...........
আমি কামিয়াবি বলতে মনে করি জান্নাত। রোজ যে আমি গুনাহ থেকে পানাহ চাই, সে কি এই জন্য নয় যে আমার কাছে কামিয়াব সে যে জান্নাতি। আমি সংসার করব না বলছি না একবারও, কিন্তু সংসারের দাসত্ব আমি করতে পারব না।
মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনার যেখানে পায়রাদের বাসা সেই বাসায় জমানো দানা মুখে নিয়ে এক ঝাঁক পায়রা উড়ল পশ্চিম আকাশে। এবার মগরিবের আজান হবে। মসজিদে আসার এই ডাক আগে মাইকে হত না। তখন তো মাইক ছিল না। যখন গাড়ি তৈরি হয়নি মানুষ পশুর পিঠে চেপেছে, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে মাইলের পর মাইল। মুয়াজ্জেন গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। আকাশে মেঘ নেই।
ওজুখানা বলতে একটা মোটা পুরু দেয়াল। তার একদিকে মেয়েরা ওজু করে, অন্যদিকে ছেলেরা ওজু করে। দেয়ালটা এত উঁচু যে কেউ কারো মুখ দেখতে পাবে না। তবে জল পড়ার শব্দ, কাচের চুড়ির শব্দ শোনা যায়। মেয়েরাও নিশ্চয়ই ছেলেদের ওজুর শব্দ শোনে। ওজুর জল যেভাবে পাথরের উপর পড়ে তাতে একটা সঙ্গীত আছে। এই সঙ্গীত ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মগরিবের আজান শেষ হয়। আজান শেষ হলে তার জবাবে একটা দোয়া পাঠ করতে হয়। ঢাকা শহরের যে আজান রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় সেখানে আজানের পরে পরে মুয়াজ্জেন দোয়াটাও মাইকেই পড়ে দেন। মিশরের ক্বারী বাসিতের আজান যেন একটানা কান্না, যেন সামনে বড় বিপদ, যেন আজই এই মুহূর্তটুকুই আমাদের কাছে অবশিষ্ট আছে তারপর পৃথিবী ফানাহ। নামাজ একটা অনুষ্ঠান আর তার আহ্বায়ক হল যে আজান দেয়।
এই শহরের মহিলারা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে। তাদের জন্য আলাদা ঘর, ঠিক পাশের ঘরটা পুরুষদের। মেয়েদের ওদিক থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মসজিদটা আর সব মসজিদের মতোই খুব নিস্তব্ধ। শুধু নামাজের ওয়াক্তে একটা সংযত পরিশীলিত মেলার সুর ওঠে। ইমামের ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বাজে। জানালাগুলো নীল। গাঢ় নীল।
সবুজ আলখাল্লা পরা মেয়েটা ফটকের ওধারে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে মুখ পরিষ্কার দেখা যায় না। সবাই নামাজ পড়ে চলে গেছে। জোহরের নামাজের পর খাবার তাকাযা থাকে। মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা আগে নামাজ শেষ করে বাড়ি চলে যায়। কাজ থাকে। তারা নামাজে ফাঁকি দেয় তা কিন্তু নয়, তারা আসলে মসজিদকে কলতলা মনে করে না। ছেলেরা মসজিদে নামাজের আগে পরে যেটুকু সময় থাকে আড্ডা দিয়ে নেয়।
আমি তসবিহ গুনছিলাম। আঙুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের দানা। এই তসবিহটা খোদ সৌদি আরবের। একজন উপহার দিয়েছিলেন। আর দিয়েছিলেন এক শিশি আরবি আতর। সেটা কথা নয়, আমার মনে হচ্ছিল গোটা মসজিদগৃহে আমি আর মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই।
