বসন্তে জানালা কেন বন্ধ রাখবেন? ৫টি মজার টিপস



১. আপনি কি রূপমুগ্ধ? যে-কোনও সৌন্দর্য আপনাকে ডুবিয়ে চুবিয়ে ধরে? শামসুর রাহমানের চেয়ে আল মাহমুদ ভালো লাগে? তাহলে সাবধান।

২. ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনেন টেলর সুইফটের বদলে? আলো জ্বালিয়ে ঘুমান? পিশাচে ভয়? বসন্ত, সরি টু সে, আপনার জন্য নয়।

৩. বিছানায় বই রাখেন? সস্তার চপ্পল পরেন? মশারি ঘেন্না করেন? মুসুর ডাল ভালোবাসেন? বসন্তে তাহলে জানালা বন্ধ রাখুন।

৪. বসন্তকে জানালা নয়, বারান্দা থেকে দেখুন। দোতলার ছাদ না থাকলে গাছের তলায় গিয়ে দুপুরে বসুন।

৫. কবিতা হুট করে ঢুকে পড়তে পারে জানালা দিয়ে। নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব আপনারই। কবিতা আপনাকে লোভ দেখিয়ে খ্যাতির কিনারে নিয়ে যাবে। ফিরতে পারবেন না, পথ নেই। 

বসন্ত এসে গেছে : আফগান কবিতা : রিশাদ


......................
বসন্ত এসেছে, এসো, শোকগুলো ভাঙো ;
দেখতে দাও শক্তির প্রতি পদক্ষেপ।
সুন্দর আর কলা ছাড়া এ আর কি ;
বিবিধ আকারে সে আসে।
কতদিন শুয়ে থাকবে অশক্ত শরীরে, কতদিন আর?
বেচারা জাহিদ! চোখ খোলো।
বেরিয়ে পড়ো, এখানে নতুন উৎসব ;
কুঁড়ির কলার ছিঁড়ে ফেলার কথা।
চোখের পাতায় সুন্দর তার সতর্ক পা রাখে ;
শিশিরের দোলনা ছেড়ে যায় ফুলপুষ্পদল।
সাকি! পানপাত্রে কিছু জল ঢেলে দাও
যাতে অচেতন হয়ে পড়ি একটি পলকে।
শুঁয়োপোকা!  সুসংবাদ তোমার জন্য, বাগানে এসো
দুর্ভাগা রূপও বেঁচেবর্তে গেছে।
রিশাদ! গতি কি থাকে সূক্ষ্মতার?
ফুলের চিবুক চুম্বন করে মৃদুমন্দ হাওয়া।


ভাবানুবাদ 
জিয়া হক 

প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে কী করবে? ৭টি পরামর্শ


পরীক্ষা কক্ষে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা শুধু নার্ভাসই বোধ করে না, তারা খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। এটা অস্বাভাবিক নয়। মানসিক চাপ এর মুখ্য কারণ। প্রস্তুতি ভালো থাকার পরও এমনটা হতে পারে। কীভাবে শুরু বা শেষ করা যেতে পারে তা নিম্নে বলা হল :

১. প্রথমে উত্তরপত্রে মার্জিনের কাজ সেরে রাখতে হবে। এই শুরুর কাজটি যত দ্রুত সম্ভব করে ফেলা উচিত। এবং মার্জিন টানতে টানতে মনকে প্রস্তুত করে ফেলতে হবে।

২. এটা ভাবতে হবে যে প্রশ্ন যেমনই হোক, সবটা শেষ করতে হবে। কোনও প্রশ্ন ছেড়ে আসা যাবে না।

৩. সব উত্তর সম মানের হয় না। তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই।

৪. প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার আগে আকাশপাতাল ভাবার অবকাশ নেই। শুধু মনে রাখতে হবে, তুমি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি রাখো নির্দিষ্ট বিষয়ে।

৫. মনকে যতটা সম্ভব শান্ত ও দৃঢ় রাখা দরকার। অযথা দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

৬. সব প্রশ্নই যে জানা থাকবে তা না ও হতে পারে। তবে যেগুলো সবচেয়ে ভালো ভাবে তৈরি সেগুলো আগে লিখতে হবে।

৭. নিজেকে বলো — তুমিই সেরা। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ক্ষতি করতে পারে। সেদিকে খেয়াল রেখো।

শুভেচ্ছা
হিমালয় বসু
এম. এ, বি. এড (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)


পরীক্ষার্থী বন্ধুদের সাফল্য কামনা করলে তাদের সঙ্গে শেয়ার করে নাও।

সাফল্য কামনা করি। 

পরীক্ষার আগে কীভাবে প্রস্তুতি নেবে : ১১টি পরামর্শ


সামনে যখন 'বড়ো' পরীক্ষা তখন নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করা দরকার তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেশ আতান্তরে পড়ে। কী পড়া হবে, কতটা পড়া হবে, কতক্ষণ পড়া হবে —এগুলি ভাবনার। পরীক্ষার সময় জীবনযাপনই বা কেমন হবে, সে বিষয়ে সঠিক ধারণার বিশেষ অভাব দেখা যায়। নিম্নে কয়েকটি শেষ মুহূর্তের পরামর্শ দেওয়া হল :

১. দিনের মধ্যে খেলাধুলোর জন্য একটা সময় বা একটু সময় বরাদ্দ রাখতেই হবে।

২. খুব সকালে যে ঘুম থেকে উঠতে হবে তার কোনও মানে নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে পড়ায় পর্যাপ্ত ও যথেষ্ট, যথাযথ সময় দেওয়া হচ্ছে কি না।

৩. যা পড়া হয়ে গেল তা যেন ভেবে দেখা হয়। অর্থাৎ যা পড়া হল সেটা স্মরণ করার চেষ্টা করাটা ভীষণ জরুরি।

৪. বন্ধুদের সঙ্গে যা পড়লে তা আলোচনা করতে পারলে খুব ভালো হয়।

৫. অতিরিক্ত সাজেশন করা অনুচিত। সাজেশন হল বাজি ধরার মতো। যারা সাজেশনভিত্তিক পড়াশোনা করে তারা রীতিমতো ভয়-শঙ্কিত থাকে, যেটা পরোক্ষে ক্ষতি করে।

৬. পড়ার সঙ্গে লেখাটাও সমান জরুরি। লিখতে গেলেই বোঝা যাবে পড়ায় কতখানি ফাঁক রয়ে গেছে। লিখলে মূল পরীক্ষার একটা রিহার্সাল বা মহড়া হয়ে যায়। উত্তরপত্র কীভাবে সুন্দর করে তোলা যেতে পারে সে বিষয়ে নানা 'আইডিয়া' আসে।

৭. সহায়িকা বই পড়লেও মূল পুস্তক নিখুঁত ভাবে পড়ে রাখা দরকার।

৮. সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতা অংশের সারাংশ বা সারমর্ম যেন স্পষ্ট ভাবে জানা থাকে।

৯. অযথা দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তাতে প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

১০. জীবনযাপনে বিনোদনের জন্য  ডিজিটাল মিডিয়ামের ব্যবহার কমিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো বেশ কার্যকর।

১১. খেয়াল রাখবে, এটা শেষ অবধি একটি পরীক্ষাই। জীবন মরণের প্রশ্ন নয়। নিজেকে সহজ ও সাবলীল রাখতে পারলে আখেরে তোমারই লাভ।

শুভেচ্ছা নাও
হিমালয় বসু
এম. এ, বি. এড (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)

পরীক্ষার্থী বন্ধুদের সাফল্য কামনা করলে তাদেরকেও লিঙ্কটি শেয়ার করে পড়ার সুযোগ করে দাও।

ধন্যবাদ

Saraswati : oh girl!

ঘটনাচক্রে ছাত্রী যারা, নীচে বসে টিভি দেখে।
জানি, তারা পাঠে নয়, দর্শনে মনোযোগী, তথ্য তাই বলে।
বিজ্ঞাপন, কার্টুন, সিরিয়াল সিরিজে তাদের
হাসি ছড়িয়ে পড়ে উঠে আসছে এত দূর উপরে।
এক বকধার্মিকের গান শোনা গেল,
শোনা গেল ছাত্রীজীবনের খলখল হাসি।
ব্যাকরণ বোঝে না তারা, আসনপিঁড়ি দিয়ে বসতে শিখেছে।
মনে পড়ে, যখন ছাত্র ছিলাম
শীতের এমন দিনে হাওয়া দিত খুব আর
মাছি বসত ব্যাকরণে এসে। সন্ধিচুক্তি ছাড়া। 

Epiphany : drooping soul

আমার এখন একজন সঙ্গী দরকার।
 তার লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে চিন্তিত নই।
মানুষ হলেই হবে।
কথা বলতে চাই।
কী কথা, জানি না, তবে কথা।
শব্দ, বাক্য, কথা।
বিমানের আওয়াজ শুনতে পাই আর মনে হয় কত লোক উড়ে গেল।
পোকাদের চিৎকার আসে, ভাবি কবরস্থান বেশি দূরে নয়। মশারির মধ্যে কোনও শত্রু নেই।
পক্ষপাতদুষ্ট নই।
বিছানার চাদরে যে ফুলের বাগিচা আমি তাতে কতকাল আগে হারিয়ে গিয়েছি।
 এখানে খননকারী আসে না।
আমাকে খুঁজে পেতো।
এত রাতে আলো জ্বলে কেন?
বিদ্যুৎ কত মূল্যবান জানো?
মূল্য যাকে দিতে হয় সে অন্ধকারে হায়নাতাড়িত গৃহপালিত পাখিশাবকের মতো বসে থাকে।
 দেখেছি, নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে মধ্যযুগ বরাবর কবিদের মুখ মনে পড়ে।
 ছবি নেই, তবু মনে পড়ে।
 প্রকাশ্যে যাবার আগে ধুতিখানি ধুয়ে নিতে হয়।
 মুর্খের মতো কথা বলি, সমস্ত সভায় মুর্খের স্বর্গে বাস করি, গড়ি। ওই যে আদি গঙ্গা বয়ে যেতে চেয়েও পারে না,
তার উপত্যকা ধরে শোকপ্রকাশ করবার মতো সঙ্গী আমি চাই এত রাতে।
চাকুরিরত, তুমি চাও প্রতিদিন রবিবার হবে।
রবিবার আমাকে সোম বা শুক্রবারের অনুভূতি দেয়।
প্রতিটি দিন আমার পাথর,
 প্রতিটি পাথর আমার আয়না,
প্রতিটি আয়নায় হাত কেটে যায়,
 সময় কাটে না।
সময় কাটার মতো বিদ্যুৎ আমার নেই আর বিদ্যুৎ খুব দামি। ছাদের মাথায় বুদ্ধি থাকে না বলে সেখানে দাঁড়াই, বলি, সূর্য আর কত দূর?
১টা ৪০ তো বাজে।
 বলি, সূর্যাস্ত, আর কত দূরে?
 সময় উল্লেখ করেছি।
 স্থাননাম নেই এমন কোথাও নিয়ে চলো।
 দারোগারা আসে,
মানুষ আসে না। 

বঙ্গ ১৯ : ছোটগল্প : জিয়া হক


...............................................................................


কুকুরটা আমার পিছনে এসে বসল।
বললাম, বিস্কুট খাবেন?
সে অলসভাবে তাকালো একবার।
আপনি আমার পোষ্য হবেন?
আমি কিন্তু স্বদেশি, আপত্তি নেই তো?
আপনার দেশ-পরিচয় নিয়ে আমার চিন্তা নেই।
একটা মাছি উড়ছিল কুকুরটার কানের পাশে।
কুকুরটা বলল, মাছিদের আমি পছন্দ করি না। আপনার বাড়ি মাছিমুক্ত তো?
মাছি যে নেই তা নয়, তবে উপদ্রব নেই।
একজন চানাচুর বিক্রেতা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদা, এখন কটা বাজে?
১১টা ৭।
ডিজিটাল ঘড়ির এই সুবিধা। সেকেন্ডের হিসেবও বলে দেওয়া যায়।
সে বলল, চানাচুর খাবেন?
বললাম, পয়সা নেই।
আপনাকে এমনিতেই আমি খাওয়াতে চাই।
কিন্তু কেন?
আপনার মুখে একটা মায়া আছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
আপনার মন ভালো হয়ে গেছে তাহলে?
আজ আমার মন এমনিতেই ভালো।
তাহলে ব্যবসায় ক্ষতি করছেন কেন?
আমি সকাল ১১টায় রাসমাঠের এক কোণে ভাঙা জমিদার বাড়ির পোড়ো পিলারের উপর বসে আছি। দূরে মেন রোড। অটো, বাস, ভ্যান, রিক্সা যাচ্ছে। ট্যাক্সি কম। মফস্বল শহর তো। সব লোক কাজে বেরিয়ে পড়েছে। আকাশে মেঘ। আজ সোমবার।
চানাচুরওয়ালা এক ঠোঙা চানাচুর দিয়ে চলে যেতে আমি পিছনে শুয়ে থাকা কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করলাম, চানাচুর খাবেন?
চোখ বুজেই সে বলল, না, আমি গায়ে পড়া লোকের দেওয়া কিছু খাই না। আপনিও খাবেন না। খেলে এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন।
কী বলছেন?
আমার দায়িত্ব পালন করলাম, বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
কিন্তু আমার কাছে যে পয়সা নেই সেটা তো ওকে বললাম, তারপরও সে আমাকে...
বিশ্বাস না হয়, মেন রোডে গিয়ে দেখুন লোকটা আড়াল থেকে আপনাকে লক্ষ রাখছে।
সত্যিই তাই।
মেন রোডে গিয়ে দেখলাম একটা চা দোকানের আড়ালে সে বসে আছে। আমি আসছি দেখে হাওয়ায় মিশে গেল।
ফিরে গিয়ে কুকুরটাকে ধন্যবাদ জানাতে সে বলল, আমি আর আপনার সঙ্গে নেই, চলি।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছেন। আমি খানিকটা ঈশ্বরের মতো। অবিশ্বাসীদের সঙ্গে থাকতে পারি না।
কিন্তু ঈশ্বর তো ক্ষমাশীলও?
ঈশ্বর ক্ষমাশীল কিন্তু আমি তো ঈশ্বর নই। ঈশ্বরের মতো, তবে আমি একটা কুকুরই।
মাছিটাকে মাথায় নিয়ে সে চলে গেল।
মনটা ভারী হয়ে গেল। মেঘ আরও কালো হয়ে এসেছে। রাসমাঠের পাশের বিশাল পুকুরে ঢেউ উঠছে। দূরে সেগুন কাঠ চেরাইয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আওয়াজ শুনে আমি কাঠের নাম বলে দিতে পারি। তবে মনটা বড়ো খারাপ। একটা উড়োজাহাজ যাচ্ছে।
মেন রোডে উঠতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আমার ছাতা নেই। জ্বরে পড়বার মতো সৌভাগ্যও নেই।
একজন পথচারী আচমকা কানের কাছে মুখ এনে বললেন, দাদা, ছাতায় আসুন।
নীল ঢাউস ছাতা তার মাথায়। পোশাক দেখে বেশ ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। পায়ে খাঁটি চামড়ার মোকাসিনা জুতো। চামড়ার জুতো দেখলে আমার একটা ছাল ছাড়ানো খাশির কথা মনে পড়ে। আকাশ থেকে কারা যেন সমবেতভাবে ঢিল ছুঁড়ছে। সাড়ে এগারোটা বাজে।
লোকটা বললেন, এই বৃষ্টিতে ভেজে নাকি কেউ?
আমি বললাম, আমাদের মতো লোকেদের কোনো বৃষ্টিতেই ভেজা উচিত নয়।
আমরা চৌমাথার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে একটা হ্যারিকেনের দোকান আছে। একজন প্রায় অন্ধ লোক সেই দোকানটা চালায়।
লোকটা জিজ্ঞেস করলেন, কী করা হয় আপনার?
ভাববাচ্যে কথা বলার দরকার নেই, আমি কিছু করি না, বললাম।
কথা শুনে আপনাকে শিক্ষিত বলেই মনে হয়। সত্যিই আপনি কিছু করেন না?
মিথ্যে কিছু করি কী করে!
একটা কাজ আছে, করবেন?
কী কাজ? তবে শুনে রাখুন, আজ আমার মনটা বড়ো খারাপ।
মন খারাপ? সে তো হতেই পারে। তবে কাজটা করলে আপনার ভালো লাগবে বলেই মনে হয়।
কী কাজ বলুন তো।
আমার একটাই ছেলে। হোলি ক্রসে নাইনে পড়ে। তাকে পড়াবেন। সপ্তায় দু দিন। পারবেন?
আচ্ছা, আমাকেই কেন এই দায়িত্ব দিতে চান বলুন তো?
বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আপনার মুখে একটা মায়া আছে।
বৃষ্টি কাটতে কাটতে একটা অটো আমাদের পাশে এসে গতি কমিয়ে দিল। আমার হাতে একটা কার্ড গুঁজে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে অটোতে উঠে পড়লেন লোকটা।
তার ছাতাটা আমার হাতে।
কার্ডে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ভদ্রলোকের নাম নাসির হোসেন। পেশা ওকালতি। বাড়ি ফুলতলা। ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।
পকেটে রাখলাম কাগজের টুকরোটা।
মুখে কীভাবে মায়া গজায়? কেমন দেখতে হয় মায়াময় মুখ? আয়নায় কি নিজেকে দেখব একবার? মায়ার সঙ্গে কি দয়ার কোনো সম্পর্ক আছে?
প্রায় অন্ধ লোকটা অসংখ্য হ্যারিকেন ঝুলিয়ে দোকানে বসে আছে। এই যুগে কে কেনে হ্যারিকেন? প্রৌঢ় দোকান মালিক দিনরাত একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখে দোকানের ঠিক সামনেটায়। লোকটার চোখ আর বেশিদিন নেই, দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়।
দোকানের নাম : আলো।
বৃষ্টি পড়ছেই।


