এই গানগুলি লিখে রাখো; তোমাকেই লিখে রাখতে হবে। পরে দেখা হবে। কথাও হতে পারবে। গানের তালিকা পাঠালাম।
চিঠিটি এভাবেই শেষ হয়ে গেল। আমি আলমারিতে তুলে রাখলাম। আলমারিতে একটা খোপ আছে যেখানে আমি আমার চিঠিগুলি রাখি। সেখানে আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের চিঠিগুলি আছে, আর আছে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের চিঠি। আমিই প্রেমিকাদের হারিয়ে যেতে দিয়েছি। ছোটবেলায় আমি কখনও ঘুড়ি ওড়াইনি। আমার সমবয়সীদের ঘুড়ি আকাশে তুলে দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। একটা লাল আর চকরাবকরা কাটা ঘুড়ি আমি একবার সন্ধ্যাবেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল—আমি তোমাকে ভালোবাসি। কে কাকে ভালোবেসে এই কথা লিখেছিল তা আজও জানতে পারিনি। রেখে দিয়েছিলাম আমার তক্তাপোষের নিচে। এক বর্ষায় ঘরে জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঘুড়িটা। লাল চকরাবকরা কাটা ঘুড়িটা।
গানগুলি মিলিয়ে দেখলাম যে সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত। জয়তী চক্রবর্তীর তিনটে, ইমনের দুটো, বিক্রম সিং খাঙ্গুরার দুটো গান। এই গানগুলি শুনে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেই ঘুড়িটাতে কে লিখেছিল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, কিন্তু যখন জানতে পেরেছিলাম তখন আমি খুব অসহায়। অসহায়ই কেননা যে মেয়েটি লিখেছিল ওই যাদুকরী শব্দ তাকে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে ততদিনে। যাইহোক, আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি শুনতে হবে কিন্তু আমার কাছে শোনার মতো ডিভাইস নেই।
শীত পড়তে শুরু করেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাশ্মীরি শালওয়ালা সুলেমানের। সে এবার বাহারি চাদর নিয়ে এসেছে। লালের পাড় দেওয়া একটা সাদা চাদর আমার পছন্দ হয়েছে। মাকে এবছর একটা চাদর উপহার দেব কথা দিয়েছি।
সুলেমান একদিন বলল, আমি আর কাশ্মীরে ফিরে যেতে চাই না আশিক ভাই। এখানে একটা বন্দোবস্ত করে দিন।
আমি বললাম, ভূ-স্বর্গ ছেড়ে এই কাদামাটির দেশে থাকবেন?
আশিক ভাই, এটা তো তবু একটা দেশ, ওটা না দেশ, না রাজ্য। একটা জোকস নিশ্চয়ই শুনেছেন, স্বর্গে সবাই মৃত। আমরা ওখানে মরে আছি।
কিন্তু আমরা কি এখানে খুব ভালো আছি সুলেমান ভাই?
ভাবছেন ভিড় বাড়াচ্ছি, তাই না? কিন্তু ভালো থাকা কাকে বলে আশিক ভাই? আপনার পরিবারের কেউ কখনও সেনার গুলিতে প্রাণ দিয়েছে কখনও? আপনি নিজের ভাইয়ের জানাযায় শরিক হলে হয়ত অন্য রকম ভাবতে বসতেন।
সুলেমানের মুখ শতদ্রু নদীর মতো ম্লান মনে হল। শতদ্রু কখনও দেখিনি। তাই শতদ্রু নাম শুনলেই আমার কেন জানি মনে হয় নদীটি খুব দুখী আর তার উপত্যকা দিয়ে চোখের জল বয়ে যায়। যেমন গঙ্গা শুনলেই মনে হয় জাতি কী, জাতীয়তাবাদ কী, মনে হয় অজস্র প্রদীপের সঙ্গে ভেসে চলেছে ভারতমাতার জাহাজ। যদিও নাব্য নয় ততটা এই গঙ্গা। তবে ভারতমাতার জাহাজ তো আর নুহের নৌকা নয় যে জোড়ায় জোড়ায় প্রাণীরা সব সারি দিয়ে মহাপ্লাবনের ভয়ে কাঁপছে। তবে একটা কাঁপুনি টের পাই। কেন কাঁপে, কে কাঁপায়? জানি তবে এখন আমাকে একটা ডিভাইস জোগাড় করতে হবে এখন যেটাতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যাবে।
আমার এক পরিচিত আছে উকিলপাড়ায়। ওর নাম অপরূপ। সে যুক্তিবাদী এবং প্রযুক্তিবাদী। তার কাছে গেলে একটা ডিভাইস পেতে পারি। তার বাড়ি যেতে দেখলাম, সে বোগেনভোলিয়া গাছে জল দিচ্ছে। সাদা সাদা বোগেনভোলিয়া ফুটে রয়েছে। এই গাছ এখন ছোট। বড় হলে দড়ি পাকিয়ে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে বোগেনভোলিয়ার গাছ ছিল। একটাই গাছ কিন্তু মনে হবে একটা আস্ত বিহারি পরিবার খাদ্যের সংস্থানে বাংলায় এসে অনেকটা ফুটপাত দখল করে নিয়ে বস্তি তুলেছে। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সাদা আর সাদা ফুলে ঢাকা। যেন এক টুকরো ভূ-স্বর্গ। আমার প্রিয় স্থান ছিল সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেট। বই পড়তে গিয়ে ওই গাছের তলায় বসে থাকতাম, মনে হত মাথার উপর দশভূজা। আমি এক অসুর। তবে মহিষের পেটে আমার জন্ম নয়। মানুষের হয়েও ভাগ্যচক্রে অসুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু থাকা জরুরি।
অপরূপ আমাকে আসতে দেখে হাসল। বলল, দাঁড়া কুকুর সরাই।
আমার কুকুর দেখে খুব ভয়। বিশেষ করে যে কুকুর চেঁচায়। শুনেছি যারা চেঁচায় তারা কামড়ায় না। তারপরও আমার ভয় লাগে। কুকুরকে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা হয়। কুকুরের রচনা লিখে আমি প্রথম হয়েছিলাম একবার। জাজ বলেছিলেন, আমার লেখাটা এমন যেন একজন কুকুরই লিখছে। রচনাটি ছিল, ‘রাস্তার কুকুর ও গৃহপালিত কুকুর’।
অপরূপ কুকুর সরিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির ঘরটায়। বেশ বড় কালো কুকুর। কী প্রজাতির কুকুর চিনি না। আমি যে কোনো বিষয়ের প্রজাতি বিষয়ে বিশেষ অজ্ঞ। মানুষেরও যে প্রজাতি হয় তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। একজন কবি লিখেছিলেন, জগৎ জুড়ে একটাই জাতি আছে। কবিদের সমস্যা হল, তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি আশাবাদী। তারা খালি ইউটোপিয়ার কথা বলে। আর নৈরাশ্যবাদে ভোগে। আমি ততটুকু আশাবাদী যতটুকু আশা রাখলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয়।
তোর কুকুরের নামটা ভুলে গেছি অপ। একবার বল তো।
ওর নাম পেড্রো।
প্লেটো রাখতে পারতিস, পেড্রো কেন রাখলি?
তুই বিখ্যাত পেড্রোর গল্প জানিস না? বলিস কি!
পেড্রো আলমাদোভার?
