আরও দুটি পদ্য


যীশুর একদিন
.....................
পুরনো পুরনো সব লোক
বলে যায় অতীতের দিন
সাগরের ঢেউয়ে ছিল ব্যথা
খ্রিস্ট প্রাচীন

সাগরের ধারে ছিল গ্রাম
কৃষিকাজ মাছ ধরা পেশা
সবার পাপের ভার কাঁধে
বয়েছে হামেশা

পাপের বস্তা নয় বড়
রাস্তাও ছায়াযুক্ত পাকা
দিন যায় দিবসের শেষে
পলাতক চাকা

দিন থেকে খসে পড়ি আমি
কদলীতলার নীল বনে
সাগরীয় পাপ যত ভাসে
আমি কি করিনে?




এই দিল, মুশকিল
........................
নুয়ে পড়া লুব্ধ প্রেমকথা
ফল নাই পাতা নেই ফুটেছে অযথা
ঘোরে যত চতুষ্পদ প্রাণী
           ভাদ্র মাসে প্রেম হয় জানি

আর হয় নদী উপকূলে
বিপুল কাঁদছে বসে আরেক বিপুলে

সেই জল দেবীদের পায়ে
ফুটে ওঠে ছোটো পাত্রে
                         চালাঘরে চায়ে
খরিদ্দার আসে
বিপুলের কান্না ভালোবাসে

কোথাকার জল তারা জানে?
কোন কাব্য মেয়ে হয়ে বসেছে আখ্যানে?

পান করা হোক
বলে সব প্রস্তাবিত লোক

ভোজনের হাড়মাংসগুলি
শব্দ হয়ে বাক্য হয়ে ছড়ায় অঙ্গুলি

কে না জানে সব
প্রেম হল যৌনদেশে নম্র কলরব

জিয়া হক


দুটি পদ্য

আমাদের বাড়ি সরিষায়
..................................
আমি আমার ব্যক্তিগত ভুলে যাই
একটি কাঠ, তুমি কীভাবে থাকো অর্বাচীন?
সব ধুয়ে যায় —ধৌত হয় মহান
মহানের ধুলোবালি বেরিয়ে পড়ে
পুজো হয় পার্বনের মতো, —ধুতি পরা কিশোর দেবতা
নগর ভিক্ষুকেরা ছবি তোলে, তোলে কন্যা
সিটি বাজার সিটি বাজানোর বয়স পেরিয়ে যায়
এক শালপাত্র ভালোবাসা নেবে? কেউ বলে ঘেউঘেউ করে
ছলনার দোকান বন্ধ হয়? হয় না কখনও
কে নয় বাচিক শিল্পী, কার গায়ে কাঁটা নেই?
বাগান কি টবের দুঃখ বোঝে?
                               গান কি গায়কের পাকস্থলী জানে?
মুদ্রার ভাষাজ্ঞান পকেটের আছে? ফ্রিজ ঠান্ডা রাখে সব
সকলেই জানে আমাদের পংক্তিভোজে ভূত খেতে বসে
আমি কি ভূত হইনি, হওনি কি তুমি?
প্রকৃত ভূতেরা তবে গোপনাঙ্গ পরীক্ষা করে না,
গণহত্যা নেই : বসবাস সরিষায় নয়
         

জ্ঞানদাস একা
....................
শয্যাশায়ীদের খাট ভেঙে গেছে : ভেঙে গেছে গলা
তাই রাস্তাচলা
মাছের মতোন কোনো দ্বীপে
উঠবে কি উঠবে না —নিজেরই সিদ্ধান্ত কোনো ছিপে

কে তাহাকে প্রতারণা, কে বা তাকে খাদ্য জ্ঞান করে
মাননীয় চেয়ারের স্তরে
জ্ঞান হলে বুক খাওয়া ছাড়া
অন্যের বুকে তাকে দুই কামরা ভাড়া—
নিতে হয় নানা প্রয়োজনে
যেহেতু সে বেঁচে আছে অবহেলা করুণ মৈথুনে

শয্যাখানি পাতা আছে দূর
সেবাদাসী পাওয়া যায়, আসে না বন্ধুর
কোনো চিঠি
ইতি


জিয়া হক

ইসলামপুর

  
বন্দুকটা নামাও, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই : শাহবাজ বলল।


বন্দুক নামাতে পারব না, বন্দুক ছাড়া আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই : সিদ্দিকী প্রত্যাখ্যান করল।

