...............................................................................
কুকুরটা আমার পিছনে এসে বসল।
বললাম, বিস্কুট খাবেন?
সে অলসভাবে তাকালো একবার।
আপনি আমার পোষ্য হবেন?
আমি কিন্তু স্বদেশি, আপত্তি নেই তো?
আপনার দেশ-পরিচয় নিয়ে আমার চিন্তা নেই।
একটা মাছি উড়ছিল কুকুরটার কানের পাশে।
কুকুরটা বলল, মাছিদের আমি পছন্দ করি না। আপনার বাড়ি মাছিমুক্ত তো?
মাছি যে নেই তা নয়, তবে উপদ্রব নেই।
একজন চানাচুর বিক্রেতা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদা, এখন কটা বাজে?
১১টা ৭।
ডিজিটাল ঘড়ির এই সুবিধা। সেকেন্ডের হিসেবও বলে দেওয়া যায়।
সে বলল, চানাচুর খাবেন?
বললাম, পয়সা নেই।
আপনাকে এমনিতেই আমি খাওয়াতে চাই।
কিন্তু কেন?
আপনার মুখে একটা মায়া আছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
আপনার মন ভালো হয়ে গেছে তাহলে?
আজ আমার মন এমনিতেই ভালো।
তাহলে ব্যবসায় ক্ষতি করছেন কেন?
আমি সকাল ১১টায় রাসমাঠের এক কোণে ভাঙা জমিদার বাড়ির পোড়ো পিলারের উপর বসে আছি। দূরে মেন রোড। অটো, বাস, ভ্যান, রিক্সা যাচ্ছে। ট্যাক্সি কম। মফস্বল শহর তো। সব লোক কাজে বেরিয়ে পড়েছে। আকাশে মেঘ। আজ সোমবার।
চানাচুরওয়ালা এক ঠোঙা চানাচুর দিয়ে চলে যেতে আমি পিছনে শুয়ে থাকা কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করলাম, চানাচুর খাবেন?
চোখ বুজেই সে বলল, না, আমি গায়ে পড়া লোকের দেওয়া কিছু খাই না। আপনিও খাবেন না। খেলে এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন।
কী বলছেন?
আমার দায়িত্ব পালন করলাম, বাকিটা আপনার ইচ্ছা।
কিন্তু আমার কাছে যে পয়সা নেই সেটা তো ওকে বললাম, তারপরও সে আমাকে...
বিশ্বাস না হয়, মেন রোডে গিয়ে দেখুন লোকটা আড়াল থেকে আপনাকে লক্ষ রাখছে।
সত্যিই তাই।
মেন রোডে গিয়ে দেখলাম একটা চা দোকানের আড়ালে সে বসে আছে। আমি আসছি দেখে হাওয়ায় মিশে গেল।
ফিরে গিয়ে কুকুরটাকে ধন্যবাদ জানাতে সে বলল, আমি আর আপনার সঙ্গে নেই, চলি।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছেন। আমি খানিকটা ঈশ্বরের মতো। অবিশ্বাসীদের সঙ্গে থাকতে পারি না।
কিন্তু ঈশ্বর তো ক্ষমাশীলও?
ঈশ্বর ক্ষমাশীল কিন্তু আমি তো ঈশ্বর নই। ঈশ্বরের মতো, তবে আমি একটা কুকুরই।
মাছিটাকে মাথায় নিয়ে সে চলে গেল।
মনটা ভারী হয়ে গেল। মেঘ আরও কালো হয়ে এসেছে। রাসমাঠের পাশের বিশাল পুকুরে ঢেউ উঠছে। দূরে সেগুন কাঠ চেরাইয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আওয়াজ শুনে আমি কাঠের নাম বলে দিতে পারি। তবে মনটা বড়ো খারাপ। একটা উড়োজাহাজ যাচ্ছে।
মেন রোডে উঠতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আমার ছাতা নেই। জ্বরে পড়বার মতো সৌভাগ্যও নেই।
একজন পথচারী আচমকা কানের কাছে মুখ এনে বললেন, দাদা, ছাতায় আসুন।
নীল ঢাউস ছাতা তার মাথায়। পোশাক দেখে বেশ ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। পায়ে খাঁটি চামড়ার মোকাসিনা জুতো। চামড়ার জুতো দেখলে আমার একটা ছাল ছাড়ানো খাশির কথা মনে পড়ে। আকাশ থেকে কারা যেন সমবেতভাবে ঢিল ছুঁড়ছে। সাড়ে এগারোটা বাজে।
লোকটা বললেন, এই বৃষ্টিতে ভেজে নাকি কেউ?
