নভেম্বর ২৫


 

দুঃখ করিব পান
যেমন বিস্ময়
বয়ে যায় বনের ওদিকে
ছাই হওয়া দিন আছে ঝরোঝরো মুখে
মুক্তো ঝুটা হ'ল
দিনভর রাত্রি-জাগরণ
দিনভর রাস্তা রাস্তা খেলা
পের হয় দুক্ষী আর দুঃখ বসে থাকে
পানপাত্র রচিবে সঙ্গিনী
এটাই কি সেই দোকান
যারা দুঃখ ব্যবসা করে

আজ আকাশ হ'ল ছোট
যেন গর্তে পড়া মাছি
যেন ছড়ানো আছে মাদুর
বড় ঘুম পেলো কি আজ

জিয়া হক

মহল্লার নাম আরশ : জিয়া হক

 গত বছর শীতে কী ঘটেছিল আমার জীবনে, মনে নেই। কার সঙ্গে হাতাহাতি করতে গিয়ে মাড়ি কেটে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, মনে নেই। রেস্তোরাঁয় কি আদৌ ঢুঁ মেরেছিলাম বন্ধু জুটিয়ে? মনে নেই। টিকিট কেটেও মহিলা কামরায় ওঠার জন্য ৪০০ টাকা জরিমানা হয়েছিল কিনা মনে নেই। শুধু মনে আছে, তোমার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল আমার। একবারও তোমার দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যাইনি। তাকাইওনি। 


একদিন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল আর পাখিরা মেঘের ভেতর দিয়ে ভাসছিল আর আমার কোথাও ফেরার ছিল না বলে উলু ভর্তি মাঠে একা বসে বসে ট্রেনের যাতায়াত লক্ষ করছিলাম। ঘন্টায় দুটো ট্রেন। ট্রেনের ভেতরে লোক, গায়ে লোক, মাথায় লোক, দুই বগির মাঝখানে লোক। গোটা গ্রাম যেন শেকড় উপড়ে শহরে চলে গিয়েছিল। আমাদের শহর। দূর থেকে দেখতে প্রাসাদের মতো মনে হয়, অন্তরটা ফোঁপরা। 


ভেবেছিলাম, তোমার বাড়ি না গিয়ে এখানে কেন অপরাধীর মতো নিজেকে আড়াল করে ঘাপটি মেরে বসে আছি। ভেবেছিলাম। অন্তত হাতমুখ ধোয়ার লোটাভর্তি জলটুকু তো মিলত। সঙ্গে সেই লাল গামছা। আমি, তুমি, অনেকেই ওই লাল গামছাটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, জানো? ভাদ্রে স্থলভাগে হাওয়া ক্ষীণ হয়। ফলে জামা ভিজে উঠছিল ঘামে। কেউ যেন এসে তালপাতার পাখার বাতাস করতে করতে জীবনের মানে ব্যাখ্যা করে শুধোবে, তাহলে তুমি কোন পথটা বেছে নিলে? 


এত হুটোপাটির মধ্যে পথ বেছে নিয়ে পদব্রজে বেরিয়ে পড়া কি সম্ভব, বলো? ছিঁচকাঁদুনে বাচ্চার মতো কখনও বলেছি, আমার সঙ্গে মিলবে এমন একটা পথ আমায় এনে দাও যেখান থেকে পারো? সূর্য অস্ত গেল। যারা পানিফল চাষ করে তারা দূরের দীঘির পাড়ে বসে ধূমপান করতে করতে ফলনের অঙ্ক কষছিল বলে মনে হয়েছিল। হয়ত তা নয়। কে কোথায় কী ভাব ধরে বসে আছে তা জানবার উপায় জানা নেই। আকাশে তারা ফুটল। দিনের দেবতা আর রাতের দেবতারা এখন জায়গা অদলবদল করবে। যখনই তারাভরা আকাশের দিকে নজর গেল তখনই মনে হল, কত পুরু অন্ধকার ছিঁড়ে ওই আলো বসানো জাজিমে পৌঁছালো চোখ! কিন্তু শেষ অব্দি গেল তো সে! এইসব কথা তোমাকে বলতে পারি না পাছে তুমি ভাবুক ভাবো আমায় আর এরপর থেকে সবার সব ভাবনার ভার চাপিয়ে দাও আমার ছোট্ট মাথার ওপরে। আমার অকল্যাণ হোক সেটা তুমি চাও না কিন্তু আমার কিসে কল্যাণ তা তুমি আমাকেই ভেবে দেখতে বলো। খুব রাগ হয়। মনে হয়, আর কখ্খনো যাবো না তোমার দরজায়। মুখ দেখাব না। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে সরু গলি বেয়ে বড় রাস্তায় উঠে ভিড়ের মধ্যে মিশে হারিয়ে যাব। রাত বাড়ছে। 


একদিন নৌকোয় যাচ্ছিলাম। তুমিও পাশেই কোনও এক নৌকোয় ছিলে। ভুতুড়ে এক হাওয়া দিচ্ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। নাকি উত্তর-পূর্ব! আমার গা ছমছম করছিল না, শুধু ভাবছিলাম তোমার গা ছমছম করে উঠছে না তো! জলের তোড়ে দুলে দুলে চলল আমাদের দুই নৌকো। তোমার নৌকোর মাঝির গান আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। দরদ ছিল। আমার মাঝি সুরেলা নয়। গানও জানে না। দায়ে পড়ে মাঝি হয়েছে। তারা চোদ্দ পুরুষ চাষী। চাষী মাঠের গান, মাটির গান জানে। মাঝি জানে জলের গান। 'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে, অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে'। এই কথা দরিয়ায় এলেই আমার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে তোমার কথা। তুমিই যেন দরিয়া হয়ে আগাপাশতলা বয়ে চলেছো। গা ভেজে, মন ভেজে না, কারণ তোমার যাত্রাপথ অজানা, যেখানে নামি সেখানে অতটুকু পাই, সবটুকু মেলে না। তারপরও তুমি পাশের নৌকোয় ছিলে। 

জিয়া হক 

সচরাচরিত : জিয়া হক

 কুতুহলে লক্ষ করি সব। 

জগৎ ফুটিয়া আছে আনাচে কানাচে। 

ফুল রচে মাটির দেবতা। 

পতঙ্গ সম্মান বয়ে নিয়ে যায় পুষ্প-পল্লীতে। 

বুঝিলাম, এ জীবন অন্যায্য নয়। 

হারাবে হারাবে করে থেকে যায় প্রতিষ্ঠা যেখানে। 

মরিতে মরিতে তারা পরিবার রচে। 

গোরস্থানের পাশে শ্মশান, সমাধি তবু বিস্তীর্ণ 

ক্ষেত্র জুড়ে পেকে ওঠে ধান্যজীবন। 

স্নেহময়ী রাত্রির বুকে দিবসের সকরুণ 

মুখ দুগ্ধ পান করে। 

মরিবে মরিবে করে ঔষধ কেনে। 

শ্রোতারাই যেখানে গায়ক 

সেইখানে গান নয়, গায়কী প্রধান। 

বিমান সচল হলে দেখব বিমান—সেবিকা সন্ধ্যার। 

রচিতে রচিতে তারা নষ্ট করে ছবি। 

তবু ছবি। থেকে যায়। 

ময়লা আকাশে। 

র‍্যান্ডম রাহাত

 




সরকারের ভিখিরিপনায় করুণা আসে যে গরিবের ঘামের উপার্জনের অংশ চায়।

 শহরে বারুদের মরশুম। গ্রামে চলো এখন পেয়ারার মরশুম।

আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ছেয়ে আছে অনেকটা মনে হচ্ছে আর ওই লোককে পরও মনে হয়।

ওর সঙ্গে দেখার করার ইচ্ছাও অনেক কিন্তু যাতায়াতের খরচও মেটাতে হয় যে।

মুখ খোল, চোখে চোখ রাখ, জবাব তো দে, আমি কতবার লুঠ হয়েছি তার হিসাব তো দে।

তোর শরীরের লেখায় চড়াই-উতরাই রয়েছে, আমি তোকে কীভাবে পড়ব, আমাকে বই তো দে। ফয়সালা যা কিছু হোক, মেনে নিতে হবে। যুদ্ধ হোক, বা প্রেম হোক, ভরপুর হতে হবে।

আর বয়স যাদের পাথর ভাঙতে ভাঙতে কেটে গেছে এখন তো তাদের হাতে কোহিনূর হওয়া উচিত। আমি আমার প্রাণের শত্রুকে প্রাণ বলি আর ভালবাসার এই মাটিকে হিন্দুস্তান বলি।