এই কথা বলেই সে গুলি চালিয়ে দিল। গুলিটা গিয়ে লাগলো শাহবাজের বুকের বাম দিকে। তার বুক পকেটে একটা একশ টাকার নোট ছিল। নোটটা রক্তে ভিজে গেল। ওখানেই মারা গেল শাহবাজ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল সিদ্দিকীর। জেলে সে খুব নম্র আচরণ করত সহবন্দিদের সঙ্গে। সবাই জানত, সিদ্দিকী খুনের আসামী। এখানে অধিকাংশই খুনের আসামী।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে গেল সিদ্দিকী। সে জেলে বসেই ভেবে নিয়েছিল প্রথমে কোথায় তাকে যেতে হবে। জেলে সময়ের অভাব নেই।
জেল থেকে বেরিয়ে সে শাহবাজের বাড়ি এলো। শাহবাজের দুটো ছোট মেয়ে আর বৌ। বিয়ের প্রস্তাব দিল শাহবাজের বৌকে। মেয়েটা রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করে অন্য একটা শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করল। ছোট দুই মেয়ে তাদের সঙ্গেই আছে।
একটা কাঠ চেরাইয়ের কারখানায় যোগ দিল সিদ্দিকী। উপার্জন বেশি নয়, তবে তা দিয়ে তাদের চলে যেত। ছোট মেয়েদুটোকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তারা বিনুনি করে স্কুলে যায়। নতুন বাবাকে তারা মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। তবে এই লোকটাই যে তাদের বাবার খুনী তা তারা জানত না। তাদের মা কখনও বলেনি।
শাহবাজের একটি ছোট ভাই ছিল। মেধাবী ছাত্র, কিন্তু দাদা খুন হয়ে যাবার পর তার পড়াশুনা আর হল না। সে সব সময় খুঁজে বেড়ায় তার দাদার খুনীকে। একটা মস্তানবাহিনীর সে এখন সক্রিয় সদস্য।
সিদ্দিকীকে একদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। রাতে বাড়ি এলো না। তার বদলে বাড়ি এলো শাহবাজের ছোট ভাই। ভাবীকে বলল, জিনিসপত্র গোছাও, আমরা দেশে ফিরে যাব।
শাহবাজ-সিদ্দিকীর বৌ দেবরের কথা মতো সব বাঁধাছাদা করে রাতের অন্ধকারে দুই মেয়ের হাত ধরে দেবরের সঙ্গে পথে নামলো। মেয়েদুটো শুধু জিগেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তাদের মা বলল, জানি না।
শাহবাজের ছোট ভাইয়ের নাম শাহনওয়াজ। শাহনওয়াজ ভাবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। দেবরের প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে গেল। তারা বিয়ে করল। শাহনওয়াজের মা বৌকে তেমন সহ্য করতে পারে না। ঝগড়া লেগেই থাকে। ছোট মেয়েদুটোকে আবার স্কুলে ভর্তি করা হল। তারা বিনুনি নিজেরা বাঁধতে শিখে গেছে।
শাহবাজ - সিদ্দিকী - শাহনওয়াজের বৌ জরির কাজ করতে শুরু করে একটা কারখানায়। একজনের সঙ্গে আলাপ হল তার কারখানায়। শাহনওয়াজের আয় নেই বললেই চলে। সে কিছু করে না। বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে। সে একটা সন্তান নিতে চেয়েছিল, তার বৌ রাজি হয়নি। রোজ ঝগড়া হয় তাদের। মেয়েদুটো দুলে দুলে ছড়া মুখস্থ করে। এতে শাহনওয়াজ আরো রেগে যায়।
জরির কাজ করে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করে ফেলে বৌটা। আরও কয়েক বছর কাজ করে এক নাগাড়ে। তারপর এক রাতে শাহনওয়াজকে খুন করে দুই মেয়েকে নিয়ে সেই বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেল দূরের এক শহরে। এখানে কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। তবে ইতিমধ্যে, শাহনওয়াজকে একটা বাচ্চা উপহার দিতে হয়েছে তাকে। তার এখন দুই মেয়ে এক ছেলে।
ছেলের নাম রেখেছে শাহরিয়ার।
অনেক অনেক বছর পরের কথা। শাহরিয়ার আঠারো বছরের যুবক। ভীষণ রাগি আর জেদি। খুনী রক্ত বইছে তার শিরায়। কীভাবে সে জানতে পেরে যায় যে, তার বাবাকে খুন করেছে তার মা। আর তার যে দুই দিদি তারা তার বড় কাকার মেয়ে। সে নিজের মাকে খুন করে। দুই দিদিকে এক দালালের হাতে তুলে দেয়। কোনো টাকা নেয় না।
পুলিশ অফিসার (থানার মেজবাবু) শোনাচ্ছিলেন এই সব কাহিনি। এই অব্দি বলার পর সিগারেট ধরালেন। দৃষ্টি উদাস।
আমি বলি, একটা পরিবারই তো পুরো শেষ হয়ে গেল! কী লাভ হল!
তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনার দাদা যদি খুন হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?
আমি চুপ করে রইলুম। একটা গান্ধীবাদী উত্তর দেব কিনা ভাবছি, তখন আমার মনে হল আমি কিন্তু সত্য গোপন করছি, যা করতে চাই তা না বলা মানে শুধু ফেক করা না, আমি কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেই পারলাম না, যা করার অর্থাৎ প্রতিশোধ নেবই, শুধু আপাতত ভালো মানুষ সেজে মিথ্যে কথা বলব, এই তো!
মেজবাবুকে বললাম, পরে একদিন এর উত্তর দেব আপনাকে, আজ যাই।
তার মানে আপনিও সহজ সরল কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, তাই তো? তিনি ঘড়ঘড় করে হাসলেন।
আমি উত্তর না দিয়ে শুধু জিগেস করলাম, সেই বন্ধুটার কী হল?
মেজবাবু বললেন, চা খান একটু, বলছি।
তিনি আমাকে বসিয়ে রাখলেন। এটা তার মজা। পুলিশদের কাছে কত রকম গল্প থাকে। যে গল্পগুলো শুনলে আমাদের রক্ত শুকিয়ে যায়, সেই গল্পগুলোও তাদের কাছে মজাই। এ তাদের ডেইলি জব। এখান থেকে তাদের উপরি আয়। সেদিক থেকেও তা মজার।
