ছোট লোক, বড় লোক
................................
—তিনি শিশু সাহিত্যিক।
— তিনি শিশু? নাকি সাহিত্যিক?
— তিনি সাহিত্যিক। তবে শুধু শিশুদের জন্য লেখেন।
— শিশু মানে কত বছরের?
— যারা সদ্য পড়তে শিখেছে তারাই মূলত তাঁর পাঠক।
— ও মানে তিনি বর্ণপরিচয় ধরনের বই লেখেন, তাই তো?
— না, তা কেন হবে। আসলে আমার বলতে একটু ভুল হয়েছে। তিনি ছোটদের জন্য লেখেন।
— ছোট আর শিশুর মধ্যে পার্থক্য কী?
— শিশু মানে যারা স্তন্যপায়ী আর ছোট মানে যারা মানসিকভাবে এখনও পাকাপোক্ত নয়।
— অনেক বড় লোক তো ওই যে বললেন 'মানসিকভাবে' এখনও 'পাকাপোক্ত' নয়, তারা কি এর আওতাভুক্ত?
— বড় লোকেদের 'ছোট' হয়ে থাকাটা সমস্যা কিন্তু যারা শিশু তাদের ছোট হয়ে থাকাটা সমস্যা না।
— কিন্তু যে ছোটরা বেশ 'বড়', মানে যাকে আপনারা ইচড়ে পোক্ত বলেন আর কি, তারা কি ওই লেখকের পাঠক? আর 'পাকা' বলতে আপনি কতটা কম 'কাঁচা' বোঝাচ্ছেন?
— পাকা মানে যারা প্রেম, যৌনতা, রাষ্ট্র, কমিউনিজম, কিউবিজম বোঝে। আর কাঁচা বলতে যারা ক্ষিদে, কান্না, হিসি, বেড়ু, কোল বোঝে।
— কমিউনিজম, কিউবিজম তো আমিই বুঝি না, তাহলে আমি কি শিশু শ্রেণিভুক্ত? আর কাঁচা বলতে যা যা বললেন তা ছাড়া আমি অন্য সব বিষয় অল্পই বুঝি, তাহলে আমি কি কাঁচা?
— না না, একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। আপনি সেটা পেরিয়ে গেছেন।
— বয়সসীমা কত ধার্য হয়েছে? কোন সংগঠন ধার্য করল?
— সেভাবে সাল তারিখের বয়সসীমা নেই তবে যারা নিজে হাতে ভাত মেখে খেতে পারে তারা আর শিশু নয়।
— আমার এক কাকার ডান হাত অকেজো। তাঁকে এখনও ভাত মেখে দিতে হয়। তিনি কি শিশু হতে পারবেন?
— তা কেন হবে। রোগশোক অন্য জিনিস। এ তো ব্যতিক্রম। তবে তিনি যদি জড় প্রকৃতির হন তাহলে অন্য কথা।
— প্রকৃতি তো জড়ই।
— আমি সে জড়র কথা বলছি না। আমি বলতে চাইছি, মানসিকভাবে পোক্ত যদি না হন।
— তিনি মানসিকভাবে খুবই দুর্বল। সামান্যতেই ভেঙে পড়েন।
— না না আমি ও ভেঙে পড়ার কথা বলছি না। মানসিক প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে চাইছি।
— হ্যাঁ, তার মনে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। তিনি ভীষণ কৃপণ। মনকে প্রতি মুহূর্তে বন্ধ করে রাখেন।
— না, এ লোক শিশু নন। শিশু মানে ধরো যে চাঁদকে একটা দূরের বাল্ব মনে করবে।
— চাঁদকে যদি ঝলসানো রুটি মনে করে তাহলে হবে না?
— না।
— কিন্তু শিশুদের তো এই লেখা পড়তে হয় অনেক সময়। তাহলে তারা কি অনধিকার প্রবেশকারী?