না, ইনি সে পেড্রো নন। ইনি কৃষ্ণের আরেক অবতার। তার ভয়ে দেশের রাজাও তটস্থ হয়ে থাকত। দেশে এমন কোনো মেয়ে ছিল না যার সঙ্গে পেড্রো শোয়নি। রাজা তার ভয়ে রানিকে ফেলে যুদ্ধে যেতে চাননি। সে অনেক গল্প।
আচ্ছা, সে গল্প পরে একদিন শুনবো। এখন আমার একটা উপকার কর তো ভাই।
কী করতে হবে বল।
আমাকে একটা ডিভাইসে কয়েকটা গানের নাম বলছি ডাউনলোড করে ভরে দে। কর্তৃপক্ষের আদেশ, শুনতেই হবে।
তোর আবার কর্তৃপক্ষ কবে হল?
এ তুই বুঝবি না, এটা পুরোটাই আনুগত্যের ব্যাপার। কাকে কর্তৃত্ব করতে দিবি আর কাকে দিবি না সেটা তোর নির্বাচন। তবে সেটা ওয়াইজলি করতে হয়। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে, যে পেড্রো এমন সুখ্যাত, তার নামটাই কেন রাখলি তোর কুকুরের। আচ্ছা, কুকুরকে কুকুর বললে তোর আপত্তি নেই তো?
মজা করিস না। কুকুরকে কি টিয়াপাখি বলে ডাকবি? যাকগে, আসলে আমার কুকুরটা ঠিক পেড্রোর উলটো চরিত্রের। এ কারো সঙ্গে শুতে চায় না। ভুল বলা হল, কুকুররা কি শোয়? বরং বলি, দাঁড়াতে চায় না। এদিকে আমার মা আমার বিয়ে নিয়ে রোজ বাড়িতে অশান্তি করছে। আচ্ছা বল, তিরিশটা এমন কিছু বয়স? আসলে এরা তো সব পঁচিশেই দন্ডিত, তাই আমার স্বাধীনতা এদের কাছে পাপ মনে হচ্ছে।
তোমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমি বুঝেছি বাবা। এবার আমাকে ডিভাইসটা দে। তাড়া আছে, আজ একটু শিগগির বেরব।
খারাপ খবর আছে। আইপডটা অতনু নিয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহের আগে পাব না। ও দিয়ে গেলে তুই নিয়ে যাস।
সিঁড়ির ঘর থেকে পেড্রোর কুক্কুরনাদ ভেসে আসছে। সাইবার কাফেতে গেলে কি ইউটিউবে গানগুলি শোনা যেতে পারে? কেন যাবে না? শিবানী পীঠের মোড়ে একটা সাইবার কাফে আছে। সেখানে যেতে হবে। ঘন্টায় দশ টাকা। পরিচয় পত্র লাগবে। আমি তো জানি যে আমি কোনো হ্যাকার নই, শুধু গুরুদেবের কয়েকটা গান শুনতে চাই কিন্তু দেশ আমার পরিচয় পত্র না দেখে আমাকে তা শুনতে দেবে না।
অপরূপকে বিদায় জানালাম।
অপরূপের বাড়ি থেকে বেরলেই মোড়ের মাথায় মদের দোকান। মুখে কাপড় জড়িয়ে তিন জন মদ কিনছে। ইন্টেলেকচুয়ালসরা মদ খায়। এরা কি ইন্টেলেকচুয়ালস? আমার এক বন্ধু সেদিন বলল, এই যুগে যারা মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এদের জ্ঞানগম্যি প্রশ্নাতীত। তবে মুখে কাপড় কেন? জ্ঞানীরা প্রচার চান না। তাঁরা নিঃশব্দে বিপ্লবের পক্ষপাতী। বন্ধুকে মনে পড়ল আর এদের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠল মনে।
২
ডিভাইস পাচ্ছি না। তাই আপনি যে গানের তালিকা পাঠিয়েছিলেন তা এখনও শোনা হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সম্ভব হলে মার্জনা করবেন। তবে আগামী সপ্তাহে আমি একটি আইপড পেতে পারি।
আশিকের চিঠিখানি পেলাম। সে বড় অসহায় বলে মায়া হয় না, তার প্রতি আমার মায়া আছে বলে তাকে খুবই অসহায় মনে হল। এই গানগুলি না শুনেই সে জীবন কাটাচ্ছে ভেবে আমার কষ্ট হল। ওর চাকরি নেই। চাকরির চেষ্টাও করে না। ও বলে, আমি চিন্তক। অম্লান দত্ত নাকি এমন কথা বলেছিলেন কাউকে। সিঙ্গেল খাটে শুয়ে শুধু বই পড়ে আর ভাবে মুরাকামির মতো একটা উপন্যাস লিখবে। তবে মুরাকামি সঙ্গীত বিষয়ে কত জানে, আর ও গান বলতে বোঝে নচিকেতা। জীবনমুখী বাংলা গান না কি সব। নচিকেতা ছাড়া বাকি সব গান কোন মুখো, বুঝি না।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার স্করপিওর মিষ্টি হর্ন বাজাচ্ছে। কলেজ স্ট্রিট যাবো। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর বইটা উপহার দিতে চাই আশিককে। একজন ঔপন্যাসিক হতে চায়, আমার কর্তব্য হল তাকে তৈরি করে তোলা। স্বপ্নের সংখ্যা সীমিত লোকেদের আমার ভালো লাগে। বাবা বলতেন একজন দরজি আর একজন ম্যাজিসিয়ানের গল্প। গল্পটা সবাই জানে। ম্যাজিসিয়ান রোজ দরজিকে এই বলে খ্যাপায় যে, তুমি তো ভায়া একটাই মাত্র কাজ জানো—সেলাই করা। সেলাই বন্ধ হয়ে গেলে তো তোমার ভাত জুটবে না। আর আমাকে দেখো, হাজার একটা খেলা জানা আছে আমার। একটা বন্ধ হলে আরেকটা। এক সময় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ম্যাজিসিয়ানের শোতে আর লোক আসে না। খেতে পায় না তো ম্যাজিক দেখবে কী করে! রোজ রাস্তা দিয়ে খালি হাতে ফেরে আর দেখে দরজি তার সেলাই মেশিন চালিয়ে যাচ্ছে। ম্যাজিসিয়ান একদিন গিয়ে বলল, ভায়া এ কি হল বলো দেখি? তখন দরজি বলল, ভাই, আমি একটাই কাজ জানি, কিন্তু যে কাজটা জানি তার প্রয়োজন সব সময়ের। অনাহারে থাকলেও পোশাক মানুষকে পরতেই হবে। খালি পেটে ম্যাজিক দেখা যায় না।
আমি একটি গান গুনগুন করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলাম।
ড্রাইভার বলল, ম্যাডাম, আজ আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
মৌলালীর কাছে গাড়ি ট্রাফিকে আটকে গেল। বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে বললাম, আচ্ছা শানু, তোমার স্বপ্ন কী?
কেন ম্যাডাম?
মানুষের স্বপ্ন জানতে আমার ভালো লাগে। তবে বলতে তোমার আপত্তি থাকলে বলো না।
আপত্তি কিসের ম্যাডাম? তবে লজ্জা লাগে বলতে।
লজ্জা কেন?
আসলে ম্যাডাম, আমি আরেকজন ট্যাক্সি, ড্রাইভারকে আমার স্বপ্নের কথা বলতে পারি, কারণ আমি জানি সে হাসবে না। সে হাসবে না কারণ তার স্বপ্নটাও আমার স্বপ্নের মতোই উদ্ভট। খোঁড়া খোঁড়াকে দেখে হাসে না।
স্বপ্ন যে খানিকটা উদ্ভট হবে তা তো ধরেই নেওয়া যায়। আমার এক বন্ধু চায় সে একজন বড় ঔপন্যাসিক হবে। ঔপন্যাসিক মানে বোঝো তো?
ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট, বুঝি ম্যাডাম।
কী করে জানলে শানু ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট?
