রসুন

রসুন
জিয়া হক
............
'রাত ভর পীঠ লাগাকর ভী তো
শোয়া নহীঁ যাতা! '— গুলজার

রোদ এসে বৃষ্টির গায়ে পড়েছে।
একটা বিড়াল লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে।
এমন দুপুরে এমন কাঁদাকাটাকাটি কেন?
ফিঙে পাখিদের স্মৃতি উড়ে উড়ে আসে,
এমন রোদে বৃষ্টি কেন ঘটে
এমন বর্ষায় রোদ কেন ঘটে।
আমি রসুন থেঁতার শব্দে আহত হয়ে আছি

স্বচ্ছ অভিযান

স্বচ্ছ অভিযান
জিয়া হক
.............

উঠোন ছিল নির্জন আর মাছও
ভাজছিল না কেউ,
গণকবরের গাছগুলো
দুলছিল সার্ধশতবর্ষে
মানুষ যাচ্ছে শিকারে আর কুকুরেরা
তার বন্ধু
নাক দিয়ে সব মনে রাখা
এই বান্ধবদের চাকরি
তুমি ভালবাসো এই সন্ধ্যা?
ভালবাসো সন্দিগ্ধ
সংশয় ছাড়া প্রীতিভাজনেরা
উদাসীনতায় বিদ্ধ
আমাকেও যারা তুলেছে এই সন্ধ্যার লাল ভবনে
রোসো!  লাল ঠিক নয়, গোলাপি তবে
তাতে আসে-যাবে এই যবনের?
তোমরা কিন্তু কবরের খুব ধারপাশ দিয়ে হাঁটছো
এই আবাসন পতঙ্গভুক,
ব্যাখ্যাও তার স্বচ্ছ

নেমে এসেছে পুতুলের শান্তি

নেমে এসেছে পুতুলের শান্তি
জিয়া হক
.............
সে বলল,  'মেয়েটা একেবারে পুতুলের মতো।'
আমি বলি, 'তুমি আমাকেও পুতুল দেখেছিলে।'
সে বলল,  'আসলে সবই আমার কাছে পুতুল। '
আমি বলি, ' তুমি একটা পুতুল আর তোমার মন
                    পুতুলখেলার ঘুমটা জাগতে চাইছে না। '
সে বলল, ' আমার যে ঘুমেই শান্তি। '
আমি বলি, ' তুমি জেগে দেখেছ কখনও? '
সে বলল, ' তুমি তো চির জেগে,  তোমার কি শান্তি আছে? '
আমি বলি, ' জেগে আছি বলে আমি যে ঘুমকেও
                   টের পেতে পারি। এটুকুও শান্তি। '
—' এটুকুও! দূর! '

আশ্বিনের কাত্তিকের কথামালা

আত্মালাপ
জিয়া হক
..............
উৎপল : নিরক্ষর বেশ্যাদের কাছে যেতে...
বিনয় : আজও ভালো লাগে?
উৎপল : নাইট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তারা...
বিনয় : আমি তো কয়েকবার ভুট্টাক্ষেতে
উৎপল : দেখা পেয়েছিলে?
বিনয় : তারা সারস সারস, কী শুভ্র সাদা!
উৎপল : তারা কর্মন্য, পাউডার সচেতন, পাহাড়ের
              অধিকার চায় না
বিনয় : পাহাড় কি বাদামের? বাদামী পাহাড়?
উৎপল : আমার চটির কথা মনে পড়ে
বিনয় : পরাঙ্মুখ চটি, নালিঘাস
উৎপল : তোমার সারস, জানো, প্রকৃতই
              উড়ে বসে প্রাকৃতজনের আপ ট্রেনে
বিনয় : হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারস
উৎপল : হেমন্তের জঙ্গলে যাবে আজ?
বিনয় : সে তো শক্তির গড়
উৎপল : সেখানে কুয়োর জলে...
বিনয় : ঈশ্বর কি গনিত বোঝেন, হ্যাঁ?

