তকদির


...................
আমি শুয়েই ছিলাম। যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে, শুনেছিলাম এক মৌলবীর মুখে, ছোটবেলায়। তখন কত আর বয়স হবে আমার? এগারো কি বারো। আমার পাশে বালাপোষ গায়ে দিয়ে আমারই ভাগ্য শুয়ে আছে, ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। ভাগ্যের এত অলস হওয়া মানায় না। উচিতও নয়। সে বসবে ঘোড়ার পিঠে আর সেই ঘোড়া দৌড়বে সেই মহল্লার মধ্যিখানের রাস্তা দিয়ে যেখানে প্রচুর ঘরবাড়ি, সুন্দরী রমণী, লোকের অরণ্য, সবার দৃষ্টি প্রবল তাই চশমা পরে না, মানুষকে মাপার ফিতে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গৃহকর্ত্রী, যেখানে সবাই সবাইকে 'আপনি' বলে সম্ভাষণ করে, দিশি কুত্তাবিহীন এক অঞ্চল। অথচ আমার ভাগ্য শুয়েই রইল, মশারিটাও আমাকেই টাঙিয়ে দিতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠেছে, ভুলে যাই যে, সূর্য উঠেছে বলেই সকাল হয়েছে আর সকাল হয়েছে বলে আমি জেগে উঠেছি। মুর্খদের সঙ্গে বাস করা কঠিন। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে যাব কোথায়? কোথাও যাওয়ার না পেয়ে টিউশন পড়াতে বসি। প্রথম টিউশন শুরু করি ২০১১ সালে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর শুরুতেই আমি পড়াতে শুরু করি একটি শিশুকন্যাকে। তার নাম জানতে চাইবেন না। কারণ তাকে আপনারা চিনতে পারবেন না কিন্তু সে যদি দুর্ভাগ্যবশত এই লেখাটি পড়ে তাহলে সে আমাকে চিনতে পারবে। কেন তার অনুমতি ছাড়াই তার নাম ব্যবহার করেছি তা নিয়ে সে প্রশ্ন তুলতে পারে। ভয় আছে। আমি সাধারণত যে ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই তা হল :
১. কবিতা কীভাবে লেখা হয়?
২. রাজনীতিকরা কি সাইকোটিক?
৩. মানুষ পাগল হয়ে যায় কীভাবে?
৪. সত্য মানে ট্রুথ কী?
৫. ঈশ্বর আছে?
এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে চাই কারণ এদের কোনও সদুত্তর নেই। আর সদুত্তর নেই বলেই যা-কিছু চিন্তা করা যায়। মাথা সচল থাকে। কিন্তু মুশকিল হল, আমার তৎকালীন ছাত্রীর বয়স ছিল ৬ বা ৭ বছর। সে রঙিন সব জামাকাপড় পরে আমার সামনের চেয়ারে এসে বসত। দুজনের মাঝখানে একটা পেল্লায় টেবিল। ওর মা 'এরকম-সচরাচর-পাওয়া-যায়-না' স্বাদের অপরূপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। পুত্রসন্তান নেই বলে তাঁর বড় আক্ষেপ ছিল। কীভাবে বুঝলাম? একদিন তিনি নিজেই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। তারপর যেভাবে সামাল দিতে হয়, সেভাবে সামালও দিয়েছিলেন। তাঁর দুই কন্যা। আমার ছাত্রীটি ছোট। ছোট হলে কী হবে, সে একদিন এক আশ্চর্য কথা শোনালো। বলল, জানো স্যার, আজ আমাদের স্কুলে একটা ছেলে আমার সামনে এসে বলছে 'তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত'। বলেই সে কি হাসি। আমি ভাবছিলাম, যে ছেলেটি বলেছে ধরে নিচ্ছি এই বয়সেই সে সব বোঝে, কিন্তু এ এত হাসে কেন? বুঝলাম, এও কম বোঝে না। যখন এই বোঝা ও পড়া চলছিল তখন আমার ভাবোদয় হল যে, আমি এই কন্যাকে কিছুই শেখাতে পারছি না, বরং রোজ আমিই শিখে বাড়ি আসছি আর তার বদলে বেতন নিচ্ছি। এভাবে তো চলে না। তাছাড়া, অভিভাবকরা