Neglected nazms by Gulzar


গুলজ়ার । অবহেলিত পদগুচ্ছ

১।
এই মাটিভূমি
যা তুমিই দিয়েছ যেখানে
সাজাতে পারি ঘর
যে ঘর তোমারই

এসো
অবশিষ্ট কাজ শেষ হয়ে এলে
হতে পারে আগামী কোনও সপ্তাহান্তে
                                            এসো


২।

এক কবিতার পংক্তি-সন্ধানে

শব্দের ঘন বনে একটি কবিতার
ধ্বনি ও পংক্তির খোঁজে
ঘুরে ঘুরে প্রিয়তম বাক্য যখন
ডাল ভেঙে আনি
         হাতময় ক্ষত-দাগ হয়
ছিঁড়ে যায় মাংসের আঙুল
কী এক রসে ডুবে যায় জিভ যখন
মুখে রাখি ওই শব্দগুলি

৩।
এক যে ছিল ভাবনা

ছিল এক চিন্তা। ধার। ভীষণ যেন করাত।
কেটে কেটে এগিয়ে চলল আমাকে
রক্তের পেয়ালা উপচে গিয়ে
মিশে গেল আমার শরীরে

বরফ হয়ে এলো যখন,  বিন্দুতে ফোঁটায়,
সে তখন জল
বয়ে গেল
প্রস্ফুটিত কাব্যের কলমীর বাগানে

উর্দু থেকে ভাবানুবাদ
জিয়া হক



Children are hookers


একটি প্রাণ জন্মালো মানে একটি মৃত্যু জন্মালো। কে তাকে হনন করবে?  এই সদ্য জাগা ছানাটি তা জানে না। কে তাকে কেনই বা নিয়ে এলো এই উপত্যকায় —সে জানে না। সে শুধু জানে, ঘুম পেলে কাঁদতে হয়, খিদে পেলে, যন্ত্রণা পেলে, পেচ্ছাপ পায়খানা পেলে কাঁদতে হয়। আর এই কাঁদনকে গুরুত্ব দেবার জন্য একজন মহিলা আছে।  একে যে চরাচরে মা শব্দ দিয়ে ধরা হয়েছে তা তার অজ্ঞাত। ল্যাংগুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস তখনও বিদ্যুৎবাহিনীর নাগাল পায়নি বলে অকেজো। বাকযন্ত্রের কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়নি। তার যে প্রগলভতা একদিন খেয়ে নিতে পারে, অতি উৎপাদনের জেরে কত সখাবিচ্ছেদ হবে —এইগুলি পাঠক্রম হয়ত জানাবে তাকে। আইয়াপ্পা পানিকর তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবন্দোবস্তকে একহাত নিয়েছিলেন শিক্ষার সার্কাস কবিতায়।  কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা বিষয়ক বহু দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।  তাঁকে মার্টিন লুথার হয়ে যেতে দেখে নেহাতই ভালো লাগে। এই ভালো লাগা খানিকটা বাটারস্কচ খাওয়ার মতো নয়। কে জানে মায়ের গালের কোন চুমুতে সন্তানের বাৎসল্য আর কোন স্পর্শে কামনা লেগে রয়েছে? যে জেনেছে সে পারতপক্ষে নিরাপদ দূরত্বে বর্জিত থাকে। কোনও দূরত্বই নিরাপত্তা দেয় না, যা দেয় তা হল স্মৃতিভ্রংশী এক ঘুম। কিছু ঘুম থাকে যেগুলো জেগে থাকার মতো। নেশাদ্রব্য যেভাবে অপ্রকৃতিস্থ করে, চেতনের সাইকেলের চাকা বাস্তব থেকে দু আঙুল উঁচুতে তুলে ভাসিয়ে রাখে, এই নিদ্রা কি তেমনই মাদক?  স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো স্বেচ্ছাজাগর এই ঘুম। কিন্তু ঘুমের মধ্যে পালিয়ে শিশু কতদূর যাবে?  ততদূরই কি যেখানে এমন এক রাষ্ট্র যার পরিচালক থলি নিয়ে বাজারে যায়, মাছের দরদাম করে, মুরগিওয়ালার থেকে গিলেমেটে চেয়ে নেয়, যে দেশে নদী দিয়ে শুধু জল বয়ে যাচ্ছে, মৃতদেহ নয়। কিন্তু এমন দেশ তো কল্পনার সামগ্রী। কল্পলোক, স্বপ্নলোক, ঘুমজগৎ —এরা তো এক লোক নয়। আলাদা আলাদা লোক, আলাদা আলাদা মুখ। শিশু তো সবেমাত্র স্বর্গভ্রষ্ট। মা নারকীয় ব্যথায় বাস করে তাকে স্বর্গ রচে দিয়েছিল। মায়ের অভিশাপের দিন গত হয়েছে। শিশু এবার লোকসর্বস্ব হয়ে লৌকিক হল। এতদিন তার বাস ছিল অভিভাবকের অলৌকিকে।