ফুলতলা
বিরাট বাড়ি। প্রাসাদই বলা চলে। বাড়ির উঠোনে দেশি বিদেশি ফুল লতাপাতা গাছের মধ্যে কয়েকটা পাতাবাহার আর বোগেনভেলিয়াকে চিনতে পারলাম। দশটা মতো টব উল্টে রাখা আছে। এখন মঙ্গলবার। সন্ধ্যাকাল।
নাসের হোসেন আমাকে চিনতে পেরে তার বই-ঠাসা বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, আফরোজ!
কেউ এলো না।
তিনি আবার ডাকলেন, আফরোজ, নীচে এসো, তোমার মাস্টারমশাই এসেছেন।
আপনি কী পড়াবেন? এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
কখনও তো কিছু পড়াইনি কাউকে, নির্বিকার ভাবে বললাম।
এমন একজনকেই খুঁজছিলাম যিনি জ্ঞানের দিক থেকে ভার্জিন।
জ্ঞানের আবার কুমারত্ব আছে এই প্রথম জানলাম, ধন্যবাদ, আমি দুই হাতের তালু একবার ঘষলাম নিঃশব্দে।
জ্ঞান আপনি কখনও কাউকে দান করেননি, মানে তার হাইমেন এখনও অটুট। তা যাক গে, আপনি নিশ্চয়ই এম এ?
এম এ, বি এড, কিন্তু বুঝলেন কী করে?
আমি একজন সফল অ্যাডভোকেট, মানুষ নিয়ে আমার ব্যবসা, বুঝি। তাছাড়া আপনার মুখে...
একটা মায়া আছে, তাই তো?
একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি মুখে মায়া থাকাটাকে আপনি ভালো চোখে দেখছেন না, কিন্তু আমি একে ইতিবাচক গুণ বলেই ধরছি।
চা এলো। কাচের কাপে লাল রঙা চা। কাচ খুব ঠুনকো বলেই কাচ আমাকে টানে। যারা কাচের কাপে চা খায় তারা স্বচ্ছ না ও হতে পারে। লাওপালার পিরিচ বলে মনে হল।
আফরোজ ইতিমধ্যে দোতলা থেকে নেমে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আফরোজের উচ্চতা বেশি নয়, গোল মুখ, গৌর বর্ণ, চিনাদের মতো চুল সোজা সোজা।
সে ঘরে ঢুকতেই নাসের হোসেন বললেন, বাবা, তোমার লেখা সেই ইংরেজি কবিতাটা 'where is my grave' আবৃত্তি করে শোনাও একবার।
আমি তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে বললাম, ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র নয় যে অতিথি এলেই আবৃত্তি করে শোনাতে হবে।
৭:৪৫ বাজে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। আকাশে তারা ফুটেছে। সব তারাই সমান। সকলেই যেন মৃত। শেষ আলোর বার্তাটুকু দিয়ে ফিরে যাবে কৃষ্ণ কালো ঘরে। হ্যারিকেন বিক্রেতার চোখদুটো মনে পড়ে গেল।
আজ থেকে আমি আফরোজের শিক্ষক। ক্রিয়েটিভ রাইটিং আমার বিষয়।
নাসের হোসেন বাড়ির গেট অবধি এসে বললেন, ওকে তৈরি করুন।
সংক্ষেপে বলি, আমার মতো?
তিনি চুপ করে রইলেন। তারপর খুব নরম ভাবে প্রিয়জন যেভাবে বলে সেভাবে বললেন, দেখে পথ হাঁটবেন।
এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে। আফরোজের মুখের মধ্যে আজ আমি মায়া দেখতে পেয়েছি।
চাঁদের বুড়ি নিরলস চরকা কাটছে আর আমার সামনের পৃথিবী আলোয় এক হাঁটু ডুবে যাচ্ছে। এমন দিনে মানুষের ধুমপান করতে ইচ্ছা হয়। আমি ধুমপান করি না। এই আলোয় তামাকের ধোঁয়া মিশিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই।
একটু নির্জন দেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখলাম, এই কুকুরটা সেই কুকুর নয়।
বললাম, বিস্কুট খাবেন?
কুকুরটা বললেন, আজ ধুমপান করতে ইচ্ছা করছে।
আমার বাড়ি গেলে ব্যবস্থা করতে পারি। আপনি কি আমার বাড়ি যাবেন? জানতে চাই।
তিনি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, আসি, আমার বকলশ পছন্দ নয়।
অন্ধকারে হারিয়ে গেল কুকুরটা। দেখলাম, ফুলতলার লীলা সিনেমা হলের আলোয় একটা আধা - পর্ণ ছবির পোস্টার। ছবির নাম 'নটি পড়োশন' ।
খুব সঙ্গম করতে ইচ্ছা হল। ঘরের মধ্যে নয়, নদী বা সমুদ্রের পাড়ে বালির উপর। বাঘের মতো গর্জন করতে করতে রমণ। আহত বাঘের মতো।  শুধু নারী নয়, পুরুষও চিৎকার করে উঠবে। এ তো এক লড়াই, আদিম কাল থেকে চলে আসছে জঙ্গল থেকে বিছানায় । বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে সূচ্যাগ্র মেদিনী ছেড়ে দেবে না। স্বর্গে যুবকেরা যত খুশি রমণ করতে পারবে, ক্লান্তি আসবে না, বীজ পড়ে যাবে না, সন্তান হবে না, রাবারের সতর্কতার দরকার পড়বে না।
আমার তো পাপ নেই, পুণ্যও নেই, আমি কি স্বর্গীয় হতে পারব?
কে যেন বলেছিল, পাপ না থাকা মানেই তো পুণ্য। তাই কি? যদি বলি, আমার জ্ঞান নেই, অজ্ঞানতাও নেই —কেমন দাঁড়ায় বিষয়টা?
একজন দালাল গোছের লোক এগিয়ে এলো।
বলল, স্বর্গে যেতে চান?
কী করে বুঝলেন আমি স্বর্গে যেতে চাই?
আমরা লোক চিনি দাদা। যেতে চাইলে চলুন আমার সঙ্গে।
বললাম, চলুন।


স্বর্গ
খুব কাছেই ছিল স্বর্গ, পথ জানা ছিল না। পৃথিবীতে দালালদের বড়ো দরকার আজ। আমার দেশ দালালে ভরে যাচ্ছে। কী অপূর্ব সংবাদ! রাত বেশি নয়।
গুহার মতো একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। জীবন এখানে যেন আজও আদিম। দূরে একটা বাঁশের মাচার উপর কয়েকজন যুবক কথাবার্তা বলছে।
ছোট ছোট ঘর। ঘর না বলে খোঁয়াড় বললেই ভালো হয়। টিমটিম করে আলো জ্বলছে প্রতিটি খোঁয়াড়ে। রাস্তার আলোর জোর খুব বেশি। সারি সারি মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। সকলেই যেন একটাই মুখ ভাগ করে নিয়ে বসে আছে। ড্রেনের দুর্গন্ধ তাদের স্নো পাউডারের গন্ধকে ম্লান করে দিয়ে পরাজিত করেছে।
সামনের ঘর থেকে একজন গোমড়ামুখো মেয়ে বেরিয়ে এসে দালালকে জিজ্ঞেস করল, কত বলেছিস?
দালাল বলল, এখনও দরদাম হয়নি।
মুখ খারাপ করে উঠল মেয়েটা। তার পুরো শরীরটাই শুধু ঝুলে পড়েনি, তার ভাষা-কপাল-বারান্দার তক্তপোষ সব যেন ঝুলে পড়েছে। তার ঘরের মাথায় যেটুকু আকাশ সেখানে কোনও তারা নেই। একটা কালো চাঁদ গলগল করে কালো আলকাতরা অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে।
আমি বললাম, পারব না।
দালালটা প্রথমে শুনতে পায়নি। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী বলছেন?
না, আমি পারব না।
মেয়েটা এই ফাঁকে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা খোঁয়াড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে তালা বন্ধ করে দিল। তারপর বিশ্রী ভাষা দিয়ে বলল, কী আছে বের কর, নইলে পুলিশ ডাকব, তখন সব ঘোমটা খুলে যাবে।
আমি বললাম, আমার কাছে পয়সা টয়সা নেই। এক প্যাকেট বিস্কুট আছে।
আবার নোংরা ভাষা দিল মেয়েটা। তারপর আমার পকেট হাতড়াতে লাগল। যথারীতি কিছুই পেল না, এক প্যাকেট বিস্কুট ছাড়া। পার্লে মারি।
সেটাই কেড়ে নিয়ে বলল, যা, ভাগ শালা।
বাইরে বেরিয়ে দালালটাকে আর দেখতে পেলাম না। ছেলেগুলো তখনও সেই মাচায় বসে ফিসফাস করছে। আমার শুধু মনে হল, এখনই আমার সঙ্গে যা ঘটল সেটা ধর্ষণ আর প্রতিটা ঘরে যে ধর্ষণ ঘটে চলেছে সেটা সঙ্গম।
কটা বাজে জানি না। রাত বাড়ছে। বাড়ি ফিরতে হবে। হেঁটেই। এ পাড়ায় ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। সবার চোখ চকচক করছে। চারিদিকে নজর রাখছে। ভদ্রলোকের পরিচিতি এক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
প্রথম জীবনের এক প্রেমিকার কথা মনে পড়ল হাঁটতে হাঁটতে। তার বাড়িতে মিলিত হয়েছিলাম এক দুপুর বেলা। সঙ্গমের পর সে আমাকে প্রণাম করেছিল। তখন তার মানে বুঝিনি। এখন বুঝতে পারি। তার কাছে সেটা আদিম লড়াই ছিল না, সেটা ছিল প্রিয়কে পূজা।
হাওয়া দিছে। মেন রোডে বড়ো বড়ো ট্রাক। লোক কমে এসেছে। আমি হাঁটছি।
শুধু মনে হল, কুকুর বিস্কুট খায় না, মানুষ খায়।


প্রথম ক্লাস
আফরোজ!
জ্বি স্যার।
তোমার প্রিয় কবি কে?
কোন ভাষার স্যার?
তুমি কটা ভাষা জানো?
তিনটে ভালো জানি। একটা মোটামুটি।
কী কী ভাষা?
বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি আর উর্দু অল্প অল্প।
বাংলা ভাষার প্রিয় কবি কে?
জীবনানন্দ দাশ। স্যার, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
আপনার প্রিয় বাঙালি লেখকের নাম কী?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তুমি কি তাঁর লেখা পছন্দ করো?
স্যার, বঙ্কিমের লেখায় নাকি মুসলিম বিদ্বেষ আছে? আনন্দমঠ, কৃষ্ণচরিত তো তাঁরই লেখা?
তোমাকে কে বলেছে এ কথা?
শুনেছি।
আচ্ছা, ধরো তোমার ধর্মকে তুমি খুব ভালোবাসো আর চাও এমন একটা দেশ তৈরি হোক যেখানে তোমার ধর্মাবলম্বীরা শাসন করবে, তাহলে তুমি কী করবে?
তাহলে কি অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখব স্যার?
আফরোজ, জাতি-গঠন অনেক বড়ো বিষয়। এখানে ধর্মটা একটা টুল মাত্র।
জাতি-গঠন অনেক বড় ব্যাপার স্যার কিন্তু সেই জাতির মধ্যে তো সবাই আছে। একজনকে বাদ দিয়ে কি জাতি-গঠন হয়?
তুমি ভুলে যাচ্ছো যে জাতিকে তিনি কাঠগড়ায় তুলছেন সেই জাতির প্রায় ৭০০ বছরের আধিপত্য। তারা তো বাইরের মানুষ। ভারতীয় নয়। বঙ্কিম তো আদি ভারতীয়দের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেটা কি ভুল?
ভুল কি না বলতে পারব না স্যার, তবে তিনি যে রাজপুতদের বীরত্ব নিয়ে এত কথা লিখলেন, তাদেরকে জিতিয়ে দিলেন, সেই রাজপুতরা কি আদি ভারতীয়?
তারা ভারতীয় নয়?
রাজপুতরা তো হুনদের বংশধর। হুনরা কি বাইরে থেকে আসেনি?
আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে আফরোজ। জেনে তোমাকে বলব। আজ আসি।
আবার কবে আসবেন স্যার?
এখনও জানি না।
আমার প্রথম ক্লাস এভাবে শেষ হয়ে গেল। রাস্তায় এসে উঠলাম। ৮টা ১০ বাজে। আজ বুধবার।
মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে। আমার প্রিয় লেখককে আমি ডিফেন্ড করতে পারলাম না। বঙ্কিম কখনও বিদ্বেষী হতে পারেন না। চৈতন্য দেবের মতো তিনিও কৃষ্ণকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। রামা কৈবর্ত্যর পাশে কি তিনি হাসিম শেখের নাম বলেননি? পল্লী গ্রামের প্রজাদের দুরবস্থা যিনি লেখেন তিনি কি সেখানে ডিসক্রিমিনেট করেছেন? বাঙ্গালার কৃষকরা কি শুধু হিন্দু ছিলেন?
সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
দু দিন ভালো ঘুম হয়নি। খুব ঘুম পাচ্ছে। এই সন্ধ্যা কি ঘুমের জন্য প্রশস্ত? আরো একটু হাঁটতে হবে। অটো নেওয়া একটা বিলাসিতা। আকাশের দিকে তাকাতে এখন মন চাইছে না। শুনেছি, তারা গুনলে ঘুম আসে। কিন্তু তারা গুনতে গুনতে হাঁটা যায় না।
রাসমাঠের ভাঙা জমিদার বাড়ির চাতালে এসে দাঁড়ালাম ২০ মিনিট হাঁটার পর। জায়গাটা নির্জন। নিঝুম। মনে হয় স্বর্গ এমনই। আম পাতা ছড়িয়ে রয়েছে সিমেন্টের চাতালে। পা দিতেই মড়মড় করে আওয়াজ হল। এখানে একটা কুকুর থাকে।
পাতার শব্দে কুকুরটা বেরিয়ে এলেন।
আমি প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললাম, আমি আপনার এক স্বদেশী ভাই, আজ রাতে এখানে ঘুমোতে পারি?
এই বলে সেই শুকনো আম পাতার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ জুড়ে আসছে। ঘুম একটা আঠা।
একেবারে ঘুমিয়ে পড়বার আগে খেয়াল করলাম, কুকুরটা আমার মাথার পাশে মায়ের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুলেন।
আমি জানি, আমার কাছে কিছুই নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই,  শুধু মুখে একটু মায়া লেগে আছে।

খুকু ও খুকুর মা


সাদা রাতের বৃষ্টি
......................
গতকল্য এখানে বৃষ্টি হল, বৃষ্টিভর্তি আকাশ
আমি আর দুটো কুকুর খুকুর মতো দৃষ্টি নিয়ে দেখেছি
খুকুরা পাটিগনিত ভুল করে
বিমানসেবিকা হয়ে যেতে চায় অধিকাংশ খুকু
বৈদ্যুতিক মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে ভালবাসে
ছড়িয়ে রেখে যেতে চায় গাঁদা ফুল, কানের গহনা
রাবণের দেশে যাবে রাম, উদ্ধারপর্বে
গতকাল বাড়ির ছাদে ঢেউটিনে পড়েছিল ছন্দ অলংকার
ছাতা নেই, কুড়োতে পারিনি
ঘুমিয়েছিল খুকু, তার মাতা শ্রম দান করে
রাজপুত্র চেয়েছে তারা সারারাত্র ধরে 