আমি বি এ পাস ম্যাডাম।
ও তাই তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যাইহোক, তোমার স্বপ্নটা বলো।
আমি যে বি এ পাস সেটা আমি ভুলে যেতে চাই ম্যাডাম। আর ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সব কিছু বুঝতে নেই, এটা খালি গুলিয়ে যায়। দেশ নিয়ে আমাদের কোনো মতামত নেই। রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনে আমাদের হাসবার অধিকার নেই। স্মৃতি একটু কম হলেই ভালো। আরও ভালো হয়, বোধও যদি একটু কম থাকে।
যানজট অনেক আগে কেটে গেছে। আমাদের গাড়ি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম, শানু তোমাকে এবার থেকে শান্তনু বলেই ডাকবো। শান্তনুদের শানু করে দিয়ে আমরা খুবই অন্যায় করি। যাইহোক, ফিরে এসে তোমাকে একটা গল্প শোনাবো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের। গল্পের নামই হল ‘নাম’।
অভিজিৎ মুখার্জি অনুবাদ করেছেন কাফকা অন দ্য শোর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বেরিয়েছে। বাংলায় বইয়ের নাম হয়েছে সমুদ্রতটে কাফকা। দুই খন্ডে। দাম করেছে সাতশ। প্রথম খন্ডটির কভার আকাশি নীল, দ্বিতীয় খন্ডটি সবুজ। উপরে বেড়ালের ছবি। আমার কুকুর রানির কথা মনে পড়ল। সে বেড়াল সহ্য করতে পারে না। তার পছন্দ টিয়াপাখি। একদিন তাকে রাস্তায় হাঁটাতে নিয়ে গিয়ে সেটা আবিষ্কার করি। রাস্তার ধারে যে খিরিশ গাছটায় টিয়াপাখিটা বসেছিল রানি সেই গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে পাখিটাকে দেখে যাচ্ছিল। সে ভুলে গিয়েছিল হাঁটার কথা, আমার কথা। তবে রানির সমস্যা হল, সে কোনো পুরুষ কুকুরকেও সহ্য করতে পারে না। এই কারণে সে মা হতে পারছে না। ধবধবে সাদা রানি যখন আমার গায়ের কাছে এসে বসে তখন যেন মনে হয় বোগেনভোলিয়া ফুটেছে।
ব্লু ডার্টে গিয়ে বই দুটো কুরিয়ার করে দিলাম আশিকার ঠিকানায়।
গাড়িতে বসে বললাম, এই নাও শান্তনু।
কী ম্যাডাম?
দেখই না।
বই?
হ্যাঁ, সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।
শান্তনুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বইটা পরম যত্নে সে পাশের সিটে নামিয়ে রেখে বলল, গাড়ি স্টার্ট করি ম্যাডাম?
করো, তবে প্যারামাউন্টের সামনে একবার দাঁড়িয়ো, ঠিক আছে?
ঠিক আছে ম্যাডাম।
ডাব সরবত নিলাম দুটো। আমার সামনের বেঞ্চে বসে আছে শান্তনু। সে খুব ইতস্তত করছে। মালকিনের সঙ্গে সে এর আগে কখনও খেতে বসেনি।
আমি বললাম, এবারও কি বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে শান্তনু?
বিহ্বল চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার চেয়ে আমার স্বপ্নের কথাটা বলি আপনাকে?
আমি বললাম, সে তো ভালো কথা। আমার প্রিয় বিষয়।
শান্তনু বলল, আমি চাই আমার নিজস্ব একটা ট্যাক্সি, আমি যার মালিক। হলুদ ট্যাক্সি। গাড়িতে সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে। আমার প্রিয় গায়ক সুবিনয় রায়। সুবিনয় রায় কেন ভালো লাগে জানেন তো ম্যাডাম? তার গলায় ভারি দুঃখ, ঔদ্ধত্য নেই, রবীন্দ্রনাথের বেদনা আর তাঁর বেদনা যেন কোথাও গিয়ে এক। আচ্ছা ম্যাডাম, দুখী মানুষদেরও কেন দুঃখের গান ভালো লাগে বলুন তো? তাদের জীবনে তো দুঃখের অভাব নেই।
আমি শুনছিলাম শান্তনুর কথা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, এম এ টা করলে না কেন শান্তনু?
সে অনেক গল্প ম্যাডাম। এই গল্পের সঙ্গে স্বপ্নের কোনো মিল নেই, যোগাযোগ নেই। আপনার স্বপ্ন শুনতে ভালো লাগে, স্বপ্ন ভাঙার গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। আপনি বরং নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পটা বলুন।
খুব বিষণ্ণ ভাবে বললাম, আজ নয়, অন্য একদিন বলব। চলো এখন যাওয়া যাক।
দাঁড়িয়ে পড়ে শান্তনু বলল, চলুন ম্যাডাম।
গাড়ি ছেড়ে দিল। শান্তনুর সিটের পাশে রবিশংকর বলের সম্পাদনা করা সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।
৩
মুরাকামির সমুদ্রতটে কাফকা পাঠালাম। মুরাকামি হতে গেলে মুরাকামি পড়তে হবে তা বলছি না। তবে পড়তে হবে। আমি জানি তুমি যথেষ্ট পড়াশুনো করো। যাইহোক, নতুন কী লিখলে জানতে চাই। আর গানগুলি কি শুনতে পেরেছো?
চিঠিখানির সঙ্গে বই দুটো পেয়ে উত্তেজিত লাগছে। পৃথিবীতে এমন কেউ আছেন যিনি চান আমি একজন ঔপন্যাসিক হয়ে উঠি। বিদ্যাপতি, আলাউল, ভারতচন্দ্রের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে। ঠিকই রাজ-পৃষ্ঠপোষনা এ হয়ত নয়। কিন্তু আমার কাছে রাজা—এই পদটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি তার চেয়েও বড় কিছু দেখতে পাচ্ছি। মুকুন্দরামকে যে প্রত্যাদেশ দিয়েছিল সেই রকম কাউকে।
অপরূপ আজ আইপড দেবে। তবে অপরূপ আজ আইপড দিতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অতনুর উপর। আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন অতনুর উপর নির্ভরশীল। অতনু যে পিয়ানো বাজায় আর প্যারিসে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পেটের দায়ে সে স্কুল শিক্ষক।
অতনুকে আজ অপরূপের বাড়িতে দেখতে পাবো ভাবিনি। পটাসিয়াম, ফসফেট আর কী সব সার মেশানো হচ্ছে একটা পাত্রে। গাছগুলি অপরূপের কাছে সন্তানের মতো। বয়সের বাৎসল্যরস যাবে কোথায়!
আরে বন্ধু! অতনু আমাকে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সে কথায় কথায় ‘বন্ধু’ বলে। তার মতে, বন্ধুরা না থাকলে সে বাঁচতো না। যদিও তার মৃত্যুর কোনো কারণ দেখি না। তবে এই ‘বাঁচা’ বোধহয় ‘মৃত্যু’র ঠিক বিপরীত শব্দ নয়। অতনুকে দেখলে প্যারিসের কথা মনে পড়ে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তার কাছে খানিকটা প্যারিসের মতো। ভূ-স্বর্গ এই জায়গায় যাওয়া মানেই বেঁচে যাওয়া। অতনু এভাবে বাঁচতে চায় বহুদিন ধরে। স্বর্গের ধারনা সবার এক নয়। যেমন এক নয় হুর-পরির দেহসৌষ্ঠব।
আমার কিছু বলার আগেই অতনু বলে উঠল, বন্ধু, আইপডটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নষ্ট করে ফেলেছি। কী হবে এখন?
