ডারউইনের ধর্ম ও বিশ্বাস। জিয়া হক

ডারউইনের ধর্ম ও বিশ্বাস — বিষয়টি কৌতূকপ্রদ মনে হতে পারে কারো কোরো কাছে। কেননা ধর্ম নামক বিশ্বাসমালা ও আপাতভাবে 'অযৌক্তিকতা'র বিপরীত স্বর হলেন এই বিশ্ববন্দিত বা 'বিশ্বনিন্দিত' জীববিজ্ঞানী । তিনি মসিহা, তবে 'সকল'-এর নন। মুক্তমনা, বস্তুবাদী, নিরীশ্বরবাদীদের মুখ্য আশ্রয় তিনি। তাঁর 'বাণী'র মতো এত উদ্ধৃত 'সমাচার' কতিপয়ই রয়েছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার নামে 'লোক' যা বলে বা করে থাকে তার আদি গুরু প্রকৃত অর্থে সংঘবিরোধিতায় মুখর কেননা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চেয়ে বড় ও সুসংগঠিত সংস্থা আর কী আছে? ঈশায়ী ধর্মের প্রাবল্যের পর্বে, 'অপৌরুষেয়' ওল্ড টেস্টামেন্টের অমোঘ নির্দেশনার যুগে, ঈশ্বর-স্বর্গ-নরকের প্রকল্পনার ভিত-ভূমিতে দাঁড়িয়ে, পারিবারিকভাবে একটি বিশেষ ধর্মীয় প্রতিনিধি হয়ে সেই ধর্মের মৌল তত্ত্ব ও ব্যাখ্যার পাশে ভিন্ন মত ও দর্শনের নির্মাণ সহ তার প্রচারণাই তো এক নিসঃঙ্কোচ অন্তর্ঘাত। যদিও তাঁর পরিবার ঈশ্বরবাদী ছিল না কখনও। যদিও তাঁর বাবা তাঁকে সতর্ক করেছিলেন যে প্রকৃতিই কেবল জড় নয়, মানুষ-প্রকৃতিও অ-চল, অ-নড় —অজ্ঞাতসারেই জড় । প্রত্যাঘাত আসতে পারে। ডারউইন কর্ণপাত করেননি সে-সাবধানী রক্ষণশীলতায়। কেননা তাঁর অকৃত্রিম প্রশ্নই এই সার্বিক রক্ষণশীল সংঘবদ্ধতার কাছে যে কে গড়ে তুলল এই 'যাবতীয়-যা'কে। কেন সৃষ্টি হল 'যন্ত্রণা'র? ওল্ড টেস্টামেন্ট উদ্ধৃত করে সমাধান খুঁজতে চাওয়াকে তিনি মনে করেন, ধর্মগ্রন্থ থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত পংক্তি উদ্ধার করে কার্যত আলোচক নিজের অ-চিন্তাকে বা চিন্তা-দৌর্বল্যকেই সুনিশ্চিত করছেন। শুধু তাই নয়, আদি টেস্টামেন্টের উল্লেখ খানিক ভরিক্কি আনে আলোচনায়। তাঁর সহজ মত ছিল এমন যে, একজন বর্ণান্ধকে লাল রঙের লালত্ব যখন বোঝাতে সক্ষম নয় 'সুস্থ'জনটি তখন সেটা কার অক্ষমতা —রঙের? সুস্থতার? নাকি ঈশ্বরের? তাঁর মনে হয়েছে,'সাফারিংস' বা কষ্টভোগকে মানুষ সুখ বা 'প্লেজা়র'-এর চাইতে বেশি মূল্য দেয়। আর এই মূল্যায়নে সক্রিয় থাকে পারলৌকিক মঙ্গলচিন্তা। কিন্তু ডারউইনের দুটি প্রশ্ন —প্রথমত : অনবরত যাতনাভোগ একটি জাতিকে অনুর্বর, অনগ্রসর ও অ-প্রজননশীল বানিয়ে তুলবে না কি? দ্বিতীয়ত : ধরা যাক মানুষের মৃত্যু-উত্তরকালিক জীবন রয়েছে, ধরা যাক রয়েছে বিচারদিবস, স্বর্গ ও নরকের ফয়সালা, তাহলে মনুষ্যেতরদের কী হবে? তারা অনন্তকাল অ-বল জাগতিক কষ্ট কেন ভোগ করে যাবে? তাদের অপরাধ কী? এমন প্রকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ডারউইন প্রকৃতির নিজস্ব 'স্বেচ্ছাচার', নির্বাচন, প্রক্রিয়া বা 'সিলেকশন'-এর কথা ভাবেন। মহাজগতে যা-ই ঘটে তার এক বা একাধিক নিয়ম, সূত্রাবলী, শৃঙ্খলা মেনে ঘটে, আর নিয়মতন্ত্র কোনো অ-জর অ-মর ঈশ্বর-নির্দিষ্ট নয় ; এই নিয়মাবলী প্রকৃতির। নিজস্ব। সবটাই প্রাকৃতিক 'সিদ্ধান্ত'। 'গ্র্যান্ড' বা 'আলটিমেট' সিদ্ধান্ত-উপসংহার বলে কিছু হয় না, অথচ ধর্মগ্রন্থগুলি তা-ই দিতে চায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবেচনাগুলি নিয়ে তাঁর তখনই সন্দেহ জাগে যখন তিনি আবিষ্কার করেন যে, গসপেলের 'কথাকাহিনি'র সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণত মিলে যায় পম্পেই প্রদেশে আবিষ্কৃত কথাকাহিনি। তাহলে বাইবেল কি অপৌরুষেয় নাকি মানুষ-রচিত? তিনি মনে করেন, অন্যান্য প্রাণীদের মতোই মানব-মস্তিষ্কের 'উচ্চ' উন্নয়নও একটা যেহেতু প্রক্রিয়া সেহেতু যে বা যারা পম্পেইয়ের ডকট্রিনের রচয়িতা তেমনই কোনো মস্তিষ্ক-সমাহার নেই তো গসপেল রচনার