প্রজাতন্ত্র একবেলা : জিয়া হক


মুরগির খামারে স্বাগত ভগ্নস্বাস্থ্যবান
খাদ্যের সম্ভারে অনবদ্য সম্ভাষণ
ওই দেখুন লাল মুরগি,
                 কালো মোরগ তার উপর
গান শুনতে পাও? রফি
ধ্রুপদী রান্না হচ্ছে ও পাশের ঘরে, গন্ধ পাও?
আজ বড় বড় বাতাস বইছে
শীত নেই, অথচ বসন্ত তিন মাইল দূরে
শৌচালয় ওইদিকে, জলাভাব নেই
মুরগিরা আসছে, ওদের অভিবাদন নিন
গর্ভবতীরা এদিকে, প্রসবাগার কাছেই
আপনার হাসিমুখ দেখাই ওদের স্বপ্ন
মশলা পেষার শব্দের জন্য দুঃখিত
আজ বড় বাতাস
আপনার পতাকার জন্য এই আয়োজন, বুঝেছেন, এই শান্তি
বিশ্রামকক্ষ বাতানুকূল, পছন্দ করুন
কাকে পেতে চান
রাতে
পাতে

ডিপ্রেসনের বাংলা মানে ডিপ্রেসনই


ডিপ্রেসন কি জ্বরের মতো, থার্মোমিটার মাপতে পারে?
ডিপ্রেসন কি কর্কুটে রোগ, উড়িয়ে নেবে পগারপারে?
ডিপ্রেসন তো কুনকি হাতি, কর্ন নাড়ে মাথায় বসে
ঘর চলে যায়, বর চলে যায়, এমন মৌন রাক্ষসী সে।

জিয়া হক 

১১ জানুয়ারির কবিতা : বিশেষত জন্মদিন


অকাল প্রয়াত এই দিনে
      হেঁটেছে সূর্য সারা বেলা
গত রাত্রে চিত্র চলাকালে
    কৃত্রিমের বসে সৌরমেলা

বাস আনে ভালোবাসা
  বাসা থেকে ওড়ে নোনা তুলো
সরিয়ে রাখতে পারো তবে
  পরিচ্ছন্ন দানপাত্রগুলো

দাতা সব, করে রব
             সূর্য যায় বৃহত্তম ঢালে
পাতারা খাদ্য রাঁধে
স্বর্গে তারা যাবে পরকালে!

জিয়া হক 

পুষ্প চাও ফুল, কীট সখি?


রাতে কথা হবে পুষ্প, রাখি?
ফলবতী হতে চাও, রাখি?
যাদের ওঠে না, যারা নীচু
তুমি কি তাদের কাছে যাবে?
পুষ্প, পুষ্প, এখানে মালা হয়ে যায়
মৃতের শোভায় তুমি যাও?
পরম্পরা মনে রাখে যারা, যারা নীচ
জলসত্র খুলেও রেখেছে
তুমি কি তাদের তাদের কাছে যাবে?

রাত হল, রাখি পুষ্প, কাল কথা হবে?


খারাপ বলছো কেন?
নিজের নামকে ভালোবাসা দাও,
        আদর করো
সে তো তোমারই অংশ
ওকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাও

পরিপাকতন্ত্রের শিক্ষা তুমি পাওনি এখনও? পুষ্প!


জিয়া হক 

দাও ও ২০১৯


আমাকে দাও সেই ভাষা যে-ভাষা নতুন, সেই ভাব যে-ভাব নতুন, সেই কল্পনা যে-কল্পনা নতুন।
আমাকে দাও। আমি লিখতে চাই। আমার মনুষ্যধর্মের পাশাপাশি এই এক ধর্ম আমি বয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমাকে মূর্খের দেশে পাঠিও না। আমাকে অজ্ঞের দেশে পাঠিও না। নির্বিকার করো না আমাকে। শুধু দুশ্চিন্তা আমাকে কেন ভোগ করে যাবে? আমাকে আমার উপর জয়ী করো। আমার যা নাকি সম্ভবনা, দিয়েছো, তাকে অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়ে রেখো। আমাকেও জাগিয়ে রেখো। অনেক ঘুমিয়েছি। এবার ভারসাম্য দাও। এবার আমার টেবিলে আলো জ্বেলে দাও। এবার আমার কলমে আলো ঢেলে দাও। আমার খাতায় ফুটিয়ে তোলো বিকল্প ফুল। এই ফুলে সুগন্ধ ভরে দাও, এত গন্ধ যে সমুদ্র সুবাসিত হয়। আমাদের বড় দুঃখ, আমি সেই দুঃখ মুছিয়ে দেবার একখানি রুমাল ধার চেয়ে নিতে চাই। এই শীতে আমি যেখানে যেখানে বরফ জমে আছে সেখানে সেখানে আগুন জ্বেলে দিতে চাই। তুমি সে বন্দোবস্ত করো। অকাতরে অতর্কিতে ঘুমিয়ে পড়া লোকের মাথার নীচে বালিশের উচ্চতা দিতে চাই। তুমি সে ব্যবস্থা করো।
আমি তো বামন। চাঁদে হাত দিতে নয়, কেবলই চাঁদের শোভার সুখ্যাত বর্ণনাকারী হওয়ার সু-ভাগ্য দাও। সূর্যে জ্বালানি দেওয়ার আমি কেউ নেই, শুধু উত্তাপ পরিবহনের সু-ভাগ্যটুকু দাও।
দাও।

জিয়া হক 

পাঠিকা ও লেখার অপমৃত্যু সংক্রান্ত


এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা বস্তাবন্দি পথ
হারায় রৌদ্রে আর হারায় অন্ধকার জলে
কে আর পৃষ্ঠপোষণা দেয়, এ লেখার পিতামাতা নেই
জন্ম হয় কুমারীর গর্ভ ফোটা ফুল
জন্ম হয় শূকরের শুভ আস্তাকুড়ে
শুভ কেন—এ চিন্তা চিরে দেয় সমুদ্রের রাশি
ভোর হয় চিন্তা নিয়ে, সন্ধ্যা আসে চিন্তারাজ্য থেকে
শূকরেরও দিন ছিল কোনো এক স্বচ্ছ প্রদেশে
সুগন্ধ কোনদিন ছিল না এখানে তাই মৃতেরা আতর ভালোবাসে
এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা হারিয়ে যাবে
গোত্রপরিচয়হীন কোনো লবণাক্ত ঘাসে

সজনী পড়বে বলে লিখে রাখি আত্মজীবকথা
প্রেমিকার সৌধ গড়া যেই মতে প্রথা
সৌধ থেকে বালি খসে পড়ে
যেরকম আত্মা হয় রাতের বাগান
পরীরা রাজ্যজুড়ে মানুষের স্নানে
যোগ দেয়
দেশ গড়া হয় এইভাবে
খানিকটা আত্মরতি, খানিক স্বভাবে

এ লেখার মানে কি, এ লেখা কেন লেখা হবে?
মনেতে মাধুরী থাকে, বেকার কর্মীর কোনো স্তবে
উচ্চারিত হবে এ লেখা?
কর্মপ্রার্থী ও কবির কি কোনদিন দেখা—
হয়ে যাবে পথে, ট্রেনে, বাসে?
হয়ত এখানে নয়, হয়ত বাগানে নয়
হয়ত নরম দোকানে কিংবা শ্রীহীন আকাশে।

সূর্য থেকে ঢেউ এসে স্পর্শ করে ঘর
পাঠোদ্ধার হবে হয়ত
                         এই লেখা শীতে অতঃপর।
বসেছে দুজন পাত্রী, মুখোমুখি, রাখা
পদের পাত্রখানি চায়ের পেয়ালা দিয়ে ঢাকা

রচনা উপচে যায়, রচনা তলিয়ে যায় ঘুমে
যে রচে সেও কি মরে না নিজভূমে?
নিজভূমি নীচুভূমি হাজির হয় না সেখানে রোদ
শূন্য পাত্রে বেজে ওঠে অসিদ্ধ ভাতের সরোদ
কে শুনবে সে-গান? ওই গান?
পাখিরাজি, বৃক্ষকুল, যন্ত্রচালিত জলযান।


জিয়া হক 

রাধা থেকে ধারা-পতনের গন্ধ


ভালো আর বাসবে না কেউ, কোথাও আর ধ্রুবতারা নেই
মাঠের মাথায় জাগে বন্য সেই চাঁদ
যা কিছু যায় না ধোয়া তাই আজ জলের তলায়
ধ্রুবতারা চাও কেন? তুমিই যখন নীল গ্রহ
চাওয়া ধর্ম —এই জেনে তুমি রোজ প্রার্থনায় বসো
আলোকিত গাছ থেকে আলোকসদৃশ ফল ঝরে
তুমি তার পাশে এসে, তুমি তার লাবণ্য হতে চাও?

হও তবে, কোথাও রয়েছে কোনো বাধা?
তুমিই কৃষ্ণ জেনো,
                    তুমিই তার প্রকাণ্ড রাধা

জিয়া হক 

মিথ্যুকের গান


ও আমার ঘুমপাড়ানি রাত —বলো
বালিশ বিছানা টলমলো
শয্যাদ্রব্য পানীয় নেয় নাকি?
স্থির নয়, বাকি
বাকি আছে রাতের আঘাত
তপশিলি কোনো উপজাত
ভিক্ষা দেয় যদি
ক্ষতি হবে? হয়ে যাবে বড় লস-ক্ষতি?
নেই বলে হাত পাতে যারা
লোকেরা কি জেনে যায় তাহাদের মুখের চেহারা?
সাধু থেকে শুরু করা লোকে
অমূলক খাদ্যাভাবে ভোগে
অদ্য রজনী তার ঘুম
কেড়ে নেবে গাজনের লৌকিক মরসুম
পরিজন থাকে যদি দূরে
সাংবাদিকের মতো
           জেনে নেয়
আখ্যানের বাকি নাকিসুরে
কে-ই বা আর হায়
শান্তি-পেয়ালা দিতে চায়
                          এই দেশে

জিয়া হক

প্রাচ্যবিদ্যা


ভূত, ভূত, ভূত!
কোথায়?
ওই তো খাটের তলায়।
কই, খাটের তলায় তো কিছু নেই?
না না, দরজার ওপাশে।
দরজার পাশে তো মাদুর দাঁড়িয়ে।
ওই তো, আলমিরার পিছনে।
আরে, আলমিরার পেছনও তো ফাঁকা, কেউ নেই।
তাহলে জানালা দিয়ে পালিয়েছে।
তুই কি মস্করা করছিস? এই এলো আর এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল? এতগুলো লোক তাকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে আর সে ব্যাটা পিঠ টান মারল?
ভূত কি আর আমার কথা শুনে চলে নাকি?
কিন্তু তুই তো বললি এখানেই সে আছে।
ভূত এক জায়গায় বেশি ক্ষণ স্থির থাকতে পারে না।
তুই কি ভূতের স্পোক পার্সন? সে নিজে এসেই বলুক না সে কী পারে আর কী পারে না। আমরা কি তাকে অসম্মান করি?
এখানেই তো সমস্যা?
এতে আবার কী সমস্যা?
ভূতেরা আমাদের কাছে সম্মান চায় না, তারা আমাদের কাছে ভয় চায়।
আমরা না হয় ভয়ও করব, সে যদি একান্ত চায়। আমরা কি এতটাই নিষ্ঠুর?
আবার ভুল করলে।
আবার কী ভুল করলাম?
নিষ্ঠুর হবে ভূতেরা, আমাদের হতে হবে মিনমিনে, ভীতুর ডিম।
মিনমিনে মানে কী বলতে চাইছিস? বড় বাবু যেমন তার বৌয়ের সামনে করেন, সেই রকম মিনমিন?
মিনমিনে মানে উঠতে বসতে ভয় পাওয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, হাত পা কাঁপা, ফিট হয়ে যাওয়া, চোখ কপালে তুলে মেঝেতে শুয়ে পড়া—এই সব আর কি।
এ কী বললি তুই?
কেন?
যাকে দেখলামই না তাকে না দেখেই চোখ কপালে উঠবে কী করে? এ অন্যায় দাবী নয়?
এখানেই তো আসল মজা। সে তো সবাইকে দেখা দেবে না। ভগবান কি সবাই কে দেখা দেয়?
ভূত আর ভগবানকে এক করলি?
এই জন্য তোমরা তাকে দেখতে পাওনা। যা ভূত তাই ভগবান। এই সত্যিটা বুঝতে হবে।
ভগবানের পুজো করা হয়, ভূতের কেউ পুজো করে?
আজ সে এসে এই কারণে চলে গেল। তাকে শুধু ভয় করলে হবে না, ভক্তিও করতে হবে। তোমাদের তার প্রতি কোনো ভক্তি নেই। তাই তোমাদের ভূত-লাভ হল না।
তোর কি ভূতের প্রতি ভক্তি আছে?
ওরে বাবা, বলে কী! ভূতের সঙ্গে আমার অন্য চুক্তি।
চুক্তি?
সে তোমরা বুঝবে না। ভূতেরা সবার সঙ্গে চুক্তি করবে না।
তোর সঙ্গে তার চুক্তি হল কীভাবে?
আরে আমি তো ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়েছি।
ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি?
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগছে তো?
না মানে, হ্যাঁ। কিন্তু ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়ে তুই করবি কী?
আমার কাজ হল ভূতকে প্রমোট করা।
ভূতের আবার প্রমোশন লাগে?
লাগে বৈকি। কার প্রমোশন লাগে না বলো তো?
কিন্তু তাতে তাদের লাভ কী?
যে কোনো প্রোডাক্ট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার প্রমোশন জরুরি। টিভিতে অ্যাড দেখো না?
তোরা টিভিতে ভূতের অ্যাড দেওয়ার কথাও ভাবছিস নাকি?
না, এখন টিভির চেয়ে ইন্টারনেট বেশি কাজের।
আমার কথাটা এখনও তুই বুঝতে পারছিস না। এসব করে ভূতেদের লাভটা কী?
তুমি যদি এসব বুঝতে তাহলে আর কেরানি হয়ে জীবন কাটাতে না।
একটু বুঝিয়ে বল না।
ভয়ের বিজনেস। এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা আর নেই।
কিন্তু ওরা তো আর কোনো দেশ শাসন করছে না। ভয়ের ব্যবসা করে তারা পাবে কী?
এই তো গোল করলে। কে বলেছে তারা দেশ শাসন করে না! আমাদের দেশ যারা শাসন করে তারা অধিকাংশই ভূত। এরা মানুষের মধ্যে এমন ভাবে মিশে থাকে যে সহজে চেনা যায় না কে ভূত আর কে মানুষ।
তুই বলতে চাস আমাদের চারধারে যে সিপাই-সান্ত্রী, মন্ত্রী-পারিষদ তাদের মধ্যে ভূতেরা মিশে আছে? তাদের অনেকেই ভূত?
বলতে চাইছি না, নয়। এটাই বলছি আর এটাই সত্যি।
কিন্তু আমরা বুঝব কী করে? না বুঝতে পারলে বিশ্বাস করব কী করে?
তোমরা যে অবিশ্বাস করো, তাই নিয়ে ভূতেরা খুব মস্করা করে।
কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না, আমরা বিশ্বাস না করলে তাদের অস্তিত্বই যে টিকে থাকে না।
এই একটা অবৈজ্ঞানিক কথা বলে ফেললে তো!
ভূতের আবার বিজ্ঞান?
পূর্ণিমার রাতে তুমি যদি চোখ বন্ধ করে রাখো তাহলে কী চাঁদের অস্তিত্ব শূন্য হয়ে যাবে?
কিন্তু আমরা তো ভূত দেখতেই চাই, চোখ কোথায় বন্ধ করে আছি? তাদের দেখা দিতে সমস্যা কোথায়?
 এই একটা অর্থহীন প্রশ্ন করলে। আচ্ছা, যারা সিনেমার হিরো হিরোইন হয়, তারা আমাদের বাড়ি এসে দেখা করে না কেন? দেখা করলে কি তাদের নিয়ে ক্রেজটা আর থাকবে? কে আর টিকিট কেটে ঘরের লোককে দেখতে যাবে বলো?
কিন্তু তারা তো আর অদৃশ্য নয়, কোথাও না কোথাও তাদের তো আমরা দেখতে পাই।
ভূতেরা কি বলিউডের নায়ক নায়িকাদের মতো আচরণ করবে বলে তোমার মনে হয়? কেন তারা ওদের নকল করবে কেন? ওদের কোনো মৌলিকতা নেই? ওদের ইন্ডিভিজুয়ালিটি নেই? তারা ভূত বলে আমাদের নকলনবিশি করে বেড়াবে নাকি?
সবই তো বূঝলাম কিন্তু তোকে ওরা পেল কী করে?
পেল মানে?
মানে তুই ওদের পেলি কী করে?
সব কিছুকে খুব সহজ মনে করো, না? আমাকে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়েছে? অনেক ক্যান্ডিডেট ছিল।
পরীক্ষা? অনেক ক্যান্ডিডেট?
ভূতটা আবার এসেছে। ওই তো সে।
কই, কোথায়?
ওই তো, খাটের তলায়।
খাটের তলায়?
না, এখন দরজার পাশে।
কই, দরজার পাশে তো নেই। দরজার পাশে তো মাদুর।
এখন সে আলমিরার পেছনে।
কই?
এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল। যাহ!


জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

নির্জন লোকটা ও তার গোরস্থান


গরমের দিনগুলিতে সে নিজেই বাগানের চারাগাছে জল দেয়। সে এটাকে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়। এভাবেই সে পৌত্তলিকতাকে ব্যাখ্যা করে। ঘন সবুজ বনই আসলে দেবতার মূর্তি। পরিচর্যাই কার্যত পূজা —উপাসনা। ঘটনা খুবই সামান্য। একদিন তাকে এই বাগানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নিজের হাতে লেখা একটি কাগজের টুকরোও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা — আমি এই মৃত্যুর তদন্ত চাই না। ভাগ্য বিপর্যয়! একে ভাগ্য বিপর্যয় বলা যায় না। মৃত্যু নামের ঘটনাকে মৃত্যুর সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হল, এইভাবে বলা যায় একে। সে দেশ-ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল কিনা বলা মুশকিল। তবে তার গায়ের রং নীল ছিল না আর সে বাজার বলতে বুঝত নোংরা জায়গা যার শুধু দেহ নয়, আত্মাও বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে।
তার পরিবার যখন সেই কাগজের টুকরোর ভাষাকে অস্বীকার করে পুলিশ ডাকল তদন্তের জন্য তখন সে ওই বাগানেই শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীটা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক নয়। এখানে উলঙ্গ লোকেরাই উলঙ্গের নগ্নতা নিয়ে চর্চা করে।
সে চুপচাপ শুয়ে রইল যেভাবে সে পরিবারে এতদিন সময় কাটিয়েছে।

জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

দার্শনিক : পুরস্কার প্রাপ্ত


মায়ের কথা বলতে গেলেই বাবার কথা আসে। বারান্দায় বসে থাকা আমার বাবা। ঝুঁকে থাকা একজন মানুষ। যেন এইমাত্র পড়ে যাবেন। দড়ির ওপর থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন নিজেকে। কেননা তাঁর নির্দেশ আমরা আর কবেই বা মান্য করেছি। অবমাননাই তাঁর প্রাপ্য ছিল আজীবন। অবমাননাকেই তিনি শ্রেয় জ্ঞান করেছিলেন আজীবন। তাঁর জুতোখানি এখনও সাজানো রয়েছে জুতোর র‍্যাকে, যেভাবে রামের পাদুকা ছিল ভরতের আশ্রয়। তার রাজ্যপাটের অভিজ্ঞান।
আমার মায়ের দাবি শূন্য। তিনি শুধু রান্না করে গিয়েছেন রান্নাঘরে। মায়ের সঙ্গে আমাদের সবার তরিতরকারির স্মৃতি। শীতের রোদে বসে পালং শাক থেকে আগাছা বেছে বেছে প্লাস্টিকের চুবড়িতে রাখছেন—এই হল পরিচিত দৃশ্য। তাঁর জঙ্গলি ছাপা শাড়ি শুকোয় একা একা উঠোনের তারে। দোল খায়। আমরা তাঁর মনের খবর রাখিনি।
সেই মা-ই সেদিন বললেন, বাবা, একবার সমুদ্রে নিয়ে যাবি?
অবাকই হয়েছিলাম। মা কখনও বাড়ির বাইরে যেতে চান না সচরাচর। নিজেকে ঘরকুনো বলেই আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।
দু মাস হল বাবা নেই। চিরদিনের জন্য নেই। শিশুদের মতো নক্ষত্রের রাতে তাঁকে আকাশে খুঁজব নাকি গাছের অগণিত পাতায় খুঁজব ভাবি। বাবার প্রিয় নিমগাছটা এখনও বাড়ির সামনে শোভা পাচ্ছে।
মা সমুদ্রে যেতে চায়; মা বাড়ির বাইরে বেরবে—এ কি কম কথা।
বাবা-মা দুজনেই বলতেন তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। যেখানে যেখানে এতদিন কথা দেওয়া ছিল, যাওয়া হয়নি, যাইনি, সেখানে ঘুরে বেড়াব। সংসার থেকে অবসর নেব। পারবি না সংসার বুঝে নিতে?
বাবা বেরিয়ে পড়েছেন ইহকালের মতো। চিরকালের মতো। মা সমুদ্রে যেতে চান।
আমি জিজ্ঞাসা করি, মা, তুমি সমুদ্রে যেতে চাও কেন?
আজীবন চুপ করে থাকতে থাকতে মা চুপ করে থাকাকেই ধর্ম মনে করেন। তাই তিনি উত্তর দেন না। আমাদের বুঝে নিতে হয়। আমরা কবে বুঝতে চেয়েছি অব্যক্তকে?
মা বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে কথা বললেন, তোর বাবা বলেছিলেন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। আমি তো সমুদ্র বলতে শুধু বুঝি জল আর জল যার কোনও কূল কিনারা নেই। তোর বাবা বলেছিল, দার্শনিকেরা সমুদ্র ভালোবাসে।
দার্শনিক কী জানো মা?
আমার মায়ের তো লেখাপড়া কম। তিনি লৌকিক জ্ঞানে শিক্ষিতা। জীবনের সব সমস্যা পেরিয়ে আসতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েই।
মা বললেন, দার্শনিক মানে আমি জানি না তো রে, তবে তোর বাবা বলেছিল যারা শুধু দেখে যায়, কিছু বলে না, শুধু দেখে যায়।
আমাদের কাজের পিসি তখন ঘরে ঝাঁটা দিচ্ছিল। তিনি সব বিষয়ে মন্তব্যে পারদর্শি।
আমি ঘুরিয়ে বলি, আচ্ছা পিসি দার্শনিক মানে জানো?
পিসি তো কিছু বলবেই। পিসি বলল, ফেরিওয়ালা?
আমি বলি, ঠিক বলেছো।
পিসির মুখে প্রসন্ন হাসি। মা জানেন না যে প্রশ্নের উত্তর সেই উত্তর সে জানে—এ কম কথা নয়।
আমার মায়ের দিকে পিসি আড়চোখে তাকিয়ে নিল একবার।
পিসি চলে যেতে মা বললেন, দার্শনিক মানে তোর বাবা ভুলই জানত, না?
মা, শোনো, আমরা সবাই দার্শনিক,--তোমার বিশ্বাস হয় আমার কথা?
তারা সমুদ্র ভালোবাসে কেন? মা জানতে চান।
মাকে কীভাবে বোঝাব যে বাবার যুক্তি অকাট্য নয়। দার্শনিকরা পাহাড়, মরুভূমি, ঝর্ণা, গিরিখাত, হিমবাহ সবই ভালোবাসতে পারে। বাবাকে কি ভুল প্রমাণ করা উচিত হবে। বাবা তো মায়ের কাছে একজন শুধু মানুষ নয়,--বিশ্বাস, স্থান, তীর্থ।
এক সপ্তাহ পরের কথা। আমরা ভাইজাগ-আরাকু উপত্যকা ঘুরে এসেছি। এখানে পাহাড় আছে, পাশাপাশি সমুদ্রও।
দুপুরে বাড়ির বারান্দায় মা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম মায়ের।
খুব নরম স্বরে বললাম, মা, তোমার কোনটা ভালো লাগল? পাহাড় না সমুদ্র?
মা বললেন, মানুষ।




জিয়া হক

অযথা বিপ্লব ২০১৯


কী হবে এই দীর্ঘদিন, কালো কালো মেঘ
পাখিরা ফুলের কাছে মধু চায় নাকি
কী হবে ও মাছেদের রোদনসঙ্গীত
আমি কি নিরামিষাশী, সমাজ-আহত
নিদ্রাশেষে জলাধারে খাব সামাজিক
কেন যে কোথাও নেই মৃত মানুষেরা
কোথাও কেন যে নেই পূর্বমাতৃদল
সূর্য কি আলো দেয় দুপুরে ও ঘরে?
ঘরেতে ঘুমোয় যারা স্বপ্ন-দার্শনিক
তারা কি পুরনো রীতি কলঙ্কিত করে?


জিয়া হক 

মোজাফফর হোসেন ও তাঁর গল্পচিন্তা


কিছু বই পড়বার ইচ্ছা থাকে, —সহজে মেলে না। আচমকা পেয়ে গেলাম, —এ অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিই।
এবার আপাতত পাঠ ও পরিক্রমা।
বিস্তারিত ক্রমপ্রকাশ্য... 

উজ্জ্বল ঘৃণাদের ভিড়


এই উজ্জ্বল ঘৃণা আমাকে ফিরিয়ে দাও
দাও ওই ঘৃণ্য উজ্জ্বলতা
সাবেকী রাতের শীতলতা, —প্রীতির পিরিচে
নীল শুদ্ধ চা
সে তো জানে না অজ্ঞতা কী
ভেবে দেখো তাকে ক্ষমা করা যায় কিনা
সে তো জানে না ক্ষমা কী
যে ঘৃণা প্রকৃতই উজ্জ্বল বলে মনে করা হয়
যে মন প্রকৃতই মৃদুমন্দ বয়
কে তাকে প্রেমপ্রস্তাব দেয় বছরের ওইসব দিনে

জিয়া হক 

ঈশ্বরের দরবার


ওদের দাবি অন্যায্য নয়। দাবি আছে মানে কোথাও ক্ষীণ হলেও কোনও যুক্তি পরম্পরা আছে ; অন্তত বিশ্বাস আছে। যে প্রার্থী সে সব সময় প্রার্থনার যোগ্য না হলেও সে যে তার প্রাপ্তির ইচ্ছা প্রসারিত করেছে সেটাই বিবেচনার। এতে কি দুর্বলতা প্রকাশ পায়? স্বাভিমান নিকাশিত হয় কি? হয়ত হয় কিন্তু তা গুরুত্বপূর্ণ নয় তখন। প্রয়োজনই প্রণিধানযোগ্য। কথা অন্যত্র। আমরা তো দাবিদার, আমরা কি অপর দাবিদারদের বিষয়ে সচেতন? যদি না হই, যদি চিন্তায় অযত্ন থাকে তাহলে প্রার্থনা করার অধিকার থাকে না। জ্ঞানদানন্দিনী একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি জীবনের কাছে কী প্রত্যাশা করো?
আমি বলেছিলাম, শান্তি।
সে পরক্ষণেই বলেছিল, তুমি কি কারও শান্তির কারণ হয়েছো কখনও?
আমি বলি, না।
তাহলে জীবন তোমাকে শান্তি দেবে কেন? সে সপ্রতিভভাবে জিজ্ঞাসা করে।
তারপরই শান্তির সংজ্ঞা জানতে চায়।
আমি উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আজও পারব না।
হাত পাততে গেলে যেমন হাতের থাকা জরুরি তেমনই হাত পাতার আগে সেই হাতের ইতিহাসে কিছু কার্যক্রম থাকাও বিশেষ জরুরি।
ভিখিরি কি রোজ বাড়ি ফিরে তার ভিক্ষাপাত্র সাবান দিয়ে মাজে? সে কার কাছে কৃতজ্ঞ —ভিক্ষাপাত্র না মানুষের কাছে? কে তাকে বঞ্চিত করে —ভিক্ষাপাত্র না মানুষ?
বৃক্ষরোপনের রচনা লেখার আগে একটা বৃক্ষচারা রোপন করা জরুরি।

জিয়া হক 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে


লোকচক্ষু
............
শুবি আয় ফুলমণি, শুবি আয়
এ খাটের তলা
খানাখন্দ, ভ্রান্তি তবু
এখানেই তোর শিল্পকলা
দেখা হবে অমাবস্যা দেখে
আমি যদি লিপি হই
তুই তোর বর্ণমালা রেখে
এসে দেখ
টুনি বাল্ব চাঁদ লাগে কিনা
তুই যদি দিকভ্রষ্ট
          আমি হব বায়ুর দখিনা
লোক আসে? 
কতগুলো লোক?
তারা তো কর্পূর আর
ঘৃণার ঘোষক

জিয়া হক 

দেশ পরিচয়

দস্যু আর নাবিকের ভেদ আমি করতে পারি আর পারি
অতিথিকে ভালোবাসা দিতে
আমি জানি, কে অতিথি, কার ব্যাগে কী কী রাখা আছে
অথচ এ আবাসন—অতিথিশালাই বলা যায় একে
গাভী চরে, দুগ্ধজাত প্রেম প্যাকেটে যায় দূরে
এখানে জানালা থেকে মৃত্যু দেখা যায় তবু আমরা
বড় আর নকশা করা জানালা বসাই
সিঁড়ি ওঠে দোতলায়, সিঁড়ি ওঠে আকাশের সদর রাস্তায়
এভাবেই পুরনোকে দেখেছি আমরা
আমাদের হিন্দুমতে মরে গেলে ঈশ্বর হয় লোকে
জাহান্নমবাসীকেও আমরা স্বর্গীয় বলে ভাবি
এটুকু উদারতা, চক্ষুলজ্জা আজও টিকে আছে

বাড়া ভাতে ছাই দেয়, সেই ছাই দন্ত সাফে লাগে
এরকমই হত নাকি আগে



সে রকম লোক
.......................................................................

লোক হবে সাধারণ, লোক হবে কিছু মাথামোটা
ঝুল ছোট জামা পরা, ঝুল ছোট স্বপ্ন অর্ধ-গোটা
দেখবে কি দেখবে না—নিজে তার নির্বাচনে এসে
বৃদ্ধ আর শিশু আর মহিলা সভায় গিয়ে মেশে

সে কি তার প্রয়াত মায়ের কথাগুলি
বলে দেবে গর্ধবের কানে বা সমাজে?
বিদেহী আত্মার যদি শান্তি থেকে থাকে
এই তথ্য তার কোনো লাগবে কি কাজে?

