বিশ্বাসে বামপন্থী, প্র্যাকটিসে নয়, অর্থাৎ ভণ্ড : কবি অয়ন চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার



অয়ন,প্রথমে একটা চিরাচরিত প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি।তোর কবিতা লেখার শুরুর ব্যাপারটা একটু বল।মানে কবিতা লিখতে হবে এই দিব্বিটা কে দিল?
আলবেয়ার কাম্যু ফুটবল খেলতেন, গোলরক্ষকের পজিশনে। একবার নিজের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, খেলা চলছে বিপক্ষের অর্ধে। কাম্যুর মনে হল, জীবন এরকমই। শোনা যায়, এভাবেই জন্ম হল আউটসাইডার উপন্যাসের। কবিতা আমার কাছে আকস্মিকভাবে এসেছে, কোনও পরিকল্পনা করে আমি কবিতা লিখিনি। আমি যা লিখি, তা পড়ে অন্যরা বলেছে এগুলো কবিতা। আমার এরকম কোনও দাবি ছিল না, এখনও নেই। বলা যায়, অন্যের মত মেনে নিয়েছি মাত্র। তাই কেউ যদি আমার লেখা পড়ে বলে যে কবিতা হয়নি, সেটাও মানতে সমস্যা হয় না আমার। আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি, অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। তার মাধ্যম কবিতা হলে কবিতা, গদ্য হলে গদ্য, দিনলিপি হলে দিনলিপি, সিনেমা হলে সিনেমা।

তোর আগের প্রজন্মের কোন কবি বা কোন কোন কবিকে তোর প্রাথমিক পর্যায়ের লেখালেখির ভিতর খুঁজলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে বলে তোর বিশ্বাস? 
আমি যাঁদের যাঁদের লেখা আজ পর্যন্ত পড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের প্রভাব আমার লেখায় আছে। ছিল, আছে এবং থাকবে। শুধু আমার আগের প্রজন্ম নয়, আমার পরের প্রজন্মের লেখাও, শুধু কবিতা নয়, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ ভ্রমণকাহিনি ব্যক্তিগত চিঠি জীবনী সব সব। আর শুধু লেখা কেন, আমি যাঁদের যাঁদের সংস্পর্শে এ জীবনে এসেছি, সে আমি তাঁদের পছন্দ করি বা না করি, যে যে ঘটনার অভিঘাত আমার জীবনকে ছুঁয়েছে, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, সমস্ত কিছুর প্রভাব আমার লেখায় আছে। কারণ প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক প্রাণী, প্রত্যেক উদ্ভিদ, প্রত্যেক জড় অজড় বস্তুসমূহ, এই মহাকাশ, এই সমুদ্র, এই বাতাস, এই নক্ষত্ররাজি, সবই আমার অভিজ্ঞতার অংশ, আর যা যা আমার অভিজ্ঞতার অংশ, সব কিছুই আমার লেখায় থাকে। আমার ঋণ অপরিসীম এবং অপরিশোধ্য।

তোর লেখালেখির প্রথম থেকেই আমি তোকে জানি।অসংখ্য লেখা তুই সম্পূর্ণ মাথায় লিখেছিস প্রথমে,পরে তা খাতায় টুকেছিস। একেক লেখকের এক এক রকম পদ্ধতি থাকে। আমি শক্তির পান্ডুলিপি দেখেছি,প্রায় কাটাছেঁড়া নেই।তোর লিখন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াটা কি?
লেখা তো মাথাতেই তৈরি হয়। খাতাতে লিখলেও মাথায় তৈরি হয়, কম্পিউটারে লিখলেও। আমার পাণ্ডুলিপিতেও কাটাছেঁড়া প্রায় থাকেই না। কারণ লেখা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি সাধারণত খাতায় কিছু লিখি না। যাবতীয় বদল, কাটাছেঁড়া, সংশোধন সংশোধন এবং সংশোধন, গোটা রান্নাঘরটাই থাকে মাথায়। পাণ্ডুলিপি হল আমার খাওয়ার টেবল। ওখানে ম্যাক্সিমাম নুন গোলমরিচ সস প্রয়োজনমতও ছেটাতে পারি।

আমরা একটা কথা শুনি।মহৎ কবিতা।এব্যাপারে তোর বক্তব্য কি? তুই মহৎ কবিতা লেখার কথা ভেবেছিস, নাকি কবিতা লিখে মহৎ হওয়ার কথা?
কবিতাই বুঝি না, তার ওপর আবার মহৎ কবিতা! মহত্ত্ব বলে আছে নিশ্চয়ই কিছু, আমি সেসব টের পাইনি, খুব একটা আগ্রহীও নই। ওসব যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগে, নিজের ভাগের শেষ জলবিন্দুটুকু বিপক্ষের মুমূর্ষু সৈনিককে দিয়ে দেওয়া টেওয়া, আমার লেখালেখিতে ওসব নেই বলেই আমার আশা।


যিনি মার্গ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ, আমরা তাঁর নামের আগে ওস্তাদ বা পন্ডিত বসাই। কিন্তু মান্না দে, কিশোর কুমার,  এঁরা যত বড় শিল্পী হোক ঐ উপাধির অধিকারি নন।কবিতায় যদি এরকম হতো।সমসাময়িক কোন কবির আগে ওস্তাদ বসাতিস?নিজেকে ইনক্লুড করে উত্তর দিবি।
এসব উপাধি বসানোর রীতিতে বিশ্বাসী নই, তবে তোর প্রশ্নের মূল স্পিরিটটা বুঝতে পেরেছি। আমার সমসাময়িকদের অনেকের লেখাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। কারোর কারোর গোটা গোটা বই, যেমন অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহিরিটোলা আর সিঙ্গালীলা ঠাকুর, বিপ্লব চৌধুরীর সিন্ধু ও সমূহ , ভবতরঙ্গ আর মদ, শোভন ভট্টাচার্যর ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রতি আর শনির জাতক, তোর লেখা মাথুর আর গুঞ্জাগাথা, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার খোয়াব, প্রসূন ভৌমিকের বুয়া ও বাবুই,  সুদীপ্ত চক্রবর্তী, শুভাশিস ভাদুড়ি, সার্থক রায়চৌধুরি, রওশনারা মিশ্র, তপন রায়, মণিশংকর বিশ্বাস, তাপসকুমার লায়েক, পারমিতা মুন্সি, তারেক কাজি, মিতুল দত্ত, কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, হিন্দোল ভট্টাচার্যর বেশ কিছু কবিতা, জয় মজুমদার জ্যোতিপ্রকাশের বন্ধুরা নামে একটা কবিতা লিখেছিল, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিল মার কাছে যাব নামে একটা কবিতা, কারোর কারোর অনবদ্য সব কবিতার লাইন ঝলসে ওঠে যেন, শুভাশিসদা লিখেছিল, একটি সুবর্ণ রেখা পড়ে আছে নদীর কিনারে, রণজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছিল, সামান্য ঘুরেছে হাওয়া পৃথিবীর শেষপ্রান্তে এসে, আবির সিংহ লিখেছিল, কোনও জাহাজই ডোবে না, আত্মহত্যা করে, মুকুট ভট্টাচার্য লিখেছিল, টিকটিকির ধৈর্য নিয়ে বসে আছি মিরাক্যল ঘটার আশায়, সাম্যব্রত জোয়ারদার লিখেছিল, অগাস্ট মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ শ্রমিকেরা কিছুতেই নিজেদের ভাগ্য বদলাতে পারছে না, দেবাশিস কুণ্ডু লিখেছিল, কথকতা আবহাওয়া শাস্ত্রীয় গীতি/ অথচতা ডুমুরের ফুল ম্রিয়মাণ / দেখেছি তো দেখেছি তো মিথ্যে প্রলাপ / হয়তো বা তোকে কারও আড়ালে দেখেছি!
সকলকেই আমার কুর্নিশ! অনেকের নামই করা হল না হয়তো।

আমার ধারণা, কবিতা লেখার পেছনে একজন কবিরএকটা বিস্ময়বোধ কাজ করে।এই মহাবিশ্বে কী তোকে বিস্মিত করে?
এই মহাবিশ্বই আমাকে প্রতিনিয়ত বিস্মিত করে। অভিশপ্ত মানুষ হল সেই, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা যার নষ্ট হয়ে গেছে। অনন্ত নক্ষত্ররাজি থেকে ঘাসে পিঁপড়ের চলাচল, সব আমাকে বিস্মিত করে। ফ্লাশ গর্ডনের কমিকসে একটা লাইন পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম, এই পৃথিবীর একটা গাছের ডাল ভেঙে দাও, সুদূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে! 

প্রতিভা, সাধনা।নিজের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কাকে এগিয়ে রাখবি?
প্রতিভা, প্রিভিলেজ এবং সাধনা, এই তিনটেই জরুরি। কে বলতে পারে, বীরভূমের আদিবাসী গ্রামে, বা রাজাবাজারের বস্তিতে হয়তো এমন কেউ কেউ আছে যারা কবিতা লেখার, কবিতার জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগই পেল না। প্রতিভা তাদের ছিল, সাধনার ক্ষেত্রও হয়তো প্রস্তুত ছিল, যোগাযোগ ঘটল না শুধু। তিনটেই না থাকলে, বাকি দুটো দিয়ে বড় কোনও কাজ হয় না।

তোর কবিতার লাইন, কবিতা বন্ধুরা লেখে আমি শুধু বাহবা ছুঁড়েছি।এই ভাবনা থেকেই কি গান্ধার পত্রিকা করতে আসা?আজ কি মনে হয়, অই পত্রিকা করা,সম্পাদনা করা, তোর নিজের লেখালখিকে কি কোনো ভাবে সাহায্য করেছে?
ঐ লাইনটা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে খানিক রাগ থেকে লেখা। পবিত্র ক্রোধ। গান্ধার আমি সম্পাদনা করার আগে থেকেই ছিল। সৌরভ পাণ্ডে, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ সেনগুপ্ত মূলতঃ কাগজটা করত। এছাড়া সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর বাগচী, তাপস দততো এরাও যুক্ত ছিল। গান্ধারের লোগো দু’বারই এঁকেছিল সাম্যব্রত জোয়ারদার। ওরা সস্নেহে আমাকে গান্ধার ছিনিয়ে নিতে দিয়েছিল। আর পত্রিকা সম্পাদনা করা অবশ্যই লেখালেখিকে সাহায্য করেছে, কারণ আগেই বলেছি, কোনও অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না।

একটা গান আছে।শুকনো সাধু করিস নে মা রাখিস আমায় রসেবসে। আমি জানি যে তুই শুকনো সাধু নোস।বিরাট একটা রসিকতাবোধ সব সময় তোকে জড়িয়ে থাকে।এই রসবোধ ব্যাপারটার সাথে সিরিয়াস  কবিতার কি কোনো আপাত বিরোধ আছে?
বিরোধের প্রশ্নই ওঠে না। রসবোধের সঙ্গে জীবনধারণের সম্পর্ক আছে। যার রসবোধ নেই, সে ঠিকঠাক বেঁচে নেই।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বই। একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ে যাবার আগে পূর্ববর্তী লেখাগুলো নতুন যে লেখা আসতে চলেছে, তাকে কি বলে সাবধান করে?
ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। আমার জীবনে ম্যাজিকাল থ্রি ওয়ার্ডস আই লাভ ইউ নয়, সেটা হল ডোন্ট রিপিট ইয়োরসেলফ। কিছু লেখা একটা বইতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, হতে চেয়েছে মানে তাদের একটা জার্নি আছে, জার্নির একটা শুরু আছে, একটা শেষ আছে, জার্নির একটা পূর্ণতা আছে। জার্নি পূর্ণ হল মানে এবার নতুন কোনও পথে হাঁটো। সেই পথে তোমার হাঁটার ধরণের সিগনেচার অবশ্যই থাকবে, তুমিই যে হাঁটছ সেটা বোঝা যাবে, কিন্তু পথ, পথের দু’ধারের দৃশ্যাবলী, অভিজ্ঞতাসমূহ অন্য হবে।

প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রেই তাঁর জীবনযাপন তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করবেই। আমার জীবনের ঘটনা আমার লেখাকে প্রভাবিত করে। কবিতা কি কখনো জীবনকে প্রভাবিত করেছে?
আমার লেখা আমার জীবনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। বাকি কথা অপ্রকাশ্য।

