নেমে এসেছে পুতুলের শান্তি

নেমে এসেছে পুতুলের শান্তি
জিয়া হক
.............
সে বলল,  'মেয়েটা একেবারে পুতুলের মতো।'
আমি বলি, 'তুমি আমাকেও পুতুল দেখেছিলে।'
সে বলল,  'আসলে সবই আমার কাছে পুতুল। '
আমি বলি, ' তুমি একটা পুতুল আর তোমার মন
                    পুতুলখেলার ঘুমটা জাগতে চাইছে না। '
সে বলল, ' আমার যে ঘুমেই শান্তি। '
আমি বলি, ' তুমি জেগে দেখেছ কখনও? '
সে বলল, ' তুমি তো চির জেগে,  তোমার কি শান্তি আছে? '
আমি বলি, ' জেগে আছি বলে আমি যে ঘুমকেও
                   টের পেতে পারি। এটুকুও শান্তি। '
—' এটুকুও! দূর! '

আশ্বিনের কাত্তিকের কথামালা

আত্মালাপ
জিয়া হক
..............
উৎপল : নিরক্ষর বেশ্যাদের কাছে যেতে...
বিনয় : আজও ভালো লাগে?
উৎপল : নাইট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তারা...
বিনয় : আমি তো কয়েকবার ভুট্টাক্ষেতে
উৎপল : দেখা পেয়েছিলে?
বিনয় : তারা সারস সারস, কী শুভ্র সাদা!
উৎপল : তারা কর্মন্য, পাউডার সচেতন, পাহাড়ের
              অধিকার চায় না
বিনয় : পাহাড় কি বাদামের? বাদামী পাহাড়?
উৎপল : আমার চটির কথা মনে পড়ে
বিনয় : পরাঙ্মুখ চটি, নালিঘাস
উৎপল : তোমার সারস, জানো, প্রকৃতই
              উড়ে বসে প্রাকৃতজনের আপ ট্রেনে
বিনয় : হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারস
উৎপল : হেমন্তের জঙ্গলে যাবে আজ?
বিনয় : সে তো শক্তির গড়
উৎপল : সেখানে কুয়োর জলে...
বিনয় : ঈশ্বর কি গনিত বোঝেন, হ্যাঁ?

রিস্কা

রিস্কা
জিয়া হক
.............
বৃষ্টির ছাঁট আসছে। গেলাম।
তারাগুলো আজ নেই। গেলাম।
কুকুরবর্গ ভিজছে। গেলাম।
বাজিগুলো সব নিভে যায়। গেলাম।
বেড়ালেরা প্রায় চিনামাটির। যাব না
দরোজারা সব পাথরের। আমি যাব না

সুকবিতার সুগন্ধ

সুকবিতার সুগন্ধ
জিয়া হক
..............
'নজম কা তজযিয়া করতে করতে / পুরা গুলাব হী ছীল দিয়া / মিসরে অলগ,  অলফাজ অলগ / ডন্ঠল-সা বচা, ন খানে কো,  ন সুঁঘনে কো! / খুশবু কুছ হাথ পে মসলী গয়ী / কুছ মিটটী মেঁ গিরকে গর্দ হুই / নজম পড়হুঁ তো ওঅ ভী অব / খালি বর্তন সী বজতী হ্যায়!!'
                                                  — প্লুটো,  গুলজ়ার

কবিতার কি কোনও দেশকালের সীমা-বাঁধনছাঁদ থাকে?  বিশেষ কাল বিশেষ একটি লিখন'ছাঁদ'-এর মোহে পড়ে বটে, সাহিত্য ঐতিহাসিকরা সেই প্রবণতা মেনে-মেপে যুগ বিভাগ, পর্ব বিভাজনও করেন হয়ত, এই ছাঁদেরই পৃষ্ঠপোষক হয় হয়ত বড়তর কোনও পুঁজি, এই 'ছেঁদো' চর্চার বাহির-বাসীরা 'অন্য' / 'ব্যতিক্রম' নামে 'কীর্তিত'  হন হয়ত, তবে এ সবে ওই 'প্রকৃত' সহৃদয় পাঠকের বিপুল উন্নাসিকতা, সে খানিকটা ওই বিনয় মজুমদারী সারস-জাতীয় — প্রকৃত কবিতা নিকটে না এলে সে 'উড়ে যায়'।  এখন প্রশ্ন হবে, প্রকৃত কবিতা কী, কাকে বলে, কোনটা?  কবিতা তো মানুষ ভেদে কবিতা হয়।  কবিতার সংজ্ঞাগুলি যে-কারণে অচল।  বুদ্ধদেব বসু বা হুমায়ুন আজাদদের আধুনিক কবিতার সংকলনগুলির বহু ' সু-নির্বাচিত ' কবিতা অনেক পাঠক অ-কবিতা বলে সরিয়ে দিতে পারেন। শিল্পে এ অধিকার-বিচারটুকু স্বীকৃত। এ কারণেই 'বড়' কবির শংসাপত্র নিয়েও বহু পদ-পদকর্তা হারিয়ে যান। বিপরীতটাও ঘটে।  তবে 'হারিয়ে' হয়ত একেবারেই যায় না। নিশ্চয়ই কোনও-কারও স্মৃতিতে তা থাকে।  আর কবিতার ব্যাখ্যাও আরও এক শূন্য-শুকনো ব্যাপার।  বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবিতারসিক শেখ সদর নইম উপরে উদ্ধৃত গুলজারের কাব্য-সমালোচনা বিষয়ক নজমটি অনুবাদ করেছেন এভাবে —
'কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে/ গোটা গোলাপই ছিন্ন করলাম / শব্দ এবং লাইন বিচ্ছিন্ন হল / কাঁটা রইল হাতে,  না খেতে পারি, না শুঁকতে / গন্ধ হাতে দলা হল,  কিছু ধুলোয় পড়ে মাটি হল / কবিতা পড়লে সেটাও এখন খালি বাসনের মতো বাজে। ' কবিতার ব্যাখ্যাবিরোধী এই নজমটির  ' ব্যাখ্যা'ও নিষ্প্রয়োজন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বা 'রবীন্দ্র-বিদূষক'  আখ্যাপ্রাপ্ত সমালোচকবর্গ যেভাবে কবিতার ব্যাখ্যা 'দিতেন' তাতে স্পষ্ট যে কাঁটা উৎপাদনই তাঁদের মৌল অভিপ্রায় এবং তারা অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের ব্যাপারে আলোচক নন, নিন্দুক অর্থে সমালোচক।  ওই 'আলোচনা'গুলি প্রকৃতই ' খালি বর্তন সী বজতী হ্যায় '। 
এই ভূমিকার পর গ্রন্থসমালোচনা লেখা কার্যত অপরাধ।  কেবল বলতে পারি সজল আহমেদ-এর কবিতার বই  ' আগুন জ্বেলে যাই ' পড়তে পড়তে মনে হয়েছে সজল প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত কবিই।  এর ভেতরে তিনি আর-যা-কিছু।  চিত্রপরিচালক, প্রযোজক প্রভৃতি ও ইত্যাদি।  তাঁর কবিতার 'ব্যাখ্যা' না 'দিয়ে', কয়েকটি প্রিয়-স্তবক উদ্ধৃত করা গেল :
'কী হবে এত শব্দ তৈরি করে /
আবার তো সেই অন্ধকারের কাছে
আলোর জন্য আত্মসমর্পণ ;/
তবুও প্রতিনিয়ত অক্ষরগুলি ঘেমে ওঠে... '
(জ্বলে উঠি নিভে যাই)

