্মের (আইজেওপি) মাধ্যমে। কোনও 'সন্দেহজনক' আচরণ শনাক্ত করতে এই ব্যবস্থা। এই লাগাতার নজরদারির ফলে উইঘুরদের চলাফেরা, যোগাযোগ রক্ষা ও মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা নেই। সারাক্ষণ আটক হওয়ার ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চিনের তথাকথিত 'জিরো কোভিড' নীতির আওতায় এই অঞ্চলকে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সার্বিক লকডাউন করে রাখা হয়েছিল। কোনও খাদ্য, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়নি। আধিকারিকরা এসে দরজাগুলিতে তালা ও শেকল ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, রাস্তাগুলি বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ২০২২ সালের নভেম্বরে যখন অগ্নিকাণ্ড 'ঘটে', তখন মানুষ অসহায় ভাবে পুড়ে মারা গিয়েছে।

প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করা হয়, কিন্তু আপনারা যে যন্ত্রণা সহ্য করছেন তা তেমন তুলে ধরা হয় না। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

উঃ আসলে, বিশ্বের অর্ধেক দেশই চিনের উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। এই কারণে, অধিকাংশ দেশ, বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি চুপ করে আছে। মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে মুনাফার গুরুত্ব অনেক বেশি। গোটা বিশ্ব রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিধনকে দেখছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যেন মায়ানমার সরকার এই পাশবিকতা চালাচ্ছে। অথচ, বেজিং রয়েছে এর পিছনে। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প যে সব এলাকার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেখানেই মুসলিমদের রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করতে মায়ানমারকে চালিত করেছে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। মায়ানমারের নেতাদের চিন চাপ দিয়েছে যাতে যে সব এলাকা দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ হবে সেখান থেকে মুসলিমদের উৎখাত করা হয়।

প্রশ্নঃ উইঘুর সমস্যার যৌক্তিক সমাধান কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উঃ জটিল প্রশ্ন। যুক্তি দিয়ে বললে, কোনও দেশের মানুষ যেন গণহত্যার মুখে না পড়ে। কিন্তু বর্তমান মৌলিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে যা দাঁড়িয়েছে তা হল, সকল দেশকে মেনে চলতে হবে যে, কোনও সরকার (এ ক্ষেত্রে চিন) যদি গণহত্যা রুখতে ব্যর্থ হয় বা নির্দিষ্ট পরিমিত বজায় রাখতে না পারে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাহলে, রাষ্ট্রসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছে সেই দেশ জবাবদিহি করতে বা দায় নিতে বাধ্য থাকবে। তাদের উপর চাপানো হবে নিষেধাজ্ঞা, রেজল্যুশন বা অন্য পথও অবলম্বন করা যেতে পারে। কর্তৃত্ববাদী রেজিমগুলি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে আজও, এর কারণ হল, এই ভয়াবহ কাজ রুখতে যথেষ্ট চাপ তাদের উপর নেই। হ্যাঁ, চিনারা উইঘুর গণহত্যার জন্য দায়ী, কিন্তু বাকি বিশ্বও সমান ভাবেই দায়ী, যদি এই গণহত্যা বন্ধ করতে তারা যদি কোনও পদক্ষেপ না নেয় এবং এই রেজিমকে দোষী সাব্যস্ত না করে। গণহত্যা, দাসত্ব ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চিনের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এই ইস্যুর সমাধানের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর এবং সেই সঙ্গে চিনা রেজিমের হাত থেকে উইঘুরদের রক্ষা করাও তাদের কর্তব্য।