ক্ষেত্রে? বাইবেল যে কোনো ঐশ্বরিক নির্মাণ বা লিখন তা মেনে নিতে অসুবিধা হয় তাঁর। আরেকটি বিষয় তাঁর অসমাধেয় সমস্যা বলে বোধ হয় —সেটি হল ধর্মগ্রন্থের সংহিতার অংশগুলি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলি। এই 'মহাগ্রন্থ'গুলিতে এত বিপুল রূপক, উপমা ও ভাষিক রহস্য-জটিলতা যে এর যে-কোনো ব্যাখ্যাই হতে পারে। ফলত 'সব বেদে আছে' ধরনের এক প্রহেলিকারও জন্ম হয়। অর্থাৎ স্বনামধন্য ঈশ্বর মানুষের মেধার উপর স্বয়ং নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হল, এই 'মেধা'র নির্মাতা বা নিয়ন্ত্রক কে? ডারউইন আগেভাগেই বলে রাখেন, নিম্ন-মস্তিষ্ক ব্যবস্থা থেকে উচ্চতর পর্যায়ে মস্তিষ্কের উত্থান একটি প্রাকৃতিক ধারাবাহিক ও নিরন্তর প্রক্রিয়া বৈ আর কিছু নয়। সেহেতু মানুষের মেধা-ই কার্যত ঈশ্বর নামক একটি সর্বৈব বিশ্বাস গড়ে তোলার মূলে। 'চতুরঙ্গ'-এর জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যেভাবে, যে-ঈশ্বর আমার বুদ্ধি দিয়েছেন সেই বুদ্ধিবৃত্তিই বলছে তিনি নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরই বলছেন ঈশ্বর নেই। এটি একটি ধাঁধার মতো। তবে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারনাকেও বহু আগে নাকচ করেছেন ডারউইন। তাঁর মনে একটি জিজ্ঞাসার কোনো মীমাংসা হয় না, আর সেটি হল, যদি হিন্দুদের ঈশ্বরের ইচ্ছা জাগে কোনো প্রত্যাদেশ দেওয়ার, তাহলে তিনি কি বিষ্ণু বা শিবের মতো কারও দ্বারস্থ হবেন বা তাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে 'কাজ' - এ লাগাবেন? একই প্রশ্ন ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পর্কেও। এ ও ভেবেছেন যে পৃথিবীতে এতগুলো ঈশ্বর কেন? প্রতিটি ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর। সৃষ্টি যেমন সত্য, স্রষ্টাও তেমনই সত্য হলে তিনি তো একক হবেন। সকলের জন্য অভিন্ন —তা সে যদি সৃজনাত্মক দলীয় তন্ত্র বা সমষ্টিগত কোনো 'টিম' থাকে তাহলেও। খ্রিস্টান ধর্মের ত্রি-স্তরীয় ঈশ্বরবাদ, ইসলামের একেশ্বরবাদ, বৌদ্ধধর্মের না-ঈশ্বরবাদ —সবার জন্যই তার এই প্রশ্ন। এমনকি সেই উপজাতিদের জন্যও যারা 'আচার'কেই নিয়ম ও নিয়মকেই ঈশ্বর বানিয়ে তুলেছে, তাঁর অভিন্ন জিজ্ঞাসা। কেননা 'মিরাকল' বা অলৌকিকতা কখনও কোনো ধর্মতত্ত্বের ভিত-মূল হতে পারে না যেটা ওল্ড টেস্টামেন্টে অহরহ আছে। অপর ধর্মেও তা অপ্রতুল নয়। তাহলে তো বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এমন —যা অব্যাখ্যেয় তা ঐশী আর যার জগৎ-যুক্তিসম্মত মীমাংসা রয়েছে তা খুদগর্জ, ঈশ্বর-শূন্য। আত্মা ও আত্মার নশ্বরতার ধারনাও এমন এক বিষম বস্তু। এই প্রতর্কে এসে মানুষ থতমত খেয়ে যায় যেহেতু তা লৌকিক চেতনার কাছে অজ্ঞেয়। যেভাবে 'প্রাণ' ঠিক কী বস্তু —এই কৌতূহলের সদুত্তর নেই। তাই এগুলিকে 'মিরাকল'-এর আওতাভুক্ত করে ঈশ্বরকে দার্ঢ্যতা দেওয়া হয়। প্রখ্যাত চিন্তক প্যালে প্রকৃতির বিপুল ডিজাইনের কল্প-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ডারউইন সেই বিশ্লেষণকেই জীবনের একটা পর্ব অবধি আলটিমেট মনে করতেন। কিন্তু অব্যবহিত পরেই তাঁর সেই তত্ত্বাদর্শকে ভ্রান্ত মনে হয়। ন্যাচারাল সিলেকশন-এর ভাবনাই তাকে প্যালে-এর মতামত থেকে মুক্ত করে। তিনি তখন আর মনে করেন না যে, যেভাবে একটি দরজা বানিয়ে তোলে একজন মানুষ, সেভাবে একটি কোষ, এমনকি একটি প্রাণও বানিয়ে তুলবে কেউ। জৈব জগতের ক্ষেত্রে এমন 'ডিজাইন'-এর অস্তিত্ব নেই, যেমনটা আছে জড়-বিশ্বে। ডারউইনের প্রশ্নটি খুবই সরল। তিনি জানতে চান, এত নিখুঁত পার্থিব আয়োজনের প্রয়োজন কোথায়? কে, কেন, কীভাবে বানালেন এমন নিশ্ছিদ্র নক্সা? তার উদ্দেশ্য কী?