লোক হবে অলৌকিক, লোক হবে সাদা ফুলগাছ
ঝরে যাবে সান্ধ্যকালে, ঝরে যাবে অপ্রাকৃত সাজ
দুপুরে সে ছোট হবে, এত ছোট পাদুকার নিচে
রাত্রি গড়িয়ে খাবে
                  প্রাচীন পন্থা মেনে
                                         মাটির পিরিচে


জিয়া হক 

সংসার যাত্রা

সংসারে বড় সুখ, রমণী রয়েছে, তার গুণ
সংসারে কী জানি অসুখ
পুরুষ রয়েছে
                 তার ঘুন

কে দীর্ঘ, —কে সেই পিরামিডখানা
শ্রমিকেরা নেই তবু
               জাদু কারখানা
বানিয়ে তুলেছে তার তার
রোগের মাথার পাশে
তুমি এসে
           বসো সংসার

ছিল ভালোবাসা—টেবিলে সাজানো
টেবিলটি ছিল দুই
তলায় সাজানো

এসেছে তন্দ্রাকাল, এসে গেছে ঘুন
ভালোবাসা বিশেষত জ্বালায় উনুন


রাত্রিকানা লোক
......................
এই রাত্রি বরং শান্ত, শুধু উড়োজাহাজ যায়
লোক পারাপার, যন্ত্রের পাখি সেজে ওঠা আর
তা ব্যতিরেকে শান্ত এই জীবনসুন্দর, গোঙানি
কলকাতা সুন্দর, নর্দমা সুন্দর, রঙিন ত্বক —সে সুন্দর
ভাড়াবাড়ি অ্যাকোরিয়ামের মতো বাষ্পে বাষ্পে জ্বলে
দূরগামী লোক দূরগামী ট্রেনে উঠে গেল
চুম্বন সুন্দর, চপেটাঘাত সুন্দর, জীবনীকাব্য— সে সুন্দর
এই রাত্রি তস্করের, এই রাত্রি ঘুমের বাসনা যার তার
আগ্নেয় উড়োজাহাজের শব্দ ব্যতিরেকে
শান্ত —সুমুখশ্রী —নিখরুচে ত্বকের

জিয়া হক 


ওহে বোর্হেস


গরমের দিনগুলিতে সে নিজেই বাগানের চারাগাছে জল দেয়। সে এটাকে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়। এভাবেই সে পৌত্তলিকতাকে ব্যাখ্যা করে। ঘন সবুজ বনই আসলে দেবতার মূর্তি। পরিচর্যাই কার্যত পূজা —উপাসনা। ঘটনা খুবই সামান্য। একদিন তাকে এই বাগানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নিজের হাতে লেখা একটি কাগজের টুকরোও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা — আমি এই মৃত্যুর তদন্ত চাই না। ভাগ্য বিপর্যয়! একে ভাগ্য বিপর্যয় বলা যায় না। মৃত্যু নামের ঘটনাকে মৃত্যুর সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হল, এইভাবে বলা যায় একে। সে দেশ-ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল কিনা বলা মুশকিল। তবে তার গায়ের রং নীল ছিল না আর সে বাজার বলতে বুঝত নোংরা জায়গা যার শুধু দেহ নয়, আত্মাও বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে।
তার পরিবার যখন সেই কাগজের টুকরোর ভাষাকে অস্বীকার পুলিশ ডাকল তদন্তের জন্য তখন সে ওই বাগানেই শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীটা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক নয়। এখানে উলঙ্গ লোকেরাই উলঙ্গের নগ্নতা নিয়ে চর্চা করে।
সে চুপচাপ শুয়ে রইল যেভাবে সে পরিবারে এতদিন সময় কাটিয়েছে।

জিয়া হক 

ভূ স্বর্গ


এই গানগুলি লিখে রাখো; তোমাকেই লিখে রাখতে হবে। পরে দেখা হবে। কথাও হতে পারবে। গানের তালিকা পাঠালাম।
চিঠিটি এভাবেই শেষ হয়ে গেল। আমি আলমারিতে তুলে রাখলাম। আলমারিতে  একটা খোপ আছে যেখানে আমি আমার চিঠিগুলি রাখি। সেখানে আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের চিঠিগুলি আছে, আর আছে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের চিঠি। আমিই প্রেমিকাদের হারিয়ে যেতে দিয়েছি। ছোটবেলায় আমি কখনও ঘুড়ি ওড়াইনি। আমার সমবয়সীদের ঘুড়ি আকাশে তুলে দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। একটা লাল আর চকরাবকরা কাটা ঘুড়ি আমি একবার সন্ধ্যাবেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল—আমি তোমাকে ভালোবাসি। কে কাকে ভালোবেসে এই কথা লিখেছিল তা আজও জানতে পারিনি। রেখে দিয়েছিলাম আমার তক্তাপোষের নিচে। এক বর্ষায় ঘরে জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঘুড়িটা। লাল চকরাবকরা কাটা ঘুড়িটা।
গানগুলি মিলিয়ে দেখলাম যে সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত। জয়তী চক্রবর্তীর তিনটে, ইমনের দুটো, বিক্রম সিং খাঙ্গুরার দুটো গান। এই গানগুলি শুনে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেই ঘুড়িটাতে কে লিখেছিল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, কিন্তু যখন জানতে পেরেছিলাম তখন আমি খুব অসহায়। অসহায়ই কেননা যে মেয়েটি লিখেছিল ওই যাদুকরী শব্দ তাকে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে ততদিনে। যাইহোক, আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি শুনতে হবে কিন্তু আমার কাছে শোনার মতো ডিভাইস নেই।
শীত পড়তে শুরু করেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাশ্মীরি শালওয়ালা সুলেমানের। সে এবার বাহারি চাদর নিয়ে এসেছে। লালের পাড় দেওয়া একটা সাদা চাদর আমার পছন্দ হয়েছে। মাকে এবছর একটা চাদর উপহার দেব কথা দিয়েছি।
সুলেমান একদিন বলল, আমি আর কাশ্মীরে ফিরে যেতে চাই না আশিক ভাই। এখানে একটা বন্দোবস্ত করে দিন।
আমি বললাম, ভূ-স্বর্গ ছেড়ে এই কাদামাটির দেশে থাকবেন?
আশিক ভাই, এটা তো তবু একটা দেশ, ওটা না দেশ, না রাজ্য। একটা জোকস নিশ্চয়ই শুনেছেন, স্বর্গে সবাই মৃত। আমরা ওখানে মরে আছি।
কিন্তু আমরা কি এখানে খুব ভালো আছি সুলেমান ভাই?
ভাবছেন ভিড় বাড়াচ্ছি, তাই না? কিন্তু ভালো থাকা কাকে বলে আশিক ভাই? আপনার পরিবারের কেউ কখনও সেনার গুলিতে প্রাণ দিয়েছে কখনও? আপনি নিজের ভাইয়ের জানাযায় শরিক হলে হয়ত অন্য রকম ভাবতে বসতেন।
সুলেমানের মুখ শতদ্রু নদীর মতো ম্লান মনে হল। শতদ্রু কখনও দেখিনি। তাই শতদ্রু নাম শুনলেই আমার কেন জানি মনে হয় নদীটি খুব দুখী আর তার উপত্যকা দিয়ে চোখের জল বয়ে যায়। যেমন গঙ্গা শুনলেই মনে হয় জাতি কী, জাতীয়তাবাদ কী, মনে হয় অজস্র প্রদীপের সঙ্গে ভেসে চলেছে ভারতমাতার জাহাজ। যদিও নাব্য নয় ততটা এই গঙ্গা। তবে ভারতমাতার জাহাজ তো আর নুহের নৌকা নয় যে জোড়ায় জোড়ায় প্রাণীরা সব সারি দিয়ে মহাপ্লাবনের ভয়ে কাঁপছে। তবে একটা কাঁপুনি টের পাই। কেন কাঁপে, কে কাঁপায়? জানি তবে এখন আমাকে একটা ডিভাইস জোগাড় করতে হবে এখন যেটাতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যাবে।
আমার এক পরিচিত আছে উকিলপাড়ায়। ওর নাম অপরূপ। সে যুক্তিবাদী এবং প্রযুক্তিবাদী। তার কাছে গেলে একটা ডিভাইস পেতে পারি। তার বাড়ি যেতে দেখলাম, সে বোগেনভোলিয়া গাছে জল দিচ্ছে। সাদা সাদা বোগেনভোলিয়া ফুটে রয়েছে। এই গাছ এখন ছোট। বড় হলে দড়ি পাকিয়ে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে বোগেনভোলিয়ার গাছ ছিল। একটাই গাছ কিন্তু মনে হবে একটা আস্ত বিহারি পরিবার খাদ্যের সংস্থানে বাংলায় এসে অনেকটা ফুটপাত দখল করে নিয়ে বস্তি তুলেছে। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সাদা আর সাদা ফুলে ঢাকা। যেন এক টুকরো ভূ-স্বর্গ। আমার প্রিয় স্থান ছিল সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেট। বই পড়তে গিয়ে ওই গাছের তলায় বসে থাকতাম, মনে হত মাথার উপর দশভূজা। আমি এক অসুর। তবে মহিষের পেটে আমার জন্ম নয়। মানুষের হয়েও ভাগ্যচক্রে অসুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু থাকা জরুরি।
অপরূপ আমাকে আসতে দেখে হাসল। বলল, দাঁড়া কুকুর সরাই।
আমার কুকুর দেখে খুব ভয়। বিশেষ করে যে কুকুর চেঁচায়। শুনেছি যারা চেঁচায় তারা কামড়ায় না। তারপরও আমার ভয় লাগে। কুকুরকে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা হয়। কুকুরের রচনা লিখে আমি প্রথম হয়েছিলাম একবার। জাজ বলেছিলেন, আমার লেখাটা এমন যেন একজন কুকুরই লিখছে। রচনাটি ছিল, ‘রাস্তার কুকুর ও গৃহপালিত কুকুর’।
অপরূপ কুকুর সরিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির ঘরটায়। বেশ বড় কালো কুকুর। কী প্রজাতির কুকুর চিনি না। আমি যে কোনো বিষয়ের প্রজাতি বিষয়ে বিশেষ অজ্ঞ। মানুষেরও যে প্রজাতি হয় তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। একজন কবি লিখেছিলেন, জগৎ জুড়ে একটাই জাতি আছে। কবিদের সমস্যা হল, তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি আশাবাদী। তারা খালি ইউটোপিয়ার কথা বলে। আর নৈরাশ্যবাদে ভোগে। আমি ততটুকু আশাবাদী যতটুকু আশা রাখলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয়।
তোর কুকুরের নামটা ভুলে গেছি অপ। একবার বল তো।
ওর নাম পেড্রো।
প্লেটো রাখতে পারতিস, পেড্রো কেন রাখলি?
তুই বিখ্যাত পেড্রোর গল্প জানিস না? বলিস কি!
পেড্রো আলমাদোভার?
না, ইনি সে পেড্রো নন। ইনি কৃষ্ণের আরেক অবতার। তার ভয়ে দেশের রাজাও তটস্থ হয়ে থাকত। দেশে এমন কোনো মেয়ে ছিল না যার সঙ্গে পেড্রো শোয়নি। রাজা তার ভয়ে রানিকে ফেলে যুদ্ধে যেতে চাননি। সে অনেক গল্প।
আচ্ছা, সে গল্প পরে একদিন শুনবো। এখন আমার একটা উপকার কর তো ভাই।
কী করতে হবে বল।
আমাকে একটা ডিভাইসে কয়েকটা গানের নাম বলছি ডাউনলোড করে ভরে দে। কর্তৃপক্ষের আদেশ, শুনতেই হবে।
তোর আবার কর্তৃপক্ষ কবে হল?
এ তুই বুঝবি না, এটা পুরোটাই আনুগত্যের ব্যাপার। কাকে কর্তৃত্ব করতে দিবি আর কাকে দিবি না সেটা তোর নির্বাচন। তবে সেটা ওয়াইজলি করতে হয়। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে, যে পেড্রো এমন সুখ্যাত, তার নামটাই কেন রাখলি তোর কুকুরের। আচ্ছা, কুকুরকে কুকুর বললে তোর আপত্তি নেই তো?
মজা করিস না। কুকুরকে কি টিয়াপাখি বলে ডাকবি? যাকগে, আসলে আমার কুকুরটা ঠিক পেড্রোর উলটো চরিত্রের। এ কারো সঙ্গে শুতে চায় না। ভুল বলা হল, কুকুররা কি শোয়? বরং বলি, দাঁড়াতে চায় না। এদিকে আমার মা আমার বিয়ে নিয়ে রোজ বাড়িতে অশান্তি করছে। আচ্ছা বল, তিরিশটা এমন কিছু বয়স? আসলে এরা তো সব পঁচিশেই দন্ডিত, তাই আমার স্বাধীনতা এদের কাছে পাপ মনে হচ্ছে।
তোমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমি বুঝেছি বাবা। এবার আমাকে ডিভাইসটা দে। তাড়া আছে, আজ একটু শিগগির বেরব।
খারাপ খবর আছে। আইপডটা অতনু নিয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহের আগে পাব না। ও দিয়ে গেলে তুই নিয়ে যাস।
সিঁড়ির ঘর থেকে পেড্রোর কুক্কুরনাদ ভেসে আসছে। সাইবার কাফেতে গেলে কি ইউটিউবে গানগুলি শোনা যেতে পারে? কেন যাবে না? শিবানী পীঠের মোড়ে একটা সাইবার কাফে আছে। সেখানে যেতে হবে। ঘন্টায় দশ টাকা। পরিচয় পত্র লাগবে। আমি তো জানি যে আমি কোনো হ্যাকার নই, শুধু গুরুদেবের কয়েকটা গান শুনতে চাই কিন্তু দেশ আমার পরিচয় পত্র না দেখে আমাকে তা শুনতে দেবে না।
অপরূপকে বিদায় জানালাম।
অপরূপের বাড়ি থেকে বেরলেই মোড়ের মাথায় মদের দোকান। মুখে কাপড় জড়িয়ে তিন জন মদ কিনছে। ইন্টেলেকচুয়ালসরা মদ খায়। এরা কি ইন্টেলেকচুয়ালস? আমার এক বন্ধু সেদিন বলল, এই যুগে যারা মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এদের জ্ঞানগম্যি প্রশ্নাতীত। তবে মুখে কাপড় কেন? জ্ঞানীরা প্রচার চান না। তাঁরা নিঃশব্দে বিপ্লবের পক্ষপাতী। বন্ধুকে মনে পড়ল আর এদের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠল মনে।


