শঙ্খবাবুর জন্মদিন

আজ সারাদিন মৃত্যুর খবরে খবরে ভরে রইল। গতকালও ভাবিনি এমনটা হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় আলস্য যাপন করছি, আব্বা রুটিমাখনের সঙ্গে মৃত্যুসংবাদ নিয়ে ঘরে ঢুকল। আরিফের দাদু ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি দুয়া করি তিনি জান্নাতবাসী হোন। কারণ শত্রুরও জাহান্নাম আমি চাইতে পারিনা। কেউই পারেনা বোধহয়। সে তো কল্পনাতীত ব্যথা। আমি আব্বার দিকে বিস্ফার চোখে তাকালাম না। গলার আওয়াজে সেই উদ্বেগ ছিল না। বিছানা থেকে নেমে মায়ের পেছনে দাঁড়ালাম। মা রুটি সেকছে, ছোট ছেলে বউয়ের জন্য। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মা বলল, আরিফের দাদু মারা গেছে। এবার এটি আমার কাছে পুরনো খবর। এখনও চোখেমুখে যেটুকু বিস্ময় সে আগের বিস্ময় থেকে টানা। অনেক থিতনো। নিভু নিভু। চমকাচ্ছি না কেন? আমি কি অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি? তা কেন হবে। তাহলে কি এই মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে উঠবার আগে আমরা আরিফের দাদুর জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম? যেভাবে, যেভাবে...লাগসই উদাহরণ পেলাম না যার সঙ্গে মিল করা যায়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০র ও বেশি। ধবধবে চুলদাড়ি। হাতে সৌখিন লাঠি। শুনেছি তাঁরা কোথাকার জমিদার ছিলেন। এই প্রথা উঠে যাবার পর মাটি বিক্রি করে এখানে চলে এসেছেন। দুই ছেলে। দুজনের সুপ্রতিষ্ঠিত। একজন রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক। আরেকজন সদ্য রাজ্য সরকার বিদ্যুত দফতরের উচ্চ পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। বৃদ্ধর নাতি-নাতনিরাও উন্নতি করছে। ভরাট অট্টালিকা, ভরাট পরিবার। এই বাড়ির সাম্মানিক গৃহকর্তা অমৃতলোকে হাঁটলেন।
যতগুলো মৃত্যুর কথা শুনলাম সবার হয়ত এমন সুন্দর গল্প নয়। সেটাই স্বাভাবিক। অনেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে মৃতের স্মৃতিটুকু পেয়েছেন। পয়সা-সচল রাস্তায় তার বিনিময় মূল্য কানাকড়ি। হয়ত অসুস্থ কড়িও নয়, শূন্য। আকাশের মতো শূন্য নয়, কেননা ফাঁকা মানে সেখানে কিছু আছে। এর বেলা খালির অর্থ খালি।
এই গ্রামে মৃত্যু দেখা দিলে মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হয়। মৃতের পরিচয় জানিয়ে তার শেষকৃত্যের সময় ও জায়গা জানানো হয়। শুরুটা হয় এভাবে--একটি বিশেষ ঘোষণা...(বাক্যটি দুবার)। ঘোষক ভেদে বাক্যের কিছু তারতম্য ঘটে। মুয়াজ্জেন ফকির মিয়াঁ দীর্ঘ কত বছর এই দায়িত্ব পালন করছেন তার হিসেব নেই। তারপরেও তাঁর ভুল হয়। 'মারা গিয়েছেন'-এর জায়গায় বলেন 'মারা যাবেন'। বকুনি খান। কিন্তু হজম হয় না। তাই সারবান হয় না।
এক সময় ভাবতাম, তখন সবে পৃথিবীর সঙ্গে ভাব হচ্ছে, যে ক্রমে জন্ম সেই ক্রমে মৃত্যু। মানে পাঁচ ভাই যেভাবে বড় মেজ সেজ... সেভাবে বড়র মৃত্যু, মেজর মৃত্যু, সেজর...। শিশুমনে নৈতিকতা ঈশ্বর। আসলে তার কাছে পরস্পরবিরোধী, বৈপরীত্যময় উদাহরণ কোথায়। যত বড় হয়, সে তার পূর্বজদের কৃতদার হয়ে পড়ে। এ ভবিতব্য। সে সংযম দেখে, অসংযম দেখে। সে শৃঙ্খলা দেখে, দেখে উচ্ছৃঙ্খলা। সে দান করে আনন্দ পায়, চুরি করে 'আনন্দ' পায়। আনন্দসুখভোগ। শিশুমনে নৈতিকতার মনোপলিতে একটি প্রায় হ্যাঁবাচক 'না'-এর মতো এসে দাঁড়ায় আনন্দসুখভোগ। এই প্রথম ঈশ্বরের পাশে সে আরেকজনের আঁশটে আটকে থাকা টের পায়। এ কে, কে ইনি? সে আমার আনন্দের সপক্ষে সওয়াল করে, আমার কমফোর্ট নিয়ে ভাবে, সে আপন। নৈতিকতা! আপনি বড় ভয় দেখান, অ-সুখের কথা বলেন, বড় কাঠকাঠ। তবে এটাও ঠিক আপনার থাকায় একধরনের পূর্ণতার বোধ জেগে থাকে। এটাই হয়ত ভারসাম্য। জানি না। শিশুমন তো ধীরে ধীরে কিশোরমন, ধীরে ধীরে যুবকমন। 'বৃদ্ধমন'-এর কিন্তু এই সব পর্যায়গুলোর অংশত স্মৃতি থাকেই। যাইহোক, আমরা তো জানি যে, মন শিশুকে চালায়, মন আর কিশোর তর্ক করতে করতে এগোয় আর যুবক চালায় মনকে। বৃদ্ধের বেলায় কী তা অনুমেয়--না চলে মন, না বুড়ো। এখানে কথা হল, যে যুবক সে তো মন সমেত যুবক, তাহলে সে আবার আলাদা হয়ে মনকে চালাবে কী করে? এই জিজ্ঞাসার সমাধা এভাবে হতে পারে যে, আমি ঘোড়াকে চালাইয়ের অর্থ হল, কোনো একটি বিশেষ অবস্থানে আমি ঘোড়ার ওপর জয়ী। তাই সে আমার আয়ত্ত, বশংবদ, নির্দেশানুসারী। হতেই পারে, জয়ী আর বিজিতের এই ছক পালটে গেল। তখন কিন্তু বাহন চালকের কাঁধে চড়বে। এবং চড়বেই। এতে যতটা অপারগতা জনিত অসহায়তা আছে তার চেয়ে বেশি অত্যাচারিতের প্রতিশোধ-ইচ্ছা। অর্থাৎ যা পাওয়া গেল তা হল, নৈতিকতা শিশুমনের ঈশ্বর তাই মল্লদাঙ্গাটি নেই, কর্মের ওপর ন্যায়-ভাবন গড়ায়। পরবর্তীতে এই মল্লদাঙ্গা সুন্দ-উপসুন্দের চেহারা নেয়। যত সময় যায়, নিরপেক্ষতার নৈয়ায়িকতাকেই 'অ-নৈতিক' ঠাউরে দলভুক্ত হয়ে পড়ে মন। কোন দল? সেই দল যা দৃশ্যত নীতি-যুক্তির, কার্যত স্বেচ্ছাচারের। আনন্দসুখভোগের। স্ব-ইচ্ছা বা আনন্দসুখভোগ মন্দ হবে কেন? না, ততক্ষণ মন্দ নয় যে অবধি অপরের মৌল-থাকার প্রাথমিক শর্তকে নাড়ায়। কেউ বলবেন, আমাদের সব সম্পর্ক, সামাজিকতা, প্রতিষ্ঠান তো আসলে এই প্রতিটি 'অপর'-এর মৌল থাকার ভেতরে যাতায়াতের মিউচুয়াল পথ! ঠিক, পথটির 'মিউচুয়ালিটি' থাকা পর্যন্তই। 'চেম্বার'স থেসারাস' অভিধান বলছে, মিউচুয়ালিটি শব্দের মানে হল, এ রেসিপ্রোকাল রিলেশন বিটুইন ইন্টারডিপেন্ডেন্ট এন্টিটিজ। 'রেসিপ্রোকাল' অংশে জোর।


