তকদির


...................
আমি শুয়েই ছিলাম। যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে, শুনেছিলাম এক মৌলবীর মুখে, ছোটবেলায়। তখন কত আর বয়স হবে আমার? এগারো কি বারো। আমার পাশে বালাপোষ গায়ে দিয়ে আমারই ভাগ্য শুয়ে আছে, ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। ভাগ্যের এত অলস হওয়া মানায় না। উচিতও নয়। সে বসবে ঘোড়ার পিঠে আর সেই ঘোড়া দৌড়বে সেই মহল্লার মধ্যিখানের রাস্তা দিয়ে যেখানে প্রচুর ঘরবাড়ি, সুন্দরী রমণী, লোকের অরণ্য, সবার দৃষ্টি প্রবল তাই চশমা পরে না, মানুষকে মাপার ফিতে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহকর্ত্রী, যেখানে সবাই সবাইকে 'আপনি' বলে সম্ভাষণ করে, দিশি কুত্তাবিহীন এক অঞ্চল। অথচ আমার ভাগ্য শুয়েই রইল, মশারিটাও আমাকেই টাঙিয়ে দিতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠেছে, ভুলে যাই যে, সূর্য উঠেছে বলেই সকাল হয়েছে আর সকাল হয়েছে বলে আমি জেগে উঠেছি। মুর্খদের সঙ্গে বাস করা কঠিন। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে যাব কোথায়? কোথাও যাওয়ার না পেয়ে টিউশন পড়াতে বসি। প্রথম টিউশন শুরু করি ২০১১ সালে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর শুরুতেই আমি পড়াতে শুরু করি একটি শিশুকন্যাকে। তার নাম জানতে চাইবেন না। কারণ তাকে আপনারা চিনতে পারবেন না কিন্তু সে যদি দুর্ভাগ্যবশত এই লেখাটি পড়ে তাহলে সে আমাকে চিনতে পারবে। কেন তার অনুমতি ছাড়াই তার নাম ব্যবহার করেছি তা নিয়ে সে প্রশ্ন তুলতে পারে। ভয় আছে। আমি সাধারণত যে ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই তা হল :
১. কবিতা কীভাবে লেখা হয়?
২. রাজনীতিকরা কি সাইকোটিক?
৩. মানুষ পাগল হয়ে যায় কীভাবে?
৪. সত্য মানে ট্রুথ কী?
৫. ঈশ্বর আছে?
এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই কারণ এদের কোনও সদুত্তর নেই। আর সদুত্তর নেই বলেই যা-কিছু চিন্তা করা যায়। মাথা সচল থাকে। কিন্তু মুশকিল হল, আমার তৎকালীন ছাত্রীর বয়স ছিল ৬ বা ৭ বছর। সে রঙিন সব জামাকাপড় পরে আমার সামনের চেয়ারে এসে বসত। দুজনের মাঝখানে একটা পেল্লায় টেবিল। ওর মা 'এরকম-সচরাচর-পাওয়া-যায়-না' স্বাদের অপরূপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। পুত্রসন্তান নেই বলে তাঁর বড় আক্ষেপ ছিল। কীভাবে বুঝলাম? একদিন তিনি নিজেই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। তারপর যেভাবে সামাল দিতে হয়, সেভাবে সামালও দিয়েছিলেন। তাঁর দুই কন্যা। আমার ছাত্রীটি ছোট। ছোট হলে কী হবে, সে একদিন এক আশ্চর্য কথা শোনালো। বলল, জানো স্যার, আজ আমাদের স্কুলে একটা ছেলে আমার সামনে এসে বলছে 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত'। বলেই সে কি হাসি। আমি ভাবছিলাম, যে ছেলেটি বলেছে ধরে নিচ্ছি এই বয়সেই সে সব বোঝে, কিন্তু এ এত হাসে কেন? বুঝলাম, এও কম বোঝে না। যখন এই বোঝা ও পড়া চলছিল তখন আমার ভাবোদয় হল যে, আমি এই কন্যাকে কিছুই শেখাতে পারছি না, বরং রোজ আমিই শিখে বাড়ি আসছি আর তার বদলে বেতন নিচ্ছি। এভাবে তো চলে না। তাছাড়া, অভিভাবকরা তো বছরের শেষে নম্বর দেখবেন। অর্থের ব্যয় অনুপাতে নম্বরের আয় কত হল? আমিই অকৃতকার্য হব। একদিন ছাত্রীর বাবাকে ডেকে বললাম, ওর জন্য শিক্ষক নয়, নার্স প্রয়োজন, যে ওকে নারিশ করবে। আমি ওর কোনও উপকারেই লাগছি না, আমাকে বিদায় করুন। শিক্ষক বিনীত হলে অভিভাবক তাঁকে আরও মহান শিক্ষক ভাবতে শুরু করেন। তিনি আমাকে ছাড়তে নারাজ আর আমিও নাছোড় যে ছাড়বই। তারপর একটা রফা হল : ও আরেকটু বড় হলে আমি আবার পড়াতে আসব। তা-ই সই। কিন্তু এখন যে আমি টিউশন পড়াতে ছাদের ঘরে এলাম, এটা আপাতত আমার জীবিকা সংগ্রহের বিবিধ উপায়ের একটি। যে শুধুমাত্র জীবিকার জন্য পড়াতে বসে, পড়ানোটা যার জীবন নয়, সে শিক্ষকই নয়। তার অন্য কাজ দেখা উচিত। অন্তত আলুবিক্রেতা হতে পারে। আমার পুঁজি নেই আর সকলেই জানে টিউশন একটা বিনাপুঁজির ব্যবসা। আমি ফলত শিক্ষক নই, একজন ব্যবসায়ী। ছাত্র-ছাত্রীরা আলাদা করে ভক্তিশ্রদ্ধা দেখালে তাই আমার লজ্জা লাগে। আমি তাদের হাতগুলো আমার পা থেকে ক্রমাগত সরিয়ে দিই। এই পায়ে পাঁচ পাঁচ দশটা আঙুল ছাড়া আর কিছু নেই, তদুপরি রয়েছে ময়লাজমা নখ। পড়িয়ে নিচে নেমে প্রথমে বারান্দায় যাই না, আব্বামায়ের সামনে যাই না, যাই আমার বিছানার পাশে যেখানে তখনও আমারই ভাগ্যখানি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ভাগ্য নিজে কি স্বপ্ন দেখে? সে তো স্বপ্ন দেখায় আর এক সুন্দরী সকালে সত্যে রূপান্তরিত হয়ে মথ থেকে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়। উড়ে গিয়ে সে মেঘ হয়, মেঘ মানে প্রথমত ছায়া, তারপর জল। সব তাপ কেটে যায়, সবকিছু নাতিশীতোষ্ণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ জীবনের লোভ জন্ম নেয় এই মেঘের গর্ভে। অথচ আমার ভাগ্য এমন নিষ্পাপীর মতো ঘুমোচ্ছে যে তাকে জাগাতে আমার মায়া হল। কে কাকে জাগাবে? আমি তাকে নাকি সে আমাকে?