অনুবাদ : জিয়া হক

মুক্তাঞ্চল 'বিপ্লব', পাঁচটি 'বাঁকা' তলোয়ার


 কোনও 'অঞ্চল'ই 'মুক্ত' নয়। অধ্যুষিত। সেখানে কার 'স্থান' আর কারই বা প্রস্থান তা জটিল বিষয়। আসলে ততটাও 'জটিল' আর কিছু নেই, প্রায় সবই এখন প্রকাশিত। এই 'জ্ঞান'ই'ই সাক্ষ্য দেয়, একটা 'মুক্তাঞ্চল'-এর খোঁজ করে যেতে হবে জাতিকে। সুন্দরবনের নিকটে গাঙ্গেয় অববাহিকার কয়েকজন তরুণ তেমনই সন্ধান করছিলেন। তাঁরা লাভ করেন, বলা ভাল অর্জন করেন এমন এক 'এনটিটি' যাকে তাঁরা 'শ্যামল বৈদ্য' নামে চিহ্নিত করতে চান। ব্যক্তিনাম বললে ব্যক্তির অবয়ব কল্পনা করা হয়। অথচ 'শ্যামল বৈদ্য' নিরাকার, অবয়বের সীমা ও বদ্ধতা থেকে মুক্ত। শ্যামল বৈদ্যর কোনও সর্বনাম হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তারপরেও সর্বনামাঙ্কিত করতে হয় কথনের প্রয়োজনে। শ্যামল বৈদ্য আমাদের নির্জ্ঞানে, অ-চেতনে ঘাপটি মেরে থাকা সেই আদি বোধ যা অস্তিত্ব-চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। প্রক্রিয়াটার মূল কথা হল, বিস্মরণ থেকে স্ব-স্মৃতির দিকে গিয়ে কালেক্টিভ কনশাসনেসকে বুঝে নেওয়া। হয়ত বিষয়টা এমন নয়, হয়তোবা এভাবে বোঝা যায় না, হয়ত পুরোটাই 'ভ্রম' ও 'ভ্রান্ত'। তারপরও শ্যামল বৈদ্য এক 'বোধ', এক 'জেগে ওঠা'। এইভাবেই কতিপয় তরুণ কয়েকটা পুস্তিকা রচনা করে সেই 'ঘোর'কে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। হয়ত এই অনুভূতি জ্ঞাপন করা অসম্ভব, তাও সেই তুরীয় 'স্থানে'র'র দিকে এ এক যাত্রা-প্রয়াস। প্রশান্ত হালদার লিখেছেন 'শময়িতা সেন', অংশুমান 'ম্যাট ব্ল্যাক', সোমনাথ ঘোষাল 'তেলাপিয়া কথা' এবং পবিত্র সাঁফুই রচনা করেছেন 'কৈখালি ডট কম'। এঁদের সঙ্গে রয়েছেন বিশ্বনাথ পুরকাইত। তাঁর পুস্তিকা 'ঘটনাচক্রে'। মুক্তাঞ্চল যেন এক হেটেরোটোপিয়া এবং এখানকার এই বাসিন্দারা কীভাবে দেখছেন বাকি-বিশ্বকে তা জানা দরকার। উৎপল দত্ত তাঁর 'টিনের তলোয়ার'-এ নর্দমার অধিবাসীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। যা দৃশ্যমান খালি ও খোলা চোখে, তার বাইরে আরেক 'দৃশ্য-সমাচার'। 'অভিজাত'দের নজরে মুক্তাঞ্চলবাসীরা হয়ত নর্দমার কেউ এবং এই পুস্তিকাগুলো নর্দমারই জীবনী মনে হতে পারে তাঁদের। কিন্তু মানুষের সাফ-সুতরো থাকায় এই নর্দমার অবদান কম নয়। এই তরুণরা 'ঘোষণা' করেছেন, সমস্ত আয়োজন শ্যামল বৈদ্যর অনুপ্রেরণাতেই সংঘটিত হয়েছে। 'প্রেরণা' কীভাবে, কোন পথে আসা-যাওয়া করে তা একটা 'বিষয়' বটে, তবে 'জটিল' নয়, কেননা এখন প্রায় সবই প্রকাশিত। সত্য-এর চারপাশের 'সত্য'।


জিয়া হক 

আমি এক শিরাফাটা নক্ষত্র : অংশুমানের গুচ্ছ কবিতা

 
কিছুতেই তেমন মনখারাপ হচ্ছে না 
কুয়াশায় কিছুদূর নেমে ঘোর 
কষ্টের থেকে ছিটকে আসি 
দেহ অনুভব শুধু জল ফ্লেশ তন্তু 

ডুবতে নাও কংক্রিট ভেঙে 
স্বপ্নের কসমস নিয়ে ডুবতে দাও 
কালো কোনো নদী তোমার কণ্ঠস্বর 
আমি এক শিরাফাটা নক্ষত্র 
নিস্তব্ধ চিৎকারে শরীর টানটান 
কিছুতেই শোকাস্তব্ধ হচ্ছি না 
পূর্ণগ্রাসের আগেই ঝলসে ওঠে 
অশ্লীল সিলভার লাইনিং

 
খুব অশরীরী রেখার রাক্ষস 
নেশায় ভাংচুর হয়ে আছে চোখের জানালা 
তোমাকে টুকরো ছাড়া দেখিনি কোনোদিন 
কোনদিকে যাব? যা কিছু ঘটে গেছে 
তাদের সুযোগ নেই আর 
অনবরত খেয়ে ফেলি ছায়ার ক্যাপসুল মায়ার 
দ্রাব্যতা 
যা কিছু চলে গেছে তা সরল নয় 
কিছুই হওয়া হয়নি 
না বৃক্ষ না অস্তাচল 
না অসৎ না অঘোর গোঙানির কংক্রিট

 
যৌনকল্পনা যৌনস্বপ্নের ভিতর ভিতর 
তুমি আছো ইলেকট্রিক পাখনার 
মাছের মতো 
তলপেটে সাঁতার দেয় বিঘ্নিত সিগন্যাল 
আর্দ্র মেঘের থেকে আমি 
দুধের বাসনা করি কবির আদব-কায়দায় 
না জানা ভাষার কথা ভাবি 
সময়ের উপর শ্যাওলা 
সরে না প্রেমের মত 
মরে না বঁড়শির আঘাত নিয়ে ঘাই মারে ঘুম 
সরোবরে 
শিশিরের শব্দে জেগে ওঠে শিশ্ন 
জন্মশোক কিছুটা হাল্কা হয় জান্তব ফুল ফোটে

