দাও ও ২০১৯


আমাকে দাও সেই ভাষা যে-ভাষা নতুন, সেই ভাব যে-ভাব নতুন, সেই কল্পনা যে-কল্পনা নতুন।
আমাকে দাও। আমি লিখতে চাই। আমার মনুষ্যধর্মের পাশাপাশি এই এক ধর্ম আমি বয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমাকে মূর্খের দেশে পাঠিও না। আমাকে অজ্ঞের দেশে পাঠিও না। নির্বিকার করো না আমাকে। শুধু দুশ্চিন্তা আমাকে কেন ভোগ করে যাবে? আমাকে আমার উপর জয়ী করো। আমার যা নাকি সম্ভবনা, দিয়েছো, তাকে অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়ে রেখো। আমাকেও জাগিয়ে রেখো। অনেক ঘুমিয়েছি। এবার ভারসাম্য দাও। এবার আমার টেবিলে আলো জ্বেলে দাও। এবার আমার কলমে আলো ঢেলে দাও। আমার খাতায় ফুটিয়ে তোলো বিকল্প ফুল। এই ফুলে সুগন্ধ ভরে দাও, এত গন্ধ যে সমুদ্র সুবাসিত হয়। আমাদের বড় দুঃখ, আমি সেই দুঃখ মুছিয়ে দেবার একখানি রুমাল ধার চেয়ে নিতে চাই। এই শীতে আমি যেখানে যেখানে বরফ জমে আছে সেখানে সেখানে আগুন জ্বেলে দিতে চাই। তুমি সে বন্দোবস্ত করো। অকাতরে অতর্কিতে ঘুমিয়ে পড়া লোকের মাথার নীচে বালিশের উচ্চতা দিতে চাই। তুমি সে ব্যবস্থা করো।
আমি তো বামন। চাঁদে হাত দিতে নয়, কেবলই চাঁদের শোভার সুখ্যাত বর্ণনাকারী হওয়ার সু-ভাগ্য দাও। সূর্যে জ্বালানি দেওয়ার আমি কেউ নেই, শুধু উত্তাপ পরিবহনের সু-ভাগ্যটুকু দাও।
দাও।

জিয়া হক 

পাঠিকা ও লেখার অপমৃত্যু সংক্রান্ত


এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা বস্তাবন্দি পথ
হারায় রৌদ্রে আর হারায় অন্ধকার জলে
কে আর পৃষ্ঠপোষণা দেয়, এ লেখার পিতামাতা নেই
জন্ম হয় কুমারীর গর্ভ ফোটা ফুল
জন্ম হয় শূকরের শুভ আস্তাকুড়ে
শুভ কেন—এ চিন্তা চিরে দেয় সমুদ্রের রাশি
ভোর হয় চিন্তা নিয়ে, সন্ধ্যা আসে চিন্তারাজ্য থেকে
শূকরেরও দিন ছিল কোনো এক স্বচ্ছ প্রদেশে
সুগন্ধ কোনদিন ছিল না এখানে তাই মৃতেরা আতর ভালোবাসে
এ লেখা হারিয়ে যায়, এ লেখা হারিয়ে যাবে
গোত্রপরিচয়হীন কোনো লবণাক্ত ঘাসে

সজনী পড়বে বলে লিখে রাখি আত্মজীবকথা
প্রেমিকার সৌধ গড়া যেই মতে প্রথা
সৌধ থেকে বালি খসে পড়ে
যেরকম আত্মা হয় রাতের বাগান
পরীরা রাজ্যজুড়ে মানুষের স্নানে
যোগ দেয়
দেশ গড়া হয় এইভাবে
খানিকটা আত্মরতি, খানিক স্বভাবে

এ লেখার মানে কি, এ লেখা কেন লেখা হবে?
মনেতে মাধুরী থাকে, বেকার কর্মীর কোনো স্তবে
উচ্চারিত হবে এ লেখা?
কর্মপ্রার্থী ও কবির কি কোনদিন দেখা—
হয়ে যাবে পথে, ট্রেনে, বাসে?
হয়ত এখানে নয়, হয়ত বাগানে নয়
হয়ত নরম দোকানে কিংবা শ্রীহীন আকাশে।

সূর্য থেকে ঢেউ এসে স্পর্শ করে ঘর
পাঠোদ্ধার হবে হয়ত
                         এই লেখা শীতে অতঃপর।
বসেছে দুজন পাত্রী, মুখোমুখি, রাখা
পদের পাত্রখানি চায়ের পেয়ালা দিয়ে ঢাকা

রচনা উপচে যায়, রচনা তলিয়ে যায় ঘুমে
যে রচে সেও কি মরে না নিজভূমে?
নিজভূমি নীচুভূমি হাজির হয় না সেখানে রোদ
শূন্য পাত্রে বেজে ওঠে অসিদ্ধ ভাতের সরোদ
কে শুনবে সে-গান? ওই গান?
পাখিরাজি, বৃক্ষকুল, যন্ত্রচালিত জলযান।


জিয়া হক 

রাধা থেকে ধারা-পতনের গন্ধ


ভালো আর বাসবে না কেউ, কোথাও আর ধ্রুবতারা নেই
মাঠের মাথায় জাগে বন্য সেই চাঁদ
যা কিছু যায় না ধোয়া তাই আজ জলের তলায়
ধ্রুবতারা চাও কেন? তুমিই যখন নীল গ্রহ
চাওয়া ধর্ম —এই জেনে তুমি রোজ প্রার্থনায় বসো
আলোকিত গাছ থেকে আলোকসদৃশ ফল ঝরে
তুমি তার পাশে এসে, তুমি তার লাবণ্য হতে চাও?

হও তবে, কোথাও রয়েছে কোনো বাধা?
তুমিই কৃষ্ণ জেনো,
                    তুমিই তার প্রকাণ্ড রাধা

জিয়া হক 

মিথ্যুকের গান


ও আমার ঘুমপাড়ানি রাত —বলো
বালিশ বিছানা টলমলো
শয্যাদ্রব্য পানীয় নেয় নাকি?
স্থির নয়, বাকি
বাকি আছে রাতের আঘাত
তপশিলি কোনো উপজাত
ভিক্ষা দেয় যদি
ক্ষতি হবে? হয়ে যাবে বড় লস-ক্ষতি?
নেই বলে হাত পাতে যারা
লোকেরা কি জেনে যায় তাহাদের মুখের চেহারা?
সাধু থেকে শুরু করা লোকে
অমূলক খাদ্যাভাবে ভোগে
অদ্য রজনী তার ঘুম
কেড়ে নেবে গাজনের লৌকিক মরসুম
পরিজন থাকে যদি দূরে
সাংবাদিকের মতো
           জেনে নেয়
আখ্যানের বাকি নাকিসুরে
কে-ই বা আর হায়
শান্তি-পেয়ালা দিতে চায়
                          এই দেশে

জিয়া হক

প্রাচ্যবিদ্যা


ভূত, ভূত, ভূত!
কোথায়?
ওই তো খাটের তলায়।
কই, খাটের তলায় তো কিছু নেই?
না না, দরজার ওপাশে।
দরজার পাশে তো মাদুর দাঁড়িয়ে।
ওই তো, আলমিরার পিছনে।
আরে, আলমিরার পেছনও তো ফাঁকা, কেউ নেই।
তাহলে জানালা দিয়ে পালিয়েছে।
তুই কি মস্করা করছিস? এই এলো আর এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল? এতগুলো লোক তাকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে আর সে ব্যাটা পিঠ টান মারল?
ভূত কি আর আমার কথা শুনে চলে নাকি?
কিন্তু তুই তো বললি এখানেই সে আছে।
ভূত এক জায়গায় বেশি ক্ষণ স্থির থাকতে পারে না।
তুই কি ভূতের স্পোক পার্সন? সে নিজে এসেই বলুক না সে কী পারে আর কী পারে না। আমরা কি তাকে অসম্মান করি?
এখানেই তো সমস্যা?
এতে আবার কী সমস্যা?
ভূতেরা আমাদের কাছে সম্মান চায় না, তারা আমাদের কাছে ভয় চায়।
আমরা না হয় ভয়ও করব, সে যদি একান্ত চায়। আমরা কি এতটাই নিষ্ঠুর?
আবার ভুল করলে।
আবার কী ভুল করলাম?
নিষ্ঠুর হবে ভূতেরা, আমাদের হতে হবে মিনমিনে, ভীতুর ডিম।
মিনমিনে মানে কী বলতে চাইছিস? বড় বাবু যেমন তার বৌয়ের সামনে করেন, সেই রকম মিনমিন?
মিনমিনে মানে উঠতে বসতে ভয় পাওয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া, হাত পা কাঁপা, ফিট হয়ে যাওয়া, চোখ কপালে তুলে মেঝেতে শুয়ে পড়া—এই সব আর কি।
এ কী বললি তুই?
কেন?
যাকে দেখলামই না তাকে না দেখেই চোখ কপালে উঠবে কী করে? এ অন্যায় দাবী নয়?
এখানেই তো আসল মজা। সে তো সবাইকে দেখা দেবে না। ভগবান কি সবাই কে দেখা দেয়?
ভূত আর ভগবানকে এক করলি?
এই জন্য তোমরা তাকে দেখতে পাওনা। যা ভূত তাই ভগবান। এই সত্যিটা বুঝতে হবে।
ভগবানের পুজো করা হয়, ভূতের কেউ পুজো করে?
আজ সে এসে এই কারণে চলে গেল। তাকে শুধু ভয় করলে হবে না, ভক্তিও করতে হবে। তোমাদের তার প্রতি কোনো ভক্তি নেই। তাই তোমাদের ভূত-লাভ হল না।
তোর কি ভূতের প্রতি ভক্তি আছে?
ওরে বাবা, বলে কী! ভূতের সঙ্গে আমার অন্য চুক্তি।
চুক্তি?
সে তোমরা বুঝবে না। ভূতেরা সবার সঙ্গে চুক্তি করবে না।
তোর সঙ্গে তার চুক্তি হল কীভাবে?
আরে আমি তো ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়েছি।
ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি?
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগছে তো?
না মানে, হ্যাঁ। কিন্তু ভূতের ফ্যাঞ্চাইজি নিয়ে তুই করবি কী?
আমার কাজ হল ভূতকে প্রমোট করা।
ভূতের আবার প্রমোশন লাগে?
লাগে বৈকি। কার প্রমোশন লাগে না বলো তো?
কিন্তু তাতে তাদের লাভ কী?
যে কোনো প্রোডাক্ট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার প্রমোশন জরুরি। টিভিতে অ্যাড দেখো না?
তোরা টিভিতে ভূতের অ্যাড দেওয়ার কথাও ভাবছিস নাকি?
না, এখন টিভির চেয়ে ইন্টারনেট বেশি কাজের।
আমার কথাটা এখনও তুই বুঝতে পারছিস না। এসব করে ভূতেদের লাভটা কী?
তুমি যদি এসব বুঝতে তাহলে আর কেরানি হয়ে জীবন কাটাতে না।
একটু বুঝিয়ে বল না।
ভয়ের বিজনেস। এর চেয়ে লাভজনক ব্যবসা আর নেই।
কিন্তু ওরা তো আর কোনো দেশ শাসন করছে না। ভয়ের ব্যবসা করে তারা পাবে কী?
এই তো গোল করলে। কে বলেছে তারা দেশ শাসন করে না! আমাদের দেশ যারা শাসন করে তারা অধিকাংশই ভূত। এরা মানুষের মধ্যে এমন ভাবে মিশে থাকে যে সহজে চেনা যায় না কে ভূত আর কে মানুষ।
তুই বলতে চাস আমাদের চারধারে যে সিপাই-সান্ত্রী, মন্ত্রী-পারিষদ তাদের মধ্যে ভূতেরা মিশে আছে? তাদের অনেকেই ভূত?
বলতে চাইছি না, নয়। এটাই বলছি আর এটাই সত্যি।
কিন্তু আমরা বুঝব কী করে? না বুঝতে পারলে বিশ্বাস করব কী করে?
তোমরা যে অবিশ্বাস করো, তাই নিয়ে ভূতেরা খুব মস্করা করে।
কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না, আমরা বিশ্বাস না করলে তাদের অস্তিত্বই যে টিকে থাকে না।
এই একটা অবৈজ্ঞানিক কথা বলে ফেললে তো!
ভূতের আবার বিজ্ঞান?
পূর্ণিমার রাতে তুমি যদি চোখ বন্ধ করে রাখো তাহলে কী চাঁদের অস্তিত্ব শূন্য হয়ে যাবে?
কিন্তু আমরা তো ভূত দেখতেই চাই, চোখ কোথায় বন্ধ করে আছি? তাদের দেখা দিতে সমস্যা কোথায়?
 এই একটা অর্থহীন প্রশ্ন করলে। আচ্ছা, যারা সিনেমার হিরো হিরোইন হয়, তারা আমাদের বাড়ি এসে দেখা করে না কেন? দেখা করলে কি তাদের নিয়ে ক্রেজটা আর থাকবে? কে আর টিকিট কেটে ঘরের লোককে দেখতে যাবে বলো?
কিন্তু তারা তো আর অদৃশ্য নয়, কোথাও না কোথাও তাদের তো আমরা দেখতে পাই।
ভূতেরা কি বলিউডের নায়ক নায়িকাদের মতো আচরণ করবে বলে তোমার মনে হয়? কেন তারা ওদের নকল করবে কেন? ওদের কোনো মৌলিকতা নেই? ওদের ইন্ডিভিজুয়ালিটি নেই? তারা ভূত বলে আমাদের নকলনবিশি করে বেড়াবে নাকি?
সবই তো বূঝলাম কিন্তু তোকে ওরা পেল কী করে?
পেল মানে?
মানে তুই ওদের পেলি কী করে?
সব কিছুকে খুব সহজ মনে করো, না? আমাকে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়েছে? অনেক ক্যান্ডিডেট ছিল।
পরীক্ষা? অনেক ক্যান্ডিডেট?
ভূতটা আবার এসেছে। ওই তো সে।
কই, কোথায়?
ওই তো, খাটের তলায়।
খাটের তলায়?
না, এখন দরজার পাশে।
কই, দরজার পাশে তো নেই। দরজার পাশে তো মাদুর।
এখন সে আলমিরার পেছনে।
কই?
এই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল। যাহ!


জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

নির্জন লোকটা ও তার গোরস্থান


গরমের দিনগুলিতে সে নিজেই বাগানের চারাগাছে জল দেয়। সে এটাকে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়। এভাবেই সে পৌত্তলিকতাকে ব্যাখ্যা করে। ঘন সবুজ বনই আসলে দেবতার মূর্তি। পরিচর্যাই কার্যত পূজা —উপাসনা। ঘটনা খুবই সামান্য। একদিন তাকে এই বাগানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নিজের হাতে লেখা একটি কাগজের টুকরোও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা — আমি এই মৃত্যুর তদন্ত চাই না। ভাগ্য বিপর্যয়! একে ভাগ্য বিপর্যয় বলা যায় না। মৃত্যু নামের ঘটনাকে মৃত্যুর সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হল, এইভাবে বলা যায় একে। সে দেশ-ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল কিনা বলা মুশকিল। তবে তার গায়ের রং নীল ছিল না আর সে বাজার বলতে বুঝত নোংরা জায়গা যার শুধু দেহ নয়, আত্মাও বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে।
তার পরিবার যখন সেই কাগজের টুকরোর ভাষাকে অস্বীকার করে পুলিশ ডাকল তদন্তের জন্য তখন সে ওই বাগানেই শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীটা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক নয়। এখানে উলঙ্গ লোকেরাই উলঙ্গের নগ্নতা নিয়ে চর্চা করে।
সে চুপচাপ শুয়ে রইল যেভাবে সে পরিবারে এতদিন সময় কাটিয়েছে।

জিয়া হক
চিত্র ঋণ : রেহান ইসলাম রিদা 

দার্শনিক : পুরস্কার প্রাপ্ত


মায়ের কথা বলতে গেলেই বাবার কথা আসে। বারান্দায় বসে থাকা আমার বাবা। ঝুঁকে থাকা একজন মানুষ। যেন এইমাত্র পড়ে যাবেন। দড়ির ওপর থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন নিজেকে। কেননা তাঁর নির্দেশ আমরা আর কবেই বা মান্য করেছি। অবমাননাই তাঁর প্রাপ্য ছিল আজীবন। অবমাননাকেই তিনি শ্রেয় জ্ঞান করেছিলেন আজীবন। তাঁর জুতোখানি এখনও সাজানো রয়েছে জুতোর র‍্যাকে, যেভাবে রামের পাদুকা ছিল ভরতের আশ্রয়। তার রাজ্যপাটের অভিজ্ঞান।
আমার মায়ের দাবি শূন্য। তিনি শুধু রান্না করে গিয়েছেন রান্নাঘরে। মায়ের সঙ্গে আমাদের সবার তরিতরকারির স্মৃতি। শীতের রোদে বসে পালং শাক থেকে আগাছা বেছে বেছে প্লাস্টিকের চুবড়িতে রাখছেন—এই হল পরিচিত দৃশ্য। তাঁর জঙ্গলি ছাপা শাড়ি শুকোয় একা একা উঠোনের তারে। দোল খায়। আমরা তাঁর মনের খবর রাখিনি।
সেই মা-ই সেদিন বললেন, বাবা, একবার সমুদ্রে নিয়ে যাবি?
অবাকই হয়েছিলাম। মা কখনও বাড়ির বাইরে যেতে চান না সচরাচর। নিজেকে ঘরকুনো বলেই আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।
দু মাস হল বাবা নেই। চিরদিনের জন্য নেই। শিশুদের মতো নক্ষত্রের রাতে তাঁকে আকাশে খুঁজব নাকি গাছের অগণিত পাতায় খুঁজব ভাবি। বাবার প্রিয় নিমগাছটা এখনও বাড়ির সামনে শোভা পাচ্ছে।
মা সমুদ্রে যেতে চায়; মা বাড়ির বাইরে বেরবে—এ কি কম কথা।
বাবা-মা দুজনেই বলতেন তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। যেখানে যেখানে এতদিন কথা দেওয়া ছিল, যাওয়া হয়নি, যাইনি, সেখানে ঘুরে বেড়াব। সংসার থেকে অবসর নেব। পারবি না সংসার বুঝে নিতে?
বাবা বেরিয়ে পড়েছেন ইহকালের মতো। চিরকালের মতো। মা সমুদ্রে যেতে চান।
আমি জিজ্ঞাসা করি, মা, তুমি সমুদ্রে যেতে চাও কেন?
আজীবন চুপ করে থাকতে থাকতে মা চুপ করে থাকাকেই ধর্ম মনে করেন। তাই তিনি উত্তর দেন না। আমাদের বুঝে নিতে হয়। আমরা কবে বুঝতে চেয়েছি অব্যক্তকে?
মা বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে কথা বললেন, তোর বাবা বলেছিলেন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। আমি তো সমুদ্র বলতে শুধু বুঝি জল আর জল যার কোনও কূল কিনারা নেই। তোর বাবা বলেছিল, দার্শনিকেরা সমুদ্র ভালোবাসে।
দার্শনিক কী জানো মা?
আমার মায়ের তো লেখাপড়া কম। তিনি লৌকিক জ্ঞানে শিক্ষিতা। জীবনের সব সমস্যা পেরিয়ে আসতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েই।
মা বললেন, দার্শনিক মানে আমি জানি না তো রে, তবে তোর বাবা বলেছিল যারা শুধু দেখে যায়, কিছু বলে না, শুধু দেখে যায়।
আমাদের কাজের পিসি তখন ঘরে ঝাঁটা দিচ্ছিল। তিনি সব বিষয়ে মন্তব্যে পারদর্শি।
আমি ঘুরিয়ে বলি, আচ্ছা পিসি দার্শনিক মানে জানো?
পিসি তো কিছু বলবেই। পিসি বলল, ফেরিওয়ালা?
আমি বলি, ঠিক বলেছো।
পিসির মুখে প্রসন্ন হাসি। মা জানেন না যে প্রশ্নের উত্তর সেই উত্তর সে জানে—এ কম কথা নয়।
আমার মায়ের দিকে পিসি আড়চোখে তাকিয়ে নিল একবার।
পিসি চলে যেতে মা বললেন, দার্শনিক মানে তোর বাবা ভুলই জানত, না?
মা, শোনো, আমরা সবাই দার্শনিক,--তোমার বিশ্বাস হয় আমার কথা?
তারা সমুদ্র ভালোবাসে কেন? মা জানতে চান।
মাকে কীভাবে বোঝাব যে বাবার যুক্তি অকাট্য নয়। দার্শনিকরা পাহাড়, মরুভূমি, ঝর্ণা, গিরিখাত, হিমবাহ সবই ভালোবাসতে পারে। বাবাকে কি ভুল প্রমাণ করা উচিত হবে। বাবা তো মায়ের কাছে একজন শুধু মানুষ নয়,--বিশ্বাস, স্থান, তীর্থ।
এক সপ্তাহ পরের কথা। আমরা ভাইজাগ-আরাকু উপত্যকা ঘুরে এসেছি। এখানে পাহাড় আছে, পাশাপাশি সমুদ্রও।
দুপুরে বাড়ির বারান্দায় মা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম মায়ের।
খুব নরম স্বরে বললাম, মা, তোমার কোনটা ভালো লাগল? পাহাড় না সমুদ্র?
মা বললেন, মানুষ।