তো বছরের শেষে নম্বর দেখবেন। অর্থের ব্যয় অনুপাতে নম্বরের আয় কত হল? আমিই অকৃতকার্য হব। একদিন ছাত্রীর বাবাকে ডেকে বললাম, ওর জন্য শিক্ষক নয়, নার্স প্রয়োজন, যে ওকে নারিশ করবে। আমি ওর কোনও উপকারেই লাগছি না, আমাকে বিদায় করুন। শিক্ষক বিনীত হলে অভিভাবক তাঁকে আরও মহান শিক্ষক ভাবতে শুরু করেন। তিনি আমাকে ছাড়তে নারাজ আর আমিও নাছোড় যে ছাড়বই। তারপর একটা রফা হল : ও আরেকটু বড় হলে আমি আবার পড়াতে আসব। তা-ই সই। কিন্তু এখন যে আমি টিউশন পড়াতে ছাদের ঘরে এলাম, এটা আপাতত আমার জীবিকা সংগ্রহের বিবিধ উপায়ের একটি। যে শুধুমাত্র জীবিকার জন্য পড়াতে বসে, পড়ানোটা যার জীবন নয়, সে শিক্ষকই নয়। তার অন্য কাজ দেখা উচিত। অন্তত আলুবিক্রেতা হতে পারে। আমার পুঁজি নেই আর সকলেই জানে টিউশন একটা বিনাপুঁজির ব্যবসা। আমি ফলত শিক্ষক নই, একজন ব্যবসায়ী। ছাত্র-ছাত্রীরা আলাদা করে ভক্তিশ্রদ্ধা দেখালে তাই আমার লজ্জা লাগে। আমি তাদের হাতগুলো আমার পা থেকে ক্রমাগত সরিয়ে দিই। এই পায়ে পাঁচ পাঁচ দশটা আঙুল ছাড়া আর কিছু নেই, তদুপরি রয়েছে ময়লাজমা নখ। পড়িয়ে নিচে নেমে প্রথমে বারান্দায় যাই না, আব্বামায়ের সামনে যাই না, যাই আমার বিছানার পাশে যেখানে তখনও আমারই ভাগ্যখানি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ভাগ্য নিজে কি স্বপ্ন দেখে? সে তো স্বপ্ন দেখায় আর এক সুন্দরী সকালে সত্যে রূপান্তরিত হয়ে মথ থেকে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়। উড়ে গিয়ে সে মেঘ হয়, মেঘ মানে প্রথমত ছায়া, তারপর জল। সব তাপ কেটে যায়, সবকিছু নাতিশীতোষ্ণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘ জীবনের লোভ জন্ম নেয় এই মেঘের গর্ভে। অথচ আমার ভাগ্য এমন নিষ্পাপীর মতো ঘুমোচ্ছে যে তাকে জাগাতে আমার মায়া হল। কে কাকে জাগাবে? আমি তাকে নাকি সে আমাকে?
আমাকে অফিসে যেতে হবে। বলা উচিত কাজে যেতে হবে। আসলে সবাই 'অফিস' যেতে চায়। আমার পরিচিত একজনের স্ত্রী তার স্বামী কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করলে বলত, অফিসে গেছে। তার মেয়েকেও সেভাবে শেখানো হয়েছে। সেও বলে, বাপি অফিসে গেছে। লোকটা ছিল প্লাম্বার।
আমিও যেমন একজন অনুবাদক ছাড়া আর কিছু নই। একটা পত্রিকার দফতরের এক কোণায় বসে হরেক মাল অনুবাদ করি। ভুঁইফোঁড় কোম্পানির ত্রৈমাসিক বা অর্ধবর্ষের অনিরীক্ষিত আর্থিক ফলাফল, ব্যাঙ্কের দখল বিজ্ঞপ্তি, দাবি বিজ্ঞপ্তি, সরকারি টেন্ডার নোটিশ, সম্পত্তি নিলাম ও বিক্রয়ের বিজ্ঞপ্তি—এর শেষ নেই। আমি রাতে বাড়ি ফিরে খলিল জিবরান অনুবাদ করব কিনা ভাবি, ভাবতে গিয়ে দেখি কবিতাগুলি বিজ্ঞপ্তি হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না, পরিভাষা ছাড়া অন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। কবির কাজ পরিভাষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, আমি রোজ তারই দাসত্ব করি, আমি কি আর কখনও-ই জিবরান অনুবাদ করতে পারব না?
