সুকবিতার সুগন্ধ
জিয়া হক
..............
'নজম কা তজযিয়া করতে করতে / পুরা গুলাব হী ছীল দিয়া / মিসরে অলগ, অলফাজ অলগ / ডন্ঠল-সা বচা, ন খানে কো, ন সুঁঘনে কো! / খুশবু কুছ হাথ পে মসলী গয়ী / কুছ মিটটী মেঁ গিরকে গর্দ হুই / নজম পড়হুঁ তো ওঅ ভী অব / খালি বর্তন সী বজতী হ্যায়!!'
— প্লুটো, গুলজ়ার
কবিতার কি কোনও দেশকালের সীমা-বাঁধনছাঁদ থাকে? বিশেষ কাল বিশেষ একটি লিখন'ছাঁদ'-এর মোহে পড়ে বটে, সাহিত্য ঐতিহাসিকরা সেই প্রবণতা মেনে-মেপে যুগ বিভাগ, পর্ব বিভাজনও করেন হয়ত, এই ছাঁদেরই পৃষ্ঠপোষক হয় হয়ত বড়তর কোনও পুঁজি, এই 'ছেঁদো' চর্চার বাহির-বাসীরা 'অন্য' / 'ব্যতিক্রম' নামে 'কীর্তিত' হন হয়ত, তবে এ সবে ওই 'প্রকৃত' সহৃদয় পাঠকের বিপুল উন্নাসিকতা, সে খানিকটা ওই বিনয় মজুমদারী সারস-জাতীয় — প্রকৃত কবিতা নিকটে না এলে সে 'উড়ে যায়'। এখন প্রশ্ন হবে, প্রকৃত কবিতা কী, কাকে বলে, কোনটা? কবিতা তো মানুষ ভেদে কবিতা হয়। কবিতার সংজ্ঞাগুলি যে-কারণে অচল। বুদ্ধদেব বসু বা হুমায়ুন আজাদদের আধুনিক কবিতার সংকলনগুলির বহু ' সু-নির্বাচিত ' কবিতা অনেক পাঠক অ-কবিতা বলে সরিয়ে দিতে পারেন। শিল্পে এ অধিকার-বিচারটুকু স্বীকৃত। এ কারণেই 'বড়' কবির শংসাপত্র নিয়েও বহু পদ-পদকর্তা হারিয়ে যান। বিপরীতটাও ঘটে। তবে 'হারিয়ে' হয়ত একেবারেই যায় না। নিশ্চয়ই কোনও-কারও স্মৃতিতে তা থাকে। আর কবিতার ব্যাখ্যাও আরও এক শূন্য-শুকনো ব্যাপার। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবিতারসিক শেখ সদর নইম উপরে উদ্ধৃত গুলজারের কাব্য-সমালোচনা বিষয়ক নজমটি অনুবাদ করেছেন এভাবে —
'কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে/ গোটা গোলাপই ছিন্ন করলাম / শব্দ এবং লাইন বিচ্ছিন্ন হল / কাঁটা রইল হাতে, না খেতে পারি, না শুঁকতে / গন্ধ হাতে দলা হল, কিছু ধুলোয় পড়ে মাটি হল / কবিতা পড়লে সেটাও এখন খালি বাসনের মতো বাজে। ' কবিতার ব্যাখ্যাবিরোধী এই নজমটির ' ব্যাখ্যা'ও নিষ্প্রয়োজন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বা 'রবীন্দ্র-বিদূষক' আখ্যাপ্রাপ্ত সমালোচকবর্গ যেভাবে কবিতার ব্যাখ্যা 'দিতেন' তাতে স্পষ্ট যে কাঁটা উৎপাদনই তাঁদের মৌল অভিপ্রায় এবং তারা অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের ব্যাপারে আলোচক নন, নিন্দুক অর্থে সমালোচক। ওই 'আলোচনা'গুলি প্রকৃতই ' খালি বর্তন সী বজতী হ্যায় '।
এই ভূমিকার পর গ্রন্থসমালোচনা লেখা কার্যত অপরাধ। কেবল বলতে পারি সজল আহমেদ-এর কবিতার বই ' আগুন জ্বেলে যাই ' পড়তে পড়তে মনে হয়েছে সজল প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত কবিই। এর ভেতরে তিনি আর-যা-কিছু। চিত্রপরিচালক, প্রযোজক প্রভৃতি ও ইত্যাদি। তাঁর কবিতার 'ব্যাখ্যা' না 'দিয়ে', কয়েকটি প্রিয়-স্তবক উদ্ধৃত করা গেল :
'কী হবে এত শব্দ তৈরি করে /
আবার তো সেই অন্ধকারের কাছে
আলোর জন্য আত্মসমর্পণ ;/
তবুও প্রতিনিয়ত অক্ষরগুলি ঘেমে ওঠে... '
(জ্বলে উঠি নিভে যাই)
' লাল কাপড়'-এর এই দুটি পংক্তি —
'যেন পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বের ভেতর /
আমিই স্ববিরোধী স্লোগান। '
কবিতার প্রকরন ও গাঠনিকতার মিস্ত্রিপনার ' লোভ'মুক্ত হতে পেরেছেন সজল আহমেদ; তিনি বক্রোক্তিজীবী নন ; সপাট বক্তব্যজীবী। শ্রদ্ধেয় অসীম সাহা তাই হয়ত এই কবিতাগুলিকে বলেছেন 'আপাতসরল'। সরলতাই কার্যত এর শক্তি। অনেকেই কাব্যগুন বিষয়ে ' সারল্য 'কে ইতিবাচক তো নয়ই বরং নঞর্থক-তাচ্ছিল্যে গ্রহণ করেন। জটিলতাই কি সিদ্ধি? যা জটলাগানো তা-ই কি সূক্ষ্ম? সূক্ষ্মতাই সৌন্দর্য? সৌন্দর্যই কেবল কাম-প্রার্থিত? বাঁকা উক্তি মাত্রই পদ্য? তবে, তার্কিক হয়ত বলবেন, যে অ-রূপ আপনাকে টানছে, পান করিয়ে নিচ্ছে তার অরূপত্ব, সেই অরূপ কার্যত অপর-রূপ, অপরূপ—সুন্দর। ভোক্তা ফলত সৌন্দর্যই 'ভোগ' করলেন। সজল আহমেদ যখন দেশ-প্রীতির কথা বলেন, যখন 'পিরীতি' র বলেন, যখন আত্মানুসন্ধানে যান, যখন পরমাত্মানুসন্ধানে যান, সব সময়ই কবিত্ব থাকে। যদিও এ সব কথা-মন্তব্যই তর্কসাপেক্ষতায় আটকে রয়েছে। এতদসত্ত্বেও গুলজারের কাছে ঋণী হয়ে বলি, অপরিবর্তিত খুশবুসহ পূর্ণ গোলাপই আমাদের হাতে ছিল —কঁহি নহি 'মসলী'।
Zia Haque
Golpukur, Baruipur
South 24 Paraganas
West Bengal