রিস্কা

রিস্কা
জিয়া হক
.............
বৃষ্টির ছাঁট আসছে। গেলাম।
তারাগুলো আজ নেই। গেলাম।
কুকুরবর্গ ভিজছে। গেলাম।
বাজিগুলো সব নিভে যায়। গেলাম।
বেড়ালেরা প্রায় চিনামাটির। যাব না
দরোজারা সব পাথরের। আমি যাব না

সুকবিতার সুগন্ধ

সুকবিতার সুগন্ধ
জিয়া হক
..............
'নজম কা তজযিয়া করতে করতে / পুরা গুলাব হী ছীল দিয়া / মিসরে অলগ,  অলফাজ অলগ / ডন্ঠল-সা বচা, ন খানে কো,  ন সুঁঘনে কো! / খুশবু কুছ হাথ পে মসলী গয়ী / কুছ মিটটী মেঁ গিরকে গর্দ হুই / নজম পড়হুঁ তো ওঅ ভী অব / খালি বর্তন সী বজতী হ্যায়!!'
                                                  — প্লুটো,  গুলজ়ার

কবিতার কি কোনও দেশকালের সীমা-বাঁধনছাঁদ থাকে?  বিশেষ কাল বিশেষ একটি লিখন'ছাঁদ'-এর মোহে পড়ে বটে, সাহিত্য ঐতিহাসিকরা সেই প্রবণতা মেনে-মেপে যুগ বিভাগ, পর্ব বিভাজনও করেন হয়ত, এই ছাঁদেরই পৃষ্ঠপোষক হয় হয়ত বড়তর কোনও পুঁজি, এই 'ছেঁদো' চর্চার বাহির-বাসীরা 'অন্য' / 'ব্যতিক্রম' নামে 'কীর্তিত'  হন হয়ত, তবে এ সবে ওই 'প্রকৃত' সহৃদয় পাঠকের বিপুল উন্নাসিকতা, সে খানিকটা ওই বিনয় মজুমদারী সারস-জাতীয় — প্রকৃত কবিতা নিকটে না এলে সে 'উড়ে যায়'।  এখন প্রশ্ন হবে, প্রকৃত কবিতা কী, কাকে বলে, কোনটা?  কবিতা তো মানুষ ভেদে কবিতা হয়।  কবিতার সংজ্ঞাগুলি যে-কারণে অচল।  বুদ্ধদেব বসু বা হুমায়ুন আজাদদের আধুনিক কবিতার সংকলনগুলির বহু ' সু-নির্বাচিত ' কবিতা অনেক পাঠক অ-কবিতা বলে সরিয়ে দিতে পারেন। শিল্পে এ অধিকার-বিচারটুকু স্বীকৃত। এ কারণেই 'বড়' কবির শংসাপত্র নিয়েও বহু পদ-পদকর্তা হারিয়ে যান। বিপরীতটাও ঘটে।  তবে 'হারিয়ে' হয়ত একেবারেই যায় না। নিশ্চয়ই কোনও-কারও স্মৃতিতে তা থাকে।  আর কবিতার ব্যাখ্যাও আরও এক শূন্য-শুকনো ব্যাপার।  বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবিতারসিক শেখ সদর নইম উপরে উদ্ধৃত গুলজারের কাব্য-সমালোচনা বিষয়ক নজমটি অনুবাদ করেছেন এভাবে —
'কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে/ গোটা গোলাপই ছিন্ন করলাম / শব্দ এবং লাইন বিচ্ছিন্ন হল / কাঁটা রইল হাতে,  না খেতে পারি, না শুঁকতে / গন্ধ হাতে দলা হল,  কিছু ধুলোয় পড়ে মাটি হল / কবিতা পড়লে সেটাও এখন খালি বাসনের মতো বাজে। ' কবিতার ব্যাখ্যাবিরোধী এই নজমটির  ' ব্যাখ্যা'ও নিষ্প্রয়োজন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বা 'রবীন্দ্র-বিদূষক'  আখ্যাপ্রাপ্ত সমালোচকবর্গ যেভাবে কবিতার ব্যাখ্যা 'দিতেন' তাতে স্পষ্ট যে কাঁটা উৎপাদনই তাঁদের মৌল অভিপ্রায় এবং তারা অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের ব্যাপারে আলোচক নন, নিন্দুক অর্থে সমালোচক।  ওই 'আলোচনা'গুলি প্রকৃতই ' খালি বর্তন সী বজতী হ্যায় '। 
এই ভূমিকার পর গ্রন্থসমালোচনা লেখা কার্যত অপরাধ।  কেবল বলতে পারি সজল আহমেদ-এর কবিতার বই  ' আগুন জ্বেলে যাই ' পড়তে পড়তে মনে হয়েছে সজল প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত কবিই।  এর ভেতরে তিনি আর-যা-কিছু।  চিত্রপরিচালক, প্রযোজক প্রভৃতি ও ইত্যাদি।  তাঁর কবিতার 'ব্যাখ্যা' না 'দিয়ে', কয়েকটি প্রিয়-স্তবক উদ্ধৃত করা গেল :
'কী হবে এত শব্দ তৈরি করে /
আবার তো সেই অন্ধকারের কাছে
আলোর জন্য আত্মসমর্পণ ;/
তবুও প্রতিনিয়ত অক্ষরগুলি ঘেমে ওঠে... '
(জ্বলে উঠি নিভে যাই)