ভাবতাম পর পর মৃত্যু হয়ে যাবে। অর্থাৎ এমন এক পর্ব আসবে যখন আমার বড়দা নেই, আমি আছি। আমি আর বড়দা নেই, আমাদের ছোট আছে। সে নেই তার স্ত্রী আছে, যেহেতু ওর চাইতে ওর স্ত্রী সামান্য সিনিয়র। কী করে বাঁচবো  যেখানে বড়দা নেই! আমার তাকে প্রয়োজন নেই কিন্তু তাকে আমার প্রয়োজন। কারো কারো আত্মবিশ্বাস 'আত্ম'-এ না থেকে পরাত্মে চলে যায়। অথবা দেহ-নিরপেক্ষতায় বিরাজ করে। যেমন কর্ণের রক্ষাকবচ। কী এই রক্ষাকবচ? একটি দৈব মাদুলি? মন্ত্রপূত গাছড়া? নেহায়েতই কি তাই? ওটাই তার আত্মবিশ্বাস নয়? বিশ্বাসটা এমনই গোঁড়ামিতে পৌছেছে যে কর্ণ নিজেকে এক মনে করলেও ওই পুঁটুলি তার কাছে ডানপাশের শূন্য। ওগুলো না থাকলে তিনি এক, থাকলে একশো। আমার বড়দা আমার এক। আমি শূন্য।

২টি মন্তব্য:

Share. Comment. Subscribe