দেওয়ালের এই যে ঘুলঘুলি তা ষড়যন্ত্রের অংশ কিন্তু একে আমি ঘরের আলোকবর্তিকা বলি।

যা দুনিয়ায় শোনা যায় তাকে বলে নীরবতা আর যা চোখে দেখা যায় তাকে তুফান বলে।

আমার মন থেকে এক এক করে সব কিছু বিদায় নিয়েছে কিন্তু একটা জিনিস বাকি আছে তাকে ইমান বলে।

শুধু ছুরিতে নয়, চোখেও জল চাই।

ও খুদা, শত্রুও আমার বনেদি চাই।

আমি আমার শুকনো চোখ থেকে রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছি আর এক সমুদ্র বলে, আমার জল চাই। অন্ধকার চারদিকে সাঁইসাঁই করতে শুরু করেছে।

প্রদীপ হাত তুলে দুয়া করতে শুরু করেছে। নিয়ম শিখিয়েছিলাম যাকে চলার, সেই লোক এখন আমাকে হেনস্থা করছে।


রাহাত ইন্দোরি

মহানগরে কবি : কেদারনাথ সিং

 

 


এই এত বড় শহরে

কোথাও থাকে এক কবি

কুঁয়োয় যেমন কলসি থাকে সেভাবে থাকে

কলসিতে যেমন শব্দ থাকে

যেমন শব্দে থাকে ডানার ঝাপটানি

এত বড় শহরে ও থাকে

আর কখনও কিছু বলে না

 

শুধু মাঝে মাঝে

অকারণে

সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে

তারপর উঠে পড়ে

বাইরে বেরিয়ে আসে

খুঁজে খুঁজে খড়ি নিয়ে আসে কোথা থেকে

আর সামনের পরিচ্ছন্ন চকচকে দেওয়ালে

লেখে 'ক'

 

এক ছোটো

সাদামাটা 'ক'

উঁচু শহরে বহুক্ষণ ধরে 

তার আওয়াজ শোনা যায়

 

'ক' মানে কী

সেপাইকে এক বুড়ি প্রশ্ন করে

সেপাই প্রশ্ন করে অধ্যাপককে

অধ্যাপক প্রশ্ন করে ক্লাসের

সবচেয়ে চুপচাপ পড়ুয়াকে

'ক' মানে কী

সারা শহর প্রশ্ন করে

 

আর এই এত বড় শহরে

কেউ জানে না যে

ওই যে একজন কবি

প্রতিবার এমনি হাত তোলে

এমনিই ওই পরিচ্ছন্ন চকচকে দেওয়ালে

লেখে 'ক'

আর সবাইকে খুন করে দিয়ে যায়!

 

শুধু এতটুকু সত্যি

বাকি সবটা ধ্বনি'

অলংকার

রসভেদ

দুঃখের বিষয় হল

আমি এর বেশি ওর

সম্বন্ধে আর কিছু জানি না।

 

১৯৮৪


তর্জমা ঃ জিয়া হক 



 

উদ্ভটরস ও গোঁজামিল


 

কুকুরটার মাথায় বুদ্ধি, পেটে বুদ্ধি, পায়ে বুদ্ধি, লেজে বুদ্ধি। সে গেরস্ত জীবনে আছে, আবার শহরের ঝাউঢাকায় চরা খেতে যায়। কচিবেলায় মুখে বল্লম খেয়েছিল। বাম চোখের পাশে দাগটা এখন তার সৌন্দর্য। জম্পেশ যুবতীর চ্যাপ্টা তিলের মতো মানানসই। কুকুরবস্তি তাকে যম ভাবে। ওর নাম লেলো। মনে রাখার মতো নাম—লেলো। 


পতাকাটা পড়েই ছিল ঠোঁঙার মতো আলুথালু। হরদিন তো মানুষের পতাকা লাগে না। তবে, পতাকা যে একটা হেলাফেলা করার মতো ব্যাপার নয়, সেটা নিশ্চয়ই সবাই মানবে। পতাকা আছে, তাই আমরা আছি। কিন্তু কেঁচিয়ে দিলো লেলো। সব ঝক্কিহীন শান্তিভর্তি ব্যাপার কেঁচিয়ে দেওয়ার চওড়া ইতিহাস আছে। পতাকায় ডান পা তুলে ইয়ে করে দিয়ে লেলো তার ইতিহাসকে আরেকবার বাঁচিয়ে দিলেও সে বাঁচিল না। শীর্ষ কুকুর আদালতে তার ফাঁসির রায় ঘোষণা হয়ে গেল। ৭ দিন পর দড়ি। 


লেলোর দল পথে নামল। 'লেলো আমাদের নায়ক, তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি চাই'। গান গাইতে গাইতে চলল মিছিল 'লেলো/আকাশেই লেজ মেলো'। লেলোর দলের বলিয়ে কইয়েরা প্রশ্ন তুলল :

এক) পতাকা ওভাবে ফেলে রাখা হল কেন? সেটা কি অন্যায় নয়? 

দুই) পতাকার সংজ্ঞা কী? 

তিন) দেশ কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? দেশের নাগরিক কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? নাগরিকের জীবন কি পতাকার চেয়ে বড় নয়? জীবনের প্রয়োজনে ইয়ে পতাকার চেয়ে বড় নয়? 


লেলোর খাল খিঁচে নিতে চাওয়া দল মিডিয়া দুর্গ দখল করে দেশ-জাতি-ধর্ম ও পতাকার স্বরূপ নিয়ে বোমার ঢঙে কালীপটকা বাজিয়ে আসর গরম করে তুললো। দাবি উঠলো, মহাজগতের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর পতাকা তৈরি করে ওখানেই পুঁতে দিতে হবে। মাপ নিয়ে কোনও গোল বাঁধলো না, নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে সৌন্দর্যের যথার্থ সংজ্ঞা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। দরজি কে হবে, তাই নিয়ে তর্ক দেখা গেল দিকে দিকে। অন্তত সতেরো বছর পতাকা বানানোর জ্ঞানগম্যি আছে এমন কাউকে নিয়োগ করা দরকার কেননা এই সেই পতাকা যা দেশের ইতিহাস নতুন করে লিখবে। 


লেলো চুপচাপ। সে হাজতে বসে ডেগি মুরগির উরু চুষতে চুষতে শুধু বলেছে, ''রাষ্ট্রপতির কাছে যাব।''


এই কথা শুনে রাষ্ট্রপতি বিদেশ সফরে যাওয়ার তারিখ দেখে। রাষ্ট্রপ্রভুর বৌ নায়াগ্রার হাওয়া সেবন করার জন্য তেতে উঠেছেন ইত্যবসরে। তাঁরা কানাডায় একটা পশ্যাধিকার সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন। 


দড়ি হয়ে যাবে লেলোর। তার চেলারা কবিতা পড়ছে যেখানে দুর্বৃত্তের টুঁটি টিপে ধরার কথা লেখা আছে। তার বিরোধীরাও ওই একই কবিতা পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে যখন ধুলোর ঝড় বইছে তরতর তিরতির করে তখন শীর্ষ আদালত রায় ফিরিয়ে নিয়ে জানালো, বিশেষ তদন্ত সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, লেলো যাতে প্রাকৃতিক করে দিয়েছিল সেটা এ-দেশের পতাকাই নয়, পাশের শত্রু দেশের। অর্থাৎ পতাকা নয়, মূর্তি হবে। লেলোর। সে জাতীয় বীর। মহাজগতের বৃহত্তম মূর্তি হবে তার। জনমত হল, এত টাকার স্ট্যাচুর মুখে পেল্লাই একটা কাঁটাতারের মতো দাগ মানাবে না, ওটা বরং মসৃণ রাখা হোক। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। লেজ অর্ধনমিত না রাখলে অণ্ডকোষ বেরিয়ে পড়ছে। 


জিয়া হক 

চিরাচরিতমালা : নিজেকে সমবেদনা : জিয়া হক



 

মাথার ভিতরে কারা হেঁটে বেড়াচ্ছে শব্দ করে। 

সেই শব্দে শব্দে আমি জেগে রয়েছি। 

রাত্রির কাছে আমি দেহী পাখার বিস্তার নয়, দাবি করি ঘুম। 

অনুরোধ শুনতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ কখনও দাবি শুনতে চায় না। 

কষ্ট হতে থাকে। 

কষ্টের কথা ডাক্তার ছাড়া কাউকে বলতে নেই। 

তিনি কষ্ট শোনার দাম নেন, চেষ্টা করেন উপশম করে দেওয়ার। 

মনে মনে খুঁজি সেই লোকটাকে 

যাকে সব কথা খুলে বলা যায় 

এবং যিনি হেফাজত করবেন সেই অসহায় কথামালা। 

কান থেকে কানে, মুখ থেকে মুখে কথারা ভেসে ভেসে সাত সাগর সতেরো নদী পেরিয়ে যায়। 

দশদিক চঞ্চল হয়ে ওঠে, বসে বিচারসভা, এখানে সকলেই জাজ।

লক্ষাধিক রায় বেরোয়। 

আসামির লক্ষবার সাজা হয়। 

সংবিধান চুপ করে থাকে যেন সে  কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো পিতা, 

সন্তানদের কলহ উদাসীন দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট নেই।

কল্যাণপুরে কল্যাণ থাকে না, 

যেভাবে সংসদে শংসাপত্র হাতে বিষধর মানুষচূর্ণ। 

শক্তি দাও। স্মৃতির শক্তি। 

যদি অতীত ভুলে যাই, আমি যে আমিই তা প্রমাণ করব কীভাবে? 