জীবন তোর কাছে কী? মৃত্যুকে তুই কিভাবে দেখিস?
জীবন অনিশ্চিত। মৃত্যু অনিবার্য । অন্ধকার থেকে এসে ফের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। মাঝে কিছু নক্ষত্র রাতের গান।

কয়েকজন আছেন, যাঁরা পরিচালক এবং কবি। বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত তাঁদের একজন।কিন্তু এরা প্রায় প্রত্যেকেই কবি হিসেবে যত না উল্লেখযোগ্য, আমার ধারণা পরিচালক হিসেবেই গ্রহণযোগ্য বেশি।  তুইও পরিচালক আর কবি। তুই সিনেমা আর তোর কবিতার মধ্যে সম্পর্কটা কি ভাবে দেখিস?
খুবই দুঃসম্পর্ক। সিনেমা বানাতে অনেক টাকা লাগে। যে টাকা আমার নেই। ফলে ইনভেস্টর নামক একজনকে প্রচুর কিছু বোঝাতে হয়। তাঁরও কিছু চাহিদা থাকে। লেখালেখির এসব দায় নেই। এটাই তফাত।

আমার একটা ব্যাক্তিগত মতামত আছে তোর দ্বিতীয় বই তুমি সম্পর্কে। আমি মনে করি ' তুমি'  তোর শ্রেষ্ঠ বই। কিছু লেখা হয় যা পাঠককে শান্তি দেয়। কিন্তু এই বইটায় যন্ত্রণার সাথে একটা ছটফটানিও মিশে আছে,একটা অদ্ভুত অতৃপ্তি বলতে পারিস। তোর কী মনে হয়?
তুমি একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে লেখা। অসম্ভব যন্ত্রণাসঞ্জাত ঐ বই। মনে হয়, তোর পাঠ সঠিক। লেখার সময় আমার ভেতর কষ্ট যন্ত্রণা বিষাদ অপরাধবোধ অতৃপ্তি অক্ষম ক্রোধ , এই সব আবেগ অনুভূতিই অতি অতি তীব্র মাত্রায় ছিল। সেসব অনুভূতি লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে সঞ্চারিত হতেই পারে।

বিষণ্ণ রূপকথা তোর সাম্প্রতিক বই। মাঝখানে অনেকদিন চলে গেছে। দীর্ঘ বিরতি। কবির জন্যএই বিরতিগুলোর কি খুব প্রয়োজন?  কবিতার বিচারে বিষণ্ণ রূপকথাকে আমার কেমন যেন একটা উদাসীন কবিতাবই বলে মনে হয়েছে। মানে, যে বিষণ্ণতা আছে, তা তেমন যেন গ্রাহ্য নয়।আমি কি ঠিক?
আমি যেহেতু চেষ্টা করে লিখি না, তাই বিরতি বিষয়টাতেও আমার হাত নেই। লেখার অনুশীলন চালিয়ে গেছি। তুমির পর যে নতুন পথ দেখতে চাইছিলাম, সেটা যখন দেখতে পেলাম, তখনই বিষণ্ণ রূপকথা এল। বলা যায়, বিষণ্ণ রূপকথার জন্য একটা অন্বেষণ ছিল, তার জন্যই বিরতি প্রয়োজন ছিল।
তুমির বিষণ্ণতার তীব্রতা বিষণ্ণ রূপকথাতে এসে স্তিমিত হয়েছে। বিষাদ এখন অনেক শান্ত, স্তিমিত, পরিব্যাপ্ত। এই বিষাদ হয়তো খানিক সুখকর। সুখ এখানে উপশম অর্থে ব্যবহৃত। তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধে নিজেকে সঁপে দেয়ার যে সুখ, সেটা। তুমির বিষাদের তল দেখতে পেতাম। বিষণ্ণ রূপকথায় সেটা পাই না। বিষাদ এতই নিত্যসঙ্গী। বন্ধুই বলা চলে। বিষণ্ণ রূপকথায় উদাসীনতা নয়, অবসাদ আছে। তুমির বিষাদের তীব্রতায় আমি হারিয়েই যেতাম, বহু যত্নে অদিতি আমাকে বিষণ্ণ রূপকথায় নিয়ে এসেছে। ওর সহ্যশক্তি অতুলনীয়।


প্রথম সিনেমার জন্যই ফিল্মফেয়ার পেয়েছিস। এতোগুলো বই লিখেও এখন অবধি কোনো পুরস্কার পাসনি। তাহলে কি পরিচালক অয়ন কবি অয়নকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে ক্রমশ? 
এতে প্রমাণিত হয়, এই বাংলায় যতজন যোগ্য কবি আছেন, ততজন যোগ্য চিত্র পরিচালক নেই। আর কে পেছোচ্ছে, কে এগোচ্ছে জানি না, নতুন লেখা লিখছি, আশা করি সামনের বছর বই হয়ে বেরোবে। বইয়ের নাম, নক্ষত্র রাতের গান।

নিজের দশক সম্পর্কে তোর মূল্যায়ন কী?
কবিতার কোনও দশকওয়াড়ি মূল্যায়ন হয় না। মাইকেল কোন দশকের কবি ছিলেন? রবীন্দ্রনাথ? জীবনানন্দ? আমারও কোনও দশক নেই। আমার কিছু বন্ধু এবং কিছু পরিচিত কবি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ দেশ পত্রিকার উমেদারি করে সময় নষ্ট করেছেন, কেউ বিরোধিতা করে, দুটোই কর্মনাশা। কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের তাঁবেদারি করে সময় নষ্ট করেছেন, কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিদের উপহাস করে, দুটোই অনর্থক শক্তিক্ষয়। কেউ কেউ নীরবে লেখা অনুশীলন করেছেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁরাই আমার বন্ধু।

তোর বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট রাজনৈতিক অয়নকে পাই। কবিতায় সেভাবে পাইনা কেন?রাজনৈতিক অয়ন সম্পর্কে বল।
আমার লেখায় রাজনীতি থাকে। কারণ কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। এক্ষেত্রে পার্টি পলিটিক্সের কথা হচ্ছে না। হ্যাঁ , সেইসব লেখা হয়তো নিকানোর পাররার মতো কী সমর সেনের মতো সেই অর্থে রাজনৈতিক লেখা নয়। ফেসবুকে লিখি না, কমেন্ট করি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স নিয়ে। আর রাজনৈতিক অয়ন হল, বিশ্বাসে বামপন্থী, প্র্যাকটিসে নয়, অর্থাৎ ভণ্ড।

প্রাচীনকালে কবিকে ঋষি বলা হত। কবি মানেই তিনি সত্যদ্রষ্টা।  আধুনিককালে এই কথাটা কতটা সত্যি?
ঋষি আর কবির মধ্যে এক সুতোর তফাত আছে। দু’জনেই বিশুদ্ধতা খুঁজছেন। যতক্ষণ পাচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি কবি, পেয়ে গেলে ঋষি। তবে কোনও কোনও কবি বিশুদ্ধতা নামক পরশপাথর পেয়েও ফেলে দিয়ে ফের খুঁজতে থাকেন, কেবল খোঁজার মজাতেই। এঁরা দুষ্টু প্রকৃতির কবি।

পাঠক অয়ন চক্রবর্তীকে মনে রাখবে কি?
কী বলছিস এসব! মহাকাল বিরাট বিরাট ব্যাপার ভাই! এই মহাকালের রথের চাকায় মহাভারত কে লিখেছিলেন, তিনি একজনই, নাকি অনেকে মিলে লেখা, তা আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। শেক্সপিয়ারের নাটক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তা কি আসলে শেক্সপিয়ারেরই লেখা? সেখানে ব্যক্তি অয়ন কে! কেউ নয়। কিচ্ছু নয়। কোনও মানুষকে মহাকাল মনে রাখেনি, মনে রাখতে দেয়নি, মনে রাখতে দেবে না। কিছু কীর্তি অন্য কীর্তির তুলনায় কিছু বেশি দিন টিকবে। তার মধ্যে আমার লেখা থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো গনৎকারের টিয়াপাখি আমি নই, হতেও চাই না।


শেষ প্রশ্ন।  আমি তুই দুজনেই টেলিভিশনে কাজ করেছি।আমরা জানি,আজকের দিনে ইন্টারভিউ দেওয়া আর নেওয়া দুটোই অনেক সহজ। কবিতা গান সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু আগেকার দিনে তা ছিল না। রফি সাহেব,কিশোরকুমার সহজে সাক্ষাৎকার দিতেনই না। কিশোর মাত্র তিনবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।একবার আমিন সাহানিকে, একবার প্রীতিশ নন্দী চেয়েছিলেন, কিন্তু কিশোর তাঁকে বলেন যে তিনি দিতে পারেন তবে প্রীতিশ নয়, কিশোরকুমারকে প্রশ্ন করবেন কিশোরকুমার নিজেই। তাই হয়েছিল তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন আর উত্তর দেন।আর তৃতীয় সাক্ষাৎকারটি তাঁর কাছে চাওয়া হলে তিনি বলেন, দেবেন যদি লতা মঙ্গেশকর নেন।তাঁরা লতাজিকে বলেন আর লতাজিও রাজি হন। সেই ইন্টারভিউর কিছু অংশের ভিডিও পাওয়া যায়। এত কথা বললাম কারন শেষ প্রশ্নটা আমি চাই তুই নিজেই নিজেকে কর।উত্তরও দে।

প্রশ্ন : কবিতা না লিখলে কি আমার মৃত্যু হবে? 
উত্তর : হ্যাঁ ।

প্রশ্ন করেছেন : কবি জয়দীপ রাউত


বিশ্বনাথ পুরকাইতের চারটি কবিতা


১।
পোকাদের বাসস্থান দেখে আসি চলো, মাথা গুঁজে
কোথায় চলেছে, দু-একটা সেলাই ছাড়া এ বছর কাজ নেই,
মেজদার শালিটারও বিয়ে হয়ে গেল।

বজ্রসম্ভাষিত পাখি, মাছ, গবাদি পশুর দল
গোধূলিতে মাঠে ছিল যারা তাদের খবর নাও;

মানব জীবন বড় দায়, কীটপতঙ্গের বাসাও
চিনে রাখতে হয়।


.২।
তোমরা নদীর পাড়ে খেলা কর, হাসাহাসি কর
হাঙর-কুমীর দেখে; বুকের পাটা হে তোমাদের।
আমার ভাইও ছিল ডাকা-বুকো, চাঁদ দেখে, ভূত
দেখে, বাঁশবন ডুবন্ত জাহাজ দেখে
মাঝরাতে ফিরে আসত বাড়ি।

আমি অতো বীর নই বাবা, ঘরে থাকি,
মাঝে মাঝে ভাইকেই দেখি উড়ে যাচ্ছে দ্রুতগামী
তারাদের আলো মাথায় ঝিলিক মারে
সোনালি-রূপালি মাছ তোমাদের নদীতে যেমন


৩।
ঊর্বশীর দাঁত দেখে আমিও হেসেছি
যদিও নাচেন তিনি ভালো
রাজা নন, সেনাপতি নন, রানিমার মন ছিল
তবলা বাদকে; তিনিই দলের অছি।

বিশ্ববন্ধু অপেরার স্মৃতি এভাবেই ফিরে আসে,
মাথার ভিতর হুহু করে গান, রমণী আহ্লাদ;
তোমাকে দেখাতে চাই মাঝিভাই তুমিই মালিক
নদী ও নৌকার। রাজনীতি ছাড়া বলো
দেশে আর কী কী আছে? পারাপার কেন
এত হিম হয়ে এল?


৪।
এবার গোসাবা যাব, প্রিয়তোষ ভাই
নৌকা লাগাও ক্যানিং-এর ঘাটে,
ভূমিহীন দেবতারা ভুল ছদ্মবেশে এদিকেও ঘোরাঘুরি
করছেন দেখি; তুমি বল, ওনাদের সঙ্গে নেওয়া
সুবিধার হবে? ওনারা কি সাঁতার জানেন?

বাতাসে কমলা রঙ, মেঘ এল অসময়ে, দূর্ভাগা স্বজন
যেদিকে ঝড়ের রাত সেদিকেই কেন যেতে চাও?