জিয়া হক

অযথা বিপ্লব ২০১৯


কী হবে এই দীর্ঘদিন, কালো কালো মেঘ
পাখিরা ফুলের কাছে মধু চায় নাকি
কী হবে ও মাছেদের রোদনসঙ্গীত
আমি কি নিরামিষাশী, সমাজ-আহত
নিদ্রাশেষে জলাধারে খাব সামাজিক
কেন যে কোথাও নেই মৃত মানুষেরা
কোথাও কেন যে নেই পূর্বমাতৃদল
সূর্য কি আলো দেয় দুপুরে ও ঘরে?
ঘরেতে ঘুমোয় যারা স্বপ্ন-দার্শনিক
তারা কি পুরনো রীতি কলঙ্কিত করে?


জিয়া হক 

মোজাফফর হোসেন ও তাঁর গল্পচিন্তা


কিছু বই পড়বার ইচ্ছা থাকে, —সহজে মেলে না। আচমকা পেয়ে গেলাম, —এ অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিই।
এবার আপাতত পাঠ ও পরিক্রমা।
বিস্তারিত ক্রমপ্রকাশ্য... 

উজ্জ্বল ঘৃণাদের ভিড়


এই উজ্জ্বল ঘৃণা আমাকে ফিরিয়ে দাও
দাও ওই ঘৃণ্য উজ্জ্বলতা
সাবেকী রাতের শীতলতা, —প্রীতির পিরিচে
নীল শুদ্ধ চা
সে তো জানে না অজ্ঞতা কী
ভেবে দেখো তাকে ক্ষমা করা যায় কিনা
সে তো জানে না ক্ষমা কী
যে ঘৃণা প্রকৃতই উজ্জ্বল বলে মনে করা হয়
যে মন প্রকৃতই মৃদুমন্দ বয়
কে তাকে প্রেমপ্রস্তাব দেয় বছরের ওইসব দিনে

জিয়া হক 

ঈশ্বরের দরবার


ওদের দাবি অন্যায্য নয়। দাবি আছে মানে কোথাও ক্ষীণ হলেও কোনও যুক্তি পরম্পরা আছে ; অন্তত বিশ্বাস আছে। যে প্রার্থী সে সব সময় প্রার্থনার যোগ্য না হলেও সে যে তার প্রাপ্তির ইচ্ছা প্রসারিত করেছে সেটাই বিবেচনার। এতে কি দুর্বলতা প্রকাশ পায়? স্বাভিমান নিকাশিত হয় কি? হয়ত হয় কিন্তু তা গুরুত্বপূর্ণ নয় তখন। প্রয়োজনই প্রণিধানযোগ্য। কথা অন্যত্র। আমরা তো দাবিদার, আমরা কি অপর দাবিদারদের বিষয়ে সচেতন? যদি না হই, যদি চিন্তায় অযত্ন থাকে তাহলে প্রার্থনা করার অধিকার থাকে না। জ্ঞানদানন্দিনী একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি জীবনের কাছে কী প্রত্যাশা করো?
আমি বলেছিলাম, শান্তি।
সে পরক্ষণেই বলেছিল, তুমি কি কারও শান্তির কারণ হয়েছো কখনও?
আমি বলি, না।
তাহলে জীবন তোমাকে শান্তি দেবে কেন? সে সপ্রতিভভাবে জিজ্ঞাসা করে।
তারপরই শান্তির সংজ্ঞা জানতে চায়।
আমি উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আজও পারব না।
হাত পাততে গেলে যেমন হাতের থাকা জরুরি তেমনই হাত পাতার আগে সেই হাতের ইতিহাসে কিছু কার্যক্রম থাকাও বিশেষ জরুরি।
ভিখিরি কি রোজ বাড়ি ফিরে তার ভিক্ষাপাত্র সাবান দিয়ে মাজে? সে কার কাছে কৃতজ্ঞ —ভিক্ষাপাত্র না মানুষের কাছে? কে তাকে বঞ্চিত করে —ভিক্ষাপাত্র না মানুষ?
বৃক্ষরোপনের রচনা লেখার আগে একটা বৃক্ষচারা রোপন করা জরুরি।

জিয়া হক 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে


লোকচক্ষু
............
শুবি আয় ফুলমণি, শুবি আয়
এ খাটের তলা
খানাখন্দ, ভ্রান্তি তবু
এখানেই তোর শিল্পকলা
দেখা হবে অমাবস্যা দেখে
আমি যদি লিপি হই
তুই তোর বর্ণমালা রেখে
এসে দেখ
টুনি বাল্ব চাঁদ লাগে কিনা
তুই যদি দিকভ্রষ্ট
          আমি হব বায়ুর দখিনা
লোক আসে? 
কতগুলো লোক?
তারা তো কর্পূর আর
ঘৃণার ঘোষক

জিয়া হক 

দেশ পরিচয়

দস্যু আর নাবিকের ভেদ আমি করতে পারি আর পারি
অতিথিকে ভালোবাসা দিতে
আমি জানি, কে অতিথি, কার ব্যাগে কী কী রাখা আছে
অথচ এ আবাসন—অতিথিশালাই বলা যায় একে
গাভী চরে, দুগ্ধজাত প্রেম প্যাকেটে যায় দূরে
এখানে জানালা থেকে মৃত্যু দেখা যায় তবু আমরা
বড় আর নকশা করা জানালা বসাই
সিঁড়ি ওঠে দোতলায়, সিঁড়ি ওঠে আকাশের সদর রাস্তায়
এভাবেই পুরনোকে দেখেছি আমরা
আমাদের হিন্দুমতে মরে গেলে ঈশ্বর হয় লোকে
জাহান্নমবাসীকেও আমরা স্বর্গীয় বলে ভাবি
এটুকু উদারতা, চক্ষুলজ্জা আজও টিকে আছে

বাড়া ভাতে ছাই দেয়, সেই ছাই দন্ত সাফে লাগে
এরকমই হত নাকি আগে



সে রকম লোক
.......................................................................

লোক হবে সাধারণ, লোক হবে কিছু মাথামোটা
ঝুল ছোট জামা পরা, ঝুল ছোট স্বপ্ন অর্ধ-গোটা
দেখবে কি দেখবে না—নিজে তার নির্বাচনে এসে
বৃদ্ধ আর শিশু আর মহিলা সভায় গিয়ে মেশে

সে কি তার প্রয়াত মায়ের কথাগুলি
বলে দেবে গর্ধবের কানে বা সমাজে?
বিদেহী আত্মার যদি শান্তি থেকে থাকে
এই তথ্য তার কোনো লাগবে কি কাজে?

লোক হবে অলৌকিক, লোক হবে সাদা ফুলগাছ
ঝরে যাবে সান্ধ্যকালে, ঝরে যাবে অপ্রাকৃত সাজ
দুপুরে সে ছোট হবে, এত ছোট পাদুকার নিচে
রাত্রি গড়িয়ে খাবে
                  প্রাচীন পন্থা মেনে
                                         মাটির পিরিচে


জিয়া হক 

সংসার যাত্রা

সংসারে বড় সুখ, রমণী রয়েছে, তার গুণ
সংসারে কী জানি অসুখ
পুরুষ রয়েছে
                 তার ঘুন

কে দীর্ঘ, —কে সেই পিরামিডখানা
শ্রমিকেরা নেই তবু
               জাদু কারখানা
বানিয়ে তুলেছে তার তার
রোগের মাথার পাশে
তুমি এসে
           বসো সংসার

ছিল ভালোবাসা—টেবিলে সাজানো
টেবিলটি ছিল দুই
তলায় সাজানো

এসেছে তন্দ্রাকাল, এসে গেছে ঘুন
ভালোবাসা বিশেষত জ্বালায় উনুন


রাত্রিকানা লোক
......................
এই রাত্রি বরং শান্ত, শুধু উড়োজাহাজ যায়
লোক পারাপার, যন্ত্রের পাখি সেজে ওঠা আর
তা ব্যতিরেকে শান্ত এই জীবনসুন্দর, গোঙানি
কলকাতা সুন্দর, নর্দমা সুন্দর, রঙিন ত্বক —সে সুন্দর
ভাড়াবাড়ি অ্যাকোরিয়ামের মতো বাষ্পে বাষ্পে জ্বলে
দূরগামী লোক দূরগামী ট্রেনে উঠে গেল
চুম্বন সুন্দর, চপেটাঘাত সুন্দর, জীবনীকাব্য— সে সুন্দর
এই রাত্রি তস্করের, এই রাত্রি ঘুমের বাসনা যার তার
আগ্নেয় উড়োজাহাজের শব্দ ব্যতিরেকে
শান্ত —সুমুখশ্রী —নিখরুচে ত্বকের

জিয়া হক 


ওহে বোর্হেস


গরমের দিনগুলিতে সে নিজেই বাগানের চারাগাছে জল দেয়। সে এটাকে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়। এভাবেই সে পৌত্তলিকতাকে ব্যাখ্যা করে। ঘন সবুজ বনই আসলে দেবতার মূর্তি। পরিচর্যাই কার্যত পূজা —উপাসনা। ঘটনা খুবই সামান্য। একদিন তাকে এই বাগানেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার নিজের হাতে লেখা একটি কাগজের টুকরোও পাওয়া গেছে। তাতে লেখা — আমি এই মৃত্যুর তদন্ত চাই না। ভাগ্য বিপর্যয়! একে ভাগ্য বিপর্যয় বলা যায় না। মৃত্যু নামের ঘটনাকে মৃত্যুর সঙ্গেই সমাধিস্থ করা হল, এইভাবে বলা যায় একে। সে দেশ-ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চাইল কিনা বলা মুশকিল। তবে তার গায়ের রং নীল ছিল না আর সে বাজার বলতে বুঝত নোংরা জায়গা যার শুধু দেহ নয়, আত্মাও বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে।
তার পরিবার যখন সেই কাগজের টুকরোর ভাষাকে অস্বীকার পুলিশ ডাকল তদন্তের জন্য তখন সে ওই বাগানেই শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারল পৃথিবীটা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক নয়। এখানে উলঙ্গ লোকেরাই উলঙ্গের নগ্নতা নিয়ে চর্চা করে।
সে চুপচাপ শুয়ে রইল যেভাবে সে পরিবারে এতদিন সময় কাটিয়েছে।

জিয়া হক 

ভূ স্বর্গ


এই গানগুলি লিখে রাখো; তোমাকেই লিখে রাখতে হবে। পরে দেখা হবে। কথাও হতে পারবে। গানের তালিকা পাঠালাম।
চিঠিটি এভাবেই শেষ হয়ে গেল। আমি আলমারিতে তুলে রাখলাম। আলমারিতে  একটা খোপ আছে যেখানে আমি আমার চিঠিগুলি রাখি। সেখানে আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের চিঠিগুলি আছে, আর আছে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের চিঠি। আমিই প্রেমিকাদের হারিয়ে যেতে দিয়েছি। ছোটবেলায় আমি কখনও ঘুড়ি ওড়াইনি। আমার সমবয়সীদের ঘুড়ি আকাশে তুলে দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। একটা লাল আর চকরাবকরা কাটা ঘুড়ি আমি একবার সন্ধ্যাবেলায় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল—আমি তোমাকে ভালোবাসি। কে কাকে ভালোবেসে এই কথা লিখেছিল তা আজও জানতে পারিনি। রেখে দিয়েছিলাম আমার তক্তাপোষের নিচে। এক বর্ষায় ঘরে জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঘুড়িটা। লাল চকরাবকরা কাটা ঘুড়িটা।
গানগুলি মিলিয়ে দেখলাম যে সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত। জয়তী চক্রবর্তীর তিনটে, ইমনের দুটো, বিক্রম সিং খাঙ্গুরার দুটো গান। এই গানগুলি শুনে দেখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেই ঘুড়িটাতে কে লিখেছিল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, কিন্তু যখন জানতে পেরেছিলাম তখন আমি খুব অসহায়। অসহায়ই কেননা যে মেয়েটি লিখেছিল ওই যাদুকরী শব্দ তাকে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে ততদিনে। যাইহোক, আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি শুনতে হবে কিন্তু আমার কাছে শোনার মতো ডিভাইস নেই।
শীত পড়তে শুরু করেছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাশ্মীরি শালওয়ালা সুলেমানের। সে এবার বাহারি চাদর নিয়ে এসেছে। লালের পাড় দেওয়া একটা সাদা চাদর আমার পছন্দ হয়েছে। মাকে এবছর একটা চাদর উপহার দেব কথা দিয়েছি।
সুলেমান একদিন বলল, আমি আর কাশ্মীরে ফিরে যেতে চাই না আশিক ভাই। এখানে একটা বন্দোবস্ত করে দিন।
আমি বললাম, ভূ-স্বর্গ ছেড়ে এই কাদামাটির দেশে থাকবেন?
আশিক ভাই, এটা তো তবু একটা দেশ, ওটা না দেশ, না রাজ্য। একটা জোকস নিশ্চয়ই শুনেছেন, স্বর্গে সবাই মৃত। আমরা ওখানে মরে আছি।
কিন্তু আমরা কি এখানে খুব ভালো আছি সুলেমান ভাই?
ভাবছেন ভিড় বাড়াচ্ছি, তাই না? কিন্তু ভালো থাকা কাকে বলে আশিক ভাই? আপনার পরিবারের কেউ কখনও সেনার গুলিতে প্রাণ দিয়েছে কখনও? আপনি নিজের ভাইয়ের জানাযায় শরিক হলে হয়ত অন্য রকম ভাবতে বসতেন।
সুলেমানের মুখ শতদ্রু নদীর মতো ম্লান মনে হল। শতদ্রু কখনও দেখিনি। তাই শতদ্রু নাম শুনলেই আমার কেন জানি মনে হয় নদীটি খুব দুখী আর তার উপত্যকা দিয়ে চোখের জল বয়ে যায়। যেমন গঙ্গা শুনলেই মনে হয় জাতি কী, জাতীয়তাবাদ কী, মনে হয় অজস্র প্রদীপের সঙ্গে ভেসে চলেছে ভারতমাতার জাহাজ। যদিও নাব্য নয় ততটা এই গঙ্গা। তবে ভারতমাতার জাহাজ তো আর নুহের নৌকা নয় যে জোড়ায় জোড়ায় প্রাণীরা সব সারি দিয়ে মহাপ্লাবনের ভয়ে কাঁপছে। তবে একটা কাঁপুনি টের পাই। কেন কাঁপে, কে কাঁপায়? জানি তবে এখন আমাকে একটা ডিভাইস জোগাড় করতে হবে এখন যেটাতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনা যাবে।
আমার এক পরিচিত আছে উকিলপাড়ায়। ওর নাম অপরূপ। সে যুক্তিবাদী এবং প্রযুক্তিবাদী। তার কাছে গেলে একটা ডিভাইস পেতে পারি। তার বাড়ি যেতে দেখলাম, সে বোগেনভোলিয়া গাছে জল দিচ্ছে। সাদা সাদা বোগেনভোলিয়া ফুটে রয়েছে। এই গাছ এখন ছোট। বড় হলে দড়ি পাকিয়ে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে বোগেনভোলিয়ার গাছ ছিল। একটাই গাছ কিন্তু মনে হবে একটা আস্ত বিহারি পরিবার খাদ্যের সংস্থানে বাংলায় এসে অনেকটা ফুটপাত দখল করে নিয়ে বস্তি তুলেছে। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সাদা আর সাদা ফুলে ঢাকা। যেন এক টুকরো ভূ-স্বর্গ। আমার প্রিয় স্থান ছিল সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গেট। বই পড়তে গিয়ে ওই গাছের তলায় বসে থাকতাম, মনে হত মাথার উপর দশভূজা। আমি এক অসুর। তবে মহিষের পেটে আমার জন্ম নয়। মানুষের হয়েও ভাগ্যচক্রে অসুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু থাকা জরুরি।
অপরূপ আমাকে আসতে দেখে হাসল। বলল, দাঁড়া কুকুর সরাই।
আমার কুকুর দেখে খুব ভয়। বিশেষ করে যে কুকুর চেঁচায়। শুনেছি যারা চেঁচায় তারা কামড়ায় না। তারপরও আমার ভয় লাগে। কুকুরকে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা হয়। কুকুরের রচনা লিখে আমি প্রথম হয়েছিলাম একবার। জাজ বলেছিলেন, আমার লেখাটা এমন যেন একজন কুকুরই লিখছে। রচনাটি ছিল, ‘রাস্তার কুকুর ও গৃহপালিত কুকুর’।
অপরূপ কুকুর সরিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির ঘরটায়। বেশ বড় কালো কুকুর। কী প্রজাতির কুকুর চিনি না। আমি যে কোনো বিষয়ের প্রজাতি বিষয়ে বিশেষ অজ্ঞ। মানুষেরও যে প্রজাতি হয় তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। একজন কবি লিখেছিলেন, জগৎ জুড়ে একটাই জাতি আছে। কবিদের সমস্যা হল, তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি আশাবাদী। তারা খালি ইউটোপিয়ার কথা বলে। আর নৈরাশ্যবাদে ভোগে। আমি ততটুকু আশাবাদী যতটুকু আশা রাখলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা হয়।
তোর কুকুরের নামটা ভুলে গেছি অপ। একবার বল তো।
ওর নাম পেড্রো।
প্লেটো রাখতে পারতিস, পেড্রো কেন রাখলি?
তুই বিখ্যাত পেড্রোর গল্প জানিস না? বলিস কি!
পেড্রো আলমাদোভার?
না, ইনি সে পেড্রো নন। ইনি কৃষ্ণের আরেক অবতার। তার ভয়ে দেশের রাজাও তটস্থ হয়ে থাকত। দেশে এমন কোনো মেয়ে ছিল না যার সঙ্গে পেড্রো শোয়নি। রাজা তার ভয়ে রানিকে ফেলে যুদ্ধে যেতে চাননি। সে অনেক গল্প।
আচ্ছা, সে গল্প পরে একদিন শুনবো। এখন আমার একটা উপকার কর তো ভাই।
কী করতে হবে বল।
আমাকে একটা ডিভাইসে কয়েকটা গানের নাম বলছি ডাউনলোড করে ভরে দে। কর্তৃপক্ষের আদেশ, শুনতেই হবে।
তোর আবার কর্তৃপক্ষ কবে হল?
এ তুই বুঝবি না, এটা পুরোটাই আনুগত্যের ব্যাপার। কাকে কর্তৃত্ব করতে দিবি আর কাকে দিবি না সেটা তোর নির্বাচন। তবে সেটা ওয়াইজলি করতে হয়। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে, যে পেড্রো এমন সুখ্যাত, তার নামটাই কেন রাখলি তোর কুকুরের। আচ্ছা, কুকুরকে কুকুর বললে তোর আপত্তি নেই তো?
মজা করিস না। কুকুরকে কি টিয়াপাখি বলে ডাকবি? যাকগে, আসলে আমার কুকুরটা ঠিক পেড্রোর উলটো চরিত্রের। এ কারো সঙ্গে শুতে চায় না। ভুল বলা হল, কুকুররা কি শোয়? বরং বলি, দাঁড়াতে চায় না। এদিকে আমার মা আমার বিয়ে নিয়ে রোজ বাড়িতে অশান্তি করছে। আচ্ছা বল, তিরিশটা এমন কিছু বয়স? আসলে এরা তো সব পঁচিশেই দন্ডিত, তাই আমার স্বাধীনতা এদের কাছে পাপ মনে হচ্ছে।
তোমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমি বুঝেছি বাবা। এবার আমাকে ডিভাইসটা দে। তাড়া আছে, আজ একটু শিগগির বেরব।
খারাপ খবর আছে। আইপডটা অতনু নিয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহের আগে পাব না। ও দিয়ে গেলে তুই নিয়ে যাস।
সিঁড়ির ঘর থেকে পেড্রোর কুক্কুরনাদ ভেসে আসছে। সাইবার কাফেতে গেলে কি ইউটিউবে গানগুলি শোনা যেতে পারে? কেন যাবে না? শিবানী পীঠের মোড়ে একটা সাইবার কাফে আছে। সেখানে যেতে হবে। ঘন্টায় দশ টাকা। পরিচয় পত্র লাগবে। আমি তো জানি যে আমি কোনো হ্যাকার নই, শুধু গুরুদেবের কয়েকটা গান শুনতে চাই কিন্তু দেশ আমার পরিচয় পত্র না দেখে আমাকে তা শুনতে দেবে না।
অপরূপকে বিদায় জানালাম।
অপরূপের বাড়ি থেকে বেরলেই মোড়ের মাথায় মদের দোকান। মুখে কাপড় জড়িয়ে তিন জন মদ কিনছে। ইন্টেলেকচুয়ালসরা মদ খায়। এরা কি ইন্টেলেকচুয়ালস? আমার এক বন্ধু সেদিন বলল, এই যুগে যারা মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এদের জ্ঞানগম্যি প্রশ্নাতীত। তবে মুখে কাপড় কেন? জ্ঞানীরা প্রচার চান না। তাঁরা নিঃশব্দে বিপ্লবের পক্ষপাতী। বন্ধুকে মনে পড়ল আর এদের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠল মনে।