 
ভোরের লোটাস 
ডুব দিয়ে ছিঁড়ে নেয় সহজাত পাপ 
পৌঁছতে চায় নখ তোমার ত্বক অবধি 
চার আঙুল দাস্তানের কোটরে 
পাখি ঝাপটায় 
এসব তোমায় দিলে কিছুটা নৃশংসতা কমতো 
কস্তূরী আকাশ থেকে ঠিকরে যেত লাল 
লেখা যেত কাঙ্ক্ষিত উপন্যাস 
ক্লীবের সাথে প্রণয় 
সংগঠিত নিরুচ্চার এক বৃষ্টি 
উল্কা উল্কা পারফিউম 
বিবর্ণ ব্যাভিচার 

ফেসবুকে অংশুমান  : https://www.facebook.com/ansumaniac

ডারউইনের ধর্ম ও বিশ্বাস। জিয়া হক

ডারউইনের ধর্ম ও বিশ্বাস — বিষয়টি কৌতূকপ্রদ মনে হতে পারে কারো কোরো কাছে। কেননা ধর্ম নামক বিশ্বাসমালা ও আপাতভাবে 'অযৌক্তিকতা'র বিপরীত স্বর হলেন এই বিশ্ববন্দিত বা 'বিশ্বনিন্দিত' জীববিজ্ঞানী । তিনি মসিহা, তবে 'সকল'-এর নন। মুক্তমনা, বস্তুবাদী, নিরীশ্বরবাদীদের মুখ্য আশ্রয় তিনি। তাঁর 'বাণী'র মতো এত উদ্ধৃত 'সমাচার' কতিপয়ই রয়েছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার নামে 'লোক' যা বলে বা করে থাকে তার আদি গুরু প্রকৃত অর্থে সংঘবিরোধিতায় মুখর কেননা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চেয়ে বড় ও সুসংগঠিত সংস্থা আর কী আছে? ঈশায়ী ধর্মের প্রাবল্যের পর্বে, 'অপৌরুষেয়' ওল্ড টেস্টামেন্টের অমোঘ নির্দেশনার যুগে, ঈশ্বর-স্বর্গ-নরকের প্রকল্পনার ভিত-ভূমিতে দাঁড়িয়ে, পারিবারিকভাবে একটি বিশেষ ধর্মীয় প্রতিনিধি হয়ে সেই ধর্মের মৌল তত্ত্ব ও ব্যাখ্যার পাশে ভিন্ন মত ও দর্শনের নির্মাণ সহ তার প্রচারণাই তো এক নিসঃঙ্কোচ অন্তর্ঘাত। যদিও তাঁর পরিবার ঈশ্বরবাদী ছিল না কখনও। যদিও তাঁর বাবা তাঁকে সতর্ক করেছিলেন যে প্রকৃতিই কেবল জড় নয়, মানুষ-প্রকৃতিও অ-চল, অ-নড় —অজ্ঞাতসারেই জড় । প্রত্যাঘাত আসতে পারে। ডারউইন কর্ণপাত করেননি সে-সাবধানী রক্ষণশীলতায়। কেননা তাঁর অকৃত্রিম প্রশ্নই এই সার্বিক রক্ষণশীল সংঘবদ্ধতার কাছে যে কে গড়ে তুলল এই 'যাবতীয়-যা'কে। কেন সৃষ্টি হল 'যন্ত্রণা'র? ওল্ড টেস্টামেন্ট উদ্ধৃত করে সমাধান খুঁজতে চাওয়াকে তিনি মনে করেন, ধর্মগ্রন্থ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত পংক্তি উদ্ধার করে কার্যত আলোচক নিজের অ-চিন্তাকে বা চিন্তা-দৌর্বল্যকেই সুনিশ্চিত করছেন। শুধু তাই নয়, আদি টেস্টামেন্টের উল্লেখ খানিক ভরিক্কি আনে আলোচনায়। তাঁর সহজ মত ছিল এমন যে, একজন বর্ণান্ধকে লাল রঙের লালত্ব যখন বোঝাতে সক্ষম নয় 'সুস্থ'জনটি তখন সেটা কার অক্ষমতা —রঙের? সুস্থতার? নাকি ঈশ্বরের? তাঁর মনে হয়েছে,'সাফারিংস' বা কষ্টভোগকে মানুষ সুখ বা 'প্লেজা়র'-এর চাইতে বেশি মূল্য দেয়। আর এই মূল্যায়নে সক্রিয় থাকে পারলৌকিক মঙ্গলচিন্তা। কিন্তু ডারউইনের দুটি প্রশ্ন —প্রথমত : অনবরত যাতনাভোগ একটি জাতিকে অনুর্বর, অনগ্রসর ও অ-প্রজননশীল বানিয়ে তুলবে না কি? দ্বিতীয়ত : ধরা যাক মানুষের মৃত্যু-উত্তরকালিক জীবন রয়েছে, ধরা যাক রয়েছে বিচারদিবস, স্বর্গ ও নরকের ফয়সালা, তাহলে মনুষ্যেতরদের কী হবে? তারা অনন্তকাল অ-বল জাগতিক কষ্ট কেন ভোগ করে যাবে? তাদের অপরাধ কী? এমন প্রকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ডারউইন প্রকৃতির নিজস্ব 'স্বেচ্ছাচার', নির্বাচন, প্রক্রিয়া বা 'সিলেকশন'-এর কথা ভাবেন। মহাজগতে যা-ই ঘটে তার এক বা একাধিক নিয়ম, সূত্রাবলী, শৃঙ্খলা মেনে ঘটে, আর নিয়মতন্ত্র কোনো অ-জর অ-মর ঈশ্বর-নির্দিষ্ট নয় ; এই নিয়মাবলী প্রকৃতির। নিজস্ব। সবটাই প্রাকৃতিক 'সিদ্ধান্ত'। 