গাহা: শুভদীপ মৈত্র


(একটি ক্রম বিবর্তনশীল কবিতা, যা লেখা হয়ে চলেছে এবং বদলে চলেছে আর তার বদলাতে থাকা চেহারা ব্লগে ফুটে উঠবে)


রাস্তাই এখন একমাত্র রাস্তা

ট্যাক্সির পেটের ভিতর থেকে দেখছি

জোনাকির মতো দপদপে পিছলে যাওয়া 

আলোকিত জানলাদের, আর হাওয়ার ঝাপটা 

আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিগত শতকে

এই হলুদ অ্যাম্বাস্যাডর ও তার বৃদ্ধ চালক 

সারথির মতো, অথবা টাইম মেশিন – 

শতবর্ষ আগের হুমায়ুন প্লেস অথবা লিন্ডসে থেকে

বালিগঞ্জের দিকে থ্রি-পিস স্যুট ও চুরুটে তরুণ 

বিভ্রান্ত যাতায়াতে – একটা পৃথিবী শেষ হচ্ছে 

আরেক নতুনের ঝাপসা অবয়বে সে বিমূঢ় 

এলিয়ট ও নাগরিকতার চর্চার শেষে পড়ে আছে

ঔপনিবেশিক অন্ধকার।


এভাবে আমিও দেখছি কনফেটির মতো আলো 

ছড়িয়ে পড়ছে সড়কের দু-পাশে। ফিরে যাচ্ছি।  

অথচ বাসার কোটর আমার জন্য নয়,

বই-পাড়া, ঐতিহ্যের সদাগরি 

মজ্জমান কলকাতা শহর ছেড়ে চলেছি

আশ্চর্য এই চার চাকার যানে।


২ 

শুধু একটা মূর্ছনার খোঁজে কবিতার কাছে আসা। 

অর্কেস্ট্রা 

অদৃশ্য কোনো কন্ডাকটরের হাতের ঈশারায় 

বেজে চলেছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে

এক কোষী প্রাণের স্পন্দন থেকে জটিলতম বিবর্তনে

সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে পর্বতের ঢেউয়ের গঠনে

দাবানলে, ঘনঘোর মৌসুমি বর্ষায়

কিশোরের শিশ্নে প্রথম চলকে ওঠা উত্তেজনায়

কিশোরীর বুকের বোঁটার প্রথম শিহরণে 

কবিদের কখনো না-লেখা সার্থক কবিতায়

সুর, মূর্ছনা, ছন্দ, স্পন্দন 

বেজে চলেছে অনিবার। 


শুধু এই মূর্ছনার খোঁজ দিতে পারলে

শয়তানের কাছে বন্ধক রাখা যেত আত্মাকে পাগানিনির মতো

অথবা সে সুরে পৌঁছলে,  বসন্তের শেষ কৃত্যে 

যেমন স্ট্রাভিনস্কি খেপিয়ে তোলেন সাধারণ্যের অভ্যস্ত কান

তাকে অবুঝ রাগে ধ্বংস করতে চায় সে জনতা

অসহনীয় তেমন সুন্দরের স্পর্শে শিউরে উঠি

মৃত্যুকেও সহজ মনে হয়।


 অথচ এর আভাসটুকু শুধু মধ্য চল্লিশে। 

১৪৩১ সন – বাতাসে বিষ, ঘৃণার উত্তাপ;

পাহাড় জঙ্গল হিমবাহ – দালির ঘড়ির মতো, 

ভয়ংকর বিকৃতিতে গলে পড়ছে, 

সংবিধান ও সংহিতা চরম নাস্তিতে বিলিয়মান,

অটুট স্বাস্থ্যের বদলে প্রাত্যহিক ছন্দপতনে 

শুকোচ্ছে আমের মুকুল। 

দরকচা দৈনন্দিনে অপার্থিব ভিনাস 

শরীর সর্বস্বতায় সামান্য স্ট্রিপার-সাজে 

নীল পর্দার মেটাচ্ছে খোরাকি,

ধর্ষকাম লালা ঝরাচ্ছে হাজারো জিভ

সুফির ‘মস্তি’ আজ ভোগীর পুংডন্ডে ঠেকেছে। 


হায়, সুর ও সোমরস... 