নিজেকে নিজের কাছে কখনও-সখনও প্রমাণ করতে হয়। 

আত্মপক্ষ সমর্থনের করতে গিয়ে 'আত্ম'বিস্মৃত বোধ করলে মামলা খারিজ হয়ে যায়। 

এই মামলায় হারা মানে শূন্যে গিয়ে দাঁড়ানো। 

সেখানে দাঁড়ানো যায়? ভেসে বেড়ানো যায়। 

যা ওড়ে তা যেমন পাখি নয়, যে ভাসে সে-ই মেঘমালা নয়। 

তার বারিধারা হয়ে ঝরে পড়বার সৌভাগ্য নেই। 

সে সাড়ে তিন হাত ঘুমোতে চায়। 

জায়গা পায়, সহমর্মী গাঁদার আপ্যায়ন পায় না বলে 

রাত্রির কাছে দুপুর আর দুপুরের কাছে রাতের প্রার্থী হয়ে 

হাত তুলে থাকে। 

বিদ্যুতের অসীম জেওরে সাজিয়ে রেখেছে আধা-বৃষ্টির প্রায়ান্ধকার রাত্রির আকাশ। 

দর্শক-শূন্য এই বায়বীয় মাঠের খেলাধুলা। 

প্রতিটি মানুষ নিজস্ব গোয়াল ও খোঁয়াড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবী শীতলতর হয়েছে ভেবে। 

তার কথা ভাবি যে সুষম তর্কের পুষ্টি পেতে চেয়ে অাগলবিহীনভাবে কথা বলে যায়। 

প্রতিটি কথায় সে বিস্ময়সূচক চিহ্ন বসায় আর বিস্মিত হতে হতে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। 

সে বেঁচে আছে। বাঁচবার প্রণোদনা দেয়। 

সবাইকে সে বর্জন করেছে বলে দাবি করে, তবে জ্ঞাতার্থে জানাই, তার শুভ বিবাহে অন্তত এক হাজার অতিথি দেখেছি। 

রস আছে তাই রসিকতা আছে। 

সন্ন্যাসী রাজা হয়, রাজাও সন্ন্যাসী। 

গানটুকু রয়ে যায়। কে গায় ঐ? 

উচ্চবংশীয় প্রলাপ মধুর। 

বংশ মানে বাঁশ। তার যাত্রা সভ্যতার পায়ুপথ ধরে। 

সিদ্ধান্ত শোনাবে বলে প্রাচীনা আলমারি থেকে বের করো নৈয়ায়িক ধুতি। 

শ্রাবণের দিনগুলো আষাঢ়ের স্মৃতি নিয়ে গর্ববোধ করে কেননা আকাশে নেই বৃষ্টি-উদ্রেককারী মেঘ, 

গত মাসে ছিল। 

Where The Truth Lies

 

..................................................................

I started from a point where no one ever intruded. It is an ultimate nowhere. It is true that people imagined about this point long before but did not entirely or even partially step towards it. This is the point, as elders say, where the very idea of truth lies. It is always moving or shivering as if it will right now explode towards eternity, negate its centre and spread like flame of all grabbing fire. Having a little knowledge about its nature, we incessantly question the fire, 'Where have you come from and to which extent do you want to go or to which direction?' The fire turns into ashes but no answer sprouts out of it. We start looking for the person who first saw this fiery ball. There is no one to accept the fact that he/she has come across this warm, yellow mystery. Truth thus burns in solitude. What happens? We can feel its warmth but cannot see or touch it because we have lost the path to truth or there was never any path to reach the coveted truth. The quest for truth is true and it is also true that a life has not all the answers that can explain or define it unanimously. 


রাখাল ছেলের গল্প : জিয়া হক



রাক্ষসবাড়ি পাহারা দেবার ছলে
ঘুমিয়ে পড়েছে রাখালের কচি খোকা
স্বপ্নে দেখছে মায়ের অট্টালিকায়
স্নেহ ধরে আছে সোনামন থোকা থোকা

পাহাড়ের নিচে শাঁপলা দেশের খুকি
ফুল তোলে আর তাড়া করে প্রজাপতি
পরনে ময়লা ছেঁড়া ছেঁড়া নীল শাড়ি
চোখে জল তার, কে এই দুঃখমতী?

রাখালবালক বাজাবে কি যাদুবাঁশি?
যাবে নাকি ওই নীল মেয়েটির পাশে?
চোখের জল তো হীরের চাইতে দামি
ঝরে যেতে দেওয়া ঠিক নয় বৃথা ঘাসে

হয়ত মেয়ের নাকের গয়নাখানি
হারিয়ে গিয়েছে ঝর্নার বুনো জলে
ফুটে গেছে পায়ে লতাগুল্মের কাঁটা
বালক আসছে একাই সদলবলে

একাকী বালক রাক্ষসপুর দেখে
সে পারবে না বালিকার কাছে যেতে?
গান্ডীবে তার অস্ত্র বলতে বাঁশি
ব্যথা পারবে না ব্যথাকে উদ্ধারিতে?

পুষ্প হাতে আকাশের দেবতারা
ঢেলে দেবে বলে উন্মুখ সারিসারি
নাকফুল তুমি লুকিয়ে কোথায় আছো
পৃথিবীর কাছে তুমি খুব দরকারি

ঘুম ভেঙে যায় খড়ের গাদার নিচে
কোথায় কন্যা, রাক্ষসপুর, বাঁশি
রাখালের গাভী গেছে খাদ্যের খোঁজে
সেও কি হবে না সঙ্গীতে সন্ন্যাসী?

দূরে দেখে তার গাভী নিয়ে এক মেয়ে
ময়লা শাড়ির ছেঁড়া নীল পাড় দাঁতে
এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে ধীরে
খুব মিল তার দুঃখমতীর সাথে

কাছে এসে বলে, এই নাও প্রিয় পশু
বারবার বলো খুঁজে দেওয়া সম্ভব?
রাখাল বলল, ভালবাসো মেয়ে গাধা?
আমাকে রাখো না, আমি সেই গর্দভ

 


বাংলায় একটি 'শের' লিখতে চেয়েছিলাম



একটি নক্ষত্র আছে আরও এক নক্ষত্রের পাশে
দেখতে যদি চাও
একটি নক্ষত্র আছে আরও এক নক্ষত্রের পাশে
দেখতে চাও যদি

আমার চোখের দিকে দেখো

যদি বলো, এ তো শুধু চোখ; নেই সেই আলো
যদি বলো, এ তো শুধু চোখ; নেই সেই আলো
তাহলে জানাই

বহুদূর থেকে তারা তোমাকে দেখবে বলে পথে নেমে
ক্রমাগত নিষ্প্রভ হয়েছে--তাই
চোখে নয়, সুর্মা পরাই আমি মুখে,--যেহেতু

শব্দ আলো দেয়

শব্দের আলোয় আমি
তোমার মুখের পত্রখানি খুলে খুলে পড়ি
শুনতে চাও যদি
তোমার মুখের পত্রখানি খুলে খুলে পড়ি
শুনতে চাও যদি