একজন ঢ্যাঙা কালো মতো লোক ঘরে ঢুকলেন চা নিয়ে। পরনে লুঙ্গি, চেক শার্ট, চুল পাকানো। বাম হাতটাতে একটু অসুবিধা আছে বলে মনে হল।
মেজবাবু বললেন, শাহজাদা, বসো ।
সে লোকটা মেঝেতেই বসে পড়ল। দেখে বোঝা যায় এভাবেই বসতে সে অভ্যস্ত। লুঙ্গিটা জড়িয়েমড়িয়ে দুই পায়ের মাঝখানে গুঁজে নিল ডান হাত দিয়েই। তার বাম হাত বিশেষ কাজ করে না।
আমি ইশারায় মেজবাবুকে বলতে চাইলাম, ইনি কে?
তিনিও ইশারায় বলতে চাইলেন, বসোই না।
বলো শাহজাদা, তোমার গল্প বলো : মেজবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন।
একজন কনস্টেবল দরজার বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করছে দেখে মেজাজ চড়িয়ে মেজবাবু বললেন, এখন লকাপে পুরে রাখো, রাতে কথা বলব।
মিনমিন করে কনস্টেবল বললেন, স্যার, মেয়ে কেস।
মেয়ে কেস! ভাবনায় পড়লেন মেজবাবু : রেপ-টেপ নাকি?
না স্যার, বৌকে পিটিয়েছে : কনস্টেবল বললেন।
ধুর শালা, আটকে রাখ —আটকে রাখ, পারলে দুটো রুল বাড়ির গুঁতো দিয়ে রাখ। শালা, প্রেম করবে, বিয়ে করবে, ছানাপোনা নেবে মৌজ করে, তখন কে আটকায়, তারপর বৌ পেটাবে, মেরে আগে মুতিয়ে দে, তারপর দেখছি। মেজবাবু থামলেন।
তাঁর উগ্র মুখ মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত : তো, শাহজাদা, বল তোর গল্প বল।
মেজবাবুর মেজাজ তিরিক্ষি দেখে জড়সড় হয়ে বসল শাহজাদা। তার চোখ বড় বড়। খুব রোগা শরীরে এত বড় চোখ মানায় না। সে বলতে শুরু করল :
সে পরের বৌ, আমি জানতাম। একই পাড়ায় থাকি। সবাই সব জানে, এ তো আর শহর নয়। আমার সঙ্গে জরির কারখানায় কাজ করতে আসত। ওর নাম ছিল মরিয়ম। মরিয়মের দুই মেয়ে, এক ছেলে। কাজ করত ঠিকই, কিন্তু সব সময় মন মরা থাকত। আমি একদিন যেচে আলাপ করি। ও একটাই ছাপা শাড়ি পরে রোজ আসত। পরা বলে না তাকে, জড়ানো বলে।
আমি একদিন একটা শাড়ি কিনে তাকে উপহার দিতে গেলে সে নিতে চায় না। বলে, বাড়িতে স্বামী - শাশুড়ি আছে। আমি বুঝতে পারি, শাড়িটা সে নিতে চায় কিন্তু ভয় পাচ্ছে। সে আমাকে জিগেস করে, কেন তাকে শাড়িটা দিতে চাই।
ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এটা না কোনো দয়া আর না কোনো ভালোবাসা —এটা উপহার, —শুধু উপহার।
ইতিমধ্যে কনস্টেবলটা আবার দরজার ফাঁকে মুখ বাড়ায় : স্যার, গৌতমবাবু এসেছেন।
সে কি গৌতমবাবু! কখন এলেন! চা দিয়েছিস? আসছি আসছি : বলে প্রায় দৌড় লাগালেন মেজবাবু। বললেন, একটু বসুন, আসছি।
ঘরের মধ্যে বসে আছি আমি আর শাহজাদা। সে-ই বলল, নিশ্চয়ই বখরা দিতে এসেছে।
আমি জিগেস করলাম, কে এই গৌতমবাবু? বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে।
কেউকেটা! হ্যাঁ, কেউকেটাই! শালা তোলাবাজ, সে আবার বাবু, ওফ্! খাতির দেখলে পোঁয়া চুলকোয়। কে যে পুলিশ বাল বোঝাও যায় না মাঝে মাঝে।
আমি চুপ করে যাই। কে এই শাহজাদা, কী তার গল্প, আমাকেই বা শোনানো হচ্ছে কেন তা না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। চুপ করে গালে হাত দিয়ে সিলিং ফ্যানের গড়িমসি করে ঘোরা দেখি। শাহজাদা বগল চুলকোচ্ছে।
প্রায় দশ মিনিট পরে ফিরে এসে নিজের টেবিলের সামনে এসে বসলেন মেজবাবু। তার মুখ খুশি খুশি। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। বেশ লম্বা সিগারেট। দামী।
খোশমেজাজে বললেন, তো শাহজাদা, আবার শুরু করো তোমার গপ্পো।
মেজাজ ভালো থাকলে তুই হয়ে যায় তুমি। এই যেমন এখন হল আর কি। মেজবাবুই একদিন বলছিলেন, মেজাজ ভালো থাকলে লকাপে ডিমভাজিও দেওয়া হয়। প্রশাসন মেজাজে চলে।
গপ্পো শুরু করার আগে বলে নিই, আপনার উত্তরটা কিন্তু এখনও পাইনি : আমার দিকে লক্ষ করে বললেন : তাড়াহুড়ো নেই, তবে ভেবে চিন্তে দিলে কিন্তু হবে না, আমি তাৎক্ষণিক ইন্সটিঙ্ক্টটা জানতে চাই, যাইহোক, বলো শাহজাদা।
আরও কয়েক মাস পরে বৌটা বলল, আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে? আমার দুটো মেয়ে আর একটা ছেলেও আছে, পারবে? শাহজাদা বলতে শুরু করল : আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলাম এই প্রস্তাবে। কোথায় নিয়ে যাব তাকে, তার পরিবার আছে, তারা ভীষণ খুনে প্রকৃতির, আমাকে মেরেই ফেলবে। এ কীভাবে সম্ভব!
তারপরও বললাম, যাবো, কোথায় যেতে চাও বলো?
তাকে দেখলে যে কারও মায়া হবে স্যার। এরকম জীবন সে পেল কেন, আমি তাই নিয়ে ভাবতাম। আল্লাহ কি চান আমি তার জন্যে একটু সুখের বন্দোবস্ত করি? কিন্তু আমার সামর্থ্য কতটুকু!  ক্ষমতাই বা কী!  জানতাম, তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানে আমার মৃত্যু। ওর বর ঠিক খুঁজে বের করে আমাকে খুন করবে কারণ এর আগেও সে খুন করেছে। কিন্তু লাশ খুঁজে মেলেনি বলে তার শাস্তি হয়নি।
বৌটাকে আবারও জিগেস করলাম, কোথায় যেতে চাও বলো? কোনো অচেনা শহরে?
সে বলল, ইসলামপুর।