' লাল কাপড়'-এর এই দুটি পংক্তি —
'যেন পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বের ভেতর /
আমিই স্ববিরোধী স্লোগান। '

কবিতার প্রকরন ও গাঠনিকতার মিস্ত্রিপনার ' লোভ'মুক্ত হতে পেরেছেন সজল আহমেদ; তিনি বক্রোক্তিজীবী নন ; সপাট বক্তব্যজীবী।  শ্রদ্ধেয় অসীম সাহা তাই হয়ত এই কবিতাগুলিকে বলেছেন 'আপাতসরল'। সরলতাই কার্যত এর শক্তি।  অনেকেই কাব্যগুন বিষয়ে ' সারল্য 'কে ইতিবাচক তো নয়ই বরং নঞর্থক-তাচ্ছিল্যে গ্রহণ করেন।  জটিলতাই কি সিদ্ধি?  যা জটলাগানো তা-ই কি সূক্ষ্ম?  সূক্ষ্মতাই সৌন্দর্য?  সৌন্দর্যই কেবল কাম-প্রার্থিত? বাঁকা উক্তি মাত্রই পদ্য? তবে, তার্কিক হয়ত বলবেন,  যে অ-রূপ আপনাকে টানছে, পান করিয়ে নিচ্ছে তার অরূপত্ব, সেই অরূপ কার্যত অপর-রূপ, অপরূপ—সুন্দর। ভোক্তা ফলত সৌন্দর্যই 'ভোগ' করলেন। সজল আহমেদ যখন দেশ-প্রীতির কথা বলেন, যখন 'পিরীতি' র বলেন, যখন আত্মানুসন্ধানে যান, যখন পরমাত্মানুসন্ধানে যান, সব সময়ই কবিত্ব থাকে। যদিও এ সব কথা-মন্তব্যই তর্কসাপেক্ষতায় আটকে রয়েছে। এতদসত্ত্বেও গুলজারের কাছে ঋণী হয়ে বলি, অপরিবর্তিত খুশবুসহ পূর্ণ গোলাপই আমাদের হাতে ছিল —কঁহি নহি 'মসলী'।

Zia Haque
Golpukur, Baruipur
South 24 Paraganas
West Bengal

আশ্বিনের আরও আরও কাব্য

ড্রিম ভাজা
জিয়া হক
..............
ঘুমিয়ে পড়ুক আদর
তার
সাদর
সম্ভাষণা
আমিও তবে ঘুমেতে
আর
স্বপ্নও
দেখব না
গ্রীষ্মদেশে কোথায় যেন
শীত পড়ল
কবে
তুমি কি আমার কষ্ট করে
ঘুমের বটিকা
হবে?

আশ্বিনের আরও কাব্য

বিবাহচিন্তা
জিয়া হক
..............
টিফিন ভরে মেয়েটা আনল হাতি
জল্লাদ আনে ছেলেটি টিফিন কোটোয়
হাতি জল্লাদ ভীতিমঞ্চের ধারে
নিজেদের ধরে নিজস্বী নামের ফোটোয়

ছেলেটি আনল সোনাকুনো ব্যাঙ জোড়া
মেয়েটি এনেছে ঘুমকাতুরের চাদর
চাদর ও ব্যাঙ প্রীতিমঞ্চের শেষে
বংশগতির সরিয়ে ফেলছে পাথর

আশ্বিনের কাব্য

স্কাই রানার
জিয়া হক
..............
এটা তো সত্যি
প্রতিটি ওয়াক্ত
                    মসজিদে আমি যেতে চাই
যেহেতু মোল্লা
দৌড় সেহেতু
                   গৃহ-ধর্মেই থেমে যায়


















ফটোসৌধ
জিয়া হক
..............
চাঁদ একটা শুঁড়িখানা
মদই বিলায় সে পক্ষকাল ধরে
গ্লাস আমাদের ভাঙা কিম্বা
হারিয়ে গেছে কোথাও