পর পর কয়েকদিন দেখলাম জোহরের নামাজের পরে মেয়েটা ফটকের লোহার শলাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না তা আমি জেনে গেছি। এই কয়দিনে আমি কাউকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার সঙ্গে যেতে দেখিনি। সে পুরুষদের মসজিদ কক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মাথা নীচু করে চলে যায়। আমি সেদিকে মাঝে মাঝে তাকাই আর তসবিহ গুণে যাই। যখন সুবহানআল্লাহ বলি তখন আল্লাহর উদ্দেশে বলি নাকি মেয়েটার সূদুর অস্তিত্বের সৌন্দর্যের জন্য বলি তা মনে থাকে না। মেয়েটা রোজ সবুজ আলখাল্লা পরে আসে।
আমি বললাম, আসসালাম আলাইকুম। একজন পুরুষ একজন অপরিচিত মহিলাকে সালাম দিতে পারে, হাত ধরতে পারে না।
সে চুপ করে রইলো। এতে সংকোচ কিসের! সালাম মানে কিন্তু আলাপ করার প্রস্তাবও নয় সব সময়। পিপীলিকার মতো এক ধরনের মৌখিক কানেক্টিভিটি শুধু। এতে আলাদা করে কোনো আবেগ বা ব্যক্তিগত অনুভূতি মেশানো নেই।
আরেকবার সালাম দেওয়ার পর মেয়েটা সলজ্জ ভাবে বলল, ওয়া আলাইকুম সালাম।
এতে লজ্জা পাবার কী আছে!
মেয়েটার বয়স বেশি নয় —একুশ বাইশ হবে। সুন্দর চেহারা। মুখে নাকাব নেই বলে পুরো মুখটাই দেখা যায়। চোখ রাঙানো। কালো কাজল সেই চোখে। ওজুর জলেও যা ধুয়ে যায় না।
তোমাকে এখানে রোজ জোহরের পর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, আমি বলি।
হ্যাঁ, আমি রোজ জোহরের পর এখানে এই একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি, সে বলে।
দূর থেকে মসজিদকে দেখতে খুব ভালো লাগে, তাই না?
সত্যি, মসজিদের ভেতর আর বাইরেটা কত আলাদা।
তার প্রাথমিক জড়তাটুকু কেটে গেছে। সালাম অনেক সময় অনেক কাজ সহজ করে দেয়।
আমি আবার বলি, তুমি কি শুধু, মানে শুধুই মসজিদকে দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকো?
সে বলল, অপেক্ষা করি।
কার অপেক্ষা?
ফেরেশতা আসে এই সময়ে। অধিকাংশ লোকেরই ধৈর্য্য নেই।
ঠিক, আমাদের ধৈর্য খুব কম।
আমি দেখেছি, যেখানেই যাই, খালি চলে যেতে পারলে, ফিরে আসতে পারলে যেন বাঁচি।
আমরা আমাদের বাড়িকে বেশি ভালোবাসি কিনা।
তাহলে মৃত্যুর পর কী হবে?
মেয়েটার লাবণ্য আছে তবে সেই লাবণ্য বড় বিষন্ন। আর এই মৃত্যুর কথা বলায় তার মুখের সাদা চামড়ার ওপরে যেন একটা মৃত পর্দার নাকাব চাপিয়ে দিল। যতটুকু পরিচয় হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি না, আজই, এখনই প্রথম দেখছি।
মেয়েটা চলে গেল মাথা নীচু করে। তার সবুজ আলখাল্লা বাতাসে পায়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে পাল তোলা নৌকার মতো তাকে গতিবেগ দিল যেন।
ছয় দিন পর ইমাম সাহেব বললেন, আপনি নাকি মসজিদের ভেতরে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন?