'গ্র্যান্ড' বা 'আলটিমেট' সিদ্ধান্ত-উপসংহার বলে কিছু হয় না, অথচ ধর্মগ্রন্থগুলি তা-ই দিতে চায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবেচনাগুলি নিয়ে তাঁর তখনই সন্দেহ জাগে যখন তিনি আবিষ্কার করেন যে, গসপেলের 'কথাকাহিনি'র সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণত মিলে যায় পম্পেই প্রদেশে আবিষ্কৃত কথাকাহিনি। তাহলে বাইবেল কি অপৌরুষেয় নাকি মানুষ-রচিত? তিনি মনে করেন, অন্যান্য প্রাণীদের মতোই মানব-মস্তিষ্কের 'উচ্চ' উন্নয়নও একটা যেহেতু প্রক্রিয়া সেহেতু যে বা যারা পম্পেইয়ের ডকট্রিনের রচয়িতা তেমনই কোনো মস্তিষ্ক-সমাহার নেই তো গসপেল রচনার ক্ষেত্রে? বাইবেল যে কোনো ঐশ্বরিক নির্মাণ বা লিখন তা মেনে নিতে অসুবিধা হয় তাঁর। আরেকটি বিষয় তাঁর অসমাধেয় সমস্যা বলে বোধ হয় —সেটি হল ধর্মগ্রন্থের সংহিতার অংশগুলি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলি। এই 'মহাগ্রন্থ'গুলিতে এত বিপুল রূপক, উপমা ও ভাষিক রহস্য-জটিলতা যে এর যে-কোনো ব্যাখ্যাই হতে পারে। ফলত 'সব বেদে আছে' ধরনের এক প্রহেলিকারও জন্ম হয়। অর্থাৎ স্বনামধন্য ঈশ্বর মানুষের মেধার উপর স্বয়ং নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হল, এই 'মেধা'র নির্মাতা বা নিয়ন্ত্রক কে? ডারউইন আগেভাগেই বলে রাখেন, নিম্ন-মস্তিষ্ক ব্যবস্থা থেকে উচ্চতর পর্যায়ে মস্তিষ্কের উত্থান একটি প্রাকৃতিক ধারাবাহিক ও নিরন্তর প্রক্রিয়া বৈ আর কিছু নয়। সেহেতু মানুষের মেধা-ই কার্যত ঈশ্বর নামক একটি সর্বৈব বিশ্বাস গড়ে তোলার মূলে। 'চতুরঙ্গ'-এর জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যেভাবে, যে-ঈশ্বর আমার বুদ্ধি দিয়েছেন সেই বুদ্ধিবৃত্তিই বলছে তিনি নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরই বলছেন ঈশ্বর নেই। এটি একটি ধাঁধার মতো। তবে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারনাকেও বহু আগে নাকচ করেছেন ডারউইন। তাঁর মনে একটি জিজ্ঞাসার কোনো মীমাংসা হয় না, আর সেটি হল, যদি হিন্দুদের ঈশ্বরের ইচ্ছা জাগে কোনো প্রত্যাদেশ দেওয়ার, তাহলে তিনি কি বিষ্ণু বা শিবের মতো কারও দ্বারস্থ হবেন বা তাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে 'কাজ' - এ লাগাবেন? একই প্রশ্ন ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পর্কেও। এ ও ভেবেছেন যে পৃথিবীতে এতগুলো ঈশ্বর কেন? প্রতিটি ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর। সৃষ্টি যেমন সত্য, স্রষ্টাও তেমনই সত্য হলে তিনি তো একক হবেন। সকলের জন্য অভিন্ন —তা সে যদি সৃজনাত্মক দলীয় তন্ত্র বা সমষ্টিগত কোনো 'টিম' থাকে তাহলেও। খ্রিস্টান ধর্মের ত্রি-স্তরীয় ঈশ্বরবাদ, ইসলামের একেশ্বরবাদ, বৌদ্ধধর্মের না-ঈশ্বরবাদ —সবার জন্যই তার এই প্রশ্ন। এমনকি সেই উপজাতিদের জন্যও যারা 'আচার'কেই নিয়ম ও নিয়মকেই ঈশ্বর বানিয়ে তুলেছে, তাঁর অভিন্ন জিজ্ঞাসা। কেননা 'মিরাকল' বা অলৌকিকতা কখনও কোনো ধর্মতত্ত্বের ভিত-মূল হতে পারে না যেটা ওল্ড টেস্টামেন্টে অহরহ আছে। অপর ধর্মেও তা অপ্রতুল নয়। তাহলে তো বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এমন —যা অব্যাখ্যেয় তা ঐশী আর যার জগৎ-যুক্তিসম্মত মীমাংসা রয়েছে তা খুদগর্জ, ঈশ্বর-শূন্য। আত্মা ও আত্মার নশ্বরতার ধারনাও এমন এক বিষম বস্তু। এই প্রতর্কে এসে মানুষ থতমত খেয়ে যায় যেহেতু তা লৌকিক চেতনার কাছে অজ্ঞেয়। যেভাবে 'প্রাণ' ঠিক কী বস্তু —এই কৌতূহলের সদুত্তর নেই। তাই এগুলিকে 'মিরাকল'-এর আওতাভুক্ত করে ঈশ্বরকে দার্ঢ্যতা দেওয়া হয়। প্রখ্যাত চিন্তক প্যালে প্রকৃতির বিপুল ডিজাইনের কল্প-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ডারউইন সেই বিশ্লেষণকেই জীবনের একটা পর্ব অবধি আলটিমেট মনে করতেন। কিন্তু অব্যবহিত পরেই তাঁর সেই তত্ত্বাদর্শকে ভ্রান্ত মনে হয়। ন্যাচারাল সিলেকশন-এর ভাবনাই তাকে প্যালে-এর মতামত থেকে মুক্ত করে। তিনি তখন আর মনে করেন না যে, যেভাবে একটি দরজা বানিয়ে তোলে একজন মানুষ, সেভাবে একটি কোষ, এমনকি একটি প্রাণও বানিয়ে তুলবে কেউ। জৈব জগতের ক্ষেত্রে এমন 'ডিজাইন'-এর অস্তিত্ব নেই, যেমনটা আছে জড়-বিশ্বে। ডারউইনের প্রশ্নটি খুবই সরল। তিনি জানতে চান, এত নিখুঁত পার্থিব আয়োজনের প্রয়োজন কোথায়? কে, কেন, কীভাবে বানালেন এমন নিশ্ছিদ্র নক্সা? তার উদ্দেশ্য কী?