গোসাবা অনেক দূর? প্রিয়তোষ, দিনে
দিনে ফিরে আসা যাবে?

উপরিভাগে : জিয়া হকের কবিতা


অশ্রুনদীর ধারে আমি দুইখানি গর্ধব আর নিজেকে দেখলাম
তিনজন গর্ধবই ছিল, তিনজন পবনসন্তান
গাছে গাছে আম্র আর বিভীষণ আশেপাশে ছিল
আমার সুলক্ষণ চাই, আমাকে সীতা এনে দাও, বলি
এই সেই ব্যস্ত নালিখাত যার তীরে জয়ী--পরাজয়ী
সিজদানত ছুরি
কোথায় কেবলামুখ, কোনদিকে ওহুদের টিলা
অজ্ঞানতা আছে তাই কাবাঘর সব দিকে আছে
কোন বনে লুকিয়ে রয়েছো দুষ্ট প্রভু?
ছেঁড়ে দেহ কাঁটা ও শামুকে--তুমি কি শিকারে রয়েছো?
তিন প্রাণী, নদীর এপারে, গলা শুকনো, অশ্রু পান করে
গ্রন্থ পিঠে, অপৌরুষেয়, সুস্বাদ কোথায়?
কতদূর ঐশ্বরিক কচি ঘাসজমি?
তোমাকে চিবিয়ে বুঝবে ঘাসে তুমি কতটুকু আছো


প্রিন্সিপিয়ার ইতিহাস এবং । দ্বিতীয় পর্ব । অর্পণ পাল



১/ লেখা শুরুর পর থেকে প্রকাশ অব্দি।।
প্রিন্সিপিয়ার বিষয়বস্তু আইজ্যাক নিউটনের মাথায় ঘুরছিল এডমন্ড হ্যালির সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার অন্তত বছর ছয়েক আগে থেকেই। সে সময়েই তাঁর আবিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে যে সূর্যের চারদিকে যে পৃথিবী ঘোরে (বা পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ)— এই ঘোরবার জন্য প্রয়োজনীয় আকর্ষণ বল বিপরীত বর্গের সূত্রই মেনে চলে (অর্থাৎ দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, আকর্ষণ বল সেই দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে কমতে থাকে)। তবে এরপরেই তাঁর জীবনে চলে আসে একের পর এক মৃত্যুর স্রোত। ১৬৭৭ সালে প্রয়াত হন তাঁর কাছের দু’জন— কেমব্রিজের প্রাক্তন লুকাসিয়ান অধ্যাপক আইজ্যাক ব্যারো আর রয়্যাল সোসাইটির প্রথম সেক্রেটারি হেনরি ওল্ডেনবার্গ, আইজ্যাককে আরও একটু নিঃসঙ্গ করে দিয়ে। এমনিতে তিনি উইকিনস ছাড়া তাঁর বাড়িতে সঙ্গ দিতেন না কাউকেই, উপরন্তু ১৬৭৯ সালের মে মাসে ন’দিনের জন্য লন্ডন থেকে ঘুরে এসে তিনি খবর পান তাঁর মায়ের শরীর খুব খারাপ।
খবরটা পেয়েই তিনি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গ্রামে মায়ের পাশে থেকে দিন কয়েক সেবা করবার পরেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় (মায়ের পাশে সারারাত জেগে থাকতেন তিনি, মায়ের ফোঁড়া নিজে হাতে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিতেন)। হানাকে তাঁর প্রথম স্বামীর পাশেই কবরস্থ করা হয়। আইজ্যাক, আশা করা যায় এই ব্যাপারে অন্তত সন্তুষ্টই হয়েছিলেন।
সম্পত্তির দেখাশোনা এবং মায়ের কিছু পাওনা আদায় করতে গ্রামের বাড়িতে এরপর আইজ্যাক থেকে যান মাস কয়েক। কেমব্রিজে যখন ফিরে আসেন, তখন দারুণ ঠাণ্ডা পড়েছে; তাঁর শূন্য বাড়িতে শুধু জমে আছে এক গুচ্ছ চিঠি। যার মধ্যে একটি এসেছে রয়্যাল সোসাইটি থেকে, প্রেরকের নাম রবার্ট হুক।
চিঠির উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না, তবু চিঠিটা পড়ে দেখলেন, সেখানে উল্লেখ করা আছে একটা বহুদিনের পুরনো সমস্যার। হুক উৎফুল্লভাবে জানিয়েছেন, তিনি গ্রহের গতি সংক্রান্ত কিছু নতুন ধারণা আবিষ্কার করেছেন এবং এ ব্যাপারে আইজ্যাকের মতামত চান। এ ব্যাপারে যদি আইজ্যাকের কিছু দ্বিমতও থাকে, সেটা জানালেও হুক আনন্দিত হবেন। আর এ সব তিনি গোপন রাখবেন।
আইজ্যাক হুককে জানান তাঁর মানসিক অবস্থার কথা, আর সেই সঙ্গে এ-ও জানান, এই ব্যাপারে (গ্রহের গতিপথ সংক্রান্ত ব্যাপারে) তাঁর জ্ঞান যথেষ্টই কম। তিনি শুধুমাত্র পৃথিবীর আহ্নিক গতি সম্বন্ধে কিছু ধারণার কথা বলে চিঠি শেষ করেন।
প্রসঙ্গটা এই, অনেকেই এর আগে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছেন, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য খুব উঁচু একটা টাওয়ার থেকে যদি কেউ কিছু নিচের দিকে ফেলে, তবে সেটা কি একেবারে নিচে না পড়ে কিছুটা এগিয়ে, বা পিছিয়ে গিয়ে পড়বে? কারণ ওই পতনকালের মধ্যেই তো পৃথিবী সামনের দিকে বা পিছনের দিকে অল্প হলেও সরে যাবে।


ছবি- ১। রবার্ট হুক। রিটা গ্রিয়ার-এর আঁকা।

রবার্ট হুকের সঙ্গে এই প্রসঙ্গ নিয়ে আইজ্যাকের বিরোধ বেধে যায় এরপরে কয়েক মাসের মধ্যে, এবং সেই বিরোধের রেশ চলেছিল ১৭০৩ সালে রবার্ট হুকের মৃত্যু অব্দি। দুজনের সম্পর্ক কখনওই আর স্বাভাবিক হয়নি। রবার্ট হুক আর আইজ্যাক নিউটনের বিরোধ সতেরো শতকের বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় ঘটনা। আমরা অন্য অধ্যায়ে এই প্রসঙ্গ আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

২/
গোটা ১৬৮৫ সাল আইজ্যাক নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন এই বইটি লেখবার কাজে। এপ্রিল আর জুন মাসে মাত্র দু’বার তিনি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন, সপ্তাহদুয়েক করে থেকে কিছু কাজ সেরে আসবার জন্য। তাঁর অন্য যে কাজে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল, সেই অ্যালকেমিবিদ্যার চর্চাও এইসময় প্রায় বছর দেড়েক বন্ধ রেখেছিলেন এই বইটি লেখার জন্য। তখন তিনি নতুন সহকারী পেয়েছেন এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় হামফ্রে নিউটনকে। হামফ্রে এসেছিল গ্র্যান্টহ্যাম থেকে, আইজ্যাক নিউটনের কাছে থেকে পড়াশুনো করবার জন্য। মূলত আইজ্যাক নিউটনের লেখাপত্র বা যন্ত্রপাতি গুছিয়ে দেওয়া— এইসবই করত সে। প্রিন্সিপিয়া বইটি সে কপিও করে দিয়েছিল, শোনা যায়। মজা করে অনেকে বলেন, হামফ্রে যা টুকতেন তার সবই প্রায় না বুঝেই টুকতেন।
প্রিন্সিপিয়া লেখাকালীন সময় দিন কয়েক শুধু এই লেখার জন্যই আইজ্যাক যোগাযোগ রেখেছিলেন তখনকার ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল জন ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বহু তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নিউটনকে। তবে নিউটন তাঁকে ঘুণাক্ষরেও বলেন নি যে তিনি একটি বিরাট বই লিখছেন, আর এই তথ্যগুলো চাওয়া হচ্ছে সেই বইয়ের প্রয়োজনেই। পরে তাঁর বইয়ে অবশ্য আইজ্যাক ফ্ল্যামস্টিডের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি।
হামফ্রে নিউটনের স্মৃতির কিছুটা উল্লেখ করা যেতে পারে—
I never saw him take any recreation or pastime, either in riding out to take the air, walking, bowling, or any other exercise whatever. Thinking all hours lost that were not spent in his studies, to which he kept so close that he seldom left his chamber… so intent, so serious [was he] … that he ate very sparingly, nay, sometimes he forgot to eat at all, so that going into his chamber, I have found his mess untouched. When I have reminded him, he would reply: Have it! Then making to the table, would eat a bit or two standing, for I cannot say, I ever saw him sit at table by himself.’ (নিউটনের জীবনীকার জন কন্ডুইটের কাছে স্মৃতিচারণ)
শুধু একটা ঘটনাতেই মাঝখানে একবার আইজ্যাক বিচলিত হয়েছিলেন, যখন খবর পেয়েছিলেন যে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। সেটা ১৬৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। রাজার ভাই দ্বিতীয় জেমস দায়িত্ব নিয়ে দেশটাকে ক্যাথলিক হিসেবে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারেন এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আইজ্যাক দ্বিতীয় চার্লসকে অনেক ব্যাপারে অপছন্দ করলেও দ্বিতীয় জেমসকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। সুতরাং তাঁর মনে কিছুটা দুশ্চিন্তা জাগল এইসময়। আর এই দুশ্চিন্তার কারণেই হয়তো, তিনি লেখবার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন।
বইটা মোটামুটি সম্পর্কযুক্ত তিনটি খণ্ডের হতে চলেছে, একটি ভূমিকা সহ— তিনি ঠিক করে ফেলেছেন ততদিনে। প্রথম খণ্ডে থাকবে তাঁর সেই গতিসূত্র তিনটি আর সেগুলো নিয়ে আলোচনা; দ্বিতীয় খণ্ডে বিভিন্নরকমের বল আর সেই বলের প্রভাবে বস্তুর গতি, উদস্থৈতিকবিদ্যা (Hydrostatics), উদগতিবিদ্যা (Hydrodynamics), শব্দ, তরঙ্গ আর স্রোত নিয়ে আলোচনা; আর তৃতীয় খণ্ডে থাকবে বিভিন্ন বলের প্রভাবে বস্তুর গতির বাস্তব কিছু উদাহরণ যেমন গ্রহ বা উপগ্রহের গতি, ধূমকেতুর গতি ইত্যাদি— এইভাবে মোটামুটি বইটাকে সম্ভাব্য সজ্জায় সাজানো হল। তবে প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন বইয়ের সম্ভাব্য খণ্ড হবে দুটি— প্রথমটি হবে ‘De motu Corporum, Liber primus, আর De motu corporum, secundus’। পরে তিনি মত পাল্টে একটি খণ্ড বাড়িয়ে দেন। তাঁর তৈরি ওই প্রাথমিক বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটি, যেটা লেখা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায়, তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় আলাদাভাবে, তবে সে প্রসঙ্গ পরে।
আইজ্যাক এটাও ভেবে রেখেছিলেন, তাঁর বই হবে একেবারেই বোদ্ধা পাঠকদের জন্য। সাধারণের বোধগম্য যাতে না হয়, সেদিকে নজর ছিল তাঁর। সে জন্য তিনি লিখলেন ল্যাটিন ভাষায়, আর পরবর্তীকালেও এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে যথেষ্ট দেরি করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র বছরখানেক আগে প্রিন্সিপিয়া ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
ইচ্ছে করেই আইজ্যাক তাঁর বইটাকে লিখেছিলেন এমনভাবে, যাতে সাধারণ পাঠকের পড়তে অসুবিধা হয়। এক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর বইটি পড়ে বুঝতে গেলে আগে সেই মানুষকে ইউক্লিডের চোদ্দ খণ্ডের ‘এলিমেন্টস’, জ্যামিতি আর বীজগণিতের একাধিক পুরনো বই, জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে কোপারনিকাসের বই— এরকম বেশ কিছু বই পড়ে তবে মাঠে নামতে হবে।