ডিভাইস পাচ্ছি না। তাই আপনি যে গানের তালিকা পাঠিয়েছিলেন তা এখনও শোনা হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সম্ভব হলে মার্জনা করবেন। তবে আগামী সপ্তাহে আমি একটি আইপড পেতে পারি।
আশিকের চিঠিখানি পেলাম। সে বড় অসহায় বলে মায়া হয় না, তার প্রতি আমার মায়া আছে বলে তাকে খুবই অসহায় মনে হল। এই গানগুলি না শুনেই সে জীবন কাটাচ্ছে ভেবে আমার কষ্ট হল। ওর চাকরি নেই। চাকরির চেষ্টাও করে না। ও বলে, আমি চিন্তক। অম্লান দত্ত নাকি এমন কথা বলেছিলেন কাউকে। সিঙ্গেল খাটে শুয়ে শুধু বই পড়ে আর ভাবে মুরাকামির মতো একটা উপন্যাস লিখবে। তবে মুরাকামি সঙ্গীত বিষয়ে কত জানে, আর ও গান বলতে বোঝে নচিকেতা। জীবনমুখী বাংলা গান না কি সব। নচিকেতা ছাড়া বাকি সব গান কোন মুখো, বুঝি না।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার স্করপিওর মিষ্টি হর্ন বাজাচ্ছে। কলেজ স্ট্রিট যাবো। মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর বইটা উপহার দিতে চাই আশিককে। একজন ঔপন্যাসিক হতে চায়, আমার কর্তব্য হল তাকে তৈরি করে তোলা। স্বপ্নের সংখ্যা সীমিত লোকেদের আমার ভালো লাগে। বাবা বলতেন একজন দরজি আর একজন ম্যাজিসিয়ানের গল্প। গল্পটা সবাই জানে। ম্যাজিসিয়ান রোজ দরজিকে এই বলে খ্যাপায় যে, তুমি তো ভায়া একটাই মাত্র কাজ জানো—সেলাই করা। সেলাই বন্ধ হয়ে গেলে তো তোমার ভাত জুটবে না। আর আমাকে দেখো, হাজার একটা খেলা জানা আছে আমার। একটা বন্ধ হলে আরেকটা। এক সময় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ম্যাজিসিয়ানের শোতে আর লোক আসে না। খেতে পায় না তো ম্যাজিক দেখবে কী করে! রোজ রাস্তা দিয়ে খালি হাতে ফেরে আর দেখে দরজি তার সেলাই মেশিন চালিয়ে যাচ্ছে। ম্যাজিসিয়ান একদিন গিয়ে বলল, ভায়া এ কি হল বলো দেখি? তখন দরজি বলল, ভাই, আমি একটাই কাজ জানি, কিন্তু যে কাজটা জানি তার প্রয়োজন সব সময়ের। অনাহারে থাকলেও পোশাক মানুষকে পরতেই হবে। খালি পেটে ম্যাজিক দেখা যায় না।
আমি একটি গান গুনগুন করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলাম।
ড্রাইভার বলল, ম্যাডাম, আজ আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
মৌলালীর কাছে গাড়ি ট্রাফিকে আটকে গেল। বাইরে থেকে চোখ ঘুরিয়ে বললাম, আচ্ছা শানু, তোমার স্বপ্ন কী?
কেন ম্যাডাম?
মানুষের স্বপ্ন জানতে আমার ভালো লাগে। তবে বলতে তোমার আপত্তি থাকলে বলো না।
আপত্তি কিসের ম্যাডাম? তবে লজ্জা লাগে বলতে।
লজ্জা কেন?
আসলে ম্যাডাম, আমি আরেকজন ট্যাক্সি, ড্রাইভারকে আমার স্বপ্নের কথা বলতে পারি, কারণ আমি জানি সে হাসবে না। সে হাসবে না কারণ তার স্বপ্নটাও আমার স্বপ্নের মতোই উদ্ভট। খোঁড়া খোঁড়াকে দেখে হাসে না।
স্বপ্ন যে খানিকটা উদ্ভট হবে তা তো ধরেই নেওয়া যায়। আমার এক বন্ধু চায় সে একজন বড় ঔপন্যাসিক হবে। ঔপন্যাসিক মানে বোঝো তো?
ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট, বুঝি ম্যাডাম।
কী করে জানলে শানু ঔপন্যাসিক মানে নভেলিস্ট?
আমি বি এ পাস ম্যাডাম।
ও তাই তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। যাইহোক, তোমার স্বপ্নটা বলো।
আমি যে বি এ পাস সেটা আমি ভুলে যেতে চাই ম্যাডাম। আর ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সব কিছু বুঝতে নেই, এটা খালি গুলিয়ে যায়। দেশ নিয়ে আমাদের কোনো মতামত নেই। রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনে আমাদের হাসবার অধিকার নেই। স্মৃতি একটু কম হলেই ভালো। আরও ভালো হয়, বোধও যদি একটু কম থাকে।
যানজট অনেক আগে কেটে গেছে। আমাদের গাড়ি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম, শানু তোমাকে এবার থেকে শান্তনু বলেই ডাকবো। শান্তনুদের শানু করে দিয়ে আমরা খুবই অন্যায় করি। যাইহোক, ফিরে এসে তোমাকে একটা গল্প শোনাবো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের। গল্পের নামই হল ‘নাম’।
অভিজিৎ মুখার্জি অনুবাদ করেছেন কাফকা অন দ্য শোর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বেরিয়েছে। বাংলায় বইয়ের নাম হয়েছে সমুদ্রতটে কাফকা। দুই খন্ডে। দাম করেছে সাতশ। প্রথম খন্ডটির কভার আকাশি নীল, দ্বিতীয় খন্ডটি সবুজ। উপরে বেড়ালের ছবি। আমার কুকুর রানির কথা মনে পড়ল। সে বেড়াল সহ্য করতে পারে না। তার পছন্দ টিয়াপাখি। একদিন তাকে রাস্তায় হাঁটাতে নিয়ে গিয়ে সেটা আবিষ্কার করি। রাস্তার ধারে যে খিরিশ গাছটায় টিয়াপাখিটা বসেছিল রানি সেই গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে পাখিটাকে দেখে যাচ্ছিল। সে ভুলে গিয়েছিল হাঁটার কথা, আমার কথা। তবে রানির সমস্যা হল, সে কোনো পুরুষ কুকুরকেও সহ্য করতে পারে না। এই কারণে সে মা হতে পারছে না। ধবধবে সাদা রানি যখন আমার গায়ের কাছে এসে বসে তখন যেন মনে হয় বোগেনভোলিয়া ফুটেছে।
ব্লু ডার্টে গিয়ে বই দুটো কুরিয়ার করে দিলাম আশিকার ঠিকানায়।
গাড়িতে বসে বললাম, এই নাও শান্তনু।
কী ম্যাডাম?
দেখই না।
বই?
হ্যাঁ, সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।
শান্তনুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বইটা পরম যত্নে সে পাশের সিটে নামিয়ে রেখে বলল, গাড়ি স্টার্ট করি ম্যাডাম?
করো, তবে প্যারামাউন্টের সামনে একবার দাঁড়িয়ো, ঠিক আছে?
ঠিক আছে ম্যাডাম।
ডাব সরবত নিলাম দুটো। আমার সামনের বেঞ্চে বসে আছে শান্তনু। সে খুব ইতস্তত করছে। মালকিনের সঙ্গে সে এর আগে কখনও খেতে বসেনি।
আমি বললাম, এবারও কি বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে শান্তনু?
বিহ্বল চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার চেয়ে আমার স্বপ্নের কথাটা বলি আপনাকে?
আমি বললাম, সে তো ভালো কথা। আমার প্রিয় বিষয়।
শান্তনু বলল, আমি চাই আমার নিজস্ব একটা ট্যাক্সি, আমি যার মালিক। হলুদ ট্যাক্সি। গাড়িতে সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে। আমার প্রিয় গায়ক সুবিনয় রায়। সুবিনয় রায় কেন ভালো লাগে জানেন তো ম্যাডাম? তার গলায় ভারি দুঃখ, ঔদ্ধত্য নেই, রবীন্দ্রনাথের বেদনা আর তাঁর বেদনা যেন কোথাও গিয়ে এক। আচ্ছা ম্যাডাম, দুখী মানুষদেরও কেন দুঃখের গান ভালো লাগে বলুন তো? তাদের জীবনে তো দুঃখের অভাব নেই।
আমি শুনছিলাম শান্তনুর কথা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, এম এ টা করলে না কেন শান্তনু?
সে অনেক গল্প ম্যাডাম। এই গল্পের সঙ্গে স্বপ্নের কোনো মিল নেই, যোগাযোগ নেই। আপনার স্বপ্ন শুনতে ভালো লাগে, স্বপ্ন ভাঙার গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। আপনি বরং নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পটা বলুন।
খুব বিষণ্ণ ভাবে বললাম, আজ নয়, অন্য একদিন বলব। চলো এখন যাওয়া যাক।
দাঁড়িয়ে পড়ে শান্তনু বলল, চলুন ম্যাডাম।
গাড়ি ছেড়ে দিল। শান্তনুর সিটের পাশে রবিশংকর বলের সম্পাদনা করা সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ।