সার মাখানো হয়ে গেছে অপরূপের। এবার সে গাছেদের খেতে দেবে। অপরূপ এই জন্য গ্রেট যে তার আইপড নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অথচ সে রাগছে না, ভ্রুক্ষেপ করছে না। তার বাগানে বনসাই ফলের গাছ আছে। বনসাই ডালিম, বনসাই সবেদা, বনসাই জামরুল। পেড্রোর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। পেড্রোকে বনসাই করে রাখা যাচ্ছে না। পেড্রো প্রজননে অক্ষম কিনা তাও স্পষ্ট নয়। রাক্ষুসে চেহারার পেড্রো। নারী কুকুরে তার আসক্তি নেই। সে কি সমকামী?
অপরূপ বলল, আজ একটা মেয়ে দেখতে যাব। বিয়ে না করলে এই বাড়িতে আমার আর থাকা যাবে না। জরুরি নোটিস।
আইপডটা না পেয়ে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। যেন একটা চক্রান্ত কোথাও ঘনিয়ে উঠছে। আমাকে গুরুদেবের কাছে পৌঁছতে দেবে না কেউ। কেউ গাছ নিয়ে ব্যস্ত, পেড্রোর আদর খাচ্ছে, কেউ পিয়ানো বাজিয়ে মোজার্ট হয়ে উঠতে চাইছে, অনায়াসে ডিভাইস নষ্ট করে ফেলছে, আর আমি পরনির্ভরশীল জীব হয়ে শুধু লোকের বাড়ির সিঁড়ি বাইছি কিন্তু কোনো উচ্চতায় পৌঁছতে পারছি না। সিঁড়ি আমাকে নিচে ফেলে দিচ্ছে।
রাগ ভরে বললাম, যা যা বিয়ে কর, বিয়ে করা ছাড়া আর কী আছে তোদের জীবনে? শুবি-খাবি-হাগবি, তোরা সবাই ভেতরে ভেতরে পেড্রো, শুধু সাহস নেই, নয়ত কৌশল করে উঠতে পারিস না। আর আমি এমন এক প্যারাসাইট যার কিনা অবলম্বন বলতে আরো কিছু প্যারাসাইটস। লাগবে না তোদের আইপড। চলি।
আজ আর কুকুরকে দেখে ভয় লাগছে না। পেড্রোর সামনে দিয়ে নেমে এলাম। পেড্রো আমার সাহস দেখে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। যার এতদিন কাজ ছিল ভয় দেখানো, সে যখন জানতে পারল ভয়টা আমার এক সংস্কার মাত্র তখন তার নখগুলো সে লুকিয়ে ফেলে, কারণ সেও জানে ওই নখগুলো প্লাস্টিকের, নকল আর ভয় জিনিসটা একচেটিয়া নয়। একটা আত্মীয়-বিচ্ছিন্ন জীব বেশিদিন ভয় দেখাতে পারে না। যদিও আত্মীয় থাকলেই আত্মীয়-বিয়োগ হয়। ব্যথা হয়। পেড্রো এসব থেকে মুক্ত। রাস্তার কুকুরদের একটা সমাজ আছে, পেড্রোর তাও নেই। তার গড়নটা কুকুরের মতো রয়ে গেছে শুধু, তার সঙ্গে অপরূপের আর কোনো তফাত নেই। পেড্রো এখন একজন যৌন ভাবে শীতল মানুষ যার প্রিয় কাজ ভীতু নির্বাচন করা আর চিৎকার করে ভয় দেখানো। চিৎকারটুকুই তাকে কুকুরত্বে স্থায়ী করে রেখেছে। দেখেছি, লেজ দিয়ে সে অণ্ডকোষ ঢাকা দেয়।
বেলা এগারোটায়ও সাইবার কাফে খোলেনি। পরিচয় পত্র নিয়ে কাফের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। নীল রঙের একটা বোর্ড জ্বলজ্বল করছে—লীলা সাইবার কাফে এন্ড সোসাইটি। এই সোসাইটির দরজা আমার জন্যে বন্ধ এখন। একটা মেয়েকে পড়াই। সামান্য হাত খরচ হয় তাতে। সে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। একটা নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তার বাবা ইন্ডিয়ান অয়েলে চাকরি করে। প্রচুর বেতন। সপ্তায় দু দিন যাই। আজ সন্ধ্যায় যাবো আমার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অহনার বাড়ি।
দুপুরেই অহনার বাড়ি হাজির হলাম। অহনা একটা সাদা স্কার্টের ওপর সাদা টি শার্ট পরে আছে। অহনাকে ভারি মিষ্টি দেখতে। অহনা কিন্তু তার রূপ নিয়ে অতটা সচেতন নয়, এটাই তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমাকে দেখে সে বলল, স্যার এখন এলেন?
আজ সন্ধ্যায় একটা কাজ আছে, তাই এখন এলাম। তোমার অসুবিধা আছে?
স্যার, এখন তো আমি স্নানে যাবো।
তোমার মা কোথায়?
আজ বাড়িতে কেউ নেই স্যার।
আমি বসে আছি, তুমি স্নান করে এসো।
অহনা বলল, ঠিক আছে স্যার, পড়ে নিয়ে স্নান করব। আপনি কিছু খেয়েছেন?
কে আর খেতে দেবে আদর করে অহনা?
আমি দিতে পারি, এই বলে সে হেসে বাড়ির মধ্যে চলে যাওয়ার আগে বলল, বসুন, আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এলো অহনা। তার হাতে প্লেট। প্লেটে বিস্কুট, আপেল আর দুটো মিষ্টি। বলল, স্যার খান।
আমি বললাম, অহনা আজ একটা খেলা খেলবে?
কী খেলা স্যার?
খেলাটা মজার। তবে এই একদিনই হবে এই খেলাটা আর এই খেলার কথা কাউকে জানাতে পারবে না।
খেলাটা কী?
তোমার মা কখন আসবেন?
পাঁচটার দিকে, কেন স্যার?
ধরে নাও, এই দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি চব্বিশ ঘন্টা। একটা দিন।
আচ্ছা, তারপর?
আমরা একটা দিন এই বাড়িতে দু জন আছি শুধু। আমরা একটা দিন সংসার করব। তুমি আমাকে ‘ওগো’ বলে ডাকবে। আমিও তোমাকে ‘সোনা’ বলে ডাকব। আমরা রান্না করব, প্রথমে তুমি স্নান করবে, তারপর আমি স্নানে যাব, তারপর একসঙ্গে খেতে বসব, খেয়েদেয়ে আমরা একসঙ্গে শোব, তারপর ঘুম থেকে একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠব, তুমি ব্রাশ করবে, আমিও ব্রাশ করব। তারপর আমি কাজে বেরিয়ে যাব, তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাবে। সবটা পাঁচটার মধ্যে।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে অহনা বলে উঠল, ওগো, আজ কী রান্না হবে গো, একবার রান্নাঘরে এসো না দেখি।
আমি বললাম, সোনা, আজ আমরা যদি উপোষ করি কেমন হয়? মাঝে মাঝে উপোষ করা শরীরের জন্য ভালো। শাস্ত্রে আছে।
তুমি আমাকে শাস্ত্র শুনিও না তো…আমি তোমার ছাত্রী নই…
আমরা স্নান করে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অহনা বলল, লাইটটা বন্ধ করে দাও না গো।
আমি জিগ্যেস করি, এসব শিখলে কোথায়?
সে বলল, মেয়েরা সব শিখেই পৃথিবীতে আসে।
আমি বললাম, সোনা, আমাদের বিবাহের মেয়াদ তো একদিনের, তাই আমরা কোনো ইস্যু নেব না, ঠিক আছে?
তুমি কি কনডোম নিয়েই এসেছিলে আজ?