আমার নামের ধ্বনি শোনো

জিয়া হক
চিত্র : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত


সঙ্গে সঙ্গে সাথে : জিয়া হক



…………………...............................................
পানার পুকুরে এই সবই ঝুঁকে পড়েছে।
ঝুঁকে পড়েছে কেননা বড়ো ভার।
ভার বইবার দেহখানি পুষ্টি পায়নি তাই
রাষ্ট্র করে দেয়, এখানে খাদ্য আছে আর আছে
কল্যাণকামী ছায়াভর্তি জল।
এখানে মানুষের দুইখানি পা, কৃষিকাজ করে বলে
এদেরকে কেউ মেধাবী বলে গণ্য করে না,
এইখানে চোখগুলি এত নুন ভরা, সামান্যতমতেই ঝরে পড়ে।  
ইঁটের বাড়িগুলি শ্রাদ্ধে বামুনের শ্রদ্ধার্ঘের গামছার মতো
আলো রাখলেই বেরিয়ে পড়ে
সেই আলো চাঁদের আলোর সাথে দেখা করতে চায়
তারা চায় স্থল ও শূন্যের মধ্যে যে মালপত্র আছে তার
গায়ে গাভীর দুধের মতো পুষ্টি রেখে যেতে


চিত্র : মনেঁ

দিন যায় বর্ষকালাধিক : জিয়া হক


আমার চিন্তা জটপাকানো উলের মতো গড়াতে গড়াতে নিম্নগগনের দিকে শূন্য-ঝাঁকা মনোহারি দ্রব্য বিক্রেতা হল।
৩ দিন পৃথিবীর মতো আর গ্রহ নেই, ৪ দিন এ আমি কোথায় এলাম। ৭ দিন আকাশে কুসুম, বাকি সাতে কুসুম আসে না।
মাসে মাসে জন্মদিন হয়, প্রতি মাসে বৃদ্ধ হয়ে যাই।
দেখে রাখি কোথায় সমাধি, সেখানেই বাড়ি বসে যায়।
১ সাল রাত্রি প্রেমোদ্ভব, ১ সাল ভানু দিবাকর।
ছেড়ে গেল দশকের অটো, ধরে থাকি হাজার হাতল



বিশ্বাসে বামপন্থী, প্র্যাকটিসে নয়, অর্থাৎ ভণ্ড : কবি অয়ন চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার



অয়ন,প্রথমে একটা চিরাচরিত প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি।তোর কবিতা লেখার শুরুর ব্যাপারটা একটু বল।মানে কবিতা লিখতে হবে এই দিব্বিটা কে দিল?
আলবেয়ার কাম্যু ফুটবল খেলতেন, গোলরক্ষকের পজিশনে। একবার নিজের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, খেলা চলছে বিপক্ষের অর্ধে। কাম্যুর মনে হল, জীবন এরকমই। শোনা যায়, এভাবেই জন্ম হল আউটসাইডার উপন্যাসের। কবিতা আমার কাছে আকস্মিকভাবে এসেছে, কোনও পরিকল্পনা করে আমি কবিতা লিখিনি। আমি যা লিখি, তা পড়ে অন্যরা বলেছে এগুলো কবিতা। আমার এরকম কোনও দাবি ছিল না, এখনও নেই। বলা যায়, অন্যের মত মেনে নিয়েছি মাত্র। তাই কেউ যদি আমার লেখা পড়ে বলে যে কবিতা হয়নি, সেটাও মানতে সমস্যা হয় না আমার। আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি, অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। তার মাধ্যম কবিতা হলে কবিতা, গদ্য হলে গদ্য, দিনলিপি হলে দিনলিপি, সিনেমা হলে সিনেমা।

তোর আগের প্রজন্মের কোন কবি বা কোন কোন কবিকে তোর প্রাথমিক পর্যায়ের লেখালেখির ভিতর খুঁজলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে বলে তোর বিশ্বাস? 
আমি যাঁদের যাঁদের লেখা আজ পর্যন্ত পড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের প্রভাব আমার লেখায় আছে। ছিল, আছে এবং থাকবে। শুধু আমার আগের প্রজন্ম নয়, আমার পরের প্রজন্মের লেখাও, শুধু কবিতা নয়, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ ভ্রমণকাহিনি ব্যক্তিগত চিঠি জীবনী সব সব। আর শুধু লেখা কেন, আমি যাঁদের যাঁদের সংস্পর্শে এ জীবনে এসেছি, সে আমি তাঁদের পছন্দ করি বা না করি, যে যে ঘটনার অভিঘাত আমার জীবনকে ছুঁয়েছে, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, সমস্ত কিছুর প্রভাব আমার লেখায় আছে। কারণ প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক প্রাণী, প্রত্যেক উদ্ভিদ, প্রত্যেক জড় অজড় বস্তুসমূহ, এই মহাকাশ, এই সমুদ্র, এই বাতাস, এই নক্ষত্ররাজি, সবই আমার অভিজ্ঞতার অংশ, আর যা যা আমার অভিজ্ঞতার অংশ, সব কিছুই আমার লেখায় থাকে। আমার ঋণ অপরিসীম এবং অপরিশোধ্য।

তোর লেখালেখির প্রথম থেকেই আমি তোকে জানি।অসংখ্য লেখা তুই সম্পূর্ণ মাথায় লিখেছিস প্রথমে,পরে তা খাতায় টুকেছিস। একেক লেখকের এক এক রকম পদ্ধতি থাকে। আমি শক্তির পান্ডুলিপি দেখেছি,প্রায় কাটাছেঁড়া নেই।তোর লিখন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াটা কি?
লেখা তো মাথাতেই তৈরি হয়। খাতাতে লিখলেও মাথায় তৈরি হয়, কম্পিউটারে লিখলেও। আমার পাণ্ডুলিপিতেও কাটাছেঁড়া প্রায় থাকেই না। কারণ লেখা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি সাধারণত খাতায় কিছু লিখি না। যাবতীয় বদল, কাটাছেঁড়া, সংশোধন সংশোধন এবং সংশোধন, গোটা রান্নাঘরটাই থাকে মাথায়। পাণ্ডুলিপি হল আমার খাওয়ার টেবল। ওখানে ম্যাক্সিমাম নুন গোলমরিচ সস প্রয়োজনমতও ছেটাতে পারি।

আমরা একটা কথা শুনি।মহৎ কবিতা।এব্যাপারে তোর বক্তব্য কি? তুই মহৎ কবিতা লেখার কথা ভেবেছিস, নাকি কবিতা লিখে মহৎ হওয়ার কথা?
কবিতাই বুঝি না, তার ওপর আবার মহৎ কবিতা! মহত্ত্ব বলে আছে নিশ্চয়ই কিছু, আমি সেসব টের পাইনি, খুব একটা আগ্রহীও নই। ওসব যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগে, নিজের ভাগের শেষ জলবিন্দুটুকু বিপক্ষের মুমূর্ষু সৈনিককে দিয়ে দেওয়া টেওয়া, আমার লেখালেখিতে ওসব নেই বলেই আমার আশা।


যিনি মার্গ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ, আমরা তাঁর নামের আগে ওস্তাদ বা পন্ডিত বসাই। কিন্তু মান্না দে, কিশোর কুমার,  এঁরা যত বড় শিল্পী হোক ঐ উপাধির অধিকারি নন।কবিতায় যদি এরকম হতো।সমসাময়িক কোন কবির আগে ওস্তাদ বসাতিস?নিজেকে ইনক্লুড করে উত্তর দিবি।
এসব উপাধি বসানোর রীতিতে বিশ্বাসী নই, তবে তোর প্রশ্নের মূল স্পিরিটটা বুঝতে পেরেছি। আমার সমসাময়িকদের অনেকের লেখাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। কারোর কারোর গোটা গোটা বই, যেমন অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহিরিটোলা আর সিঙ্গালীলা ঠাকুর, বিপ্লব চৌধুরীর সিন্ধু ও সমূহ , ভবতরঙ্গ আর মদ, শোভন ভট্টাচার্যর ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি আর শনির জাতক, তোর লেখা মাথুর আর গুঞ্জাগাথা, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার খোয়াব, প্রসূন ভৌমিকের বুয়া ও বাবুই,  সুদীপ্ত চক্রবর্তী, শুভাশিস ভাদুড়ি, সার্থক রায়চৌধুরি, রওশনারা মিশ্র, তপন রায়, মণিশংকর বিশ্বাস, তাপসকুমার লায়েক, পারমিতা মুন্সি, তারেক কাজি, মিতুল দত্ত, কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, হিন্দোল ভট্টাচার্যর বেশ কিছু কবিতা, জয় মজুমদার জ্যোতিপ্রকাশের বন্ধুরা নামে একটা কবিতা লিখেছিল, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিল মার কাছে যাব নামে একটা কবিতা, কারোর কারোর অনবদ্য সব কবিতার লাইন ঝলসে ওঠে যেন, শুভাশিসদা লিখেছিল, একটি সুবর্ণ রেখা পড়ে আছে নদীর কিনারে, রণজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছিল, সামান্য ঘুরেছে হাওয়া পৃথিবীর শেষপ্রান্তে এসে, আবির সিংহ লিখেছিল, কোনও জাহাজই ডোবে না, আত্মহত্যা করে, মুকুট ভট্টাচার্য লিখেছিল, টিকটিকির ধৈর্য নিয়ে বসে আছি মিরাক্যল ঘটার আশায়, সাম্যব্রত জোয়ারদার লিখেছিল, অগাস্ট মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ শ্রমিকেরা কিছুতেই নিজেদের ভাগ্য বদলাতে পারছে না, দেবাশিস কুণ্ডু লিখেছিল, কথকতা আবহাওয়া শাস্ত্রীয় গীতি/ অথচতা ডুমুরের ফুল ম্রিয়মাণ / দেখেছি তো দেখেছি তো মিথ্যে প্রলাপ / হয়তো বা তোকে কারও আড়ালে দেখেছি!
সকলকেই আমার কুর্নিশ! অনেকের নামই করা হল না হয়তো।

