অয়ন,প্রথমে
একটা চিরাচরিত প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি।তোর
কবিতা লেখার শুরুর ব্যাপারটা একটু বল।মানে
কবিতা লিখতে হবে এই দিব্বিটা কে দিল?
আলবেয়ার কাম্যু ফুটবল খেলতেন,
গোলরক্ষকের পজিশনে। একবার নিজের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, খেলা চলছে বিপক্ষের
অর্ধে। কাম্যুর মনে হল, জীবন এরকমই। শোনা যায়, এভাবেই জন্ম হল আউটসাইডার উপন্যাসের।
কবিতা আমার কাছে আকস্মিকভাবে এসেছে, কোনও পরিকল্পনা করে আমি কবিতা লিখিনি। আমি যা লিখি,
তা পড়ে অন্যরা বলেছে এগুলো কবিতা। আমার এরকম কোনও দাবি ছিল না, এখনও নেই। বলা যায়,
অন্যের মত মেনে নিয়েছি মাত্র। তাই কেউ যদি আমার লেখা পড়ে বলে যে কবিতা হয়নি, সেটাও
মানতে সমস্যা হয় না আমার। আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি,
অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। তার মাধ্যম কবিতা হলে কবিতা, গদ্য হলে গদ্য, দিনলিপি
হলে দিনলিপি, সিনেমা হলে সিনেমা।
তোর আগের
প্রজন্মের কোন কবি বা কোন কোন কবিকে
তোর প্রাথমিক পর্যায়ের লেখালেখির ভিতর খুঁজলে
পাওয়া গেলেও যেতে পারে বলে তোর বিশ্বাস?
আমি যাঁদের যাঁদের লেখা আজ
পর্যন্ত পড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের প্রভাব আমার লেখায় আছে। ছিল, আছে এবং থাকবে। শুধু
আমার আগের প্রজন্ম নয়, আমার পরের প্রজন্মের লেখাও, শুধু কবিতা নয়, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ
ভ্রমণকাহিনি ব্যক্তিগত চিঠি জীবনী সব সব। আর শুধু লেখা কেন, আমি যাঁদের যাঁদের সংস্পর্শে
এ জীবনে এসেছি, সে আমি তাঁদের পছন্দ করি বা না করি, যে যে ঘটনার অভিঘাত আমার জীবনকে
ছুঁয়েছে, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, সমস্ত কিছুর প্রভাব আমার লেখায় আছে। কারণ প্রত্যেক মানুষ,
প্রত্যেক প্রাণী, প্রত্যেক উদ্ভিদ, প্রত্যেক জড় অজড় বস্তুসমূহ, এই মহাকাশ, এই সমুদ্র,
এই বাতাস, এই নক্ষত্ররাজি, সবই আমার অভিজ্ঞতার অংশ, আর যা যা আমার অভিজ্ঞতার অংশ, সব
কিছুই আমার লেখায় থাকে। আমার ঋণ অপরিসীম এবং অপরিশোধ্য।
তোর লেখালেখির
প্রথম থেকেই আমি তোকে জানি।অসংখ্য লেখা
তুই সম্পূর্ণ মাথায় লিখেছিস প্রথমে,পরে
তা খাতায় টুকেছিস। একেক লেখকের এক এক
রকম পদ্ধতি থাকে। আমি শক্তির পান্ডুলিপি
দেখেছি,প্রায় কাটাছেঁড়া নেই।তোর লিখন পদ্ধতি
বা প্রক্রিয়াটা কি?
লেখা তো মাথাতেই তৈরি হয়। খাতাতে
লিখলেও মাথায় তৈরি হয়, কম্পিউটারে লিখলেও। আমার পাণ্ডুলিপিতেও কাটাছেঁড়া প্রায় থাকেই
না। কারণ লেখা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি সাধারণত খাতায় কিছু লিখি না। যাবতীয় বদল,
কাটাছেঁড়া, সংশোধন সংশোধন এবং সংশোধন, গোটা রান্নাঘরটাই থাকে মাথায়। পাণ্ডুলিপি হল
আমার খাওয়ার টেবল। ওখানে ম্যাক্সিমাম নুন গোলমরিচ সস প্রয়োজনমতও ছেটাতে পারি।
আমরা একটা
কথা শুনি।মহৎ কবিতা।এব্যাপারে তোর বক্তব্য কি?
তুই মহৎ কবিতা লেখার কথা ভেবেছিস, নাকি
কবিতা লিখে মহৎ হওয়ার কথা?