চাঁদের সঙ্গে সেলফি তোলার
লোক কম















মনোগামী
জিয়া হক
.............
আমি যখন চন্দ্র থেকে ফিরে আসি
সে
    আসে
            চাঁদে
আমি যখন ভালোবাসি
                   সে
       অতর্কিতেই
কাঁদে

এ শুধু অন্ত্যমিল নয়,
                         জানি আমি
যদিও সে একা নেই
  তবুও নয় এ পলিগ্যামী

পুনরুক্তি : যতবারই যৌনতা ছাড়া
                 প্রেমের কাছে
                 বেশিকিছু দাবি করতে গেছি
                  সোজা বাংলায়
                  হার্টব্রেক হয়েছে




শব্দতাড়িত প্লুটো
জিয়া হক
..............
পেল্লায় এই জীবন আর গোল্লার এই জীবন
আর মোল্লার এই জীবন আর
সাহিত্যময় স্নাতক,
আমি মুখ্যু সময়-ঘাতক
একে গ্রহণ মানে অসুখ
ইহা ত্যাজ্য সেও বিসুখ
দূরে বকের রাজ্যে আলো
আমায় শত্রুই কি পাঠালো?

আমার শিক্ষকগণ মহান
তাদের পা
অমৃত সমান
তাদের ভক্তি মানে বিজয়
তারা আছেন মানে অভয়
আমার মধ্যযুগে ভীতি
এবং কাব্যকলায় প্রীতি
আমি কাজের ক্ষেত্রে ঠুঁটো
তাই বিবাহবাজারে প্লুটো





আত্মালাপ
জিয়া হক
..............
উৎপল : নিরক্ষর বেশ্যাদের কাছে যেতে...
বিনয় : আমিও তো কয়েকবার ভুট্টাক্ষেতে
উৎপল : তারা কাজ করে, অর্থ নেয়, পাহাড়ের
              অধিকার চায় না
বিনয় : পাহাড় কি বাদামের? বাদামী পাহাড়?
উৎপল : আমার চটির কথা মনে পড়ে
বিনয় : পরাঙ্মুখ চটি, নালিঘাস
উৎপল : তোমার সারস, জানো, প্রকৃতই
              উড়ে বসে প্রাকৃতজনের আপ ট্রেনে
বিনয় : হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারস
উৎপল : হেমন্তের জঙ্গলে যাবে আজ?
বিনয় : সে তো শক্তির গড়
উৎপল : সেখানে কুয়োর জলে...
বিনয় : ঈশ্বর কি গনিত বোঝেন, হ্যাঁ?

Zia Haque |

বাইপাসে ঝুঁকির অন্ধকার

টিউশন পড়াই।  ফিরি সাইকেলে।  বাইপাস ধরে।  একা ও সাইকেল।  প্রায় মাঝরাত হয়ে যায়।  এত রাত অবধি কী পড়াশোনা? এর উত্তর নেই।  আপনি অভিভাবক হলে এই প্রশ্ন করতেন না।  পড়ুয়া ছুটি চায়, পড়ুয়ার পিতামাতৃসমাজ ঘন্টা দিয়ে ফিজের ভাগবিয়োগ করেন। থাক সে কথা।  তাঁর শ্রমার্জিত পয়সা খয়রাত করে দেবেন কেন?  একটা তুল্য-মূল্যায়ণ, হিসেবনিকেশের বিলিবন্দোবস্ত থাকা জরুরি। 
বাইপাসে অন্ধকার বেশিই থাকে।  এর কারণ আছে।  সেটা জানতে পারি ক্লাস টেনে।  ভিনপাড়ার এক যুগল বাইপাসে একটু আদি প্রেমে নেমে পড়েছিল।  তাদের সহায়ক বলতে বাইপেসে অন্ধকার। 

Half boiled, half spoiled

এত অলস আলো

তোমাদের গল্প লিখে যাব
যাব কোথায়?
ঢুকে যাব তোমাদের গল্পেই
কীভাবে ঢুকব?
চরিত্রে ঢুকে যাব
কার্যত
এই দৃশ্যমান সফলতা, সুবেশ, সাজঘরে
আমার সামান্য প্রেমটুকু হারিয়ে ফেলব
একটা অকথিত যন্ত্রনার মতো
সঙ্গীত আবহে বাজে সারাক্ষণ
এই অসুখটি বড় বয়সে বাঁধিয়ে বসেছি
পংক্তিটি এভাবে বলা যেতে পারে
প্রৌঢ়ে পাওয়া রোগ হে আমার
শুধু ওই শিশুগাছটি বাঁচিয়ে রেখো যে
শরণার্থী অথচ একটা হীনকান্ড , হীনজ্ঞান
প্রেম
সফলতা বর্ণনার সচিত্র শহরে
উতল চাকার ধারে
এই কথাগুলো বড় কবিতার মতো শোনায়
মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না

আমার ব্যথাগুলো
কবিতার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে 

প্রিয় কবি


আমাদের বন্ধুরা আজ আসবে। বাড়ি আলো হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার এ এক বিকল্প। 