আমি বললাম, আমাদের মতো লোকেদের কোনো বৃষ্টিতেই ভেজা উচিত নয়।
আমরা চৌমাথার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে একটা হ্যারিকেনের দোকান আছে। একজন প্রায় অন্ধ লোক সেই দোকানটা চালায়।
লোকটা জিজ্ঞেস করলেন, কী করা হয় আপনার?
ভাববাচ্যে কথা বলার দরকার নেই, আমি কিছু করি না, বললাম।
কথা শুনে আপনাকে শিক্ষিত বলেই মনে হয়। সত্যিই আপনি কিছু করেন না?
মিথ্যে কিছু করি কী করে!
একটা কাজ আছে, করবেন?
কী কাজ? তবে শুনে রাখুন, আজ আমার মনটা বড়ো খারাপ।
মন খারাপ? সে তো হতেই পারে। তবে কাজটা করলে আপনার ভালো লাগবে বলেই মনে হয়।
কী কাজ বলুন তো।
আমার একটাই ছেলে। হোলি ক্রসে নাইনে পড়ে। তাকে পড়াবেন। সপ্তায় দু দিন। পারবেন?
আচ্ছা, আমাকেই কেন এই দায়িত্ব দিতে চান বলুন তো?
বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আপনার মুখে একটা মায়া আছে।
বৃষ্টি কাটতে কাটতে একটা অটো আমাদের পাশে এসে গতি কমিয়ে দিল। আমার হাতে একটা কার্ড গুঁজে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে অটোতে উঠে পড়লেন লোকটা।
তার ছাতাটা আমার হাতে।
কার্ডে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ভদ্রলোকের নাম নাসির হোসেন। পেশা ওকালতি। বাড়ি ফুলতলা। ফোন নম্বরও দেওয়া আছে।
পকেটে রাখলাম কাগজের টুকরোটা।
মুখে কীভাবে মায়া গজায়? কেমন দেখতে হয় মায়াময় মুখ? আয়নায় কি নিজেকে দেখব একবার? মায়ার সঙ্গে কি দয়ার কোনো সম্পর্ক আছে?
প্রায় অন্ধ লোকটা অসংখ্য হ্যারিকেন ঝুলিয়ে দোকানে বসে আছে। এই যুগে কে কেনে হ্যারিকেন? প্রৌঢ় দোকান মালিক দিনরাত একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখে দোকানের ঠিক সামনেটায়। লোকটার চোখ আর বেশিদিন নেই, দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায়।
দোকানের নাম : আলো।
বৃষ্টি পড়ছেই।
২
ফুলতলা
বিরাট বাড়ি। প্রাসাদই বলা চলে। বাড়ির উঠোনে দেশি বিদেশি ফুল লতাপাতা গাছের মধ্যে কয়েকটা পাতাবাহার আর বোগেনভেলিয়াকে চিনতে পারলাম। দশটা মতো টব উল্টে রাখা আছে। এখন মঙ্গলবার। সন্ধ্যাকাল।
নাসের হোসেন আমাকে চিনতে পেরে তার বই-ঠাসা বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, আফরোজ!
কেউ এলো না।
তিনি আবার ডাকলেন, আফরোজ, নীচে এসো, তোমার মাস্টারমশাই এসেছেন।
আপনি কী পড়াবেন? এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
কখনও তো কিছু পড়াইনি কাউকে, নির্বিকার ভাবে বললাম।
এমন একজনকেই খুঁজছিলাম যিনি জ্ঞানের দিক থেকে ভার্জিন।
জ্ঞানের আবার কুমারত্ব আছে এই প্রথম জানলাম, ধন্যবাদ, আমি দুই হাতের তালু একবার ঘষলাম নিঃশব্দে।
জ্ঞান আপনি কখনও কাউকে দান করেননি, মানে তার হাইমেন এখনও অটুট। তা যাক গে, আপনি নিশ্চয়ই এম এ?
এম এ, বি এড, কিন্তু বুঝলেন কী করে?
আমি একজন সফল অ্যাডভোকেট, মানুষ নিয়ে আমার ব্যবসা, বুঝি। তাছাড়া আপনার মুখে...
একটা মায়া আছে, তাই তো?
একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি মুখে মায়া থাকাটাকে আপনি ভালো চোখে দেখছেন না, কিন্তু আমি একে ইতিবাচক গুণ বলেই ধরছি।
চা এলো। কাচের কাপে লাল রঙা চা। কাচ খুব ঠুনকো বলেই কাচ আমাকে টানে। যারা কাচের কাপে চা খায় তারা স্বচ্ছ না ও হতে পারে। লাওপালার পিরিচ বলে মনে হল।
আফরোজ ইতিমধ্যে দোতলা থেকে নেমে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আফরোজের উচ্চতা বেশি নয়, গোল মুখ, গৌর বর্ণ, চিনাদের মতো চুল সোজা সোজা।
সে ঘরে ঢুকতেই নাসের হোসেন বললেন, বাবা, তোমার লেখা সেই ইংরেজি কবিতাটা 'where is my grave' আবৃত্তি করে শোনাও একবার।
আমি তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে বললাম, ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র নয় যে অতিথি এলেই আবৃত্তি করে শোনাতে হবে।
৭:৪৫ বাজে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। আকাশে তারা ফুটেছে। সব তারাই সমান। সকলেই যেন মৃত। শেষ আলোর বার্তাটুকু দিয়ে ফিরে যাবে কৃষ্ণ কালো ঘরে। হ্যারিকেন বিক্রেতার চোখদুটো মনে পড়ে গেল।
আজ থেকে আমি আফরোজের শিক্ষক। ক্রিয়েটিভ রাইটিং আমার বিষয়।
নাসের হোসেন বাড়ির গেট অবধি এসে বললেন, ওকে তৈরি করুন।
সংক্ষেপে বলি, আমার মতো?
তিনি চুপ করে রইলেন। তারপর খুব নরম ভাবে প্রিয়জন যেভাবে বলে সেভাবে বললেন, দেখে পথ হাঁটবেন।
এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে। আফরোজের মুখের মধ্যে আজ আমি মায়া দেখতে পেয়েছি।
চাঁদের বুড়ি নিরলস চরকা কাটছে আর আমার সামনের পৃথিবী আলোয় এক হাঁটু ডুবে যাচ্ছে। এমন দিনে মানুষের ধুমপান করতে ইচ্ছা হয়। আমি ধুমপান করি না। এই আলোয় তামাকের ধোঁয়া মিশিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই।
একটু নির্জন দেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখলাম, এই কুকুরটা সেই কুকুর নয়।
বললাম, বিস্কুট খাবেন?
কুকুরটা বললেন, আজ ধুমপান করতে ইচ্ছা করছে।
আমার বাড়ি গেলে ব্যবস্থা করতে পারি। আপনি কি আমার বাড়ি যাবেন? জানতে চাই।
তিনি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, আসি, আমার বকলশ পছন্দ নয়।
অন্ধকারে হারিয়ে গেল কুকুরটা। দেখলাম, ফুলতলার লীলা সিনেমা হলের আলোয় একটা আধা - পর্ণ ছবির পোস্টার। ছবির নাম 'নটি পড়োশন' ।
খুব সঙ্গম করতে ইচ্ছা হল। ঘরের মধ্যে নয়, নদী বা সমুদ্রের পাড়ে বালির উপর। বাঘের মতো গর্জন করতে করতে রমণ। আহত বাঘের মতো। শুধু নারী নয়, পুরুষও চিৎকার করে উঠবে। এ তো এক লড়াই, আদিম কাল থেকে চলে আসছে জঙ্গল থেকে বিছানায় । বিনা যুদ্ধে কেউ কাউকে সূচ্যাগ্র মেদিনী ছেড়ে দেবে না। স্বর্গে যুবকেরা যত খুশি রমণ করতে পারবে, ক্লান্তি আসবে না, বীজ পড়ে যাবে না, সন্তান হবে না, রাবারের সতর্কতার দরকার পড়বে না।
আমার তো পাপ নেই, পুণ্যও নেই, আমি কি স্বর্গীয় হতে পারব?
কে যেন বলেছিল, পাপ না থাকা মানেই তো পুণ্য। তাই কি? যদি বলি, আমার জ্ঞান নেই, অজ্ঞানতাও নেই —কেমন দাঁড়ায় বিষয়টা?
একজন দালাল গোছের লোক এগিয়ে এলো।
বলল, স্বর্গে যেতে চান?
কী করে বুঝলেন আমি স্বর্গে যেতে চাই?