৩/
প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ডের প্রাথমিক খসড়া শেষ হল ১৬৮৬-এর এপ্রিল মাসে। সেটা নিউটন পাঠালেন লন্ডনে, রয়্যাল সোসাইটিতে। হ্যালি ততদিনে সোসাইটিতে বইটি প্রকাশের ব্যাপারে প্রাথমিক জমি তৈরি করে রেখেছেন। এদিকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এসেছে নতুন অতিথি— ১৬৮৫ এর এপ্রিলে তাঁদের একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু তাঁর নিজের তখন সোসাইটিতে অবনমন হয়েছে। এতদিন ছিলেন ফেলো এবং কাউন্সিলের সদস্য, ১৬৮৬ এর ২৭ জানুয়ারি থেকে তিনি হয়েছেন ক্লার্ক। তাঁর বছরে পঞ্চাশ পাউন্ড মাইনে নির্ধারিত হয়েছে। [অনেকে মনে করেন বাবার মৃত্যুর পর এডমন্ড হ্যালির আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই চাকরিটি তিনি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু এই সময়ে তাঁর অন্য উপার্জনও ছিল, তিনি বাবার এস্টেট থেকে বছরে প্রায় দুশো পাউন্ড পেতেন]


ছবি-২। এডমন্ড হ্যালি। থমাস মারে-র আঁকা।

তবু হ্যালি এক মাসের মধ্যে সোসাইটির মিটিং থেকে বইটি প্রকাশের জন্য অনুমতি আদায় করে নিলেন। তবে সোসাইটির পরের মিটিং হতে একটু দেরি হল, মে মাসের উনিশ তারিখের মিটিং-এ ঠিক হল বইটি সোসাইটির খরচের ছাপা হবে। আবার এর পরের মিটিং-এ, জুনের ২ তারিখে সিদ্ধান্ত হল বইটির ছাপাবার যা কিছু খরচ, সব দেবেন এডমন্ড হ্যালি নিজেই, তাঁর ট্যাঁক থেকে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজেই, বইটির প্রকাশ যাতে আটকে না যায় সেজন্য। কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? আসলে সোসাইটির বইটি ছাপাবার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তখন। প্রয়োজনীয় পাউন্ড না থাকার কারণটাও ভারী অদ্ভুত। রয়্যাল সোসাইটি তখন অর্থকষ্টে জেরবার অন্য একটি বই ছেপে বিপুল লস খাওয়ার ফলে। আজ এসব ইতিহাস শুনলে অবিশ্বাস্য লাগে, আইজ্যাক নিউটনের অত বিপুল বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া’ প্রকাশিত হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল যে বইটির কারণে, সেটার নাম ‘Historia Piscium’, বা ‘History of Fishes’, যার লেখক John Ray আর Francis Willughbyসচিত্র এই মৎস্যবিষয়ক বইটি নিয়ে সোসাইটির আশা বা উচ্চাশা ছিল বিরাট, অনেকটা বড় বাণিজ্যিক ব্লকবাস্টার ছবি ফ্লপ হওয়ায় প্রযোজকদের মাথায় যেমন হাত পড়ে, সেরকমই; পরবর্তী সিনেমায় ইনভেস্ট করবার মতো ট্যাঁকের জোর নেই আর তাঁদের।
সুতরাং এডমন্ড হ্যালির আগ্রহে এবং আর্থিক সাহায্যের ফলেই ১৬৮৭-এর জুলাই মাসে প্রকাশিত হল প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ড। বইটি প্রকাশের আগে আরও কিছু নাটকীয় ব্যাপার ঘটেছিল, যার জন্য এর প্রকাশ হওয়াটাই প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তখন রয়্যাল সোসাইটির সেক্রেটারি রবার্ট হুক, যাঁর সঙ্গে বিরোধের জন্যেই মূলত প্রিন্সিপিয়ার আকাশে কালো মেঘ দেখা দেয় গোটা ১৬৮৬ সাল জুড়ে। তবে সে প্রসঙ্গ পরের পর্বে।

প্ল্যানচেটে শক্তি এসে আমার কবিতার বইয়ের নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন : জয়দীপ রাউতের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার




প্রথমেই জানতে চাই তোমার কবিতা লিখতে শুরু করার ঘটনা। তোমার প্রথম লেখা কবে? কীভাবে?
আমার ছোটবেলা কেটেছে গান বাজনার আবহে। আমার বাড়ির সূত্রে নয়, আমার মামার বাড়ি ছিল সঙ্গীত মুখর। আমার মামা, মাসিরা গান বাজনা করতেন। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল, অতুলপ্রসাদ আর অনুষ্ঠানে গাইতেন 'নাম তার ছিল জন হেনরি', 'ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম' ইত্যাদি। আমি মাঝেমধ্যে সেইসব গানে অল্পস্বল্প তবলা বাজানোর সুযোগ পেতাম। আর ছিল কীর্তন। আমার মামাবাড়ির দাদুর এক বন্ধু ছিলেন, তাঁর বাড়িতেই বসত কীর্তনের আসর। আর তিনি শ্রীখোল বাজাতেন। আমি তাঁকে কীর্তনদাদু  বলে ডাকতাম। এই সব গান বাজনা আমাকে প্রভাবিত করেছিল। আসলে কবিতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে অনেক পরে, কিন্তু সঙ্গীতকে আমরা শ্রুতির ভিতর প্রায় জন্ম থেকেই পাই, পেতে থাকি। এরপর যখন একটু বড় হলাম আমার এক গায়ক বন্ধু শুভ্রকান্তি,  আমায় বলল যে, আচ্ছা তুই গান লিখতে পারবি? আমি তাহলে সুর দেব। শুরু হল গান বাঁধা খেলা। আমি তখন ওই মাধ্যমিক পাশ করেছি আর কি। গান লিখে, সুর দিয়ে বসে আছি, এমন সময় একদিন জানলাম মান্না দে কলকাতায় এসেছেন। ছুটলাম তাঁর সিমলার বাড়ি। সাহস বা মূর্খামি, যাই বল না কেন আমরা তখন উত্তেজনায় ফুটছি। গিয়ে বললাম আমাদের তৈরি গান আপনাকে গাইতে হবে। মান্না দে কিছুক্ষণ আমাদের দেখলেন আর তারপর বললেন তোমরা জান, আমি কে? আমরা বললাম হ্যাঁ, জানি বলেই তো এসেছি। উনি বললেন, এবার তাহলে বেরিয়ে যাও। পরবর্তী জীবনে আমার সাথে মান্না দে'র দারুণ সম্পর্ক হয়েছিল, কিন্তু সেটা অন্য কথা। সেইদিন আমরা এই ঘটনায় খুব আহত হয়েছিলাম আর আমি বুঝলাম যে, না, গানটান লিখলে হবে না। কে কবে গাইবেন, বা আদৌ গাইবেন কিনা তার থেকে কবিতা লেখার চেষ্টা করা যাক। ব্যাস।
এবার যেটা শুরু হল তা হচ্ছে কবিতা কী ও কেমন তা বোঝার চেষ্টা। খুব যে বুঝতে পেরেছি তা নয়, তবে সেই থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বোঝার আর মাঝে মাঝে সামান্য লেখার। 

তোমার কবিতা প্রথম কবে কোথায় প্রকাশিত হয়?
আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করলাম, সেই সঙ্গে শুরু করলাম কবিদের সঙ্গে মেলামেশাও। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমায় একদিন একটা চিঠি হাতে ধরিয়ে বললেন এটা নিয়ে তুমি আনন্দবাজারে যাও। সঙ্গে চারটে লেখা নিয়ে যেও। আমি তাতে রাজি হইনি। বললাম না, আপনার অনুরোধে কেউ আমার কবিতা ছাপবে এটা আমি মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারব না। যদি নিজের যোগ্যতায় কোনো দিন ছাপা হয়, হবে। এরপর  স্থানীয় একটা  দুর্গাপূজার সুভেনিয়রে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। আমার মা বাবার খুব উৎসাহ ছিল আমার লেখালেখির ব্যাপারে। আমার মা স্কুলে পড়াতেন। বাবার ছিল দর্জির দোকান। আমার বাবা সেই প্রথম ছাপা হওয়া লেখা দোকানের দেওয়ালে আঁঠা দিয়ে আটকে রেখেছিলেন। যাতে জামা প্যান্ট যাঁরা বানাতে আসবেন তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁর ছেলে লেখালেখি করে আর তা ছাপাও হয়।

কবিতার সঙ্গে তোমার পথচলাটা কীভাবে হয়? মানে, বলতে চাইছি তুমি কবিতার সঙ্গে কীভাবে পথ হাঁটো?
দেখো প্রসূন, আমি প্রথম জীবনে কবিতা কি জানার চেষ্টা করেছি আর পাশাপাশি লেখার চেষ্টা করেছি। আমি সেদিন হঠাৎ খুঁজে পেলাম আমার প্রাচীন অংক খাতা যেখানে তিনটি ভুল অংক আর বাকি সব কবিতা। আমি হাজার হাজার কবিতা লিখেছি  আর ফেলে দিয়েছি। এই এত বছরের কবিতা চর্চায় ছাপিয়েছি মাত্র একশোটার সামান্য কিছু বেশী। কিন্তু একটা সময়ের পরে আমি খেয়াল করেছি যে এই চেষ্টা ব্যাপারটা আসে পরে। এই কাজটা  অনেকটা মেকআপ ম্যানের মত। মানে নায়ক বা নায়িকা এলো। তারপর শুরু হল তাকে সাজানো। আমি তাকে সাজাতে পারলে সেই লেখা রেখেছি, না পারলে ফেলে দিয়েছি। সিরিয়াসলি বললে, আমার কাছে কবিতা ভীষণ রকম একটা দৈব ব্যাপার। দেবী যদি কবিতা পাঠান তখন তাকে আমি অলংকৃত করেছি মাত্র । কিন্তু নিজের ইচ্ছেতে আজ অবধি একটি লাইনও আমি লিখতে পারিনি। এবার তুমি বলতেই পারো যে দেবী যদি নিজেই তোমায় কবিতা পাঠান তো সে সব কবিতা আরো স্বর্গীয় হয় না কেন? কেন তুমি আরো ভালো লিখতে পারো না? পারলাম না কারণ আমি ওই সাজানোটায় সেভাবে হয়ত দক্ষ হয়ে উঠতে পারলাম না বলে।
তুমি যে জিজ্ঞেস করলে কবিতার সাথে আমি পথ চলি কিভাবে, সেটা খুব সচেতন ভাবে আর আজকাল চলি না। সচেতনতা ক্ষতি করে। মাঝেমাঝে মাথায় লাইন এলে তখন সচেতন হই। নিজের মন, নিজের অবস্থান, নিজের জীবন, নিজের আনন্দযন্ত্রণা অনুযায়ী তারপর সাজাই। তবে চেষ্টা করি সেই আনন্দ যন্ত্রণা যেন আমার একার আনন্দ যন্ত্রণা হয়েই না থেকে যায়। আর এই সাজানোর জন্যই চর্চার দরকার। দরকার সাধনার। আমি আমার মতো করে সাধনা করেছি।

কবিতার বলয়ে তোমার কবিবন্ধুদের সঙ্গে আদানপ্রদানের কথা যদি একটু বলো।
তরুণ বয়সে আমি গান্ধার কবিতা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। গান্ধারের প্রধান হল আমাদের অয়ন চক্রবর্তী।  অয়ন প্রথম থেকেই নিজে লেখার পাশাপাশি বন্ধুদেরও উৎসাহিত করে এসেছে। এই গুণ আমার অন্য কবি বন্ধুদেরও ছিল কমবেশি। আমি মনে করি আমার কবিতার শিক্ষক হিসেবে এই কবিবন্ধুদের অবদান সব থেকে বেশী। ধরা যাক আমি যদি গান্ধারের সঙ্গে না মিশে অন্য পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশতাম তাহলে আমার কবিতা ভাবনা বা ওই যে এতক্ষন কবিতাকে সাজানোর কথা বললাম সেটা অন্যরকম হয়ে যেত হয়তো। আমার ভাগ্য ভালো যে আমি প্রচন্ড ক্ষমতাশালী কিছু তরুণ কবির বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলাম সেদিন। কাজেই কবিতা লেখার প্রথম দিকের দিনগুলোয় আদানের দিকটা ছিলই। প্রদান কিছু করেছি বলে তো মনে হয় না। আমার প্রথম বইয়ের শেষ লেখাটার নামকরণ মনে আছে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিল। পরবর্তীকালেও গুঞ্জাগাথার একটা লেখা ছিল, অয়ন কে শোনানোর পরে ও বলল যে শেষ দুটো লাইন দরকার নেই। এরকম হয়েছে। একটা সময়ের পর থেকে তো আমার বন্ধু বলতে শুধু কবি আর কবি। সারাদিনে যত কথাবার্তা তাও ওই কবিতাকে কেন্দ্র করে। আমরা কিন্তু কবিতাকেন্দ্রিক জীবনযাপনই করেছি। তবে আসতে আসতে অনেক কবি বন্ধুর থেকেই মানসিক ভাবে দূরে সরে গেছি আমি। সেটা হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। 