ডিভাইস পাচ্ছি না। তাই আপনি যে গানের তালিকা পাঠিয়েছিলেন তা এখনও শোনা হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সম্ভব হলে মার্জনা করবেন। তবে আগামী সপ্তাহে আমি একটি আইপড পেতে পারি।
আশিকের চিঠিখানি পেলাম। সে বড় অসহায় বলে মায়া হয় না, তার প্রতি আমার মায়া আছে বলে তাকে খুবই অসহায় মনে হল। এই গানগুলি না শুনেই সে জীবন কাটাচ্ছে ভেবে আমার কষ্ট হল। ওর চাকরি নেই। চাকরির চেষ্টাও করে না। ও বলে, আমি চিন্তক। অম্লান দত্ত নাকি এমন কথা বলেছিলেন কাউকে। সিঙ্গেল খাটে শুয়ে শুধু বই পড়ে আর ভাবে মুরাকামির মতো একটা উপন্যাস লিখবে। তবে মুরাকামি সঙ্গীত বিষয়ে কত জানে, আর ও গান বলতে বোঝে নচিকেতা। জীবনমুখী বাংলা গান না কি সব। নচিকেতা ছাড়া বাকি সব গান কোন মুখো, বুঝি না।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার স্করপিওর মিষ্টি হর্ন বাজাচ্ছে। কলেজ স্ট্রিট যাবো। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর বইটা উপহার দিতে চাই আশিককে। একজন ঔপন্যাসিক হতে চায়, আমার কর্তব্য হল তাকে তৈরি করে তোলা। স্বপ্নের সংখ্যা সীমিত লোকেদের আমার ভালো লাগে। বাবা বলতেন একজন দরজি আর একজন ম্যাজিসিয়ানের গল্প। গল্পটা সবাই জানে। ম্যাজিসিয়ান রোজ দরজিকে এই বলে খ্যাপায় যে, তুমি তো ভায়া একটাই মাত্র কাজ জানো—সেলাই করা। সেলাই বন্ধ হয়ে গেলে তো তোমার ভাত জুটবে না। আর আমাকে দেখো, হাজার একটা খেলা জানা আছে আমার। একটা বন্ধ হলে আরেকটা। এক সময় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ম্যাজিসিয়ানের শোতে আর লোক আসে না। খেতে পায় না তো ম্যাজিক দেখবে কী করে! রোজ রাস্তা দিয়ে খালি হাতে ফেরে আর দেখে দরজি তার সেলাই মেশিন চালিয়ে যাচ্ছে। ম্যাজিসিয়ান একদিন গিয়ে বলল, ভায়া এ কি হল বলো দেখি? তখন দরজি বলল, ভাই, আমি একটাই কাজ জানি, কিন্তু যে কাজটা জানি তার প্রয়োজন সব সময়ের। অনাহারে থাকলেও পোশাক মানুষকে পরতেই হবে। খালি পেটে ম্যাজিক দেখা যায় না।
আমি একটি গান গুনগুন করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলাম।
ড্রাইভার বলল, ম্যাডাম, আজ আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
মৌলালীর কাছে গাড়ি ট্রাফিকে আটকে গেল। বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে বললাম, আচ্ছা শানু, তোমার স্বপ্ন কী?
কেন ম্যাডাম?
মানুষের স্বপ্ন জানতে আমার ভালো লাগে। তবে বলতে তোমার আপত্তি থাকলে বলো না।
আপত্তি কিসের ম্যাডাম? তবে লজ্জা লাগে বলতে।
লজ্জা কেন?
আসলে ম্যাডাম, আমি আরেকজন ট্যাক্সি, ড্রাইভারকে আমার স্বপ্নের কথা বলতে পারি, কারণ আমি জানি সে হাসবে না। সে হাসবে না কারণ তার স্বপ্নটাও আমার স্বপ্নের মতোই উদ্ভট। খোঁড়া খোঁড়াকে দেখে হাসে না।
স্বপ্ন যে খানিকটা উদ্ভট হবে তা তো ধরেই নেওয়া যায়। আমার এক বন্ধু চায় সে একজন বড় ঔপন্যাসিক হবে। ঔপন্যাসিক মানে বোঝো তো?
ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট, বুঝি ম্যাডাম।
কী করে জানলে শানু ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট?
আমি বি এ পাস ম্যাডাম।
ও তাই তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যাইহোক, তোমার স্বপ্নটা বলো।
আমি যে বি এ পাস সেটা আমি ভুলে যেতে চাই ম্যাডাম। আর ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সব কিছু বুঝতে নেই, এটা খালি গুলিয়ে যায়। দেশ নিয়ে আমাদের কোনো মতামত নেই। রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনে আমাদের হাসবার অধিকার নেই। স্মৃতি একটু কম হলেই ভালো। আরও ভালো হয়, বোধও যদি একটু কম থাকে।
যানজট অনেক আগে কেটে গেছে। আমাদের গাড়ি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম, শানু তোমাকে এবার থেকে শান্তনু বলেই ডাকবো। শান্তনুদের শানু করে দিয়ে আমরা খুবই অন্যায় করি। যাইহোক, ফিরে এসে তোমাকে একটা গল্প শোনাবো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের। গল্পের নামই হল ‘নাম’।
অভিজিৎ মুখার্জি অনুবাদ করেছেন কাফকা অন দ্য শোর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বেরিয়েছে। বাংলায় বইয়ের নাম হয়েছে সমুদ্রতটে কাফকা। দুই খন্ডে। দাম করেছে সাতশ। প্রথম খন্ডটির কভার আকাশি নীল, দ্বিতীয় খন্ডটি সবুজ। উপরে বেড়ালের ছবি। আমার কুকুর রানির কথা মনে পড়ল। সে বেড়াল সহ্য করতে পারে না। তার পছন্দ টিয়াপাখি। একদিন তাকে রাস্তায় হাঁটাতে নিয়ে গিয়ে সেটা আবিষ্কার করি। রাস্তার ধারে যে খিরিশ গাছটায় টিয়াপাখিটা বসেছিল রানি সেই গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে পাখিটাকে দেখে যাচ্ছিল। সে ভুলে গিয়েছিল হাঁটার কথা, আমার কথা। তবে রানির সমস্যা হল, সে কোনো পুরুষ কুকুরকেও সহ্য করতে পারে না। এই কারণে সে মা হতে পারছে না। ধবধবে সাদা রানি যখন আমার গায়ের কাছে এসে বসে তখন যেন মনে হয় বোগেনভোলিয়া ফুটেছে।
ব্লু ডার্টে গিয়ে বই দুটো কুরিয়ার করে দিলাম আশিকার ঠিকানায়।
গাড়িতে বসে বললাম, এই নাও শান্তনু।
কী ম্যাডাম?
দেখই না।
বই?
হ্যাঁ, সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।
শান্তনুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বইটা পরম যত্নে সে পাশের সিটে নামিয়ে রেখে বলল, গাড়ি স্টার্ট করি ম্যাডাম?
করো, তবে প্যারামাউন্টের সামনে একবার দাঁড়িয়ো, ঠিক আছে?
ঠিক আছে ম্যাডাম।
ডাব সরবত নিলাম দুটো। আমার সামনের বেঞ্চে বসে আছে শান্তনু। সে খুব ইতস্তত করছে। মালকিনের সঙ্গে সে এর আগে কখনও খেতে বসেনি।
আমি বললাম, এবারও কি বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে শান্তনু?
বিহ্বল চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার চেয়ে আমার স্বপ্নের কথাটা বলি আপনাকে?
আমি বললাম, সে তো ভালো কথা। আমার প্রিয় বিষয়।
শান্তনু বলল, আমি চাই আমার নিজস্ব একটা ট্যাক্সি, আমি যার মালিক। হলুদ ট্যাক্সি। গাড়িতে সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে। আমার প্রিয় গায়ক সুবিনয় রায়। সুবিনয় রায় কেন ভালো লাগে জানেন তো ম্যাডাম? তার গলায় ভারি দুঃখ, ঔদ্ধত্য নেই, রবীন্দ্রনাথের বেদনা আর তাঁর বেদনা যেন কোথাও গিয়ে এক। আচ্ছা ম্যাডাম, দুখী মানুষদেরও কেন দুঃখের গান ভালো লাগে বলুন তো? তাদের জীবনে তো দুঃখের অভাব নেই।
আমি শুনছিলাম শান্তনুর কথা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, এম এ টা করলে না কেন শান্তনু?
সে অনেক গল্প ম্যাডাম। এই গল্পের সঙ্গে স্বপ্নের কোনো মিল নেই, যোগাযোগ নেই। আপনার স্বপ্ন শুনতে ভালো লাগে, স্বপ্ন ভাঙার গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। আপনি বরং নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পটা বলুন।
খুব বিষণ্ণ ভাবে বললাম, আজ নয়, অন্য একদিন বলব। চলো এখন যাওয়া যাক।
দাঁড়িয়ে পড়ে শান্তনু বলল, চলুন ম্যাডাম।
গাড়ি ছেড়ে দিল। শান্তনুর সিটের পাশে রবিশংকর বলের সম্পাদনা করা সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।


মুরাকামির সমুদ্রতটে কাফকা পাঠালাম। মুরাকামি হতে গেলে মুরাকামি পড়তে হবে তা বলছি না। তবে পড়তে হবে। আমি জানি তুমি যথেষ্ট পড়াশুনো করো। যাইহোক, নতুন কী লিখলে জানতে চাই। আর গানগুলি কি শুনতে পেরেছো?
চিঠিখানির সঙ্গে বই দুটো পেয়ে উত্তেজিত লাগছে। পৃথিবীতে এমন কেউ আছেন যিনি চান আমি একজন ঔপন্যাসিক হয়ে উঠি। বিদ্যাপতি, আলাউল, ভারতচন্দ্রের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে। ঠিকই রাজ-পৃষ্ঠপোষনা এ হয়ত নয়। কিন্তু আমার কাছে রাজা—এই পদটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি তার চেয়েও বড় কিছু দেখতে পাচ্ছি। মুকুন্দরামকে যে প্রত্যাদেশ দিয়েছিল সেই রকম কাউকে।
অপরূপ আজ আইপড দেবে। তবে অপরূপ আজ আইপড দিতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অতনুর উপর। আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন অতনুর উপর নির্ভরশীল। অতনু যে পিয়ানো বাজায় আর প্যারিসে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পেটের দায়ে সে স্কুল শিক্ষক।
অতনুকে আজ অপরূপের বাড়িতে দেখতে পাবো ভাবিনি। পটাসিয়াম, ফসফেট আর কী সব সার মেশানো হচ্ছে একটা পাত্রে। গাছগুলি অপরূপের কাছে সন্তানের মতো। বয়সের বাৎসল্যরস যাবে কোথায়!
আরে বন্ধু! অতনু আমাকে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সে কথায় কথায় ‘বন্ধু’ বলে। তার মতে, বন্ধুরা না থাকলে সে বাঁচতো না। যদিও তার মৃত্যুর কোনো কারণ দেখি না। তবে এই ‘বাঁচা’ বোধহয় ‘মৃত্যু’র ঠিক বিপরীত শব্দ নয়। অতনুকে দেখলে প্যারিসের কথা মনে পড়ে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তার কাছে খানিকটা প্যারিসের মতো। ভূ-স্বর্গ এই জায়গায় যাওয়া মানেই বেঁচে যাওয়া। অতনু এভাবে বাঁচতে চায় বহুদিন ধরে। স্বর্গের ধারনা সবার এক নয়। যেমন এক নয় হুর-পরির দেহসৌষ্ঠব।
আমার কিছু বলার আগেই অতনু বলে উঠল, বন্ধু, আইপডটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নষ্ট করে ফেলেছি। কী হবে এখন?
সার মাখানো হয়ে গেছে অপরূপের। এবার সে গাছেদের খেতে দেবে। অপরূপ এই জন্য গ্রেট যে তার আইপড নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অথচ সে রাগছে না, ভ্রুক্ষেপ করছে না। তার বাগানে বনসাই ফলের গাছ আছে। বনসাই ডালিম, বনসাই সবেদা, বনসাই জামরুল। পেড্রোর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। পেড্রোকে বনসাই করে রাখা যাচ্ছে না। পেড্রো প্রজননে অক্ষম কিনা তাও স্পষ্ট নয়। রাক্ষুসে চেহারার পেড্রো। নারী কুকুরে তার আসক্তি নেই। সে কি সমকামী?
অপরূপ বলল, আজ একটা মেয়ে দেখতে যাব। বিয়ে না করলে এই বাড়িতে আমার আর থাকা যাবে না। জরুরি নোটিস।
আইপডটা না পেয়ে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। যেন একটা চক্রান্ত কোথাও ঘনিয়ে উঠছে। আমাকে গুরুদেবের কাছে পৌঁছতে দেবে না কেউ। কেউ গাছ নিয়ে ব্যস্ত, পেড্রোর আদর খাচ্ছে, কেউ পিয়ানো বাজিয়ে মোজার্ট হয়ে উঠতে চাইছে, অনায়াসে ডিভাইস নষ্ট করে ফেলছে, আর আমি পরনির্ভরশীল জীব হয়ে শুধু লোকের বাড়ির সিঁড়ি বাইছি কিন্তু কোনো উচ্চতায় পৌঁছতে পারছি না। সিঁড়ি আমাকে নিচে ফেলে দিচ্ছে।
রাগ ভরে বললাম, যা যা বিয়ে কর, বিয়ে করা ছাড়া আর কী আছে তোদের জীবনে? শুবি-খাবি-হাগবি, তোরা সবাই ভেতরে ভেতরে পেড্রো, শুধু সাহস নেই, নয়ত কৌশল করে উঠতে পারিস না। আর আমি এমন এক প্যারাসাইট যার কিনা অবলম্বন বলতে আরো কিছু প্যারাসাইটস। লাগবে না তোদের আইপড। চলি।
আজ আর কুকুরকে দেখে ভয় লাগছে না। পেড্রোর সামনে দিয়ে নেমে এলাম। পেড্রো আমার সাহস দেখে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। যার এতদিন কাজ ছিল ভয় দেখানো, সে যখন জানতে পারল ভয়টা আমার এক সংস্কার মাত্র তখন তার নখগুলো সে লুকিয়ে ফেলে, কারণ সেও জানে ওই নখগুলো প্লাস্টিকের, নকল আর ভয় জিনিসটা একচেটিয়া নয়। একটা আত্মীয়-বিচ্ছিন্ন জীব বেশিদিন ভয় দেখাতে পারে না। যদিও আত্মীয় থাকলেই আত্মীয়-বিয়োগ হয়। ব্যথা হয়। পেড্রো এসব থেকে মুক্ত। রাস্তার কুকুরদের একটা সমাজ আছে, পেড্রোর তাও নেই। তার গড়নটা কুকুরের মতো রয়ে গেছে শুধু, তার সঙ্গে অপরূপের আর কোনো তফাত নেই। পেড্রো এখন একজন যৌন ভাবে শীতল মানুষ যার প্রিয় কাজ ভীতু নির্বাচন করা আর চিৎকার করে ভয় দেখানো। চিৎকারটুকুই তাকে কুকুরত্বে স্থায়ী করে রেখেছে। দেখেছি, লেজ দিয়ে সে অণ্ডকোষ ঢাকা দেয়।
বেলা এগারোটায়ও সাইবার কাফে খোলেনি। পরিচয় পত্র নিয়ে কাফের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। নীল রঙের একটা বোর্ড জ্বলজ্বল করছে—লীলা সাইবার কাফে এন্ড সোসাইটি। এই সোসাইটির দরজা আমার জন্যে বন্ধ এখন। একটা মেয়েকে পড়াই। সামান্য হাত খরচ হয় তাতে। সে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। একটা নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তার বাবা ইন্ডিয়ান অয়েলে চাকরি করে। প্রচুর বেতন। সপ্তায় দু দিন যাই। আজ সন্ধ্যায় যাবো আমার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অহনার বাড়ি।
দুপুরেই অহনার বাড়ি হাজির হলাম। অহনা একটা সাদা স্কার্টের ওপর সাদা টি শার্ট পরে আছে। অহনাকে ভারি মিষ্টি দেখতে। অহনা কিন্তু তার রূপ নিয়ে অতটা সচেতন নয়, এটাই তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমাকে দেখে সে বলল, স্যার এখন এলেন?
আজ সন্ধ্যায় একটা কাজ আছে, তাই এখন এলাম। তোমার অসুবিধা আছে?
স্যার, এখন তো আমি স্নানে যাবো।
তোমার মা কোথায়?
আজ বাড়িতে কেউ নেই স্যার।
আমি বসে আছি, তুমি স্নান করে এসো।
অহনা বলল, ঠিক আছে স্যার, পড়ে নিয়ে স্নান করব। আপনি কিছু খেয়েছেন?
কে আর খেতে দেবে আদর করে অহনা?
আমি দিতে পারি, এই বলে সে হেসে বাড়ির মধ্যে চলে যাওয়ার আগে বলল, বসুন, আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এলো অহনা। তার হাতে প্লেট। প্লেটে বিস্কুট, আপেল আর দুটো মিষ্টি। বলল, স্যার খান।
আমি বললাম, অহনা আজ একটা খেলা খেলবে?
কী খেলা স্যার?
খেলাটা মজার। তবে এই একদিনই হবে এই খেলাটা আর এই খেলার কথা কাউকে জানাতে পারবে না।
খেলাটা কী?
তোমার মা কখন আসবেন?
পাঁচটার দিকে, কেন স্যার?
ধরে নাও, এই দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি চব্বিশ ঘন্টা। একটা দিন।
আচ্ছা, তারপর?
আমরা একটা দিন এই বাড়িতে দু জন আছি শুধু। আমরা একটা দিন সংসার করব। তুমি আমাকে ‘ওগো’ বলে ডাকবে। আমিও তোমাকে ‘সোনা’ বলে ডাকব। আমরা রান্না করব, প্রথমে তুমি স্নান করবে, তারপর আমি স্নানে যাব, তারপর একসঙ্গে খেতে বসব, খেয়েদেয়ে আমরা একসঙ্গে শোব, তারপর ঘুম থেকে একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠব, তুমি ব্রাশ করবে, আমিও ব্রাশ করব। তারপর আমি কাজে বেরিয়ে যাব, তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাবে। সবটা পাঁচটার মধ্যে।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে অহনা বলে উঠল, ওগো, আজ কী রান্না হবে গো, একবার রান্নাঘরে এসো না দেখি।
আমি বললাম, সোনা, আজ আমরা যদি উপোষ করি কেমন হয়? মাঝে মাঝে উপোষ করা শরীরের জন্য ভালো। শাস্ত্রে আছে।
তুমি আমাকে শাস্ত্র শুনিও না তো…আমি তোমার ছাত্রী নই…
আমরা স্নান করে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অহনা বলল, লাইটটা বন্ধ করে দাও না গো।
আমি জিগ্যেস করি, এসব শিখলে কোথায়?
সে বলল, মেয়েরা সব শিখেই পৃথিবীতে আসে।
আমি বললাম, সোনা, আমাদের বিবাহের মেয়াদ তো একদিনের, তাই আমরা কোনো ইস্যু নেব না, ঠিক আছে?
তুমি কি কনডোম নিয়েই এসেছিলে আজ?
না, আমার কোনো ছদ্মবেশ নেই। আর আজ এমন খেলা হবে তা আমি জানতামও না।
ক্যারেকটার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো বাবু, খেলাটা মাটি করবে নাকি?
অহনা, খেলাটা আমার আর ভালো লাগছে না, আফটার অল আমি তোমার শিক্ষক। পরের দিন তোমাকে পড়াতে আমার অসুবিধা হবে। আর একটা সমস্যা আছে, এই খেলাটা রোজ খেলতে ইচ্ছা করবে, তখন কী করব?
কাউকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নেবেন। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?
আমি উঠে আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। বিছানায় শুয়ে আছে অহনা। সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে মনে হল, আমি একটি বোগেনভোলিয়া খেতের ধার থেকে এই মাত্র উঠে এলাম। অহনার শরীরে পূর্ণ নারীর মিষ্টি সুগন্ধ এসে গিয়েছে। সে এখন বিবাহযোগ্যা। সে এখন অনায়াসে মা হতে পারে। যদিও তার এখনও আঠারো বছর পূর্ণ হয়নি। বুঝলাম, আঠারো একটা সংখ্যা মাত্র। আঠারো একটা অনুশাসন। তার বেশি কিছু নয়।
অহনাকে বললাম, আজ যাই।
আমাকে আশির্বাদ করবেন না?
ছাত্রী হিসেবে না স্ত্রী হিসেবে?
একটু চুপ করে থেকে বলল, একদিনের জন্য হলেও আমি আপনার স্ত্রী হয়েছি আর এখনও পাঁচটা বাজেনি। তবে আমি আপনাকে জোর করব না, যা হিসেবে আশির্বাদ করতে চান আমি তা নেব। শুধু একটা কথা, পাঁচটার পর থেকে যেহেতু আমি ছাত্রী আর আপনি আমার শিক্ষক আর এই সম্পর্কটাও আমার কাছে একটা বিশেষ স্মৃতি, তাই দুবার আশির্বাদ করুন আমাকে—একবার ছাত্রী হিসেবে, আরেকবার স্ত্রী হিসেবে।
বুঝলাম, অহনা আমাকে ভালোবাসে।
আমার আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সে চোখ বন্ধ করল। যেন কোনো সিনেমা।
আমি বেরিয়ে পড়লাম। গেটের ধারে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অহনা, তার চোখ ভারি শান্ত, মাথায় শাড়ির আঁচল।



দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি শুরু করছি। পৃথিবীতে ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশের বেদনা বয়ে বেড়াবার জন্য যেন জন্ম নিয়েছি। যাইহোক, গানগুলি এখনও শুনে উঠতে পারিনি। এই কারণে নয় যে গানগুলি শুনবার ইচ্ছা আমার নেই, বরং এই কারণে যে গানগুলি শুনবার উপায় আমার নেই। কীভাবে ব্যবস্থা হবে তার চিন্তায় কালাতিপাত করছি। কাফকা অন দ্য শোর আমার মাথার ধারে জায়গা করে নিয়েছে। ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি শেষ করছি।
দুপুরে এই চিঠি এসে পৌঁছেছে। এই যুগেও আমি চিঠি পেতে ভালোবাসি। তবে চিঠি লেখার লোক অত্যাশ্চর্যভাবে কমে গেছে। এই নয় যে তারা চিঠির বিরোধী বা চিঠি লেখার পদ্ধতিকে মেনে চলতে নারাজ বরং এই যে তাদের বলবার কিছু নেই। অভিধান উপহার পেলেও এই রোগ সারবার নয়। অভিধান একটা সহায়ক উপকরণ মাত্র, কথা বলবার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে অপারগ। একজনের বিয়েতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ উপহার দিয়েছিলাম। দুঃখের সঙ্গে জানাই, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে। এই বিচ্ছেদটা ভাষাজনিত, তা বোঝাই যায়। যাকে ডিনার সেট উপহার দিয়েছি সে এখনও আমার বাড়িতে আসে। হরিচরণ এখানেই ডিনার সেটের কাছে রোজ হেরে যাচ্ছে।
আমার বাবার গলা পেলাম। দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, কে এই আশিক?
ও, তুমি চিঠি দেখেছো?
সেটুকু দেখার অধিকার এখনও আমার আছে বলেই মনে হয়, নাকি নেই?
বাবা, তুমি আশিক সম্পর্কে যেটা শুনতে পছন্দ করো সেটাই বলব নাকি যেটা বললে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকবে তেমন একটা কিছু বলে রাখব আপাতত?
তুমি সত্যিটা বলবে।
তাহলে শোনো, আশিক আমার একটা প্রকল্প। আমি ওর এক স্বপ্নের এজেন্ট। তুমি কখনও কারও স্বপ্ন ডেসপারেটলি পূরণ করার চেষ্টা করেছো বাবা?
প্রকল্প, এজেন্ট, স্বপ্ন—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দিন দিন সেই হেঁয়ালিটার মতো হয়ে উঠছো যেটার প্রস্তুতকারক স্বপ্নে পেয়েছে সেটা আর নিজেই তার উত্তর জানে না।
আচ্ছা বাবা, তুমি নতুন তিন জন বাঙালি নভেলিস্টের নাম বলতে পারবে যাদের পড়া যায়?
তোমার কি মনে হয় যে অফিসের পর আমার এতটাই সময় আর ইচ্ছা থাকে যে যা দিয়ে আমি উপন্যাস পড়তে পারি? তুমি বিত্ত দেখেছো কিন্তু আমার জার্নিটা কতটা সহৃদয় ভাবে দেখো তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমি জানি বাবা তুমি খুব স্ট্রাগল করে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছ কিন্তু তাই বলে আমি রোজ তোমার এই স্ট্রাগলটা থেকে কী পেতে পারি? তুমি নিশ্চয়ই মালাচন্দন পাওয়ার জন্য আমাকে জন্ম দাওনি। এই ভেবেও আমার জন্ম দাওনি যা ভেবে স্বর্গের অনিরুদ্ধ আর ঊষা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে লখিন্দর-বেহুলা হয়ে জন্ম নিয়েছিল।
আমার বাবা চুপ করে থাকে। তার এই চুপ করে থাকার মধ্যে বিষণ্ণতা নেই। যদিও আমি বাবার চুপ থাকা মুখটা পছন্দ করি না। বাবা নিয়মিত কথা বলবে, আমাকে বাক্যবাণে জর্জরিত করবে, পরাস্ত করবে—এটাই আমি চাই।
বললাম, বাবা তুমি আমার সব স্বপ্ন পূরণ করেছো। আর আমিও যে কারো স্বপ্ন পূরণ করতে পারি তার উপযুক্ত করে তুলেছো আর ব্যবস্থাও করেছো। কিন্তু আমি ছাড়া তুমি আর কারো একজনের স্বপ্ন পূরণ করে দেখো, আমি তোমাকে মহামানব হয়ে যেতে বলছি না। ক্যাপিটালিস্টরা যেভাবে পুঁজি জড়ো করে সেই ভাবে কিছু স্বপ্ন জড়ো করে দেখতে পারো। আমি তোমার কাছে একটা দায়িত্ব কিন্তু যে তোমার দায়িত্বাধীন নয় তাকে ভরন করে দেখই না একবার।
কী করতে হবে আমাকে? গম্ভীর ভাবে বলল বাবা।
শান্তনুর একটা ট্যাক্সি কিনে দাও না বাবা। হলুদ ট্যাক্সি। ওর স্বপ্ন ও একদিন একটা ট্যাক্সির মালিক হবে। নিজের ট্যাক্সি, নিজের মর্জি, নিজের স্বর্গ।
নিঃশব্দে বাবা চলে গেল। তার মুখ থমথম করছে।
আমি আজ একটা সিনেমা দেখব। ল্যাপটপটা অন করলাম। আজকের আবার মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অফ হেভেন দেখব। ইরানের পরিচালকরা ম্যাজিসিয়ান কিন্তু সেই দরজিটার মতো যারা শুধু একটা কাজই ভালো জানে সেটা হল অত্যাশ্চর্য সব ছবি বানানো। মাজিদ মাজিদিকে মনে হয় ইরানের সত্যজিৎ রায়। অস্কার দিয়ে কিছুই বিচার করা যায় না। বরং যারা অস্কারের দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকে তাদের ছবিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। আমার এক বন্ধু আছে যে শুধু নোবেল আর বুকার পাওয়া সাহিত্যটুকুই পড়ে। এর মানে তাকে সব সময় পথ দেখিয়ে দিতে হয়। এই দেখানো পথের
বাইরের জগৎটা তার কাছে ব্লার। বাঙালিপনা আর মধ্যবিত্তপনা এগুলো। তবে আমেরিকার মধ্যবিত্তরা কীভাবে ভাবে তা জানতে ইচ্ছা হয় খুব। দেশকাল অনুযায়ী মধ্যবিত্তদের ভাবনা কাঠামোর বদল হয় কিনা তা জানার বিষয়। আমি অশিক্ষিত, তাই জানি না। আমি যে অশিক্ষিত—এই কথা স্বীকার করি বলে লোকে আমাকে আরো বেশি করে শিক্ষিত ভাবে। এ আমার কোনো কৌশল নয়, এ নেহাতই সামাজিক মনোবিকলন।
সিনেমাটা ভিএলসিতে অন করতে যাবো, এমন সময়ে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। একটা কাগজের টুকরো আমার টেবিলের উপর রেখে যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবে বেরিয়ে গেলেন।
উঠে গিয়ে দেখি, একটা চেক।
শান্তনুর স্বপ্নটা এখন রাস্তায় দৌড়বে হলুদ সর্ষে ফুল উড়িয়ে।
গ্যারাজে এসে দেখলাম শান্তনু নেই। দারোয়ান নয়নকে জিগ্যেস করে জানলাম, সে বাড়ি চলে গেছে। তার মা মারা গেছে। একটা ছোটবোন আছে তার। সে এখন গ্রামের একটা সাইকেল গ্যারাজে মেকানিকের কাজ করবে। আর ফিরবে না।
আমি বললাম, আমাদের না জানিয়ে চলে গেল কেন?
নয়ন বলল, জানি না ম্যাডাম।
আমার বাবা একটা গল্প বলেছিল। এক দরিদ্র লোক বাজারে যায় তার বানানো মাটির পাত্র নিয়ে আর কিছু বিক্রি হয় না তাই খালি হাতে ফিরে আসে। সে খুব দুখী। দেবীরও খুব কষ্ট হল। একদিন দেবী এক থলি টাকা নিয়ে লোকটার ফেরার পথের ধারে রেখে দিল। লোকটা সেদিন কী যে হল, ভাবল, অন্ধরা কীভাবে পথ চলে? দেখা যাক, এই ভেবে সে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেল সেই টাকার থলি। দেবীর চেষ্টা ব্যর্থ হল। দেবী বুঝল, এর দারিদ্রের কোনও পরিবর্তন নেই। তবে শান্তনু শিক্ষিত, সে অপরিনামদর্শী নয়, সুবিবেচক। আর আমি কোনো মতেই দেবী নয়। আমার অন্তত চারটে হাত নেই। বরং আমার নিজেকেই এখানে ওই দরিদ্র লোকটার মতো মনে হল আর শান্তনুকে দেবী। যদিও ব্যাকরণ বলবে সে দেবী কখনই হতে পারে না। হতে হলে তাকে দেবতাই হতে হবে। আশিককে একটা আইপড পাঠাতে হবে। নইলে অন্তত একটা স্মার্ট ফোন। ভাবতে ভাবতে গ্যারাজের পাশে ছোট ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
শান্তনু যে ঘরে থাকত সেখানে গিয়ে দেখলাম দেওয়ালে কালীর ছবি, গাঁদা দেওয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি, তাতেও গাঁদা ফুলের মালা, কয়েকটা সাদা পাতা ছড়ানো, তাতে কবিতা ধরনের কিছু লাইন। তুলে রাখলাম, পরে পড়ে দেখতে হবে। তার বিছানার উপর পড়ে রয়েছে একটা ময়লা বালিশ, সেটা সে নিয়ে যায়নি, বালিশের পাশে সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ। বুকমার্ক দেওয়া।