আমার ধারণা, কবিতা লেখার পেছনে একজন কবিরএকটা বিস্ময়বোধ কাজ করে।এই মহাবিশ্বে কী তোকে বিস্মিত করে?
এই মহাবিশ্বই আমাকে প্রতিনিয়ত বিস্মিত করে। অভিশপ্ত মানুষ হল সেই, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা যার নষ্ট হয়ে গেছে। অনন্ত নক্ষত্ররাজি থেকে ঘাসে পিঁপড়ের চলাচল, সব আমাকে বিস্মিত করে। ফ্লাশ গর্ডনের কমিকসে একটা লাইন পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম, এই পৃথিবীর একটা গাছের ডাল ভেঙে দাও, সুদূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে! 

প্রতিভা, সাধনা।নিজের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কাকে এগিয়ে রাখবি?
প্রতিভা, প্রিভিলেজ এবং সাধনা, এই তিনটেই জরুরি। কে বলতে পারে, বীরভূমের আদিবাসী গ্রামে, বা রাজাবাজারের বস্তিতে হয়তো এমন কেউ কেউ আছে যারা কবিতা লেখার, কবিতার জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগই পেল না। প্রতিভা তাদের ছিল, সাধনার ক্ষেত্রও হয়তো প্রস্তুত ছিল, যোগাযোগ ঘটল না শুধু। তিনটেই না থাকলে, বাকি দুটো দিয়ে বড় কোনও কাজ হয় না।

তোর কবিতার লাইন, কবিতা বন্ধুরা লেখে আমি শুধু বাহবা ছুঁড়েছি।এই ভাবনা থেকেই কি গান্ধার পত্রিকা করতে আসা?আজ কি মনে হয়, অই পত্রিকা করা,সম্পাদনা করা, তোর নিজের লেখালখিকে কি কোনো ভাবে সাহায্য করেছে?
ঐ লাইনটা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে খানিক রাগ থেকে লেখা। পবিত্র ক্রোধ। গান্ধার আমি সম্পাদনা করার আগে থেকেই ছিল। সৌরভ পাণ্ডে, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ সেনগুপ্ত মূলতঃ কাগজটা করত। এছাড়া সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর বাগচী, তাপস দততো এরাও যুক্ত ছিল। গান্ধারের লোগো দু’বারই এঁকেছিল সাম্যব্রত জোয়ারদার। ওরা সস্নেহে আমাকে গান্ধার ছিনিয়ে নিতে দিয়েছিল। আর পত্রিকা সম্পাদনা করা অবশ্যই লেখালেখিকে সাহায্য করেছে, কারণ আগেই বলেছি, কোনও অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না।

একটা গান আছে।শুকনো সাধু করিস নে মা রাখিস আমায় রসেবসে। আমি জানি যে তুই শুকনো সাধু নোস।বিরাট একটা রসিকতাবোধ সব সময় তোকে জড়িয়ে থাকে।এই রসবোধ ব্যাপারটার সাথে সিরিয়াস  কবিতার কি কোনো আপাত বিরোধ আছে?
বিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। রসবোধের সঙ্গে জীবনধারণের সম্পর্ক আছে। যার রসবোধ নেই, সে ঠিকঠাক বেঁচে নেই।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বই। একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ে যাবার আগে পূর্ববর্তী লেখাগুলো নতুন যে লেখা আসতে চলেছে, তাকে কি বলে সাবধান করে?
ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। আমার জীবনে ম্যাজিকাল থ্রি ওয়ার্ডস আই লাভ ইউ নয়, সেটা হল ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। কিছু লেখা একটা বইতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, হতে চেয়েছে মানে তাদের একটা জার্নি আছে, জার্নির একটা শুরু আছে, একটা শেষ আছে, জার্নির একটা পূর্ণতা আছে। জার্নি পূর্ণ হল মানে এবার নতুন কোনও পথে হাঁটো। সেই পথে তোমার হাঁটার ধরণের সিগনেচার অবশ্যই থাকবে, তুমিই যে হাঁটছ সেটা বোঝা যাবে, কিন্তু পথ, পথের দু’ধারের দৃশ্যাবলী, অভিজ্ঞতাসমূহ অন্য হবে।

প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রেই তাঁর জীবনযাপন তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করবেই। আমার জীবনের ঘটনা আমার লেখাকে প্রভাবিত করে। কবিতা কি কখনো জীবনকে প্রভাবিত করেছে?
আমার লেখা আমার জীবনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। বাকি কথা অপ্রকাশ্য।

জীবন তোর কাছে কী? মৃত্যুকে তুই কিভাবে দেখিস?
জীবন অনিশ্চিত। মৃত্যু অনিবার্য । অন্ধকার থেকে এসে ফের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। মাঝে কিছু নক্ষত্র রাতের গান।

কয়েকজন আছেন, যাঁরা পরিচালক এবং কবি। বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত তাঁদের একজন।কিন্তু এরা প্রায় প্রত্যেকেই কবি হিসেবে যত না উল্লেখযোগ্য, আমার ধারণা পরিচালক হিসেবেই গ্রহণযোগ্য বেশি।  তুইও পরিচালক আর কবি। তুই সিনেমা আর তোর কবিতার মধ্যে সম্পর্কটা কি ভাবে দেখিস?
খুবই দুঃসম্পর্ক। সিনেমা বানাতে অনেক টাকা লাগে। যে টাকা আমার নেই। ফলে ইনভেস্টর নামক একজনকে প্রচুর কিছু বোঝাতে হয়। তাঁরও কিছু চাহিদা থাকে। লেখালেখির এসব দায় নেই। এটাই তফাত।

আমার একটা ব্যাক্তিগত মতামত আছে তোর দ্বিতীয় বই তুমি সম্পর্কে। আমি মনে করি ' তুমি'  তোর শ্রেষ্ঠ বই। কিছু লেখা হয় যা পাঠককে শান্তি দেয়। কিন্তু এই বইটায় যন্ত্রণার সাথে একটা ছটফটানিও মিশে আছে,একটা অদ্ভুত অতৃপ্তি বলতে পারিস। তোর কী মনে হয়?
তুমি একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে লেখা। অসম্ভব যন্ত্রণাসঞ্জাত ঐ বই। মনে হয়, তোর পাঠ সঠিক। লেখার সময় আমার ভেতর কষ্ট যন্ত্রণা বিষাদ অপরাধবোধ অতৃপ্তি অক্ষম ক্রোধ , এই সব আবেগ অনুভূতিই অতি অতি তীব্র মাত্রায় ছিল। সেসব অনুভূতি লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে সঞ্চারিত হতেই পারে।