— দেখুন, শিশু সাহিত্যিক হতে গেলে 'বাড়ি'র সঙ্গে 'গাড়ি'র মিল দিতে হবে।
—'আড়ি' বা 'হাঁড়ি' দিলে হবে না?
— হ্যাঁ, তাও হবে।
— কী দেওয়া যাবে না?
— বাড়ির সঙ্গে তরবারি বা নরনারীর মিল চলবে না।
— আপনারা কি কোনও তালিকা প্রকাশ করেছেন? এমন একটা মহাগ্রন্থ হাতের কাছে থাকলে বড় সুবিধে হয়।
— ঠিক বলেছেন। শিশুদের জন্য লেখা ভীষণরকম কঠিন একটা কাজ।
— গাড়ি-বাড়ি মেলানো ভীষণরকম কঠিন কাজ বলছেন?
— আপনি অস্বীকার করছেন মানেই তো শিশুদের কাগজে আপনার লেখা বন্ধ হয়ে গেল। আচ্ছা যাইহোক, পিসির সঙ্গে কী মিল দেবেন বলুন তো?
— সহজ তো — হিসি।
— হল না। ছোটদের আপনি অপভাষা শেখাতে পারেন না। তারা ছোট বলে তাদেরকে ছোট করবেন না।
— তাহলে কী মিলবে বলে দিন।
— সব বলে দেব। তার আগে বলুন, পাখির সঙ্গে কার মিল দেবেন?
— কেন ডাকি, রাখি, চাখি, কাকি, বাকি, মাখি, দেখি, ফাঁকি, নাকি, লাখ-ই, কত হয়।
— কিন্ত আপনি 'খি'র সঙ্গে 'কি' মেলাচ্ছেন। শিশুরা কি বুঝবে এত জটিলতা?
— তাহলে কী মিলবে?
— সেটা শিশু সাহিত্যিককে সাধনার মাধ্যমে বের করতে হবে।
— সাধনা?
— কী ভেবেছেন আপনি, এতই সহজ সব? কা-এ কা মেলানো, গা-এ গা মেলানো, পা-এ পা মেলানো — অনেক সাধনা করতে হয়।
— ওই শিশু সাহিত্যিক কি একজন সাধক?
— সে কি আর প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে?
— তিনি নিশ্চয়ই শিশুদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়?
— জনপ্রিয় বলবেন না, বলুন শিশুপ্রিয়। জন বললেই বড় লোক বোঝায়। এগুলো বুঝতে হবে।
— কিন্তু আমার পরিবারে সব মিলিয়ে প্রায় ৭জন শিশু আছে। কই তাদের তো কখনও তাঁর নাম করতে শুনিনি।
— আপনি শিশুদের ভাষা বোঝেন? শিশুদের ভাষা আর পাখিদের ভাষা এক। বোঝা যায় না।
— তাহলে তিনি নিশ্চয়ই পাখিমহলেও খুব জনপ্রিয়?
— আবার ভুল করছেন। পাখিরা জন হবে কী করে?
— হ্যাঁ ঠিক, পাখিপ্রিয়।
— এই তো, এই তো... এবার ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারছেন।
— কিন্তু, শিশু সাহিত্যসভায় শিশুদের দেখতে পাই না কেন? একজন শিশু অনেকজন শিশুর জন্য একটা শিশুকবিতা লিখে পাঠ করছে —এটা কি আরও ভাল না? আমি তো শিশু সাহিত্য উৎসবেও বুড়োদেরই দেখি।
— আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন।
— কী কথা?
— শেক্সপিয়রের সেই বাণী, মনে করে দেখুন।
— কী সেই বাণী?
— আরে আপনি তো দেখছি কিছুই জানেন না। শেক্সপিয়র বলেছিলেন, বার্ধক্য হল দ্বিতীয় শৈশব।
— তাতে কী প্রমাণ হল?
— শিশু সাহিত্যসভায়, শিশু সাহিত্য উৎসবে তাই বুড়োদের ভিড়।
জিয়া হক