না, আমার কোনো ছদ্মবেশ নেই। আর আজ এমন খেলা হবে তা আমি জানতামও না।
ক্যারেকটার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো বাবু, খেলাটা মাটি করবে নাকি?
অহনা, খেলাটা আমার আর ভালো লাগছে না, আফটার অল আমি তোমার শিক্ষক। পরের দিন তোমাকে পড়াতে আমার অসুবিধা হবে। আর একটা সমস্যা আছে, এই খেলাটা রোজ খেলতে ইচ্ছা করবে, তখন কী করব?
কাউকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নেবেন। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?
আমি উঠে আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। বিছানায় শুয়ে আছে অহনা। সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে মনে হল, আমি একটি বোগেনভোলিয়া খেতের ধার থেকে এই মাত্র উঠে এলাম। অহনার শরীরে পূর্ণ নারীর মিষ্টি সুগন্ধ এসে গিয়েছে। সে এখন বিবাহযোগ্যা। সে এখন অনায়াসে মা হতে পারে। যদিও তার এখনও আঠারো বছর পূর্ণ হয়নি। বুঝলাম, আঠারো একটা সংখ্যা মাত্র। আঠারো একটা অনুশাসন। তার বেশি কিছু নয়।
অহনাকে বললাম, আজ যাই।
আমাকে আশির্বাদ করবেন না?
ছাত্রী হিসেবে না স্ত্রী হিসেবে?
একটু চুপ করে থেকে বলল, একদিনের জন্য হলেও আমি আপনার স্ত্রী হয়েছি আর এখনও পাঁচটা বাজেনি। তবে আমি আপনাকে জোর করব না, যা হিসেবে আশির্বাদ করতে চান আমি তা নেব। শুধু একটা কথা, পাঁচটার পর থেকে যেহেতু আমি ছাত্রী আর আপনি আমার শিক্ষক আর এই সম্পর্কটাও আমার কাছে একটা বিশেষ স্মৃতি, তাই দুবার আশির্বাদ করুন আমাকে—একবার ছাত্রী হিসেবে, আরেকবার স্ত্রী হিসেবে।
বুঝলাম, অহনা আমাকে ভালোবাসে।
আমার আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সে চোখ বন্ধ করল। যেন কোনো সিনেমা।
আমি বেরিয়ে পড়লাম। গেটের ধারে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অহনা, তার চোখ ভারি শান্ত, মাথায় শাড়ির আঁচল।
৪
দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি শুরু করছি। পৃথিবীতে ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশের বেদনা বয়ে বেড়াবার জন্য যেন জন্ম নিয়েছি। যাইহোক, গানগুলি এখনও শুনে উঠতে পারিনি। এই কারণে নয় যে গানগুলি শুনবার ইচ্ছা আমার নেই, বরং এই কারণে যে গানগুলি শুনবার উপায় আমার নেই। কীভাবে ব্যবস্থা হবে তার চিন্তায় কালাতিপাত করছি। কাফকা অন দ্য শোর আমার মাথার ধারে জায়গা করে নিয়েছে। ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি শেষ করছি।
দুপুরে এই চিঠি এসে পৌঁছেছে। এই যুগেও আমি চিঠি পেতে ভালোবাসি। তবে চিঠি লেখার লোক অত্যাশ্চর্যভাবে কমে গেছে। এই নয় যে তারা চিঠির বিরোধী বা চিঠি লেখার পদ্ধতিকে মেনে চলতে নারাজ বরং এই যে তাদের বলবার কিছু নেই। অভিধান উপহার পেলেও এই রোগ সারবার নয়। অভিধান একটা সহায়ক উপকরণ মাত্র, কথা বলবার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে অপারগ। একজনের বিয়েতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ উপহার দিয়েছিলাম। দুঃখের সঙ্গে জানাই, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে। এই বিচ্ছেদটা ভাষাজনিত, তা বোঝাই যায়। যাকে ডিনার সেট উপহার দিয়েছি সে এখনও আমার বাড়িতে আসে। হরিচরণ এখানেই ডিনার সেটের কাছে রোজ হেরে যাচ্ছে।
আমার বাবার গলা পেলাম। দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, কে এই আশিক?
ও, তুমি চিঠি দেখেছো?
সেটুকু দেখার অধিকার এখনও আমার আছে বলেই মনে হয়, নাকি নেই?
বাবা, তুমি আশিক সম্পর্কে যেটা শুনতে পছন্দ করো সেটাই বলব নাকি যেটা বললে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকবে তেমন একটা কিছু বলে রাখব আপাতত?
তুমি সত্যিটা বলবে।
তাহলে শোনো, আশিক আমার একটা প্রকল্প। আমি ওর এক স্বপ্নের এজেন্ট। তুমি কখনও কারও স্বপ্ন ডেসপারেটলি পূরণ করার চেষ্টা করেছো বাবা?
প্রকল্প, এজেন্ট, স্বপ্ন—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দিন দিন সেই হেঁয়ালিটার মতো হয়ে উঠছো যেটার প্রস্তুতকারক স্বপ্নে পেয়েছে সেটা আর নিজেই তার উত্তর জানে না।
আচ্ছা বাবা, তুমি নতুন তিন জন বাঙালি নভেলিস্টের নাম বলতে পারবে যাদের পড়া যায়?
তোমার কি মনে হয় যে অফিসের পর আমার এতটাই সময় আর ইচ্ছা থাকে যে যা দিয়ে আমি উপন্যাস পড়তে পারি? তুমি বিত্ত দেখেছো কিন্তু আমার জার্নিটা কতটা সহৃদয় ভাবে দেখো তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমি জানি বাবা তুমি খুব স্ট্রাগল করে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছ কিন্তু তাই বলে আমি রোজ তোমার এই স্ট্রাগলটা থেকে কী পেতে পারি? তুমি নিশ্চয়ই মালাচন্দন পাওয়ার জন্য আমাকে জন্ম দাওনি। এই ভেবেও আমার জন্ম দাওনি যা ভেবে স্বর্গের অনিরুদ্ধ আর ঊষা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে লখিন্দর-বেহুলা হয়ে জন্ম নিয়েছিল।
আমার বাবা চুপ করে থাকে। তার এই চুপ করে থাকার মধ্যে বিষণ্ণতা নেই। যদিও আমি বাবার চুপ থাকা মুখটা পছন্দ করি না। বাবা নিয়মিত কথা বলবে, আমাকে বাক্যবাণে জর্জরিত করবে, পরাস্ত করবে—এটাই আমি চাই।
বললাম, বাবা তুমি আমার সব স্বপ্ন পূরণ করেছো। আর আমিও যে কারো স্বপ্ন পূরণ করতে পারি তার উপযুক্ত করে তুলেছো আর ব্যবস্থাও করেছো। কিন্তু আমি ছাড়া তুমি আর কারো একজনের স্বপ্ন পূরণ করে দেখো, আমি তোমাকে মহামানব হয়ে যেতে বলছি না। ক্যাপিটালিস্টরা যেভাবে পুঁজি জড়ো করে সেই ভাবে কিছু স্বপ্ন জড়ো করে দেখতে পারো। আমি তোমার কাছে একটা দায়িত্ব কিন্তু যে তোমার দায়িত্বাধীন নয় তাকে ভরন করে দেখই না একবার।
কী করতে হবে আমাকে? গম্ভীর ভাবে বলল বাবা।
শান্তনুর একটা ট্যাক্সি কিনে দাও না বাবা। হলুদ ট্যাক্সি। ওর স্বপ্ন ও একদিন একটা ট্যাক্সির মালিক হবে। নিজের ট্যাক্সি, নিজের মর্জি, নিজের স্বর্গ।
নিঃশব্দে বাবা চলে গেল। তার মুখ থমথম করছে।