আমরা লোক চিনি দাদা। যেতে চাইলে চলুন আমার সঙ্গে।
বললাম, চলুন।
৩
স্বর্গ
খুব কাছেই ছিল স্বর্গ, পথ জানা ছিল না। পৃথিবীতে দালালদের বড়ো দরকার আজ। আমার দেশ দালালে ভরে যাচ্ছে। কী অপূর্ব সংবাদ! রাত বেশি নয়।
গুহার মতো একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। জীবন এখানে যেন আজও আদিম। দূরে একটা বাঁশের মাচার উপর কয়েকজন যুবক কথাবার্তা বলছে।
ছোট ছোট ঘর। ঘর না বলে খোঁয়াড় বললেই ভালো হয়। টিমটিম করে আলো জ্বলছে প্রতিটি খোঁয়াড়ে। রাস্তার আলোর জোর খুব বেশি। সারি সারি মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। সকলেই যেন একটাই মুখ ভাগ করে নিয়ে বসে আছে। ড্রেনের দুর্গন্ধ তাদের স্নো পাউডারের গন্ধকে ম্লান করে দিয়ে পরাজিত করেছে।
সামনের ঘর থেকে একজন গোমড়ামুখো মেয়ে বেরিয়ে এসে দালালকে জিজ্ঞেস করল, কত বলেছিস?
দালাল বলল, এখনও দরদাম হয়নি।
মুখ খারাপ করে উঠল মেয়েটা। তার পুরো শরীরটাই শুধু ঝুলে পড়েনি, তার ভাষা-কপাল-বারান্দার তক্তপোষ সব যেন ঝুলে পড়েছে। তার ঘরের মাথায় যেটুকু আকাশ সেখানে কোনও তারা নেই। একটা কালো চাঁদ গলগল করে কালো আলকাতরা অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে।
আমি বললাম, পারব না।
দালালটা প্রথমে শুনতে পায়নি। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী বলছেন?
না, আমি পারব না।
মেয়েটা এই ফাঁকে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা খোঁয়াড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে তালা বন্ধ করে দিল। তারপর বিশ্রী ভাষা দিয়ে বলল, কী আছে বের কর, নইলে পুলিশ ডাকব, তখন সব ঘোমটা খুলে যাবে।
আমি বললাম, আমার কাছে পয়সা টয়সা নেই। এক প্যাকেট বিস্কুট আছে।
আবার নোংরা ভাষা দিল মেয়েটা। তারপর আমার পকেট হাতড়াতে লাগল। যথারীতি কিছুই পেল না, এক প্যাকেট বিস্কুট ছাড়া। পার্লে মারি।
সেটাই কেড়ে নিয়ে বলল, যা, ভাগ শালা।
বাইরে বেরিয়ে দালালটাকে আর দেখতে পেলাম না। ছেলেগুলো তখনও সেই মাচায় বসে ফিসফাস করছে। আমার শুধু মনে হল, এখনই আমার সঙ্গে যা ঘটল সেটা ধর্ষণ আর প্রতিটা ঘরে যে ধর্ষণ ঘটে চলেছে সেটা সঙ্গম।
কটা বাজে জানি না। রাত বাড়ছে। বাড়ি ফিরতে হবে। হেঁটেই। এ পাড়ায় ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। সবার চোখ চকচক করছে। চারিদিকে নজর রাখছে। ভদ্রলোকের পরিচিতি এক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
প্রথম জীবনের এক প্রেমিকার কথা মনে পড়ল হাঁটতে হাঁটতে। তার বাড়িতে মিলিত হয়েছিলাম এক দুপুর বেলা। সঙ্গমের পর সে আমাকে প্রণাম করেছিল। তখন তার মানে বুঝিনি। এখন বুঝতে পারি। তার কাছে সেটা আদিম লড়াই ছিল না, সেটা ছিল প্রিয়কে পূজা।
হাওয়া দিছে। মেন রোডে বড়ো বড়ো ট্রাক। লোক কমে এসেছে। আমি হাঁটছি।
শুধু মনে হল, কুকুর বিস্কুট খায় না, মানুষ খায়।
৪
প্রথম ক্লাস
আফরোজ!
জ্বি স্যার।
তোমার প্রিয় কবি কে?
কোন ভাষার স্যার?
তুমি কটা ভাষা জানো?
তিনটে ভালো জানি। একটা মোটামুটি।
কী কী ভাষা?
বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি আর উর্দু অল্প অল্প।
বাংলা ভাষার প্রিয় কবি কে?