মুরাকামির সমুদ্রতটে কাফকা পাঠালাম। মুরাকামি হতে গেলে মুরাকামি পড়তে হবে তা বলছি না। তবে পড়তে হবে। আমি জানি তুমি যথেষ্ট পড়াশুনো করো। যাইহোক, নতুন কী লিখলে জানতে চাই। আর গানগুলি কি শুনতে পেরেছো?
চিঠিখানির সঙ্গে বই দুটো পেয়ে উত্তেজিত লাগছে। পৃথিবীতে এমন কেউ আছেন যিনি চান আমি একজন ঔপন্যাসিক হয়ে উঠি। বিদ্যাপতি, আলাউল, ভারতচন্দ্রের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে। ঠিকই রাজ-পৃষ্ঠপোষনা এ হয়ত নয়। কিন্তু আমার কাছে রাজা—এই পদটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি তার চেয়েও বড় কিছু দেখতে পাচ্ছি। মুকুন্দরামকে যে প্রত্যাদেশ দিয়েছিল সেই রকম কাউকে।
অপরূপ আজ আইপড দেবে। তবে অপরূপ আজ আইপড দিতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অতনুর উপর। আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন অতনুর উপর নির্ভরশীল। অতনু যে পিয়ানো বাজায় আর প্যারিসে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। পেটের দায়ে সে স্কুল শিক্ষক।
অতনুকে আজ অপরূপের বাড়িতে দেখতে পাবো ভাবিনি। পটাসিয়াম, ফসফেট আর কী সব সার মেশানো হচ্ছে একটা পাত্রে। গাছগুলি অপরূপের কাছে সন্তানের মতো। বয়সের বাৎসল্যরস যাবে কোথায়!
আরে বন্ধু! অতনু আমাকে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সে কথায় কথায় ‘বন্ধু’ বলে। তার মতে, বন্ধুরা না থাকলে সে বাঁচতো না। যদিও তার মৃত্যুর কোনো কারণ দেখি না। তবে এই ‘বাঁচা’ বোধহয় ‘মৃত্যু’র ঠিক বিপরীত শব্দ নয়। অতনুকে দেখলে প্যারিসের কথা মনে পড়ে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তার কাছে খানিকটা প্যারিসের মতো। ভূ-স্বর্গ এই জায়গায় যাওয়া মানেই বেঁচে যাওয়া। অতনু এভাবে বাঁচতে চায় বহুদিন ধরে। স্বর্গের ধারনা সবার এক নয়। যেমন এক নয় হুর-পরির দেহসৌষ্ঠব।
আমার কিছু বলার আগেই অতনু বলে উঠল, বন্ধু, আইপডটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নষ্ট করে ফেলেছি। কী হবে এখন?
সার মাখানো হয়ে গেছে অপরূপের। এবার সে গাছেদের খেতে দেবে। অপরূপ এই জন্য গ্রেট যে তার আইপড নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অথচ সে রাগছে না, ভ্রুক্ষেপ করছে না। তার বাগানে বনসাই ফলের গাছ আছে। বনসাই ডালিম, বনসাই সবেদা, বনসাই জামরুল। পেড্রোর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। পেড্রোকে বনসাই করে রাখা যাচ্ছে না। পেড্রো প্রজননে অক্ষম কিনা তাও স্পষ্ট নয়। রাক্ষুসে চেহারার পেড্রো। নারী কুকুরে তার আসক্তি নেই। সে কি সমকামী?
অপরূপ বলল, আজ একটা মেয়ে দেখতে যাব। বিয়ে না করলে এই বাড়িতে আমার আর থাকা যাবে না। জরুরি নোটিস।
আইপডটা না পেয়ে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। যেন একটা চক্রান্ত কোথাও ঘনিয়ে উঠছে। আমাকে গুরুদেবের কাছে পৌঁছতে দেবে না কেউ। কেউ গাছ নিয়ে ব্যস্ত, পেড্রোর আদর খাচ্ছে, কেউ পিয়ানো বাজিয়ে মোজার্ট হয়ে উঠতে চাইছে, অনায়াসে ডিভাইস নষ্ট করে ফেলছে, আর আমি পরনির্ভরশীল জীব হয়ে শুধু লোকের বাড়ির সিঁড়ি বাইছি কিন্তু কোনো উচ্চতায় পৌঁছতে পারছি না। সিঁড়ি আমাকে নিচে ফেলে দিচ্ছে।
রাগ ভরে বললাম, যা যা বিয়ে কর, বিয়ে করা ছাড়া আর কী আছে তোদের জীবনে? শুবি-খাবি-হাগবি, তোরা সবাই ভেতরে ভেতরে পেড্রো, শুধু সাহস নেই, নয়ত কৌশল করে উঠতে পারিস না। আর আমি এমন এক প্যারাসাইট যার কিনা অবলম্বন বলতে আরো কিছু প্যারাসাইটস। লাগবে না তোদের আইপড। চলি।
আজ আর কুকুরকে দেখে ভয় লাগছে না। পেড্রোর সামনে দিয়ে নেমে এলাম। পেড্রো আমার সাহস দেখে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। যার এতদিন কাজ ছিল ভয় দেখানো, সে যখন জানতে পারল ভয়টা আমার এক সংস্কার মাত্র তখন তার নখগুলো সে লুকিয়ে ফেলে, কারণ সেও জানে ওই নখগুলো প্লাস্টিকের, নকল আর ভয় জিনিসটা একচেটিয়া নয়। একটা আত্মীয়-বিচ্ছিন্ন জীব বেশিদিন ভয় দেখাতে পারে না। যদিও আত্মীয় থাকলেই আত্মীয়-বিয়োগ হয়। ব্যথা হয়। পেড্রো এসব থেকে মুক্ত। রাস্তার কুকুরদের একটা সমাজ আছে, পেড্রোর তাও নেই। তার গড়নটা কুকুরের মতো রয়ে গেছে শুধু, তার সঙ্গে অপরূপের আর কোনো তফাত নেই। পেড্রো এখন একজন যৌন ভাবে শীতল মানুষ যার প্রিয় কাজ ভীতু নির্বাচন করা আর চিৎকার করে ভয় দেখানো। চিৎকারটুকুই তাকে কুকুরত্বে স্থায়ী করে রেখেছে। দেখেছি, লেজ দিয়ে সে অণ্ডকোষ ঢাকা দেয়।
বেলা এগারোটায়ও সাইবার কাফে খোলেনি। পরিচয় পত্র নিয়ে কাফের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। নীল রঙের একটা বোর্ড জ্বলজ্বল করছে—লীলা সাইবার কাফে এন্ড সোসাইটি। এই সোসাইটির দরজা আমার জন্যে বন্ধ এখন। একটা মেয়েকে পড়াই। সামান্য হাত খরচ হয় তাতে। সে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। একটা নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তার বাবা ইন্ডিয়ান অয়েলে চাকরি করে। প্রচুর বেতন। সপ্তায় দু দিন যাই। আজ সন্ধ্যায় যাবো আমার একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অহনার বাড়ি।
দুপুরেই অহনার বাড়ি হাজির হলাম। অহনা একটা সাদা স্কার্টের ওপর সাদা টি শার্ট পরে আছে। অহনাকে ভারি মিষ্টি দেখতে। অহনা কিন্তু তার রূপ নিয়ে অতটা সচেতন নয়, এটাই তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমাকে দেখে সে বলল, স্যার এখন এলেন?
আজ সন্ধ্যায় একটা কাজ আছে, তাই এখন এলাম। তোমার অসুবিধা আছে?
স্যার, এখন তো আমি স্নানে যাবো।
তোমার মা কোথায়?
আজ বাড়িতে কেউ নেই স্যার।
আমি বসে আছি, তুমি স্নান করে এসো।
অহনা বলল, ঠিক আছে স্যার, পড়ে নিয়ে স্নান করব। আপনি কিছু খেয়েছেন?
কে আর খেতে দেবে আদর করে অহনা?
আমি দিতে পারি, এই বলে সে হেসে বাড়ির মধ্যে চলে যাওয়ার আগে বলল, বসুন, আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এলো অহনা। তার হাতে প্লেট। প্লেটে বিস্কুট, আপেল আর দুটো মিষ্টি। বলল, স্যার খান।
আমি বললাম, অহনা আজ একটা খেলা খেলবে?
কী খেলা স্যার?
খেলাটা মজার। তবে এই একদিনই হবে এই খেলাটা আর এই খেলার কথা কাউকে জানাতে পারবে না।
খেলাটা কী?
তোমার মা কখন আসবেন?
পাঁচটার দিকে, কেন স্যার?
ধরে নাও, এই দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি চব্বিশ ঘন্টা। একটা দিন।
আচ্ছা, তারপর?
আমরা একটা দিন এই বাড়িতে দু জন আছি শুধু। আমরা একটা দিন সংসার করব। তুমি আমাকে ‘ওগো’ বলে ডাকবে। আমিও তোমাকে ‘সোনা’ বলে ডাকব। আমরা রান্না করব, প্রথমে তুমি স্নান করবে, তারপর আমি স্নানে যাব, তারপর একসঙ্গে খেতে বসব, খেয়েদেয়ে আমরা একসঙ্গে শোব, তারপর ঘুম থেকে একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠব, তুমি ব্রাশ করবে, আমিও ব্রাশ করব। তারপর আমি কাজে বেরিয়ে যাব, তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাবে। সবটা পাঁচটার মধ্যে।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে অহনা বলে উঠল, ওগো, আজ কী রান্না হবে গো, একবার রান্নাঘরে এসো না দেখি।
আমি বললাম, সোনা, আজ আমরা যদি উপোষ করি কেমন হয়? মাঝে মাঝে উপোষ করা শরীরের জন্য ভালো। শাস্ত্রে আছে।
তুমি আমাকে শাস্ত্র শুনিও না তো…আমি তোমার ছাত্রী নই…
আমরা স্নান করে না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অহনা বলল, লাইটটা বন্ধ করে দাও না গো।
আমি জিগ্যেস করি, এসব শিখলে কোথায়?
সে বলল, মেয়েরা সব শিখেই পৃথিবীতে আসে।
আমি বললাম, সোনা, আমাদের বিবাহের মেয়াদ তো একদিনের, তাই আমরা কোনো ইস্যু নেব না, ঠিক আছে?
তুমি কি কনডোম নিয়েই এসেছিলে আজ?
না, আমার কোনো ছদ্মবেশ নেই। আর আজ এমন খেলা হবে তা আমি জানতামও না।
ক্যারেকটার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো বাবু, খেলাটা মাটি করবে নাকি?
অহনা, খেলাটা আমার আর ভালো লাগছে না, আফটার অল আমি তোমার শিক্ষক। পরের দিন তোমাকে পড়াতে আমার অসুবিধা হবে। আর একটা সমস্যা আছে, এই খেলাটা রোজ খেলতে ইচ্ছা করবে, তখন কী করব?
কাউকে সত্যি সত্যি বিয়ে করে নেবেন। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?
আমি উঠে আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। বিছানায় শুয়ে আছে অহনা। সাদা শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে মনে হল, আমি একটি বোগেনভোলিয়া খেতের ধার থেকে এই মাত্র উঠে এলাম। অহনার শরীরে পূর্ণ নারীর মিষ্টি সুগন্ধ এসে গিয়েছে। সে এখন বিবাহযোগ্যা। সে এখন অনায়াসে মা হতে পারে। যদিও তার এখনও আঠারো বছর পূর্ণ হয়নি। বুঝলাম, আঠারো একটা সংখ্যা মাত্র। আঠারো একটা অনুশাসন। তার বেশি কিছু নয়।
অহনাকে বললাম, আজ যাই।
আমাকে আশির্বাদ করবেন না?
ছাত্রী হিসেবে না স্ত্রী হিসেবে?
একটু চুপ করে থেকে বলল, একদিনের জন্য হলেও আমি আপনার স্ত্রী হয়েছি আর এখনও পাঁচটা বাজেনি। তবে আমি আপনাকে জোর করব না, যা হিসেবে আশির্বাদ করতে চান আমি তা নেব। শুধু একটা কথা, পাঁচটার পর থেকে যেহেতু আমি ছাত্রী আর আপনি আমার শিক্ষক আর এই সম্পর্কটাও আমার কাছে একটা বিশেষ স্মৃতি, তাই দুবার আশির্বাদ করুন আমাকে—একবার ছাত্রী হিসেবে, আরেকবার স্ত্রী হিসেবে।
বুঝলাম, অহনা আমাকে ভালোবাসে।
আমার আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সে চোখ বন্ধ করল। যেন কোনো সিনেমা।
আমি বেরিয়ে পড়লাম। গেটের ধারে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অহনা, তার চোখ ভারি শান্ত, মাথায় শাড়ির আঁচল।



দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি শুরু করছি। পৃথিবীতে ক্রমাগত দুঃখ প্রকাশের বেদনা বয়ে বেড়াবার জন্য যেন জন্ম নিয়েছি। যাইহোক, গানগুলি এখনও শুনে উঠতে পারিনি। এই কারণে নয় যে গানগুলি শুনবার ইচ্ছা আমার নেই, বরং এই কারণে যে গানগুলি শুনবার উপায় আমার নেই। কীভাবে ব্যবস্থা হবে তার চিন্তায় কালাতিপাত করছি। কাফকা অন দ্য শোর আমার মাথার ধারে জায়গা করে নিয়েছে। ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি শেষ করছি।
দুপুরে এই চিঠি এসে পৌঁছেছে। এই যুগেও আমি চিঠি পেতে ভালোবাসি। তবে চিঠি লেখার লোক অত্যাশ্চর্যভাবে কমে গেছে। এই নয় যে তারা চিঠির বিরোধী বা চিঠি লেখার পদ্ধতিকে মেনে চলতে নারাজ বরং এই যে তাদের বলবার কিছু নেই। অভিধান উপহার পেলেও এই রোগ সারবার নয়। অভিধান একটা সহায়ক উপকরণ মাত্র, কথা বলবার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে অপারগ। একজনের বিয়েতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ উপহার দিয়েছিলাম। দুঃখের সঙ্গে জানাই, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে। এই বিচ্ছেদটা ভাষাজনিত, তা বোঝাই যায়। যাকে ডিনার সেট উপহার দিয়েছি সে এখনও আমার বাড়িতে আসে। হরিচরণ এখানেই ডিনার সেটের কাছে রোজ হেরে যাচ্ছে।
আমার বাবার গলা পেলাম। দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, কে এই আশিক?
ও, তুমি চিঠি দেখেছো?
সেটুকু দেখার অধিকার এখনও আমার আছে বলেই মনে হয়, নাকি নেই?
বাবা, তুমি আশিক সম্পর্কে যেটা শুনতে পছন্দ করো সেটাই বলব নাকি যেটা বললে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকবে তেমন একটা কিছু বলে রাখব আপাতত?
তুমি সত্যিটা বলবে।
তাহলে শোনো, আশিক আমার একটা প্রকল্প। আমি ওর এক স্বপ্নের এজেন্ট। তুমি কখনও কারও স্বপ্ন ডেসপারেটলি পূরণ করার চেষ্টা করেছো বাবা?
প্রকল্প, এজেন্ট, স্বপ্ন—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দিন দিন সেই হেঁয়ালিটার মতো হয়ে উঠছো যেটার প্রস্তুতকারক স্বপ্নে পেয়েছে সেটা আর নিজেই তার উত্তর জানে না।
আচ্ছা বাবা, তুমি নতুন তিন জন বাঙালি নভেলিস্টের নাম বলতে পারবে যাদের পড়া যায়?
তোমার কি মনে হয় যে অফিসের পর আমার এতটাই সময় আর ইচ্ছা থাকে যে যা দিয়ে আমি উপন্যাস পড়তে পারি? তুমি বিত্ত দেখেছো কিন্তু আমার জার্নিটা কতটা সহৃদয় ভাবে দেখো তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমি জানি বাবা তুমি খুব স্ট্রাগল করে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছ কিন্তু তাই বলে আমি রোজ তোমার এই স্ট্রাগলটা থেকে কী পেতে পারি? তুমি নিশ্চয়ই মালাচন্দন পাওয়ার জন্য আমাকে জন্ম দাওনি। এই ভেবেও আমার জন্ম দাওনি যা ভেবে স্বর্গের অনিরুদ্ধ আর ঊষা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে লখিন্দর-বেহুলা হয়ে জন্ম নিয়েছিল।
আমার বাবা চুপ করে থাকে। তার এই চুপ করে থাকার মধ্যে বিষণ্ণতা নেই। যদিও আমি বাবার চুপ থাকা মুখটা পছন্দ করি না। বাবা নিয়মিত কথা বলবে, আমাকে বাক্যবাণে জর্জরিত করবে, পরাস্ত করবে—এটাই আমি চাই।
বললাম, বাবা তুমি আমার সব স্বপ্ন পূরণ করেছো। আর আমিও যে কারো স্বপ্ন পূরণ করতে পারি তার উপযুক্ত করে তুলেছো আর ব্যবস্থাও করেছো। কিন্তু আমি ছাড়া তুমি আর কারো একজনের স্বপ্ন পূরণ করে দেখো, আমি তোমাকে মহামানব হয়ে যেতে বলছি না। ক্যাপিটালিস্টরা যেভাবে পুঁজি জড়ো করে সেই ভাবে কিছু স্বপ্ন জড়ো করে দেখতে পারো। আমি তোমার কাছে একটা দায়িত্ব কিন্তু যে তোমার দায়িত্বাধীন নয় তাকে ভরন করে দেখই না একবার।
কী করতে হবে আমাকে? গম্ভীর ভাবে বলল বাবা।
শান্তনুর একটা ট্যাক্সি কিনে দাও না বাবা। হলুদ ট্যাক্সি। ওর স্বপ্ন ও একদিন একটা ট্যাক্সির মালিক হবে। নিজের ট্যাক্সি, নিজের মর্জি, নিজের স্বর্গ।
নিঃশব্দে বাবা চলে গেল। তার মুখ থমথম করছে।
আমি আজ একটা সিনেমা দেখব। ল্যাপটপটা অন করলাম। আজকের আবার মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অফ হেভেন দেখব। ইরানের পরিচালকরা ম্যাজিসিয়ান কিন্তু সেই দরজিটার মতো যারা শুধু একটা কাজই ভালো জানে সেটা হল অত্যাশ্চর্য সব ছবি বানানো। মাজিদ মাজিদিকে মনে হয় ইরানের সত্যজিৎ রায়। অস্কার দিয়ে কিছুই বিচার করা যায় না। বরং যারা অস্কারের দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকে তাদের ছবিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। আমার এক বন্ধু আছে যে শুধু নোবেল আর বুকার পাওয়া সাহিত্যটুকুই পড়ে। এর মানে তাকে সব সময় পথ দেখিয়ে দিতে হয়। এই দেখানো পথের
বাইরের জগৎটা তার কাছে ব্লার। বাঙালিপনা আর মধ্যবিত্তপনা এগুলো। তবে আমেরিকার মধ্যবিত্তরা কীভাবে ভাবে তা জানতে ইচ্ছা হয় খুব। দেশকাল অনুযায়ী মধ্যবিত্তদের ভাবনা কাঠামোর বদল হয় কিনা তা জানার বিষয়। আমি অশিক্ষিত, তাই জানি না। আমি যে অশিক্ষিত—এই কথা স্বীকার করি বলে লোকে আমাকে আরো বেশি করে শিক্ষিত ভাবে। এ আমার কোনো কৌশল নয়, এ নেহাতই সামাজিক মনোবিকলন।
সিনেমাটা ভিএলসিতে অন করতে যাবো, এমন সময়ে বাবা আমার ঘরে ঢুকলেন। একটা কাগজের টুকরো আমার টেবিলের উপর রেখে যেভাবে এসেছিলেন সেইভাবে বেরিয়ে গেলেন।
উঠে গিয়ে দেখি, একটা চেক।
শান্তনুর স্বপ্নটা এখন রাস্তায় দৌড়বে হলুদ সর্ষে ফুল উড়িয়ে।
গ্যারাজে এসে দেখলাম শান্তনু নেই। দারোয়ান নয়নকে জিগ্যেস করে জানলাম, সে বাড়ি চলে গেছে। তার মা মারা গেছে। একটা ছোটবোন আছে তার। সে এখন গ্রামের একটা সাইকেল গ্যারাজে মেকানিকের কাজ করবে। আর ফিরবে না।
আমি বললাম, আমাদের না জানিয়ে চলে গেল কেন?
নয়ন বলল, জানি না ম্যাডাম।
আমার বাবা একটা গল্প বলেছিল। এক দরিদ্র লোক বাজারে যায় তার বানানো মাটির পাত্র নিয়ে আর কিছু বিক্রি হয় না তাই খালি হাতে ফিরে আসে। সে খুব দুখী। দেবীরও খুব কষ্ট হল। একদিন দেবী এক থলি টাকা নিয়ে লোকটার ফেরার পথের ধারে রেখে দিল। লোকটা সেদিন কী যে হল, ভাবল, অন্ধরা কীভাবে পথ চলে? দেখা যাক, এই ভেবে সে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেল সেই টাকার থলি। দেবীর চেষ্টা ব্যর্থ হল। দেবী বুঝল, এর দারিদ্রের কোনও পরিবর্তন নেই। তবে শান্তনু শিক্ষিত, সে অপরিনামদর্শী নয়, সুবিবেচক। আর আমি কোনো মতেই দেবী নয়। আমার অন্তত চারটে হাত নেই। বরং আমার নিজেকেই এখানে ওই দরিদ্র লোকটার মতো মনে হল আর শান্তনুকে দেবী। যদিও ব্যাকরণ বলবে সে দেবী কখনই হতে পারে না। হতে হলে তাকে দেবতাই হতে হবে। আশিককে একটা আইপড পাঠাতে হবে। নইলে অন্তত একটা স্মার্ট ফোন। ভাবতে ভাবতে গ্যারাজের পাশে ছোট ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
শান্তনু যে ঘরে থাকত সেখানে গিয়ে দেখলাম দেওয়ালে কালীর ছবি, গাঁদা দেওয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি, তাতেও গাঁদা ফুলের মালা, কয়েকটা সাদা পাতা ছড়ানো, তাতে কবিতা ধরনের কিছু লাইন। তুলে রাখলাম, পরে পড়ে দেখতে হবে। তার বিছানার উপর পড়ে রয়েছে একটা ময়লা বালিশ, সেটা সে নিয়ে যায়নি, বালিশের পাশে সাদাত হসন মান্টোর রচনাসংগ্রহ। বুকমার্ক দেওয়া।