বিষণ্ণ রূপকথা তোর সাম্প্রতিক বই। মাঝখানে অনেকদিন চলে গেছে। দীর্ঘ বিরতি। কবির জন্যএই বিরতিগুলোর কি খুব প্রয়োজন?  কবিতার বিচারে বিষণ্ণ রূপকথাকে আমার কেমন যেন একটা উদাসীন কবিতাবই বলে মনে হয়েছে। মানে, যে বিষণ্ণতা আছে, তা তেমন যেন গ্রাহ্য নয়।আমি কি ঠিক?
আমি যেহেতু চেষ্টা করে লিখি না, তাই বিরতি বিষয়টাতেও আমার হাত নেই। লেখার অনুশীলন চালিয়ে গেছি। তুমির পর যে নতুন পথ দেখতে চাইছিলাম, সেটা যখন দেখতে পেলাম, তখনই বিষণ্ণ রূপকথা এল। বলা যায়, বিষণ্ণ রূপকথার জন্য একটা অন্বেষণ ছিল, তার জন্যই বিরতি প্রয়োজন ছিল।
তুমির বিষণ্ণতার তীব্রতা বিষণ্ণ রূপকথাতে এসে স্তিমিত হয়েছে। বিষাদ এখন অনেক শান্ত, স্তিমিত, পরিব্যাপ্ত। এই বিষাদ হয়তো খানিক সুখকর। সুখ এখানে উপশম অর্থে ব্যবহৃত। তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধে নিজেকে সঁপে দেয়ার যে সুখ, সেটা। তুমির বিষাদের তল দেখতে পেতাম। বিষণ্ণ রূপকথায় সেটা পাই না। বিষাদ এতই নিত্যসঙ্গী। বন্ধুই বলা চলে। বিষণ্ণ রূপকথায় উদাসীনতা নয়, অবসাদ আছে। তুমির বিষাদের তীব্রতায় আমি হারিয়েই যেতাম, বহু যত্নে অদিতি আমাকে বিষণ্ণ রূপকথায় নিয়ে এসেছে। ওর সহ্যশক্তি অতুলনীয়।


প্রথম সিনেমার জন্যই ফিল্মফেয়ার পেয়েছিস। এতোগুলো বই লিখেও এখন অবধি কোনো পুরস্কার পাসনি। তাহলে কি পরিচালক অয়ন কবি অয়নকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে ক্রমশ? 
এতে প্রমাণিত হয়, এই বাংলায় যতজন যোগ্য কবি আছেন, ততজন যোগ্য চিত্র পরিচালক নেই। আর কে পেছোচ্ছে, কে এগোচ্ছে জানি না, নতুন লেখা লিখছি, আশা করি সামনের বছর বই হয়ে বেরোবে। বইয়ের নাম, নক্ষত্র রাতের গান।

নিজের দশক সম্পর্কে তোর মূল্যায়ন কী?
কবিতার কোনও দশকওয়াড়ি মূল্যায়ন হয় না। মাইকেল কোন দশকের কবি ছিলেন? রবীন্দ্রনাথ? জীবনানন্দ? আমারও কোনও দশক নেই। আমার কিছু বন্ধু এবং কিছু পরিচিত কবি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ দেশ পত্রিকার উমেদারি করে সময় নষ্ট করেছেন, কেউ বিরোধিতা করে, দুটোই কর্মনাশা। কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের তাঁবেদারি করে সময় নষ্ট করেছেন, কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের উপহাস করে, দুটোই অনর্থক শক্তিক্ষয়। কেউ কেউ নীরবে লেখা অনুশীলন করেছেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁরাই আমার বন্ধু।

তোর বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট রাজনৈতিক অয়নকে পাই। কবিতায় সেভাবে পাইনা কেন?রাজনৈতিক অয়ন সম্পর্কে বল।
আমার লেখায় রাজনীতি থাকে। কারণ কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। এক্ষেত্রে পার্টি পলিটিক্সের কথা হচ্ছে না। হ্যাঁ , সেইসব লেখা হয়তো নিকানোর পাররার মতো কী সমর সেনের মতো সেই অর্থে রাজনৈতিক লেখা নয়। ফেসবুকে লিখি না, কমেন্ট করি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে। আর রাজনৈতিক অয়ন হল, বিশ্বাসে বামপন্থী, প্র্যাকটিসে নয়, অর্থাৎ ভণ্ড।

প্রাচীনকালে কবিকে ঋষি বলা হত। কবি মানেই তিনি সত্যদ্রষ্টা।  আধুনিককালে এই কথাটা কতটা সত্যি?
ঋষি আর কবির মধ্যে এক সুতোর তফাত আছে। দু’জনেই বিশুদ্ধতা খুঁজছেন। যতক্ষণ পাচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি কবি, পেয়ে গেলে ঋষি। তবে কোনও কোনও কবি বিশুদ্ধতা নামক পরশপাথর পেয়েও ফেলে দিয়ে ফের খুঁজতে থাকেন, কেবল খোঁজার মজাতেই। এঁরা দুষ্টু প্রকৃতির কবি।

পাঠক অয়ন চক্রবর্তীকে মনে রাখবে কি?
কী বলছিস এসব! মহাকাল বিরাট বিরাট ব্যাপার ভাই! এই মহাকালের রথের চাকায় মহাভারত কে লিখেছিলেন, তিনি একজনই, নাকি অনেকে মিলে লেখা, তা আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। শেক্সপিয়ারের নাটক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা কি আসলে শেক্সপিয়ারেরই লেখা? সেখানে ব্যক্তি অয়ন কে! কেউ নয়। কিচ্ছু নয়। কোনও মানুষকে মহাকাল মনে রাখেনি, মনে রাখতে দেয়নি, মনে রাখতে দেবে না। কিছু কীর্তি অন্য কীর্তির তুলনায় কিছু বেশি দিন টিকবে। তার মধ্যে আমার লেখা থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো গনৎকারের টিয়াপাখি আমি নই, হতেও চাই না।


শেষ প্রশ্ন।  আমি তুই দুজনেই টেলিভিশনে কাজ করেছি।আমরা জানি,আজকের দিনে ইন্টারভিউ দেওয়া আর নেওয়া দুটোই অনেক সহজ। কবিতা গান সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু আগেকার দিনে তা ছিল না। রফি সাহেব,কিশোরকুমার সহজে সাক্ষাৎকার দিতেনই না। কিশোর মাত্র তিনবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।একবার আমিন সাহানিকে, একবার প্রীতিশ নন্দী চেয়েছিলেন, কিন্তু কিশোর তাঁকে বলেন যে তিনি দিতে পারেন তবে প্রীতিশ নয়, কিশোরকুমারকে প্রশ্ন করবেন কিশোরকুমার নিজেই। তাই হয়েছিল তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন আর উত্তর দেন।আর তৃতীয় সাক্ষাৎকারটি তাঁর কাছে চাওয়া হলে তিনি বলেন, দেবেন যদি লতা মঙ্গেশকর নেন।তাঁরা লতাজিকে বলেন আর লতাজিও রাজি হন। সেই ইন্টারভিউর কিছু অংশের ভিডিও পাওয়া যায়। এত কথা বললাম কারন শেষ প্রশ্নটা আমি চাই তুই নিজেই নিজেকে কর।উত্তরও দে।

প্রশ্ন : কবিতা না লিখলে কি আমার মৃত্যু হবে? 
উত্তর : হ্যাঁ ।

প্রশ্ন করেছেন : কবি জয়দীপ রাউত


বিশ্বনাথ পুরকাইতের চারটি কবিতা


১।
পোকাদের বাসস্থান দেখে আসি চলো, মাথা গুঁজে
কোথায় চলেছে, দু-একটা সেলাই ছাড়া এ বছর কাজ নেই,
মেজদার শালিটারও বিয়ে হয়ে গেল।

বজ্রসম্ভাষিত পাখি, মাছ, গবাদি পশুর দল
গোধূলিতে মাঠে ছিল যারা তাদের খবর নাও;

মানব জীবন বড় দায়, কীটপতঙ্গের বাসাও
চিনে রাখতে হয়।


.২।
তোমরা নদীর পাড়ে খেলা কর, হাসাহাসি কর
হাঙর-কুমীর দেখে; বুকের পাটা হে তোমাদের।
আমার ভাইও ছিল ডাকা-বুকো, চাঁদ দেখে, ভূত
দেখে, বাঁশবন ডুবন্ত জাহাজ দেখে
মাঝরাতে ফিরে আসত বাড়ি।

আমি অতো বীর নই বাবা, ঘরে থাকি,
মাঝে মাঝে ভাইকেই দেখি উড়ে যাচ্ছে দ্রুতগামী
তারাদের আলো মাথায় ঝিলিক মারে
সোনালি-রূপালি মাছ তোমাদের নদীতে যেমন


৩।
ঊর্বশীর দাঁত দেখে আমিও হেসেছি
যদিও নাচেন তিনি ভালো
রাজা নন, সেনাপতি নন, রানিমার মন ছিল
তবলা বাদকে; তিনিই দলের অছি।

বিশ্ববন্ধু অপেরার স্মৃতি এভাবেই ফিরে আসে,
মাথার ভিতর হুহু করে গান, রমণী আহ্লাদ;
তোমাকে দেখাতে চাই মাঝিভাই তুমিই মালিক
নদী ও নৌকার। রাজনীতি ছাড়া বলো
দেশে আর কী কী আছে? পারাপার কেন
এত হিম হয়ে এল?