আমাকে অফিসে যেতে হবে। বলা উচিত কাজে যেতে হবে। আসলে সবাই 'অফিস' যেতে চায়। আমার পরিচিত একজনের স্ত্রী তার স্বামী কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করলে বলত, অফিসে গেছে। তার মেয়েকেও সেভাবে শেখানো হয়েছে। সেও বলে, বাপি অফিসে গেছে। লোকটা ছিল প্লাম্বার।
আমিও যেমন একজন অনুবাদক ছাড়া আর কিছু নই। একটা পত্রিকার দফতরের এক কোণায় বসে হরেক মাল অনুবাদ করি। ভুঁইফোঁড় কোম্পানির ত্রৈমাসিক বা অর্ধবর্ষের অনিরীক্ষিত আর্থিক ফলাফল, ব্যাঙ্কের দখল বিজ্ঞপ্তি, দাবি বিজ্ঞপ্তি, সরকারি টেন্ডার নোটিশ, সম্পত্তি নিলাম ও বিক্রয়ের বিজ্ঞপ্তি—এর শেষ নেই। আমি রাতে বাড়ি ফিরে খলিল জিবরান অনুবাদ করব কিনা ভাবি, ভাবতে গিয়ে দেখি কবিতাগুলি বিজ্ঞপ্তি হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না, পরিভাষা ছাড়া অন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। কবির কাজ পরিভাষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, আমি রোজ তারই দাসত্ব করি, আমি কি আর কখনও-ই জিবরান অনুবাদ করতে পারব না?
এই দফতরে নানা কিসিমের লোকের সঙ্গে এই অল্প কয়দিনে আলাপ হল। একদিন সৃজিত মুখার্জির মতো সিনেমা বানাবে—এই স্বপ্ন নিয়ে এক তরুণ উত্তর ২৪ পরগনা থেকে রোজ বিকেলে এসে রাজনৈতিক খবর লেখে। সে অনেক বিদেশি সিনেমার নাম বলল। সব সে দেখেছে। কিন্তু সে বক্স অফিস চায়। তাহলে ওই বিদেশি ছবিগুলি দেখে সে কী শিখেছে? 'সিনেমাকে ভালবাসতে শিখেছি', 'লাভ-চাইল্ড'-এর মুখের গড়ন কেমন হবে? শ্রী মুখার্জির মতো। বানাক না, সে যা চায়, যেমনটা চায়, বানাক। আমরা বড় বেশি দাগ টেনে দিই। আমি বরং সেই তরুণের গল্প বলি যে ডিটিপি অপারেট করে আর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পশুচিকিৎসকদের হেল্পারের কাজ করে। সে ফরেন কুকুরের নামগুলি সংক্ষেপে বলে। সে যে একজন ভেটারেন ভেট তা বোঝাতে চেষ্টা করে। আনন্দ পাই। চোখ বড় বড় করে একদিন বলল, একটা ল্যাবের তিনটে বাচ্চা হয়েছে, একটা মরা, এইটুকু মাথা। আঙুল গোল গোল করে দেখালো। আর একদিন বলল, 'আজ দুটো কুকুরের ইউট্রাস অপারেশন হল।' আমি বললাম, ইউটেরাস? সে এক মুখ লজ্জাবন্ধ হাসি নিয়ে বলল, ওই হল দাদা, আমাদের লাইনে সব চলে।
তার আঙুল চলছে কী-বোর্ডে আর মনিটরে নানান মুদ্রায় ফুটে উঠছে অক্ষর। ওর কি এত অর্থের প্রয়োজন? নাকি ভাগ্য ওর সহায়?
আরেকজনের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এই দফতরে সবাই পেশাগতভাবে দ্বৈত পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি মরে যাচ্ছি।
দফতর থেকে বাড়ি ফিরে আব্বামার সঙ্গে কথা বলা হয় না। ভালো থাকে না মেজাজ। আয়নায় নিজেকে দেখলে যেমন করুণা জাগে, তেমনই তাদের দেখলেই যেন রাগ হয়, তারা কি একবারও বলতে পারে না যে করতে হবে না এমন চাকরি যা তোকে আরও বিমর্ষ আর বিষন্ন করে তুলছে দিন দিন? তারা বিশ্বাস করে, যুবকদের ব্যস্ত থাকা ভালো। উচিত। আমি এই বিধিবদ্ধ ঔচিত্যে আটকে থাকতে থাকতে তাদের থেকে ক্রমশ দূরবর্তী হয়ে পড়ছি, তা তারা বোঝে না। আমি ভুলে যাই কী দিয়ে কথা শুরু করব তাদের সঙ্গে। মনে করতে পারি না আমাদের পারিবারিক সংলাপের পরম্পরা কোন অবধি এসে থমকে আছে। বাড়িটা প্রতিদিন একটু একটু করে হোটেল হয়ে উঠছে। আমি হোটেলে থাকতে চাইনি কখনও। চাই না।
দফতর থেকে বাড়িতে সোজাসুজি না ফিরে চলে এলাম গঙ্গার কাছে। পাপ এতে ডোবে কি না জানি না তবে জীবন ডুবে যায়।
লাফ দিলাম গঙ্গায়। জোয়ার তখন। একটি উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে ছোটগল্প হয়ে, লাফ দেওয়ার আগে এই সব ভাবছিলাম। আমি নেই মানে আমার ভাগ্যও নেই? তার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখখানা মনে পড়ছিল। সে যদিও এখনও বিছানায় আর আমি একা একা পালিয়ে যাচ্ছি জীবনাঞ্চল থেকে। সে আমার সঙ্গে থেকেছে আজীবন কিন্তু সখ্য হয়নি। চললাম সঙ্গী, তুমিই এবার আমার সওয়ার হও। অথচ বিপরীতটা হতে পারত আর হলে তুমিও দীর্ঘায়ু হতে। যাইহোক।
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাগ্য, আমি একটি নৌকোর পাটাতনে শুয়ে আছি। বেঁচে আছি তাহলে? কীভাবে সম্ভব? কে বাঁচালো? একে কি কৃপা বলা যাবে? যদি যায়, তাহলে কার এই কৃপা?
'আমার', ভাগ্য বলল বেশ উদাসীনভাবে, 'আমার সম্পর্কে তোমার যা ধারনা আর আমি যা, আমার কাছে রোজ তুমি যা চাও আর রোজ আমি তোমাকে যা দিই, যাকগে, বাড়ি চলো, আমাদের আব্বামা অপেক্ষা করে আছে। তারা এখনও খায়নি।'