সিরিয়া ও একটি বক্সিং ব্যাগ




শহরটার ল্যান্ডস্কেপ আমি হারিয়ে ফেলছিলাম । বাজার,  স্কুল,  আদি গঙ্গা, বন্ধুর বাড়ি,  প্রেমিকা যেখানে মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়েছিল,  চপের দোকান,  সাইকেলের লিক সারানোর সেন্টার,  ভোটগ্রহণ কেন্দ্র,  ছাপাখানা,  রাধেশ্যাম বস্ত্রালয়, আসমা হোটেল,  অন্নপূর্না মিষ্টান্ন ভান্ডার, পদ্মপুকুর বাস স্ট্যান্ড,  পাথর-ওঠা নতুন বাইপাস, আমার নিজের বাড়ি —একে একে আমি সব গুলিয়ে ফেলছিলাম । গুলিয়ে পড়া লোকেরা গুলিয়ে ফেলে । গুলিয়ে হঠাৎ করে যায় না, তার একটা পূর্বাশ্রম থাকে । অতীত আপাতত থাক । কেননা 'অন্ধকার যুগ'  থেকে শিক্ষা নিয়ে 'নতুন'  যে যুগ আমরা গড়েছি তা মোটেও আলো-ভর্তি নয় । আসলে নিজের অন্ধকার ঢাকার জন্য অন্যকে অন্ধকার প্রমাণ করা জরুরি । কিন্তু আমার চিন্তা তা নয়,  আমি ভাবছি যে কীভাবে আমার ঘনিষ্ঠতম শহরটার ল্যান্ডস্কেপ ফিরে পেতে পারি । 

তাপসীকে জানালাম । 
নাফিসাকে জানালাম ।
অপরূপকে জানালাম ।
আর জানালাম সুনয়নাকে । 
এখন সব এমসিকিউ । চারজনকে জানালে একজনের সাড়া মিলতে পারে । না মিললে আবার চারজন । আমি অক্লান্ত কারণ গুলিয়ে পড়া কোনও কাজের কথা নয় আর এখান থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতেই হবে । আসতেই হবে কারণ আমার রোজগার দিয়ে আব্বা মা কে এখনও দু'জোড়া জুতো কিনে দিতে পারি নি । 

সুনয়নার গলা শুনে মনে হল আমার বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবার মতো অবসর তার রয়েছে । 
সে বলল,  আমার সঙ্গে বকখালি চল । এসব একঘেয়েমি থেকে হয় । 
সেই মুহূর্তে ওকে বিলেত-ফেরত ডাক্তারই মনে হল । যদিও সে মেটালার্জি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে শিবপুরে । ওর বাবা রাজ্য সরকারের কোনও একটা দপ্তরের সচিব । 
আমি বললাম,  আমার এমন একজনকে দরকার যে বিকালে আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরবে, বকখালি না গেলেও অসুবিধে নেই । 
সুনয়না বলল,  তুই আমাদের কসবার ফ্ল্যাটটায় মাসখানেক অজ্ঞাতবাস নে । চেনা,  জানা,  পরিচিত দুনিয়াটাকে একটু দূর থেকে দেখ না । আমার মনে হয় না খারাপ লাগবে । 
আমি বলি,  এভাবে কি নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়? 
সে বেশ মজার একটা কথা বলল । এমন কথা তার মুখে কখনও শুনি নি । 
সে বলল,  দুভাবে স্বর্গে যাওয়া যায় । যদি স্বর্গে আদৌ তোর বিশ্বাস থাকে । প্রথম হল,  পুণ্য করে আর দু নম্বর হল,  পাপ না করে । 

সব কিছুর উত্তর সব সময় দিতে নেই । আমি সুনয়নাদের কসবার ফ্ল্যাটে আত্মগোপন করে থাকবো স্থির করে ফেলেছি । 
শুধু বললাম,  সন্ধ্যাগুলো আমার সঙ্গে কাটিয়ে যাস কিন্তু । 
সে মাথা নাড়ল । 

প্রগলভ নয় এমন মেয়েদের আমি পছন্দ করি কিন্তু আমার পছন্দ কাউকে জানাই না কারণ সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেলেই ওই রাষ্ট্রে আমার যে অ-বান্ধব শ্রেণি আছে তাদের প্রাথমিক কাজই হবে আমার পছন্দ - অপছন্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে আক্রমণ করা । আক্রান্ত হতে তারা ভালোবাসে যারা আক্রান্তের রাজনীতি জিনিসটা বোঝে ভালো । আমি শুধু বুঝি না তা নয়, বুঝতে চাইও না । 

গোল বাধল অন্যত্র । 
ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছি,  শনিবার বিকেল,  সন্ধ্যার আগেই কসবায় পৌঁছতে চাই । ৩টে ২০ তে ট্রেন । পারতপক্ষে আমি বাসে চড়ি না । বাস ব্যবসায়ীরা আমার বিরুদ্ধে যান-বৈষম্যের অভিযোগ আনতেই পারে । একমাত্র মহামান্য আদালত যদি বছর দশেকের মধ্যে এই তুমুল জটিল বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে আমাকে স্বস্তি দিতে পারে । 

বেরনোর ঠিক আগে তাপসীর ফোন ।
'তুই সেদিন কীসব বলছিলি বল তো,  একটু ডিস্টার্বড ছিলাম তাই মন দিতে পারি নি । '

ওকে কসবার ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিলাম ।
সেক্টর ফাইভ থেকে ফেরবার পথে ও একবার ঘুরে যাবে । 

তাপসী কয়েক মাস হল বিয়ে করেছে । ওর বর ইস্টার্ন রেলের টিকিট পরীক্ষক । ওদের বিয়েতে আমি যাই নি । আসলে আমি মেনে নিতে পারি নি । আমি চেয়েছিলাম যে তাপসীও আমার মতো একা থাকুক । একা থাকতে গেলে এক নীল আগুন নিজের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখতে হয়,  নিভতে দেওয়া যায় না । তাপসী পারত । মনে হত,  যে-আগুনে চাল সিদ্ধ হতে পারত,  সেই আগুনে বিড়ি জ্বালানো হতে থাকবে । এ অপচয় । 