ইসলামপুর! ইসলামপুর কেন? আগে কি ওখানে গিয়েছিলে? আমি জানতে চাই।
সে শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে বলে, না।
তাহলে অন্য কোনো শহরে চলো যাই : তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শেষে বলি, আচ্ছা ঠিক আছে, ইসলামপুরেই চলো।
ইসলামপুরে এসে দেখি ছোট মেয়েদুটো তাদের খেলার সঙ্গী পেয়ে গেছে। কত দিন পর যেন তাদের সঙ্গে দেখা। মরিয়মকেও অনেকে চিনতে পারছে। আমি একটু অবাকই হলাম। ও কি আগে এখানে এসেছে! এত জানপেহচান হল কেমন করে! আমি কাজ খুঁজতে শুরু করলাম। তবে সন্দেহটা গেল না।
একদিন মেয়েদুটোকে জিগেস করে সব জানতে পারি। এই শহরে তারা আগে কয়েক মাস ছিল। ঘটনাচক্রে, যে পাড়ায় আমরা উঠেছি সেই পাড়ায়। তারপর যা শুনলাম তাতে আমার ভয় গলায় উঠে এলো।
মেজবাবু শাহজাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাকি গপ্পো পরে, আগে চা নিয়ে আয়, আর পারা যাচ্ছে না। এক গল্প এতবার বলবার পরও এত এনার্জি কোত্থেকে পাস বল তো? যা ভালো করে দু কাপ চা নিয়ে আয়।
শাহজাদা মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল চা আনতে। মেজবাবু আমার দিকে তাকালেন। জানি, তিনি সেই প্রশ্নটি করবেন —করলেনও। আমি হলে কী করতাম —প্রতিশোধ, না ক্ষমা?
আমি এবার বললাম, এখনই যদি জানতে চান আর এখনই যদি আমাকে উত্তর দিতে হয় তাহলে বলব ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না, আমি প্রতিশোধ নিতাম।
মেজবাবু শুধু মুচকি হাসলেন। তিনি কি এই উত্তরটাই চাইছিলেন? আমি যে কপটতা করিনি তাতে কি তিনি খুশি হয়েছেন? নাকি আমাকেই অপরাধী ভাবতে শুরু করেছেন —কে জানে!
চা নিয়ে ঢুকতেই শাহজাদাকে মেজবাবু বললেন, মেঝেতে নয়, তুই এই ভদ্রলোকের পাশের চেয়ারটাতে বস, তারপর বল বাকি ঘটনা।
শাহজাদা ইতস্তত করছে দেখে ধমক দিলেন মেজবাবু। সে উপায়ান্তর না দেখে আমার পাশের চেয়ারে আড়ষ্ঠ হয়ে বসে শুরু করল তার গল্প :
মেয়েদুটোর কাছে জানতে পারি আগে যে লোকটার সঙ্গে এই পাড়ায় তারা এসেছিল তার নাম সিদ্দিকী। সিদ্দিকী ভালোবাসতো তাদের। তাদের মাকেও সে ভালোবাসতো। তাদের স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিন সব গোলমাল হয়ে যায়। তাদের নতুন বাবা আর ফিরে আসে না। তার বদলে বাড়িতে হাজির হয় তাদের কাকা। তার নাম শাহনওয়াজ। এবং তাদেরকে জোর করে দেশের বাড়িতে নিয়ে চলে যায়।
রাতে কাজ থেকে ভয় ভয় করে বাড়িতে ফিরি। মরিয়ম তা যেন দেখে না।
মরিয়মকে একদিন বললাম : আমি সব জেনে গেছি।
সে নির্বিকার ভাবে বলল : কী জেনে গেছো? জানার আছেটা কী যা তুমি জানো না।
আমি সবটা জেনে গেছি। সবটা আমার খুব ভয় করছে : বলি।
মরিয়ম যেমন কষ্ট সহ্য করতে পারে, তেমনই কষ্ট দিতেও পারে। সে আমার কথায় পাত্তা দেয় না। আমাকে টেনে বিছানার মধ্যে নিয়ে যায়। সব কথা এখানে শেষ।
অনেক বছর আমরা ওই শহরে কাটালাম। আমাদের ছেলে শাহরিয়ার বড় হয়ে উঠল। সব বেশ থিতিয়ে এসেছে। শাহরিয়ার খুব মেধাবী, বাধ্য। স্কলারশিপ পেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করল। আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলাম।
হঠাৎ একদিন রাতে শাহরিয়ার বাড়ি ফিরে মাকে মারতে আরম্ভ করল। আমি বাধা দেওয়ায় আমার বাম হাতে পড়ল শক্ত লাঠি। সেই থেকে আমার বাম হাত নষ্ট হয়ে গেল। মরিয়মকে পিটিয়ে মেরেই ফেলল ছেলেটা। আমি পালিয়ে গেলাম সেই রাতেই। পরে শুনলাম, বোন দুটোকে দালালের হাতে তুলে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ থেমে শাহজাদা বলল, মরিয়মকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি বলে উঠলাম : ও, আপনিই তাহলে জরির কারখানার সেই লোক?
এবার মেজবাবু বললেন, বাকিটা আমি বলি। শাহজাদা এর পর মস্তান দলে যোগ দেয়। ওর কাছে সব সময় তখন পিস্তল থাকত। আমিই ওকে সেই নোংরা ডেরা থেকে তুলে এনে থানার মধ্যে একটা চা দোকান করে দিই। তারপর থেকে ও এখানেই আছে। কিন্তু ওর দোকান খুঁজলে এখনও একটা আধটা পিস্তল আপনি পাবেন। কী শাহজাদা, ঠিক বলছি কিনা?
শাহজাদা চোখ নীচু করে টেবিলের উপর ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের ছায়া দেখে।
এইবার আসল কথা বলি, বলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলেন মেজবাবু : আপনি কি জানেন শাহরিয়ার এখন কোথায়? আপনার জানার কথাও নয়। শাহরিয়ার এখন এই শহরেই থাকে। এবার আমি শাহজাদাকে একটা প্রশ্ন করব। আচ্ছা, শাহজাদা, তুমি কি শাহরিয়ারকে ক্ষমা করে দিয়েছো, না প্রতিশোধ নিতে চাও?
শাহজাদা বেশ দৃঢ় ভাবে বলল : আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
মেজবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যেন অনেক জটিল কোনো বিষয়ের মীমাংসা করে দিয়েছেন এবং আমাদের মনস্তত্ত্বের অমীমাংসিত কোনো বিষয়কে উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন সাবলীল ভাবে।