কবিতাই বুঝি না, তার ওপর আবার
মহৎ কবিতা! মহত্ত্ব বলে আছে নিশ্চয়ই কিছু, আমি সেসব টের পাইনি, খুব একটা আগ্রহীও নই।
ওসব যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগে, নিজের ভাগের শেষ জলবিন্দুটুকু বিপক্ষের মুমূর্ষু সৈনিককে
দিয়ে দেওয়া টেওয়া, আমার লেখালেখিতে ওসব নেই বলেই আমার আশা।
যিনি মার্গ
সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ, আমরা তাঁর নামের আগে
ওস্তাদ বা পন্ডিত বসাই। কিন্তু মান্না দে,
কিশোর কুমার, এঁরা যত বড়
শিল্পী হোক ঐ উপাধির অধিকারি নন।কবিতায়
যদি এরকম হতো।সমসাময়িক কোন কবির আগে ওস্তাদ
বসাতিস?নিজেকে ইনক্লুড করে উত্তর দিবি।
এসব উপাধি বসানোর রীতিতে বিশ্বাসী
নই, তবে তোর প্রশ্নের মূল স্পিরিটটা বুঝতে পেরেছি। আমার সমসাময়িকদের অনেকের লেখাই আমাকে
মুগ্ধ করেছে। কারোর কারোর গোটা গোটা বই, যেমন অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহিরিটোলা
আর সিঙ্গালীলা ঠাকুর, বিপ্লব চৌধুরীর সিন্ধু ও সমূহ , ভবতরঙ্গ আর মদ, শোভন ভট্টাচার্যর
ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি আর শনির জাতক, তোর লেখা মাথুর আর গুঞ্জাগাথা, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কলকাতার খোয়াব, প্রসূন ভৌমিকের বুয়া ও বাবুই,
সুদীপ্ত চক্রবর্তী, শুভাশিস ভাদুড়ি, সার্থক রায়চৌধুরি, রওশনারা মিশ্র, তপন রায়,
মণিশংকর বিশ্বাস, তাপসকুমার লায়েক, পারমিতা মুন্সি, তারেক কাজি, মিতুল দত্ত, কল্পর্ষি
বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, হিন্দোল ভট্টাচার্যর বেশ কিছু কবিতা, জয় মজুমদার
জ্যোতিপ্রকাশের বন্ধুরা নামে একটা কবিতা লিখেছিল, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিল মার
কাছে যাব নামে একটা কবিতা, কারোর কারোর অনবদ্য সব কবিতার লাইন ঝলসে ওঠে যেন, শুভাশিসদা
লিখেছিল, একটি সুবর্ণ রেখা পড়ে আছে নদীর কিনারে, রণজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছিল, সামান্য ঘুরেছে
হাওয়া পৃথিবীর শেষপ্রান্তে এসে, আবির সিংহ লিখেছিল, কোনও জাহাজই ডোবে না, আত্মহত্যা
করে, মুকুট ভট্টাচার্য লিখেছিল, টিকটিকির ধৈর্য নিয়ে বসে আছি মিরাক্যল ঘটার আশায়, সাম্যব্রত
জোয়ারদার লিখেছিল, অগাস্ট মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ শ্রমিকেরা কিছুতেই নিজেদের ভাগ্য
বদলাতে পারছে না, দেবাশিস কুণ্ডু লিখেছিল, কথকতা আবহাওয়া শাস্ত্রীয় গীতি/ অথচতা ডুমুরের
ফুল ম্রিয়মাণ / দেখেছি তো দেখেছি তো মিথ্যে প্রলাপ / হয়তো বা তোকে কারও আড়ালে দেখেছি!
সকলকেই আমার কুর্নিশ! অনেকের
নামই করা হল না হয়তো।
আমার ধারণা,
কবিতা লেখার পেছনে একজন কবিরএকটা বিস্ময়বোধ
কাজ করে।এই মহাবিশ্বে কী তোকে বিস্মিত করে?
এই মহাবিশ্বই আমাকে প্রতিনিয়ত
বিস্মিত করে। অভিশপ্ত মানুষ হল সেই, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা যার নষ্ট হয়ে গেছে। অনন্ত
নক্ষত্ররাজি থেকে ঘাসে পিঁপড়ের চলাচল, সব আমাকে বিস্মিত করে। ফ্লাশ গর্ডনের কমিকসে
একটা লাইন পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম, এই পৃথিবীর একটা গাছের ডাল ভেঙে দাও, সুদূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ
পর্যন্ত কেঁপে উঠবে!
প্রতিভা, সাধনা।নিজের
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কাকে এগিয়ে রাখবি?