অপরূপের ফোনও এল । 
এখন আর কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না । কিছুই আর সমাপতন নয় । নাফিসার ফোনও এসে যেতেই পারে । সে যতই আমাকে ঘৃণা করুক । প্রসঙ্গত বলবার,  নাফিসা বানু অত্যন্ত মিতবাক আর সেই সঙ্গে মেধাবী । কলেজের কোনও কোনও শিক্ষক ও অ-শিক্ষক কর্মচারীও তার পাণিপ্রার্থী ছিলেন । আর নাফিসার স্বপ্নে ছিল অভিনব বিন্দ্রার মতো কেউ । ও একদিন স্বপ্ন বলে ফেলেছিল । কিন্তু মিস্টার বিন্দ্রাকে ভালবাসতে হলে আমাকে  যে কেন ঘৃণা করতে হবে তার কোনও সদুত্তর পাই নি ।

অপরূপকেও কসবার ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়েছি । ও স্কুল থেকে ফেরার পথে আসবে । 

নিজেরই আধা-পরিচিত বাড়ি ছেড়ে বেরনোর সময় দেখি মা ঘুমোচ্ছে । তার পায়ে হাত রাখতেই তার ঘুম ভেঙে গেল । মা বেশ অবাক, কেননা প্রণাম আমি আগে কখনও করিনি । শ্রদ্ধা জানাতে কারো পায়ে হাত দিতে হয় —এই তত্ত্বে আমার বিশ্বাস নেই । আমার শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল,  মায়ের জন্য একটা এসি যন্ত্র কিনে আনব । এই গরমে তার ভীষণ কষ্ট হয়,  ঘুমোতে পারে না । 

একজন মানুষ ঘুম থেকে তৃপ্তি নিয়ে জেগে ওঠে অথচ মা'র চোখে জল । 
আমি ও মা দুজনেই দুজনকে বললাম,  কী হয়েছে? 
মা বলল, একটা খারাপ স্বপ্ন কদিন আমাকে খুব জ্বালাতন করছে রে । 
আমি বললাম,  সেই স্বপ্নটা আবার ফিরে এসেছে মা? 
-কোন স্বপ্নটা? 
আমি ধরিয়ে দিতে চাইলাম,  যে-স্বপ্নে আমি মরে যাচ্ছি, সেই স্বপ্নটা ।
মা বলল,  তুই কী করে বুঝলি? 
আমি সত্যিই মরে যাচ্ছি মা । তুমি টের পাবে না তা কি হয়? 
মা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,  এসব কী বলছিস আসাদ ? 
-শুধু দোয়া কোরো যেন ন্যাচারাল ডেথ হয় । 
মা তাকিয়ে আছে তার ছেলের মুখের দিকে । বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে । কেউই তার সৃষ্টি করা জিনিসের মৃত্যু দেখতে চায় না । খুব বিকৃত হলেও সে চায় জিনিসটা থাক । 
মা শুধু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস বাবা? 
আমি বললাম, জানলে তুমি যেতে দেবে না মা । কিন্তু যেতে আমাকে হবেই । 
মা'র চোখেমুখে সন্তান হারিয়ে ফেলবার  বিন্দু বিন্দু ভয় জমে উঠেছে ।
আমি রাস্তায় নামলাম । 

পরিচিত রাস্তায় নামলে যেমন অনুভূতি হওয়া দরকার তা হচ্ছে না । এ রাস্তা আমাকে বারুইপুর রেলস্টেশন নিয়ে যাবে —এই জ্ঞানটুকু আমার সান্ত্বনা । সান্ত্বনা খুব জরুরি । অনেকে শুধু সান্ত্বনা পেতে চিকিৎসকের কাছে যায় । চিকিৎসক একটি মূর্তিমান সান্ত্বনা ।

কসবার ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি গত পঁয়তাল্লিশ মিনিট । চাবি নিতে ভুলে গেছি । সুনয়নাও আমাকে চাবিখানা দিতে ভুলে গেছে । তাপসী, অপরূপ কেউ এখনও এসে পৌঁছয় নি । দশ মিনিটের মধ্যে কেউ না এলে সন্তোষপুরে এক জ্যোতিষীর দরবারে যাবো, মনস্থির করে ফেলেছি । জ্যোতিষীদের আত্মবিশ্বাস খুব কন্টাজিয়াস । আমার এখন সেটুকুও দরকার ।

আরও মিনিট পাঁচেক পর সিড়িতে অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল । ওরা হয়ত এসে গেছে । আমার উদভ্রান্ত মুখ দেখে তারা কী ভাববে আমি তাই-ই ভাবছি । ভালোবাসা যে পাত্র থেকেই আসুক সেটা যদি তোমাকে শীতল না করে তবে সরেজমিনে আবার দেখে নিতে হবে আগাছা কোথায় জন্মে গেল । যে কোনও সম্পর্কে নিড়ানি ব্যবহার জরুরি । 

এ আমি কাদের দেখছি এখানে?  তাপসী, সুনয়না, অপরূপ তো এরা নয় । খাকি-পরা তিনজন পুলিশ । 
সবচেয়ে লম্বা পুলিশটা বলল, তোকে থানায় যেতে হবে ।
আমি বললাম,  'তোকে' বলছেন কেন,  আপনি বলুন । 
সবচেয়ে মোটা পুলিশটা বলল,  যতক্ষণ তুই নির্দোষ প্রমাণ না হবি ততক্ষণ আমরা তোকে আপনি বলতে পারব না । 
-কিন্তু আমার দোষ কী? 
সবচেয়ে রোগা পুলিশটা বলল,  থানায় না গেলে আমরা তোকে কিছু বলতে পারব না । 
অগত্যা থানা ।