তালসারি দূরে দেখা যাচ্ছে। না, তালসারি নয়, এটা ঝাউসারি। আমরা দীঘার বোল্ডারের উপর বসে আছি। আমার কানে হেডফোন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। প্রথমে শুনবো খাঙ্গুরা, তারপর জয়তী, তারপর ইমন। আমার পাশে বসে আছেন অহল্যা, মানে যিনি আমাকে দিনের পর দিন উপন্যাস লেখার রসদ জুগিয়ে এসেছেন। মুরাকামি দিয়েছেন, রবীন্দ্রগানের লিস্ট দিয়েছেন, একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে এসেছেন এই দীঘায়। আমি কেবলই কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ছি যত তিনি তত আমাকে টলস্টয়ের গল্প বলছেন, দস্তয়েভস্কির গল্প বলছেন। আমার চেয়ে অহল্যার বয়স সামান্য বেশি। অহল্যার তার স্করপিও গাড়ি করে পোষা কুকুর রানিকেও এনেছেন।
আমরা আসব দীঘাতে—কেউ জানত না সে কথা। কিন্তু অপরূপকে আবিষ্কার করেছি আমাদের পাশের হোটেলে। সেও এসেছে তার কুকু-র পেড্রোকে নিয়ে। সবাই বাঙালির দীঘা আসাকে মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রসারিত অংশ করে দিয়েছে। বলা হয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের তিনটে বেড়ানোর জায়গা যথা দীঘা, পুরি, দার্জিলিং অর্থাৎ দীপুদা। মধ্যবিত্ত ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বাঙালি সব কিছুকে ক্যাটেগোরাইজ করতে ভালোবাসে। এরা ব্যাখ্যা দিতে জানে না, শুধু মন্তব্য করতে জানে। বলা হয়, ভাবখানি সম্প্রসারন করে নেওয়া হৌক। কেমন মন্তব্যজীবিতা? না, এরা বলবে,--যারা নচিকেতা শোনে তারা বাল বা যারা এই যুগেও মদ খায় না তাদের জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রশ্ন আছে, রোদ্দুর রায় শ্রেষ্ঠ কেননা তাকে সবাই অপছন্দ করে, রাম ছাড়া জগতে আর কোনো মদ পেয় নয়,--এই রকম আর কি। আমার মজাই লাগে। বাঙালি মাত্রেই অম্লান দত্ত সিনড্রোমে অসুস্থ।
অহল্যা আমাকে ‘আপনি’ বলতে যত নিষেধ করেন ততই আমি ‘আপনি’ বলে ফেলি। এই আপনিটা শুধুই একটা সম্মান নয়, এর মধ্যে রয়েছে অকথিত দূরত্ব আর কৃতজ্ঞতা। আমি চাই না, অহল্যা আমার দূরে, কেউ হয়ে আজীবন বেঁচে থাক। আমি চাই সে আমার সবচেয়ে কাছের, ঘনিষ্ঠতম মানুষটি হয়ে উঠুক। কিন্তু তার স্করপিও গাড়িটার কথা মনে পড়লেই আমি তাকে সমীহ করা ছাড়া অন্য উপায় খুঁজে পাই না। আমি কি সম্পদের কাছে নত? আমার মধ্যে কি বিত্তের একটা শ্রেনিবিন্যাস খুব প্রকট হয়ে গড়ে উঠেছে যেটা শত অনুরোধেও উপড়ে যাচ্ছে না? দীঘার সমুদ্রের চেয়ে সুন্দর আর কিছু আজকের আমার কাছে আর কিছু নেই।
অহল্যাকে আমার দেবার কিছু নেই। তাকে শুধু মাত্র একটা উপন্যাস দিতে পারি। সেই উপন্যাস যদি খাজা হয় তার মানে আমার উপহারটিও যথারীতি খাজা।
অহল্যা বললেন, কেউ কাউকে ভালো না বাসলে এতদূর আসতে পারে?
আমি বলি, দয়া বলেও একটা শব্দ অভিধানে আছে।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন চলছে। তার হাতে রানির গলার চেন ধরা। রানি দৌড়তে চায় কিন্তু মালকিন তাকে অনুশাসনে রেখেছে। কুকুর একটি বিলাসিতা শুধু নয়, একটা সিম্বল। কিসের সিম্বল? সবাই জানে, এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না।
অহল্যা বললেন, এই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি কেমন?
আমি বলি, খাঙ্গুরাকে আমি ভালোবাসলাম।
এইভাবে আমাদের কথোপকথন বয়ে চলেছে। এই কথোপকথনে কোনো ঢেউ নেই, দীঘার সমুদ্রের মতো। শুনেছি, পুরীর সমুদ্র যা বা যাকে নিয়ে যায় তাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায়। দীঘার সমুদ্রের এই সুনাম নেই। তবে একটা বিষয় আছে, সেটা হল, দীঘার সমুদ্র তেমন কিছু নিয়েও যায় না। যে নিয়ে যায় না কিছুই সে ফেরাবে কী?
দেখলাম, অপরূপ তার কুকুর নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওহো, তাহলে পেড্রোকে দেখেই রানির এত উত্তেজনা? যে রানি পুরুষ কুকুর সহ্য করতেই পারে না। পেড্রোও অপরূপের হাত ছাড়িয়ে রানির কাছে আসতে চাইছে। যে পেড্রো কোনো কুক্কুরীকে আজও মেনে নিতে পারেনি।
অপরূপ কাছে আসতেই রানি আর পেড্রো পরষ্পরের গা শুঁকতে লাগল। গা মানে শুধু গা নয়, গায়ের সবটা। মূলত প্রজননদ্বার। দুজনে যেন তাদের হারানো সোলমেটকে ফিরে পেয়েছে এই দীঘার সমুদ্রের ধারে। যেন বৌদ্ধ ধর্মের দুই জাতক, গত জন্মে তারা পতি-পত্নি ছিল, পাপের ফলে এই জন্মে কুকুরজীবন লাভ করেছে। মিলিত হলেই যেন তাদের ইমানসিপেসন হবে, নির্বাণলাভ হবে। তারা শূন্যে হারিয়ে যাবে।
আমি বললাম, অহল্যা, রানিকে ছেড়ে দাও। ওকে আটকে রেখো না। দেখো, তুমি বলে ফেললাম তোমাকে। ভাই অপরূপ, তুইও তোর পেড্রোকে ছেড়ে দে। ওরা সমুদ্রের আরও কাছে চলে যাক। ওদের খেলতে দে।
দুজনে হাতের চেন আলগা করল না শুধু, ছেড়ে দিল। পেড্রো আর রানি পাশাপাশি যেন হাত ধরাধরা করে এগিয়ে চলল। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। তারা আজ খেলবে। ওদের লজ্জা নেই, অথচ আমরা তিনজন কেমন লজ্জিত মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরাই শাপগ্রস্থ। আমি যেন অনিরুদ্ধ আর ঊষা যে কে তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, কাশ্মীরি চাদর বিক্রেতা সুলেমান ভাই এসেছে।
দুপুর হতে আর বেশি বাকি নেই। খানিকটা লিখলেই আমার ঘুম পেয়ে যায়।
একটা চাদর নেবে বলেছিলেন আশিক ভাই, বললেন সুলেমান।
হ্যাঁ সুলেমান ভাই, মায়ের জন্য একটা চাদর আমাকে নিতে হবে, বললাম।
সবচেয়ে উমদা চাদরটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি, এই যে দেখুন, এতে যে ফুল করা সুতো দিয়ে, ওটা আমার বেগমের করা
বেগমের কথা মনে পড়ে না সুলেমান ভাই?
আশিক ভাই, কাশ্মীরিদের মনের খবর কেউ রাখে না। আপনি জিগ্যেস করলেন, ভালো লাগলো। আপনাকে বলি, আমার ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। তাকে এক রাতে সেনারা তুলে নিয়ে চলে গেল। সে পড়াশুনোয় কত ভালো ছিল। আই এ এস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আপেলের মতো গায়ের রঙ। একবার সে আই এ এস পরীক্ষা পাসও করেছিল, ইন্টারভিউয়ে বাদ পড়ে। তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম আমারই এক আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে। সে মেয়েটি খুব সুন্দর। মেয়েটা ইংরেজি অনার্স নিয়ে কলেজে পড়ত। তার নাম সবনম। সবনম আমাদের বাড়ি আসত। আমার ভাই ফারহান যখন চেয়ারে বসে পড়ত তখন সে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকত। সবনম বাড়ি থেকে ফারহানের জন্য সুন্দর খাবার বানিয়ে আনত। যে দিন ফারহানকে তুলে নিয়ে গেল সেনারা পর দিন তার জানাযা পড়লাম।
কেন, কী হল?
আশিক ভাই, সব ভারতীয়ই এর কারণ জানে, সবাই জানে কী হল, আপনি এর পরও জানতে চাইছেন কেন?
আমাদের সমস্যা কী জানেন? আপনার ভাইয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
শুধু আমার ভাই নয় আশিক ভাই, গ্রামের পর গ্রামের ভাই। সবার ভাই। সবার। আমরা শুধু আমাদের ভাই, আর কারও ভাই নই। আমাদের জানাযায় কেউ শরিক নয়। ভূ-স্বর্গের কবরগুলো স্বর্গীয় নয় আশিক ভাই।
আপনি কবিদের মতো কথা বলছেন।
কাশ্মীরিরা সবাই কবি, শায়ের। সবার অপরিসীম যন্ত্রণা তো। টেগর কত দুঃখ পেয়েছেন সারা জীবন বলুন তো?
আপনি টেগর পড়েছেন?
টেগর পড়িনি তবে তার জীবন সম্পর্কে শুনেছি। তার অনেক আত্মীয় মারা গিয়েছে তার সামনে, আমাদের মতো। তবে আমার একটা উপকার আপনাকে করতে হবে আশিক ভাই।
কী উপকার?
এখানে আমার একটা রেশন কার্ড বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি পরিবার নিয়ে এই বাংলায় চলে আসব। কাশ্মীর মরে যাচ্ছে ভাই, ভারতবর্ষের ম্যাপের মাথাটা পচে যাচ্ছে। সবাই জানে, নাকে রুমাল দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু চিকিৎসা করবে না।
কিন্তু ভাই, আপনার রেশন কার্ড এখানে করা যাবে কীভাবে আমি তো বুঝতে পারছি না। এ সব বিষয়ে আমি ভীষণ রকম অজ্ঞ।
কোনো লিগ্যাল সমস্যা আছে?
বোধ হয়।
আমাদের সঙ্গে লিগ্যালি কী হচ্ছে ভাই, আমাদের বেঁচে থাকাটাই তো ইল-লিগ্যাল, মৃত্যুটাই বৈধ।
সুলেমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বেঁচে থাকার বেসিক সুবিধাটুকু ভোগ না করে কাশ্মীরে চলে যাই। আমিও ওদের সঙ্গে দেশ কাকে বলে বুঝি। রাষ্ট্র যে আসলে যন্ত্র তা উপলব্ধি করি। আচ্ছা, রাষ্ট্র যদি একটা যন্ত্র হয় তাহলে আমরা কী? এর নাটবল্টু? সুলেমান ভাই একটা নাট, অপরূপ একটা নাট, অতনু একটা, আমি একটা। আমাদের যদি মানসিক রোগ হয়, তাহলে রাষ্ট্রেরও মানসিক বিকার হয় নিশ্চয়ই? রাষ্ট্রেরও এসাইলাম দরকার তাহলে? আমি ইন্টেলেকচুয়াল নই, আমি বুঝি না। আমার একটা সাদা চাদর দরকার শুধু। নাগরিক হিসেবে এটুকুই বুঝি।
সাদা চাদর আজ নেই। সুলেমান ভাই পরে তার আরও যে গাঁটরিগুলো রয়েছে সেখান থেকে খুঁজে বের করে দিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে গরম পোশাকের গাঁটরি, কাপড় দিয়ে কষে বাঁধা, যেন পড়ে না যায়, সেভাবে। কিন্তু তিনি রোজ একটা দেশ থেকে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন। তার সাইকেলের আওয়াজ ধাতব নয়,--তার সাইকেল বালি পড়ার মতো শব্দ করে ঝর ঝর। আর এগিয়ে যায়। কোথায় যায় এগিয়ে? ভারতের দিকে, পাকিস্তানের দিকে, নাকি নেভারল্যাণ্ডের দিকে? জানি না।

 ৬
শীতের দিনে বৃষ্টি। আমি বৃষ্টি পছন্দ করি না। শীতের বৃষ্টি আরও খারাপ। এমন দিনে মনে হয় আমি কাউকে চাই না, কেউ আমাকে চায় না। এই মনে হওয়ার সঙ্গে যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। তাত্ত্বিক ও তার্কিকদের দেখে আমার খুবই ভয় করে। আমি জ্ঞান থেকে পালাতে চাই। অজ্ঞান হতে চাই কি? নির্জ্ঞানের দিকে যেতে চাই আমি? বলে রাখি, আমি কোথাও যেতে চাই না। শুধু একবার দীঘা যেতে চাই। আশিক কি যাবে আমার সঙ্গে? শান্তনুর কথা মনে পড়ছে। গাড়ির ড্রাইভাররা কি মালকিনদের ভালোবাসে? আজ আমার খুব ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করছে। ঋভু আমাকে ভালোবাসত। সে সব কলেজ দিনের কথা। ঋভু জানত না জীবনে সে কী করবে। সে জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আওড়ে বলত, ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে যাব। তখন আমার খুব সাংসারিক হতে ইচ্ছা করত। মনে হত, বর হবে একটা বট গাছের মতো, একটা তালগাছের মতো, যাকে দূর থেকেও দেখা যায়, যে হবে আমার লাইটহাউস। মার্টিন স্করসেসির শাটার আইল্যাণ্ড ছবিতে লাইটহাউসে মনোরোগীদের মস্তিষ্কের চিকিৎসার নামে মস্তিষ্কটাই কেটে বাদ দেওয়া হত। দেশের জন্য যারা বিপজ্জনক তাদের ওই রাষ্ট্র পরিচালিত এসাইলামে এক প্রকার বন্দি করে রাখা হত। ওটা একটা দ্বীপ। ওই দ্বীপ থেকে পালানোর একটাই মাত্র ফেরিঘাট। যেটা পাহারা দিত সেনারা। বাইরে থেকে মনে হবে ওটা একটা ভূ-স্বর্গ যেখানে ট্রিটমেন্ট চলে। সবাই ভাববে, ওটা একটা উদ্যান। উদ্যানই তো। যদিও এই উদ্যান থেকে পালাতে চাইবে ক্যাপ্রিও। সে তো সুস্থ, সে কেন থাকবে, কিন্তু সে কার কাছে সুস্থ, সুস্থতার সংজ্ঞা কী? যারা জানে, যারা অধিকার দেয় সব কিছুর, তাদের ব্যাখ্যা আলাদা। আমি এসব কিছু বুঝি না, আমার একটু ভালোবাসা দরকার।
আমার পাশে রানি এসে বসেছে। বৃষ্টিতে সে কুঁকড়ে গেছে। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। সে আমার কোলে শুয়ে পড়তে চাইছে। তারও ভালোবাসার প্রয়োজন।
ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার লং স্কার্ট ভিজে যাচ্ছে জলে। আমি ইচ্ছা করেই লং স্কার্ট পরে বেরিয়েছি। আমি চাই ভিজে যাক আমার পোশাক।
চা দোকানে দাঁড়ালাম।
রঘুদা বলল, দিদিমণি, বৃষ্টিতে কোথায় বেরিয়েছেন?
আমি বললাম, আপনার ছেলে কি ফোন করে?
ছেলে? না, মা, সে নাকি কী একটা পেয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
স্কলারশিপ পেয়েছে?
হ্যাঁ, ওই।
রঘুদার ছেলে খুব ভালো ছাত্র। খড়্গপুর থেকে আর সে ফিরল না তাহলে। ‘ভালো ছেলে’রা ফেরে না। রঘুদার ‘খারাপা ছেলে’টা রঘুদার সঙ্গে চা দোকানে থাকে।
একটা ট্যাক্সি ধরলাম। আজ আশিকের বাড়ি যাব। সে কি বাড়ি থাকবে?
দুপুরবেলা আশিকের পাড়ায় ঢুকে পড়লাম। জিগ্যেস করে খুঁজেও পেলাম আশিকের বাড়ি। খুব সাধারণ একটা বাড়ি। নীল রঙ। বাড়ির সামনে পাতাবাহার গাছ। একটা নিম গাছ। আর কিছু পালং শাক হয়ে আছে উঠোনে।
আশিকের বাড়িটা নির্জন। গেট খুলেও কাউকে দেখতে পেলাম না। ডাকব কিনা ভাবছি, তারপর মনে হল, না, যাব না। আশিকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পত্রেই সীমাবদ্ধ থাক। আমার ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিলে দূরে। আমি গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
আশিক জানবে না আমি এসেছিলাম। আমি তাকে কখনও জানাবো না। আমি একটা পাপ করেছি। পাপটা হল, কিছু জায়গায় কখনও যেতে নেই। দূর থেকে শুধু এই জায়গাটার কথা কল্পনা করতে হয়। ভাবতে হয় যে, ওটাই আমার শেষ আশ্রয়। হয়ত সেটা কোনও আশ্রয়ই নয়। তবু ভেবে ভেবে এগিয়ে যেতে হয়। অভিসারের পর কৃষ্ণের দর্শন না হলেই বরং রাধার জন্য ভালো। আমি কি রাধা? আশিক কি কৃষ্ণ? ‘একদিন আমি ওখানে যেতে চাই’—এই বাক্যটাই আমাদের সান্ত্বনা। ওই ‘একদিন’টা কখনও না এলেই ভালো। বাড়ির পথ ধরে মনে হল, আমি ভূ-স্বর্গের কাছ দিয়ে চলে এলাম। বৃষ্টিতে যে বাড়িটা ঝাপসা, যে বাড়িতে লোক আছে, তবে ধরে নেব যে কেউ ছিল না। আর ওটা আশিকের বাড়িই নয়। বৃষ্টিতেও আমার গাড়ি জ্যামে আটকে গেল।


জিয়া হক

ক্ষমাদিবস

ক্ষম মোরে,—বলতে পারি না। পাথর হয়ে উঠছি কি আমি ক্রমাগত? পাথর —সে তো নত হয়ে, বড় অবজ্ঞার ধারে ছোট অবজ্ঞা হয়ে পড়ে থাকে। তাকে আক্রমণ করা যায়, সযত্ন হাত তার নরম গায়ে রাখে কে? নরমও নয় সে হয়ত, অথচ তা তো গুঁড়ো হয়ে যায়। ধুলো ছাড়া তার স্মৃতিতে কেউই ওড়ে না। তবে কি পাথর হওয়াই খুব শ্রেয়? শ্রেয়জ্ঞান নেই বলে আমি একটি নদী হয়ে পাথরকেই দিনাতিদিন ক্ষয় করে চলি। কেউ কি বলে আমি অপরাধী? কারাকক্ষে কে বা পাঠাবে? কারাগার হত যদি দোপাটি বাগান, কারারক্ষী প্রেমপত্র লিখে থাকত যদি , কতৃপক্ষ ডাল দিত ঘন —কে আর সমাজে শুধু আটকে পড়ে থাকে, কেই বা চায় রোজ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা? আমাদের ভগবান সম্প্রদায় আপন সংসারে ব্যস্ততম লোক। পুজো চায়, আশীর্বাদ করে কদাচিৎ। এমন আশীর্বাদ স্বনামধন্য হয়ে জমা হয় দেওয়ালে ও ড্রেনে। সমিতি মন্দ নয়, যতক্ষণ শিশুভাব থাকে।
আমি কি যাব না কোনো রক্ষিতার কাছে, যে আমাকে রক্ষা করে, চা দেয়, দুগ্ধজাত পনির?