প্রতিভা, প্রিভিলেজ এবং সাধনা,
এই তিনটেই জরুরি। কে বলতে পারে, বীরভূমের আদিবাসী গ্রামে, বা রাজাবাজারের বস্তিতে হয়তো
এমন কেউ কেউ আছে যারা কবিতা লেখার, কবিতার জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগই পেল না।
প্রতিভা তাদের ছিল, সাধনার ক্ষেত্রও হয়তো প্রস্তুত ছিল, যোগাযোগ ঘটল না শুধু। তিনটেই
না থাকলে, বাকি দুটো দিয়ে বড় কোনও কাজ হয় না।
তোর কবিতার
লাইন, কবিতা বন্ধুরা লেখে আমি শুধু বাহবা
ছুঁড়েছি।এই ভাবনা থেকেই কি গান্ধার পত্রিকা
করতে আসা?আজ কি মনে হয়, অই পত্রিকা
করা,সম্পাদনা করা, তোর নিজের লেখালখিকে
কি কোনো ভাবে সাহায্য করেছে?
ঐ লাইনটা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে
খানিক রাগ থেকে লেখা। পবিত্র ক্রোধ। গান্ধার আমি সম্পাদনা করার আগে থেকেই ছিল। সৌরভ
পাণ্ডে, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ সেনগুপ্ত মূলতঃ কাগজটা করত। এছাড়া সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়,
দীপঙ্কর বাগচী, তাপস দততো এরাও যুক্ত ছিল। গান্ধারের লোগো দু’বারই এঁকেছিল সাম্যব্রত
জোয়ারদার। ওরা সস্নেহে আমাকে গান্ধার ছিনিয়ে নিতে দিয়েছিল। আর পত্রিকা সম্পাদনা করা
অবশ্যই লেখালেখিকে সাহায্য করেছে, কারণ আগেই বলেছি, কোনও অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না।
একটা গান
আছে।শুকনো সাধু করিস নে মা রাখিস আমায়
রসেবসে। আমি জানি যে তুই শুকনো সাধু
নোস।বিরাট একটা রসিকতাবোধ সব সময় তোকে জড়িয়ে
থাকে।এই রসবোধ ব্যাপারটার সাথে সিরিয়াস কবিতার
কি কোনো আপাত বিরোধ আছে?
বিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। রসবোধের
সঙ্গে জীবনধারণের সম্পর্ক আছে। যার রসবোধ নেই, সে ঠিকঠাক বেঁচে নেই।
প্রথম, দ্বিতীয়,
তৃতীয় বই। একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ে
যাবার আগে পূর্ববর্তী লেখাগুলো নতুন যে
লেখা আসতে চলেছে, তাকে কি বলে সাবধান
করে?
ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। আমার
জীবনে ম্যাজিকাল থ্রি ওয়ার্ডস আই লাভ ইউ নয়, সেটা হল ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। কিছু লেখা
একটা বইতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, হতে চেয়েছে মানে তাদের একটা জার্নি আছে, জার্নির একটা
শুরু আছে, একটা শেষ আছে, জার্নির একটা পূর্ণতা আছে। জার্নি পূর্ণ হল মানে এবার নতুন
কোনও পথে হাঁটো। সেই পথে তোমার হাঁটার ধরণের সিগনেচার অবশ্যই থাকবে, তুমিই যে হাঁটছ
সেটা বোঝা যাবে, কিন্তু পথ, পথের দু’ধারের দৃশ্যাবলী, অভিজ্ঞতাসমূহ অন্য হবে।
প্রত্যেক কবির
ক্ষেত্রেই তাঁর জীবনযাপন তাঁর লেখাকে প্রভাবিত
করবেই। আমার জীবনের ঘটনা আমার লেখাকে প্রভাবিত
করে। কবিতা কি কখনো জীবনকে প্রভাবিত করেছে?
আমার লেখা আমার জীবনে নির্ণায়ক
ভূমিকা নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। বাকি কথা অপ্রকাশ্য।
জীবন তোর
কাছে কী? মৃত্যুকে তুই কিভাবে দেখিস?
জীবন অনিশ্চিত। মৃত্যু অনিবার্য
। অন্ধকার থেকে এসে ফের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। মাঝে কিছু নক্ষত্র রাতের গান।
কয়েকজন আছেন,
যাঁরা পরিচালক এবং কবি। বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত
তাঁদের একজন।কিন্তু এরা প্রায় প্রত্যেকেই কবি
হিসেবে যত না উল্লেখযোগ্য, আমার ধারণা পরিচালক
হিসেবেই গ্রহণযোগ্য বেশি। তুইও পরিচালক
আর কবি। তুই সিনেমা আর তোর কবিতার
মধ্যে সম্পর্কটা কি ভাবে দেখিস?