আমি আজ একটা সিনেমা দেখব। ল্যাপটপটা অন করলাম। আজকের আবার মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অফ হেভেন দেখব। ইরানের পরিচালকরা ম্যাজিসিয়ান কিন্তু সেই দরজিটার মতো যারা শুধু একটা কাজই ভালো জানে সেটা হল অত্যাশ্চর্য সব ছবি বানানো। মাজিদ মাজিদিকে মনে হয় ইরানের সত্যজিৎ রায়। অস্কার দিয়ে কিছুই বিচার করা যায় না। বরং যারা অস্কারের দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকে তাদের ছবিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। আমার এক বন্ধু আছে যে শুধু নোবেল আর বুকার পাওয়া সাহিত্যটুকুই পড়ে। এর মানে তাকে সব সময় পথ দেখিয়ে দিতে হয়। এই দেখানো পথের
বাইরের জগৎটা তার কাছে ব্লার। বাঙালিপনা আর মধ্যবিত্তপনা এগুলো। তবে আমেরিকার মধ্যবিত্তরা কীভাবে ভাবে তা জানতে ইচ্ছা হয় খুব। দেশকাল অনুযায়ী মধ্যবিত্তদের ভাবনা কাঠামোর বদল হয় কিনা তা জানার বিষয়। আমি অশিক্ষিত, তাই জানি না। আমি যে অশিক্ষিত—এই কথা স্বীকার করি বলে লোকে আমাকে আরো বেশি করে শিক্ষিত ভাবে। এ আমার কোনো কৌশল নয়, এ নেহাতই সামাজিক মনোবিকলন।
সিনেমাটা ভিএলসিতে অন করতে যাবো, এমন সময়ে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। একটা কাগজের টুকরো আমার টেবিলের উপর রেখে যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবে বেরিয়ে গেলেন।
উঠে গিয়ে দেখি, একটা চেক।
শান্তনুর স্বপ্নটা এখন রাস্তায় দৌড়বে হলুদ সর্ষে ফুল উড়িয়ে।
গ্যারাজে এসে দেখলাম শান্তনু নেই। দারোয়ান নয়নকে জিগ্যেস করে জানলাম, সে বাড়ি চলে গেছে। তার মা মারা গেছে। একটা ছোটবোন আছে তার। সে এখন গ্রামের একটা সাইকেল গ্যারাজে মেকানিকের কাজ করবে। আর ফিরবে না।
আমি বললাম, আমাদের না জানিয়ে চলে গেল কেন?
নয়ন বলল, জানি না ম্যাডাম।
আমার বাবা একটা গল্প বলেছিল। এক দরিদ্র লোক বাজারে যায় তার বানানো মাটির পাত্র নিয়ে আর কিছু বিক্রি হয় না তাই খালি হাতে ফিরে আসে। সে খুব দুখী। দেবীরও খুব কষ্ট হল। একদিন দেবী এক থলি টাকা নিয়ে লোকটার ফেরার পথের ধারে রেখে দিল। লোকটা সেদিন কী যে হল, ভাবল, অন্ধরা কীভাবে পথ চলে? দেখা যাক, এই ভেবে সে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেল সেই টাকার থলি। দেবীর চেষ্টা ব্যর্থ হল। দেবী বুঝল, এর দারিদ্রের কোনও পরিবর্তন নেই। তবে শান্তনু শিক্ষিত, সে অপরিনামদর্শী নয়, সুবিবেচক। আর আমি কোনো মতেই দেবী নয়। আমার অন্তত চারটে হাত নেই। বরং আমার নিজেকেই এখানে ওই দরিদ্র লোকটার মতো মনে হল আর শান্তনুকে দেবী। যদিও ব্যাকরণ বলবে সে দেবী কখনই হতে পারে না। হতে হলে তাকে দেবতাই হতে হবে। আশিককে একটা আইপড পাঠাতে হবে। নইলে অন্তত একটা স্মার্ট ফোন। ভাবতে ভাবতে গ্যারাজের পাশে ছোট ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
শান্তনু যে ঘরে থাকত সেখানে গিয়ে দেখলাম দেওয়ালে কালীর ছবি, গাঁদা দেওয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি, তাতেও গাঁদা ফুলের মালা, কয়েকটা সাদা পাতা ছড়ানো, তাতে কবিতা ধরনের কিছু লাইন। তুলে রাখলাম, পরে পড়ে দেখতে হবে। তার বিছানার উপর পড়ে রয়েছে একটা ময়লা বালিশ, সেটা সে নিয়ে যায়নি, বালিশের পাশে সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ। বুকমার্ক দেওয়া।
৫
তালসারি দূরে দেখা যাচ্ছে। না, তালসারি নয়, এটা ঝাউসারি। আমরা দীঘার বোল্ডারের উপর বসে আছি। আমার কানে হেডফোন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। প্রথমে শুনবো খাঙ্গুরা, তারপর জয়তী, তারপর ইমন। আমার পাশে বসে আছেন অহল্যা, মানে যিনি আমাকে দিনের পর দিন উপন্যাস লেখার রসদ জুগিয়ে এসেছেন। মুরাকামি দিয়েছেন, রবীন্দ্রগানের লিস্ট দিয়েছেন, একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে এসেছেন এই দীঘায়। আমি কেবলই কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ছি যত তিনি তত আমাকে টলস্টয়ের গল্প বলছেন, দস্তয়েভস্কির গল্প বলছেন। আমার চেয়ে অহল্যার বয়স সামান্য বেশি। অহল্যার তার স্করপিও গাড়ি করে পোষা কুকুর রানিকেও এনেছেন।
আমরা আসব দীঘাতে—কেউ জানত না সে কথা। কিন্তু অপরূপকে আবিষ্কার করেছি আমাদের পাশের হোটেলে। সেও এসেছে তার কুকু-র পেড্রোকে নিয়ে। সবাই বাঙালির দীঘা আসাকে মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রসারিত অংশ করে দিয়েছে। বলা হয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের তিনটে বেড়ানোর জায়গা যথা দীঘা, পুরি, দার্জিলিং অর্থাৎ দীপুদা। মধ্যবিত্ত ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালি সব কিছুকে ক্যাটেগোরাইজ করতে ভালোবাসে। এরা ব্যাখ্যা দিতে জানে না, শুধু মন্তব্য করতে জানে। বলা হয়, ভাবখানি সম্প্রসারন করে নেওয়া হৌক। কেমন মন্তব্যজীবিতা? না, এরা বলবে,--যারা নচিকেতা শোনে তারা বাল বা যারা এই যুগেও মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন আছে, রোদ্দুর রায় শ্রেষ্ঠ কেননা তাকে সবাই অপছন্দ করে, রাম ছাড়া জগতে আর কোনো মদ পেয় নয়,--এই রকম আর কি। আমার মজাই লাগে। বাঙালি মাত্রেই অম্লান দত্ত সিনড্রোমে অসুস্থ।
অহল্যা আমাকে ‘আপনি’ বলতে যত নিষেধ করেন ততই আমি ‘আপনি’ বলে ফেলি। এই আপনিটা শুধুই একটা সম্মান নয়, এর মধ্যে রয়েছে অকথিত দূরত্ব আর কৃতজ্ঞতা। আমি চাই না, অহল্যা আমার দূরে, কেউ হয়ে আজীবন বেঁচে থাক। আমি চাই সে আমার সবচেয়ে কাছের, ঘনিষ্ঠতম মানুষটি হয়ে উঠুক। কিন্তু তার স্করপিও গাড়িটার কথা মনে পড়লেই আমি তাকে সমীহ করা ছাড়া অন্য উপায় খুঁজে পাই না। আমি কি সম্পদের কাছে নত? আমার মধ্যে কি বিত্তের একটা শ্রেনিবিন্যাস খুব প্রকট হয়ে গড়ে উঠেছে যেটা শত অনুরোধেও উপড়ে যাচ্ছে না? দীঘার সমুদ্রের চেয়ে সুন্দর আর কিছু আজকের আমার কাছে আর কিছু নেই।
অহল্যাকে আমার দেবার কিছু নেই। তাকে শুধু মাত্র একটা উপন্যাস দিতে পারি। সেই উপন্যাস যদি খাজা হয় তার মানে আমার উপহারটিও যথারীতি খাজা।
অহল্যা বললেন, কেউ কাউকে ভালো না বাসলে এতদূর আসতে পারে?