যন্ত্রণাপ্রবাহ । জিয়া হক


 

তারপর যা হওয়া উচিত । জিয়া হক

ব্যাঘ্রশাবক অরণ্য পরিদর্শনে বাহির হইয়া দেখিল এক রুগ্ন, শীর্ণ ও প্রৌঢ় কাঠুরে ঘামিতে ঘামিতে একটি বাবলা গাছের মোটা শিকড় কাটিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার লাল গামছা মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ব্যঘ্রশাবকের বড় করুণা হইল। কাঠুরেটির কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। একটি জলজ্যান্ত ব্যাঘ্র দেখিয়া ভয় পাইয়া দুই পা পিছাইয়া গেল কাঠুরে। পালাইবার পথ খুঁজিতে সে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল। কিন্তু সে তো জানিত না, সকল ব্যাঘ্র অনুরূপ হয় না। ব্যাঘ্রশাবক বিনীত ভাবে করজোড়ে বলিল, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষ খাওয়া শিখিনি। নররক্তের স্বাদ কী তা আমার অজানা। কাঠুরে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, আমি কি তোমার প্রথম খাদ্য হব? দুঃখমিশ্রিত হাসিতে সেই শিশু ব্যাঘ্রের মুখখানি মলিন হইয়া গেল। সে বলিল, আপনি কাঁপা বন্ধ করুন। একটা জরুরি কথা আপনাকে এখন বলতে চাই, মন দিয়ে শুনুন। আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আপনার কাঠ আমিই কেটে দেব। আপনি শুধু সেগুলো বেঁধে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবেন। এমন আশ্বাস ও অভয়বাণী শুনিয়া কাঠুরে শান্ত হইল। তাহার চোখে জল আসিল। মাটি হইতে গামছা তুলিয়া চোখ মুছিয়া সে বলিল, তুমি নিশ্চয়ই বনেদি বংশের। তোমার শরীরে এক বিন্দু হলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব, তিনি যেন পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই তোমাকে মানুষ করে দেন। আজ আমি চলি। এই বলিয়া কাঠুরে তাহার ছোট কাঠের বোঝাটি মাথায় চাপাইয়া চলিয়া গেল বাজারের দিকে। শিশু ব্যাঘ্রটি আবার চলিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে দেখিল, প্রখর রৌদ্রে এক কৃষক কাদা-জলে দাঁড়িয়ে ধানের চারা পুঁতিয়া দিতেছে। তাহার শরীর অনাহারে অর্ধাহারে পাকাটির মতো হইয়া গিয়াছে। দর দর করিয়া ঘামিতেছে অথচ কাজে বিরাম নাই। এই দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটির বড় মায়া জন্মিল। গুটি গুটি পায়ে সে কৃষকটির পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। কত দূর ধানের চারা পোঁতা হইল তা দেখিবার জন্য পিছনে ফিরিয়া কৃষকের চক্ষু চড়ক গাছে উঠিল। সে উল্টাইয়া কাদাজলে পড়িয়া গেল। সেই দৃশ্য দেখিয়া ব্যাঘ্রশাবকটি মুচকি হাসিল। তারপর বলিল, আমাকে অনুগ্রহ করে ভয় পাবেন না। আমি এখনও মানুষের মাংস খাই না। নররক্তের স্বাদ কেমন তা আজও আমার জানা হয়নি। কৃষকটি বলিল, তাহলে আমাকে দিয়েই কি শুরু করবে, বাবা? শিশু ব্যাঘ্রটি বলিল, আমাকে বাবা বলেছেন মানে আমি আপনার সন্তান হলাম। বাবার প্রতি সন্তানের একটা দায়িত্ব থাকে না? কৃষক জানাইল, আমার তো তিন ছেলে। কেউই তাদের দায়িত্ব পালন করল না। আমাকে খেয়ে তুমিই সেই দায়িত্বটা পালন করে দাও, বাবা। আপনি অযথা ভয় করছেন। আমি এখন একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শুনুন। যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন আমিই আপনার ধানের চারা পুঁতে দেব। ধান বড় হলে কেটে, বেঁধে, ঝেড়ে, বস্তা বোঝাই করে ধান আপনার গোলায় তুলে দিয়ে আসব। আপনি শুধু বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসবেন। কৃষক বলিল, তুমি কোন বাড়ির ছেলে বাছা? তোমার মনে এত মায়া কোথা থেকে এলো বাছা? তুমি নিশ্চয়ই বাঘবেশী কোনও দেবতা। যদি দেবতা না-ও হও, তাহলেও প্রকৃত মানুষের রক্ত এক ফোঁটা হলেও তোমার শরীরে বইছে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই যেন তোমাকে মানুষ করে দেন। এই বলিয়া কৃষক বাড়ির পথ ধরিল। ব্যাঘ্রশাবকটিও চলিয়া গেল। গুহায় ফিরিয়া বাবা-মা'কে যা যা দেখিয়াছিল সব কথা বিস্তারিত বলিতে লাগিল ব্যাঘ্রশাবকটি। শুনিয়া তাহার অভিভাবকরা চমকাইয়া উঠিল। সন্তানের এমত মতিগতি তাহাদের ভাল ঠেকিল না। তাহারা বুঝিল বিপদ আসন্ন। মনুষ্যপ্রজাতির হাতেই তাহাদের সন্তানের অনিষ্ট হইবে। পুত্র যাহাতে বুঝিতে না পারে সেইভাবে তাহারা ভিন্ন ভাষায় আলাপ করিতে লাগিল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইয়ে জাগা ইসকে লিয়ে ঠিক নেহি। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, কিসি দুসরে জাগা পর ইসকো লে জানা চাহিয়ে। -তুমহারি শ্বশুরাল জিস জঙ্গল মে হ্যায়, ওঁহা পর জানা সব সে সেফ হ্যায়। -ঠিক কাহা আপনে। চলো, কাল হি নিকাল পড়তে হ্যায়। ব্যাঘ্রশিশুটি পিতামাতার কোনও কথা বুজিতে না পারিয়া আকাশ দেখিতে লাগিল। অরণ্যানির মর্মরধ্বনি, দূরের ঝর্নার কলকল শব্দ, পাখির বিচিত্র গুঞ্জন, শুষ্ক পত্র ঝরিবার খসখস আওয়াজ শুনিতে লাগিল। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা কী বলছ গো? ব্যাঘ্রমাতা বলিল, অনেক দিন এই বনে আছি। কাল আমরা তোর মামার বাড়ি যাব। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসব। তোর মামা খবর পাঠিয়েছে। পরের দিন তাহারা বাহির হইয়া পড়িল। সকাল হইয়াছে। চারিদিকে কেবলই আলো। রাস্তা নির্জন বলিয়া ঘাসেদের তখন ঘুম ভাঙে নাই। ব্যাঘ্র-পরিবার সন্তর্পণে লোকালয়ের পাশ দিয়া চলিতে লাগিল। ব্যাঘ্রশিশুটি পুনঃ পুনঃ পিছন ফিরিয়া চাহিয়া তাহাদের পুরাতন অরণ্যখানি দেখিতে লাগিল। তাহার মুখে খানিক দুঃখ লাগিয়া রহিয়াছে। অকস্মাৎ এক কাণ্ড ঘটিল। তাহারা দেখিল, পথের পাশে এক কাঠুরে তাহার পরিবারসহ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার হাতে গুড়-মুড়ি-বাতাসা-চিঁড়ে। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রপিতা বলিল, ইনি কে? ব্যাঘ্রশিশুটি বলিল, প্রকৃত মানুষ। তাহারা আবার চলিতে লাগিল। আরও একটি লোকালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখিল কেউ যেন কিছু হাতে লইয়া কারও জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কাছে যাইতে তাহারা দেখিল--এক কৃষক। তাহার হাতে রুটি-তরকারি। তাহার চোখে জল। ব্যাঘ্রমাতা বলিল, ইনি কে খোকা? ব্যাঘ্রখোকা বলিল, প্রকৃত মানুষ।