খুবই দুঃসম্পর্ক। সিনেমা বানাতে
অনেক টাকা লাগে। যে টাকা আমার নেই। ফলে ইনভেস্টর নামক একজনকে প্রচুর কিছু বোঝাতে হয়।
তাঁরও কিছু চাহিদা থাকে। লেখালেখির এসব দায় নেই। এটাই তফাত।
আমার একটা
ব্যাক্তিগত মতামত আছে তোর দ্বিতীয় বই তুমি
সম্পর্কে। আমি মনে করি ' তুমি' তোর
শ্রেষ্ঠ বই। কিছু লেখা হয় যা পাঠককে
শান্তি দেয়। কিন্তু এই বইটায় যন্ত্রণার
সাথে একটা ছটফটানিও মিশে আছে,একটা অদ্ভুত
অতৃপ্তি বলতে পারিস। তোর কী মনে হয়?
তুমি একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে
লেখা। অসম্ভব যন্ত্রণাসঞ্জাত ঐ বই। মনে হয়, তোর পাঠ সঠিক। লেখার সময় আমার ভেতর কষ্ট
যন্ত্রণা বিষাদ অপরাধবোধ অতৃপ্তি অক্ষম ক্রোধ , এই সব আবেগ অনুভূতিই অতি অতি তীব্র
মাত্রায় ছিল। সেসব অনুভূতি লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে সঞ্চারিত হতেই পারে।
বিষণ্ণ রূপকথা
তোর সাম্প্রতিক বই। মাঝখানে অনেকদিন চলে
গেছে। দীর্ঘ বিরতি। কবির জন্যএই বিরতিগুলোর
কি খুব প্রয়োজন? কবিতার বিচারে
বিষণ্ণ রূপকথাকে আমার কেমন যেন একটা উদাসীন
কবিতাবই বলে মনে হয়েছে। মানে, যে বিষণ্ণতা
আছে, তা তেমন যেন গ্রাহ্য নয়।আমি কি
ঠিক?
আমি যেহেতু চেষ্টা করে লিখি
না, তাই বিরতি বিষয়টাতেও আমার হাত নেই। লেখার অনুশীলন চালিয়ে গেছি। তুমির পর যে নতুন
পথ দেখতে চাইছিলাম, সেটা যখন দেখতে পেলাম, তখনই বিষণ্ণ রূপকথা এল। বলা যায়, বিষণ্ণ
রূপকথার জন্য একটা অন্বেষণ ছিল, তার জন্যই বিরতি প্রয়োজন ছিল।
তুমির বিষণ্ণতার তীব্রতা বিষণ্ণ
রূপকথাতে এসে স্তিমিত হয়েছে। বিষাদ এখন অনেক শান্ত, স্তিমিত, পরিব্যাপ্ত। এই বিষাদ
হয়তো খানিক সুখকর। সুখ এখানে উপশম অর্থে ব্যবহৃত। তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে
কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধে নিজেকে সঁপে দেয়ার যে সুখ, সেটা। তুমির বিষাদের তল দেখতে পেতাম।
বিষণ্ণ রূপকথায় সেটা পাই না। বিষাদ এতই নিত্যসঙ্গী। বন্ধুই বলা চলে। বিষণ্ণ রূপকথায়
উদাসীনতা নয়, অবসাদ আছে। তুমির বিষাদের তীব্রতায় আমি হারিয়েই যেতাম, বহু যত্নে অদিতি
আমাকে বিষণ্ণ রূপকথায় নিয়ে এসেছে। ওর সহ্যশক্তি অতুলনীয়।
প্রথম সিনেমার
জন্যই ফিল্মফেয়ার পেয়েছিস। এতোগুলো বই লিখেও
এখন অবধি কোনো পুরস্কার পাসনি। তাহলে কি
পরিচালক অয়ন কবি অয়নকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে
ক্রমশ?
এতে প্রমাণিত হয়, এই বাংলায়
যতজন যোগ্য কবি আছেন, ততজন যোগ্য চিত্র পরিচালক নেই। আর কে পেছোচ্ছে, কে এগোচ্ছে জানি
না, নতুন লেখা লিখছি, আশা করি সামনের বছর বই হয়ে বেরোবে। বইয়ের নাম, নক্ষত্র রাতের
গান।
নিজের দশক
সম্পর্কে তোর মূল্যায়ন কী?
