ভারতীয় ইতিহাসবিদরা ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে’র মোকাবেলায় ব্যর্থ কেন? শোয়েব ড্যানিয়েল

ভারতে “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে”র বাড়বাড়ন্তের জন্য ইতিহাসবিদ উইলিয়ম ডালরিম্পল ভারতীয় ইতিহাসবেত্তাদেরকেই দায়ী করেছেন। ইতিহাসের ছদ্মবেশে ভুয়ো ব্যাখ্যা ছড়িয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্য (পড়ুন হিন্দুত্ববাদী) মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই কৌশলে। ডালরিম্পল বলেছেন, “আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, প্রায় ৫০-এর দশকের শুরু থেকে বর্তমান শতকের শুরু অবধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাসের যে চর্চা হয় তা শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং তাঁরা প্রায়শই এমন অস্পষ্ট ও ঝাপসা ভাষায় সাব অল্টার্ন বিদ্যা বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন যে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এর ফলে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস’ ও ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।” ভারতের পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদরা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই এমনটা ঘটছে। উইলিয়ম ডালরিম্পল ভারতীয় ঐতিহাসিকদের সমালোচনা করায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে না বা অনেকে স্বীকার করে নিয়েছেন তা হল—হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস। ভারতে আম আদমি সহজে ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়ায় এমন তীব্র সাংস্কৃতিক পরিণতি হয়েছে এবং ভুয়ো ইতিহাস তৈরি করা হচ্ছে ও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষেশ উদ্দেশ্যে। হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পিছনে এই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুয়ো ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডালরিম্পল উল্লেখ করেছেন, এই ছদ্ম ইতিহাস জেনে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির অস্তিত্ব ছিল, মহাভারতে পারমাণবিক বোমার ফর্মুলা রয়েছে এবং রামায়ণ হেলিকপ্টারের মতো আকাশযানের কথা বলেছে। তবে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক বিষয় হল, মধ্যযুগীয় ভারতের মুসলিম রাজা ও সম্রাটদের অত্যাচারী, নৃশংস ও কদর্য রূপে তুলে ধরা হচ্ছে। এই সম্রাটদের কয়েকজন মাত্র ধর্মীয় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সকল মুসলিম বাদশাহকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে এই ভার্চুয়াল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’। ভারতের শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে ডালরিম্পল যে মন্তব্য করেছেন তা সর্বৈব ভুল নয়। ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাসে’র এই তুমুল সাফল্যের আংশিক কারণ হল, গবেষণালব্ধ বিদ্যায়তনিক ইতিহাস সমাজের সব স্তরে পৌঁছায়নি। বরং ঐতিহাসিকদের একটা ছোট বৃত্তের মধ্যে এটা সব সময় আটকে গেছে। গবেষণার ফলে উঠে আসা প্রকৃত ইতিহাসের কাছে পৌঁছনো সাধারণ পাঠকের পক্ষে কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া, যে ভাষায় ও লব্জে বিদ্যায়তনিকে পাঠ্য ইতিহাস লেখা হয় তা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে এবং এ থেকে আন্দাজ করা যায়, ইতিহাস চর্চার ধারায় একটা বড় ঘাটতি বা সমস্যা রয়েছে। তবে, উইলিয়ম ডালরিম্পল সম্ভবত যেটা খেয়াল করতে ভুলে গেছেন তা হল, শুধুমাত্র ঐতিহাসিকদের দায়ী করা ঠিক নয়। হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থানের পিছনে রয়েছে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি। জনতার কাছে এই ইতিহাসের গ্রহণযোগ্যতা অনেক। তারা অনায়াসেই এগুলি বিশ্বাস করে ও অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয়। এর একটা কারণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেহরুর জমানায় এটা ঘটেনি। স্পষ্টতই সেই যুগের রাজনীতি এই ধরনের ভুয়ো ইতিহাসকে মদত দেয়নি, বরং গবেষণাভিত্তিক অ্যাকাডেমিক ভাষ্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন নিজেদের অন্ধ, গোঁড়া ও বিকৃত ভাষ্য, বয়ানকে প্রচার করতে দীর্ঘ সময়, প্রচেষ্টা ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এটা নিশ্চিত, বিদ্যায়তনিক ইতিহাসবিদরা যদি জনগণের সঙ্গে আরও বেশি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত থাকতেন তাহলে তাঁরা এই ভুয়ো ইতিহাসকে খানিকটা হলেও মোকাবেলা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা কি এটা পাল্টাতে পারতেন? সম্ভবত না। অনেকে মনে করেন, মানুষের কাছে পৌঁছনোর গুরুত্ব ও মূল্যকে বহু ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিহাসবিদদের উপস্থিতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রাজনৈতিক ভাষ্যের পাঁকভর্তি নর্দমা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করছেন তাঁরা। ট্যুইটার (বর্তমানে এক্স), ইউটিউব, এমনকি ইন্সটাগ্রামেও ব্যবহারকারীরা গবেষণা-ভিত্তিক ইতিহাস খুঁজছেন এবং তাঁরা আলোর সন্ধান পাচ্ছেন। এটা আশার দিক। তাহলে কি এই সব গবেষণাপুষ্ট ইতিহাসবিদরা হিন্দুত্ববাদী “ইতিহাস”কে পরাস্ত করতে বা সমকক্ষও হয়ে উঠতে পারবে? এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে বলা যায়, এ লড়াই অসম। “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস” এতখানি ভাইরাল যে এর সঙ্গে মোকাবেলা করা কঠিন। একদল স্বেচ্ছাসেবী এগুলি ছড়ায় এবং তাদের সেই ধারণা সহজে মানুষ গ্রহণ করে কারণ এতে তাদের বদ্ধমূল ধারণা আরও জোরালো হওয়ার সুযোগ পায়। তবে, এটাও গুরুত্বপূর্ণ, এই ইতিহাসবিদরা হারিয়ে যাননি, তাঁরা রয়েছেন এবং তাঁরা ভাল লড়াই দিচ্ছেন এই ভুয়ো ইতিহাসের প্রচারণার বিরুদ্ধে। রাজনীতি একটা লম্বা খেলা এবং প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার একমাত্র রাস্তা হল, রণক্ষেত্র থেকে সবাইকে হটিয়ে দেওয়া। নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধির জমানা থেকে হিন্দুত্ববাদী তাত্ত্বিকরা এটা খুব ভাল ভাবে বুঝতেন। কিন্তু কংগ্রেসের সেই যুগ তাঁদের জন্য অনুকূল ছিল না। বিদ্বেষপরায়ণ এই হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিপক্ষ যারা তাদের বইয়ের পাতা উল্টে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং জন পরিসরে তাদের উপস্থিতিকে টের পাইয়ে দিতে হবে। আজকের যুগে “হোয়াটসঅ্যাপ ইতিহাস” ও “হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়” আধিপত্য কায়েম করলেও এটা হেজেমনিক হয়ে উঠবে না এবং সাধারণ মানুষের জন্য পাল্টা যুক্তি যেন সব সময় হাজির থাকে ও সেই যুক্তি তারা যেন অনায়াসে লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করা দরকার।