যন্ত্রণাপ্রবাহ । জিয়া হক


 

তারপর যা হওয়া উচিত । জিয়া হক

ব্যাঘ্রশাবক অরণ্য পরিদর্শনে বাহির হইয়া দেখিল এক রুগ্ন, শীর্ণ ও প্রৌঢ় কাঠুরে ঘামিতে ঘামিতে একটি বাবলা গাছের মোটা শিকড় কাটিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার লাল গামছা মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ব্যঘ্রশাবকের বড় করুণা হইল। কাঠুরেটির কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। একটি জলজ্যান্ত ব্যাঘ্র দেখিয়া ভয় পাইয়া দুই পা পিছাইয়া গেল কাঠুরে। পালাইবার পথ খুঁজিতে সে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল। কিন্তু সে তো জানিত না, সকল ব্যাঘ্র অনুরূপ হয় না। ব্যাঘ্রশাবক বিনীত ভাবে করজোড়ে বলিল, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষ খাওয়া শিখিনি। নররক্তের স্বাদ কী তা আমার অজানা। কাঠুরে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, আমি কি তোমার প্রথম খাদ্য হব? দুঃখমিশ্রিত হাসিতে সেই শিশু ব্যাঘ্রের মুখখানি মলিন হইয়া গেল। সে বলিল, আপনি কাঁপা বন্ধ করুন। একটা জরুরি কথা আপনাকে এখন বলতে চাই, মন দিয়ে শুনুন। আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আপনার কাঠ আমিই কেটে দেব। আপনি শুধু সেগুলো বেঁধে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবেন। এমন আশ্বাস ও অভয়বাণী শুনিয়া কাঠুরে শান্ত হইল। তাহার চোখে জল আসিল। মাটি হইতে গামছা তুলিয়া চোখ মুছিয়া সে বলিল, তুমি নিশ্চয়ই বনেদি বংশের। তোমার শরীরে এক বিন্দু হলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই তোমাকে মানুষ করে দেন। আজ আমি চলি। এই বলিয়া কাঠুরে তাহার ছোট কাঠের বোঝাটি মাথায় চাপাইয়া চলিয়া গেল বাজারের দিকে। শিশু ব্যাঘ্রটি আবার চলিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে দেখিল, প্রখর রৌদ্রে এক কৃষক কাদা-জলে দাঁড়িয়ে ধানের চারা পুঁতিয়া দিতেছে। তাহার শরীর অনাহারে অর্ধাহারে পাকাটির মতো হইয়া গিয়াছে। দর দর করিয়া ঘামিতেছে অথচ কাজে বিরাম নাই। এই দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটির বড় মায়া জন্মিল। গুটি গুটি পায়ে সে কৃষকটির পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। কত দূর ধানের চারা পোঁতা হইল তা দেখিবার জন্য পিছনে ফিরিয়া কৃষকের চক্ষু চড়ক গাছে উঠিল। সে উল্টাইয়া কাদাজলে পড়িয়া গেল। সেই দৃশ্য দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটি মুচকি হাসিল। তারপর বলিল, আমাকে অনুগ্রহ করে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষের মাংস খাই না। নররক্তের স্বাদ কেমন তা আজও আমার জানা হয়নি। কৃষকটি বলিল, তাহলে আমাকে দিয়েই কি শুরু করবে, বাবা? শিশু ব্যাঘ্রটি বলিল, আমাকে বাবা বলেছেন মানে আমি আপনার সন্তান হলাম। বাবার প্রতি সন্তানের একটা দায়িত্ব থাকে না? কৃষক জানাইল, আমার তো তিন ছেলে। কেউই তাদের দায়িত্ব পালন করল না। আমাকে খেয়ে তুমিই সেই দায়িত্বটা পালন করে দাও, বাবা। আপনি অযথা ভয় করছেন। আমি