লকাপে বসে আছি । জেল যদি হয় সংশোধনাগার, তাহলে লকাপকে কী বলা যাবে?  ভাবছি সংশোধনাগারে যদি আমাকে পাঠানোই হয় তাহলে আমার কী কী সংশোধন হতে পারে । প্রথমেই মনে হল, মানুষকে সহজে বিশ্বাস-ভরসা করবার পাপটাই সবার আগে শোধন হবে । 

সবচেয়ে মোটা পুলিশটা লকাপের গেট খুলে দিয়ে বলল, আয়, বড়বাবু কথা বলবেন । 
গিয়ে দেখলাম সবচেয়ে রোগা পুলিশটাই বড়বাবু ।
একটা চটি - পাতলা পুস্তিকা এগিয়ে দিয়ে বড়বাবু বললেন, এটা পড় । 
একটা আরবি বর্ণপরিচয় ধরনের বই । আলিফ,  বা, তা, সা, জিম,  হা,  খ,  দাল, জাল —প্রতিটা অক্ষর প্রায় তিরিশ ফন্ট সাইজে নিউজ প্রিন্টে ছাপা । 
আমি বললাম,  এসব পড়তে হবে কেন? আর আমিই বা পড়তে যাব কেন? 
বড়বাবু বললেন,  তুইই পড়বি কারণ এটা যা-তা বই নয় । এটা একটা সন্ত্রাসী সংগঠনের ইশতেহার । আর তুই সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ।
-কীভাবে? 
—তোর ব্যাগে এই ধরনের কয়েকটা বই পেয়েছি আমরা । 
আমি জানি যে আমার ব্যাগে এখন নাপাম বোমা, ক্ষেপনাস্ত্র, এবং রাসায়নিক অস্ত্র পাওয়া যাবে একে একে । আর এঁদের সঙ্গে তর্ক করেও লাভ নেই ।
বিনীতভাবে বললাম,  স্যার,  এটা একটা আরবি বর্ণপরিচয় । এই দেখুন,  এই আলিফ জবর আ,  শিন জবর শা,  মিম জবর মা,  যেমন আমাদের বাংলায় তালব্য শ আকার শা,  ম আকার মা,  ঠিক তেমনি । দেখুন দুটোতেই মা আছে,  কী মজার না? 
সবচেয়ে লম্বা পুলিশটা বললেন,  দেখলেন স্যার,  বলেছিলাম, এ সব জানে,  তথ্য গোপন করছে । 

পরের দিন সকালে একজন বিরাপ্পানী গোঁফের পুলিশ এসে লকাপ খুলে আমাকে বড়বাবুর সামনে নিয়ে গেলেন ।
বড়বাবু বললেন,  বসুন । 
আমি বেশ অবাকই হলাম । জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার স্যার,  আমাকে আপনি-আজ্ঞে করছেন? 
তিনি বললেন,  উই আর সরি ।
-সরি কেন স্যার? 
-আপনার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই ।
আমার খুব দুঃখ  হল । এটা অনৈতিক । এতে পুলিশি ব্যবস্থার  মানহানি হয় । 
বললাম, স্যার,  দুঃখ করবেন না,  সব ঠিক হয়ে যাবে । 

থানার বাইরে বেরিয়ে এসেছি । থানার বাইরে পৃথিবীটা সত্যিই অন্যরকম । কিন্তু এই অন্যরকম পৃথিবীটা আমি এখন চিনতে পারছি । সবাইকে চিনতে পারছি । আর অসুস্থ বোধ হচ্ছে না । আমাকে জ্যোতিষীর কাছে একবার যেতে হবেই।

জ্যোতিষী গোবর্ধন শাস্ত্রীর বাড়ির সামনে প্রচুর লোক । এত মানুষ জ্যোতিষে বিশ্বাসী!  ঠিক,  যখন জনপদ খুব হতাশায় ভোগে তখন এই ধরনের খোপগুলোতে ভিড় বাড়ে । জ্যোতিষীদের মতো ধৈর্য খুব অল্প প্রাণীরই থাকে । তারা ঠিক দেবতা নয়,  ঠিক দৈত্যও নয় —মাঝখানে আটকে থাকা জীব —এই অবস্থানে থাকা যে কী উপভোগ্য তা সংখ্যালঘু মাত্রেই জানে । 

জানলাম যে জ্যোতিষার্ণব শ্রী গোবর্ধন শাস্ত্রী হিমালয় চলে যাচ্ছেন । ইহজগৎ থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্তি । তাঁর কাছে হিমালয় ইহজগতের অংশই নয় । 

ভিড় ঠেলে তাঁর সামনে যেতেই তিনি বললেন,  ভিজিলান্তে!  কিছু ভাষা এবার ভুলে যাও বৎস ।
আমি জানি তাঁর কানে সব খবর চলে এসেছে । কীভাবে তিনি এত খবর পেয়ে যান, রাখেন আমি বুঝি না । 
আমি বললাম, আপনাকে এখন আমাদের খুব দরকার শাস্ত্রী মশাই ।
তিনি মৃদু হাসলেন । তারপর মুখময় সেই হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে বললেন,  কেউই দরকারি নয় বৎস । প্রত্যেকে শাস্তি ভোগ করে চলে যাবে । এই যেমন আমি চলে যাচ্ছি । 
আমি অবাক হলাম । কী বলছেন ইনি! 
জিজ্ঞেস করলাম,  আপনার অপরাধ কী শাস্ত্রীজি? 
তিনি একই ভঙ্গিতে বললেন,  অপরাধ আমার না,  অপরাধ আমার পিতামাতার । আমাকে জন্ম দেওয়ার মহান যে অপরাধ তারা করেছিল তার শাস্তি আমাকেই ভোগ করে যেতে হবে । 
-আপনার সঙ্গে কথা বলে আজ মোটেও ভালো লাগছে না । এর একটা বিহিত করুন ।
শাস্ত্রীজি বললেন,  আসাদ,  আমরা সবাই মুক্তি চাই কিন্তু যে - সামান্যটুকুও আমাদের আয়ত্তাধীন তাকে মুক্তি দিতে আমরা পারি? 
নাহ,  এত রগরগে জীবনবোধ আমার ভালো লাগছে না । বললাম,  যাই শাস্ত্রীজি । হিমালয়ে কখনও গেলে দেখা করে আসব ।
তিনি আবারও হাসলেন । এই হাসির ব্যাখ্যা সবাই জানে । এমন হাসি হাসতে সবাই পারে না । 