প্রাণই কি প্রাণের জন্ম দেয়?  এমন প্রশ্ন তুলেছিল সেই থুরথুরে বুড়োটা যার একটাও খুকি বাঁচেনি।
তার দিকে করুণাভরে তাকালো সদ্য যে যুবক আব্বা হয়েছে।
কেউ এর উত্তর দেবার চেষ্টা করল না এই কারণে নয় যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে মনস্তত্ত্ব রাখেনি বা তারা এতটাই ধার্মিক যে যে-ক‌োনো ব্যাখ্যা ঈশ্বরবিরোধী হয়ে যায় কি না এই ভয়ে ভীত। তারা চুপ রইলো।
আরও দুজন থুরথুরের কানে তাম্বাকু গোঁজা ছিল। তারা উদাসীন কেননা এখানে পুনরায় দেখবার মতো আকর্ষক কিছু আর পড়ে নেই। তাদের চোখ ফুলে ভিজে জবজবে হয়ে আছে যেন দুটো আরোগ্যহীন ঘা।
দ্বিতীয় থুরথুরে বলল,  তুই বড্ড জ্ঞানগর্ভ কথা বলিস।
তৃতীয়জন বলল,  জ্ঞানগর্ভ না ছাই, ও বড্ড কথা বলে আর এটাই মূল কথা।
প্রথম থুরথুরে বলল,  এই দেখো কী মস্ত ভুলটা তুমি করে বসলে।
তৃতীয় বলল,  ভুল আর আমি? তাও মস্ত?  তোর কি মাথায় ছানি পড়েছে?
দ্বিতীয় হাসছে। যুবকটি চুপ করে আছে।
প্রথম : নিজের কথাটাই যে 'মূল' কথা —এটা কারা বলে?
তৃতীয় : যে সত্য সে সত্যির খানিকটা টের পায়। এর বিজ্ঞান, ব্যাখ্যা নেই।
প্রথম : বেশ কথা। কিন্ত কতটুকু টের পাও বললে? খানিকটা, তাই না?
দ্বিতীয় : একটু খৈনী হবে?
তৃতীয় : খানিকটা বলেছি বিনয়বশত। আসলে অনেকটা।
দ্বিতীয় : বলছি খানিকটা খৈনী নিলে হত না?
প্রথম : অনেকটা কিন্তু সবটা নয় —এ সহজ কথা তুমি জানো বলেই জানি।
যুবক বলল, মূল আলোচনাটা ছিল কিন্তু শিশু নিয়ে।
দ্বিতীয় : ঠিক ঠিক। এরা কেউ কাজের নয়।
তৃতীয় : কী কাজ চাই তোর, বল তো!
দ্বিতীয় : তাহলে আলোচনায় শিশু কই?  আর একটু খৈ মানে খৈনী হলে ভালো হতো।
প্রকৃতই, কেউ ভাবে মাদক নিলে নিয়মাতিরিক্ত হওয়া যায়, 'অপ্রকৃতিস্থ'  বলে যাবতীয় প্রকৃতির বিপরীতে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। ঘটনাক্রম থেকে বেরিয়ে একটা দূরবর্তী টিলার উপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবার মতো করে সবকিছুর অস্তাচলমানতা দেখা যায়। এ ধারণা নিয়ে আমাদের কোনও অসূয়া নেই। ধারনার সুবিধা হল সে বুদ্ধির খাপ-খোপ মেনে দেহ নেয় অথচ অশরীরী। এই শরীরশূন্যতাও তাকে আঘাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। সে আহত হয় বলেই সেও সন্ত্রাসী হয়। নমনীয়তার সন্ধান তার অনবরত চলে। নরম জমি, নাবাল জমি শুধু পরমতসহিষ্ণু নয়, সুখহীনভাবেই সে দণ্ড নেয় নরমে। শস্য ফলানো তার কাছে সততই সুখের নয়, ব্যথারও ।
—আপনি শিশুদের ভালোবাসেন না?
—জ্বি না জনাব।
—কেন?
—শিশু হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো। না, ভুল বললাম। গুছিয়ে বলি,  শিশু হল বলিউডের মতো খানিকটা।
—বলিউড মানে যারা মূলত মিউজিক ভিডিও বানায়?
—জ্বি জনাব, আপনে সহি পকড়া হ্যায়।
—হিন্দি কহ কেন? কোনো এজেন্ডা নেই তো আবার।
—মূল কথা হল, শিশু একটা বিনোদন। তাকে দেখে আনন্দ, তাকে শুনে আনন্দ, তাকে ছুঁয়ে আনন্দ, তাকে চেঁটে আনন্দ।
—চেঁটে?
—শিশুর আঙুল, মুখে আপনি জিভ কখনও ঠেকাননি?
—আপনি শিশু ভালোবাসেন না, সেটা নিশ্চিত?
—জ্বি জনাব, আমি শিশুদের ঘৃণা করি।
—কিন্তু সাধারণ লোকও বলবে যে আপনি কি একদিন শিশু ছিলেন না?
—সেটা কি আমার সমস্যা? সেটা কি প্রাকৃতিক পদ্ধতিগত সমস্যা নয়?
—আপনি একজন বাস্টার্ড।
—জ্বি জনাব।