এখন একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন আমিই আপনার ধানের চারা পুঁতে দেব। ধান বড় হলে কেটে, বেঁধে, ঝেড়ে, বস্তা বোঝাই করে ধান আপনার গোলায় তুলে দিয়ে আসব। আপনি শুধু বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসবেন। কৃষক বলিল, তুমি কোন বাড়ির ছেলে বাছা? তোমার মনে এত মায়া কোথা থেকে এলো বাছা? তুমি নিশ্চয়ই বাঘবেশী কোনও দেবতা। যদি দেবতা না-ও হও, তাহলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত এক ফোঁটা হলেও তোমার শরীরে বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই যেন তোমাকে মানুষ করে দেন। এই বলিয়া কৃষক বাড়ির পথ ধরিল। ব্যাঘ্রশাবকটিও চলিয়া গেল। গুহায় ফিরিয়া বাবা-মা'কে যা যা দেখিয়াছিল সব কথা বিস্তারিত বলিতে লাগিল ব্যাঘ্রশাবকটি। শুনিয়া তাহার অভিভাবকরা চমকাইয়া উঠিল। সন্তানের এমত মতিগতি তাহাদের ভাল ঠেকিল না। তাহারা বুঝিল বিপদ আসন্ন। মনুষ্যপ্রজাতির হাতেই তাহাদের সন্তানের অনিষ্ট হইবে। পুত্র যাহাতে বুঝিতে না পারে সেইভাবে তাহারা ভিন্ন ভাষায় আলাপ করিতে লাগিল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইয়ে জাগা ইসকে লিয়ে ঠিক নেহি। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, কিসি দুসরে জাগা পর ইসকো লে জানা চাহিয়ে। -তুমহারি শ্বশুরাল জিস জঙ্গল মে হ্যায়, ওঁহা পর জানা সব সে সেফ হ্যায়। -ঠিক কাহা আপনে। চলো, কাল হি নিকাল পড়তে হ্যায়। ব্যাঘ্রশিশুটি পিতামাতার কোনও কথা বুজিতে না পারিয়া আকাশ দেখিতে লাগিল। অরণ্যানির মর্মরধ্বনি, দূরের ঝর্নার কলকল শব্দ, পাখির বিচিত্র গুঞ্জন, শুষ্ক পত্র ঝরিবার খসখস আওয়াজ শুনিতে লাগিল। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা কী বলছ গো? ব্যাঘ্রমাতা বলিল, অনেক দিন এই বনে আছি। কাল আমরা তোর মামার বাড়ি যাব। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসব। তোর মামা খবর পাঠিয়েছে। পরের দিন তাহারা বাহির হইয়া পড়িল। সকাল হইয়াছে। চারিদিকে কেবলই আলো। রাস্তা নির্জন বলিয়া ঘাসেদের তখন ঘুম ভাঙে নাই। ব্যাঘ্র-পরিবার সন্তর্পণে লোকালয়ের পাশ দিয়া চলিতে লাগিল। ব্যাঘ্রশিশুটি পুনঃ পুনঃ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া তাহাদের পুরাতন অরণ্যখানি দেখিতে লাগিল। তাহার মুখে খানিক দুঃখ লাগিয়া রহিয়াছে। অকস্মাৎ এক কাণ্ড ঘটিল। তাহারা দেখিল, পথের পাশে এক কাঠুরে তাহার পরিবারসহ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার হাতে গুড়-মুড়ি-বাতাসা-চিঁড়ে। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইনি কে? ব্যাঘ্রশিশুটি বলিল, প্রকৃত মানুষ। তাহারা আবার চলিতে লাগিল। আরও একটি লোকালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখিল কেউ যেন কিছু হাতে লইয়া কারও জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কাছে যাইতে তাহারা দেখিল--এক কৃষক। তাহার হাতে রুটি-তরকারি। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, ইনি কে খোকা? ব্যাঘ্রখোকা বলিল, প্রকৃত মানুষ।