জিয়া হক 

আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে


..............................................
কী পুছহ, জিজ্ঞাসিত বুঝিতে না পারি
বর্ণ যেন শব্দে এসে
গড়ে তোলে বদহজমী
বাক্যের তরকারি
কী পুছহ, কী প্রশ্ন খুকি
দরজায় মেহগনি
তদুপরি দ্বাররক্ষী
কোন জ্ঞানে ঢুকি?
দেখনি, কী উত্তেজক জল!
হারাম হালাল করে
ডাকে ওই মূত্রদ্বারে
যেখানেই তির্পল
পাতা ছিল শয্যা হবে তাই
প্রশ্নপত্র যথাযথ
বানানও বিধিবদ্ধ
শয্যাশায়ী শিশুছাত্র নাই

জিয়া হক 

প্রতি প্রতিষ্ঠান



...................................
কী আলো তোমাদের কথায় বাসা বেঁধে আছে
কুক্কুট মাংস ইহাতেই প্রসিদ্ধ হয়ে যেতে পারে
যে শোনে, সে শ্রোতা, যেভাবে আমি ও কুকুর
তার ধর্মভাব বেশি তাই কলহ করে না
যে বক্তার অঙ্গভঙ্গি নেই, সে কতখানি বক্তা হল শেষে
যে-দেবতা আরাধ্য, তাকে নগরের পথে
আমি হারিয়ে ফেলেছি
সে-দেবতা কি আমাকে আমারই মতো খুঁজিতেছে—
ভিড়ে, আস্তাকুড়়ে?
প্রচলিত গান শুনে বুঝি বিপ্লবীরা গুপ্তভাবে সভা করে কেন
হে জনের মাধ্যম, হে ছাপার বাক্যবর্ণযতি
থাক, বৃথা এই 'হে' বলে ডাকা, পাখা ডাকি, ক্লান্ত হয়েছো
মরুভূমিকে তুমি, তুমিই সমুদ্র বলে ব্যাখ্যা করতে পারো যেহেতু
সংস্থা আর বালিও খেয়েছো অঞ্জলিভরে, পাদপদ্মে বসে

জিয়া হক 

দ্বিজাতীয়


........................
কন্যা কি চলে যায় ভিজে
উঠে আসে তোমাদের
আমাদের
মাংসের দহলিজে?
বালক কি চলে যায় একা
উঠে পড়ে পল্লি ট্রেনে
দক্ষিণের
নদীর অদেখা—
কোনো গ্রামে?
দুজনের প্রতি দেখো
দেবতার
ইবলিশের
কথামালা নামে

'মিলে যাও,
ঢুকে যাও দেহে
তুমি ঠিক ছোট নও
        আমি ঠিক বড় নই
                     শংসাপত্রী
দৈবশাস্ত্র চেয়ে'

ফলবতী নিম ছিল দূরে
ডুবে গেছে পৃষ্ঠা যার
সুমিষ্ট ভক্তি আর
ষান্মাসিক নিহত রোদ্দুরে
সান্ধ্যকালে সূর্য ধরে গান
নামকরণ ভুল নয়?
গোত্রে তারা একপ্রকার?
সুচিন্তিত মেলে ধরে
                       লোক-অভিধান

অতঃপর বৈধ পেঁচা বলে
মিলে গেলে কেমন কৌশলে

এই দেশে?





জিয়া হক
চিত্র : ভ্যান গখ

আমাদের যা নয়

......................
আমাদের বাক্য হল ছোট, আমাদের 'আমি'ই গেল ডুবে
আমাদের অন্ত্যমিলের বাজার
                  পড়ে গেল হাজার একটা কূপে
আমাদের খাদ্য মাটি মাটি, আমাদের পেটের মধ্যে ধান
আমাদের যন্ত্রে কান্না বাজে
           ফুলে ওঠে চোখের বাসস্থান
আমাদের কোমলমতি চারা, আমাদের মৃত্যুশয্যা ঘিরে
আমাদের পেলাস্টিকের গৃহে
                   খেলা করে উদ্বাহু আর স্থিরে

জিয়া হক 

বলদ চলেছে গাভীটির পাশে

প্রকাণ্ড দেহে যারা বাস করে প্রায়শ মানুষ
দাবি করে বলে চা দেয় সুবেশা রানিমা
বলদেরা ধান খায়, বলদেরা ধান চাষ করে
তাঁদের বেতন নেই, খোরপোষ বিধিবদ্ধভাবে
নক্ষত্রখচিত ওই ভাষা : তাঁরা কথা বলে, মান্য শ্রম দেয়
নগরের প্রতিটি সিন্দুক আরও এক মুনাফাবন্ধনে
শোভিতই করে রাখে তাঁদের আলোকচিত্রে, অমৃতচরণে
উহাদের শয্যা নয় ; স্বপ্নেই ঢেলে দিন মূত্র-প্রসাধন
ও মানুষ —প্রায়শ বলদ 

দুধের পাহাড়ে একদিন

অন্তর্হিত হলাম এই লোকমান্য পেয়ারা বাগানে
যেখানে পোকা ও মাকড় থাকে, অন্তর্ভুক্ত হলাম সেখানে
দয়ার প্রাসাদ আর দয়াময় ধানের মণ্ডপে
আসন্ন শীতের প্রাক্কালে
কাকে যেন দেব আমি সুগৃহিণী,—নাচের পুতুল
নাচের পুতুল যাবে প্রসূতিসদনে
জন্ম দেবে প্রতিটি বাড়ির মতে আরও এক চাঁদ
ইঁদুর এসেছে কিছু, বৃষ্টি হল খুব
যেভাবে শাস্ত্রসম্মতভাবে দস্যু আসে দেশে
শিক্ষক যেভাবে আসে মল-মন্ত্র মুখে
তাকে একটি উপগ্রহ কর দিতে হবে
যে-লোক বাড়িতে নেই, যে-লোক সভাবিমুখীন,
গৃহিণীকে বাৎসল্যে দেখে বলে সন্তান চায়নি
তাকে আমি সানুনয়ে অনুরোধ করি—
যেখানে হারিয়ে গেল সবাই, অন্তর্হিত হল
সন্ধ্যা পতনের আগে সেখানেই অন্তর্গত হয় যেন সে