কবিতার কোনও দশকওয়াড়ি মূল্যায়ন
হয় না। মাইকেল কোন দশকের কবি ছিলেন? রবীন্দ্রনাথ? জীবনানন্দ? আমারও কোনও দশক নেই। আমার
কিছু বন্ধু এবং কিছু পরিচিত কবি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ দেশ পত্রিকার উমেদারি করে সময়
নষ্ট করেছেন, কেউ বিরোধিতা করে, দুটোই কর্মনাশা। কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের তাঁবেদারি
করে সময় নষ্ট করেছেন, কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের উপহাস করে, দুটোই অনর্থক শক্তিক্ষয়। কেউ
কেউ নীরবে লেখা অনুশীলন করেছেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁরাই আমার বন্ধু।
তোর বিভিন্ন
ফেসবুক পোস্ট এ রাজনৈতিক অয়নকে পাই। কবিতায়
সেভাবে পাইনা কেন?রাজনৈতিক অয়ন সম্পর্কে
বল।
আমার লেখায় রাজনীতি থাকে। কারণ
কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। এক্ষেত্রে পার্টি পলিটিক্সের কথা হচ্ছে না। হ্যাঁ , সেইসব
লেখা হয়তো নিকানোর পাররার মতো কী সমর সেনের মতো সেই অর্থে রাজনৈতিক লেখা নয়। ফেসবুকে
লিখি না, কমেন্ট করি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে। আর রাজনৈতিক অয়ন হল, বিশ্বাসে বামপন্থী,
প্র্যাকটিসে নয়, অর্থাৎ ভণ্ড।
প্রাচীনকালে কবিকে
ঋষি বলা হত। কবি মানেই তিনি সত্যদ্রষ্টা। আধুনিককালে
এই কথাটা কতটা সত্যি?
ঋষি আর কবির মধ্যে এক সুতোর
তফাত আছে। দু’জনেই বিশুদ্ধতা খুঁজছেন। যতক্ষণ পাচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি কবি, পেয়ে গেলে
ঋষি। তবে কোনও কোনও কবি বিশুদ্ধতা নামক পরশপাথর পেয়েও ফেলে দিয়ে ফের খুঁজতে থাকেন,
কেবল খোঁজার মজাতেই। এঁরা দুষ্টু প্রকৃতির কবি।
পাঠক অয়ন
চক্রবর্তীকে মনে রাখবে কি?
কী বলছিস এসব! মহাকাল বিরাট
বিরাট ব্যাপার ভাই! এই মহাকালের রথের চাকায় মহাভারত কে লিখেছিলেন, তিনি একজনই, নাকি
অনেকে মিলে লেখা, তা আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। শেক্সপিয়ারের নাটক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে,
তা কি আসলে শেক্সপিয়ারেরই লেখা? সেখানে ব্যক্তি অয়ন কে! কেউ নয়। কিচ্ছু নয়। কোনও মানুষকে
মহাকাল মনে রাখেনি, মনে রাখতে দেয়নি, মনে রাখতে দেবে না। কিছু কীর্তি অন্য কীর্তির
তুলনায় কিছু বেশি দিন টিকবে। তার মধ্যে আমার লেখা থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্নের উত্তর
দেয়ার মতো গনৎকারের টিয়াপাখি আমি নই, হতেও চাই না।
শেষ প্রশ্ন। আমি
তুই দুজনেই টেলিভিশনে কাজ করেছি।আমরা জানি,আজকের
দিনে ইন্টারভিউ দেওয়া আর নেওয়া দুটোই অনেক
সহজ। কবিতা গান সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু আগেকার
দিনে তা ছিল না। রফি সাহেব,কিশোরকুমার
সহজে সাক্ষাৎকার দিতেনই না। কিশোর মাত্র
তিনবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।একবার আমিন সাহানিকে,
একবার প্রীতিশ নন্দী চেয়েছিলেন, কিন্তু কিশোর
তাঁকে বলেন যে তিনি দিতে পারেন তবে
প্রীতিশ নয়, কিশোরকুমারকে প্রশ্ন করবেন কিশোরকুমার
নিজেই। তাই হয়েছিল তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন
করেন আর উত্তর দেন।আর তৃতীয় সাক্ষাৎকারটি
তাঁর কাছে চাওয়া হলে তিনি বলেন, দেবেন
যদি লতা মঙ্গেশকর নেন।তাঁরা লতাজিকে বলেন
আর লতাজিও রাজি হন। সেই ইন্টারভিউর কিছু
অংশের ভিডিও পাওয়া যায়। এত কথা বললাম
কারন শেষ প্রশ্নটা আমি চাই তুই নিজেই
নিজেকে কর।উত্তরও দে।
প্রশ্ন : কবিতা না লিখলে কি
আমার মৃত্যু হবে?
উত্তর : হ্যাঁ ।
প্রশ্ন করেছেন : কবি জয়দীপ রাউত