ইউনানি সাধনে শরীর ও মন, 

মননের উজ্জ্বল স্ফুরণে নাগরিক হতে চেয়েছিল

আদর্শ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটা ইঁট গাঁথার শুরুতে

ভাব ও বস্তুর স্বরূপের খোঁজ; 

সেখানেই সংগীত সেখানেই সংখ্যা,

আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়,

নীল ক্যাসিডির গাড়ি এসে থামে;

নাগরিক সংকীর্তন জ্যাজের আলাপে

বেজে ওঠে – হ্লাদিনী উন্মাদপারা

জাগরুক সে আজ মেটালের সুর বিস্তারে

পিনা বাউশ-এর পায়ের ছন্দে যেমন দেখেছি 

আবির্ভূত হন নটরাজ,

যেমন বিচ্ছেদ ও প্রেমে দ্বান্দ্বিক যাতায়াত

প্রলয়ের মাঝে সুন্দরের প্রকাশ – 

ত্রস্ত করে, প্রতি মুহূর্তে টানটান রাখে আমাদের৷ 

আমার জানলার নামানো কাঁচে

শহরের উচ্চতম বাড়ি পেরিয়ে, এখন  

ঠিকরে উঠছে ‘নক্ষত্রের রাত’ 

হলুদ ট্যাক্সির চালক গুনগুন করে উঠল 

বাবুল মোরা নৈহর ছুট যায়... 

আমি তাকিয়ে দেখলাম আকাশের তারাগুলো 

মরে যাচ্ছে একটা একটা করে। 



আমি একটা মন্ত্র-বর্জিত সুরের পিছু ধাওয়া করছি

পৌনঃপুনিকতায় যা আমাদের ভোঁতা করে দেয় না,

যেভাবে প্রত্যেক মুহূর্তে মেঘেরা আকাশের ক্যানভাসে 

নতুন বিন্যাস হয়ে ওঠে তার তলায় চলমান মানুষের 

স্রোতও বদলাতে থাকে – ক্যালাইডোস্কোপের মতো;

আমি শিকারির মতো নই, কাউবয়ও না, 

নেহাত ভুল করে বা গ্রহের ফেরে আনাড়ির বেওকুফিতে 

হলিউড ওয়েস্টার্নের সালোন গার্ল-এর টেবিলে উঠে নাচ 

আর পায়ের মলের শব্দে – সচকিত। 

               একটা নগ্ন মোলায়েম পা

ঘূর্ণিঝড়, দুলন্ত হ্যারিকেন, ক্যান্টনের আফিমের ঠেক

একই সঙ্গে ঝিম ও আলপিনের তীক্ষ্ণতা 

সার শরীরকে টার্ন-টেবলের মতো গীতিময় রাখছে। 

একটা টেবল ফ্যানের ফররাও কী ভাল 

বেসিনে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার শব্দ 

দুটো হুলো বেড়ালের টার্ফ-ওয়ার

লিখিত শব্দ বা ছাপা কবিতার থেকেও বাঙময়,

আমি স্বপ্ন দেখতে চাই না আর, বরং শুনতে চাই

শ্রুত স্বপ্নরা বেজে চলুক দিন রাত।  


সমস্ত মানুষের ঘুমের ভিতর থেকে উঠে আসা মন্তাজে 

সুর বসে যাচ্ছে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে;