আমিও চৌকিদার : একটি গল্প


........................
—ইন্টারনেট আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। আমি একজন মিলেনিয়াল। দুধে কি কেশর দেওয়া আছে? খেতে খুব সুন্দর হয়েছে। হ্যাঁ, আমি একজন মিলেনিয়াল, ইন্টারনেটের উঠে আসা আর আমাদের বেড়ে ওঠা তো প্রায় একই সময়ে, আলফা প্রজন্ম এসে গেছে, সে যাকগে, কিন্তু মূল কথা হল, ইন্টারনেট আমাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে।
—তুমি কি ভীষণভাবে অ্যাডিক্টেড?
—কোকেনের চেয়ে বেশি। ইদানীং তো দিন-রাতের হিসেব গুলিয়ে যায়। সূর্য ডোবা যে কতদিন দেখি না! চোখের বড় অপব্যবহার করছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, সারাদিন ইন্টারনেটে কী যে দেখি তার কোনও সদুত্তর দিতে পারব না। তাহলে আমি কী দেখি? আদৌ কি কিছু দেখছি?
—ইন্টারনেট প্যাকেজ রিচার্জ করা বন্ধ করে দাও তাহলে, এছাড়া আর উপায় কী?
—একবার করে যে দেখিনি তা নয় কিন্তু উইথড্রল সিনড্রোম দেখা দিতে শুরু করে। সে যে কী ভয়ানক ফিলিং!
—কেমন হত?
—সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না, তবে পাগল-পাগল অবস্থা। ড্রাগ নেওয়া বন্ধ করলে যেমনটা হয় আর কি। বিস্কুটের উপর চিনি ছড়ানো দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আরেকটা দে তো।

আমাদের কথা শুরু হলেই রাত্রি গভীর হয়ে যায়। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র, বুঝতে পারি, যদিও কুচক্রীদের হাতেনাতে ধরতে পারি না। খেয়াল করে দেখেছি, যখন থেকে আমি তর্ক করা ছেড়ে দিয়েছি, তখন থেকে আমার সঙ্গীসংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি লোকগীতি শুনেছিলাম বহুদিন আগে, সেখানে গায়ক বলছেন যে কান, চোখ দুটো করে আছে কিন্তু মুখ মাত্র একটা তাই দেখবে আর শুনবে, কথা কম বলবে। শব্দভান্ডার নিপাত যাক। দাদা দুঃখবোধ নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

আমার বন্ধু আফরোজের সঙ্গে এই দাদার কখনও সম্ভব হলে আলাপ করিয়ে দেব। আফরোজ শ্রীনগরে থাকে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই প্রায় দু-মাস। কয়েক মাস আগেও আমাদের প্রতি সপ্তাহে কথা হয়েছে। ১১ই জানুয়ারি ওর জন্মদিন। মূল কথা হল, কাশ্মীরে এখন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। এ বছর জন্মদিনে ওকে শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। আফরোজ আমার এই দাদাটির মতো খানিকটা—ইন্টারনেট অ্যাডিক্ট। ওর কি এখন উইথড্রল সিনড্রোম দেখা দিয়েছে? আজ আমাদের বাসায় কাটা পোনা রান্না হয়েছে।

এলাকায় চোরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তরুন সংঘ ক্লাবের ছেলেরা রাতে পাহারা দিতে শুরু করেছে। পাড়ার প্রতিটা বাড়ি থেকে একজন করে লোক এই দলে যোগ দেয়। দলটা বেশ বড় হয় কেননা ঘর তো কম নেই। রাত আড়াইটে অবধি এই পাহারা চলে রোজ। বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রতিটি বাড়ির যুবকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। আমাদের পাড়ায় এখন যুদ্ধ-পরিস্থিতি। চোরদের সমস্যা হল, তাদের কোনো কৃপাকারী দেবতা বা অপদেবতা নেই। এককালে দস্যুদের কালিকা ছিল, বলিটলি দিয়ে রক্ততিলক কপালে টেনে পল্লীজয়ে বের হতো তারা। দেবী বা দেবতা একজন দরকার, অন্তত আমাদের মতো দেশে। আজ গাছে বিন্দুমাত্র বাতাস নেই।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ গিয়ে ভিড়লাম পাহারার দলে। তরুন সংঘ ক্লাব। কয়েকজন গঞ্জিকা সেবন করছে। গাঁজার গন্ধেই একটা নেশা থাকে। খানিকটা দূর থেকে সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে। মাথাটা তাতেই ঝিমঝিম করে উঠল। একটা ছড়া ছোটবেলায় শুনেছিলাম —
আপেলে ধরেছে পোকা
দুধে দেয় জল
গাঁজায় বুদ্ধি বাড়ে
পানে বাড়ে মল।