এই দফতরে নানা কিসিমের লোকের সঙ্গে এই অল্প কয়দিনে আলাপ হল। একদিন সৃজিত মুখার্জির মতো সিনেমা বানাবে—এই স্বপ্ন নিয়ে এক তরুণ উত্তর ২৪ পরগনা থেকে রোজ বিকেলে এসে রাজনৈতিক খবর লেখে। সে অনেক বিদেশি সিনেমার নাম বলল। সব সে দেখেছে। কিন্তু সে বক্স অফিস চায়। তাহলে ওই বিদেশি ছবিগুলি দেখে সে কী শিখেছে? 'সিনেমাকে ভালবাসতে শিখেছি', 'লাভ-চাইল্ড'-এর মুখের গড়ন কেমন হবে? শ্রী মুখার্জির মতো। বানাক না, সে যা চায়, যেমনটা চায়, বানাক। আমরা বড় বেশি দাগ টেনে দিই। আমি বরং সেই তরুণের গল্প বলি যে ডিটিপি অপারেট করে আর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পশুচিকিৎসকদের হেল্পারের কাজ করে। সে ফরেন কুকুরের নামগুলি সংক্ষেপে বলে। সে যে একজন ভেটারেন ভেট তা বোঝাতে চেষ্টা করে। আনন্দ পাই। চোখ বড় বড় করে একদিন বলল, একটা ল্যাবের তিনটে বাচ্চা হয়েছে, একটা মরা, এইটুকু মাথা। আঙুল গোল গোল করে দেখালো। আর একদিন বলল, 'আজ দুটো কুকুরের ইউট্রাস অপারেশন হল।' আমি বললাম, ইউটেরাস? সে এক মুখ লজ্জাবন্ধ হাসি নিয়ে বলল, ওই হল দাদা, আমাদের লাইনে সব চলে।
তার আঙুল চলছে কী-বোর্ডে আর মনিটরে নানান মুদ্রায় ফুটে উঠছে অক্ষর। ওর কি এত অর্থের প্রয়োজন? নাকি ভাগ্য ওর সহায়?
আরেকজনের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এই দফতরে সবাই পেশাগতভাবে দ্বৈত পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি মরে যাচ্ছি।
দফতর থেকে বাড়ি ফিরে আব্বামার সঙ্গে কথা বলা হয় না। ভালো থাকে না মেজাজ। আয়নায় নিজেকে দেখলে যেমন করুণা জাগে, তেমনই তাদের দেখলেই যেন রাগ হয়, তারা কি একবারও বলতে পারে না যে করতে হবে না এমন চাকরি যা তোকে আরও বিমর্ষ আর বিষন্ন করে তুলছে দিন দিন? তারা বিশ্বাস করে, যুবকদের ব্যস্ত থাকা ভালো। উচিত। আমি এই বিধিবদ্ধ ঔচিত্যে আটকে থাকতে থাকতে তাদের থেকে ক্রমশ দূরবর্তী হয়ে পড়ছি, তা তারা বোঝে না। আমি ভুলে যাই কী দিয়ে কথা শুরু করব তাদের সঙ্গে। মনে করতে পারি না আমাদের পারিবারিক সংলাপের পরম্পরা কোন অবধি এসে থমকে আছে। বাড়িটা প্রতিদিন একটু একটু করে হোটেল হয়ে উঠছে। আমি হোটেলে থাকতে চাইনি কখনও। চাই না।
দফতর থেকে বাড়িতে সোজাসুজি না ফিরে চলে এলাম গঙ্গার কাছে। পাপ এতে ডোবে কি না জানি না তবে জীবন ডুবে যায়।
লাফ দিলাম গঙ্গায়। জোয়ার তখন। একটি উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে ছোটগল্প হয়ে, লাফ দেওয়ার আগে এই সব ভাবছিলাম। আমি নেই মানে আমার ভাগ্যও নেই? তার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখখানা মনে পড়ছিল। সে যদিও এখনও বিছানায় আর আমি একা একা পালিয়ে যাচ্ছি জীবনাঞ্চল থেকে। সে আমার সঙ্গে থেকেছে আজীবন কিন্তু সখ্য হয়নি। চললাম সঙ্গী, তুমিই এবার আমার সওয়ার হও। অথচ বিপরীতটা হতে পারত আর হলে তুমিও দীর্ঘায়ু হতে। যাইহোক।
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাগ্য, আমি একটি নৌকোর পাটাতনে শুয়ে আছি। বেঁচে আছি তাহলে? কীভাবে সম্ভব? কে বাঁচালো? একে কি কৃপা বলা যাবে? যদি যায়, তাহলে কার এই কৃপা?
'আমার', ভাগ্য বলল বেশ উদাসীনভাবে, 'আমার সম্পর্কে তোমার যা ধারনা আর আমি যা, আমার কাছে রোজ তুমি যা চাও আর রোজ আমি তোমাকে যা দিই, যাকগে, বাড়ি চলো, আমাদের আব্বামা অপেক্ষা করে আছে। তারা এখনও খায়নি।'