এই ছয় দিন রোজ দুপুরে জোহরের নামাজের পর মেয়েটার সঙ্গে গল্প করেছি। মেয়েটা ফটকের ওধারে, আমি এ ধারে। একদিন তার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। তার আঙুলগুলো করমর্দনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে যেন। সংযত করেছি নিজেকে। কেরামান - কাতিবিন আমার দুই কাঁধে বসে নেকি-বদীর তালিকা তৈরি করছে তো।
যদি মসজিদে এসে নিজের নফস, খাহেশাতকে সংযত করতে না পারেন তো কী হবে বলুন তো? ইমাম।
একটা সত্যি কথা বলব ইমাম সাহেব? নফস চাইছে ওর সঙ্গে শুয়ে পড়তে, কিন্তু,— কিন্তু দেখুন আমাকে কি ওর সঙ্গে শুতে দেখেছেন? সংযম আছে বলেই তো শুধু কথাটুকু বলি।
সেটাও না করাই উত্তম, বলে ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি জোহরের নামাজ শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলুম। এই ইমামকে আমার তেমন সহ্য হয় না। যদিও ইমামদের ভুল-ত্রুটি ধরা আমার মতো সাধারণ মানুষদের কাজ নয়। আলেম, উলেমারা আকাশের নক্ষত্র না হোক, উপগ্রহ তো বটে। এখন অমাবস্যা চলছে।
সুন্দর রোদ ঢেকে দিয়েছে মসজিদের মিনারগুলো। একটা দুটো পায়রা উড়ছে মিনারের ধারে ধারে। পুরনো গান ভেসে আসছে পাশের কোনো মহল্লা থেকে। সেই গান ছুঁয়ে যাচ্ছে মসজিদের সামনের ছোট একটুখানি জায়গায় চাষ করা ফুলের বাগানকে। পাতা, ফুল, কান্ড সব হালকা হাওয়া আর গানের ধাক্কায় দুলছে মৃদুমন্দ ভাবে।
মেয়েটাকে জিগেস করলাম : পেলে তোমার হারিয়ে যাওয়া ফেরেশতাকে?
সে ইতস্তত করে জবাব দিল : হারানো ফেরেশতা? কিন্তু আমার ফেরেশতা তো হারিয়ে যায়নি, আমি তাকে খুঁজছি মানে সে হারিয়ে গেছে তা নয়, হয়ত আমিই হারিয়ে গেছি আর সে প্রতিটা মসজিদের ফটকের সামনে জোহরের নামাজের পর আমার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে।
হ্যাঁ, কে যে হারিয়ে গেছে তা বলা মুশকিল, তবে কেউ একজন সন্ধান করছে মানে কেউ একজন হারিয়ে গেছে, হয়ত লুকিয়ে আছে : আমি বলি।
লুকিয়ে আছে? হবে হয়ত : ঈষৎ সন্দিগ্ধ ভাবে সে মাথা নেড়ে বলল। কাঁধ ঝাঁকালো।
আমি জিগেস করি : তুমি ফেরেশতাকে পেতে চাও, তাই তো, এতে কোনো ভুল নেই, আচ্ছা, ফেরেশতাকে পেলে তুমি কী করবে?
আমি শুধু তাকে পেতে চাই, পেলে কী করব এখনও ভেবে দেখিনি, হয়ত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, হয়ত বলতে পারি আমাকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে চলো : খুব উদাসীন মুখ করে মেয়েটা বলল।
বেশ কয়েকদিন কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা কেন বারবার মৃত্যুর কথা বলে, সে কেন এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চায়। তার আসলে পৃথিবীতে কেউ নেই আব্বা ছাড়া। তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না। তার ওজুর জলও মেয়েটাকে তুলে এনে দিতে হয়। মেয়েটা তাই একদিন বলেছিল, সে তার আব্বার জন্যে নতুন এক জোড়া চোখ উপহার চাইবে ফেরেশতার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে। আমি বলি, যখন চাইবে তখন বড় কিছু — স্থায়ী কিছু চাইবে না কেন? জান্নাত চাওয়া কি আরো ভালো নয়? সে বলে, তুমি আমার আব্বার কষ্ট দেখলে নিজের জন্যে জান্নাত চেয়ে পালিয়ে যেতে পারতে না।
পালিয়ে যাওয়া! এটা কি সত্যিই কাউকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া!