হানাদারি ড্রোন মৌমাছির মতো গুঞ্জরণে উড়ছে,

কালো হাওয়ার ঝড়, হাওয়ায় আগুন আর বিষ

নিচে সরসর সরছে মাটি, তলিয়ে যাচ্ছে বসতি 

মাথার ভিতর যারা বুনেছিল সভ্যতা 

তাদের স্বপ্নের ভিতর ছায়া ফেলছে ধ্বংসবীজ,  

ফিলিস্তিন থেকে সবুজ-বাংলায়, তুষিত স্বর্গের বাগানে

ঘাতকের ই.ডি.এম বেজে চলেছে অনিবার 

ব্যাবিলনের, বাঘদাদের, লোথালের প্রতি রাতের খোয়াবে

স্বপ্ন-রাক্ষস এক শিশুদের নিয়ে যায় অগম দেশে।  


তবুও বৃষ্টির সামান্য দু-ফোঁটা আভাসে যেমন

জেগে ওঠে ঘাসের শিষেরা, সেভাবেই মানুষ ও মানুষীর 

প্রেমের আধো-বলা কথারা ভেসে উঠতেই দেখছি আরেক 

সুরের প্রতিরোধ, শত-শত নিলাজ শীৎকারের মধ্যে,

বন্ধুর হাতের স্পর্শের বিশ্বাসে – জেগে উঠছে কন্ট্রাপয়েন্ট,

শুধু শেষের কথা বোলো না আজ, 

           কিছু নতুন জন্মের কথাও শোনাও

                 নতুন বিন্যাসে জুড়ে যাবে মানুষেরা 

                       নিয়ে আসবে নবতম ম্যানিফেস্টো

সুরের মূর্ছনার ঘাত-প্রতিঘাতে আমরা পূর্ণতা পাব বলে। 


কোনো কিছুই বেসুরো লাগছে না তারিফ-অপ্রত্যাশী কানে,

শুনি নীলবসনা সুন্দরীর পিছু ধাওয়া করে দেবেন্দ্রবিজয়

না-কি দেবেন্দ্রবিজয়ের খোঁজে সে রহস্যময়ী?

ধরা দেবে কে কার কাছে জানা নেই অনক্ত বেলায়?

কেন-না রহস্য বস্তুটাই আসলে এরম

অনেকটা বাক্যের মতো, কবিতার থেকে টেনে আনলে 

যেমন অজস্র অর্থ আর অর্থহীনতার আলোছায়া,

তবুও দেবেন্দ্রবিজয় আছে, দাঁড়িয়ে ঈষৎ আড়ালে,

যেমন হামফ্রে বোগার্ট মলটিজ ফ্যালকনে স্থির – 

‘ব্রায়র পাইপ হাতে লোলচর্ম’ যাকে সে দেখে 

সেই জ্ঞানী-বৃষ, বেগুনী পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ও গরল 

গিলে ফেলে ছায়া ও ধোঁণার মেঘ নিয়ের ফেরে 

দেবেন্দ্রবিজয় তাই পারে না ঠাওড়াতে। 

দেবেন্দ্রবিজয় পুরনো পৃথিবীর সত্যান্বেষীদের মতো 

যুক্তিবাদে পোক্ত, তার্কিক, এককথায় 

রেনেসাঁস পুরুষের শেষতম খোঁয়াড়ি

সে জানে অবরোহী বা আরোহী কাঠামোয় ধাপেধাপে

পৌঁছনো যায় সিদ্ধান্তে, তারপর তাক লাগানো – এক্সপোজিশন। 

অথচ সে এই কবিতার ভিতর ঢুকে ক্লুহীন হয়েছে

ধোঁয়াটে পৃথিবীতে সে দেখছে 

               ক্রমশ প্রতিটা মানুষই তদন্ত সাপেক্ষ। 



এখনো তাদের ভাল লাগে শাদা পায়রার উড়াল

শারদ-নীল বিকেলের আকাশ যদি থাকে,

একখানা ডিঙি নৌকোর জল কেটে এগনো,

দু-হাতে দাঁড় টানা, অথবা কালাপোখরির পথে 

রাকস্যাক নামিয়ে পেঁজা-তুলো মেঘ মুঠো ভরে

বারান্দায় পা ছড়িয়ে শেষ শীতের রদ্দুর

ঝিম ধরা বৃষ্টিতে ওল্ড মংক রামে-ভেজা ঠোঁট

 - কিছু কিছু মানুষের মাথায় এসব দৃশ্য 

এখনো জন্ম নেয় বেগুনী জগতে, প্রযুক্তি যুগের

সুতানুটি শহরে বুঝি বিভ্রমের মতো

দিবাস্বপ্ন। নয়েজ। ভাইরাজ। এরর নম্বর ৩৫৭৯…

প্রচীন সারল্যের গোস্তাকি কেউ করে ফেলে

কে যেন ফিসফিউস করে বলে যায় 

ডিজিটাল শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই তার

এদেরই কি খুঁজে ফেরে জ্ঞানীবৃষ?

এদেরই কি খুঁজে ফেরে দেবেন্দ্রবিজয়? 


পূর্ব-পাঠ এই লিঙ্কে:

https://museumrural.blogspot.com/2024/05/blog-post.html?m=1