৪।
এবার গোসাবা যাব, প্রিয়তোষ ভাই
নৌকা লাগাও ক্যানিং-এর ঘাটে,
ভূমিহীন দেবতারা ভুল ছদ্মবেশে এদিকেও ঘোরাঘুরি
করছেন দেখি; তুমি বল, ওনাদের সঙ্গে নেওয়া
সুবিধার হবে? ওনারা কি সাঁতার জানেন?

বাতাসে কমলা রঙ, মেঘ এল অসময়ে, দূর্ভাগা স্বজন
যেদিকে ঝড়ের রাত সেদিকেই কেন যেতে চাও?

গোসাবা অনেক দূর? প্রিয়তোষ, দিনে
দিনে ফিরে আসা যাবে?

উপরিভাগে : জিয়া হকের কবিতা


অশ্রুনদীর ধারে আমি দুইখানি গর্ধব আর নিজেকে দেখলাম
তিনজন গর্ধবই ছিল, তিনজন পবনসন্তান
গাছে গাছে আম্র আর বিভীষণ আশেপাশে ছিল
আমার সুলক্ষণ চাই, আমাকে সীতা এনে দাও, বলি
এই সেই ব্যস্ত নালিখাত যার তীরে জয়ী--পরাজয়ী
সিজদানত ছুরি
কোথায় কেবলামুখ, কোনদিকে ওহুদের টিলা
অজ্ঞানতা আছে তাই কাবাঘর সব দিকে আছে
কোন বনে লুকিয়ে রয়েছো দুষ্ট প্রভু?
ছেঁড়ে দেহ কাঁটা ও শামুকে--তুমি কি শিকারে রয়েছো?
তিন প্রাণী, নদীর এপারে, গলা শুকনো, অশ্রু পান করে
গ্রন্থ পিঠে, অপৌরুষেয়, সুস্বাদ কোথায়?
কতদূর ঐশ্বরিক কচি ঘাসজমি?
তোমাকে চিবিয়ে বুঝবে ঘাসে তুমি কতটুকু আছো


প্রিন্সিপিয়ার ইতিহাস এবং । দ্বিতীয় পর্ব । অর্পণ পাল



১/ লেখা শুরুর পর থেকে প্রকাশ অব্দি।।
প্রিন্সিপিয়ার বিষয়বস্তু আইজ্যাক নিউটনের মাথায় ঘুরছিল এডমন্ড হ্যালির সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার অন্তত বছর ছয়েক আগে থেকেই। সে সময়েই তাঁর আবিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে যে সূর্যের চারদিকে যে পৃথিবী ঘোরে (বা পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ)— এই ঘোরবার জন্য প্রয়োজনীয় আকর্ষণ বল বিপরীত বর্গের সূত্রই মেনে চলে (অর্থাৎ দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, আকর্ষণ বল সেই দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে কমতে থাকে)। তবে এরপরেই তাঁর জীবনে চলে আসে একের পর এক মৃত্যুর স্রোত। ১৬৭৭ সালে প্রয়াত হন তাঁর কাছের দু’জন— কেমব্রিজের প্রাক্তন লুকাসিয়ান অধ্যাপক আইজ্যাক ব্যারো আর রয়্যাল সোসাইটির প্রথম সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গ, আইজ্যাককে আরও একটু নিঃসঙ্গ করে দিয়ে। এমনিতে তিনি উইকিনস ছাড়া তাঁর বাড়িতে সঙ্গ দিতেন না কাউকেই, উপরন্তু ১৬৭৯ সালের মে মাসে ন’দিনের জন্য লন্ডন থেকে ঘুরে এসে তিনি খবর পান তাঁর মায়ের শরীর খুব খারাপ।
খবরটা পেয়েই তিনি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গ্রামে মায়ের পাশে থেকে দিন কয়েক সেবা করবার পরেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় (মায়ের পাশে সারারাত জেগে থাকতেন তিনি, মায়ের ফোঁড়া নিজে হাতে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিতেন)। হানাকে তাঁর প্রথম স্বামীর পাশেই কবরস্থ করা হয়। আইজ্যাক, আশা করা যায় এই ব্যাপারে অন্তত সন্তুষ্টই হয়েছিলেন।
সম্পত্তির দেখাশোনা এবং মায়ের কিছু পাওনা আদায় করতে গ্রামের বাড়িতে এরপর আইজ্যাক থেকে যান মাস কয়েক। কেমব্রিজে যখন ফিরে আসেন, তখন দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছে; তাঁর শূন্য বাড়িতে শুধু জমে আছে এক গুচ্ছ চিঠি। যার মধ্যে একটি এসেছে রয়্যাল সোসাইটি থেকে, প্রেরকের নাম রবার্ট হুক।
চিঠির উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না, তবু চিঠিটা পড়ে দেখলেন, সেখানে উল্লেখ করা আছে একটা বহুদিনের পুরনো সমস্যার। হুক উৎফুল্লভাবে জানিয়েছেন, তিনি গ্রহের গতি সংক্রান্ত কিছু নতুন ধারণা আবিষ্কার করেছেন এবং এ ব্যাপারে আইজ্যাকের মতামত চান। এ ব্যাপারে যদি আইজ্যাকের কিছু দ্বিমতও থাকে, সেটা জানালেও হুক আনন্দিত হবেন। আর এ সব তিনি গোপন রাখবেন।
আইজ্যাক হুককে জানান তাঁর মানসিক অবস্থার কথা, আর সেই সঙ্গে এ-ও জানান, এই ব্যাপারে (গ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত ব্যাপারে) তাঁর জ্ঞান যথেষ্টই কম। তিনি শুধুমাত্র পৃথিবীর আহ্নিক গতি সম্বন্ধে কিছু ধারণার কথা বলে চিঠি শেষ করেন।
প্রসঙ্গটা এই, অনেকেই এর আগে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য খুব উঁচু একটা টাওয়ার থেকে যদি কেউ কিছু নিচের দিকে ফেলে, তবে সেটা কি একেবারে নিচে না পড়ে কিছুটা এগিয়ে, বা পিছিয়ে গিয়ে পড়বে? কারণ ওই পতনকালের মধ্যেই তো পৃথিবী সামনের দিকে বা পিছনের দিকে অল্প হলেও সরে যাবে।


ছবি- ১। রবার্ট হুক। রিটা গ্রিয়ার-এর আঁকা।

রবার্ট হুকের সঙ্গে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আইজ্যাকের বিরোধ বেধে যায় এরপরে কয়েক মাসের মধ্যে, এবং সেই বিরোধের রেশ চলেছিল ১৭০৩ সালে রবার্ট হুকের মৃত্যু অব্দি। দুজনের সম্পর্ক কখনওই আর স্বাভাবিক হয়নি। রবার্ট হুক আর আইজ্যাক নিউটনের বিরোধ সতেরো শতকের বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় ঘটনা। আমরা অন্য অধ্যায়ে এই প্রসঙ্গ আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