যে তার্কিক রাগ-প্রধান, সে তার্কিক জ্ঞানচর্চার মতামতবহুল বিচিত্রানুষ্ঠানে দয়ার পাত্র হয়ে উঠবেন। তাঁরও যে জ্ঞান আছে, সেই জ্ঞান যখন অগ্রাহ্যতা ও গালাজপদ্ধতি নেন, তখনই তিনি 'জ্ঞান'কেই মুক্ত করে দিয়ে বহিরাগত হয়ে পড়েন কেননা তাঁর আত্ম-প্রদেশ এতটাই সার্বভৌম যে সেখানে সকলেই 'বহিরাগত'। নীতির নিয়মই হল সে নির্ধারককেও আহত করে। আর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই জাগিয়ে দেয় কখনও কখনও ফাঁকতালীয় তত্ত্ব যা 'দেখতে' তত্ত্বের মতো, কার্যত ছদ্ম। উদাহরণ অজ্ঞাত নয়।
—ফেমিনিজম কি তেমনই একটা তত্ত্ব?
—এই তত্ত্ব সমতার কথা বলে কিন্ত পদ্ধতিটি বড় দ্বেষপূর্ণ। একমাত্রিক আর পূর্ণাঙ্গ মানব-সম্প্রদায় নিয়ে তার ব্যথা নেই। আংশিক আর ক্ষুদ্রলক্ষ্য এই বক্তব্যের।
—কিন্তু ফেমিনিস্টদের তর্কগুলো? তার তো সামান্য হলেও সার আছে।
—নিশ্চয়ই আছে, আর তা ওই সামান্যই।
শিশু থেকে নারীবাদে গেল কেন তর্কালোচনা? শিশুও কি নারীবাদীদের 'তত্ত্ব'-এ নরম উপাদান হয়ে ফিরে আসে? এটা কি একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা? কোন তত্ত্বে রাজনৈতিকতা নেই?
—আপনারা কে কার পক্ষে গুলিয়ে যাচ্ছে।
—জ্বি জনাব।
—এতেও জ্বি জনাব?
—আসলে কী বলুন তো, বাস্টার্ডদের আব্বাজানগুলোও গুলিয়ে যায় কিনা ।