আমাদের দলটা যখন মন্ডলপাড়া স্কুল পেরিয়ে হাজার ফুট কলের ধারে এসে দাঁড়াল তখন শিবেন্দু বলল, "তপন মাস্টারদের পেঁপে গাছগুলো দারুণ হয়েছে, তাই না?"
শিবেন্দু আমাদের দলের শিক্ষিততম ছেলে। ডবল এম এ আছে, তবে কোন কোন বিষয়ে তা জানি না। তাত্ত্বিক নেতা, সুবক্তা, নানা রকম ম্যানিফেস্টো পড়া ছেলে। চাকরি নেই তাই চাকরি পায়নি। সেই কারণে সুকন্যার সঙ্গে সম্পর্কটা টিকল না। টিউশন পড়িয়ে সে একপ্রকার টিকে রয়েছে।
জগন্নাথ বলল, ওদের পেয়ারা গাছগুলো কি খারাপ? তাকিয়ে দেখ একবার।
দুটো কুকুর আমাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাতে তাকাতে আজাদনগরের গলির দিকে ঢুকে গেল। ইলেকট্রিক পোস্টের তীব্র আলো রাতকে নিশুতি হতে দিচ্ছে না। অন্ধকারকে আপ্রাণ ঠেকিয়ে রেখেছে।
শিবেন্দু বলল, জগা, তোর কি ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিষয়ে কোনো জ্ঞান আছে?
জগন্নাথ বলল, একটু একটু।
শিবেন্দু এবার তাকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা বল তো, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন আসলে লাইফ সায়েন্স না হোম সায়েন্স?
এত গভীর ও সূক্ষ্ম প্রশ্ন জগন্নাথ প্রত্যাশা করেনি। সে মাথা চুলকোতে লাগল। জগন্নাথ খর্বকায়, চুল কোঁকড়ানো, টাইমেক্সের ঘড়ি পরে, পায়ে কোলাপুরি ধরনের চামড়ার জুতো।
গগনদা বয়েসে একটু বড়। সে বলল, তোরা এ সব রাখ। আজ চুরি হতে পারে, আমার কাছে খবর রয়েছে। একটু এই দিকে মন দে, চল—পিন্টুদার দোকানের ওদিকটায় যাই একবার, হকির স্টিক দুটো এনেছিস তো?
শিবেন্দু তখনও তপন মাস্টারদের ফলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে। অস্ফুটে সে বলল, পুরো হলুদ হয়ে গেছে, গাছেপাকা জিনিস বাজারে এখন আর পাওয়াই যায় না।

ঘন্টাখানেক টহল দেওয়ার পর আমরা ক্লাবের গুমটি ঘরে ফিরে এলাম। নিপুনভাবে চৌকি দিয়েছি আমরা। পাড়া আমাদের হাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বেশ সুন্দর, আলোয় আলোয় ভরা। শিবেন্দু, জগন্নাথ, গগনদা আর সবাই ক্লাবের লাল মেঝেতে আলতো করে নামিয়ে রেখেছে ৪টে হলুদ পেঁপে আর গোটা পনেরো পেয়ারা।
গগনদা সিগারেট ধরিয়েছে, কেউ একজন টিভি চালু করল, ছুরি দিয়ে ফল কাটতে বসে গেল দুজন।

না, সে-রাতে আমাদের পাড়ায় কোনো চোর আসেনি।


জিয়া হক




শিক্ষক দিবস


.................. ..................................................... 
নির্মলতা এনে দাও বাসনে, বিদ্যালয়ে, জঞ্জালে ও স্তূপে
শিশুরা রয়েছে, আছে আদি মাতা, গোত্রের সুন্দরী
বিদূষক, কবিরাজ আছে, আছে কীর্তনগায়ক
মাজারের পির আর মৌলানা হুজুর,—আছে
ও আকাশদেবতা, ও জলজ সান্নিধ্যের দেবী ও মায়েরা
দাও নির্মলতা,
আমাদের বর্জন করো যদি বর্জ্যদ্রব্য হয়ে আমরাই কি
জঞ্জাল হব না?
আমরা যেখানে যাই সন্তান প্রসব হতে থাকে
ইস্কুল বানাই, শিক্ষা দিই আমরাই প্রথম আর স্বর্গ আমাদের
যে যত উপহার পায়, সে তত প্রধান শিক্ষক

জিয়া হক 

ব-দ্বীপবাসীর সুসমাচার : জিয়া হক


......................................... ..............................................
দিনকে দরিদ্র মনে হয় কেন? তার তো আছে রাত্রির সম্পদ
তার তো আছে সৌর মৌলিকতা, —
কর্মকাজ, দৃশ্যতই স্পষ্ট কৃষিক্ষেত্রজমি
তবে তার বেদনা কোথায়, কোথায় দুঃখ রপ্তানি?
আমি তো মীমাংসক নই, নই পীর কেবলা হুজুর
বুদ্ধের মতো অথচ বলতেও পারি না, 'আমি তো জানি না'
নীরবতা শেখার নৈশ বিদ্যালয়ে যাইনি কখনও
গুরুরা বশীভূত করতে চায়, চায় মৌখিক বিস্তার
চেয়েছে সব ফুল ফোটে যেন তারই বাগানে,
যদিও পিপীলিকা ঘৃণা করে তারা, পিঁপড়ার অধিকার
ধরো তুমি এই দিন, ধরো তোমাকেই করুণা করে কেউ
চাকুরিরতা, সুবক্তা স্বামী যা কার্যত প্রভু, ডালিম
পাতার মতো শিশুতে সাজানো তোমাদের সোফা ও বিছানা
নাগরিকপঞ্জি সুসমাচার আনে, ধর্মগৃহে যাতায়াত আছে
তবু কেউ যদি দরিদ্র বলে, করুণাই করে, কী করবে তুমি?
ফিরিয়ে কি দিয়ে দেবে পুনরুক্তি করে? পূর্বোক্ত কথা
আত্মীয় মনে করে, এ সবেরই লক্ষ্যবস্তু তারা
তারা কি জানে না পৃষ্ঠপোষনা কুক্কুরও চায়?
পশুদের মন, সর্বোপরি তার মনে হওয়া!


চিত্র : mi wallpaper

ভাস্করকে লেখা চিঠি


প্রিয় ভাস্কর, 
সম্বোধন করার রীতি মেনে 'প্রিয়' লিখতে হল, অথচ তুমি তো জানই এ কত সামান্য নৈকট্য বয়ে আনে। 
আজ রবিবার। 
এখন সকাল উত্তীর্ণ হয়ে যেতে বসেছে আর আমি বসেছি তোমাকে একখানি পত্র লিখিবার খোয়াইশ নিয়ে। 
অনেক ভেবেছি, কেন আর কেউ চিঠি লেখে না কারণে-অকারণে, দুর্দিন-সুদিনে, ভিড়-একাকীত্বে? 
হয়ত বিরক্তিই উৎপাদন করছি, 
এ সকল প্রগলভতা, বাগাড়ম্বর মনে হতে পারে কেননা এখানে কাজের কথা, 'কেজো' কথা নেই, যা আছে তা হল সংযোগাযোগের শ্রীময়ী ইচ্ছা। গতকাল যাদবপুর গিয়েছিলাম।
 মহারাজ এসেছিলেন। 
অনেক কথার পর বুঝলাম, আমরা ভারতাত্মা নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
 তোমাকে কেবলই মনে পড়ে গেল। 
যাদের বিবেক কলুষমুক্ত তাদের বিবেচনা শুনতে হয়, যেভাবে তোমার ভাবনা জানতে চাই নানা বিষয়ে, যদিও আমরা কোনও আন্দোলন তৈরি করতে পারি না, তবু আশা জাগে একদিন আমাদের দ্বৈত কথোপকথন ছড়াবে ধান্যশস্যের মতো, সবুজ হবে অনুর্বর শাসকের হৃদয়, মগজ। 