আমি বললাম : শাহজাদা, তুমি যদি বন্দুকটা ফেলে দাও, তাহলে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি।

সে বেশ কেঠো গলায় বলল : বন্দুক ছাড়া আমার আর বিশ্বস্ত বন্ধু নেই, কেউ হবেও না, আমাকে ক্ষমা করবেন।

শাহজাদা এবার চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল : স্যার, যাই তাহলে?

বেশ তৃপ্তি নিয়ে মেজবাবু বললেন : এসো।
দরজা অব্দি গিয়ে ফের ফিরে এলো শাহজাদা নামের লোকটা। তারপর ইতস্তত করে বলল : একটা প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাচ্ছি না স্যার, জিজ্ঞেস করব?
মেজবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন : কী প্রশ্ন?
—মরিয়ম সব জেনেশুনে কেন আমাকে ইসলামপুরেই নিয়ে গিয়ে উঠল?
এই প্রশ্ন শুনে দারোগা সাহেব একেবারে থমথমে হয়ে গেলেন। মনোবিদ্যার সব অধ্যায়গুলো আবার যেন তিনি শুরু থেকে পড়তে শুরু করেছেন।


জিয়া হক

ইবলিশ


...........
আমি কামিয়াবি বলতে মনে করি জান্নাত। রোজ যে আমি গুনাহ থেকে পানাহ চাই, সে কি এই জন্য নয় যে আমার কাছে কামিয়াব সে যে জান্নাতি। আমি সংসার করব না বলছি না একবারও, কিন্তু সংসারের দাসত্ব আমি করতে পারব না।

মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনার যেখানে পায়রাদের বাসা সেই বাসায় জমানো দানা মুখে নিয়ে এক ঝাঁক পায়রা উড়ল পশ্চিম আকাশে। এবার মগরিবের আজান হবে। মসজিদে আসার এই ডাক আগে মাইকে হত না। তখন তো মাইক ছিল না। যখন গাড়ি তৈরি হয়নি মানুষ পশুর পিঠে চেপেছে, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে মাইলের পর মাইল। মুয়াজ্জেন গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই।

ওজুখানা বলতে একটা মোটা পুরু দেয়াল। তার একদিকে মেয়েরা ওজু করে, অন্যদিকে ছেলেরা ওজু করে। দেয়ালটা এত উঁচু যে কেউ কারো মুখ দেখতে পাবে না। তবে জল পড়ার শব্দ, কাচের চুড়ির শব্দ শোনা যায়। মেয়েরাও নিশ্চয়ই ছেলেদের ওজুর শব্দ শোনে। ওজুর জল যেভাবে পাথরের উপর পড়ে তাতে একটা সঙ্গীত আছে। এই সঙ্গীত ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মগরিবের আজান শেষ হয়। আজান শেষ হলে তার জবাবে একটা দোয়া পাঠ করতে হয়। ঢাকা শহরের যে আজান রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় সেখানে আজানের পরে পরে মুয়াজ্জেন দোয়াটাও মাইকেই পড়ে দেন। মিশরের ক্বারী বাসিতের আজান যেন একটানা কান্না, যেন সামনে বড় বিপদ, যেন আজই এই মুহূর্তটুকুই আমাদের কাছে অবশিষ্ট আছে তারপর পৃথিবী ফানাহ। নামাজ একটা অনুষ্ঠান আর তার আহ্বায়ক হল যে আজান দেয়।

এই শহরের মহিলারা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে। তাদের জন্য আলাদা ঘর, ঠিক পাশের ঘরটা পুরুষদের। মেয়েদের ওদিক থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মসজিদটা আর সব মসজিদের মতোই খুব নিস্তব্ধ। শুধু নামাজের ওয়াক্তে একটা সংযত পরিশীলিত মেলার সুর ওঠে। ইমামের ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বাজে। জানালাগুলো নীল। গাঢ় নীল।

সবুজ আলখাল্লা পরা মেয়েটা ফটকের ওধারে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে মুখ পরিষ্কার দেখা যায় না। সবাই নামাজ পড়ে চলে গেছে। জোহরের নামাজের পর খাবার তাকাযা থাকে। মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা আগে নামাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায়। কাজ থাকে। তারা নামাজে ফাঁকি দেয় তা কিন্তু নয়, তারা আসলে মসজিদকে কলতলা মনে করে না। ছেলেরা মসজিদে নামাজের আগে পরে যেটুকু সময় থাকে আড্ডা দিয়ে নেয়।

আমি তসবিহ গুনছিলাম। আঙুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের দানা। এই তসবিহটা খোদ সৌদি আরবের। একজন উপহার দিয়েছিলেন। আর দিয়েছিলেন এক শিশি আরবি আতর। সেটা কথা নয়, আমার মনে হচ্ছিল গোটা মসজিদগৃহে আমি আর মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই।

পর পর কয়েকদিন দেখলাম জোহরের নামাজের পরে মেয়েটা ফটকের লোহার শলাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না তা আমি জেনে গেছি। এই কয়দিনে আমি কাউকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার সঙ্গে যেতে দেখিনি। সে পুরুষদের মসজিদ কক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মাথা নীচু করে চলে যায়। আমি সেদিকে মাঝে মাঝে তাকাই আর তসবিহ গুণে যাই। যখন সুবহানআল্লাহ বলি তখন আল্লাহর উদ্দেশে বলি নাকি মেয়েটার সূদুর অস্তিত্বের সৌন্দর্যের জন্য বলি তা মনে থাকে না। মেয়েটা রোজ সবুজ আলখাল্লা পরে আসে।