আমি উঠে ভিড় ঠেলে বারান্দায় এসেছি, তাঁর একজন ভক্ত ডাকলেন ,  গুরুজি তোমাকে ডাকছেন ।

ভক্তটি আমাকে পাশেই আরেকটা ঘরে নিয়ে গেলেন । এই ঘরে লোকজন নেই । দেওয়ালে একটা বড় ফটো টাঙানো । শাস্ত্রী মশাইয়ের যৌবনের ফটো । উলোঝুলো দাড়িগোঁফ নেই,  একেবারে ক্লিন শেভেন । সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো লাগছে । চোখময় দ্রোহ ।
শাস্ত্রী মশাই ঘরে ঢুকে বললেন,  আখলাক,  এই টাকাটা রাখ,  মায়ের জন্যে একটা এসি  নিও ।
এ আবার কী?  আমি তো নিজের উপার্জনে মা'কে  যা কেনার কিনে দিতে চাই । এই টাকায় আমার শ্রম কোথায়? এ টাকা আমি নিতে পারব না, তা-সে যতই মহৎ কাজের জন্য দেওয়া হোক না কেন । 
বললাম, আমার কাজ আপনি কেন করে দিতে চাইছেন? 
শাস্ত্রী মশাই বললেন,  তুমি জিজ্ঞেস করলে না কী করে আমি জানলাম । 
-আপনার 'জানা' নিয়ে সংশয় অনেক দিন আগে থেকেই আর আমার মনে নেই । কিন্তু এ টাকা আমি নিতে পারব না । 

তিনি তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে , যদিও তাঁর দৃষ্টিতে আমি নেই তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি,  তাঁর দৃষ্টি আর মোটেও ইহজাগতিক নয়,  আমার এবার যাওয়া দরকার । ভিড় ঠেলেই আবার আমাকে যেতে হবে । ভক্তদের ভিড় । 

বিকালে নিঃশব্দে বাড়িতে এসে ঢুকলাম । একটা অচেনা বেড়াল আমাদের গেটের ধারে দুটো ছানা নিয়ে বসে আছে । ধবধবে তাদের লোম । মা ঘুমাচ্ছে । 
ছাদে আমার একটা গোপন কুঠুরি আছে । আদৌ সেটা গোপন নয়,  তবে ভাবতে ভালো লাগে যে এই ঘরের হদিশ কেউ জানে না । এই কক্ষটার নাম দিয়েছিলাম উত্তমাশা অন্তরীপ । তখনও বার্থালোমিউ দিয়াজ একটা স্বপ্ন । সে দস্যু না এক্সপ্লোরার তা চিন্তাতেই ছিল না ।

ওই অন্তরীপে ঢুকে আমার প্রথম কাজ হল একে একে তাপসী, সুনয়না, অপরূপকে ফোন করা । 
পুরো বিষয়টা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয় । হঠাৎ সবাইকে নিজের জীবনে ডাকলাম, তারা এলোও, কিন্তু এটা কী হল তারপর?

প্রথমেই সুনয়নাকে ফোন করলাম ।
তার ফোনের সুইচ বন্ধ ।
অপরূপের ফোনের সুইচ বন্ধ ।
তাপসীর বেলাও তাই । 
কিন্তু এ থেকে কোনও সিদ্ধান্তেই আসা অনুচিত । একই সঙ্গে তিনজনই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারে । একই সঙ্গে তিনজনের ফোন বিগড়ে যেতেই পারে । তাদের প্রতি ক্ষোভ করে আমি নিজেকেও  আর যন্ত্রণা দিতে চাই না ।  খুব স্বাভাবিক ।
বারুইপুর শহরটাকে এখন আমার স্নায়ুর মধ্যে অনুভব করতে পারছি কি না —সেটা দেখাই এখন আমার প্রাথমিক কাজ ।

জিয়া হক

ম্যাকারেল : জিয়া হক

ম্যাকারেল : জিয়া হক: পোয়েট অফ ফল আমার দাদার ঘড়ি ঘড়িটি দাদার নয় আসলে। দাদা দিয়েছিলেন আমাকে। তখন সদ্য হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালে চাকুরি পেয়েছেন। আব্বা...

Social circus

বক্তৃতাসভায় যাওয়ার আগে। befor going to a seminar

বাঙালি আলুবৎ। শুধু বাঙালি কেন, হোমো সেপিয়েন্স মাত্রই পট্যাটোসম। সব তরকারিতে দরকারি। নুনও বলা যায় এই অপরিহার্যতা সম্বন্ধে। আমরা domestic help-এর জন্য শিশুকর্মি রাখব এবং child labor বিষয়ে সারস্বত তর্ক তুলব। তর্ক একটি প্রপঞ্চ। একটি illusion.। পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর তর্কানুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে, প্রয়োগ হয়নি তর্ক-ফলের। তাই এটা সারস্বত 'ধানাইপানাই' ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা বলব, অধ্যাপকের তো তর্কই পেশা। আমরা বলব, উৎপাদকের কাজ ফলানো, ব্যবহারকারীকে সব সময় উৎপাদক হতে হয় না। thinkers চিন্তা পরিবেশন করবেন, society তার usage নির্ধারণ করবে। এই হল প্রক্রিয়া। system.। অথচ এমন ব্যবস্থা আমরা চেয়েছিলাম যেখানে অ-ন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীও 'সার্বিক'ভাবে just থাকবেন। আমার শিক্ষক লিখেছেন, 'যত বেশি জানে, তত বেশি মানে'। হওয়ার তো ছিল তা-ই। কিন্তু তা কি হয়? ঘটে? প্রথমত, জ্ঞানী আক্রমণ করেন অজ্ঞানীকে, অজ্ঞানতাকে নয়। জ্ঞান কার্যত এমন এক advocacy তে নেমে পড়ে যেখানে যাবতীয় 'disobey'কে মান্যতা দেওয়ার পয়জার-judo ছকা হয়।