জীবনানন্দ দাশ। স্যার, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
আপনার প্রিয় বাঙালি লেখকের নাম কী?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তুমি কি তাঁর লেখা পছন্দ করো?
স্যার, বঙ্কিমের লেখায় নাকি মুসলিম বিদ্বেষ আছে? আনন্দমঠ, কৃষ্ণচরিত তো তাঁরই লেখা?
তোমাকে কে বলেছে এ কথা?
শুনেছি।
আচ্ছা, ধরো তোমার ধর্মকে তুমি খুব ভালোবাসো আর চাও এমন একটা দেশ তৈরি হোক যেখানে তোমার ধর্মাবলম্বীরা শাসন করবে, তাহলে তুমি কী করবে?
তাহলে কি অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখব স্যার?
আফরোজ, জাতি-গঠন অনেক বড়ো বিষয়। এখানে ধর্মটা একটা টুল মাত্র।
জাতি-গঠন অনেক বড় ব্যাপার স্যার কিন্তু সেই জাতির মধ্যে তো সবাই আছে। একজনকে বাদ দিয়ে কি জাতি-গঠন হয়?
তুমি ভুলে যাচ্ছো যে জাতিকে তিনি কাঠগড়ায় তুলছেন সেই জাতির প্রায় ৭০০ বছরের আধিপত্য। তারা তো বাইরের মানুষ। ভারতীয় নয়। বঙ্কিম তো আদি ভারতীয়দের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেটা কি ভুল?
ভুল কি না বলতে পারব না স্যার, তবে তিনি যে রাজপুতদের বীরত্ব নিয়ে এত কথা লিখলেন, তাদেরকে জিতিয়ে দিলেন, সেই রাজপুতরা কি আদি ভারতীয়?
তারা ভারতীয় নয়?
রাজপুতরা তো হুনদের বংশধর। হুনরা কি বাইরে থেকে আসেনি?
আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে আফরোজ। জেনে তোমাকে বলব। আজ আসি।
আবার কবে আসবেন স্যার?
এখনও জানি না।
আমার প্রথম ক্লাস এভাবে শেষ হয়ে গেল। রাস্তায় এসে উঠলাম। ৮টা ১০ বাজে। আজ বুধবার।
মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে। আমার প্রিয় লেখককে আমি ডিফেন্ড করতে পারলাম না। বঙ্কিম কখনও বিদ্বেষী হতে পারেন না। চৈতন্য দেবের মতো তিনিও কৃষ্ণকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। রামা কৈবর্ত্যর পাশে কি তিনি হাসিম শেখের নাম বলেননি? পল্লী গ্রামের প্রজাদের দুরবস্থা যিনি লেখেন তিনি কি সেখানে ডিসক্রিমিনেট করেছেন? বাঙ্গালার কৃষকরা কি শুধু হিন্দু ছিলেন?
সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
দু দিন ভালো ঘুম হয়নি। খুব ঘুম পাচ্ছে। এই সন্ধ্যা কি ঘুমের জন্য প্রশস্ত? আরো একটু হাঁটতে হবে। অটো নেওয়া একটা বিলাসিতা। আকাশের দিকে তাকাতে এখন মন চাইছে না। শুনেছি, তারা গুনলে ঘুম আসে। কিন্তু তারা গুনতে গুনতে হাঁটা যায় না।
রাসমাঠের ভাঙা জমিদার বাড়ির চাতালে এসে দাঁড়ালাম ২০ মিনিট হাঁটার পর। জায়গাটা নির্জন। নিঝুম। মনে হয় স্বর্গ এমনই। আম পাতা ছড়িয়ে রয়েছে সিমেন্টের চাতালে। পা দিতেই মড়মড় করে আওয়াজ হল। এখানে একটা কুকুর থাকে।
পাতার শব্দে কুকুরটা বেরিয়ে এলেন।
আমি প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললাম, আমি আপনার এক স্বদেশী ভাই, আজ রাতে এখানে ঘুমোতে পারি?
এই বলে সেই শুকনো আম পাতার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ জুড়ে আসছে। ঘুম একটা আঠা।
একেবারে ঘুমিয়ে পড়বার আগে খেয়াল করলাম, কুকুরটা আমার মাথার পাশে মায়ের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুলেন।
আমি জানি, আমার কাছে কিছুই নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই, শুধু মুখে একটু মায়া লেগে আছে।