প্রীতি জেনো 
জিয়া হক

চিত্রকলাঃ ভ্যান গখ 

যে ওড়ে ওড়ার যন্ত্রণায়

দুর্গের মাথার চুলের হাওয়ায় আর কাউকে মনে পড়ে না
এখানে বড়ো গ্রীষ্মকাল, রঙিন বক ওড়ে
আমাদের পালকের ঘরবাড়ি ইতস্তত
শান্তি আসে? শান্তি আসে ধীর পদক্ষেপে?
যে যুবকের বুক থেকে চটি খুলে গেছে, তার দিকে চাও
যে জঙ্গলে কোনো গাছ গুঞ্জন করে না সারা বর্ষব্যাপী
উপহারে বাঘ কেন তাকে দিতে চাও?
সমস্ত জলই ঘোলা আর মাছও স্বাদমুক্ত, টক
দুর্গের মাথায় তাই চুল নেই, ঘাসের ভেতরে মৃত বক

জিয়া হক 

হাত একটি প্রতিষ্ঠান


এই হাতে মলিনতা বাসা বেঁধে আছে, এই হাত ধরো
স্বর্গ থেকে দূর, তবে যাত্রাপথ ভালো
সোনালি অক্ষরে নাম চায় যারা কিছু গড়ে
গড় রক্ষা করে
ওই হাত অমলিন, ওই হাতে নেই কোনো সংক্রামক ব্যাধি
স্বর্গ থেকে ওই হাত এক হাত দূরে
স্নান করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে যেতে আঙুলেই বসো
অনেক আঙুর, পিত্তলমূর্তি, মাংস ও প্রজাপতি ছুঁয়েছে ওই হাত
উহাকেই প্রতিষ্ঠা, ধরো, অবলম্বন করো

জিয়া হক
চিত্রী: অনুরিতা দাস 

দিন বুঝি শেষ


আমার এই নাট্যালয়, যতটুকু কাব্যরঙ্গ আমি, শেষ হল বুঝি?
গন্তব্য দেখা যায় বুঝি?
অতিপক্ব ফল থেকে দানার ধারনাগুলি ঝরে এলো বুঝি?
জানালা, শার্সি সব একে একে নিভে গেল বুঝি?
কান্নার পর্যাপ্ত কয়লা অবশিষ্ট রইল না বুঝি?

কিছুই বুঝি না
লেজকাটা, পা-হীন কুকুরটি হাঁটিতেছে শুধু
আমার এই পুঁটলি ও না-বোঝার পাশে

আমাদের ছায়া মিলে যায় 

আত্মীয়তাবোধ


........................................
নিঝুম গাছ, পাতা থেকে সবুজ সরিয়ে রাখে পাশে
লোক আসে, তার কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নেই, পাপী
যেহেতু দুপুর, আলো পড়ে অনেক উপর থেকে নিচে
ভেঙে যায়,
সংরক্ষা করে রাখে কেউ, পরিপাকা হয়ে ওঠে ফল
এই সুবিন্যস্ত মাঠে নেই গরু কিংবা কৃষকের মেয়ে
                                                     এত গাছ
                                                     তবু যেন
                                                     গাছগুলি
                                                     একা
পাতা সব করে রব, তবু যেন
আত্মীয়তা তাহাদের নাই
নদীদের প্রিয় খাদ্য গ্রাম, তারপরও
লোককথা তাদের অজানা 

প্রসূন মজুমদার-এর তিনটি কবিতা

 এই অসময়

 এখন স্তিমিত সব সুর।  ঝর্ণাধারা। নিরীহ যাপন।

বন ও বন্ধন থেকে রক্ত ঝরে। কাদামাখা মাথা

লাফ দিয়ে শিকারি সিংহের দ্রুততায়

দিগন্তে মিলায়। শুধু দুটো একটা ম্লান, প্রবীণ ভিখারি

তুখোড় স্পর্ধায় একা গোটা একটা দেশ হয়ে রাস্তায় দাঁড়াল।

এরও পরে সামান্য বাতির মতো আলো, ঝরে থাকে

সজিনার ডালে ও পাতায়, আলো নয় শুঁয়োপোকা

ধীরে ধীরে ছালের ভিতরে সরে যায়।

প্রজাপতি হবে ভেবে অপেক্ষায়, অলস প্রহর

দেখে নিম্নে শৃগালেরা অন্ধকারে সন্দিগ্ধ আঁচড়

রেখে চলে গেছে জাহান্নমে, বাকি যা, রুধির

মাটির সোঁদায় মিশে, অতিকায় ভবিতব্য, ঘ্রাণঘর্মে মিশে যাচ্ছে, ধীর।



পলাতক

কোথাও যাওয়ার নেই তাই যে তোমার ছায়ায় রয়েছে

অন্য কোন ছায়া পেলে মুহূর্তেই মিলাবে ছায়ায়।

বাস্তবতা সে যেমন অনুপুঙ্খ জানে, তুমিও তেমনই।

আমি শুধু ছায়ার ওপারে কবন্ধ - কৌতুক খুঁড়ে, সরে সরে যাই।


ছায়াবাজি দেখি, হাসি , ধীরে ধীরে ভারকেন্দ্রহীন মৃত নক্ষত্রে হারাই।



অন্ধকার অথবা নির্জন

এক সূর্য অন্ধকার, নদীর আড়ালে ভেসে যায়।

ভাঁটার বিবর্ণ স্রোত। দুটো একটা মৃতদেহ।

পাখির বা গাছের অথবা অসুখী কোন বিষণ্ণ পাতার।

এই দৃশ্য বাস্তবিক, কল্প মনে হয়।

সূর্য - এর আড়ালে নদী বয়ে ভেসে যাওয়ার সময়

রুপোলি আগুন জ্বলে, কিছুটা চিতার মতো, কিছু বিপ্লবের।

শব্দের ভিতরে যত নির্জনতা, আলস্য ভাঙার ঢং-এ

দিগন্তে ছড়ায়।




গৃহদাহের দিনে : জিয়া হক



চেয়েছি রাত্রি, রাত্রির কাছে সমতার সাদা পদ্য
ফুটেছিল চাঁদ, আকাশের গায়ে, ডুবে গেল ইহা সদ্য
শিশু ও কুকুর, খুকুর কান্না বনজঙ্গলে বাজে
পরিবার নিয়ে পারিবারিকতার যাবতীয় হীন কাজে—
ব্যস্ত ছিলাম, এই কথা বলে জলে ডুব দিল তারা
ভাসতে ভাসতে বাড়িগৃহডোর বদলে ফেলেছি পাড়া
কুশপুতুলের আগুনে আমার মুখ পুড়ে যায় দেখি
সহজ লোকের দিন ফুরোবার সূর্য ডুবল সখী?