রেন্ট : জিয়া হক

জোবেদার নাম আসলে জুবাইদা। এই নাম কেউ ডাকতে পারে? হয়ে গেল জোবেদা। সে নিজেও জানে না তার আসল নামটা কী, কতটা সুন্দর। ছাগলের মুখের ধারে ফ্যানের গামলা বসিয়ে দিয়ে দাবায় উঠে দেখে ছোট ছেলেটা পায়খানা করে তার ওপর বসে আছে। আগুন হয়ে গেল জোবেদার মাথা। কেন যে এই আধবুড়ি বয়সে এসে বাচ্চা নিতে গেল। চড়চড় করে রাগ ওঠে মদ্দের ওপর। ছানা বিইয়ে সে যেন পাপ করেছে। মদ্দটার হুঁশ আছে? সারাদিন সরকারি খালে ছিপ ফেলে মোবাইলে মমতাজ বেগমের তর্জাগান শুনছে। জোবেদা বুঝতে পারে না গান বাজলে মাছ আসবে কেমন করে? এইটুকু বুদ্ধি কি আল্লাহ এই মরদের মাথায় ঠুসে দেয়নি? বাচ্চাকে পুকুরে নিয়ে কাপড় কাচার মতো আছড়ে ধুয়ে উঠোনে রোদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে দাবার পায়খানা পরিষ্কার করে জোবেদা। সে ভাবে, আচিয়া কীভাবে তিন তিনটে বাচ্চা মানুষ করল। একটা নিয়ে তার জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে। উঠোনের রোদে বসে বসে পোকামাকড় ধরে মুখে পোরার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা। তাই দেখে জোবেদা আর থাকতে না পেরে দাবার পায়খানার ওপর থেবড়ে বসে পড়ল। সংসার করতে তার আর ভাল লাগে না। জোবেদার ছেলে খয়রাত হোসেন তালি বাজিয়ে হাসছে। এই সময় জোবেদার মরদ মোবারক বদনা হাতে পোঁটের সামনে এসে দাঁড়ায়। অ্যালুমিনিয়ামের বদনার ভেতর কী যেন খলখল করে ওঠে। মাছ ওঠেনি, কাঁকড়া। বাম হাতে ছিপ, লুঙ্গির ট্যাঁকে মোবাইল গোঁজা। দুপুর হয়ে গেছে। জোহরের আজান দিচ্ছে আনিস মিঞা। পাড়ার লোকেরা গোসল করতে সব পুকুর ঘাটে ভিড় করছে এক এক করে। মোবারক বলে, এই জোবে বদনাটা রাখ আর গামছাটা দে, গোসল সেরে আসি। জোবেদা কোনও কথা বলে না। মোবারক চেঁচিয়ে ওঠে, রাখনা এটা। একটাও শব্দ না করে চুপচাপ দাবা থেকে নেমে পুকুর পাড়ের গা ধরে সোজা বড় রাস্তায় ওঠে জোবেদা। উঠোনে তখনও গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে মোবারক। কিছুই বুঝতে পারে না। —এভাবে গল্প শুরু করতেই পারো, কিন্তু তুমি কি তাই চাও, মানে পল্লির জীবনের গল্পই কেন শোনাতে চাইছ, মানে তোমার কি এই জীবনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে বা এই জীবন তোমাকে এতটাই স্পর্শ করেছে যে তাদের কথা না বললে তোমার ঘুম আসছে না? —শহরের গল্প তো অনেকেই শুনিয়েছে, শোনাচ্ছে, শোনাবে কিন্তু এদের কথাগুলো বলার জন্য তো কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে, তাই না? —সেই দায়িত্ব কি তোমার? কে দিয়েছে তোমাকে এই দায়িত্ব? যাদের গল্প তারা নিজেরাই বলবে, যদি তারা বলতে চায়। তুমি কে হে শহরের ঘরকুনো ধেড়ে মদ্দ? ছুটি পেলে হয় পাহাড় নয় ইউরোপ ঘুরে এসে মানুষকে চকমকে ইমারতের পাশে কফি খাওয়ার ছবি দেখিয়ে বেড়াও। —কিন্তু আমি যেভাবে বলতে পারি ওদের কথা সেভাবে তো ওরা পারবে না। ওদের কি সেই পড়াশোনা আছে, দেখার চোখ আছে? নিজের অবস্থা তো নিজের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। বাইরে থেকে কেউ না দেখিয়ে, ধরিয়ে দিলে হয়? —তোমার পড়াশোনা আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই। তুমি জানো শামুকে পা কেটে গেলে গ্রামের লোক কোন গাছের পাতার রস ঘষে দেয়? এই যে তুমি শিক্ষার বড়াই করছ এখানে বসে, ওগুলো কি শিক্ষা নয় বলে তুমি মনে করো? তুমি কী করতে পারো শেষ পর্যন্ত, গ্রামের মানুষের জীবনের ওপর একটু ফ্রয়েড, ইয়ুং, ফুকো, নিদেন মার্ক্স চাপিয়ে দেবে, এই তো? তোমার 'পড়াশোনা' তো শেষ পর্যন্ত