রেন্ট : জিয়া হক

জোবেদার নাম আসলে জুবাইদা। এই নাম কেউ ডাকতে পারে? হয়ে গেল জোবেদা। সে নিজেও জানে না তার আসল নামটা কী, কতটা সুন্দর। ছাগলের মুখের ধারে ফ্যানের গামলা বসিয়ে দিয়ে দাবায় উঠে দেখে ছোট ছেলেটা পায়খানা করে তার ওপর বসে আছে। আগুন হয়ে গেল জোবেদার মাথা। কেন যে এই আধবুড়ি বয়সে এসে বাচ্চা নিতে গেল। চড়চড় করে রাগ ওঠে মদ্দের ওপর। ছানা বিইয়ে সে যেন পাপ করেছে। মদ্দটার হুঁশ আছে? সারাদিন সরকারি খালে ছিপ ফেলে মোবাইলে মমতাজ বেগমের তর্জাগান শুনছে। জোবেদা বুঝতে পারে না গান বাজলে মাছ আসবে কেমন করে? এইটুকু বুদ্ধি কি আল্লাহ এই মরদের মাথায় ঠুসে দেয়নি? বাচ্চাকে পুকুরে নিয়ে কাপড় কাচার মতো আছড়ে ধুয়ে উঠোনে রোদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে দাবার পায়খানা পরিষ্কার করে জোবেদা। সে ভাবে, আচিয়া কীভাবে তিন তিনটে বাচ্চা মানুষ করল। একটা নিয়ে তার জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে। উঠোনের রোদে বসে বসে পোকামাকড় ধরে মুখে পোরার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা। তাই দেখে জোবেদা আর থাকতে না পেরে দাবার পায়খানার ওপর থেবড়ে বসে পড়ল। সংসার করতে তার আর ভাল লাগে না। জোবেদার ছেলে খয়রাত হোসেন তালি বাজিয়ে হাসছে। এই সময় জোবেদার মরদ মোবারক বদনা হাতে পোঁটের সামনে এসে দাঁড়ায়। অ্যালুমিনিয়ামের বদনার ভেতর কী যেন খলখল করে ওঠে। মাছ ওঠেনি, কাঁকড়া। বাম হাতে ছিপ, লুঙ্গির ট্যাঁকে মোবাইল গোঁজা। দুপুর হয়ে গেছে। জোহরের আজান দিচ্ছে আনিস মিঞা। পাড়ার লোকেরা গোসল করতে সব পুকুর ঘাটে ভিড় করছে এক এক করে। মোবারক বলে, এই জোবে বদনাটা রাখ আর গামছাটা দে, গোসল সেরে আসি। জোবেদা কোনও কথা বলে না। মোবারক চেঁচিয়ে ওঠে, রাখনা এটা। একটাও শব্দ না করে চুপচাপ দাবা থেকে নেমে পুকুর পাড়ের গা ধরে সোজা বড় রাস্তায় ওঠে জোবেদা। উঠোনে তখনও গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে মোবারক। কিছুই বুঝতে পারে না। —এভাবে গল্প শুরু করতেই পারো, কিন্তু তুমি কি তাই চাও, মানে পল্লির জীবনের গল্পই কেন শোনাতে চাইছ, মানে তোমার কি এই জীবনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে বা এই জীবন তোমাকে এতটাই স্পর্শ করেছে যে তাদের কথা না বললে তোমার ঘুম আসছে না? —শহরের গল্প তো অনেকেই শুনিয়েছে, শোনাচ্ছে, শোনাবে কিন্তু এদের কথাগুলো বলার জন্য তো কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে, তাই না? —সেই দায়িত্ব কি তোমার? কে দিয়েছে তোমাকে এই দায়িত্ব? যাদের গল্প তারা নিজেরাই বলবে, যদি তারা বলতে চায়। তুমি কে হে শহরের ঘরকুনো ধেড়ে মদ্দ? ছুটি পেলে হয় পাহাড় নয় ইউরোপ ঘুরে এসে মানুষকে চকমকে ইমারতের পাশে কফি খাওয়ার ছবি দেখিয়ে বেড়াও। —কিন্তু আমি যেভাবে বলতে পারি ওদের কথা সেভাবে তো ওরা পারবে না। ওদের কি সেই পড়াশোনা আছে, দেখার চোখ আছে? নিজের অবস্থা তো নিজের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। বাইরে থেকে কেউ না দেখিয়ে, ধরিয়ে দিলে হয়? —তোমার পড়াশোনা আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই। তুমি জানো শামুকে পা কেটে গেলে গ্রামের লোক কোন গাছের পাতার রস ঘষে দেয়? এই যে তুমি শিক্ষার বড়াই করছ এখানে বসে, ওগুলো কি শিক্ষা নয় বলে তুমি মনে করো? তুমি কী করতে পারো শেষ পর্যন্ত, গ্রামের মানুষের জীবনের ওপর একটু ফ্রয়েড, ইয়ুং, ফুকো, নিদেন মার্ক্স চাপিয়ে দেবে, এই তো? তোমার 'পড়াশোনা' তো শেষ পর্যন্ত এটুকুই করবে বা বড়জোর বিজ্ঞান দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করবে কত অযৌক্তিক তাদের জীবন, সঙ্গে একটু সিমপ্যাথি, এই তো? —বাদ দিন, জোবেদার কী হল জানতে মন চায়। —এরকম হাজার জোবেদা রয়েছে হাজার হাজার গ্রামে। কতজনের গল্প শুনবে? ধরে নাও, এই জোবেদা বাপের বাড়ি চলে গেল ও কিছুদিন পর খয়রাত হোসেন নামে একটা বিপত্নীক ছেলের সঙ্গে জুড়ে গেল। ধরে নাও, খয়রাত রেডিও বাজিয়ে বিড়ি বাঁধে সারাদিন। রাতভোর আসনাই করে। জোবেদা একসময় পোয়াতি হয়ে প্রচুর তেঁতুলগোলা জল খেতে শুরু করে আর যখন-তখন ওয়াক তোলে। কিছুদিন পর তার একটা পোলা হয়। খয়রাত ছেলের নাম রাখতে চায় সলিমুল্লাহ আর জোবেদা চায় অন্য কিছু, অন্য নাম। এই নিয়ে দু'জনের খুব টকঝাল হয়। ধরে নাও, শেষ পর্যন্ত জোবেদা জিতে যায় এই খেলায়। ছেলের নাম রাখা হয় মোবারক। রেডিও বাজিয়ে খয়রাত বিড়ি বাঁধে সারাদিন আর মোবারক পায়খানা করে গায়ে মেখে বসে বসে তালি বাজায়। গোরুর দুধ দুয়ে এসে উঠোন থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে জোবেদা, তাকিয়েই থাকে। ধরে নাও, মাগুরহাটে এক কাপড়ের দোকানে খয়রাতের সঙ্গে দেখা মোবারকের। কেউ কাউকে চেনে না। দু'জনেই তাদের ছেলের ইদের জামা কিনতে এসেছে। জোবেদা তখন মাগুরহাটেই শিমুইয়ের দোকান থেকে লাচ্চা কিনছিল। কাপড়ের দোকানে এসে দেখে খয়রাত মোবারকের জন্যে একটা ফুটফুটে লাল জামা পছন্দ করেছে আর মোবারক একই রঙের ফুটফুটে জামা বেছেছে খয়রাতের জন্যে। —এও কি সম্ভব? এবার তো আপনি জীবনের গল্প বলছেন না, আপনার গল্প বলছেন। —তুমি কি জানো, দুই স্বামী, দুই ছেলে নিয়ে জোবেদা এখন যাদবপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে? —গ্রামে থাকতে পারল না? —যতদূর পর্যন্ত গ্রাম ওদের গ্রহণ করতে পেরেছিল করেছে, তারপর পুরো ব্যাপারটা শহরের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গ্রামের আর কোনও উপায় নেই খোকা! —তাহলে গ্রামের গল্প আর রইল কই? বাকি অর্ধেক তো শহর গিলে ফেলল! —শোনো, জোবেদার আসল নাম জুবাইদা আর জুবাইদা মানে কোমলতনু, জোবেদারা এসব জানে না। জানার দরকার আছে বলে মনেও করে না। গ্রাম ও শহর একসঙ্গে নিয়ে ছোট দু'কামরার ঘরে সে রয়ে গেছে। তার একজোড়া কেয়ারিং হাত চাই আর একটা মাথা-গোঁজার ঘর। নদীর ধারে নাকি পার্কের গায়ে, সেটা জরুরি বিষয় নয়। এসব বাদ দাও, তুমি বরং মানুষের গল্প লেখো জিয়া। এই সময় চা নিয়ে ঘরে ঢুকল রফিকবাবুর মেয়ে তাসনিমা যাকে প্রেম নিবেদন করতে প্রতিদিন আমার আসা ও যে-কোনও একটা আলোচনা পাড়ার ফাঁকে একবার তার মুখ দেখতে পাওয়াই আমার রোজকার রোজগার। কিন্তু তাসনিমা নামের মানে কি তাসনিমা জানে? —একটা ছোট্ট কৌতুহল রয়েছে। —বলো। —যাদবপুরে ঘর ভাড়া পেল জোবেদারা? —ধরে নাও। —হ্যাঁ, ধরে নিতে হবে। আমাদের সবকিছু ধরে নিতে হবে। নমস্কার জিয়া হক আরম্ভ পোর্টালে প্রকাশিত