জিয়া হক



The blind shop


ও অচঞ্চল লঘুকালো মাথা 
বাঁকা চুল, পাকা চুল, নুন ও মরিচ 
এই শৈত্যের প্রকাণ্ড গর্তড্রেনপথে 
এসেছো বার্লি, বাজরা আর কল্যাণের খোঁজে? 
সাহসী বলেই তুমি পারো, তবে 
তুমি কারও পোষ্য জীব গাধাটি নও তো? 
নেই কারও হাত যেটা নোনাধরা বোঝার সদৃশ? 
লালি চায় লেবু দেয় 
অবসর প্রাপ্ত বৈকাল 
পট্ট ব্যাগ পাটভাঙা রমণীর দিকে মৌলালির ভিড়ে 
সোহাগের সৌজন্য পেতে শাদী করে লোকে 
এখানে পুরুষ যেভাবে মেয়েও সেভাবে মেলে 
অন্ধ দোকানে 
ও কপাল দধি! 
দুয়ার শব্দে রোগ সেরে যায় যদি 
কে আর বিজ্ঞান শেখে, অস্ত্রোপচার 
দেবতারা পাপ বোঝে, সে মতো বিচার 
বেড়ালিনী ছানাসহ মন্দিরের পাশে 
পরিবারে সুখ নাকি বইছে সন্ন্যাসে 
অজ্ঞতার লোম পেতে বসে আছে রোদ 
    ছানাগুলো তার কাছে শ্রীহীন সরোদ 

জিয়া হক 

A birthday boy's neglected date and data


সব হারানোর বনে একটা ফুটিয়াছিল দেহ
প্রেম চাইবার পাত্রে শুধু ফেলত চেয়ে স্নেহ
বিরাগভাজন রাত্রিকালীন মিষ্টি মুখের খুকি
সে তো নিতে রাজিই ছিল প্রসবকালীন ঝুঁকি
দেহ কেবল মনের মতো মনের কথা বলে
চায়ের পাত্র নামিয়ে রাখে মাদক রাখার স্থলে
সন্দেহী যারা, তর্কপ্রবণ কালো কফি নেওয়া পেশা
এই ধরনেরা ওই ধরনের সান্ধ্যভ্রমনে মেশা —
মেশামেলা ছাড়া এমন বস্তু দূরবর্তীর কাছে
বাবা হইবার যাবতীয় পথ তালা বন্ধনে আছে

জিয়া হক 

পোকাব্য


তুমি একটি পোকা আর পোকাদের খাদ্য পোকারা
অথচ বোকারা
বিরাট সাইকেল নেয় অন্ধকার জ্বেলে
এ আলো যতদূর যায় তেলতেলে
পিছলে যায় অট্টালিকা চাকা
'মেলা-ই মেলাবে লোক ', বলে পিছু পাকা
ঝরে না তবুও এত গৃহে পক্ব ফল
ডোবা তবে তল
তার এত নীচু মেলে মুক্তো, ব্যথা
যথা
কাটা ঘা, নুন মরিচ, কাশ্মীরি ঝাল
 প্রসাধনকক্ষ জানে তার গায়ে আদিম অস্ত্রাল
বুনো ফুল?
 পোকাদের আহার হৃদয়, আর ওড়ে অস্তগামী চুল

জিয়া হক