আমি আমাকেই কেন ক্ষমা করতে শিখলুম না আজও। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না মানে আমার ভুলগুলো পুনরাবৃত্ত হোক, চাই না। কিন্তু তা কি হয় কার্যত? একই ভুল করে চলেছি যা আমাকে রুগ্ন করে, অসুস্থ করে, অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলে। আমি তো রুগ্নতা চাইনি কখনও। রুগ্নতা সম্পর্কিত যাবতীয় পরিভাষা ব্যথিত করে, আহত করে। যে-হাত কৃপণ নয়, তাকে কৃপণতাকে স্বীকৃতি দেওয়া কি ঝঞ্ঝাট! আততায়ী নিজের ভেতরে বাস করে যদি, বর্ম কি কোনো কাজে আসে? বর্ম তো বহিঃশত্রুর জন্য। আমি আউজুবিল্লাহ পড়ি, অথচ শয়তান দূর হয় না। সে পুষ্টি পায় কোথা থেকে? আমিই কি তার প্রকারান্তরে পরিচর্যা করি? কীটদষ্ট কপালে বলিরেখা আশ্চর্য দেখায়। আশ্চর্য দেখায় বলে এমন কপাল ঐশী কোনো আলো পায় না যা তাকে দেবে কাঁটামুক্ত লতার মুকুট। তা নাহলে সঙ্গীত তার কাছে সুরেলা চিৎকার ছাড়া আর কীই বা মনে হবে! অথচ কে না জানে, গীতিময়তাই গতিময়তা। আমি গতিকে সময় দিয়ে বিভাজন করে গতির দরদাম করি না। এর কারণ, সময় নিজেই স্থিতিশীল নয়। দুই দৌড়বিদ পাশাপাশি দৌড়াক, তাদের প্রতিযোগিতা চাই না। আমি তো হাততালিখোর 'মব' নই, বা কোনো পিত্তল ট্রফি নেই আমার কাছে —আমি কেন আয়োজক হব এমন রেসের?  সংগঠক হতে আমার অনীহা। কর্মী হতে পারি। নেতৃত্বের ইতিহাস আমাকে বিমর্ষ করে। যেহেতু লবণ খাওয়ার আগে দেখে নিতে চাই লবণের মালিকানা কার —তার দাবি ও দাওয়া, শর্তরাশি, চোখ। এমন লোকের জন্য লবণহ্রদ আছে, লবণ কিন্তু নেই।

জিয়া হক 

আরও দুটি পদ্য


যীশুর একদিন
.....................
পুরনো পুরনো সব লোক
বলে যায় অতীতের দিন
সাগরের ঢেউয়ে ছিল ব্যথা
খ্রিস্ট প্রাচীন

সাগরের ধারে ছিল গ্রাম
কৃষিকাজ মাছ ধরা পেশা
সবার পাপের ভার কাঁধে
বয়েছে হামেশা

পাপের বস্তা নয় বড়
রাস্তাও ছায়াযুক্ত পাকা
দিন যায় দিবসের শেষে
পলাতক চাকা

দিন থেকে খসে পড়ি আমি
কদলীতলার নীল বনে
সাগরীয় পাপ যত ভাসে
আমি কি করিনে?




এই দিল, মুশকিল
........................
নুয়ে পড়া লুব্ধ প্রেমকথা
ফল নাই পাতা নেই ফুটেছে অযথা
ঘোরে যত চতুষ্পদ প্রাণী
           ভাদ্র মাসে প্রেম হয় জানি

আর হয় নদী উপকূলে
বিপুল কাঁদছে বসে আরেক বিপুলে

সেই জল দেবীদের পায়ে
ফুটে ওঠে ছোটো পাত্রে
                         চালাঘরে চায়ে
খরিদ্দার আসে
বিপুলের কান্না ভালোবাসে

কোথাকার জল তারা জানে?
কোন কাব্য মেয়ে হয়ে বসেছে আখ্যানে?

পান করা হোক
বলে সব প্রস্তাবিত লোক

ভোজনের হাড়মাংসগুলি
শব্দ হয়ে বাক্য হয়ে ছড়ায় অঙ্গুলি

কে না জানে সব
প্রেম হল যৌনদেশে নম্র কলরব

জিয়া হক


দুটি পদ্য

আমাদের বাড়ি সরিষায়
..................................
আমি আমার ব্যক্তিগত ভুলে যাই
একটি কাঠ, তুমি কীভাবে থাকো অর্বাচীন?
সব ধুয়ে যায় —ধৌত হয় মহান
মহানের ধুলোবালি বেরিয়ে পড়ে
পুজো হয় পার্বনের মতো, —ধুতি পরা কিশোর দেবতা
নগর ভিক্ষুকেরা ছবি তোলে, তোলে কন্যা
সিটি বাজার সিটি বাজানোর বয়স পেরিয়ে যায়
এক শালপাত্র ভালোবাসা নেবে? কেউ বলে ঘেউঘেউ করে
ছলনার দোকান বন্ধ হয়? হয় না কখনও
কে নয় বাচিক শিল্পী, কার গায়ে কাঁটা নেই?
বাগান কি টবের দুঃখ বোঝে?
                               গান কি গায়কের পাকস্থলী জানে?
মুদ্রার ভাষাজ্ঞান পকেটের আছে? ফ্রিজ ঠান্ডা রাখে সব
সকলেই জানে আমাদের পংক্তিভোজে ভূত খেতে বসে
আমি কি ভূত হইনি, হওনি কি তুমি?
প্রকৃত ভূতেরা তবে গোপনাঙ্গ পরীক্ষা করে না,
গণহত্যা নেই : বসবাস সরিষায় নয়
         

জ্ঞানদাস একা
....................
শয্যাশায়ীদের খাট ভেঙে গেছে : ভেঙে গেছে গলা
তাই রাস্তাচলা
মাছের মতোন কোনো দ্বীপে
উঠবে কি উঠবে না —নিজেরই সিদ্ধান্ত কোনো ছিপে

কে তাহাকে প্রতারণা, কে বা তাকে খাদ্য জ্ঞান করে
মাননীয় চেয়ারের স্তরে
জ্ঞান হলে বুক খাওয়া ছাড়া
অন্যের বুকে তাকে দুই কামরা ভাড়া—
নিতে হয় নানা প্রয়োজনে
যেহেতু সে বেঁচে আছে অবহেলা করুণ মৈথুনে

শয্যাখানি পাতা আছে দূর
সেবাদাসী পাওয়া যায়, আসে না বন্ধুর
কোনো চিঠি
ইতি


জিয়া হক

ইসলামপুর

  
বন্দুকটা নামাও, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই : শাহবাজ বলল।


বন্দুক নামাতে পারব না, বন্দুক ছাড়া আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই : সিদ্দিকী প্রত্যাখ্যান করল।

এই কথা বলেই সে গুলি চালিয়ে দিল। গুলিটা গিয়ে লাগলো শাহবাজের বুকের বাম দিকে। তার বুক পকেটে একটা একশ টাকার নোট ছিল। নোটটা রক্তে ভিজে গেল। ওখানেই মারা গেল শাহবাজ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল সিদ্দিকীর। জেলে সে খুব নম্র আচরণ করত সহবন্দিদের সঙ্গে। সবাই জানত, সিদ্দিকী খুনের আসামী। এখানে অধিকাংশই খুনের আসামী।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে গেল সিদ্দিকী। সে জেলে বসেই ভেবে নিয়েছিল প্রথমে কোথায় তাকে যেতে হবে। জেলে সময়ের অভাব নেই।
জেল থেকে বেরিয়ে সে শাহবাজের বাড়ি এলো। শাহবাজের দুটো ছোট মেয়ে আর বৌ। বিয়ের প্রস্তাব দিল শাহবাজের বৌকে। মেয়েটা রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করে অন্য একটা শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করল। ছোট দুই মেয়ে তাদের সঙ্গেই আছে।
একটা কাঠ চেরাইয়ের কারখানায় যোগ দিল সিদ্দিকী। উপার্জন বেশি নয়, তবে তা দিয়ে তাদের চলে যেত। ছোট মেয়েদুটোকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তারা বিনুনি করে স্কুলে যায়। নতুন বাবাকে তারা মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। তবে এই লোকটাই যে তাদের বাবার খুনী তা তারা জানত না। তাদের মা কখনও বলেনি।
শাহবাজের একটি ছোট ভাই ছিল। মেধাবী ছাত্র, কিন্তু দাদা খুন হয়ে যাবার পর তার পড়াশুনা আর হল না। সে সব সময় খুঁজে বেড়ায় তার দাদার খুনীকে। একটা মস্তানবাহিনীর সে এখন সক্রিয় সদস্য।
সিদ্দিকীকে একদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। রাতে বাড়ি এলো না। তার বদলে বাড়ি এলো শাহবাজের ছোট ভাই। ভাবীকে বলল, জিনিসপত্র গোছাও, আমরা দেশে ফিরে যাব।
শাহবাজ-সিদ্দিকীর বৌ দেবরের কথা মতো সব বাঁধাছাদা করে রাতের অন্ধকারে দুই মেয়ের হাত ধরে দেবরের সঙ্গে পথে নামলো। মেয়েদুটো শুধু জিগেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তাদের মা বলল, জানি না।
শাহবাজের ছোট ভাইয়ের নাম শাহনওয়াজ। শাহনওয়াজ ভাবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। দেবরের প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করল। শাহনওয়াজের মা বৌকে তেমন সহ্য করতে পারে না। ঝগড়া লেগেই থাকে। ছোট মেয়েদুটোকে আবার স্কুলে ভর্তি করা হল। তারা বিনুনি নিজেরা বাঁধতে শিখে গেছে।
শাহবাজ - সিদ্দিকী - শাহনওয়াজের বৌ জরির কাজ করতে শুরু করে একটা কারখানায়। একজনের সঙ্গে আলাপ হল তার কারখানায়। শাহনওয়াজের আয় নেই বললেই চলে। সে কিছু করে না। বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। সে একটা সন্তান নিতে চেয়েছিল, তার বৌ রাজি হয়নি। রোজ ঝগড়া হয় তাদের। মেয়েদুটো দুলে দুলে ছড়া মুখস্থ করে। এতে শাহনওয়াজ আরো রেগে যায়।
জরির কাজ করে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করে ফেলে বৌটা। আরও কয়েক বছর কাজ করে এক নাগাড়ে। তারপর এক রাতে শাহনওয়াজকে খুন করে দুই মেয়েকে নিয়ে সেই বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেল দূরের এক শহরে। এখানে কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। তবে ইতিমধ্যে, শাহনওয়াজকে একটা বাচ্চা উপহার দিতে হয়েছে তাকে। তার এখন দুই মেয়ে এক ছেলে।
ছেলের নাম রেখেছে শাহরিয়ার।
অনেক অনেক বছর পরের কথা। শাহরিয়ার আঠারো বছরের যুবক। ভীষণ রাগি আর জেদি। খুনী রক্ত বইছে তার শিরায়। কীভাবে সে জানতে পেরে যায় যে, তার বাবাকে খুন করেছে তার মা। আর তার যে দুই দিদি তারা তার বড় কাকার মেয়ে। সে নিজের মাকে খুন করে। দুই দিদিকে এক দালালের হাতে তুলে দেয়। কোনো টাকা নেয় না।
পুলিশ অফিসার (থানার মেজবাবু) শোনাচ্ছিলেন এই সব কাহিনি। এই অব্দি বলার পর সিগারেট ধরালেন। দৃষ্টি উদাস।
আমি বলি, একটা পরিবারই তো পুরো শেষ হয়ে গেল! কী লাভ হল!
তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনার দাদা যদি খুন হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?
আমি চুপ করে রইলুম। একটা গান্ধীবাদী উত্তর দেব কিনা ভাবছি, তখন আমার মনে হল আমি কিন্তু সত্য গোপন করছি, যা করতে চাই তা না বলা মানে শুধু ফেক করা না, আমি কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেই পারলাম না, যা করার অর্থাৎ প্রতিশোধ নেবই, শুধু আপাতত ভালো মানুষ সেজে মিথ্যে কথা বলব, এই তো!
মেজবাবুকে বললাম, পরে একদিন এর উত্তর দেব আপনাকে, আজ যাই।
তার মানে আপনিও সহজ সরল কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, তাই তো? তিনি ঘড়ঘড় করে হাসলেন।
আমি উত্তর না দিয়ে শুধু জিগেস করলাম, সেই বন্ধুটার কী হল?
মেজবাবু বললেন, চা খান একটু, বলছি।
তিনি আমাকে বসিয়ে রাখলেন। এটা তার মজা। পুলিশদের কাছে কত রকম গল্প থাকে। যে গল্পগুলো শুনলে আমাদের রক্ত শুকিয়ে যায়, সেই গল্পগুলোও তাদের কাছে মজাই। এ তাদের ডেইলি জব। এখান থেকে তাদের উপরি আয়। সেদিক থেকেও তা মজার।
একজন ঢ্যাঙা কালো মতো লোক ঘরে ঢুকলেন চা নিয়ে। পরনে লুঙ্গি, চেক শার্ট, চুল পাকানো। বাম হাতটাতে একটু অসুবিধা আছে বলে মনে হল।
মেজবাবু বললেন, শাহজাদা, বসো ।
সে লোকটা মেঝেতেই বসে পড়ল। দেখে বোঝা যায় এভাবেই বসতে সে অভ্যস্ত। লুঙ্গিটা জড়িয়েমড়িয়ে দুই পায়ের মাঝখানে গুঁজে নিল ডান হাত দিয়েই। তার বাম হাত বিশেষ কাজ করে না।
আমি ইশারায় মেজবাবুকে বলতে চাইলাম, ইনি কে?
তিনিও ইশারায় বলতে চাইলেন, বসোই না।
বলো শাহজাদা, তোমার গল্প বলো : মেজবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন।
একজন কনস্টেবল দরজার বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করছে দেখে মেজাজ চড়িয়ে মেজবাবু বললেন, এখন লকাপে পুরে রাখো, রাতে কথা বলব।
মিনমিন করে কনস্টেবল বললেন, স্যার, মেয়ে কেস।
মেয়ে কেস! ভাবনায় পড়লেন মেজবাবু : রেপ-টেপ নাকি?
না স্যার, বৌকে পিটিয়েছে : কনস্টেবল বললেন।
ধুর শালা, আটকে রাখ —আটকে রাখ, পারলে দুটো রুল বাড়ির গুঁতো দিয়ে রাখ। শালা, প্রেম করবে, বিয়ে করবে, ছানাপোনা নেবে মৌজ করে, তখন কে আটকায়, তারপর বৌ পেটাবে, মেরে আগে মুতিয়ে দে, তারপর দেখছি। মেজবাবু থামলেন।
তাঁর উগ্র মুখ মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত : তো, শাহজাদা, বল তোর গল্প বল।
মেজবাবুর মেজাজ তিরিক্ষি দেখে জড়সড় হয়ে বসল শাহজাদা। তার চোখ বড় বড়। খুব রোগা শরীরে এত বড় চোখ মানায় না। সে বলতে শুরু করল :
সে পরের বৌ, আমি জানতাম। একই পাড়ায় থাকি। সবাই সব জানে, এ তো আর শহর নয়। আমার সঙ্গে জরির কারখানায় কাজ করতে আসত। ওর নাম ছিল মরিয়ম। মরিয়মের দুই মেয়ে, এক ছেলে। কাজ করত ঠিকই, কিন্তু সব সময় মন মরা থাকত। আমি একদিন যেচে আলাপ করি। ও একটাই ছাপা শাড়ি পরে রোজ আসত। পরা বলে না তাকে, জড়ানো বলে।
আমি একদিন একটা শাড়ি কিনে তাকে উপহার দিতে গেলে সে নিতে চায় না। বলে, বাড়িতে স্বামী - শাশুড়ি আছে। আমি বুঝতে পারি, শাড়িটা সে নিতে চায় কিন্তু ভয় পাচ্ছে। সে আমাকে জিগেস করে, কেন তাকে শাড়িটা দিতে চাই।
ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এটা না কোনো দয়া আর না কোনো ভালোবাসা —এটা উপহার, —শুধু উপহার।
ইতিমধ্যে কনস্টেবলটা আবার দরজার ফাঁকে মুখ বাড়ায় : স্যার, গৌতমবাবু এসেছেন।
সে কি গৌতমবাবু! কখন এলেন! চা দিয়েছিস? আসছি আসছি : বলে প্রায় দৌড় লাগালেন মেজবাবু। বললেন, একটু বসুন, আসছি।
ঘরের মধ্যে বসে আছি আমি আর শাহজাদা। সে-ই বলল, নিশ্চয়ই বখরা দিতে এসেছে।
আমি জিগেস করলাম, কে এই গৌতমবাবু? বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে।
কেউকেটা! হ্যাঁ, কেউকেটাই! শালা তোলাবাজ, সে আবার বাবু, ওফ্! খাতির দেখলে পোঁয়া চুলকোয়। কে যে পুলিশ বাল বোঝাও যায় না মাঝে মাঝে।
আমি চুপ করে যাই। কে এই শাহজাদা, কী তার গল্প, আমাকেই বা শোনানো হচ্ছে কেন তা না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। চুপ করে গালে হাত দিয়ে সিলিং ফ্যানের গড়িমসি করে ঘোরা দেখি। শাহজাদা বগল চুলকোচ্ছে।
প্রায় দশ মিনিট পরে ফিরে এসে নিজের টেবিলের সামনে এসে বসলেন মেজবাবু। তার মুখ খুশি খুশি। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। বেশ লম্বা সিগারেট। দামী।
খোশমেজাজে বললেন, তো শাহজাদা, আবার শুরু করো তোমার গপ্পো।
মেজাজ ভালো থাকলে তুই হয়ে যায় তুমি। এই যেমন এখন হল আর কি। মেজবাবুই একদিন বলছিলেন, মেজাজ ভালো থাকলে লকাপে ডিমভাজিও দেওয়া হয়। প্রশাসন মেজাজে চলে।
গপ্পো শুরু করার আগে বলে নিই, আপনার উত্তরটা কিন্তু এখনও পাইনি : আমার দিকে লক্ষ করে বললেন : তাড়াহুড়ো নেই, তবে ভেবে চিন্তে দিলে কিন্তু হবে না, আমি তাৎক্ষণিক ইন্সটিঙ্ক্টটা জানতে চাই, যাইহোক, বলো শাহজাদা।
আরও কয়েক মাস পরে বৌটা বলল, আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে? আমার দুটো মেয়ে আর একটা ছেলেও আছে, পারবে? শাহজাদা বলতে শুরু করল : আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলাম এই প্রস্তাবে। কোথায় নিয়ে যাব তাকে, তার পরিবার আছে, তারা ভীষণ খুনে প্রকৃতির, আমাকে মেরেই ফেলবে। এ কীভাবে সম্ভব!
তারপরও বললাম, যাবো, কোথায় যেতে চাও বলো?
তাকে দেখলে যে কারও মায়া হবে স্যার। এরকম জীবন সে পেল কেন, আমি তাই নিয়ে ভাবতাম। আল্লাহ কি চান আমি তার জন্যে একটু সুখের বন্দোবস্ত করি? কিন্তু আমার সামর্থ্য কতটুকু!  ক্ষমতাই বা কী!  জানতাম, তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানে আমার মৃত্যু। ওর বর ঠিক খুঁজে বের করে আমাকে খুন করবে কারণ এর আগেও সে খুন করেছে। কিন্তু লাশ খুঁজে মেলেনি বলে তার শাস্তি হয়নি।
বৌটাকে আবারও জিগেস করলাম, কোথায় যেতে চাও বলো? কোনো অচেনা শহরে?
সে বলল, ইসলামপুর।
ইসলামপুর! ইসলামপুর কেন? আগে কি ওখানে গিয়েছিলে? আমি জানতে চাই।
সে শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে বলে, না।
তাহলে অন্য কোনো শহরে চলো যাই : তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শেষে বলি, আচ্ছা ঠিক আছে, ইসলামপুরেই চলো।
ইসলামপুরে এসে দেখি ছোট মেয়েদুটো তাদের খেলার সঙ্গী পেয়ে গেছে। কত দিন পর যেন তাদের সঙ্গে দেখা। মরিয়মকেও অনেকে চিনতে পারছে। আমি একটু অবাকই হলাম। ও কি আগে এখানে এসেছে! এত জানপেহচান হল কেমন করে! আমি কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। তবে সন্দেহটা গেল না।
একদিন মেয়েদুটোকে জিগেস করে সব জানতে পারি। এই শহরে তারা আগে কয়েক মাস ছিল। ঘটনাচক্রে, যে পাড়ায় আমরা উঠেছি সেই পাড়ায়। তারপর যা শুনলাম তাতে আমার ভয় গলায় উঠে এলো।
মেজবাবু শাহজাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাকি গপ্পো পরে, আগে চা নিয়ে আয়, আর পারা যাচ্ছে না। এক গল্প এতবার বলবার পরও এত এনার্জি কোত্থেকে পাস বল তো? যা ভালো করে দু কাপ চা নিয়ে আয়।
শাহজাদা মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল চা আনতে। মেজবাবু আমার দিকে তাকালেন। জানি, তিনি সেই প্রশ্নটি করবেন —করলেনও। আমি হলে কী করতাম —প্রতিশোধ, না ক্ষমা?
আমি এবার বললাম, এখনই যদি জানতে চান আর এখনই যদি আমাকে উত্তর দিতে হয় তাহলে বলব ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না, আমি প্রতিশোধ নিতাম।
মেজবাবু শুধু মুচকি হাসলেন। তিনি কি এই উত্তরটাই চাইছিলেন? আমি যে কপটতা করিনি তাতে কি তিনি খুশি হয়েছেন? নাকি আমাকেই অপরাধী ভাবতে শুরু করেছেন —কে জানে!
চা নিয়ে ঢুকতেই শাহজাদাকে মেজবাবু বললেন, মেঝেতে নয়, তুই এই ভদ্রলোকের পাশের চেয়ারটাতে বস, তারপর বল বাকি ঘটনা।
শাহজাদা ইতস্তত করছে দেখে ধমক দিলেন মেজবাবু। সে উপায়ান্তর না দেখে আমার পাশের চেয়ারে আড়ষ্ঠ হয়ে বসে শুরু করল তার গল্প :
মেয়েদুটোর কাছে জানতে পারি আগে যে লোকটার সঙ্গে এই পাড়ায় তারা এসেছিল তার নাম সিদ্দিকী। সিদ্দিকী ভালোবাসতো তাদের। তাদের মাকেও সে ভালোবাসতো। তাদের স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিন সব গোলমাল হয়ে যায়। তাদের নতুন বাবা আর ফিরে আসে না। তার বদলে বাড়িতে হাজির হয় তাদের কাকা। তার নাম শাহনওয়াজ। এবং তাদেরকে জোর করে দেশের বাড়িতে নিয়ে চলে যায়।
রাতে কাজ থেকে ভয় ভয় করে বাড়িতে ফিরি। মরিয়ম তা যেন দেখে না।
মরিয়মকে একদিন বললাম : আমি সব জেনে গেছি।
সে নির্বিকার ভাবে বলল : কী জেনে গেছো? জানার আছেটা কী যা তুমি জানো না।
আমি সবটা জেনে গেছি। সবটা আমার খুব ভয় করছে : বলি।
মরিয়ম যেমন কষ্ট সহ্য করতে পারে, তেমনই কষ্ট দিতেও পারে। সে আমার কথায় পাত্তা দেয় না। আমাকে টেনে বিছানার মধ্যে নিয়ে যায়। সব কথা এখানে শেষ।
অনেক বছর আমরা ওই শহরে কাটালাম। আমাদের ছেলে শাহরিয়ার বড় হয়ে উঠল। সব বেশ থিতিয়ে এসেছে। শাহরিয়ার খুব মেধাবী, বাধ্য। স্কলারশিপ পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করল। আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলাম।
হঠাৎ একদিন রাতে শাহরিয়ার বাড়ি ফিরে মাকে মারতে আরম্ভ করল। আমি বাধা দেওয়ায় আমার বাম হাতে পড়ল শক্ত লাঠি। সেই থেকে আমার বাম হাত নষ্ট হয়ে গেল। মরিয়মকে পিটিয়ে মেরেই ফেলল ছেলেটা। আমি পালিয়ে গেলাম সেই রাতেই। পরে শুনলাম, বোন দুটোকে দালালের হাতে তুলে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ থেমে শাহজাদা বলল, মরিয়মকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি বলে উঠলাম : ও, আপনিই তাহলে জরির কারখানার সেই লোক?
এবার মেজবাবু বললেন, বাকিটা আমি বলি। শাহজাদা এর পর মস্তান দলে যোগ দেয়। ওর কাছে সব সময় তখন পিস্তল থাকত। আমিই ওকে সেই নোংরা ডেরা থেকে তুলে এনে থানার মধ্যে একটা চা দোকান করে দিই। তারপর থেকে ও এখানেই আছে। কিন্তু ওর দোকান খুঁজলে এখনও একটা আধটা পিস্তল আপনি পাবেন। কী শাহজাদা, ঠিক বলছি কিনা?
শাহজাদা চোখ নীচু করে টেবিলের উপর ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের ছায়া দেখে।
এইবার আসল কথা বলি, বলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন মেজবাবু : আপনি কি জানেন শাহরিয়ার এখন কোথায়? আপনার জানার কথাও নয়। শাহরিয়ার এখন এই শহরেই থাকে। এবার আমি শাহজাদাকে একটা প্রশ্ন করব। আচ্ছা, শাহজাদা, তুমি কি শাহরিয়ারকে ক্ষমা করে দিয়েছো, না প্রতিশোধ নিতে চাও?
শাহজাদা বেশ দৃঢ় ভাবে বলল : আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
মেজবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যেন অনেক জটিল কোনো বিষয়ের মীমাংসা করে দিয়েছেন এবং আমাদের মনস্তত্ত্বের অমীমাংসিত কোনো বিষয়কে উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন সাবলীল ভাবে।