এখন 'knowledgeable' আর 'wise' শব্দদুটি নিয়ে মেধা-চক্র চলতে পারবে।

আপাতত বক্তৃতা সভায় যাওয়ার আগে বক্তার বাকযন্ত্রপাতিকে তুলায় তোলার আগে বক্তাকেই তুলুন না। অন্তত অব্যবহিত পরে হৃদয়-বিদার-মুক্তির জন্যে।

NB: বিবেচক নির্বাচক চাই।

জি হ

প্রথামাফিক ধর্মে যাদের বিশ্বাস, তাদের জন্য কিছু কথা।

এই ভোট-তপ্ত অঞ্চলে আপনি কী করবেন? তাঁদের কথাই বলছি যাঁরা উপনিষদ-সংহিতা-কুর'আন-ওল্ড টেস্টামেন্ট-হাদিস-ত্রিপিটক-গ্রন্থসাহেব-জেন্দাবেস্তা পড়েন নি, পৈত্রিক/মাত্রেয় কিছু অনুশাসনকে 'ধর্ম' বলে জানেন, স্বগৃহই উপাসনালয় যাঁদের, অনিচ্ছাবশত চাঁদা দেন ধর্মানুষ্ঠানে এবং পথিমধ্যে অনুশোচনা করেন, উত্তরণ-অযোগ্য বিপদে না পড়লে ধর্মের সাধারণত দরকার পড়ে না যাঁদের, তাঁরা কী করবেন এই ভোট-নগরে? আমরা একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি করণীয়ের--
১। প্রচারে ধর্ম অনুষঙ্গ হয়ে এলেও আপনি মুখ ফেরান কেননা প্রচারক কার্যত আপনার বোধকে অপমান করছেন।
২। উন্নয়নের কোনো ধর্মীয় বিভাজন হয় ? মানে, প্রজাতিভিত্তিক উন্নয়ন-গ্রাফের অস্তিত্ব আছে কারণ প্রজাতিভিত্তিক ডিসক্রিমিনেশনের অস্তিত্বও রয়েছে। আপনি সবার কথা ভাবেন, কেউ শুধু আপনার কথা ভাবছেন বলে নাট্যাভিনয় করেন।
৩। রাজনৈতিকতাকে রাজনীতি দিয়ে সামলাতে হয়। আপনি শুধু শুধু কারো ধারালো বুদ্ধির সামনে আপনার করোজ্জ্বল হৃদয় পেতে দেবেন না। যে প্রীতি তাৎক্ষণিক তা আসলে 'গুডএনাফ' নয়।
জি হ

গাভী-খেলানো মেয়েরা অনতিদূরে শুয়ে আছে




একটি রূপাতীত পোকা এসে বসল জংলী পাতায়।
আমি এখানে এলাম অনেকদিন পরে।
এখানে গাভী আর গাভী। কিছু ধেনু ষাঁড়ের দৌলত। তার জঙ্গ।
দূরে, অনেকানেক দূরে উড়ন্ত চাকির মতো জলের ট্যাঙ্ক দেখা যায়, খাঁ খাঁ করে।
শুধু তৃণজীবীদের ঘাস টেনে ছেঁড়ার শব্দ।


গাভী-খেলানো মেয়েরা অনতিদূরে শুয়ে আছে।
রয়েছে অপ্রাপ্তবয়স্ক বাবলার মরমর মূরতি।
‘আকাশ ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে’।
এই রূপ দেখবার কোনো সঙ্গী আমার নেই।
প্রকৃতি ধীরে ধীরে মেনোপজে চলে যাচ্ছে,
আমরা তার সবুজ-লাগা সাদা থানখানি
৮০০ স্কোয়ার ফিট বাড়ির টবে টবে টাঙিয়ে রাখলাম।
 সে অবলা, সে অবোলা।
সূর্যোদয়ের জন্য আপাতত সে পুব। সূর্যাস্তের জন্য ফলত তা পশ্চিম।
এতে যেমন বিজ্ঞান নেই,
ঘাসে শুয়ে রূপের এই যে বর্ণনাকারী সে ও প্রকৃতিপ্রেমে নেই কার্যত।

Book review : Mr. Mukherjee

এই গ্রন্থটি উপকারী। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের শাক্ত-শক্তি-উপাসনা নেই শুধু, এখানে রয়েছে তাঁর জীব-দর্শন। রামকৃষ্ণের কৃষ্ণ-দেবী-আকুতির সূক্ষ্মরূপ আর মায়া ও মোক্ষ-এর উজাড়-চিন্তা এই বইয়ে আছে। এটি কি কাব্যগ্রন্থ? বোধ হয়, না। আপনি একে রাজনৈতিকতা মিশিয়ে পড়ে দেখতে পারেন, কিংবা উত্তর-আধুনিকতা, শুধু আপনার সহৃদয়তা চাইছে পংক্তিগুলি।
ইলাহি ভরসা।