আমি বলি, দয়া বলেও একটা শব্দ অভিধানে আছে।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন চলছে। তার হাতে রানির গলার চেন ধরা। রানি দৌড়তে চায় কিন্তু মালকিন তাকে অনুশাসনে রেখেছে। কুকুর একটি বিলাসিতা শুধু নয়, একটা সিম্বল। কিসের সিম্বল? সবাই জানে, এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
অহল্যা বললেন, এই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি কেমন?
আমি বলি, খাঙ্গুরাকে আমি ভালোবাসলাম।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন বয়ে চলেছে। এই কথোপকথনে কোনো ঢেউ নেই, দীঘার সমুদ্রের মতো। শুনেছি, পুরীর সমুদ্র যা বা যাকে নিয়ে যায় তাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়। দীঘার সমুদ্রের এই সুনাম নেই। তবে একটা বিষয় আছে, সেটা হল, দীঘার সমুদ্র তেমন কিছু নিয়েও যায় না। যে নিয়ে যায় না কিছুই সে ফেরাবে কী?
দেখলাম, অপরূপ তার কুকুর নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওহো, তাহলে পেড্রোকে দেখেই রানির এত উত্তেজনা? যে রানি পুরুষ কুকুর সহ্য করতেই পারে না। পেড্রোও অপরূপের হাত ছাড়িয়ে রানির কাছে আসতে চাইছে। যে পেড্রো কোনো কুক্কুরীকে আজও মেনে নিতে পারেনি।
অপরূপ কাছে আসতেই রানি আর পেড্রো পরষ্পরের গা শুঁকতে লাগল। গা মানে শুধু গা নয়, গায়ের সবটা। মূলত প্রজননদ্বার। দুজনে যেন তাদের হারানো সোলমেটকে ফিরে পেয়েছে এই দীঘার সমুদ্রের ধারে। যেন বৌদ্ধ ধর্মের দুই জাতক, গত জন্মে তারা পতি-পত্নি ছিল, পাপের ফলে এই জন্মে কুকুরজীবন লাভ করেছে। মিলিত হলেই যেন তাদের ইমানসিপেসন হবে, নির্বাণলাভ হবে। তারা শূন্যে হারিয়ে যাবে।
আমি বললাম, অহল্যা, রানিকে ছেড়ে দাও। ওকে আটকে রেখো না। দেখো, তুমি বলে ফেললাম তোমাকে। ভাই অপরূপ, তুইও তোর পেড্রোকে ছেড়ে দে। ওরা সমুদ্রের আরও কাছে চলে যাক। ওদের খেলতে দে।
দুজনে হাতের চেন আলগা করল না শুধু, ছেড়ে দিল। পেড্রো আর রানি পাশাপাশি যেন হাত ধরাধরা করে এগিয়ে চলল। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। তারা আজ খেলবে। ওদের লজ্জা নেই, অথচ আমরা তিনজন কেমন লজ্জিত মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরাই শাপগ্রস্থ। আমি যেন অনিরুদ্ধ আর ঊষা যে কে তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, কাশ্মীরি চাদর বিক্রেতা সুলেমান ভাই এসেছে।
দুপুর হতে আর বেশি বাকি নেই। খানিকটা লিখলেই আমার ঘুম পেয়ে যায়।
একটা চাদর নেবে বলেছিলেন আশিক ভাই, বললেন সুলেমান।
হ্যাঁ সুলেমান ভাই, মায়ের জন্য একটা চাদর আমাকে নিতে হবে, বললাম।
সবচেয়ে উমদা চাদরটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি, এই যে দেখুন, এতে যে ফুল করা সুতো দিয়ে, ওটা আমার বেগমের করা
বেগমের কথা মনে পড়ে না সুলেমান ভাই?
আশিক ভাই, কাশ্মীরিদের মনের খবর কেউ রাখে না। আপনি জিগ্যেস করলেন, ভালো লাগলো। আপনাকে বলি, আমার ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। তাকে এক রাতে সেনারা তুলে নিয়ে চলে গেল। সে পড়াশুনোয় কত ভালো ছিল। আই এ এস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আপেলের মতো গায়ের রঙ। একবার সে আই এ এস পরীক্ষা পাসও করেছিল, ইন্টারভিউয়ে বাদ পড়ে। তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম আমারই এক আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে। সে মেয়েটি খুব সুন্দর। মেয়েটা ইংরেজি অনার্স নিয়ে কলেজে পড়ত। তার নাম সবনম। সবনম আমাদের বাড়ি আসত। আমার ভাই ফারহান যখন চেয়ারে বসে পড়ত তখন সে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকত। সবনম বাড়ি থেকে ফারহানের জন্য সুন্দর খাবার বানিয়ে আনত। যে দিন ফারহানকে তুলে নিয়ে গেল সেনারা পর দিন তার জানাযা পড়লাম।
কেন, কী হল?
আশিক ভাই, সব ভারতীয়ই এর কারণ জানে, সবাই জানে কী হল, আপনি এর পরও জানতে চাইছেন কেন?
আমাদের সমস্যা কী জানেন? আপনার ভাইয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
শুধু আমার ভাই নয় আশিক ভাই, গ্রামের পর গ্রামের ভাই। সবার ভাই। সবার। আমরা শুধু আমাদের ভাই, আর কারও ভাই নই। আমাদের জানাযায় কেউ শরিক নয়। ভূ-স্বর্গের কবরগুলো স্বর্গীয় নয় আশিক ভাই।
আপনি কবিদের মতো কথা বলছেন।
কাশ্মীরিরা সবাই কবি, শায়ের। সবার অপরিসীম যন্ত্রণা তো। টেগর কত দুঃখ পেয়েছেন সারা জীবন বলুন তো?
আপনি টেগর পড়েছেন?
টেগর পড়িনি তবে তার জীবন সম্পর্কে শুনেছি। তার অনেক আত্মীয় মারা গিয়েছে তার সামনে, আমাদের মতো। তবে আমার একটা উপকার আপনাকে করতে হবে আশিক ভাই।
কী উপকার?
এখানে আমার একটা রেশন কার্ড বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি পরিবার নিয়ে এই বাংলায় চলে আসব। কাশ্মীর মরে যাচ্ছে ভাই, ভারতবর্ষের ম্যাপের মাথাটা পচে যাচ্ছে। সবাই জানে, নাকে রুমাল দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু চিকিৎসা করবে না।
কিন্তু ভাই, আপনার রেশন কার্ড এখানে করা যাবে কীভাবে আমি তো বুঝতে পারছি না। এ সব বিষয়ে আমি ভীষণ রকম অজ্ঞ।
কোনো লিগ্যাল সমস্যা আছে?