তোমার প্রথম কবিতার বই মাথুর। আমার মতে এটা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতার বই।এই বইএর জন্মের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলো।
নিজের বই নিয়ে কি বলি বলো তো? একটা বই তো একদিনে জন্মায় না। অনেকদিন ধরে জন্মায়। মাথুর আমার প্রথম বই বা পুস্তিকাও বলতে পারো। যখন বই করবার কথা ভাবলাম প্রথমেই ভাবলাম যথাসম্ভব ভালো লেখাগুলো নিয়েই বই হওয়া দরকার। এই ভালোর ব্যাপারটা আমার ক্ষমতা অনুযায়ী ভালো আর কি। নির্বাচন আমিই করেছিলাম। তারপর প্রশ্ন হল কোন লেখার পর কোন লেখা সাজাবো? এই সাজানোর কাজটাও সম্ভবত বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করেছিলাম আমি। মাথুরের মধ্যে প্রেম আর অধ্যাত্মচেতনার একটা মেলবন্ধনের চেষ্টা আছে কোনো কোনো লেখায়। আমার মনে হয় সেই কবিতাই স্থায়ী যার মিধ্যে দিয়ে জীবনের মূল দর্শন বা মূল সত্যগুলি প্রকাশিত হয়। আধ্যাত্মিকতা একটা পথ সেই সত্যকে ছোঁয়ার। পেরেছি কিনা সময় বলবে। 
এই মাথুর নামটি নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। আমার একটা নেশা ছিল মাঝে মাঝে প্ল্যানচেট করার। নানা সময় নানা জনের আত্মা ডাকার একটা নেশা ধরেছিল আমায়। একদিন মনে হল দেখা যাক শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার ডাকে আসেন কিনা। তা, তিনি এলেন একদিন। তাঁকে একথা ওকথার পর জিজ্ঞেস করলাম যে আমার বই প্রকাশিত হবে, কি নাম দেওয়া যায়? উনি বললেন 'মাথু্র' রাখো। এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন, নাও পারেন। কিন্তু এই নামটি আমি প্ল্যানচেটের মাধ্যমেই পেয়েছি। শক্তি আমার কলমে ভর করে এই নামটি লিখে দিয়েছিলেন। যদিও যাঁরা এই ঘটনাটা জানেন তাঁরা বলেন যে এই নামটি আমি যে আমার প্রথম বইয়ের নাম হিসেবে রাখব সেটা নাকি আমার অবচেতনেই ছিল। জানিনা। চেতন আর অবচেতনের মধ্যে মানুষের মন তো নিরন্তর যাতায়াত করছেই।

মাথুর বইটিতে একটি কবিতা আছে যার প্রথম লাইনটা--সন্ধ্যায় যে ফুল ফোটে তার নীরবতা ছায়া ফেলে যেখানে আকাশ,একটি নক্ষত্রে তুমি সেইখানে স্থির হয়ে আছো। এই কবিতার জন্মকথা জানতে খুব ইচ্ছে করে। একটু যদি সেইকথা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করো।
কোনো একটি বিশেষ কবিতা কেন লেখা হল তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, আমার মনে হয় খুব স্পষ্ট করে বলা যায় না। বিশেষত, আজ এতদিন পর যদি বলিও, বানিয়ে বলা হবে। সত্যি কথাটা হল, এলো তাই লিখলাম। আমার কেমন মনে হয় এই পৃথিবীতে যা যা হয় তা শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়। মানে, ওই যে, সন্ধ্যায় যে ফুলটি এখানে নীরবে ফুটল, তা শধু এখানেই ফুটল না। তা আকাশেও ফুটল অথবা প্রতিবিম্বিত হল। ছায়া শব্দটি দূরত্বব্যাঞ্জক। আর ওই দূরের প্রতিবিম্বে একজন 'তুমি' আছো। বিরহের ব্যাপারস্যাপার, বুঝেছ তো? এর বেশী নিজেও জানিনা আমি।

তোমার সঙ্গে বাংলাভাষার একাধিক শ্রেষ্ঠমানের কবির ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়েছে, তাদের ব্যক্তিত্ব আর কবিতা তোমার লেখায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?
বাংলা কবিতায় একটা মজার ব্যাপার আছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বাদ দিলে পরবর্তী কালে বাংলা কবিতাকে সরাসরি ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করেছেন যে দুজন কবি, তাঁরা হলেন উৎপলকুমার বসু আর জয় গোস্বামী। আমি খেয়াল করেছি যে ভাস্কর চক্রবর্তী,  গৌতম বসু, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, রণজিৎ দাশ এঁরা সকলেই কমবেশি প্রাথমিকভাবে উৎপল অনুসারী। এঁরা অবশ্যই নিজ নিজ লেখায় প্রতিভার অধিকারী,  কিন্তু ওদের প্রবাহিত নদী উৎপলদার যে গভীর প্রবাহ তার আশপাশ দিয়েই বয়ে গেছে প্রাথমিক ভাবে। বাংলা কবিতাকে উৎপল যে কিভাবে প্রভাবিত করেছে, ভাবা যায় না। আমাদের ন'য়ের দশকেও সেই প্রভাব অব্যাহত। 
এর পরে আসি জয় গোস্বামীর কথায়। জয় পরবর্তী বাংলা কবিতায় হাজার হাজার জয়। তবে উৎপলকে তাঁর পরের প্রজন্ম যতটা সার্থক ভাবে অনুসরণ করেছিল, জয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এর কারণ হতে পারে এই যে, জয়কে যতটা ভালোলাগার কারনে তারা অনুসরণ করেছেন ততটা গভীরভাবে বুঝতে পারেনি। যাঁরা তাঁকে অনুসরণ করতে চেয়েছেন তাঁরা ব্যর্থ অনুকরণ করে ফেলেছেন শেষ অবধি। 
খেয়াল করলে দেখা যাবে, এত যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ কবি শক্তি, তাঁর জীবন যাপন যতটা পরের কবিদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলো ততটা কিন্তু পরবর্তী  লেখালেখিতে প্রবাহিত হলেন না তিনি।
আমি শক্তি, উৎপল, বিনয়, জয়, এঁদের সঙ্গে মিশেছি এবং কবিতার পাঠক হয়ে থেকেছি। কিন্তু যে কোনো রকম সরাসরি প্রভাব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি আমি জানিনা। শক্তির শব্দ ব্যবহারের যে ম্যাজিক আমাকে আকর্ষণ করেছে। উৎপলের যে শিল্পকুশলতা তা আমায় লোভ দেখিয়েছে। আমি সেখান থেকে কবিতার যে মূল মেরুদণ্ড, তাকে খুঁজে বের করতে চেয়েছি। বুঝতে চেয়েছি।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কথা একটু জানতে চাই। ওঁর কবিতা নিয়ে তোমাদের কখনও কথা হয়েছে? সেইকথা একটু জানতে ইচ্ছে করছে?
সে তো অনেক গল্প। আমি তখন একটি পত্রিকা করব ঠিক করেছি। আমি আর আমার পাড়ার এক বন্ধু। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামক এক কবি এই বাংলা ভাষায় আছেন এবং তিনি বেলেঘাটায় থাকেন, এইটুকু শুধু শুনেছি। তবে তিনি কি, কেমন, কিছুই জানিনা। আমিও তখন সম্ভবত ১২ ক্লাস পাস করেছি। একদিন তাঁর বাড়ি চলে গেছি। কড়া নাড়তে একজন এসে দরজা খুলেছেন। বললাম যে একটা পত্রিকা করব, সেই ব্যাপারে কথা বলতাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কি বাড়ি আছেন? কিছু উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে গেলেন। তারপর আবার বেরিয়ে এসে বললেন আমিই শক্তি। ভিতরে এস। গিয়ে বসেছি। আমি যথেষ্ট বিস্মিত। কিন্তু তখনও বুঝিনি যে বিস্ময়ের সেই সবে শুরু। তিনি নিজে অন্য ঘরে চলে গেলেন আর  কিছুক্ষণ পরে তিনি দুই কাপ লিকার চা হাতে নিয়ে এলেন আমার সামনে। বসলেন। আমি সেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বুঝলাম যে সেই চা যথেষ্ট ঠান্ডা। তারপর, তাতে চুমুক দিতেই চমকে প্রায় ছিটকে উঠেছি। আর শক্তিও ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে কাপ বদলাবদলি হয়ে গেছে। একই রকম দেখতে দুটো কাপের একটিতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ঠান্ডা লিকার চা আর অন্যটিতে বাংলা মদ। আমার প্রথম মদ খাওয়া সেইদিনই।
এরপর শক্তি কবিতা দেবেন কথা দিলেন ঠিকই কিন্তু ঘোরাতে লাগলেন। যেদিন যাই সেইদিন গিয়ে বসি, চা চানাচুর খাই আর তারপর তিনি বলেন যে সামনের সপ্তাহে এসো। আবার যাই আর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।  এই করতে করতে প্রায় ছমাস গেছি। তারপর একদিন একটা কবিতা দিলেন আমায়। কবিতার প্রথম লাইনটা ছিল, 'এ বৃদ্ধ বয়সে গান শুনে হয় আক্রান্ত যৌবন'। আমি আগেই বলেছি যে শক্তি কি, কেন, কেমন এ সম্পর্কে তখন পর্যন্ত তেমন ধারণা ছিল না আমার। আমি কবিতা পেয়েই অন্য একটা আবদার করে বসি। আমি বলি যে আমি যে পত্রিকাটি করব ভাবছি আমি নিজেই তার সম্পাদক আর যদি আপনি সহ-সম্পাদক হন? আপনি রাজি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, রাজি। আজ ভাবলে লজ্জা লাগে, আবার আনন্দও হয়।  সরলতা বা বোকামো মানুষকে কখনো কখনো ঈশ্বরের কাছে নিয়ে আসে।
আমি আসলে এক শান্ত শক্তিকে দেখেছি। যে বোহেমিয়ান শক্তিকে নিয়ে সবাই রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলে, তাঁকে আমি দেখিনি খুব একটা। এরপর ৪ বছর তাঁর  মৃত্যুর আগে এই শহর ছাড়ার আগের রাত অবধি প্রায় প্রতিদিন তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে। আমার প্রথম চাকরিও তাঁর দেওয়া। তাঁর জন্য যে গাড়ি বরাদ্দ ছিল, তাতেই এক সঙ্গে বহুদিন অফিস গেছি। ফিরেছি একা।
হ্যাঁ, আমার সেই অল্প বয়সের লেখা আমি তাঁকে কখনো কখনো শুনিয়েছি। তিনি মতামত দিয়েছেন। এই ভাবে চলতে চলতে আমি শক্তি পড়া শুরু করেছি আর ততদিনে শক্তি কি, কেন এই ব্যাপারটা কিছুটা হলেও বুঝেছি। 
শক্তি নিজের লেখা নিয়ে কথা বলতেন না খুব একটা। 
তবে মনে আছে, একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, 'অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে।' কেন কুয়ার জল, কেন তা কুয়ো নয়? শক্তি বলেছিলেন অই অনন্তের  চাঁদ যেখানে এসে পড়বে, সেই জায়গাটা একটু প্রসারিত না হলে চলে? কুয়ো বললে কেমন ছোট ছোট লাগে। কিন্তু যেই কুয়া বললাম, দেখ জায়গাটা বড় হয়ে গেল কেমন। এটা শোনার পর,  কবিতাকে দেখার বা পড়ার তৃতীয় একটা চোখ খুলে গিয়েছিল আমার।