' লাল কাপড়'-এর এই দুটি পংক্তি —
'যেন পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বের ভেতর /
আমিই স্ববিরোধী স্লোগান। '

কবিতার প্রকরন ও গাঠনিকতার মিস্ত্রিপনার ' লোভ'মুক্ত হতে পেরেছেন সজল আহমেদ; তিনি বক্রোক্তিজীবী নন ; সপাট বক্তব্যজীবী।  শ্রদ্ধেয় অসীম সাহা তাই হয়ত এই কবিতাগুলিকে বলেছেন 'আপাতসরল'। সরলতাই কার্যত এর শক্তি।  অনেকেই কাব্যগুন বিষয়ে ' সারল্য 'কে ইতিবাচক তো নয়ই বরং নঞর্থক-তাচ্ছিল্যে গ্রহণ করেন।  জটিলতাই কি সিদ্ধি?  যা জটলাগানো তা-ই কি সূক্ষ্ম?  সূক্ষ্মতাই সৌন্দর্য?  সৌন্দর্যই কেবল কাম-প্রার্থিত? বাঁকা উক্তি মাত্রই পদ্য? তবে, তার্কিক হয়ত বলবেন,  যে অ-রূপ আপনাকে টানছে, পান করিয়ে নিচ্ছে তার অরূপত্ব, সেই অরূপ কার্যত অপর-রূপ, অপরূপ—সুন্দর। ভোক্তা ফলত সৌন্দর্যই 'ভোগ' করলেন। সজল আহমেদ যখন দেশ-প্রীতির কথা বলেন, যখন 'পিরীতি' র বলেন, যখন আত্মানুসন্ধানে যান, যখন পরমাত্মানুসন্ধানে যান, সব সময়ই কবিত্ব থাকে। যদিও এ সব কথা-মন্তব্যই তর্কসাপেক্ষতায় আটকে রয়েছে। এতদসত্ত্বেও গুলজারের কাছে ঋণী হয়ে বলি, অপরিবর্তিত খুশবুসহ পূর্ণ গোলাপই আমাদের হাতে ছিল —কঁহি নহি 'মসলী'।

Zia Haque
Golpukur, Baruipur
South 24 Paraganas
West Bengal

আশ্বিনের আরও আরও কাব্য

ড্রিম ভাজা
জিয়া হক
..............
ঘুমিয়ে পড়ুক আদর
তার
সাদর
সম্ভাষণা
আমিও তবে ঘুমেতে
আর
স্বপ্নও
দেখব না
গ্রীষ্মদেশে কোথায় যেন
শীত পড়ল
কবে
তুমি কি আমার কষ্ট করে
ঘুমের বটিকা
হবে?

আশ্বিনের আরও কাব্য

বিবাহচিন্তা
জিয়া হক
..............
টিফিন ভরে মেয়েটা আনল হাতি
জল্লাদ আনে ছেলেটি টিফিন কোটোয়
হাতি জল্লাদ ভীতিমঞ্চের ধারে
নিজেদের ধরে নিজস্বী নামের ফোটোয়

ছেলেটি আনল সোনাকুনো ব্যাঙ জোড়া
মেয়েটি এনেছে ঘুমকাতুরের চাদর
চাদর ও ব্যাঙ প্রীতিমঞ্চের শেষে
বংশগতির সরিয়ে ফেলছে পাথর

আশ্বিনের কাব্য

স্কাই রানার
জিয়া হক
..............
এটা তো সত্যি
প্রতিটি ওয়াক্ত
                    মসজিদে আমি যেতে চাই
যেহেতু মোল্লা
দৌড় সেহেতু
                   গৃহ-ধর্মেই থেমে যায়


















ফটোসৌধ
জিয়া হক
..............
চাঁদ একটা শুঁড়িখানা
মদই বিলায় সে পক্ষকাল ধরে
গ্লাস আমাদের ভাঙা কিম্বা
হারিয়ে গেছে কোথাও

চাঁদের সঙ্গে সেলফি তোলার
লোক কম















মনোগামী
জিয়া হক
.............
আমি যখন চন্দ্র থেকে ফিরে আসি
সে
    আসে
            চাঁদে
আমি যখন ভালোবাসি
                   সে
       অতর্কিতেই
কাঁদে