আমি বললাম, আসসালাম আলাইকুম। একজন পুরুষ একজন অপরিচিত মহিলাকে সালাম দিতে পারে, হাত ধরতে পারে না।
সে চুপ করে রইলো। এতে সংকোচ কিসের! সালাম মানে কিন্তু আলাপ করার প্রস্তাবও নয় সব সময়। পিপীলিকার মতো এক ধরনের মৌখিক কানেক্টিভিটি শুধু। এতে আলাদা করে কোনো আবেগ বা ব্যক্তিগত অনুভূতি মেশানো নেই।
আরেকবার সালাম দেওয়ার পর মেয়েটা সলজ্জ ভাবে বলল, ওয়া আলাইকুম সালাম।
এতে লজ্জা পাবার কী আছে!
মেয়েটার বয়স বেশি নয় —একুশ বাইশ হবে। সুন্দর চেহারা। মুখে নাকাব নেই বলে পুরো মুখটাই দেখা যায়। চোখ রাঙানো। কালো কাজল সেই চোখে। ওজুর জলেও যা ধুয়ে যায় না।
তোমাকে এখানে রোজ জোহরের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আমি বলি।
হ্যাঁ, আমি রোজ জোহরের পর এখানে এই একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, সে বলে।

দূর থেকে মসজিদকে দেখতে খুব ভালো লাগে, তাই না?

সত্যি, মসজিদের ভেতর আর বাইরেটা কত আলাদা।

তার প্রাথমিক জড়তাটুকু কেটে গেছে। সালাম অনেক সময় অনেক কাজ সহজ করে দেয়।

আমি আবার বলি, তুমি কি শুধু, মানে শুধুই মসজিদকে দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকো?

সে বলল, অপেক্ষা করি।

কার অপেক্ষা?

ফেরেশতা আসে এই সময়ে। অধিকাংশ লোকেরই ধৈর্য্য নেই।

ঠিক, আমাদের ধৈর্য খুব কম।

আমি দেখেছি, যেখানেই যাই, খালি চলে যেতে পারলে, ফিরে আসতে পারলে যেন বাঁচি।

আমরা আমাদের বাড়িকে বেশি ভালোবাসি কিনা।

তাহলে মৃত্যুর পর কী হবে?

মেয়েটার লাবণ্য আছে তবে সেই লাবণ্য বড় বিষন্ন। আর এই মৃত্যুর কথা বলায় তার মুখের সাদা চামড়ার ওপরে যেন একটা মৃত পর্দার নাকাব চাপিয়ে দিল। যতটুকু পরিচয় হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি না, আজই, এখনই প্রথম দেখছি।

মেয়েটা চলে গেল মাথা নীচু করে। তার সবুজ আলখাল্লা বাতাসে পায়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে পাল তোলা নৌকার মতো তাকে গতিবেগ দিল যেন।

ছয় দিন পর ইমাম সাহেব বললেন, আপনি নাকি মসজিদের ভেতরে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন?

এই ছয় দিন রোজ দুপুরে জোহরের নামাজের পর মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেছি। মেয়েটা ফটকের ওধারে, আমি এ ধারে। একদিন তার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তার আঙুলগুলো করমর্দনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে যেন। সংযত করেছি নিজেকে। কেরামান - কাতিবিন আমার দুই কাঁধে বসে নেকি-বদীর তালিকা তৈরি করছে তো।

যদি মসজিদে এসে নিজের নফস, খাহেশাতকে সংযত করতে না পারেন তো কী হবে বলুন তো? ইমাম।

একটা সত্যি কথা বলব ইমাম সাহেব? নফস চাইছে ওর সঙ্গে শুয়ে পড়তে, কিন্তু,— কিন্তু দেখুন আমাকে কি ওর সঙ্গে শুতে দেখেছেন? সংযম আছে বলেই তো শুধু কথাটুকু বলি।

সেটাও না করাই উত্তম, বলে ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি জোহরের নামাজ শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলুম। এই ইমামকে আমার তেমন সহ্য হয় না। যদিও ইমামদের ভুল-ত্রুটি ধরা আমার মতো সাধারণ মানুষদের কাজ নয়। আলেম, উলেমারা আকাশের নক্ষত্র না হোক, উপগ্রহ তো বটে। এখন অমাবস্যা চলছে।

সুন্দর রোদ ঢেকে দিয়েছে মসজিদের মিনারগুলো। একটা দুটো পায়রা উড়ছে মিনারের ধারে ধারে। পুরনো গান ভেসে আসছে পাশের কোনো মহল্লা থেকে। সেই গান ছুঁয়ে যাচ্ছে মসজিদের সামনের ছোট একটুখানি জায়গায় চাষ করা ফুলের বাগানকে। পাতা, ফুল, কান্ড সব হালকা হাওয়া আর গানের ধাক্কায় দুলছে মৃদুমন্দ ভাবে।

মেয়েটাকে জিগেস করলাম : পেলে তোমার হারিয়ে যাওয়া ফেরেশতাকে?

সে ইতস্তত করে জবাব দিল : হারানো ফেরেশতা? কিন্তু আমার ফেরেশতা তো হারিয়ে যায়নি, আমি তাকে খুঁজছি মানে সে হারিয়ে গেছে তা নয়, হয়ত আমিই হারিয়ে গেছি আর সে প্রতিটা মসজিদের ফটকের সামনে জোহরের নামাজের পর আমার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে।

হ্যাঁ, কে যে হারিয়ে গেছে তা বলা মুশকিল, তবে কেউ একজন সন্ধান করছে মানে কেউ একজন হারিয়ে গেছে, হয়ত লুকিয়ে আছে : আমি বলি।

লুকিয়ে আছে? হবে হয়ত : ঈষৎ সন্দিগ্ধ ভাবে সে মাথা নেড়ে বলল। কাঁধ ঝাঁকালো।

আমি জিগেস করি : তুমি ফেরেশতাকে পেতে চাও, তাই তো, এতে কোনো ভুল নেই, আচ্ছা, ফেরেশতাকে পেলে তুমি কী করবে?