মাথুরের পরে তোমার দ্বিতীয় বই গুঞ্জাগাথা। এই বই মাথুর প্রকাশের বেশ অনেক বছর পরে প্রকাশিত। প্রথম বই থেকে দ্বিতীয় বইতে যেতে তুমি এতদিন সময় নিলে কেন?
আমি একটা টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি নিয়ে ঢুকলাম এর পর। ক্রীড়া সাংবাদিকতার চাকরি। রাত একটা দেড়টায় বাড়ি ঢুকতাম। তারপরে বাড়ি ফিরে হয়তো খেতে বসেছি। তখন অফিস থেকে ফোন।  শোনো, তুমি কাল ভোর ৫টায় ইস্টবেঙ্গল মাঠে চলে যাও। কাল বাইচুং প্র‍্যাক্টিস করবেন। এটা চলতে থাকলো। একদিন হঠাৎ রাগে হতাশায় নিজের লেখা সমস্ত কবিতা, হাতের কাছে যা পেলাম ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলাম। তারপর কাঁদতে বসলাম হাউ হাউ করে। চাকরি জীবনের প্রথম দিকের ওই শাসন, ওই নিয়মানুবর্তিতা আমাকে কাজের জীবনে উন্নতি করতে সাহায্য করেছিল আর আমি শিখেওছিলাম অনেক কিছু, কিন্তু সেই সময় অসহ্যই লাগত। আমি প্রায় ১০বছর আর কবিতা লিখিনি সে ভাবে। মাথুর প্রকাশিত হওয়ার পর, শুধু ২০০৯ সালে, মনে আছে মেয়ে হওয়ার পর একটা লেখা লিখেছিলাম যা গুঞ্জাগাথার প্রথম কবিতা হিসেবে ছাপা হয়েছে। আর ওই সময়েই আরো একটা লেখা লিখেছিলাম যা ওই বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা। এর পর আর লিখিই নি। এরপর আমি একটা সময় চাকরি ছাড়লাম। কিছু দিন চুপচাপ গিয়ে কফি হাউসে বসে থাকলাম। ওই অবসরের সুযোগে হঠাৎ আবার কবিতা আসতে শুরু করল হু হু করে। আর আমি খেয়াল করলাম যে এই লেখাগুলো খানিকটা গল্প বলার ঢং-এ আসছে। আমি দু'মাসে কফিহাউসে বসে পুরো গুঞ্জাগাথা লিখলাম। তারপর প্রায় একবছর ফেলে রাখলাম লেখাগুলো। তারপর আমার কবি বন্ধু তারেক কাজি বই করলো।

বিনয় মজুমদারকে তুমি কাছ থেকে দেখেছ।তাঁর কবিতা তোমায় কীভাবে ভাবিয়েছে?
বিনয় মজুমদার এক বিস্ময়কর মানুষ আর কবি। তাঁর কবিতাভাষা এককথায় অননুকরণীয়।  আমরা মাঝে মাঝে যেতাম। তাঁর বাড়ি ঠাকুরনগরেও যেতাম, কলকাতার মেডিকেল কলেজেও যেতাম। ঠাকুরনগর গেলে, আমাদের কবি বন্ধু মণিশঙ্করের বাড়িতে থেকে যেতাম বা ফিরে আসতাম কলকাতায়। বিনয়দা খুব কম কথা বলতেন কিন্তু পছন্দ করতেন আমাদের যাওয়া আসা। তাঁর সঙ্গে কবিতা নিয়ে যথেষ্ট কথা হত। মানে, আমরা জানার চেষ্টা করতাম আর তিনি দু এক কথায় উত্তর দিতেন। অয়ন, অয়ন চক্রবর্তী একদিন বলে বসল, বিনয়দা, আপনার কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব আপনি মানবেন? এই প্রশ্নের পর উত্তর আসবে নাকি আক্রমণ, বুঝতে পারছিলাম না। বিনয়দা হেসে বললেন, শিষ্যকে দেখে বুঝতে পারছ যে গুরু কত বড়?
বিনয়দা কত বড় কবি সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করার পক্ষে আমি খুবই ছোট মাপের লোক। আমি শুধু অবাক হয়ে ভেবেছি মানুষটার নিরবচ্ছিন্ন একাকীত্বের কথা। একটা ভয়ংকর অন্ধকার একাকীত্ব। তিনি একটা ঘরের ভিতর থাকতেন। যেখানে আলো নেই। পাখা নেই। আমরা সেখান থেকে সন্ধ্যা নামার আগে যখন চলে আসতাম, ভাবতাম যে এই অন্ধকার নামার পরে তিনি কি করবেন? এই যে একটা বিরাট বিপুল অন্ধকার প্রত্যেক দিন ধেয়ে আসছে, আর তার গ্রাসের ভিতর ঢুকে পড়তে হচ্ছে, এটা আমাকে ভাবাতো। বিনয়দা একদিন বললেন যে, রাত হলে তারাদের ছেলেমেয়েরা আসে। তাঁর কাছে আসে। কেন আসে? অঙ্ক করতে। একজন কবি ও গনিতজ্ঞর কাছে কোনো মানুষ যাচ্ছেন না কিন্তু অঙ্ক জানতে। কে যাচ্ছে? তারা, নক্ষত্র, ছোট ছোট নক্ষত্রের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। এর থেকে বড় অসহায় একাকীত্ব আর কি হতে পারে! এই একাকীত্ব তাঁর কবিতা জুড়ে। কিন্তু কেন তিনি বড়? কারণ তাঁর একাকীত্বে আকাশ ঢুকে পড়ছে। নক্ষত্র ঢুকে পড়ছে। মহাবিশ্ব ঢুকে পড়ছে। 
'সেতু চুপে শুয়ে আছে ছায়ার ওপরে'। একটা সেতু তার নিজের ছায়ার ওপর শুয়ে আছে। অঘ্রাণের অনুভূতিমালার লাইন। অয়ন বলল, এটা যৌনতার ইমেজ। বিনয়দা চমকে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু জানো তো যৌনতার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার নেই। ভাবা যায়! আর বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই বলেই সেতু শুয়ে আছে কার ওপরে? ছায়ার ওপরে। যার আসলে অস্তিত্বই নেই।

কবিতার বাইরে তুমি মিডিয়ায় চাকরি করেছ, খুব ভালো কিছু সিনেমা বানিয়েছ। এই কাজগুলো তোমার কবিতাকে কী কোনওভাবে সাহায্য করেছে?
না। মিডিয়ার চাকরি আমার কবিতাকে সাহায্য করেনি। কবিতার ক্ষতি করেছে। ওই চাকরি না করতে হলে আমি কবি হতাম হয়তো। আর আমার সিনেমা, মানে শর্টফিল্মও আমার কবিতাকে সাহায্য করেনি। কিন্তু কবিতা সিনেমা বানাতে সাহায্য করেছে। কবিতা অনেক বড় ব্যাপার। সিনেমা একটা যৌথ শিল্প। আমি ইচ্ছে করলে মোটামুটি ভালো মানের কিছু সিনেমা বানিয়ে যেতেই পারি, যদি ভালো একটা টিম পাই।। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখতে পারি না। আমি আমার সিনেমার মধ্যে দিয়েও কবিতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টাই করেছি সবসময়।
এছাড়াও যেটা বলার তা হল আমি সিনেমা বানাতামই না হয়তো যদি কথা নন্দীর সঙ্গে আমার দেখা না হত। আমার এখন অবধি একটি ছবি বাদে সবেতেই কথা অভিনয় করেছেন। যেটায় করেননি সেটা কোনো মেয়ে চরিত্র নেই। ও একজন অসামান্য অভিনেত্রী। কবিতা যেমন অক্ষর দিয়ে লেখা হয়। শব্দ দিয়ে। কথা আমার সিনেমার অক্ষর।
এছাড়াও পবিত্র জানা, প্রমিত দাস...ওঁরা  আমার সম্পাদক, ডিওপি। ওদের অসামান্য অবদান রয়েছে।

তোমার বন্ধুদের কবিতা নিয়ে তোমার মতামত কী? কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কবিসঙ্গ ঠিক কতটা জরুরি বলে তোমার মনে হয়?
বন্ধুদের কবিতা? বন্ধুদের কবিতা নিয়ে আমি মতামত দেওয়ার কে? আমার প্রত্যেক কবি বন্ধুই নিজের মতো লিখছেন। মতামত তো পরের প্রজন্ম দেবে। সমসাময়িক লেখা নিয়ে কিছু বললে ভুল বলার সম্ভাবনাই বেশি থাকে, বিশেষত যাঁদের সাথে আমি প্রথম থেকে মিশছি। তবে একটা কথা বলতে পারি যে আমার কবি বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ থেকে গেলেন। চিরকালের জন্য থেকে গেলেন। এর বেশী কিছু আর বলার যোগ্যতা আমার নেই ওঁদের সম্পর্কে। কারণ আমি বিশ্বাস করি কবিতা লেখক হিসেবে আমি ওঁদের থেকে অনেক কম ক্ষমতার অধিকারী। 

কবিতা লেখার সঙ্গে কবিসঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। প্রয়োজনই নেই। কবিতা একটা নিভৃত শিল্প। ছাপার আগে অবধি অন্তত তাই। আমার বন্ধুদের বেশিরভাগ কবি বা কবিরাই ঘটনাচক্রে আমার বন্ধু, এই ব্যাপারটা আমায় প্রাথমিকভাবে এই পথে থাকতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কবিতা লিখতে হলে 'সৎসঙ্গ'র মত কবিসঙ্গ করতে হবে। 

কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে তোমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে, তোমাকে কীভাবে এই সম্পর্ক কবিতায় সাহায্য করেছে?
জয় গোস্বামীর সঙ্গে আমার সান্ধ্য আড্ডা জুড়ে যতটা না কবিতা থাকে, তার থেকে বেশি থাকে গান। জয়দা একসময় সেতার শিখেছিলেন। তিনি গান-পাগল। তাঁর মত গানবোঝা লোক আমি কম দেখেছি। তিনি 'কানসেন'। এরকম সুরের কান ভাবা যায় না। আমি যাওয়ার পর জয়দা চা করছেন।  আমরা তারপর এক গামলা চা নিয়ে আড্ডায় বসব। আমি গুনগুন করে গান গাইছি। জয়দা চা করা ছেড়ে ছুটে এলেন। বললেন এই যে এই মন্দ্র সপ্তকের জায়গাটা, এটা তোমার গলায় দারুণ এল। বলেই তিনি অতুল প্রসাদ ধরলেন। জয়দা অতুলপ্রসাদের তুমুল ভক্ত। 
দেখ, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের আগের কবির কাছে কোন না কোনো ভাবে ঋণী। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য নয়। তাঁদের প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থের জন্য। তবে হ্যাঁ, একটা বিরাট মেধার সামনে বসলে তোমার নিজের মেধার যে জায়গাটায় সহজে আলো পড়েনি, সেইখানটা কখনো কখনো আলোকিত হয়, এটা সত্যি।