মেয়েটা আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তাতে আমার বেশ ভাল লাগে। মেয়েরা তুমি বললেই আমার মনে হয় আমরা যেন একটা ভালোবাসার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটার নাম জানি না। জিগেস করিনি। সেও আমার নাম জানতে চায়নি। নাম জিগেস করা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশাধিকার চাওয়ার মতো ব্যাপার। সন্ধ্যা বেলা আমাদের কখনও দেখা হয়নি।
আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? আমি বলি।
প্রশ্ন? যখন কেউ প্রশ্ন করার আগে অনুমতি চায় তখন বুঝতে হবে প্রশ্নটা বিশেষ। তো কি সেই বিশেষ প্রশ্ন? নিজে নিজে ব্যাখ্যা করে মেয়েটা।
হ্যাঁ, বিশেষ মনে করলেই বিশেষ। এটা পুরোপুরি মনে করার ব্যাপার। আসলে আমি তোমার নাম জানতে চাই : আমি বলি।
নাম? আমার নাম — মনে করো সবুজ পোশাক পরা মেয়েটা, এটাই আমার নাম, বা ধরো ফটকের ওধারের কন্যা, হ্যাঁ, এটাও একটা ভালো নাম হতে পারে আমার : সে এইভাবে বলল।
আমি খুব লজ্জা পেলাম। আমার হয়ত নাম জানতে চাওয়া উচিত হয়নি। কেউ আড়াল চাইতেই পারে। আমি কি এই কয়দিনে তাকে বড় আপন ভাবতে শুরু করেছি বলে সে ভাবল? আমার লজ্জা লাগল, ধরা পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক। মসজিদের ফুলগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে আনন্দ প্রকাশ করছে। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। ছায়া পড়েছে, রোদ নেই। আজ মঙ্গলবার।
দু দিন জোহরের নামাজে মসজিদে যাইনি।
শুক্রবার জুম্মার দিন। লোকের ভিড় অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। যারা কখনও নামাজে আসে না তারাও এই দিন আসে। পাপের ভয়? মাফের আশা? জানি না, তবে আসে। মসজিদ গমগম করে ওঠে। ধোয়া মোছা হয় মসজিদের ঘরগুলো। কাচা হয় কার্পেট, গালিচা, চাদর। পবিত্রতার গায়ে জল পড়লে আরও ঐশ্বরিক বলে মনে হয়। আমার নামাজে মন তেমন নেই। তসবিহ হাতে নেই, পাঞ্জাবির পকেটে রুমালের পাশে পড়ে আছে। আরবি আতর গায়ে। নামাজের অনুষ্ঠান কখন শেষ হয় তার অপেক্ষা করছিলুম।
গত দিন ইমাম সাহেব দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। ছ ফুট প্রায় লম্বা, সাদা জোব্বা পরা, পায়ে চামড়ার জুতো, হাতে তসবিহ, সব সময় জিকির করেন।
তিনি বললেন : মসজিদ একটা পবিত্র জায়গা।
মসজিদ নিঃসন্দেহে একটা পবিত্র জায়গা —স্থান বলা ভালো। হাদীসেই তো আছে, মসজিদ হল জান্নাতের টুকরো : বিনীত ভাবে আমি বলি।
সেই জান্নাতের টুকরোতে এমন কাজ আমাদের করা উচিত নয় যেটা অপবিত্র, নাজায়েজ।
হ্যাঁ, নাজায়েজ কাজ মসজিদ বাইরে অন্য জায়গায় করাই ভালো।
না, আমি তা বলিনি। নাজায়েজ কাজ কোথাও করাই ভালো নয়। আপনি আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আমি একটা মসজিদের ইমাম।
আপনি একটা মসজিদ শুধু নয়, বিশাল বড় মসজিদের শাহী ইমাম —আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সরকার আপনাকে মাসোহারা দেয় —এ যা-তা কথা নয়। আপনাকে আবারও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
তাঁর মুখমণ্ডল ভারি কঠিন হয়ে গেল।
আপনি হাদীস জানেন, একটু আগেই হাদীস বলছিলেন, না? তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়াকে সমর্থন করতেন না। ভেবে দেখেছেন যদি খারাপ কিছু একটা ঘটে যায়, পুরো সমাজটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তিনি মৃদু স্বরে বলে গেলেন।
হ্যাঁ, ওসমান গণি ইশার নামাজের পর রাতের অন্ধকারে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ভয় দেখিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর স্ত্রী আর মসজিদে যেতেন না, ভয় পেতেন : আমি বলি : মসজিদের সামনে ফুল চাষ করেন কেন?
তিনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যাওয়ার লোক নন। শুধু বললেন, ফুলগাছ আপনার জন্যে নাজায়েজ নয় আর আমি ধর্মের ভাষায় কথা বলি, সেটা আমার কাছে একটা সামাজিক সংবিধান। সে যদি মসজিদে যেতে কাউকে নিষেধ করার বিধান দিত তাহলে আমি বলতাম —আর মসজিদে যাবেন না।
হ্যাঁ, সংবিধান মানা খুব জরুরি। দেশের সংবিধানে যেমন ফাঁসি রয়েছে তেমন ধর্মের সংবিধানে আছে জাহান্নাম। খুব সিমিলার : বলি : আচ্ছা, পৃথিবীতে যার পৃথিবীর নিয়মে অপরাধের জন্যে ফাঁসি হয়েছে তার কি ধর্মের নিয়মেও জাহান্নমই হবে?
তিনি বিরক্ত হয়ে চলে যান।
জুম্মার নামাজের পর সবাই চলে গেছে। মসজিদ ফাঁকা। বাতাসের শব্দ শোনা যায়। কয়েকটা টকটকে লাল গোলাপ হাওয়ায় তির তির করে নৌকোর মতো কাঁপছে। দেখলাম, ফটকের ধারে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সে আজ মেরুন লাল একটা আলখাল্লা পরেছে। হাত দুটো পেছনে জড়ো করা।
মসজিদের ফুলবাগান থেকে কয়েকটা লাল গোলাপ তুলে হাতে করে পেছনে লুকিয়ে ফেললাম, তারপর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার মুখে আজ বিষন্নতা নেই, বেশ হাসিহাসি। তাকে মেরুন লাল পোশাকে একটা হুরের মতো লাগছে। হুর জান্নাতে না গেলে দেখা যায় না।
সে জিগেস করল : দু দিন কোথায় ছিলে?
তুমি কি ফেরেশতার দেখা পেয়েছো? আমি জানতে চাই।
আমি কিন্তু এই এইখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম।
হাতে কী?
আমার হাতে! তোমার হাতে কী?
সে বলল : আল্লাহর উপহার, আব্বার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। তার চোখের অবস্থা খুব খারাপ কিনা। তুমি?