ভুল লোক


কাহিনিতে মজে গিয়েছি। যে-কোনও গল্পই এখন আকর্ষণ করছে। এই গল্পগুলো কিন্তু আমি যে পাঠ করছি, এমনটা নয়। মূলত শুনছি। আন্তর্জাল বিস্তর সুবিধা প্রদান করেছে। তার নির্মিত কারাকক্ষে কার্যত বন্দি। এই অবস্থানটাই একটা ঘেমো দুঃস্বপ্ন। অথচ এই ঘুমের মশারি কেটে বেরিয়ে আসতেও পারছি না। কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। কী সংশোধন হল আমার, বুঝতে পারি না। বরং এক শোধন অযোগ্য কূপের বাসিন্দা হয়ে পড়ছি ক্রমাগত। ভেবেছিলাম, কাহিনির জন্মস্থান হবে আমার মন ও মানস। বাস্তবতা ভাবনার সহযোগী নয়, বলা বাহুল্য। নিজেই একটা মুখরোচক কাহিনি হয়ে উঠছি। কারও সান্ধ্যবাসরে দুঃখ-উদযাপনের বিষয় হতে পেরে ভেঙে পড়ছি। দুঃখের আলোচনাবিহীন আসর বরফশূন্য মেরুপ্রদেশের মতোই অপূর্ণ। চাই না গলে যাক তুষারপর্বত, কিন্তু আমাদের কর্মপরিকল্পনা আমাদের চিন্তার সত্যতার সাক্ষ্য দেয় না। কাঠের পালঙ্কে বসে বৃক্ষছেদনের বিরোধিতা করা এই মানুষ চোখের জল ফেলাকে আনুষ্ঠানিক করে তুলেছে। ধ্যান আত্মার জন্য নয়, চিত্রগ্রাহক যন্ত্রের জন্যে। প্রসাধন-প্রীতিই প্রমাণ করে আমরা নিজেদের স্বাভাবিকতাকে কতটা ঘেন্না করি। বাক্যেরও প্রসাধন হয়। তাই ভুল লোককে নির্বাচন করে ফেলি। 

মাইনর-নারী


সসম্মানে পরগাছা ফুটেছিল দেহে
অশত্থ, বটের ছায়া আর কিছু অনুকম্পা বেয়ে
এসেছিল দুর্দিনের দিন
ফুলভক্ত গণরাশি আগাছায় ভক্তিবিহীন
ফলত সে পুড়ে যায় উনুনের ঘৃণার আলোকে
আহত কি হয় কেউ ঘাসেদের মৃতজীব-শোকে?
বন্ধ হয়ে যাবে তবে হিতবাদী পাঠশালার ঘর?
নেমে যেতে থাকে শুধু সামাজিক, একা জলস্তর

ভগন্দরের দেশ : জিয়া হক

আমার মনকে একটু করে সরল বাক্যে ভরিয়া দিন
ও পরিপন্থাবিহীন
মনোরোগী সুন্দর, —বলে না কেউ, যাদেরকে চিনি
গবাদিপশুসম প্রাণী
ভাবে এই লোকালয়, লোকেদের সুশীল বন্দর
মুখ যার কবেকার জীর্ণ ভগন্দর
জামা ওড়ে পাল তোলা গাড়ির মতোই
এ লুডো সাপের দেশ,
                        বিরল নারীর মতো বিরল দড়িগাছা, মই
উঠে সব যেতে চায়, —দূরদেশে, অন্তত বাস
টার্মিনাসের পাশে
ঘাসেরা কাব্যে থাকে, পিচ ঢাকা দিয়ে যায় ঘাসে

Under twelve : Zia Haque


Oh dear God
Open the secret window of mind
Mind that seeks answers to many questions
Kept as mystery
We want our caged birds to sing the way we sing
We confine the winged creature and
Talk about our freedom
Sing like trees who are perplexed but still
Draw the shadows around her
So that we can befool the birds 

একটি কবিতা : জিয়া হক


খুকুর দেশ
...............
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গান
পার হয় দেবতারা, —
               ভক্তি ও শিষ্যের সন্ধান
কখন সন্ধ্যা হবে, লম্ফ কখন যাবে ভেসে
জেগে উঠবে পড়শিবাড়ি, —
                            শাস্ত্রের প্রাচীনা সন্ত্রাসে
ভোর হল, দোর খোলো, খুকু,—খুকুমনি
তোমাকে আদর করবে
           আপেল বাগানের অভুক্ত সেনানী

এসেছে শকুন আর নক্ষত্রখচিত সেনাপতি
সে চায় দেশপ্রেম,
                      এক-শয্যা জাতিসেবা —রতি 

তুমি, তুমি ও গোরস্থান : জিয়া হকের কবিতা


যদিও তোমার গল্পকে চুমু খাই, অবলম্বন করি
খসে যাও, ভেসে যাও, এমনভাবে হারাও যে
পুরনো পকেটগুলো ধোঁয়া আর বরফ ছাড়া
কিছুই রাখে না।
তোমার গল্পে যে-চরিত্র পেয়ে থাকি আমি,
যে-বাক্য নির্দেশ করে আমাকে
ও যে কবরস্থল, আমি তার পাশ দিয়ে যেতে ভয় পাই
ভালোবাসা চৈত্রের শেষে সাড়ে তিন হাত প্রাসাদ দিয়েছে