এ শুধু অন্ত্যমিল নয়,
                         জানি আমি
যদিও সে একা নেই
  তবুও নয় এ পলিগ্যামী

পুনরুক্তি : যতবারই যৌনতা ছাড়া
                 প্রেমের কাছে
                 বেশিকিছু দাবি করতে গেছি
                  সোজা বাংলায়
                  হার্টব্রেক হয়েছে




শব্দতাড়িত প্লুটো
জিয়া হক
..............
পেল্লায় এই জীবন আর গোল্লার এই জীবন
আর মোল্লার এই জীবন আর
সাহিত্যময় স্নাতক,
আমি মুখ্যু সময়-ঘাতক
একে গ্রহণ মানে অসুখ
ইহা ত্যাজ্য সেও বিসুখ
দূরে বকের রাজ্যে আলো
আমায় শত্রুই কি পাঠালো?

আমার শিক্ষকগণ মহান
তাদের পা
অমৃত সমান
তাদের ভক্তি মানে বিজয়
তারা আছেন মানে অভয়
আমার মধ্যযুগে ভীতি
এবং কাব্যকলায় প্রীতি
আমি কাজের ক্ষেত্রে ঠুঁটো
তাই বিবাহবাজারে প্লুটো





আত্মালাপ
জিয়া হক
..............
উৎপল : নিরক্ষর বেশ্যাদের কাছে যেতে...
বিনয় : আমিও তো কয়েকবার ভুট্টাক্ষেতে
উৎপল : তারা কাজ করে, অর্থ নেয়, পাহাড়ের
              অধিকার চায় না
বিনয় : পাহাড় কি বাদামের? বাদামী পাহাড়?
উৎপল : আমার চটির কথা মনে পড়ে
বিনয় : পরাঙ্মুখ চটি, নালিঘাস
উৎপল : তোমার সারস, জানো, প্রকৃতই
              উড়ে বসে প্রাকৃতজনের আপ ট্রেনে
বিনয় : হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারস
উৎপল : হেমন্তের জঙ্গলে যাবে আজ?
বিনয় : সে তো শক্তির গড়
উৎপল : সেখানে কুয়োর জলে...
বিনয় : ঈশ্বর কি গনিত বোঝেন, হ্যাঁ?

Zia Haque |

বাইপাসে ঝুঁকির অন্ধকার

টিউশন পড়াই।  ফিরি সাইকেলে।  বাইপাস ধরে।  একা ও সাইকেল।  প্রায় মাঝরাত হয়ে যায়।  এত রাত অবধি কী পড়াশোনা? এর উত্তর নেই।  আপনি অভিভাবক হলে এই প্রশ্ন করতেন না।  পড়ুয়া ছুটি চায়, পড়ুয়ার পিতামাতৃসমাজ ঘন্টা দিয়ে ফিজের ভাগবিয়োগ করেন। থাক সে কথা।  তাঁর শ্রমার্জিত পয়সা খয়রাত করে দেবেন কেন?  একটা তুল্য-মূল্যায়ণ, হিসেবনিকেশের বিলিবন্দোবস্ত থাকা জরুরি। 
বাইপাসে অন্ধকার বেশিই থাকে।  এর কারণ আছে।  সেটা জানতে পারি ক্লাস টেনে।  ভিনপাড়ার এক যুগল বাইপাসে একটু আদি প্রেমে নেমে পড়েছিল।  তাদের সহায়ক বলতে বাইপেসে অন্ধকার। 

Half boiled, half spoiled

এত অলস আলো

তোমাদের গল্প লিখে যাব
যাব কোথায়?
ঢুকে যাব তোমাদের গল্পেই
কীভাবে ঢুকব?
চরিত্রে ঢুকে যাব
কার্যত
এই দৃশ্যমান সফলতা, সুবেশ, সাজঘরে
আমার সামান্য প্রেমটুকু হারিয়ে ফেলব
একটা অকথিত যন্ত্রনার মতো
সঙ্গীত আবহে বাজে সারাক্ষণ
এই অসুখটি বড় বয়সে বাঁধিয়ে বসেছি
পংক্তিটি এভাবে বলা যেতে পারে
প্রৌঢ়ে পাওয়া রোগ হে আমার
শুধু ওই শিশুগাছটি বাঁচিয়ে রেখো যে
শরণার্থী অথচ একটা হীনকান্ড , হীনজ্ঞান
প্রেম
সফলতা বর্ণনার সচিত্র শহরে
উতল চাকার ধারে
এই কথাগুলো বড় কবিতার মতো শোনায়
মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না

আমার ব্যথাগুলো
কবিতার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে