নেলি হত্যালীলার ৪১ বছর: নয়া ভারতের এক প্রাক-গোধরা অধ্যায়
১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেলি হত্যালীলার পর ৪১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীন ভারতের অন্যতম ভয়াবহ সহিংসাত্মক ঘটনা হিসেবে একে দেখা হয়। সরকারি হিসেবে এই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ১৮০০ থেকে ২০০০ জনের মধ্যে, কিন্তু বেসরকারি খাতায় এই সংখ্যাটা ৭ হাজারের কাছাকাছি। এখন প্রশ্ন হল, অসমে ঘটা এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয় বা নিগৃহীতদের আত্মপরিচয়ের কাছে এই সংখ্যার গুরুত্ব কতখানি। ওই ম্যাসাকারের প্রতীকী সহিংসতা বর্তমানে অসমের সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
নেলিতে সর্বোপরি ‘বাংলাদেশি’দের প্রতি একটা ভীতিমূলক ও ঘৃণাপূর্ণ ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছিল এবং অসমের “আদি” বাসিন্দাদের শত্রু হিসেবে তাদেরকে দেগে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯-১৯৮৫ সালে অসম আন্দোলনের সময় বিহারি ও নেপালিদেরও বিদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ ও এনআরসির মাধ্যমে আইনি ভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে। আজকের দিনে অসমে তারা গণশত্রু এবং তাদের মানবিক অস্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বিজেপি।
অসম আন্দোলনের আবহে ১৯৮৩ সালে অসমে সংঘটিত নেলি ও অন্যান্য ম্যাসাকারের নির্যাতিতরা বেশিরভাগই ছিল বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম এবং এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। বস্তুত, দেবব্রত শর্মার মতো গবেষকরা অনুসন্ধান করে বের করেছে, অসম আন্দোলনে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মূলত বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম, এসসি-এসটি-ওবিসি সংখ্যালঘু ও বাম কর্মীরা। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ও সত্য। এর ফলস্বরূপ বর্ণ অসমিয়ারা এক প্রকার “আদি বাসিন্দাসুলভ” সুবিধা ভোগ করে। অসমিয়া জাতীয়বাদের পরিণতিতেই সংঘটিত হয়েছিল নেলি হত্যাকাণ্ড।
হত্যাযজ্ঞের দিনই যুক্তিবোধকে খুন করা হয়েছিল এবং ঘরোয়া সহিংসতা এর সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। বর্ণ অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য উপযুক্ত মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল এটি। সেই সঙ্গে অসমিয়া জাতীয়বাদে বিশ্বাসীরা নৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। নেলিতে ওই ঘটনা না ঘটলে সিপাহঝড়ে মইনুল হকের সঙ্গে ওই নেক্রোফিলিয়াক আচরণ করতে পারত না বিজয় বনিয়া।
নেলি অসমিয়াদের মানসজগতকে আমূল বদলে দিয়েছিল এবং তা খারাপের দিকে। এই হত্যালীলা বর্ষপূর্তিতে অপরাধবোধহীনতা ও নীরবতা কার্যত সামাজিক অবক্ষয়কেই তুলে ধরে। এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও নেলিকে ভুলে গেছেন। ফ্রাঞ্জ ফ্যানোঁ যথার্য বলেছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্ছিন্নতাতেই মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়। আঞ্চলিক গণমাধ্যমও এই বিষয়কে পরিত্যাগ করার পথে হাঁটছে ও গভীর নীরবতা পালন করছে। এরা কার্যত ওই বুদ্ধিবৃত্তিহীন মধ্যবিত্ত সমাজেরই সম্প্রসারিত অংশ। ফ্যানোঁ সঠিক ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে “রুদ্ধ সমাজ” হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এমন এক সমাজে যেখানে কারও রুচিবোধ নেই, “আইডিয়া ও মানুষ” অসৎ, নীতিভ্রষ্ট ও দুর্নীতিগ্রস্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই সমাজ গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ এবং এরা অগ্রগতি ও উদ্ভাবনের পরিপন্থী।
অসমে বড় হওয়ায় আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি, এটা একটা রুদ্ধ সমাজে পরিণত হয়েছে। বিদেশী অর্থাৎ ‘বাংলাদেশি’দের বাইরে তারা কিছু দেখার ক্ষমতা হারিয়েছে। বাংলাদেশিদের নিয়ে এই বদ্ধমূল ধারণা অসমিয়া জাতীয়তাবাদের একটা স্বতন্ত্র সামাজিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধারণার ভিত্তিমূলে রয়েছে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অসমের রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেন এমন বহু লেখক এমনটাই যুক্তি দিয়েছেন।
আত্মপরিচয় নিয়ে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশিদেরকে ‘অবজেক্টিফাই’ করা ও অসমিয়াদের আত্মরতি রয়েছে। একজন বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমকে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে দেখা হয় না, বরং তাদের সম্পর্কে গড়ে তোলা কিছু বদ্ধমূল ধারণা থেকে দেখা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৮১-১৯৮২ সালে অসম সাহিত্য সভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন সীতানাথ ব্রহ্মচৌধুরী। তিনি ময়মনসিংহ বংশোদ্ভূত কৃষকদের “মাটি-লোভী” তকমা দিতেন। পূর্ব বাংলার অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে ১৯৩১ সালে করা সিএস মুলানের সেনসাস রিপোর্টের প্রভাব আমরা এ ক্ষেত্রে দেখতে পারি। মুলান শুধু অভিবাসীদের মাটি-লোভীই বলেননি, সেই সঙ্গে অভিযোগ তুলেছিলেন যে, এই অভিবাসীরা লাখ লাখ একর জমি জবরদখল করে নিচ্ছে। সমস্ত কৃষক ও অভিবাসীদের সম্পর্কে এই ধরনের মতামত শুধু সমস্যাজনক ও বেঠিকই নয়, পাশাপাশি আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে এই ধারণা।
নেলির মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল সাহিত্যিক সমাজও। একদল সাহিত্যিক লাগাতার অভিবাসীদের নিয়ে বিষোদ্গার করে গেছেন। ‘বিদেশী’দের প্রতি এতটাই তীব্র ও প্রসারিত ছিল সমষ্টিগত ঘৃণা। ডব্লিউ ই বি ডুবয়েসের থেকে একটা রূপক ধার করে বলা যায়, বাংলাদেশিদের দেহের উপর একটা আবরণ বা পর্দা তৈরি করেছিল নেলি। আর এই আবৃত দেহে বারবার নানা ধরনের হিংসাত্মক নিগ্রহ আছড়ে পড়েছে।
বাঙালি বংশোদ্ভূত মায়েদের মাতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের পরিবারগুলির নাগরিকত্বকে নাকচ করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের জমি, তাদের শরীরকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদেরকে বস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, তারা বিষাক্ত, কেউ তাদের চায় না। অসমিয়া সমাজ ও ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখানোর ফাঁদে তারা আটকে পড়েছে। দেওয়ালে যেমন পরজীবী লতাগুল্ম গজায় তেমনই নেলির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এদের সঙ্গে অব-মানবের আচরণ করা হচ্ছে।
মিয়া মুসলিমদের সম্পর্কে বর্তমান সরকারের বিবিধ রাজনৈতিক মন্তব্য ও একাধিক আইনি নিষেধাজ্ঞা আসলে ক্রমবর্ধমান ঘৃণাকেই প্রতিফলিত করে। অসম গবাদি পশু সুরক্ষা আইন ২০২১, অসম রিপিলিং আইন ২০২২ (এর মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষায় জনগণের অনুদানকে বন্ধ করা হয়েছে), নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা নির্ধারণ, সবজির মূল্যবৃদ্ধির জন্য মিয়া মুসলিমদের দায়ী করা (ফুড জিহাদ), প্রকাশ্যে ঘোষণা করা যে, নির্বাচনে জিততে মিয়াদের ভোট দরকার নেই বিজেপির, তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিযুক্ত করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং শিলচরে বন্যার পর তাদের বিরুদ্ধে ‘ফ্লাড জিহাদে’র অভিযোগ আনা—এই সবই যদি বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষ না হয় তাহলে কাকে বলব বর্ণবাদ?
বর্তমানের ঘটনা পরম্পরা থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার সূচনা-মুহূর্ত ছিল নেলির হত্যালীলা। সেই ম্যাসাকারের এত বছর পরও আরও সহিংসতার আয়োজন করা হচ্ছে তথাকথিত ‘বিদেশী’দের দেহভূমির উপর। ব্যাপক ঘৃণা জমে রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাদের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বকে আক্রমণ করার নানা রকম পথ বের করা হচ্ছে।
তরজমা: জিয়াউল হক