জিয়া হকের লেখা

 এখানে গানের দেশ

এখানে লোকাদেশ চমৎকারা

এখানে মাতৃমুক্তি লোকবল চায়

এখানে রাত্রি মূত্রহীন

এখানে গামছা যায় গ্রীবা ও মৈথুনে

এখানে এখন ক্ষণজন্মা

ভিড় ভিড় ভিড় ভিড়াক্রান্ত

কমল সিরিজ

 


কমল ১

বলেছিল, গাছের সন্ধান করে তোমাকে পাইলাম
বলেছিল, আমার এ পাতা পুষ্পগুলি গহনা তোমার
বলেছিল, যতদূর আমার অর্জন, ততদূর তোমারও উপায়
বলেছিল, যদি না আমাকে নাও, আমি কিন্তু তোমাকে নিলাম
বলেছিল, পথে পথে ঘাস আর ঘাসে ঘাসে কাঁটা
বলেছিল, সাবধানে পথ বেছে নিও

বুঝেছি কি? বুঝিনি কি?
মায়ের সেবায় সে তো ঋণ নেয়, কাউকে পায় না

জিয়া হক-এর কবিতা


 

এই, এই দিকে  


ছায়াছবি দেখি। 'সুস্থ' ও 'স্বাভাবিক' জীবনের বিবরণ দেখি। মিলিয়ে বুঝি, কতদূর এলাম (অধিকাংশত অনিচ্ছায়, না—শতভাগ) পূর্বাশ্রম থেকে। অনভিপ্রেত, কিন্তু এলাম। নিজেকে পূর্বাপর দেখলাম আর বুঝলাম এই যে প্রাত্যহিক মানুষী চলচ্ছবি, আমি তার অংশভাগী নই। নিজেকে বরফ ভেবেছি, উত্তাপ ভেবেছি নিজেকে। ফলত উদ্বায়ী হয়ে আকাশপথের যাত্রী হয়েছি ক্রমশ আর ভাবনার সঙ্গে ভাবনার মালিন্য রয়ে গেল। 

বাদ্যযন্ত্রের সসীম চিৎকার নয়, বলি, প্রকৃতির আওয়াজ শোন। দূরের সুপুরি বাগানের শুকনো পাতা খসার শব্দ শোনাও পৃথিবীর সঙ্গে এক প্রকারে যুক্ত হওয়া। আর কত, কত কত ছিন্নতার পরে ওষধি বনের সমীপে যাওয়া সম্ভব হবে? উচ্চারণ রুগ্ন, তাই মর্মও তা উপেক্ষা করে। রুগ্ন কবির জন্য মুগ্ধতা ও মায়া, কিংবা মায়া-মুগ্ধতা। একটা পাথরকেও উপেক্ষা করতে করতে নিজেকে অসংবেদনশীল ও হিংস্র মনে হয় একদিন। তুলে আনি, যত্ন করি, প্রণাম জানাই। এ সবই প্রায়শ্চিত্তের অংশ। এমন 'পাপ'-এর স্খালন-চেষ্টা যা কার্যত পুণ্যের বিরোধী নয়। যে-কোনও দিক ও দর্শন থেকে যারা 'অপর' ও 'ভিন্ন' তারা ওই পাথর। 

তেমনই এক নুড়ি ছায়াছবি দেখে পরিপার্শ্বের সঙ্গে তার মিল-অমিল খোঁজে। অনুরূপ লক্ষ্যে খবররের কাগজ নেয়। 




ওই, ওই দিকে 


প্রয়োজনাতীতকে চেয়েছি। আধার ততটাই নেয় যতটা তার ক্ষেত্র। আমার ইচ্ছা কি আধারের পরিমাপ জেনে প্রকাশিত হয়? কী কী দেখব বলে চোখ অপলক ছিল বনে? ময়ূরপুচ্ছ বৃষ্টিতে সুন্দর। শুধু কি বিশেষ পাখির পুচ্ছ? দেখতে চাইনি নাচ? নিরাপদ দূরত্বে বসে পশুর পাশবিক ভাষা—চাইনি কি? জনৈক কাঠুরের গাছ-প্রীতি ও বৃক্ষ-ঘৃণার করুণাচিহ্নিত সংলাপ—চেয়েছি তো। প্রয়াত আত্মীয়ের মুখ দেখব কোনও এক অপরিচিত শিরীষের তলে। ভাবনা যে-দিকে যায়, মানুষ তার ভক্ত-অনুসারী। মাছের উদরে বসে মাছকেই খাদ্য ভাবা—কাঠিন্য আছে। 


মহাকাশ থেকে সুন্দর এই নীলগ্রহ—তিন ভাগ জল—এক ভাগ নারী 

সিরিজ কবিতা : স্বেচ্ছামৃত্যু অথবা নির্বাসন : অভিজিৎ মণ্ডল


 

উৎসর্গঃ 'নির্জনতা, আরও নিবিড় হয়ে ওঠো... '

 

গানের ভিতর নেমে একজন সমানে খুঁজে চলেছে ভৈরব, অন্যজন পূরবী। একজন রাগ, অন্যজন রাগিণী। অদূরে দিগন্ত জুড়ে ঘন মেঘের ঘনঘটা, হয়ত বৃষ্টি আসবে খানিক পরেই, ভিজিয়ে দিয়ে যাবে মেয়েটির শিউলি গন্ধ মাখা করতল আর ছেলেটির ক্ষয়িষ্ণু ফুসফুস। ফাঁকা মাঠ, ধু-ধু। তারও কিছুক্ষণ পর হয়ত মেয়েটি নিজেই বৃষ্টি হয়ে উঠবে, ছেলেটি গাছ। তারা জানে, তার বেশি কাছাকাছি এলে কোনও গানই আর গান হয়ে উঠবে না। ঠিক যেভাবে কোনও কোনও দিন ছেলেটি কাঙাল হলে, মেয়েটি কুহক হয়ে ওঠে। সেতারে সন্ধ্যে বাজে, একা একা...

 

 ****


ফুলের বাগান ভেবে সরে সরে, যে গেছে

খাদের কিনারে—সবুজ দৃশ্য ভরা চোখে তার

ঝরনা উপচে পড়ে, পাহাড়ের নিস্তব্ধতা...

 

এমন প্রমত্ত দিনে সেও কি নিজেকে 

প্রজাপতি ভাবে, ভাবে নিরুদ্দেশ কুয়াশার ভিতর

কোনও উন্মাদ যুবকের ভেসে ওঠা মুখ?

 

একা, সে কিশোরী—

রোদের নরম ডানায় রঙ ছিঁড়ে ছিঁড়ে

গুপ্ত ছোরায় লিখে রাখে ঋতুদোষ।

 

*****

 

হয়ত তোমারই মতন দেখায়

লেগে থাকে, আমার চোখ—

ঠিক যেভাবে অনন্ত শূন্যের দিকে 

বাঁক নেয়—পাহাড়ী খাদ—

                       খাদের পাশে দৃশ্যময় চাঁদ

              অপেক্ষার মতো স্থির।

 

হা-মুখ গালের ভিতর ঢুকে পড়ে 

সন্ধ্যের আবছায়া গলি

সেইসব অচেনা পেরিয়ে—

তবু তো রোজ তোমার কাছে ফিরি 

 

আসলে একা একা, নির্জন, অন্ধকারে

আরও স্পষ্ট হয়ে উঠি আমি—

 

নিজেকে কেমন প্রেমিক প্রেমিক মনে হয় তখন!

 

*****

 

তুমি আমার পাশে পাশে হাঁটো

আমি তোমার পাশাপাশি—

 

কে কাকে অনুসরণ করে, কে কার 

সঙ্গে থাকে—সেসব প্রশ্ন সরিয়ে রেখে

অতল জলের নীচে, নিবিড়

 

বুদবুদে ভেসে ওঠে ছায়ার শরীর... 

 

কে কাকে ছেড়ে গেছে, কে কার মুক্তি 

এসব ভাবলে এখন—শিকড়ে টান পড়ে

ঝুলন্ত হ্যাঙারে দোলে বিষণ্ণ পৃথিবী!