এটুকুই করবে বা বড়জোর বিজ্ঞান দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করবে কত অযৌক্তিক তাদের জীবন, সঙ্গে একটু সিমপ্যাথি, এই তো? —বাদ দিন, জোবেদার কী হল জানতে মন চায়। —এরকম হাজার জোবেদা রয়েছে হাজার হাজার গ্রামে। কতজনের গল্প শুনবে? ধরে নাও, এই জোবেদা বাপের বাড়ি চলে গেল ও কিছুদিন পর খয়রাত হোসেন নামে একটা বিপত্নীক ছেলের সঙ্গে জুড়ে গেল। ধরে নাও, খয়রাত রেডিও বাজিয়ে বিড়ি বাঁধে সারাদিন। রাতভোর আসনাই করে। জোবেদা একসময় পোয়াতি হয়ে প্রচুর তেঁতুলগোলা জল খেতে শুরু করে আর যখন-তখন ওয়াক তোলে। কিছুদিন পর তার একটা পোলা হয়। খয়রাত ছেলের নাম রাখতে চায় সলিমুল্লাহ আর জোবেদা চায় অন্য কিছু, অন্য নাম। এই নিয়ে দু'জনের খুব টকঝাল হয়। ধরে নাও, শেষ পর্যন্ত জোবেদা জিতে যায় এই খেলায়। ছেলের নাম রাখা হয় মোবারক। রেডিও বাজিয়ে খয়রাত বিড়ি বাঁধে সারাদিন আর মোবারক পায়খানা করে গায়ে মেখে বসে বসে তালি বাজায়। গোরুর দুধ দুয়ে এসে উঠোন থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে জোবেদা, তাকিয়েই থাকে। ধরে নাও, মাগুরহাটে এক কাপড়ের দোকানে খয়রাতের সঙ্গে দেখা মোবারকের। কেউ কাউকে চেনে না। দু'জনেই তাদের ছেলের ইদের জামা কিনতে এসেছে। জোবেদা তখন মাগুরহাটেই শিমুইয়ের দোকান থেকে লাচ্চা কিনছিল। কাপড়ের দোকানে এসে দেখে খয়রাত মোবারকের জন্যে একটা ফুটফুটে লাল জামা পছন্দ করেছে আর মোবারক একই রঙের ফুটফুটে জামা বেছেছে খয়রাতের জন্যে। —এও কি সম্ভব? এবার তো আপনি জীবনের গল্প বলছেন না, আপনার গল্প বলছেন। —তুমি কি জানো, দুই স্বামী, দুই ছেলে নিয়ে জোবেদা এখন যাদবপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে? —গ্রামে থাকতে পারল না? —যতদূর পর্যন্ত গ্রাম ওদের গ্রহণ করতে পেরেছিল করেছে, তারপর পুরো ব্যাপারটা শহরের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গ্রামের আর কোনও উপায় নেই খোকা! —তাহলে গ্রামের গল্প আর রইল কই? বাকি অর্ধেক তো শহর গিলে ফেলল! —শোনো, জোবেদার আসল নাম জুবাইদা আর জুবাইদা মানে কোমলতনু, জোবেদারা এসব জানে না। জানার দরকার আছে বলে মনেও করে না। গ্রাম ও শহর একসঙ্গে নিয়ে ছোট দু'কামরার ঘরে সে রয়ে গেছে। তার একজোড়া কেয়ারিং হাত চাই আর একটা মাথা-গোঁজার ঘর। নদীর ধারে নাকি পার্কের গায়ে, সেটা জরুরি বিষয় নয়। এসব বাদ দাও, তুমি বরং মানুষের গল্প লেখো জিয়া। এই সময় চা নিয়ে ঘরে ঢুকল রফিকবাবুর মেয়ে তাসনিমা যাকে প্রেম নিবেদন করতে প্রতিদিন আমার আসা ও যে-কোনও একটা আলোচনা পাড়ার ফাঁকে একবার তার মুখ দেখতে পাওয়াই আমার রোজকার রোজগার। কিন্তু তাসনিমা নামের মানে কি তাসনিমা জানে? —একটা ছোট্ট কৌতুহল রয়েছে। —বলো। —যাদবপুরে ঘর ভাড়া পেল জোবেদারা? —ধরে নাও। —হ্যাঁ, ধরে নিতে হবে। আমাদের সবকিছু ধরে নিতে হবে। নমস্কার জিয়া হক আরম্ভ পোর্টালে প্রকাশিত

জিয়া হকের লেখা

 এখানে গানের দেশ

এখানে লোকাদেশ চমৎকারা

এখানে মাতৃমুক্তি লোকবল চায়

এখানে রাত্রি মূত্রহীন

এখানে গামছা যায় গ্রীবা ও মৈথুনে

এখানে এখন ক্ষণজন্মা

ভিড় ভিড় ভিড় ভিড়াক্রান্ত

কমল সিরিজ

 


কমল ১

বলেছিল, গাছের সন্ধান করে তোমাকে পাইলাম
বলেছিল, আমার এ পাতা পুষ্পগুলি গহনা তোমার
বলেছিল, যতদূর আমার অর্জন, ততদূর তোমারও উপায়
বলেছিল, যদি না আমাকে নাও, আমি কিন্তু তোমাকে নিলাম
বলেছিল, পথে পথে ঘাস আর ঘাসে ঘাসে কাঁটা
বলেছিল, সাবধানে পথ বেছে নিও

বুঝেছি কি? বুঝিনি কি?
মায়ের সেবায় সে তো ঋণ নেয়, কাউকে পায় না