যেমন লেখাও তেমন লিখি


আমার ছলনা যাত্রা কোন পথে হারালো এখন
বন্য প্রাণী দেখে বুঝি এমন অরণ্য আমি চাই
বহুদিন ধরে
গাভী শুধু নয়, রাখালের গর্ধভেরও পরিচর্যা হবে
সকল পশুই ওই কচি ঘাস সুপ্রভাতে চায়
ঘাসে হোক সুবিচার,
            রাজা কি নামাজপাঠে গেছে?
দেশের প্রয়াণ যদি আসন্ন হয়, তবে
তুমি কি সেনানী হবে? ভ্রমণে পাকিস্তান যাবে?
সব দেশ বাদ রেখে এই যে পাকিস্তানই উল্লিখিত হল,
প্রিয় দেশ এভাবে বলেছে,
আমি তা অতিক্রম করে দেশদ্রোহী হবো?
আমার মায়ের রান্না করা মাংসের প্রশংসা করো আর
আমার মাংসও তুমি সমিতিতে চাও, আমি জানি

দেখো, লিখতে চাই তো কিছু প্রেম, কিছু প্রাকৃতিক কথা
রাষ্ট্র আমাকে দিয়ে কী সব লেখায়, দেখো তুমি
সহিংস তপোবন কারিগর গড়ে,—রাজধানী, প্রত্যন্ত অঞ্চলে
এসো সখী, মন খারাপ, চুমু দাও, ভালোবাসা নাও,
হে আমার পাখি, দুলে ওঠো দ্বৈত পুষ্প —
এইসব লিখতে পারি না।
এও জানা গেছে, ভালোবাসা কুমড়োর দানার মতো
ছড়িয়ে দিতে হবে, এতে শান্তি, গণহত্যা চুপ হয়ে যাবে

কৃষিকাজই করি যদি সুসময়ে বৃষ্টি এসে যেতো

জিয়া হক 

প্রতিটি মানুষ আলো দেয় : জিয়া হক

আহা, আজ, আহা, সেই পাখিটা কোনো পেয়ারা গাছের মরণোন্মুখ ডাল থেকে ডাকছে।
তিনি নিকটেই আছেন।
ওই পাখি আমার সব স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসেছে।
তিনিও এসেছেন। আরোগ্য এসেছে।
ছাদ আমাকে নক্ষত্র দেখতে বাধা দেয়, তবু আমি
একটা ছাদ চেয়েছি, চেয়েছি ছাদের তলায় সব জীব।

সূর্য নয় শুধু, প্রতিটি মানুষ আলো দেয়।
প্রতিটি লোকের চারপাশে প্রত্যেকে ক্রমান্বয়ে ঘোরে।
গ্রহাণুপুঞ্জের কথা জানি?
নবদ্বীপ থেকে ধরো এই আমার ঘর,—
এর মধ্যে কত লোক, লোকান্তর, মৃত্যুজন্মবিয়ে
এসবই ছায়াপথ, আমার বিশ্বাস

ভিজিয়ে দেয়, স্পর্শ করে না


এই বৃষ্টি আমাকে স্পর্শ করছে না।
শুধু ভাবছি, আমি কী হতে চাই।
কী হতে চাই, চেয়েছিলাম
পুরনো হাতে আমি মুখ রাখি
নিজের আশ্রয় আমি নিজে হব, ভাবি
শ্রোতা হয়ে জীবন কাটাবো, ভাবিনি কখনও
অপরাধী আমার কাছে তথ্য রাখে, অপরাধ —
সেও কিছু রেখে যায় তথ্যসদৃশ
রটে গেছে আমি ভালো লোহার সিন্দুক
নীরবতা পালনেই আমি ভালো অভ্যস্ত আছি
বাদামের, মুড়ির, চায়ের বিনিময়ে আমি
অশ্রাব্য গানও শুনে যেতে পারি
কেননা আমি ভুলে গেছি, কী হতে চাই,—
কথা ছিল কী কী হওয়ার
বৃষ্টি তাই ঝরে পড়া তীরবেগে জল
ভিজিয়ে দেয়, স্পর্শ করে না 

শেখো : আফগান কবিতা : আবদুল্লাহ


পাপিয়ার মতো সুরারোপিত বাক্য বলতে শেখো,
ফুল ও পাপিয়ার নীরব আলাপ কীভাবে ঘটে, শেখো
মাথা ঢেকে ফুলের অরণ্য থেকে বের হও,
শিখে নাও হাওয়ার ভেতরে বাতাসের চলাচল।
কতদিন বাঁচবে পাখির মতো, পাখি হয়ে?
ওড়া শেখো মুক্ত ঈগলের মতো।
গতি বাড়াও, যাত্রীদল যাতে গতিপ্রাপ্ত হয় সে ব্যবস্থা করো,
গন্তব্য কাছেই।
শেখো ঘন্টাধ্বনি কীভাবে নিজেকে বিস্তার করে।
ও ফুর্তিবাজ আফগান! আরাম ছাড়ো, কষ্টকে নাও,
যে দেশ তোমার তার ব্যথা ও শোকে কান্নাকাটি শেখো।

আবদুল্লাহ
৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ 

আত্মা-হনন


জীবন তখন অসভ্য
তাই
গাধার পিঠে ছুটছিলাম
আর
গাধাই এখন অসুস্থ
তাই
অন্য পশু —জয় শ্রী রাম

কৃষি আমার ভিত্তি
তবে
গোটা কতক পাশ ছিল
আর
গোবর গাদায় কী ফুল
যেন
আমার দেহ ভাসছিল



মফস্বলের গীতি


এই রাতে কি গান বাজবে বালিশের তীরে?
ঢেউ এসে লাগবে গতরে? এখন বসন্ত।
গাছে গাছে পাখি আর মাঠে মাঠে মানুষ।
এই মফস্বলেও দূর থেকে গ্রামীণ গাজনগান আসে।
গায়ক চিনি না, সুরে বড় ব্যথা।
এ তবে গাজন নয়, অন্য কোনো গান।
শুনি আর ভাবি যে মানুষ অনুভূতি দেশ থেকে আলো আর পায় না এখন, সে এক বিপুল অপচয়।
এমন রাত্রে পাহারাদার পথিক কুকুরের পায়ের আওয়াজও কী সঙ্গীতময়! পোকা ডাকছে।
এই সুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেয়ে আপাতত প্রিয়।
ডাকে আমার চিঠি পাঠাও —দাবি করো কেন?
যদি তুমি ঠিক ঠিক দাও, আমি তবে ঠিক ঠিক পাব।
এত রাতে ডাক বিভাগ খোলা?
পিওনের বিবাহ হয়নি?
তাকে কিছু লিখতে দাও বিছানা, বালিশে