জিয়া হক 

আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে


..............................................
কী পুছহ, জিজ্ঞাসিত বুঝিতে না পারি
বর্ণ যেন শব্দে এসে
গড়ে তোলে বদহজমী
বাক্যের তরকারি
কী পুছহ, কী প্রশ্ন খুকি
দরজায় মেহগনি
তদুপরি দ্বাররক্ষী
কোন জ্ঞানে ঢুকি?
দেখনি, কী উত্তেজক জল!
হারাম হালাল করে
ডাকে ওই মূত্রদ্বারে
যেখানেই তির্পল
পাতা ছিল শয্যা হবে তাই
প্রশ্নপত্র যথাযথ
বানানও বিধিবদ্ধ
শয্যাশায়ী শিশুছাত্র নাই

জিয়া হক 

প্রতি প্রতিষ্ঠান



...................................
কী আলো তোমাদের কথায় বাসা বেঁধে আছে
কুক্কুট মাংস ইহাতেই প্রসিদ্ধ হয়ে যেতে পারে
যে শোনে, সে শ্রোতা, যেভাবে আমি ও কুকুর
তার ধর্মভাব বেশি তাই কলহ করে না
যে বক্তার অঙ্গভঙ্গি নেই, সে কতখানি বক্তা হল শেষে
যে-দেবতা আরাধ্য, তাকে নগরের পথে
আমি হারিয়ে ফেলেছি
সে-দেবতা কি আমাকে আমারই মতো খুঁজিতেছে—
ভিড়ে, আস্তাকুড়়ে?
প্রচলিত গান শুনে বুঝি বিপ্লবীরা গুপ্তভাবে সভা করে কেন
হে জনের মাধ্যম, হে ছাপার বাক্যবর্ণযতি
থাক, বৃথা এই 'হে' বলে ডাকা, পাখা ডাকি, ক্লান্ত হয়েছো
মরুভূমিকে তুমি, তুমিই সমুদ্র বলে ব্যাখ্যা করতে পারো যেহেতু
সংস্থা আর বালিও খেয়েছো অঞ্জলিভরে, পাদপদ্মে বসে

জিয়া হক 

দ্বিজাতীয়


........................
কন্যা কি চলে যায় ভিজে
উঠে আসে তোমাদের
আমাদের
মাংসের দহলিজে?
বালক কি চলে যায় একা
উঠে পড়ে পল্লি ট্রেনে
দক্ষিণের
নদীর অদেখা—
কোনো গ্রামে?
দুজনের প্রতি দেখো
দেবতার
ইবলিশের
কথামালা নামে

'মিলে যাও,
ঢুকে যাও দেহে
তুমি ঠিক ছোট নও
        আমি ঠিক বড় নই
                     শংসাপত্রী
দৈবশাস্ত্র চেয়ে'

ফলবতী নিম ছিল দূরে
ডুবে গেছে পৃষ্ঠা যার
সুমিষ্ট ভক্তি আর
ষান্মাসিক নিহত রোদ্দুরে
সান্ধ্যকালে সূর্য ধরে গান
নামকরণ ভুল নয়?
গোত্রে তারা একপ্রকার?
সুচিন্তিত মেলে ধরে
                       লোক-অভিধান

অতঃপর বৈধ পেঁচা বলে
মিলে গেলে কেমন কৌশলে

এই দেশে?





জিয়া হক
চিত্র : ভ্যান গখ

আমাদের যা নয়

......................
আমাদের বাক্য হল ছোট, আমাদের 'আমি'ই গেল ডুবে
আমাদের অন্ত্যমিলের বাজার
                  পড়ে গেল হাজার একটা কূপে
আমাদের খাদ্য মাটি মাটি, আমাদের পেটের মধ্যে ধান
আমাদের যন্ত্রে কান্না বাজে
           ফুলে ওঠে চোখের বাসস্থান
আমাদের কোমলমতি চারা, আমাদের মৃত্যুশয্যা ঘিরে
আমাদের পেলাস্টিকের গৃহে
                   খেলা করে উদ্বাহু আর স্থিরে

জিয়া হক