তুমি যেসময় জয়দার সঙ্গ করছো সেই সময়েই তোমার খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে চলেছে। এই ব্যাপারটা তুমি কীভাবে দেখো?
এই প্রশ্নটার উত্তর না দিলেই ভালো হত। জয়দার সঙ্গে আমার প্রায় ১৯৯৬ বা ৯৭ সালে একবার আলাপ হয়েছিল। আমি ডাকে দেশ পত্রিকায়  কবিতা পাঠাতাম। দুবার পাঠানোর পর একটা লেখা প্রকাশিত হল। তারপর আবার পাঠালাম, আবার প্রকাশিত হল। এভাবে চলছিল। একদিন রাস্তায় আমি জয় গোস্বামীকে দেখে, তাঁর কাছে যাই।  আর বলি যে আমি জয়দীপ রাউত।  তিনি আমায় দেখে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার থেকে দুটো কবিতা মুখস্ত বলে যেতে লাগলেন। সেই দুটো লেখা আমার প্রথম বইতে আছে। একটা হল দাহ, অন্যটার নাম মনে নেই...ওই যে, 'তুমি আজ ভোরে এসে যে ঘুম ভাঙাবে তার তলদেশে দ্বীপ, তন্দ্রাজল।' 
আমি তো অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায়। কি বলব, কি করব বুঝতে পারছিনা। উনি চলে গেলেন। এর বেশি সম্পর্ক আমার জয়দার সাথে ছিলনা আর তারপর থেকে কোনো দিন দেখাই হয়নি। দু বছর আগে, আমি একদিন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি উল্টো দিক থেকে জয়দা আসছেন। আমি বললাম আপনি, এখানে? তিনি বললেন অনেকদিন হল আমি এখানেই থাকি। ব্যাস। আবার যোগাযোগ শুরু হল। আর তা নিয়মিত শুরু হল। আমি আমার অল্প বয়সে যে জয় গোস্বামীকে রাস্তায় দেখেছিলাম, তিনি তখন পরিবৃত। এবার যে জয় গোস্বামীকে দেখলাম তিনি একা, একেবারেই একা। দেশ পত্রিকার জন্য যাঁরা তাকে ঘিরে রাখতেন সবসময়, তারা কেউ নেই আর। কেউ না। এই একাকীত্বের পথ দিয়ে আমি তাঁর কাছে, খুবই কাছে পৌঁছালাম নতুন করে।
তোমার প্রশ্নের উত্তরে এত কথা বললাম এই কারণে যে একটা সময় ছিল, তাঁকে ঘিরে থাকত তরুণ কবিদের অনেকাংশ। এবার একটা সময় এল যখন তাঁকে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে তাঁর পরবর্তী সময়ের কোনো কোনো কবির কাছ থেকে। এই দুটো অবস্থার কোনোটারই কোনো মূল্য থাকা উচিৎ নয় একজন কবির কাছে।
কাজেই কে জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে খারাপ বলল সে ব্যাপারে আমি কেন মন্তব্য করব, বলো? বন্ধু বা কবি বন্ধুদের কথা বলছি না, ইন জেনারেল দেখেছি, একটা আশ্চর্য ধারণা আছে যে, কেউ জনপ্রিয় মানেই সে খারাপ। ভাবটা এমন যে যাঁরা তাকে জনপ্রিয় করল, তাঁরা কিছুই বোঝেন না। যেন, যিনি জনপ্রিয় তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছেন যে, আমাকে ভালো বলো, আমাকে জনপ্রিয় করে তোলো।। আর যাঁকে কেউ চেনে না, আমার মত যাঁরা, তারাই আসলে মহান। জনপ্রিয়তা আর আঁতলামোর মধ্যে একটা বিরোধ আছে। আমি এমন লোককে চিনি যিনি সারাক্ষণ গুনগুন করে কিশোরকুমার গাইছেন আর কবিতা লিখছেন আখতারি বাঈকে নিয়ে। আমি এই ভন্ডামিকে ঘৃণা করি।

তুমি প্রধানত কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসো? কীভাবে অবসরযাপন করতে ভালো লাগে তোমার?
আমি ইদানীং উপন্যাস একেবারে পড়ি না। কবিতার বাইরে, ছোটগল্প খুব পড়ি। আর আধ্যাত্মিক বইপত্রের প্রতি ঝোঁক আছে। পারলৌকিক বইপত্রের প্রতি নেশা আছে আমার। অবসরে বই পড়ার পাশাপাশি অনেকসময় একদম চুপ করে বসে থাকি। একটাও কথা না বলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারি। ইদানীং সেটাই থাকি বেশি। আর হ্যাঁ, গান শুনি। সঙ্গীত আমাকে শান্তি দেয় কিছুটা। আমার গান শোনার বিরাট পরিধি। কিশোরকুমার থেকে রামকুমার। বড়ে গোলাম আলি থেকে গোলাম ফকির।

তোমার আপাতত শেষ বইটা অপরূপ কথাখানি। এই বইতে অসাধারণ সব প্রেমের কবিতা আছে। এই বইএর কবিতা লেখার নেপথ্য প্রেরণার কথা জানতে চাই।
অপরূপকথাখানি'র মধ্যে আমার নিজের অসহায়তার কথা, আর একটি মেয়ের পাগলের মতো ভালোবাসার কথা আছে। কবিতা, বিশেষত প্রেমের কবিতার ভিতরে যদি কখনো সরাসরি কোনো নারী থাকেন তবে আমি বলব পাঠক তাঁকে খুঁজে বের করুক। তিনি বইয়ের নামকরণ থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কবিতার ভিতরে, সর্বত্রই তো আছেন। আমি যদি গোটা গোটা অক্ষরে তাঁর নাম বলে দিই তাহলে কবিতা তার রহস্যময়তা অনেকটাই হারাবে। তখন কবিতা নয়, মেয়েটিই কোনো দুর্বল পাঠকের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠবে। শুধু একটা কথা বলি, তিনি আমার কাছে সমস্ত অর্থে অপরূপ। শুধু কবিতার প্রেরণা নয়, তিনি আমার কাছে আরো বড় কিছু।


কবিতার বাইরেও বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গ করেছ তুমি, তাদের প্রভাব তোমার জীবনকে কতটা আলোড়িত করেছে?
আমার সৌভাগ্য যে আমি ক্রীড়াজগৎ থেকে শুরু করে সঙ্গীতজগতের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে দেখেছি। আমি প্রথমে, মান্না দের কাছে গিয়ে ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার কথা বললাম না একটু আগে। অল্প বয়সে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম... পরবর্তীকালে কিন্তু তাঁর সাথে আমার দারুণ সম্পর্ক হয়। আমি তাঁর বিখ্যাত সব গান তাঁর গলায় পাশে বসে শুনেছি। সেটা একটা লাইফটাইম অভিজ্ঞতা। মান্না দের বাইরেটা ভীষণ রুক্ষ। কিন্তু মনটার তুলনা নেই। তাঁদের সময়ের কত গল্প শুনেছি আমি তাঁর কাছ থেকে। কিশোরকুমার, রফি সাহেব, শচীন কর্তার কত যে গল্প। মান্না দে-কে এক দিন আমি জিজ্ঞেস করলাম যে আপনার মতে, প্লে ব্যাক সিঙ্গারদের মধ্যে সেরা তিনজনকে বেছে নিতে বললে আপনি কাকে বাছবেন? মান্না দে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন যে আমি সবার ওপরে রাখব রফি সাহেবকে। তাঁর থেকে মাত্র এক ইঞ্চি নিচে কিশোর। তারপর মান্নাজ্যেঠু আবার চুপ। আমি বললাম, আর তৃতীয়?  তিনি বললেন ওটা তুমি নিজে বেছে নাও। ভিতরে ভিতরে এত রসিক আর এত বড় মনের মানুষ  আমি কম দেখেছি। আজকে তুমি কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখ? সে বলবে যে সে-ই সেরা। কবিতার জগতেও তাই-ই চলছে। 

আসলে আমি অনেক কিছু শিখেছি এই কবিতার বাইরের বিখ্যাত বা গুনী মানুষগুলোর কাছ থেকে। শানুদা, মানে কুমার শানুর ব্যক্তিজীবনে তখন ঝড় চলছে। এদিকে একটা আপাত তরল বা চটুল গান গাইতে হবে তাঁকে। আর সেই গানের কথা আর সুর দুটোই আবার আমার। আমি জানি শানুদা কি সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। আগেরদিন রাতে সে সব বলছিলেন আমাকে হোটেলের ঘরে বসে। এবার তিনি রেকর্ডিং-এ এলেন। গানটা শুনলেন, নিজে হাতে লিরিকটা লিখলেন। দু'বার গুনগুন করে গাইলেন আর তারপর মাত্র ১৫ মিনিটে রেকর্ডিং শেষ করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, এই কঠিন মানসিক অবস্থার মধ্যেও গানের মধ্যে এত প্রাণ প্রাচুর্য আসে কি করে? শানু দা স্টুডিওর বাইরে লাল আলোটার দিকে দেখালেন আমাকে। বললেন, ওই যে আলোটা দেখছিস, ওটা যেই জ্বলে উঠল, অমনি আমি আমার গায়ক সত্তাটুকু রেখে জীবনের বাকি সব কিছু ওই দরজার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

 তুমি বলো যে তুমি অলৌকিক পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। ভূত এবং ভগবান সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?
না না। আমি ভুত বা ভগবান কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারি এরকম কখনো বলিনি। আমি কি ওঝা বা তন্ত্রসাধক নাকি! আমি এই সমস্ত বিশ্বাস করি। যাঁরা বলেন যে ঈশ্বর নেই বা অলৌকিক কিছু হয়না আমি তাদের সঙ্গে সহমত নই। একটা থালা বা প্লেটে পাউরুটি নেই। এটা আমি বলতে পারছি। কেন বলতে পারছি? কারণ আমি পুরো থালা বা প্লেটটাকেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ঈশ্বর নেই কি করে বলি? এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আমি কতটুকু জানি? জানি না। কিন্তু টের পাই। ধারণা পাই। তবে এই ধারণা বা বিশ্বাস একই থাকলেও মান্যতা কখনো কমে কখনো বাড়ে। মানে আমি জানি যে বাড়িতে বাবা আছেন। কিন্তু সব সময় কি তাঁকে মেনে চলি? চলি না তো? সেরকমই। আমার বাড়িতে রাধাকৃষ্ণ আর আমি এক ঘরেই থাকি। মানে ঠাকুরঘরটর নেই। সেই রাধামাধবের মূর্তি আমি কখনো সাজাই নিজে হাতে, কখনো আবার তাকিয়েও দেখিনা দিনের পর দিন। এভাবেই চলতে থাকে।
একটা সময় আমি খুব স্বপ্ন দেখতাম। খুব আশ্চর্যের বিষয় হল যে আমি কৃষ্ণমুগ্ধ লোক। কিন্তু দিনের পর দিন আমি শুধু কালীর স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্নগুলো অদ্ভুত। যাই হোক। এটা আমাকে ভাবাতো। সারাদিন শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবলাম আর স্বপ্ন দেখলাম কালীকে! একদিন হঠাৎ ভবা পাগলার একটা গান শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। গানটার বক্তব্য হল, তুমি যদি কৃষ্ণ ভাবো, কালী তোমায় পথ দেখাবে।এই গানটা থেকে আমি আমার স্বপ্ন সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম। আমার মনে হয়, ঈশ্বরের জন্ম বিস্ময় থেকে। আর ঈশ্বরের পূর্ণতা বিশ্বাসে।
এবার আসি ভূতটুতের ব্যাপারে। মৃত্যুর পরে কিছু আছে? এই প্রশ্ন আমার একার নয়। অনন্তকাল ধরে মানুষ জানতে চাইছে। আমার জীবনে অনেক অলৌকিক অভিজ্ঞতা আছে। এখানে সবগুলো বিস্তারিত ভাবে বলা মুশকিল। 
শুধু একটা ঘটনা বলি। আগেও এই গল্প আমি অনেককেই বলেছি। আমি তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। আমার মা বাবা দুই মাসি মামা ও ভাইবোনেরা গোয়ায় গিয়েছি ঘুরতে। আঞ্জুনা বিচের পাশে একটি সম্পূর্ণ বাড়ি আমরা ভাড়া নিয়েছি দু'তিন দিনের জন্যে। বাড়ির মালিক পাশেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন। প্রথম রাত্রে, সারাদিন ঘোরাঘুরির পর আমি একটা কাগজ আর পেন নিয়ে কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি কেটেছি। এঁকেছি একটি অল্পবয়সী ছেলের ছবি। আঁকার পর আমি সেই ছবি পাশের টেবিলে দাঁড় করিয়ে রাখি। তারপর খাওয়া দাওয়া, আড্ডা শেষে ক্লান্তির ঘুম। আমি শুয়েছিলাম আমার মায়ের পাশে। তাঁর পাশে পরপর দুই মাসি। বাইরে অনেক রাত অবধি মামা মেসো বাবা তাস খেলছিলেন। অন্য ঘরে বোনেরা ও দুই মামি।
মাঝরাতের দিকে স্বপ্ন দেখি একটা বাচ্চা ছেলে সেই ঘরেরই লাগোয়া বাথরুমের দরজা খুলে সোজা আমার মায়ের মাথার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঘুম ভেঙ্গে যায় মাসির গলার আওয়াজে। মাসি ব'লে ওঠেন দিদি, তোর মাথার কাছে কে?
জানা যায়, যে স্বপ্ন আমি দেখেছি, সেই স্বপ্ন একই সঙ্গে দেখেছেন সকলেই। এবং একই ভাবে। অর্থাৎ আমি যখন দেখছি ছেলেটি মায়ের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, মাসিরাও তাই দেখছেন।
এরপর ভয় ও বিস্ময় সামলে আমরা আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করি এবং ঘুমিয়েও পড়ি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারো স্বপ্নে বাথরুমের দরজা খুলে যায় আর বেরিয়ে আসে সেই ছেলেটি। এবার সে ছোট মাসির পা'য়ের সামনে দাঁড়ায় এসে। দেখতে থাকে নবাগত অতিথিদের। এরপর আর ঘুমানো যায় না। সবাই বাইরে, বাইরের ঘরে বেড়িয়ে আসি। ছোট মামা বললেন আমি শুচ্ছি ওই ঘরে, তোরা বাইরের ঘরেই শুয়ে পড় দেখি। তারপর মামা ঘন্টাখানেকর মধ্যে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে, বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে,  মেইন দরজা  খুলে সোজা গিয়ে কড়া নাড়লেন মালিকের বাড়ি। গোয়ার আকাশে, আঞ্জুনা বিচের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তখন ভোরের আলো সবে মাত্র পাল তোলা নৌকার মত দুলে উঠতে শুরু করেছে। আমাদের যিনি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি বেরিয়ে এলেন। এসে বসলেন যে বাড়ি তিনি আমাদের ভাড়া দিয়েছিলেন তার বাইরের ঘরের চেয়ারে। সব শুনলেন। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার মনে ছিল না এই তারিখটা। গতকালই ছিল সেই দিন। আজ থেকে কয়েক বছর আগে, যেখানকার চটি খুব বিখ্যাত সেই কোলাপুর থেকে একটা বাচ্চা এসেছিল ওঁর কাছে। তখন ওঁরা এই বাড়িটাতেই থাকতেন। ছেলেটি দৈনন্দিন কাজে নিযুক্ত হয় এই বাড়িতেই। কিন্তু একদিন তার গায়ে আগুন লেগে যায় আর সে বাঁচবার জন্য জ্বলন্ত অবস্থায় ওই বাথরুমে ঢোকে। কিন্তু আর বেরোতে পারেনি। কাল ছিল তার মৃত্যু  দিন।
আমি একদিন উল্টো দিক থেকে ভাবছিলাম। যদি সব কিছু মুছতে মুছতে যাই প্রসূন। ধর, পৃথিবীটা মুছে দিলাম। সব গ্রহ তারা মুছে দিলাম। কী থাকে? যা থাকে, তাও মুছে দিলাম। এভাবে মুছতে মুছতে যখন কিছুই থাকল না, তখন সেই না থাকাটা কোথায় থাকে? আসলে না থাকা বলে কিছু নেই। ঈশ্বর আছেন, আমিও হয়তো থাকছি মৃত্যুর পরে।