বোধ হয়।
আমাদের সঙ্গে লিগ্যালি কী হচ্ছে ভাই, আমাদের বেঁচে থাকাটাই তো ইল-লিগ্যাল, মৃত্যুটাই বৈধ।
সুলেমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বেঁচে থাকার বেসিক সুবিধাটুকু ভোগ না করে কাশ্মীরে চলে যাই। আমিও ওদের সঙ্গে দেশ কাকে বলে বুঝি। রাষ্ট্র যে আসলে যন্ত্র তা উপলব্ধি করি। আচ্ছা, রাষ্ট্র যদি একটা যন্ত্র হয় তাহলে আমরা কী? এর নাটবল্টু? সুলেমান ভাই একটা নাট, অপরূপ একটা নাট, অতনু একটা, আমি একটা। আমাদের যদি মানসিক রোগ হয়, তাহলে রাষ্ট্রেরও মানসিক বিকার হয় নিশ্চয়ই? রাষ্ট্রেরও এসাইলাম দরকার তাহলে? আমি ইন্টেলেকচুয়াল নই, আমি বুঝি না। আমার একটা সাদা চাদর দরকার শুধু। নাগরিক হিসেবে এটুকুই বুঝি।
সাদা চাদর আজ নেই। সুলেমান ভাই পরে তার আরও যে গাঁটরিগুলো রয়েছে সেখান থেকে খুঁজে বের করে দিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে গরম পোশাকের গাঁটরি, কাপড় দিয়ে কষে বাঁধা, যেন পড়ে না যায়, সেভাবে। কিন্তু তিনি রোজ একটা দেশ থেকে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন। তার সাইকেলের আওয়াজ ধাতব নয়,--তার সাইকেল বালি পড়ার মতো শব্দ করে ঝর ঝর। আর এগিয়ে যায়। কোথায় যায় এগিয়ে? ভারতের দিকে, পাকিস্তানের দিকে, নাকি নেভারল্যাণ্ডের দিকে? জানি না।
৬
শীতের দিনে বৃষ্টি। আমি বৃষ্টি পছন্দ করি না। শীতের বৃষ্টি আরও খারাপ। এমন দিনে মনে হয় আমি কাউকে চাই না, কেউ আমাকে চায় না। এই মনে হওয়ার সঙ্গে যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। তাত্ত্বিক ও তার্কিকদের দেখে আমার খুবই ভয় করে। আমি জ্ঞান থেকে পালাতে চাই। অজ্ঞান হতে চাই কি? নির্জ্ঞানের দিকে যেতে চাই আমি? বলে রাখি, আমি কোথাও যেতে চাই না। শুধু একবার দীঘা যেতে চাই। আশিক কি যাবে আমার সঙ্গে? শান্তনুর কথা মনে পড়ছে। গাড়ির ড্রাইভাররা কি মালকিনদের ভালোবাসে? আজ আমার খুব ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করছে। ঋভু আমাকে ভালোবাসত। সে সব কলেজ দিনের কথা। ঋভু জানত না জীবনে সে কী করবে। সে জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আওড়ে বলত, ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে যাব। তখন আমার খুব সাংসারিক হতে ইচ্ছা করত। মনে হত, বর হবে একটা বট গাছের মতো, একটা তালগাছের মতো, যাকে দূর থেকেও দেখা যায়, যে হবে আমার লাইটহাউস। মার্টিন স্করসেসির শাটার আইল্যাণ্ড ছবিতে লাইটহাউসে মনোরোগীদের মস্তিষ্কের চিকিৎসার নামে মস্তিষ্কটাই কেটে বাদ দেওয়া হত। দেশের জন্য যারা বিপজ্জনক তাদের ওই রাষ্ট্র পরিচালিত এসাইলামে এক প্রকার বন্দি করে রাখা হত। ওটা একটা দ্বীপ। ওই দ্বীপ থেকে পালানোর একটাই মাত্র ফেরিঘাট। যেটা পাহারা দিত সেনারা। বাইরে থেকে মনে হবে ওটা একটা ভূ-স্বর্গ যেখানে ট্রিটমেন্ট চলে। সবাই ভাববে, ওটা একটা উদ্যান। উদ্যানই তো। যদিও এই উদ্যান থেকে পালাতে চাইবে ক্যাপ্রিও। সে তো সুস্থ, সে কেন থাকবে, কিন্তু সে কার কাছে সুস্থ, সুস্থতার সংজ্ঞা কী? যারা জানে, যারা অধিকার দেয় সব কিছুর, তাদের ব্যাখ্যা আলাদা। আমি এসব কিছু বুঝি না, আমার একটু ভালোবাসা দরকার।
আমার পাশে রানি এসে বসেছে। বৃষ্টিতে সে কুঁকড়ে গেছে। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। সে আমার কোলে শুয়ে পড়তে চাইছে। তারও ভালোবাসার প্রয়োজন।
ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার লং স্কার্ট ভিজে যাচ্ছে জলে। আমি ইচ্ছা করেই লং স্কার্ট পরে বেরিয়েছি। আমি চাই ভিজে যাক আমার পোশাক।
চা দোকানে দাঁড়ালাম।
রঘুদা বলল, দিদিমণি, বৃষ্টিতে কোথায় বেরিয়েছেন?
আমি বললাম, আপনার ছেলে কি ফোন করে?
ছেলে? না, মা, সে নাকি কী একটা পেয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
স্কলারশিপ পেয়েছে?
হ্যাঁ, ওই।
রঘুদার ছেলে খুব ভালো ছাত্র। খড়্গপুর থেকে আর সে ফিরল না তাহলে। ‘ভালো ছেলে’রা ফেরে না। রঘুদার ‘খারাপা ছেলে’টা রঘুদার সঙ্গে চা দোকানে থাকে।
একটা ট্যাক্সি ধরলাম। আজ আশিকের বাড়ি যাব। সে কি বাড়ি থাকবে?
দুপুরবেলা আশিকের পাড়ায় ঢুকে পড়লাম। জিগ্যেস করে খুঁজেও পেলাম আশিকের বাড়ি। খুব সাধারণ একটা বাড়ি। নীল রঙ। বাড়ির সামনে পাতাবাহার গাছ। একটা নিম গাছ। আর কিছু পালং শাক হয়ে আছে উঠোনে।
আশিকের বাড়িটা নির্জন। গেট খুলেও কাউকে দেখতে পেলাম না। ডাকব কিনা ভাবছি, তারপর মনে হল, না, যাব না। আশিকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পত্রেই সীমাবদ্ধ থাক। আমার ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিলে দূরে। আমি গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
আশিক জানবে না আমি এসেছিলাম। আমি তাকে কখনও জানাবো না। আমি একটা পাপ করেছি। পাপটা হল, কিছু জায়গায় কখনও যেতে নেই। দূর থেকে শুধু এই জায়গাটার কথা কল্পনা করতে হয়। ভাবতে হয় যে, ওটাই আমার শেষ আশ্রয়। হয়ত সেটা কোনও আশ্রয়ই নয়। তবু ভেবে ভেবে এগিয়ে যেতে হয়। অভিসারের পর কৃষ্ণের দর্শন না হলেই বরং রাধার জন্য ভালো। আমি কি রাধা? আশিক কি কৃষ্ণ? ‘একদিন আমি ওখানে যেতে চাই’—এই বাক্যটাই আমাদের সান্ত্বনা। ওই ‘একদিন’টা কখনও না এলেই ভালো। বাড়ির পথ ধরে মনে হল, আমি ভূ-স্বর্গের কাছ দিয়ে চলে এলাম। বৃষ্টিতে যে বাড়িটা ঝাপসা, যে বাড়িতে লোক আছে, তবে ধরে নেব যে কেউ ছিল না। আর ওটা আশিকের বাড়িই নয়। বৃষ্টিতেও আমার গাড়ি জ্যামে আটকে গেল।
জিয়া হক