তালসারি দূরে দেখা যাচ্ছে। না, তালসারি নয়, এটা ঝাউসারি। আমরা দীঘার বোল্ডারের উপর বসে আছি। আমার কানে হেডফোন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। প্রথমে শুনবো খাঙ্গুরা, তারপর জয়তী, তারপর ইমন। আমার পাশে বসে আছেন অহল্যা, মানে যিনি আমাকে দিনের পর দিন উপন্যাস লেখার রসদ জুগিয়ে এসেছেন। মুরাকামি দিয়েছেন, রবীন্দ্রগানের লিস্ট দিয়েছেন, একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে এসেছেন এই দীঘায়। আমি কেবলই কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ছি যত তিনি তত আমাকে টলস্টয়ের গল্প বলছেন, দস্তয়েভস্কির গল্প বলছেন। আমার চেয়ে অহল্যার বয়স সামান্য বেশি। অহল্যার তার স্করপিও গাড়ি করে পোষা কুকুর রানিকেও এনেছেন।
আমরা আসব দীঘাতে—কেউ জানত না সে কথা। কিন্তু অপরূপকে আবিষ্কার করেছি আমাদের পাশের হোটেলে। সেও এসেছে তার কুকু-র পেড্রোকে নিয়ে। সবাই বাঙালির দীঘা আসাকে মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রসারিত অংশ করে দিয়েছে। বলা হয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের তিনটে বেড়ানোর জায়গা যথা দীঘা, পুরি, দার্জিলিং অর্থাৎ দীপুদা। মধ্যবিত্ত ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালি সব কিছুকে ক্যাটেগোরাইজ করতে ভালোবাসে। এরা ব্যাখ্যা দিতে জানে না, শুধু মন্তব্য করতে জানে। বলা হয়, ভাবখানি সম্প্রসারন করে নেওয়া হৌক। কেমন মন্তব্যজীবিতা? না, এরা বলবে,--যারা নচিকেতা শোনে তারা বাল বা যারা এই যুগেও মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন আছে, রোদ্দুর রায় শ্রেষ্ঠ কেননা তাকে সবাই অপছন্দ করে, রাম ছাড়া জগতে আর কোনো মদ পেয় নয়,--এই রকম আর কি। আমার মজাই লাগে। বাঙালি মাত্রেই অম্লান দত্ত সিনড্রোমে অসুস্থ।
অহল্যা আমাকে ‘আপনি’ বলতে যত নিষেধ করেন ততই আমি ‘আপনি’ বলে ফেলি। এই আপনিটা শুধুই একটা সম্মান নয়, এর মধ্যে রয়েছে অকথিত দূরত্ব আর কৃতজ্ঞতা। আমি চাই না, অহল্যা আমার দূরে, কেউ হয়ে আজীবন বেঁচে থাক। আমি চাই সে আমার সবচেয়ে কাছের, ঘনিষ্ঠতম মানুষটি হয়ে উঠুক। কিন্তু তার স্করপিও গাড়িটার কথা মনে পড়লেই আমি তাকে সমীহ করা ছাড়া অন্য উপায় খুঁজে পাই না। আমি কি সম্পদের কাছে নত? আমার মধ্যে কি বিত্তের একটা শ্রেনিবিন্যাস খুব প্রকট হয়ে গড়ে উঠেছে যেটা শত অনুরোধেও উপড়ে যাচ্ছে না? দীঘার সমুদ্রের চেয়ে সুন্দর আর কিছু আজকের আমার কাছে আর কিছু নেই।
অহল্যাকে আমার দেবার কিছু নেই। তাকে শুধু মাত্র একটা উপন্যাস দিতে পারি। সেই উপন্যাস যদি খাজা হয় তার মানে আমার উপহারটিও যথারীতি খাজা।
অহল্যা বললেন, কেউ কাউকে ভালো না বাসলে এতদূর আসতে পারে?
আমি বলি, দয়া বলেও একটা শব্দ অভিধানে আছে।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন চলছে। তার হাতে রানির গলার চেন ধরা। রানি দৌড়তে চায় কিন্তু মালকিন তাকে অনুশাসনে রেখেছে। কুকুর একটি বিলাসিতা শুধু নয়, একটা সিম্বল। কিসের সিম্বল? সবাই জানে, এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
অহল্যা বললেন, এই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি কেমন?
আমি বলি, খাঙ্গুরাকে আমি ভালোবাসলাম।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন বয়ে চলেছে। এই কথোপকথনে কোনো ঢেউ নেই, দীঘার সমুদ্রের মতো। শুনেছি, পুরীর সমুদ্র যা বা যাকে নিয়ে যায় তাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়। দীঘার সমুদ্রের এই সুনাম নেই। তবে একটা বিষয় আছে, সেটা হল, দীঘার সমুদ্র তেমন কিছু নিয়েও যায় না। যে নিয়ে যায় না কিছুই সে ফেরাবে কী?
দেখলাম, অপরূপ তার কুকুর নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওহো, তাহলে পেড্রোকে দেখেই রানির এত উত্তেজনা? যে রানি পুরুষ কুকুর সহ্য করতেই পারে না। পেড্রোও অপরূপের হাত ছাড়িয়ে রানির কাছে আসতে চাইছে। যে পেড্রো কোনো কুক্কুরীকে আজও মেনে নিতে পারেনি।
অপরূপ কাছে আসতেই রানি আর পেড্রো পরষ্পরের গা শুঁকতে লাগল। গা মানে শুধু গা নয়, গায়ের সবটা। মূলত প্রজননদ্বার। দুজনে যেন তাদের হারানো সোলমেটকে ফিরে পেয়েছে এই দীঘার সমুদ্রের ধারে। যেন বৌদ্ধ ধর্মের দুই জাতক, গত জন্মে তারা পতি-পত্নি ছিল, পাপের ফলে এই জন্মে কুকুরজীবন লাভ করেছে। মিলিত হলেই যেন তাদের ইমানসিপেসন হবে, নির্বাণলাভ হবে। তারা শূন্যে হারিয়ে যাবে।
আমি বললাম, অহল্যা, রানিকে ছেড়ে দাও। ওকে আটকে রেখো না। দেখো, তুমি বলে ফেললাম তোমাকে। ভাই অপরূপ, তুইও তোর পেড্রোকে ছেড়ে দে। ওরা সমুদ্রের আরও কাছে চলে যাক। ওদের খেলতে দে।
দুজনে হাতের চেন আলগা করল না শুধু, ছেড়ে দিল। পেড্রো আর রানি পাশাপাশি যেন হাত ধরাধরা করে এগিয়ে চলল। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। তারা আজ খেলবে। ওদের লজ্জা নেই, অথচ আমরা তিনজন কেমন লজ্জিত মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরাই শাপগ্রস্থ। আমি যেন অনিরুদ্ধ আর ঊষা যে কে তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, কাশ্মীরি চাদর বিক্রেতা সুলেমান ভাই এসেছে।
দুপুর হতে আর বেশি বাকি নেই। খানিকটা লিখলেই আমার ঘুম পেয়ে যায়।
একটা চাদর নেবে বলেছিলেন আশিক ভাই, বললেন সুলেমান।
হ্যাঁ সুলেমান ভাই, মায়ের জন্য একটা চাদর আমাকে নিতে হবে, বললাম।
সবচেয়ে উমদা চাদরটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি, এই যে দেখুন, এতে যে ফুল করা সুতো দিয়ে, ওটা আমার বেগমের করা
বেগমের কথা মনে পড়ে না সুলেমান ভাই?
আশিক ভাই, কাশ্মীরিদের মনের খবর কেউ রাখে না। আপনি জিগ্যেস করলেন, ভালো লাগলো। আপনাকে বলি, আমার ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। তাকে এক রাতে সেনারা তুলে নিয়ে চলে গেল। সে পড়াশুনোয় কত ভালো ছিল। আই এ এস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আপেলের মতো গায়ের রঙ। একবার সে আই এ এস পরীক্ষা পাসও করেছিল, ইন্টারভিউয়ে বাদ পড়ে। তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম আমারই এক আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে। সে মেয়েটি খুব সুন্দর। মেয়েটা ইংরেজি অনার্স নিয়ে কলেজে পড়ত। তার নাম সবনম। সবনম আমাদের বাড়ি আসত। আমার ভাই ফারহান যখন চেয়ারে বসে পড়ত তখন সে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকত। সবনম বাড়ি থেকে ফারহানের জন্য সুন্দর খাবার বানিয়ে আনত। যে দিন ফারহানকে তুলে নিয়ে গেল সেনারা পর দিন তার জানাযা পড়লাম।
কেন, কী হল?
আশিক ভাই, সব ভারতীয়ই এর কারণ জানে, সবাই জানে কী হল, আপনি এর পরও জানতে চাইছেন কেন?
আমাদের সমস্যা কী জানেন? আপনার ভাইয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
শুধু আমার ভাই নয় আশিক ভাই, গ্রামের পর গ্রামের ভাই। সবার ভাই। সবার। আমরা শুধু আমাদের ভাই, আর কারও ভাই নই। আমাদের জানাযায় কেউ শরিক নয়। ভূ-স্বর্গের কবরগুলো স্বর্গীয় নয় আশিক ভাই।
আপনি কবিদের মতো কথা বলছেন।
কাশ্মীরিরা সবাই কবি, শায়ের। সবার অপরিসীম যন্ত্রণা তো। টেগর কত দুঃখ পেয়েছেন সারা জীবন বলুন তো?
আপনি টেগর পড়েছেন?
টেগর পড়িনি তবে তার জীবন সম্পর্কে শুনেছি। তার অনেক আত্মীয় মারা গিয়েছে তার সামনে, আমাদের মতো। তবে আমার একটা উপকার আপনাকে করতে হবে আশিক ভাই।
কী উপকার?
এখানে আমার একটা রেশন কার্ড বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি পরিবার নিয়ে এই বাংলায় চলে আসব। কাশ্মীর মরে যাচ্ছে ভাই, ভারতবর্ষের ম্যাপের মাথাটা পচে যাচ্ছে। সবাই জানে, নাকে রুমাল দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু চিকিৎসা করবে না।
কিন্তু ভাই, আপনার রেশন কার্ড এখানে করা যাবে কীভাবে আমি তো বুঝতে পারছি না। এ সব বিষয়ে আমি ভীষণ রকম অজ্ঞ।
কোনো লিগ্যাল সমস্যা আছে?
বোধ হয়।
আমাদের সঙ্গে লিগ্যালি কী হচ্ছে ভাই, আমাদের বেঁচে থাকাটাই তো ইল-লিগ্যাল, মৃত্যুটাই বৈধ।
সুলেমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বেঁচে থাকার বেসিক সুবিধাটুকু ভোগ না করে কাশ্মীরে চলে যাই। আমিও ওদের সঙ্গে দেশ কাকে বলে বুঝি। রাষ্ট্র যে আসলে যন্ত্র তা উপলব্ধি করি। আচ্ছা, রাষ্ট্র যদি একটা যন্ত্র হয় তাহলে আমরা কী? এর নাটবল্টু? সুলেমান ভাই একটা নাট, অপরূপ একটা নাট, অতনু একটা, আমি একটা। আমাদের যদি মানসিক রোগ হয়, তাহলে রাষ্ট্রেরও মানসিক বিকার হয় নিশ্চয়ই? রাষ্ট্রেরও এসাইলাম দরকার তাহলে? আমি ইন্টেলেকচুয়াল নই, আমি বুঝি না। আমার একটা সাদা চাদর দরকার শুধু। নাগরিক হিসেবে এটুকুই বুঝি।
সাদা চাদর আজ নেই। সুলেমান ভাই পরে তার আরও যে গাঁটরিগুলো রয়েছে সেখান থেকে খুঁজে বের করে দিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে গরম পোশাকের গাঁটরি, কাপড় দিয়ে কষে বাঁধা, যেন পড়ে না যায়, সেভাবে। কিন্তু তিনি রোজ একটা দেশ থেকে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন। তার সাইকেলের আওয়াজ ধাতব নয়,--তার সাইকেল বালি পড়ার মতো শব্দ করে ঝর ঝর। আর এগিয়ে যায়। কোথায় যায় এগিয়ে? ভারতের দিকে, পাকিস্তানের দিকে, নাকি নেভারল্যাণ্ডের দিকে? জানি না।

 ৬
শীতের দিনে বৃষ্টি। আমি বৃষ্টি পছন্দ করি না। শীতের বৃষ্টি আরও খারাপ। এমন দিনে মনে হয় আমি কাউকে চাই না, কেউ আমাকে চায় না। এই মনে হওয়ার সঙ্গে যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। তাত্ত্বিক ও তার্কিকদের দেখে আমার খুবই ভয় করে। আমি জ্ঞান থেকে পালাতে চাই। অজ্ঞান হতে চাই কি? নির্জ্ঞানের দিকে যেতে চাই আমি? বলে রাখি, আমি কোথাও যেতে চাই না। শুধু একবার দীঘা যেতে চাই। আশিক কি যাবে আমার সঙ্গে? শান্তনুর কথা মনে পড়ছে। গাড়ির ড্রাইভাররা কি মালকিনদের ভালোবাসে? আজ আমার খুব ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করছে। ঋভু আমাকে ভালোবাসত। সে সব কলেজ দিনের কথা। ঋভু জানত না জীবনে সে কী করবে। সে জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আওড়ে বলত, ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে যাব। তখন আমার খুব সাংসারিক হতে ইচ্ছা করত। মনে হত, বর হবে একটা বট গাছের মতো, একটা তালগাছের মতো, যাকে দূর থেকেও দেখা যায়, যে হবে আমার লাইটহাউস। মার্টিন স্করসেসির শাটার আইল্যাণ্ড ছবিতে লাইটহাউসে মনোরোগীদের মস্তিষ্কের চিকিৎসার নামে মস্তিষ্কটাই কেটে বাদ দেওয়া হত। দেশের জন্য যারা বিপজ্জনক তাদের ওই রাষ্ট্র পরিচালিত এসাইলামে এক প্রকার বন্দি করে রাখা হত। ওটা একটা দ্বীপ। ওই দ্বীপ থেকে পালানোর একটাই মাত্র ফেরিঘাট। যেটা পাহারা দিত সেনারা। বাইরে থেকে মনে হবে ওটা একটা ভূ-স্বর্গ যেখানে ট্রিটমেন্ট চলে। সবাই ভাববে, ওটা একটা উদ্যান। উদ্যানই তো। যদিও এই উদ্যান থেকে পালাতে চাইবে ক্যাপ্রিও। সে তো সুস্থ, সে কেন থাকবে, কিন্তু সে কার কাছে সুস্থ, সুস্থতার সংজ্ঞা কী? যারা জানে, যারা অধিকার দেয় সব কিছুর, তাদের ব্যাখ্যা আলাদা। আমি এসব কিছু বুঝি না, আমার একটু ভালোবাসা দরকার।
আমার পাশে রানি এসে বসেছে। বৃষ্টিতে সে কুঁকড়ে গেছে। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। সে আমার কোলে শুয়ে পড়তে চাইছে। তারও ভালোবাসার প্রয়োজন।
ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার লং স্কার্ট ভিজে যাচ্ছে জলে। আমি ইচ্ছা করেই লং স্কার্ট পরে বেরিয়েছি। আমি চাই ভিজে যাক আমার পোশাক।
চা দোকানে দাঁড়ালাম।
রঘুদা বলল, দিদিমণি, বৃষ্টিতে কোথায় বেরিয়েছেন?
আমি বললাম, আপনার ছেলে কি ফোন করে?
ছেলে? না, মা, সে নাকি কী একটা পেয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
স্কলারশিপ পেয়েছে?
হ্যাঁ, ওই।
রঘুদার ছেলে খুব ভালো ছাত্র। খড়্গপুর থেকে আর সে ফিরল না তাহলে। ‘ভালো ছেলে’রা ফেরে না। রঘুদার ‘খারাপা ছেলে’টা রঘুদার সঙ্গে চা দোকানে থাকে।
একটা ট্যাক্সি ধরলাম। আজ আশিকের বাড়ি যাব। সে কি বাড়ি থাকবে?
দুপুরবেলা আশিকের পাড়ায় ঢুকে পড়লাম। জিগ্যেস করে খুঁজেও পেলাম আশিকের বাড়ি। খুব সাধারণ একটা বাড়ি। নীল রঙ। বাড়ির সামনে পাতাবাহার গাছ। একটা নিম গাছ। আর কিছু পালং শাক হয়ে আছে উঠোনে।
আশিকের বাড়িটা নির্জন। গেট খুলেও কাউকে দেখতে পেলাম না। ডাকব কিনা ভাবছি, তারপর মনে হল, না, যাব না। আশিকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পত্রেই সীমাবদ্ধ থাক। আমার ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিলে দূরে। আমি গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
আশিক জানবে না আমি এসেছিলাম। আমি তাকে কখনও জানাবো না। আমি একটা পাপ করেছি। পাপটা হল, কিছু জায়গায় কখনও যেতে নেই। দূর থেকে শুধু এই জায়গাটার কথা কল্পনা করতে হয়। ভাবতে হয় যে, ওটাই আমার শেষ আশ্রয়। হয়ত সেটা কোনও আশ্রয়ই নয়। তবু ভেবে ভেবে এগিয়ে যেতে হয়। অভিসারের পর কৃষ্ণের দর্শন না হলেই বরং রাধার জন্য ভালো। আমি কি রাধা? আশিক কি কৃষ্ণ? ‘একদিন আমি ওখানে যেতে চাই’—এই বাক্যটাই আমাদের সান্ত্বনা। ওই ‘একদিন’টা কখনও না এলেই ভালো। বাড়ির পথ ধরে মনে হল, আমি ভূ-স্বর্গের কাছ দিয়ে চলে এলাম। বৃষ্টিতে যে বাড়িটা ঝাপসা, যে বাড়িতে লোক আছে, তবে ধরে নেব যে কেউ ছিল না। আর ওটা আশিকের বাড়িই নয়। বৃষ্টিতেও আমার গাড়ি জ্যামে আটকে গেল।


জিয়া হক

ক্ষমাদিবস

ক্ষম মোরে,—বলতে পারি না। পাথর হয়ে উঠছি কি আমি ক্রমাগত? পাথর —সে তো নত হয়ে, বড় অবজ্ঞার ধারে ছোট অবজ্ঞা হয়ে পড়ে থাকে। তাকে আক্রমণ করা যায়, সযত্ন হাত তার নরম গায়ে রাখে কে? নরমও নয় সে হয়ত, অথচ তা তো গুঁড়ো হয়ে যায়। ধুলো ছাড়া তার স্মৃতিতে কেউই ওড়ে না। তবে কি পাথর হওয়াই খুব শ্রেয়? শ্রেয়জ্ঞান নেই বলে আমি একটি নদী হয়ে পাথরকেই দিনাতিদিন ক্ষয় করে চলি। কেউ কি বলে আমি অপরাধী? কারাকক্ষে কে বা পাঠাবে? কারাগার হত যদি দোপাটি বাগান, কারারক্ষী প্রেমপত্র লিখে থাকত যদি , কতৃপক্ষ ডাল দিত ঘন —কে আর সমাজে শুধু আটকে পড়ে থাকে, কেই বা চায় রোজ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা? আমাদের ভগবান সম্প্রদায় আপন সংসারে ব্যস্ততম লোক। পুজো চায়, আশীর্বাদ করে কদাচিৎ। এমন আশীর্বাদ স্বনামধন্য হয়ে জমা হয় দেওয়ালে ও ড্রেনে। সমিতি মন্দ নয়, যতক্ষণ শিশুভাব থাকে।
আমি কি যাব না কোনো রক্ষিতার কাছে, যে আমাকে রক্ষা করে, চা দেয়, দুগ্ধজাত পনির?


আমি আমাকেই কেন ক্ষমা করতে শিখলুম না আজও। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না মানে আমার ভুলগুলো পুনরাবৃত্ত হোক, চাই না। কিন্তু তা কি হয় কার্যত? একই ভুল করে চলেছি যা আমাকে রুগ্ন করে, অসুস্থ করে, অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলে। আমি তো রুগ্নতা চাইনি কখনও। রুগ্নতা সম্পর্কিত যাবতীয় পরিভাষা ব্যথিত করে, আহত করে। যে-হাত কৃপণ নয়, তাকে কৃপণতাকে স্বীকৃতি দেওয়া কি ঝঞ্ঝাট! আততায়ী নিজের ভেতরে বাস করে যদি, বর্ম কি কোনো কাজে আসে? বর্ম তো বহিঃশত্রুর জন্য। আমি আউজুবিল্লাহ পড়ি, অথচ শয়তান দূর হয় না। সে পুষ্টি পায় কোথা থেকে? আমিই কি তার প্রকারান্তরে পরিচর্যা করি? কীটদষ্ট কপালে বলিরেখা আশ্চর্য দেখায়। আশ্চর্য দেখায় বলে এমন কপাল ঐশী কোনো আলো পায় না যা তাকে দেবে কাঁটামুক্ত লতার মুকুট। তা নাহলে সঙ্গীত তার কাছে সুরেলা চিৎকার ছাড়া আর কীই বা মনে হবে! অথচ কে না জানে, গীতিময়তাই গতিময়তা। আমি গতিকে সময় দিয়ে বিভাজন করে গতির দরদাম করি না। এর কারণ, সময় নিজেই স্থিতিশীল নয়। দুই দৌড়বিদ পাশাপাশি দৌড়াক, তাদের প্রতিযোগিতা চাই না। আমি তো হাততালিখোর 'মব' নই, বা কোনো পিত্তল ট্রফি নেই আমার কাছে —আমি কেন আয়োজক হব এমন রেসের?  সংগঠক হতে আমার অনীহা। কর্মী হতে পারি। নেতৃত্বের ইতিহাস আমাকে বিমর্ষ করে। যেহেতু লবণ খাওয়ার আগে দেখে নিতে চাই লবণের মালিকানা কার —তার দাবি ও দাওয়া, শর্তরাশি, চোখ। এমন লোকের জন্য লবণহ্রদ আছে, লবণ কিন্তু নেই।

জিয়া হক