তোমার সময়ের কবিদের কবিতা নিয়ে তোমার মতামত কী? তোমার বন্ধুবৃত্তের বাইরে যারা তোমার সমসাময়িক কবি তাদের মধ্যে কাদের কবিতা ভালো লাগে তোমার?
দেওয়ালে টাঙানো ছবি যেমন একটু দূর থেকে দেখতে হয়, তেমনি আমার সমসময়ের কবিতাকেও যাঁরা একটু দূর থেকে দেখবেন এই মূল্যায়নটা তাঁদের পক্ষে করা ঠিক হবে। তবে এইটুকু বলতে পারি ৯এর দশক বাংলা কবিতার উল্লেখযোগ্য দশক। আরো উল্লেখযোগ্য হল এই দশকের একদম প্রথম দিকে যে সব কবিদের জয়ধ্বনি আমরা শুনেছিলাম তাঁদের অনেকেই কিন্তু শেষ অবধি মিলিয়েই গেল। আর যাঁরা সেই সময় প্রায় নেই হয়ে ছিল তাঁরাই মূলত লিখল প্রকৃত কবিতাটা। মন্দিরের মাথায় পতাকা উড়তে দেখেছ কখনো? একে সে মন্দিরের মাথায় অবস্থিত, তার ওপর প্রবল হাওয়া।  আমি খেয়াল করে দেখেছি বিভিন্ন মন্দিরের শীর্ষপতাকার আকাশ ছোঁয়া দম্ভ। তো হল কি, সেই পতাকা উড়ল, কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারল না। আর পাখিও উড়ল এবং কোথাও পৌঁছাল। আমার সময়ের কবিদের কেউ কেউ ওই পতাকাটির মতো উড়েছিল, কেউ কেউ স্বাধীন আর স্বেচ্ছাচারী পাখির মত।
কবিতার অনেক পথ আছে। অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা শোভন ভট্টাচার্য ধ্রুপদী সেতার বা সরোদের মতো বেজে ওঠেন। আবার তুমি যদি অয়ন চক্রবর্তীকে দেখ, দেখবে হাল্কা চালে অনেক বড় কথা বলার ক্ষমতা রাখেন অয়ন। অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর বাগচি, সার্থক রায়চৌধুরী, এঁরা খুব ক্ষমতাশালী। বিপ্লব চৌধুরী তো কবিতাটা সঙ্গে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন। মণিশঙ্কর বিশ্বাসের উপমাশক্তি আমাকে বিস্মিত করে। এছাড়াও সুদীপ্ত চক্রবর্তীর লেখা আমার বেশ ভালো লাগে। তবে এভাবে নাম ধরে ধরে না বলাই ভালো। আমি খুব কাছ থেকে যাঁদের দেখেছি তাঁদের নাম উল্লেখ করলাম মানে এই নয় যে যাঁদের নাম বললাম না তাঁদেরকে আমি খারাপ বলছি।

তোমার জীবনে তো একাধিক প্রেম এসেছে। প্রেম বলতে তুমি ঠিক কী মনে করো? প্রেম কীভাবে তোমাকে কবিতা দিয়েছে একটু বলো।
হায় ঈশ্বর! এর কি উত্তর দেব? প্রেম কী বলো তো? প্রেম হচ্ছে একটা প্রিয় আয়না। মাঝে মাঝে যার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ইচ্ছে হয় অথবা আয়না আমাকে কি ভাবে দেখছে, সেটা বুঝে নেওয়াই প্রেম। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না, 'কে মোরে ফিরাবে অনাদরে, কে মোরে ডাকিবে কাছে, কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে'। 
এই 'প্রেমের বেদনা'টা দারুন একটা বিষয়। কার প্রেমের বেদনায় আমি জাগ্রত, এটা আমারও জানতে ইচ্ছে করেছে, জেনেওছি।
হ্যাঁ, আমার জীবনে অতুলনীয় আর অনিয়ন্ত্রিত প্রেম এসেছে। কবিতাও এসেছে স্বাভাবিক ভাবে। তবে প্রেম বলতে একটা নায়ক নায়িকার যে কনসেপ্ট আছে, আমার জীবনে প্রেম সেরকম নয়। বরং আমার মনে হয় রূপকথার রাক্ষস আর রাক্ষসের সঙ্গে থাকা রাজকন্যার যে প্রেম, আমার সেরকম। আমার তৃতীয় বইয়ের শেষ লেখাটায় সে কথা বলা আছে। 
     সে যদি জিজ্ঞেস করে আমি 
     কে হই তোমার 
     তুই বা কে হোস?
     বোলো তাকে তুমি হও অপরূপকথাখানি আর
     আমি হই তোমার রাক্ষস 
  
তোমার পরবর্তী কবিদের নিয়ে তোমার ভাবনা কী? তাদের কবিতা তোমার কেমন লাগে?
আমাদের পরবর্তী, যাঁরা লিখতে আসছেন তাঁদের অনেকেই সত্যি ভালো লিখেছেন এবং আরো ভালো লিখবেন। তবে এই বিশ্বাসের পাশাপাশি একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করি ইদানীং। আমি ফেসবুকে কত যে কবিকে দেখি যাঁরা কি লেখেন, কেন লেখেন, বুঝতে পারিনা। আর তাঁদের এই অল্পবয়সেই একেকজনের প্রায় আট ন'টা বই। এখন ফেসবুক হল এমন একটা দেওয়াল যেখানে কবিতা টাঙাতে গেলে কোনো সম্পাদকের প্রয়োজন হয় না। আর বিস্ময়কর ব্যাপার যেটা, সেটা হল তাঁরা তাদের কবিতায় হাজার হাজার লাইক পাচ্ছেন। ধরা যাক ক্যালাস দে বলে কেউ কিছু লিখলেন। এই নামটা বানালাম আর কি। তো, তিনি লিখলেন। কিন্তু যা লিখলেন তার মাথামুণ্ডু নেই, অথচ  হৈ হৈ করে লাইক পড়তে লাগল। তিনি ভাবলেন তিনি তাহলে ভালোই লেখেন। আর যে নতুন ছেলেটি ভালো লিখতে শুরু করেছেন, ধরা যাক তার নাম অর্ণব চৌধুরী, তিনি যখন দেখলেন যে তাঁর কবিতায় তেমন কোনো লাইক নেই তিনি কিন্তু মনে মনে মুষড়ে পড়লেন। এই মুষড়ে পড়াটা যেন না আসে।

তোমার নতুন লেখা বা নতুন বই নিয়ে কী ভাবছ?
লেখার ব্যাপারটা যেহেতু অনিশ্চিত এবং আমি যেহেতু ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখতে পারিনা, তাই আগাম ভাবনা কিছু নেই। আমি এমনিতেই এত কম লিখেছি! আমার মতো কম খুব কম জনই লিখেছেন। আমার এযাবৎ প্রকাশিত লেখা মাত্র একশোটার মতো। আগামি দিনে কি লিখব,বা আদৌ লিখতে পারব কিনা কবিতার দেবীই জানেন। কিন্তু যেটা হয়েছে তা হল ২০১৮য় একটা শ্যুটিং করতে গিয়ে আমার ডান হাতের তর্জনী প্রায় দু'টুকরো হয়ে যায়। তখন একটা অভূতপূর্ব সময় উপস্থিত হয় আমার জীবনে। ভয়ংকর যন্ত্রণা। আমি ব্যথার ওষুধ আর নানা রকম ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারতাম না। আমি রাত দশটা নাগাদ ঐসব ওষুধগুলো খেয়ে, জানলার ধারে বসে ছটফট করতাম সারা রাত। ওই সময় হঠাৎ যেটা হল কবিতা আসতে শুরু করলো আমার কাছে। কিন্তু লিখব কি ভাবে? আমি মনে মনে লেখাগুলো তৈরি করতে শুরু করলাম আর সেগুলো জানাতে থাকলাম কথাকে। কথা আমার সেই সব লেখা ওঁর বাড়িতে বসে খাতায় টুকে রাখতে শুরু করল। এদিকে আমি রাত জাগছি যন্ত্রণায়, রাত জাগছি নতুন কবিতায়, ঐদিকে কথা রাতের পর রাত জাগছে সেগুলো লিখে রাখার জন্য। দূরে থেকেও অসম্ভব কাছে থাকা বলতে যা বোঝায়, সেই দিনগুলোয় সেইভাবে পাশে থেকে সাহায্য করে গেছেন কথা। আমি  তিন মাসে প্রায় আড়াইশ কবিতা লিখেছি ঐ সময়। সব যে গ্রহণযোগ্য, তা হয় তো নাও হতে পারে, কিন্তু লিখেছি। আর তারমধ্যে ৫০টা লেখার বিষয় আমার ঐ কাটা আঙুলটা।  এছাড়াও আরো অন্যান্য কবিতাও আছে। সেসব নিয়ে বই হবে হয়তো কখনো। আপাতত শীতলার গাধা নামে দশটা কবিতার একটা  সিরিজ লিখেছি। বই হিসেবে প্রকাশ পাবে।

পরবর্তী কবিতালেখকদের তুমি কী বলতে চাও, এই প্রশ্ন দিয়েই আমাদের কথোপকথন শেষ হোক।
কিচ্ছু না। আমি কি বাংলা কবিতায় ধর্মযাজক নাকি যে পরবর্তী কবিতা লেখকদের কিছু  বলব! আমার সেই যোগ্যতা নেই।

প্রশ্ন করেছেন : প্রসূন মজুমদার


জয়দীপ রাউতের গুচ্ছ কবিতার লিঙ্ক