আল্লাহর উপহার, মায়ের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি। মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না : আমি বলি।
আকাশে হঠাৎ মেঘ জড়ো হতে হতে পুরো আকাশটাই মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। মেয়েটার হাসিহাসি মুখটা কিন্তু এই প্রায়ান্ধকারেও ম্লান হল না। ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত একটা মোমবাতির মতো সে যেন জ্বলছে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। হালকা বৃষ্টি নয়, মুষলধারায় বৃষ্টি। চারদিক জলের পর্দায় ঝাপসা —যেন সমাজ, সভ্যতা, প্রকৃতি সব নাকাব পরে আছে।
মেয়েটা বলল, চলো মসজিদের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই।
মসজিদের কোন দিকে? ছেলেদের দিকটাতে নাকি মেয়েদের দিকটাতে? আমি জিগেস করি।
আমি ছেলেদের দিকে যাব না।
আমি মেয়েদের দিকে যাব না।
তাহলে চলো দুই দিকের মাঝখানে যে ওজুঘর আছে ওখানে গিয়ে দাঁড়াই : সে প্রস্তাব দিল।
হ্যাঁ, ওজুখানাই ভালো : আমি সম্মতি দিই।
জনহীন মসজিদ একটা কারখানার মতো। আমরা ওজুঘরে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, একটা প্রাণী আশেপাশে নেই, মসজিদের ফুলগাছগুলো বৃষ্টির আক্রমণে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দূরে ফটকটা এমনভাবে বন্ধ যেন আমরা একটা বিশাল দুর্গে আত্মগোপন করে আছি। শত্রুসৈন্যরা টের পেয়েও কাছে আসতে পারছে না। মেয়েটা মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে দিয়েছে। চুল ভিজে।
তুমি কি জানো যখন কোনো নারী পুরুষ নির্জনে থাকে তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হল শয়তান? আমি বলি।
শয়তান? এখানে? এ তো মসজিদ : সে আশ্বস্ত করে বলে।
কিন্তু ওজুখানার পাশেই তো ইস্তেঞ্জাঘর —শৌচাগার তো অপবিত্র। ওখানে তো শয়তান থাকতেই পারে আর আচমকা বেরিয়েও আসতে পারে আমাদের মাঝখানে।
তা তো ভেবে দেখিনি, তবে শুনেছি শয়তান ইবলিশ নাকি এক সময় ফেরেশতাদের সর্দার ছিল। আদমকে সিজদা করেনি বলে আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করে তাড়িয়ে দেয় : সে বলে।
তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?
তোমার কোন কথা বিশ্বাস করতে হবে? সে জানতে চাইলো।
আমি আমার মধ্যে শয়তানকে টের পাচ্ছি।
কীভাবে বুঝছো যে তোমার মধ্যে শয়তান এসে হাজির হয়েছে? মেয়েটা আবার জানতে চাইলো।
তোমার হাত দুটো ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি লজ্জিত মুখে বললাম।
সে বলল, আমারও তোমার হাত দুটো ধরতে ইচ্ছে করছে। আমি আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষের হাত ধরিনি। তবে হ্যাঁ, আব্বার হাত ধরেছি।
আমিও কোনো মেয়ের হাত ধরিনি আজ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, মায়ের হাত ধরেছি : আমি বলি।
যেভাবে বৃষ্টিটা আচমকা শুরু হয়েছিল সেভাবেই আচমকা থেমে গেল। রোদ বেরিয়ে পড়েছে। মেঘের পেটে যা জল ছিল সব যেন ঢালা হয়ে গেছে। মসজিদের ফুলগুলো রোদে নেচে উঠলো।
আমি আমার ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছি : মেয়েটা একটু দূরে সরে গিয়ে মাথায় ওড়না টেনে দিল।
কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে? কীভাবে পেলে? আমি জানতে চাই।
এই নাও দুটো লাল গোলাপ, এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম আব্বাকে দেব : পেছন দিক থেকে হাত ঘুরিয়ে সে গোলাপ দুটি আমার সামনে তুলে ধরল।
আমিও তোমাকে কয়েকটা গোলাপ দিতে চাই যেটা মাকে দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি কখন তোমার ফেরেশতাকে পেলে বললে না তো?
মেয়েটা ওজুঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর বলল : আমি আমার মধ্যে এই পবিত্র জায়গায়ও শয়তানকে টের পেয়েছি।
শয়তানকে পেয়েছো তো, কিন্তু তুমি যে ফেরেশতার কথা বলছো?
সেও এক সময় ফেরেশতাই ছিল। যাইহোক, তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না।
এই বলে মেয়েটা মসজিদের ফটকের দিকে চলে গেল। তার দেওয়া গোলাপ দুটো হাতে ধরে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।
জিয়া হক