আমি শুধু তাকে পেতে চাই, পেলে কী করব এখনও ভেবে দেখিনি, হয়ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, হয়ত বলতে পারি আমাকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে চলো : খুব উদাসীন মুখ করে মেয়েটা বলল।

বেশ কয়েকদিন কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা কেন বারবার মৃত্যুর কথা বলে, সে কেন এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায়। তার আসলে পৃথিবীতে কেউ নেই আব্বা ছাড়া। তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না। তার ওজুর জলও মেয়েটাকে তুলে এনে দিতে হয়। মেয়েটা তাই একদিন বলেছিল, সে তার আব্বার জন্যে নতুন এক জোড়া চোখ উপহার চাইবে ফেরেশতার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে। আমি বলি, যখন চাইবে তখন বড় কিছু — স্থায়ী কিছু চাইবে না কেন? জান্নাত চাওয়া কি আরো ভালো নয়? সে বলে, তুমি আমার আব্বার কষ্ট দেখলে নিজের জন্যে জান্নাত চেয়ে পালিয়ে যেতে পারতে না।
পালিয়ে যাওয়া! এটা কি সত্যিই কাউকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া!
মেয়েটা আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তাতে আমার বেশ ভাল লাগে। মেয়েরা তুমি বললেই আমার মনে হয় আমরা যেন একটা ভালোবাসার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটার নাম জানি না। জিগেস করিনি। সেও আমার নাম জানতে চায়নি। নাম জিগেস করা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশাধিকার চাওয়ার মতো ব্যাপার। সন্ধ্যা বেলা আমাদের কখনও দেখা হয়নি।

আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? আমি বলি।

প্রশ্ন? যখন কেউ প্রশ্ন করার আগে অনুমতি চায় তখন বুঝতে হবে প্রশ্নটা বিশেষ। তো কি সেই বিশেষ প্রশ্ন? নিজে নিজে ব্যাখ্যা করে মেয়েটা।

হ্যাঁ, বিশেষ মনে করলেই বিশেষ। এটা পুরোপুরি মনে করার ব্যাপার। আসলে আমি তোমার নাম জানতে চাই : আমি বলি।

নাম? আমার নাম — মনে করো সবুজ পোশাক পরা মেয়েটা, এটাই আমার নাম, বা ধরো ফটকের ওধারের কন্যা, হ্যাঁ, এটাও একটা ভালো নাম হতে পারে আমার : সে এইভাবে বলল।

আমি খুব লজ্জা পেলাম। আমার হয়ত নাম জানতে চাওয়া উচিত হয়নি। কেউ আড়াল চাইতেই পারে। আমি কি এই কয়দিনে তাকে বড় আপন ভাবতে শুরু করেছি বলে সে ভাবল? আমার লজ্জা লাগল, ধরা পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক। মসজিদের ফুলগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে আনন্দ প্রকাশ করছে। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। ছায়া পড়েছে, রোদ নেই। আজ মঙ্গলবার।

দু দিন জোহরের নামাজে মসজিদে যাইনি।
 শুক্রবার জুম্মার দিন। লোকের ভিড় অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। যারা কখনও নামাজে আসে না তারাও এই দিন আসে। পাপের ভয়? মাফের আশা? জানি না, তবে আসে। মসজিদ গমগম করে ওঠে। ধোয়া মোছা হয় মসজিদের ঘরগুলো। কাচা হয় কার্পেট, গালিচা, চাদর। পবিত্রতার গায়ে জল পড়লে আরও ঐশ্বরিক বলে মনে হয়। আমার নামাজে মন তেমন নেই। তসবিহ হাতে নেই, পাঞ্জাবির পকেটে রুমালের পাশে পড়ে আছে। আরবি আতর গায়ে। নামাজের অনুষ্ঠান কখন শেষ হয় তার অপেক্ষা করছিলুম।

গত দিন ইমাম সাহেব দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। ছ ফুট প্রায় লম্বা, সাদা জোব্বা পরা, পায়ে চামড়ার জুতো, হাতে তসবিহ, সব সময় জিকির করেন।
তিনি বললেন : মসজিদ একটা পবিত্র জায়গা।

মসজিদ নিঃসন্দেহে একটা পবিত্র জায়গা —স্থান বলা ভালো। হাদীসেই তো আছে, মসজিদ হল জান্নাতের টুকরো : বিনীত ভাবে আমি বলি।

সেই জান্নাতের টুকরোতে এমন কাজ আমাদের করা উচিত নয় যেটা অপবিত্র, নাজায়েজ।

হ্যাঁ, নাজায়েজ কাজ মসজিদ বাইরে অন্য জায়গায় করাই ভালো।

না, আমি তা বলিনি। নাজায়েজ কাজ কোথাও করাই ভালো নয়। আপনি আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আমি একটা মসজিদের ইমাম।

আপনি একটা মসজিদ শুধু নয়, বিশাল বড় মসজিদের শাহী ইমাম —আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সরকার আপনাকে মাসোহারা দেয় —এ যা-তা কথা নয়। আপনাকে আবারও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

তাঁর মুখমণ্ডল ভারি কঠিন হয়ে গেল।

আপনি হাদীস জানেন, একটু আগেই হাদীস বলছিলেন, না? তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়াকে সমর্থন করতেন না। ভেবে দেখেছেন যদি খারাপ কিছু একটা ঘটে যায়, পুরো সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তিনি মৃদু স্বরে বলে গেলেন।

হ্যাঁ, ওসমান গণি ইশার নামাজের পর রাতের অন্ধকারে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ভয় দেখিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর স্ত্রী আর মসজিদে যেতেন না, ভয় পেতেন : আমি বলি : মসজিদের সামনে ফুল চাষ করেন কেন?

তিনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যাওয়ার লোক নন। শুধু বললেন, ফুলগাছ আপনার জন্যে নাজায়েজ নয় আর আমি ধর্মের ভাষায় কথা বলি, সেটা আমার কাছে একটা সামাজিক সংবিধান। সে যদি মসজিদে যেতে কাউকে নিষেধ করার বিধান দিত তাহলে আমি বলতাম —আর মসজিদে যাবেন না।

হ্যাঁ, সংবিধান মানা খুব জরুরি। দেশের সংবিধানে যেমন ফাঁসি রয়েছে তেমন ধর্মের সংবিধানে আছে জাহান্নাম। খুব সিমিলার : বলি : আচ্ছা, পৃথিবীতে যার পৃথিবীর নিয়মে অপরাধের জন্যে ফাঁসি হয়েছে তার কি ধর্মের নিয়মেও জাহান্নমই হবে?