আমি বললাম : শাহজাদা, তুমি যদি বন্দুকটা ফেলে দাও, তাহলে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি।

সে বেশ কেঠো গলায় বলল : বন্দুক ছাড়া আমার আর বিশ্বস্ত বন্ধু নেই, কেউ হবেও না, আমাকে ক্ষমা করবেন।

শাহজাদা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল : স্যার, যাই তাহলে?

বেশ তৃপ্তি নিয়ে মেজবাবু বললেন : এসো।
দরজা অব্দি গিয়ে ফের ফিরে এলো শাহজাদা নামের লোকটা। তারপর ইতস্তত করে বলল : একটা প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাচ্ছি না স্যার, জিজ্ঞেস করব?
মেজবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন : কী প্রশ্ন?
—মরিয়ম সব জেনেশুনে কেন আমাকে ইসলামপুরেই নিয়ে গিয়ে উঠল?
এই প্রশ্ন শুনে দারোগা সাহেব একেবারে থমথমে হয়ে গেলেন। মনোবিদ্যার সব অধ্যায়গুলো আবার যেন তিনি শুরু থেকে পড়তে শুরু করেছেন।


জিয়া হক

ইবলিশ


...........
আমি কামিয়াবি বলতে মনে করি জান্নাত। রোজ যে আমি গুনাহ থেকে পানাহ চাই, সে কি এই জন্য নয় যে আমার কাছে কামিয়াব সে যে জান্নাতি। আমি সংসার করব না বলছি না একবারও, কিন্তু সংসারের দাসত্ব আমি করতে পারব না।

মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনার যেখানে পায়রাদের বাসা সেই বাসায় জমানো দানা মুখে নিয়ে এক ঝাঁক পায়রা উড়ল পশ্চিম আকাশে। এবার মগরিবের আজান হবে। মসজিদে আসার এই ডাক আগে মাইকে হত না। তখন তো মাইক ছিল না। যখন গাড়ি তৈরি হয়নি মানুষ পশুর পিঠে চেপেছে, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে মাইলের পর মাইল। মুয়াজ্জেন গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই।

ওজুখানা বলতে একটা মোটা পুরু দেয়াল। তার একদিকে মেয়েরা ওজু করে, অন্যদিকে ছেলেরা ওজু করে। দেয়ালটা এত উঁচু যে কেউ কারো মুখ দেখতে পাবে না। তবে জল পড়ার শব্দ, কাচের চুড়ির শব্দ শোনা যায়। মেয়েরাও নিশ্চয়ই ছেলেদের ওজুর শব্দ শোনে। ওজুর জল যেভাবে পাথরের উপর পড়ে তাতে একটা সঙ্গীত আছে। এই সঙ্গীত ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মগরিবের আজান শেষ হয়। আজান শেষ হলে তার জবাবে একটা দোয়া পাঠ করতে হয়। ঢাকা শহরের যে আজান রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় সেখানে আজানের পরে পরে মুয়াজ্জেন দোয়াটাও মাইকেই পড়ে দেন। মিশরের ক্বারী বাসিতের আজান যেন একটানা কান্না, যেন সামনে বড় বিপদ, যেন আজই এই মুহূর্তটুকুই আমাদের কাছে অবশিষ্ট আছে তারপর পৃথিবী ফানাহ। নামাজ একটা অনুষ্ঠান আর তার আহ্বায়ক হল যে আজান দেয়।

এই শহরের মহিলারা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে। তাদের জন্য আলাদা ঘর, ঠিক পাশের ঘরটা পুরুষদের। মেয়েদের ওদিক থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মসজিদটা আর সব মসজিদের মতোই খুব নিস্তব্ধ। শুধু নামাজের ওয়াক্তে একটা সংযত পরিশীলিত মেলার সুর ওঠে। ইমামের ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বাজে। জানালাগুলো নীল। গাঢ় নীল।

সবুজ আলখাল্লা পরা মেয়েটা ফটকের ওধারে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে মুখ পরিষ্কার দেখা যায় না। সবাই নামাজ পড়ে চলে গেছে। জোহরের নামাজের পর খাবার তাকাযা থাকে। মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা আগে নামাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায়। কাজ থাকে। তারা নামাজে ফাঁকি দেয় তা কিন্তু নয়, তারা আসলে মসজিদকে কলতলা মনে করে না। ছেলেরা মসজিদে নামাজের আগে পরে যেটুকু সময় থাকে আড্ডা দিয়ে নেয়।

আমি তসবিহ গুনছিলাম। আঙুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের দানা। এই তসবিহটা খোদ সৌদি আরবের। একজন উপহার দিয়েছিলেন। আর দিয়েছিলেন এক শিশি আরবি আতর। সেটা কথা নয়, আমার মনে হচ্ছিল গোটা মসজিদগৃহে আমি আর মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই।

পর পর কয়েকদিন দেখলাম জোহরের নামাজের পরে মেয়েটা ফটকের লোহার শলাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না তা আমি জেনে গেছি। এই কয়দিনে আমি কাউকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার সঙ্গে যেতে দেখিনি। সে পুরুষদের মসজিদ কক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মাথা নীচু করে চলে যায়। আমি সেদিকে মাঝে মাঝে তাকাই আর তসবিহ গুণে যাই। যখন সুবহানআল্লাহ বলি তখন আল্লাহর উদ্দেশে বলি নাকি মেয়েটার সূদুর অস্তিত্বের সৌন্দর্যের জন্য বলি তা মনে থাকে না। মেয়েটা রোজ সবুজ আলখাল্লা পরে আসে।

আমি বললাম, আসসালাম আলাইকুম। একজন পুরুষ একজন অপরিচিত মহিলাকে সালাম দিতে পারে, হাত ধরতে পারে না।
সে চুপ করে রইলো। এতে সংকোচ কিসের! সালাম মানে কিন্তু আলাপ করার প্রস্তাবও নয় সব সময়। পিপীলিকার মতো এক ধরনের মৌখিক কানেক্টিভিটি শুধু। এতে আলাদা করে কোনো আবেগ বা ব্যক্তিগত অনুভূতি মেশানো নেই।
আরেকবার সালাম দেওয়ার পর মেয়েটা সলজ্জ ভাবে বলল, ওয়া আলাইকুম সালাম।
এতে লজ্জা পাবার কী আছে!
মেয়েটার বয়স বেশি নয় —একুশ বাইশ হবে। সুন্দর চেহারা। মুখে নাকাব নেই বলে পুরো মুখটাই দেখা যায়। চোখ রাঙানো। কালো কাজল সেই চোখে। ওজুর জলেও যা ধুয়ে যায় না।
তোমাকে এখানে রোজ জোহরের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আমি বলি।
হ্যাঁ, আমি রোজ জোহরের পর এখানে এই একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, সে বলে।

দূর থেকে মসজিদকে দেখতে খুব ভালো লাগে, তাই না?

সত্যি, মসজিদের ভেতর আর বাইরেটা কত আলাদা।

তার প্রাথমিক জড়তাটুকু কেটে গেছে। সালাম অনেক সময় অনেক কাজ সহজ করে দেয়।

আমি আবার বলি, তুমি কি শুধু, মানে শুধুই মসজিদকে দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকো?

সে বলল, অপেক্ষা করি।

কার অপেক্ষা?

ফেরেশতা আসে এই সময়ে। অধিকাংশ লোকেরই ধৈর্য্য নেই।

ঠিক, আমাদের ধৈর্য খুব কম।

আমি দেখেছি, যেখানেই যাই, খালি চলে যেতে পারলে, ফিরে আসতে পারলে যেন বাঁচি।

আমরা আমাদের বাড়িকে বেশি ভালোবাসি কিনা।

তাহলে মৃত্যুর পর কী হবে?

মেয়েটার লাবণ্য আছে তবে সেই লাবণ্য বড় বিষন্ন। আর এই মৃত্যুর কথা বলায় তার মুখের সাদা চামড়ার ওপরে যেন একটা মৃত পর্দার নাকাব চাপিয়ে দিল। যতটুকু পরিচয় হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি না, আজই, এখনই প্রথম দেখছি।

মেয়েটা চলে গেল মাথা নীচু করে। তার সবুজ আলখাল্লা বাতাসে পায়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে পাল তোলা নৌকার মতো তাকে গতিবেগ দিল যেন।

ছয় দিন পর ইমাম সাহেব বললেন, আপনি নাকি মসজিদের ভেতরে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন?

এই ছয় দিন রোজ দুপুরে জোহরের নামাজের পর মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেছি। মেয়েটা ফটকের ওধারে, আমি এ ধারে। একদিন তার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তার আঙুলগুলো করমর্দনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে যেন। সংযত করেছি নিজেকে। কেরামান - কাতিবিন আমার দুই কাঁধে বসে নেকি-বদীর তালিকা তৈরি করছে তো।

যদি মসজিদে এসে নিজের নফস, খাহেশাতকে সংযত করতে না পারেন তো কী হবে বলুন তো? ইমাম।

একটা সত্যি কথা বলব ইমাম সাহেব? নফস চাইছে ওর সঙ্গে শুয়ে পড়তে, কিন্তু,— কিন্তু দেখুন আমাকে কি ওর সঙ্গে শুতে দেখেছেন? সংযম আছে বলেই তো শুধু কথাটুকু বলি।

সেটাও না করাই উত্তম, বলে ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি জোহরের নামাজ শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলুম। এই ইমামকে আমার তেমন সহ্য হয় না। যদিও ইমামদের ভুল-ত্রুটি ধরা আমার মতো সাধারণ মানুষদের কাজ নয়। আলেম, উলেমারা আকাশের নক্ষত্র না হোক, উপগ্রহ তো বটে। এখন অমাবস্যা চলছে।

সুন্দর রোদ ঢেকে দিয়েছে মসজিদের মিনারগুলো। একটা দুটো পায়রা উড়ছে মিনারের ধারে ধারে। পুরনো গান ভেসে আসছে পাশের কোনো মহল্লা থেকে। সেই গান ছুঁয়ে যাচ্ছে মসজিদের সামনের ছোট একটুখানি জায়গায় চাষ করা ফুলের বাগানকে। পাতা, ফুল, কান্ড সব হালকা হাওয়া আর গানের ধাক্কায় দুলছে মৃদুমন্দ ভাবে।

মেয়েটাকে জিগেস করলাম : পেলে তোমার হারিয়ে যাওয়া ফেরেশতাকে?

সে ইতস্তত করে জবাব দিল : হারানো ফেরেশতা? কিন্তু আমার ফেরেশতা তো হারিয়ে যায়নি, আমি তাকে খুঁজছি মানে সে হারিয়ে গেছে তা নয়, হয়ত আমিই হারিয়ে গেছি আর সে প্রতিটা মসজিদের ফটকের সামনে জোহরের নামাজের পর আমার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে।

হ্যাঁ, কে যে হারিয়ে গেছে তা বলা মুশকিল, তবে কেউ একজন সন্ধান করছে মানে কেউ একজন হারিয়ে গেছে, হয়ত লুকিয়ে আছে : আমি বলি।

লুকিয়ে আছে? হবে হয়ত : ঈষৎ সন্দিগ্ধ ভাবে সে মাথা নেড়ে বলল। কাঁধ ঝাঁকালো।

আমি জিগেস করি : তুমি ফেরেশতাকে পেতে চাও, তাই তো, এতে কোনো ভুল নেই, আচ্ছা, ফেরেশতাকে পেলে তুমি কী করবে?