 

*****

 

আমাকে আততায়ী ধরে এগোতে এগোতে

 

যেভাবে আড়াল শিখে নিচ্ছে কান্না 

ভুলে যাচ্ছো কেন—গোপন হত্যারও 

সুপারিকিলার থাকে, ফেলে আসা রাতের কথা

মনে করাচ্ছে—এইসব অন্তর্বর্তী অনুযোগ—

 

যদিও, সব তদন্তই প্রমাণ সাপেক্ষ...

 

তবু কোনও কোনও সুন্দরের চোখে চোখ রেখে

নিজের প্রকৃত খুনিকে চিনে নেওয়া যায়!

 

*****

 

মুণ্ডুহীন দেহ শুধু শুয়ে আছে যোনির ভিতর

আমি তার কান্না শুনি, রক্ত-দ্বেষ-ঘৃণাময়

জীবনের পাশে জেগে থাকেন—একা—

                               নির্বিকার জননী—

তাঁর ভ্রাম্যমাণ ডানায় ওড়ে বোধের চেতনা। 

 

প্রলুব্ধ জিভের ডগায় বসে থাকেন

তিনি মা অন্নপূর্ণা, আরাধ্যা দেবী আমার 

ধান্যদুগ্ধে ধুয়ে দেন ধরিত্রীর বুক

আমি তাঁকে পূজা দিই মাংসের থালায়

 

এভাবে অন্ধকার মুছে মুছে ক্রমশ

আলোর দিকে যাই—

পাপ কুষ্ঠে খসে পড়ে তৃতীয় আঙুল।

 

*****

 

আমি নিজের দেহে বৈষ্ণব হয়ে ঘুরে বেড়াই

স্রোতের মুখে নৌকা বাঁধি, সরে সরে 

যায় মাটি; সরে যায় ছায়া

রঙিন স্বপ্নে পড়ে থাকে সবুজ বীজতলা 

 

অদূরে নদীর ঘাটে কে যেন বাজায় বাঁশি—

ভিক্ষা শেষে ফিরে আসি নিজের শরীরে।

 

যেভাবে শূন্যতা সাঁতরে আসে ব্যাধ ও শিকার

লক্ষ-কোটি চোখ এসে গিঁথে থাকে জন্মের দাগে—

তারা কেউ আমার চেনা বন্ধু নয়, শত্রু নয় কেউ

 

অনর্থক শরীরে বাজে তীরের ঝঙ্কার! 

 

 *****

 

গোধূলি ডুবছে ওই দূরে, শ্যামলা পুকুরে 

 

ফড়িংয়ের ডানা ঘেঁষে চিকন হাসির মতো

ঝিলমিল লেগে থাকে লাজুক মেয়েটির চোখে—

অন্ন ও অবস্থান পাশাপাশি বসে

চাল ধোয়া হাতে যেন আলপনা আঁকে

                                  আকাশের গা'য়

 

নির্জনতা, আরও নিবিড় হয়ে ওঠে...

 

সন্ধ্যের মলিনতা মুছে—

বাড়ন্ত সংসারে উপচে পড়ে চাঁদ।

 

*****


সারাটা শরীর এখন স্তব্ধ দিঘি মনে হয় 

আর তুমি ঘাই মেরে চলে যাও, খাবি খাও দূরে

হিঞ্চে কলমি শাপলা শালুকের দাম ঘিরে

গোল হয়ে শুয়ে থাকে—

                ব্যর্থ দিনগুলি রাতগুলি।

 

ঘাট নেই বলে কেউ আর 

নাইতে নামে না জলে, একা একা

আমাদের ফেলে আসা পুনর্জন্মের মতো 

নিবিড় আলোয় ফেরে ছদ্মডাকনামগুলো

 

ছোট ছোট স্রোত ভেঙে ভেসে আসে—

মরা-পচা ঘাসপাতা ঘেঁড়ি গুগলি; জানালা 

                                     আঁকা চোখ— 

 

অগত্যা উদাসীন ডানায় ওড়ে মেঘের পালক।



ফেসবুকে কবিকে পেতে : https://www.facebook.com/avijit.mondal.5836

 


সিরিজ কবিতা : কালের কদম্ব-কাঁটা : শোভন ভট্টাচার্য


 

 

কালের কদম্ব-কাঁটা

সন্তানই ধর্ষক হলে নাভীশ্বাস ওঠে প্রকৃতির;
বিষে বিষে ছটফটায় ক্ষিতি অপ তেজ মরুত ব্যোম।
সেদিকে দ্যাখে না ফিরে সভ্যতার উদ্ধত অহম;
মানুষই নিয়ন্তা যেন বিশ্বময় গতি ও স্থিতির।

 

ভুলে যায় তার জন্ম এই প্রকৃতিরই ছায়াতলে।
সেই শান্তি, সে-আশ্রয়, কী নিবিড় মাতৃস্নেহবৎ
ভুলে গিয়ে ভাবে মূর্খ মহাবিশ্বে মানুষই মহৎ;
লুন্ঠনের থাবা তার পড়ে জলেস্থলে ফুলেফলে।

 

স্বপ্ন বোমাবিশ্বরূপ, ধ্বংসরূপে ন্যস্ত পরমাণু;

মাটি-আকাশের কান্না আস্ফালনে চাপা পড়ে যায়;

সেই অশ্রু সুনামির ঢেউ হয়ে জগৎ ভাসায়;

কালের কদম্ব-কাঁটা হয়ে অশ্রু ছড়ায় জীবাণু।

 

ঘরমুখী দুনিয়া, মৃত্ প্রতিদিন হাজারে হাজার...
সভ্যতা উজাড় করে পথ খোঁজে প্রকৃতি বাঁচার।

 

 

যুদ্ধবাজ ‘প্রথম’ বিশ্বকে 

তোমার ধ্বংসের বার্তা তোমারই বিজয়-ব্যভিচারে;

মানুষকে মানুষ নয়, ভেবেছ গ্ল্যাডিয়েটর তুমি;

শিকল-গোঙানি যত শুনেছে তোমার মাতৃভূমি;

যত মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা, উদযাপিত অ্যাম্ফিথিয়েটারে…

 

মানুষের মুণ্ডু কেটে তোমরাই তো খেলেছ ফুটবল;

হিরোশিমা নাগাশাকিতে ছুড়েছ পরমাণু বোমা;

কোথাও খইয়ের মতো ছড়িয়েছ মিসাইল তোমার;

জ্বলন্ত ক্ষুধার মুখ বন্ধ করতে গুঁজেছ পিস্তল।

 

তোমার দুর্দশা দেখে, প্রকৃতিও যেন তাই হাসে! 