তিনি বিরক্ত হয়ে চলে যান।

জুম্মার নামাজের পর সবাই চলে গেছে। মসজিদ ফাঁকা। বাতাসের শব্দ শোনা যায়। কয়েকটা টকটকে লাল গোলাপ হাওয়ায় তির তির করে নৌকোর মতো কাঁপছে। দেখলাম, ফটকের ধারে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ মেরুন লাল একটা আলখাল্লা পরেছে। হাত দুটো পেছনে জড়ো করা।

মসজিদের ফুলবাগান থেকে কয়েকটা লাল গোলাপ তুলে হাতে করে পেছনে লুকিয়ে ফেললাম, তারপর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখে আজ বিষন্নতা নেই, বেশ হাসিহাসি। তাকে মেরুন লাল পোশাকে একটা হুরের মতো লাগছে। হুর জান্নাতে না গেলে দেখা যায় না।

সে জিগেস করল : দু দিন কোথায় ছিলে?

তুমি কি ফেরেশতার দেখা পেয়েছো? আমি জানতে চাই।

আমি কিন্তু এই এইখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম।

হাতে কী?

আমার হাতে! তোমার হাতে কী?

সে বলল : আল্লাহর উপহার, আব্বার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। তার চোখের অবস্থা খুব খারাপ কিনা। তুমি?

আল্লাহর উপহার, মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না : আমি বলি।

আকাশে হঠাৎ মেঘ জড়ো হতে হতে পুরো আকাশটাই মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। মেয়েটার হাসিহাসি মুখটা কিন্তু এই প্রায়ান্ধকারেও ম্লান হল না। ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত একটা মোমবাতির মতো সে যেন জ্বলছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। হালকা বৃষ্টি নয়, মুষলধারায় বৃষ্টি। চারদিক জলের পর্দায় ঝাপসা —যেন সমাজ, সভ্যতা, প্রকৃতি সব নাকাব পরে আছে।

মেয়েটা বলল, চলো মসজিদের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই।

মসজিদের কোন দিকে? ছেলেদের দিকটাতে নাকি মেয়েদের দিকটাতে? আমি জিগেস করি।

আমি ছেলেদের দিকে যাব না।

আমি মেয়েদের দিকে যাব না।

তাহলে চলো দুই দিকের মাঝখানে যে ওজুঘর আছে ওখানে গিয়ে দাঁড়াই : সে প্রস্তাব দিল।

হ্যাঁ, ওজুখানাই ভালো : আমি সম্মতি দিই।

জনহীন মসজিদ একটা কারখানার মতো। আমরা ওজুঘরে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, একটা প্রাণী আশেপাশে নেই, মসজিদের ফুলগাছগুলো বৃষ্টির আক্রমণে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দূরে ফটকটা এমনভাবে বন্ধ যেন আমরা একটা বিশাল দুর্গে আত্মগোপন করে আছি। শত্রুসৈন্যরা টের পেয়েও কাছে আসতে পারছে না। মেয়েটা মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে দিয়েছে। চুল ভিজে।

তুমি কি জানো যখন কোনো নারী পুরুষ নির্জনে থাকে তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হল শয়তান? আমি বলি।

শয়তান? এখানে? এ তো মসজিদ : সে আশ্বস্ত করে বলে।

কিন্তু ওজুখানার পাশেই তো ইস্তেঞ্জাঘর —শৌচাগার তো অপবিত্র। ওখানে তো শয়তান থাকতেই পারে আর আচমকা বেরিয়েও আসতে পারে আমাদের মাঝখানে।

তা তো ভেবে দেখিনি, তবে শুনেছি শয়তান ইবলিশ নাকি এক সময় ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। আদমকে সিজদা করেনি বলে আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয় : সে বলে।

তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?

তোমার কোন কথা বিশ্বাস করতে হবে? সে জানতে চাইলো।

আমি আমার মধ্যে শয়তানকে টের পাচ্ছি।

কীভাবে বুঝছো যে তোমার মধ্যে শয়তান এসে হাজির হয়েছে? মেয়েটা আবার জানতে চাইলো।

তোমার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি লজ্জিত মুখে বললাম।

সে বলল, আমারও তোমার হাত দুটো ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষের হাত ধরিনি। তবে হ্যাঁ, আব্বার হাত ধরেছি।

আমিও কোনো মেয়ের হাত ধরিনি আজ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, মায়ের হাত ধরেছি : আমি বলি।

যেভাবে বৃষ্টিটা আচমকা শুরু হয়েছিল সেভাবেই আচমকা থেমে গেল। রোদ বেরিয়ে পড়েছে। মেঘের পেটে যা জল ছিল সব যেন ঢালা হয়ে গেছে। মসজিদের ফুলগুলো রোদে নেচে উঠলো।

আমি আমার ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছি : মেয়েটা একটু দূরে সরে গিয়ে মাথায় ওড়না টেনে দিল।

কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে? কীভাবে পেলে? আমি জানতে চাই।

এই নাও দুটো লাল গোলাপ, এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম আব্বাকে দেব : পেছন দিক থেকে হাত ঘুরিয়ে সে গোলাপ দুটি আমার সামনে তুলে ধরল।

আমিও তোমাকে কয়েকটা গোলাপ দিতে চাই যেটা মাকে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে বললে না তো?

মেয়েটা ওজুঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বলল : আমি আমার মধ্যে এই পবিত্র জায়গায়ও শয়তানকে টের পেয়েছি।

শয়তানকে পেয়েছো তো, কিন্তু তুমি যে ফেরেশতার কথা বলছো?

সেও এক সময় ফেরেশতাই ছিল। যাইহোক, তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না।

এই বলে মেয়েটা মসজিদের ফটকের দিকে চলে গেল। তার দেওয়া গোলাপ দুটো হাতে ধরে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।

জিয়া হক