আমি শুধু তাকে পেতে চাই, পেলে কী করব এখনও ভেবে দেখিনি, হয়ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, হয়ত বলতে পারি আমাকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে চলো : খুব উদাসীন মুখ করে মেয়েটা বলল।

বেশ কয়েকদিন কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা কেন বারবার মৃত্যুর কথা বলে, সে কেন এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায়। তার আসলে পৃথিবীতে কেউ নেই আব্বা ছাড়া। তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না। তার ওজুর জলও মেয়েটাকে তুলে এনে দিতে হয়। মেয়েটা তাই একদিন বলেছিল, সে তার আব্বার জন্যে নতুন এক জোড়া চোখ উপহার চাইবে ফেরেশতার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে। আমি বলি, যখন চাইবে তখন বড় কিছু — স্থায়ী কিছু চাইবে না কেন? জান্নাত চাওয়া কি আরো ভালো নয়? সে বলে, তুমি আমার আব্বার কষ্ট দেখলে নিজের জন্যে জান্নাত চেয়ে পালিয়ে যেতে পারতে না।
পালিয়ে যাওয়া! এটা কি সত্যিই কাউকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া!
মেয়েটা আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তাতে আমার বেশ ভাল লাগে। মেয়েরা তুমি বললেই আমার মনে হয় আমরা যেন একটা ভালোবাসার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটার নাম জানি না। জিগেস করিনি। সেও আমার নাম জানতে চায়নি। নাম জিগেস করা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশাধিকার চাওয়ার মতো ব্যাপার। সন্ধ্যা বেলা আমাদের কখনও দেখা হয়নি।

আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? আমি বলি।

প্রশ্ন? যখন কেউ প্রশ্ন করার আগে অনুমতি চায় তখন বুঝতে হবে প্রশ্নটা বিশেষ। তো কি সেই বিশেষ প্রশ্ন? নিজে নিজে ব্যাখ্যা করে মেয়েটা।

হ্যাঁ, বিশেষ মনে করলেই বিশেষ। এটা পুরোপুরি মনে করার ব্যাপার। আসলে আমি তোমার নাম জানতে চাই : আমি বলি।

নাম? আমার নাম — মনে করো সবুজ পোশাক পরা মেয়েটা, এটাই আমার নাম, বা ধরো ফটকের ওধারের কন্যা, হ্যাঁ, এটাও একটা ভালো নাম হতে পারে আমার : সে এইভাবে বলল।

আমি খুব লজ্জা পেলাম। আমার হয়ত নাম জানতে চাওয়া উচিত হয়নি। কেউ আড়াল চাইতেই পারে। আমি কি এই কয়দিনে তাকে বড় আপন ভাবতে শুরু করেছি বলে সে ভাবল? আমার লজ্জা লাগল, ধরা পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক। মসজিদের ফুলগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে আনন্দ প্রকাশ করছে। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। ছায়া পড়েছে, রোদ নেই। আজ মঙ্গলবার।

দু দিন জোহরের নামাজে মসজিদে যাইনি।
 শুক্রবার জুম্মার দিন। লোকের ভিড় অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। যারা কখনও নামাজে আসে না তারাও এই দিন আসে। পাপের ভয়? মাফের আশা? জানি না, তবে আসে। মসজিদ গমগম করে ওঠে। ধোয়া মোছা হয় মসজিদের ঘরগুলো। কাচা হয় কার্পেট, গালিচা, চাদর। পবিত্রতার গায়ে জল পড়লে আরও ঐশ্বরিক বলে মনে হয়। আমার নামাজে মন তেমন নেই। তসবিহ হাতে নেই, পাঞ্জাবির পকেটে রুমালের পাশে পড়ে আছে। আরবি আতর গায়ে। নামাজের অনুষ্ঠান কখন শেষ হয় তার অপেক্ষা করছিলুম।

গত দিন ইমাম সাহেব দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। ছ ফুট প্রায় লম্বা, সাদা জোব্বা পরা, পায়ে চামড়ার জুতো, হাতে তসবিহ, সব সময় জিকির করেন।
তিনি বললেন : মসজিদ একটা পবিত্র জায়গা।

মসজিদ নিঃসন্দেহে একটা পবিত্র জায়গা —স্থান বলা ভালো। হাদীসেই তো আছে, মসজিদ হল জান্নাতের টুকরো : বিনীত ভাবে আমি বলি।

সেই জান্নাতের টুকরোতে এমন কাজ আমাদের করা উচিত নয় যেটা অপবিত্র, নাজায়েজ।

হ্যাঁ, নাজায়েজ কাজ মসজিদ বাইরে অন্য জায়গায় করাই ভালো।

না, আমি তা বলিনি। নাজায়েজ কাজ কোথাও করাই ভালো নয়। আপনি আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আমি একটা মসজিদের ইমাম।

আপনি একটা মসজিদ শুধু নয়, বিশাল বড় মসজিদের শাহী ইমাম —আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সরকার আপনাকে মাসোহারা দেয় —এ যা-তা কথা নয়। আপনাকে আবারও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

তাঁর মুখমণ্ডল ভারি কঠিন হয়ে গেল।

আপনি হাদীস জানেন, একটু আগেই হাদীস বলছিলেন, না? তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়াকে সমর্থন করতেন না। ভেবে দেখেছেন যদি খারাপ কিছু একটা ঘটে যায়, পুরো সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তিনি মৃদু স্বরে বলে গেলেন।

হ্যাঁ, ওসমান গণি ইশার নামাজের পর রাতের অন্ধকারে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ভয় দেখিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর স্ত্রী আর মসজিদে যেতেন না, ভয় পেতেন : আমি বলি : মসজিদের সামনে ফুল চাষ করেন কেন?

তিনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যাওয়ার লোক নন। শুধু বললেন, ফুলগাছ আপনার জন্যে নাজায়েজ নয় আর আমি ধর্মের ভাষায় কথা বলি, সেটা আমার কাছে একটা সামাজিক সংবিধান। সে যদি মসজিদে যেতে কাউকে নিষেধ করার বিধান দিত তাহলে আমি বলতাম —আর মসজিদে যাবেন না।

হ্যাঁ, সংবিধান মানা খুব জরুরি। দেশের সংবিধানে যেমন ফাঁসি রয়েছে তেমন ধর্মের সংবিধানে আছে জাহান্নাম। খুব সিমিলার : বলি : আচ্ছা, পৃথিবীতে যার পৃথিবীর নিয়মে অপরাধের জন্যে ফাঁসি হয়েছে তার কি ধর্মের নিয়মেও জাহান্নমই হবে?

তিনি বিরক্ত হয়ে চলে যান।

জুম্মার নামাজের পর সবাই চলে গেছে। মসজিদ ফাঁকা। বাতাসের শব্দ শোনা যায়। কয়েকটা টকটকে লাল গোলাপ হাওয়ায় তির তির করে নৌকোর মতো কাঁপছে। দেখলাম, ফটকের ধারে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ মেরুন লাল একটা আলখাল্লা পরেছে। হাত দুটো পেছনে জড়ো করা।

মসজিদের ফুলবাগান থেকে কয়েকটা লাল গোলাপ তুলে হাতে করে পেছনে লুকিয়ে ফেললাম, তারপর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখে আজ বিষন্নতা নেই, বেশ হাসিহাসি। তাকে মেরুন লাল পোশাকে একটা হুরের মতো লাগছে। হুর জান্নাতে না গেলে দেখা যায় না।

সে জিগেস করল : দু দিন কোথায় ছিলে?

তুমি কি ফেরেশতার দেখা পেয়েছো? আমি জানতে চাই।

আমি কিন্তু এই এইখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম।

হাতে কী?

আমার হাতে! তোমার হাতে কী?

সে বলল : আল্লাহর উপহার, আব্বার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। তার চোখের অবস্থা খুব খারাপ কিনা। তুমি?

আল্লাহর উপহার, মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না : আমি বলি।

আকাশে হঠাৎ মেঘ জড়ো হতে হতে পুরো আকাশটাই মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। মেয়েটার হাসিহাসি মুখটা কিন্তু এই প্রায়ান্ধকারেও ম্লান হল না। ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত একটা মোমবাতির মতো সে যেন জ্বলছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। হালকা বৃষ্টি নয়, মুষলধারায় বৃষ্টি। চারদিক জলের পর্দায় ঝাপসা —যেন সমাজ, সভ্যতা, প্রকৃতি সব নাকাব পরে আছে।

মেয়েটা বলল, চলো মসজিদের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই।

মসজিদের কোন দিকে? ছেলেদের দিকটাতে নাকি মেয়েদের দিকটাতে? আমি জিগেস করি।

আমি ছেলেদের দিকে যাব না।

আমি মেয়েদের দিকে যাব না।

তাহলে চলো দুই দিকের মাঝখানে যে ওজুঘর আছে ওখানে গিয়ে দাঁড়াই : সে প্রস্তাব দিল।

হ্যাঁ, ওজুখানাই ভালো : আমি সম্মতি দিই।

জনহীন মসজিদ একটা কারখানার মতো। আমরা ওজুঘরে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, একটা প্রাণী আশেপাশে নেই, মসজিদের ফুলগাছগুলো বৃষ্টির আক্রমণে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দূরে ফটকটা এমনভাবে বন্ধ যেন আমরা একটা বিশাল দুর্গে আত্মগোপন করে আছি। শত্রুসৈন্যরা টের পেয়েও কাছে আসতে পারছে না। মেয়েটা মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে দিয়েছে। চুল ভিজে।

তুমি কি জানো যখন কোনো নারী পুরুষ নির্জনে থাকে তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হল শয়তান? আমি বলি।

শয়তান? এখানে? এ তো মসজিদ : সে আশ্বস্ত করে বলে।

কিন্তু ওজুখানার পাশেই তো ইস্তেঞ্জাঘর —শৌচাগার তো অপবিত্র। ওখানে তো শয়তান থাকতেই পারে আর আচমকা বেরিয়েও আসতে পারে আমাদের মাঝখানে।

তা তো ভেবে দেখিনি, তবে শুনেছি শয়তান ইবলিশ নাকি এক সময় ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। আদমকে সিজদা করেনি বলে আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয় : সে বলে।

তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?

তোমার কোন কথা বিশ্বাস করতে হবে? সে জানতে চাইলো।

আমি আমার মধ্যে শয়তানকে টের পাচ্ছি।

কীভাবে বুঝছো যে তোমার মধ্যে শয়তান এসে হাজির হয়েছে? মেয়েটা আবার জানতে চাইলো।

তোমার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি লজ্জিত মুখে বললাম।

সে বলল, আমারও তোমার হাত দুটো ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষের হাত ধরিনি। তবে হ্যাঁ, আব্বার হাত ধরেছি।

আমিও কোনো মেয়ের হাত ধরিনি আজ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, মায়ের হাত ধরেছি : আমি বলি।

যেভাবে বৃষ্টিটা আচমকা শুরু হয়েছিল সেভাবেই আচমকা থেমে গেল। রোদ বেরিয়ে পড়েছে। মেঘের পেটে যা জল ছিল সব যেন ঢালা হয়ে গেছে। মসজিদের ফুলগুলো রোদে নেচে উঠলো।

আমি আমার ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছি : মেয়েটা একটু দূরে সরে গিয়ে মাথায় ওড়না টেনে দিল।

কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে? কীভাবে পেলে? আমি জানতে চাই।

এই নাও দুটো লাল গোলাপ, এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম আব্বাকে দেব : পেছন দিক থেকে হাত ঘুরিয়ে সে গোলাপ দুটি আমার সামনে তুলে ধরল।

আমিও তোমাকে কয়েকটা গোলাপ দিতে চাই যেটা মাকে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে বললে না তো?

মেয়েটা ওজুঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বলল : আমি আমার মধ্যে এই পবিত্র জায়গায়ও শয়তানকে টের পেয়েছি।

শয়তানকে পেয়েছো তো, কিন্তু তুমি যে ফেরেশতার কথা বলছো?

সেও এক সময় ফেরেশতাই ছিল। যাইহোক, তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না।

এই বলে মেয়েটা মসজিদের ফটকের দিকে চলে গেল। তার দেওয়া গোলাপ দুটো হাতে ধরে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।

জিয়া হক









প্রতিশ্রুতি ও সহবাস


ভালোবাসা। সব সমাধান করে মুহূর্তে। কী সমাধানযোগ্য আর কোনটা অসমাধেয়? যেখানে 'বিকার' রয়েছে সামান্যও, তার মীমাংসা। নির্বিকার বলে হয় কি কিছু? আসলে ভালোবাসা কোথাও বিকৃতি দেখে না। তার সব সুন্দর। তার কাছে সুন্দর সবটুকু। ফুল তার কাছে ফুল তো বটেই, কাঁটাও তার কাছে ওই ফুলের সৌন্দর্যের বর্ধিত অংশ। যদি কাঁটা বিঁধে যায় হাতে? রক্তপতন হয় যদি? তাহলে? তাহলেও সেই রক্তে অসূয়া নেই, নেই সহিংসাত্মক মনোবেদনা। উপত্যকা-জোড়া ঘৃনা ও ঘৃন্যতার ভেতর যে রূহ সচল রাখে জনজীবন তা-ই ভালোবাসা। এখন প্রশ্ন হল, ভালোবাসা কী ও কেন, কীভাবে ও কেমন তা অনেকেই জানে, তারপরও কথা কেন এত? প্রেম কি কম পড়িয়াছ‌ে? পার্কে রেস্তোরাঁয় এত এত 'প্রেম', হৃদয়-চিহ্ন ভরা ইমোটিকনরাজি, অপ্রতিশ্রুত সহবাস —তারপরও? কোথাও কি বিপদঘন্টি বেজে চলেনি অজ্ঞাতসারে? মন জানে, মনই জানে। এমন কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে যাদের জ্বর আসে ঘন ঘন। অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসার দরকার হয়। অথচ তারা নাচতে বাধ্য হয় জমায়েতে। আসরে। যে নাচে তার প্রাপ্য ব্যথা আর যে নাচায় তার পাওনা মুদ্রা, হাততালি, কেয়াবাত জনাব। ভালোবাসা এখন, হ্যাঁ এখনই, সেই প্রাণীটি। পড়ে থাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি, রাবার ও লুব্রিক্যান্ট।

ভালোবাসাহীন মূল্যবোধের অস্তিত্ব আছে? যদি দেশকে ভালো না বাসা হয়, যদি দেশবাসীকে ভালোবাসা না হয়, যদি পৃথিবীর প্রতি না থাকে ভালোবাসা, মানুষের জন্য ভালোবাসা রাখা না থাকে যদি, তাহলে কেমন হয়? তাহলে প্রতিটি মানুষই হয়ে থাকে সুপ্ত ক্ষেপণ-উদগ্রীব সোরা যাকে একটি চিত্র, একটি বাক্যের কণা বিস্ফারে নিয়ে যেতে পারে। শান্তি যেমন একটি মানসিক চুক্তি, ভালোবাসা তা কিন্তু নয়। এ স্বতঃপ্রণোদনাময়। এ আসে ;ডেকে আনতে হয় না একে। ঘৃনা তাই ছড়ানো সহজ, কিন্তু ভালোবাসা? তাকে ছড়িয়ে দিলেই অঙ্কুরোদগম হয় না। এ জাগে ; একে জাগাতে হয় না। তবে চাইলেই সে জাগে না —আসে না। তার জন্য আধারকে প্রস্তুত করে রাখতে হয়। আমাদের রাষ্ট্র কি প্রস্তুত? ভালোবাসার এত এত ঐতিহ্য নাকি আমাদের ইতিহাসে। তাহলে কেন ধর্ম'পরিচয়ের নিরিখে কোতল হয়ে যায় কেউ? লিঙ্গ'পরিচয়ে বলাৎকার হয়ে যায় কেন একজন? বিত্ত'পরিচয়ে বিচ্ছিন্নতা বোধে রোজ আরও প্রান্তিক হয়ে ওঠে কেন কেউ? আমাদের ইতিহাসে ইসলামি শাসনই তো কেবল রক্তপাতের কথা বলে, এ অন্ধকার। আর কোথাও, কোনোখানে লাল চোখ, রক্ত নেই তো? বাকি সবটুকু কেবলই আলো আর আলো তো? তাদের আগে ও পরে? অতিথি আমাদের ঈশ্বর-সমগোত্রজ। এ-ই তো ভালোবাসা। এখন আঘাতের আগে প্রশ্ন করে নেওয়া হয় নিশ্চয়ই, কে অতিথি আর কে অনুপ্রবেশকারী। এই সুচিন্তিত ভালোবাসা, এই সু-নির্দিষ্ট ভালোবাসা, এই সু-বিশেষ ভালোবাসা বড় বিপদ-জনক।

অ-সভ্যেরা প্রেম বলতে বোঝে শরীর। সেখানে কুসুমের মন নাই। সভ্য মানুষ প্রেম বলতে কয়েকটি প্রশ্ন বোঝে —কাকে প্রেম, তার আধারসম্বলিত পরিচয় পত্র কোথায়, কতদূর প্রেম, কেনই বা প্রেম? এ প্রেম নির্বাচিত। এ প্রেম রেজিমেন্টেড। সে শুধু শরীর নয়, বোঝে পূর্ণত ও নিঃশর্ত অধিকার। এই প্রেম যেহেতু অভিনয়কলার নিকটবর্তী, তাই এই প্রেম বিজ্ঞাপনের।  এই প্রেমে নেই প্রেম, বিবাহ, দায়বোধ : যা আছে তা হল সহবাস ও প্রতিশ্রুতি। যদিও 'বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস' বিষয়টি সোনার পাথরবাটির মতো। একজন নিজেকে  'ভোগ্য পণ্য' ভাবছে শুরুতেই। বিনিময় মূল্য কী? না যৌনসম্মতি। তাছাড়া, তাকে কে বলে দিয়েছে যে একজনের সঙ্গে যৌনতা করলে অন্য কাউকে বিয়ের অধিকার সে হারিয়ে ফেলে? কুমারীত্বকে কি সে মূলধন ভাবে নাকি? এখানে আরেকটি তর্ক রয়েছে। যে-লোক, যে-সমাজ, যে-রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তার সঙ্গে সহাবস্থান করবে কীভাবে একজন? সে তো প্রত্যাখ্যানেরই যোগ্য।

আমাদের প্রেমিকসত্তাটিকে আত্মপ্রেমে মগ্ন করে রেখেছি আমরা। সে যত নিজেকে ভালোবাসতে যাচ্ছে ততই সে বিবিধের কাছে ঘৃণ্য হয়ে উঠছে অগোচরে। সে যতই নিজের মধ্যে ডুব দিতে যায় ততই তার বিপুল তুচ্ছতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মুশকিল হল, এই স্ব-প্রেমীটি নির্লোভী নয়। তার একটা ভাবমূর্তির প্রশ্ন আছে। সে রাতের গোপনে বৃক্ষ-হন্তারক আর দিনের প্রকাশ্যে বৃক্ষপ্রেমী সেজে থাকতে চায়। সে প্রকাশ্যে নিরামিষাশী আর গোপনে মাংস ছাড়া কিছু গ্রহণ করে না। এরাও ভালোবাসে কাউকে, ঘৃণাও করে এরা কাউকে। এই ঘেন্না ও ভালোবাসার রূপ কিন্তু সরল একরৈখিক নয়। এরাই সাম্প্রতিকে নেতৃত্বে। এরাই এখন পথপ্রদর্শক। এরাই নৈয়ায়িক। ফলত সমস্ত 'ন্যায়', সব 'পথ' এখন বিপদসঙ্কুল। অন্ধকার বিপথগামী।

জিয়া হক