মাটিতে লুটোয় আকাশের হাসি— হাসে কালপুরুষ—

তিনিও হাসেন, ঘরে ঘরে যার টাঙিয়েছ ক্রুশ।

তুমি কিনা কাঁপছ পারমাণবিক সামান্য ভাইরাসে?

 

তোমরাই তো চেয়েছিলে অস্ত্র হোক ‘জীবাণু-সন্ত্রাস’;

এখন কে কাকে মারবে? কে কবর দেবে কার লাশ?

 

 

‘পরিযায়ী’ প্রশাসনকে

অসুখ উড়িয়ে আনলে, সব সুখের পায়রা এল দেশে;

যতদিন না জান-জাহান ছেয়ে গেল পর্যাপ্ত জীবাণু।

কে তুমি সরকার আর এ তোমার কী ‘কালাকানুন’

পরিযায়ী শ্রমিকেরা দেশেরই ভেতরে গেল ফেঁসে।

 

ভিনরাজ্যে, কর্মহীন, অনাহারে, অনিশ্চয়তায়;

লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি, লক্ষ-কোটি ক্ষুধাক্লিষ্ট প্রাণ

পড়ে থাকল, পচতে থাকল একা— অসহ্য পেটের টান

সামলাতে না পেরে কেউ, বাড়ির আলেয়া-পথ পা’য়

 

হাঁটা শুরু করল— পথে ঝরল কত মেহনতী লোক;

তারাই দেশের চাকা ঘোরাত লকডাউনের আগে;

তাদেরও বাড়ি-ফেরার জন্য যে কয়েকটা চাকা লাগে

কে চায় সে-কথা ভাবতে? তাদের মরণে কার শোক?

 

ত্রাণের প্লাস্টিকে ছাপা মন্ত্রীর প্রধান-মুখ্য মুখ

দেখায়— মহামারির চেয়ে কত গভীরে অসুখ।    

 


কালাজাদু

আফ্রিকা নামে যে একটা মহাদেশ ছিল পৃথিবীর

সেই ছায়াচরাচর মহামারিকালে আজও আছে?

খররোদ তুচ্ছ করা কালো মানুষের বোবা নাচে

এখনো কি জেগে আছে সীমাহীন দুর্ভিক্ষ শিবির?

 

যখন ছেয়েছে বিশ্ব শ্বাসরোধী মারণ ভাইরাস;

ঘোর মৃত্যুভয়ে কাঁপছে আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ;

প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর রোগের প্রকোপ;

হাঁপাচ্ছে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারেরা লড়ছে রুদ্ধশ্বাস।

 

সুসভ্য মিডিয়া সেই কাঁপনের তালে থরহরি;

এমনকী মাস্ক পরে বাকরুদ্ধ সংবাদপাঠিকা;

সংবাদ সমূহে তবু দুনিয়ার কোথায় আফ্রিকা !

পৃথিবীর গল্পে তার স্থান শুধু কালাজাদুকরি ? 

 

বাকি পৃথিবী কি জানে সে-ভূখণ্ড কোথায় বেখোঁজ ?

'ওদের বাঁচামরায় কী ভেদ, ওরা তো মরে রোজ'...

 


শূন্য থেকে শুরু

প্রকৃতি, আত্মরক্ষার্থে, জন্ম দেয় যতেক ভাইরাস;

করোনা ইবোলা নিপা— নাম শুধু বদলে বদলে যায়;

আসে নবমৃত্যুদূত সভ্যতার স্বীয় কালবেলায়;

নাচে মৃত্যু নিঃশ্বাসের আসন্ন বাতাসে— তাই মাস্ক—

 

অন্যের প্রশ্বাস থেকে পালিয়ে বাঁচার বর্ম তাই;

পালিয়ে বাঁচার পথ পেতে যে চালিয়েছিল ‘এসি’

সেও আজ জেনে গেছে সে-পথে বিপদ আরো বেশি;

কখনো বৃক্ষের চেয়ে সুরক্ষিত হয় কি বনসাই?

 

তাই তারা সহজেই উপড়ে আসে, মূলে নেই মাটি;

শহরে শহরে তাই ঝড় এলে বড় গাছ পড়ে;

শহরে শহরে তাই করোনায় বড় লোক মরে;

যেখানে আকাশ নেই, আছে দালানের দাঁতকপাটি।

 

শূন্য খনি শূন্য বন শূন্য জমি শূন্য জলাধার;

শূন্য থেকে শুরু হোক মানুষের প্রস্তুতি আবার।   

 

 

হিরণ্যকশিপু

তোমার সংহারমূর্তি আমাকে সংযত হতে বলে;

দেখায় আমার মৃত্যু স্বরোপিত খেতের ফসল;

দেখায় আমারই বিষে নীলাভ আকাশমাটিজল;

আমারই গরল দুধে, ওষুধে, ঘাতক স্নেহতলে।

 

দেখায় আমার থাবা খাবলা করে দিচ্ছে বনস্থলী;

দেখায় আমার থাবা ফুটো করে দিচ্ছে বায়ুস্তর;

দেখায় আমার থাবা শ্বাপদের চেয়ে ভয়ঙ্কর;

আমারই সহস্তে লেখা সভ্যতার এই অন্তর্জলী।

 

করোনা কারণ মাত্র— এ আমার স্বীয় আত্মঘাত;

নৃসিংহের মতো জাগে আমার প্রতিটি স্তম্ভ, রিপু;

ক্ষুদ্রতার আস্ফালনে আমি মস্ত হিরণ্যকশিপু;

মরে যেন বাঁচি, যাতে বাঁচে কিছু প্রকৃত প্রহ্লাদ।

 

মানুষ বাঁচার মন্ত্র খুঁজে পাবে হয়তো বা তখন;

নম্র-সগৌরবে যদি বুনে তুলতে শেখে তপোবন।