২/
গোটা ১৬৮৫ সাল আইজ্যাক নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন এই বইটি লেখবার কাজে। এপ্রিল আর জুন মাসে মাত্র দু’বার তিনি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন, সপ্তাহদুয়েক করে থেকে কিছু কাজ সেরে আসবার জন্য। তাঁর অন্য যে কাজে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল, সেই অ্যালকেমিবিদ্যার চর্চাও এইসময় প্রায় বছর দেড়েক বন্ধ রেখেছিলেন এই বইটি লেখার জন্য। তখন তিনি নতুন সহকারী পেয়েছেন এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় হামফ্রে নিউটনকে। হামফ্রে এসেছিল গ্র্যান্টহ্যাম থেকে, আইজ্যাক নিউটনের কাছে থেকে পড়াশুনো করবার জন্য। মূলত আইজ্যাক নিউটনের লেখাপত্র বা যন্ত্রপাতি গুছিয়ে দেওয়া— এইসবই করত সে। প্রিন্সিপিয়া বইটি সে কপিও করে দিয়েছিল, শোনা যায়। মজা করে অনেকে বলেন, হামফ্রে যা টুকতেন তার সবই প্রায় না বুঝেই টুকতেন।
প্রিন্সিপিয়া লেখাকালীন সময় দিন কয়েক শুধু এই লেখার জন্যই আইজ্যাক যোগাযোগ রেখেছিলেন তখনকার ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল জন ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বহু তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নিউটনকে। তবে নিউটন তাঁকে ঘুণাক্ষরেও বলেন নি যে তিনি একটি বিরাট বই লিখছেন, আর এই তথ্যগুলো চাওয়া হচ্ছে সেই বইয়ের প্রয়োজনেই। পরে তাঁর বইয়ে অবশ্য আইজ্যাক ফ্ল্যামস্টিডের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি।
হামফ্রে নিউটনের স্মৃতির কিছুটা উল্লেখ করা যেতে পারে—
I never saw him take any recreation or pastime, either in riding out to take the air, walking, bowling, or any other exercise whatever. Thinking all hours lost that were not spent in his studies, to which he kept so close that he seldom left his chamber… so intent, so serious [was he] … that he ate very sparingly, nay, sometimes he forgot to eat at all, so that going into his chamber, I have found his mess untouched. When I have reminded him, he would reply: Have it! Then making to the table, would eat a bit or two standing, for I cannot say, I ever saw him sit at table by himself.’ (নিউটনের জীবনীকার জন কন্ডুইটের কাছে স্মৃতিচারণ)
শুধু একটা ঘটনাতেই মাঝখানে একবার আইজ্যাক বিচলিত হয়েছিলেন, যখন খবর পেয়েছিলেন যে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। সেটা ১৬৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। রাজার ভাই দ্বিতীয় জেমস দায়িত্ব নিয়ে দেশটাকে ক্যাথলিক হিসেবে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারেন এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আইজ্যাক দ্বিতীয় চার্লসকে অনেক ব্যাপারে অপছন্দ করলেও দ্বিতীয় জেমসকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। সুতরাং তাঁর মনে কিছুটা দুশ্চিন্তা জাগল এইসময়। আর এই দুশ্চিন্তার কারণেই হয়তো, তিনি লেখবার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন।
বইটা মোটামুটি সম্পর্কযুক্ত তিনটি খণ্ডের হতে চলেছে, একটি ভূমিকা সহ— তিনি ঠিক করে ফেলেছেন ততদিনে। প্রথম খণ্ডে থাকবে তাঁর সেই গতিসূত্র তিনটি আর সেগুলো নিয়ে আলোচনা; দ্বিতীয় খণ্ডে বিভিন্নরকমের বল আর সেই বলের প্রভাবে বস্তুর গতি, উদস্থৈতিকবিদ্যা (Hydrostatics), উদগতিবিদ্যা (Hydrodynamics), শব্দ, তরঙ্গ আর স্রোত নিয়ে আলোচনা; আর তৃতীয় খণ্ডে থাকবে বিভিন্ন বলের প্রভাবে বস্তুর গতির বাস্তব কিছু উদাহরণ যেমন গ্রহ বা উপগ্রহের গতি, ধূমকেতুর গতি ইত্যাদি— এইভাবে মোটামুটি বইটাকে সম্ভাব্য সজ্জায় সাজানো হল। তবে প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন বইয়ের সম্ভাব্য খণ্ড হবে দুটি— প্রথমটি হবে ‘De motu Corporum, Liber primus, আর De motu corporum, secundus’। পরে তিনি মত পাল্টে একটি খণ্ড বাড়িয়ে দেন। তাঁর তৈরি ওই প্রাথমিক বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটি, যেটা লেখা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায়, তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় আলাদাভাবে, তবে সে প্রসঙ্গ পরে।
আইজ্যাক এটাও ভেবে রেখেছিলেন, তাঁর বই হবে একেবারেই বোদ্ধা পাঠকদের জন্য। সাধারণের বোধগম্য যাতে না হয়, সেদিকে নজর ছিল তাঁর। সে জন্য তিনি লিখলেন ল্যাটিন ভাষায়, আর পরবর্তীকালেও এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে যথেষ্ট দেরি করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র বছরখানেক আগে প্রিন্সিপিয়া ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
ইচ্ছে করেই আইজ্যাক তাঁর বইটাকে লিখেছিলেন এমনভাবে, যাতে সাধারণ পাঠকের পড়তে অসুবিধা হয়। এক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর বইটি পড়ে বুঝতে গেলে আগে সেই মানুষকে ইউক্লিডের চোদ্দ খণ্ডের ‘এলিমেন্টস’, জ্যামিতি আর বীজগণিতের একাধিক পুরনো বই, জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে কোপারনিকাসের বই— এরকম বেশ কিছু বই পড়ে তবে মাঠে নামতে হবে।

৩/
প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ডের প্রাথমিক খসড়া শেষ হল ১৬৮৬-এর এপ্রিল মাসে। সেটা নিউটন পাঠালেন লন্ডনে, রয়্যাল সোসাইটিতে। হ্যালি ততদিনে সোসাইটিতে বইটি প্রকাশের ব্যাপারে প্রাথমিক জমি তৈরি করে রেখেছেন। এদিকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে নতুন অতিথি— ১৬৮৫ এর এপ্রিলে তাঁদের একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু তাঁর নিজের তখন সোসাইটিতে অবনমন হয়েছে। এতদিন ছিলেন ফেলো এবং কাউন্সিলের সদস্য, ১৬৮৬ এর ২৭ জানুয়ারি থেকে তিনি হয়েছেন ক্লার্ক। তাঁর বছরে পঞ্চাশ পাউন্ড মাইনে নির্ধারিত হয়েছে। [অনেকে মনে করেন বাবার মৃত্যুর পর এডমন্ড হ্যালির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই চাকরিটি তিনি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু এই সময়ে তাঁর অন্য উপার্জনও ছিল, তিনি বাবার এস্টেট থেকে বছরে প্রায় দুশো পাউন্ড পেতেন]


ছবি-২। এডমন্ড হ্যালি। থমাস মারে-র আঁকা।

তবু হ্যালি এক মাসের মধ্যে সোসাইটির মিটিং থেকে বইটি প্রকাশের জন্য অনুমতি আদায় করে নিলেন। তবে সোসাইটির পরের মিটিং হতে একটু দেরি হল, মে মাসের উনিশ তারিখের মিটিং-এ ঠিক হল বইটি সোসাইটির খরচের ছাপা হবে। আবার এর পরের মিটিং-এ, জুনের ২ তারিখে সিদ্ধান্ত হল বইটির ছাপাবার যা কিছু খরচ, সব দেবেন এডমন্ড হ্যালি নিজেই, তাঁর ট্যাঁক থেকে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজেই, বইটির প্রকাশ যাতে আটকে না যায় সেজন্য। কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? আসলে সোসাইটির বইটি ছাপাবার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তখন। প্রয়োজনীয় পাউন্ড না থাকার কারণটাও ভারী অদ্ভুত। রয়্যাল সোসাইটি তখন অর্থকষ্টে জেরবার অন্য একটি বই ছেপে বিপুল লস খাওয়ার ফলে। আজ এসব ইতিহাস শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে, আইজ্যাক নিউটনের অত বিপুল বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া’ প্রকাশিত হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল যে বইটির কারণে, সেটার নাম ‘Historia Piscium’, বা ‘History of Fishes’, যার লেখক John Ray আর Francis Willughbyসচিত্র এই মৎস্যবিষয়ক বইটি নিয়ে সোসাইটির আশা বা উচ্চাশা ছিল বিরাট, অনেকটা বড় বাণিজ্যিক ব্লকবাস্টার ছবি ফ্লপ হওয়ায় প্রযোজকদের মাথায় যেমন হাত পড়ে, সেরকমই; পরবর্তী সিনেমায় ইনভেস্ট করবার মতো ট্যাঁকের জোর নেই আর তাঁদের।
সুতরাং এডমন্ড হ্যালির আগ্রহে এবং আর্থিক সাহায্যের ফলেই ১৬৮৭-এর জুলাই মাসে প্রকাশিত হল প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ড। বইটি প্রকাশের আগে আরও কিছু নাটকীয় ব্যাপার ঘটেছিল, যার জন্য এর প্রকাশ হওয়াটাই প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তখন রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি রবার্ট হুক, যাঁর সঙ্গে বিরোধের জন্যেই মূলত প্রিন্সিপিয়ার আকাশে কালো মেঘ দেখা দেয় গোটা ১৬৮৬ সাল জুড়ে। তবে সে প্রসঙ্গ পরের পর্বে।